বিশ্ব–সমস্যা
উই, পিঁপড়ে, মৌমাছি, ভিমরুল প্রভৃতিও সমাজবদ্ধ জীব। কর্মে ও জীবিকায় এদেরও রয়েছে যৌথ জীবন। জলে-ডাঙায় এমনি আরো অনেক প্রাণী রয়েছে যারা সামাজিক ও যৌথ জীবনযাপন করে। এগুলো প্রাকৃত প্রাণী–স্বভাব বা সহজাত বৃত্তি-প্রবৃত্তির দ্বারা চালিত। এদের জীবনে রীতি-নীতি কিংবা পদ্ধতির পরিবর্তন নেই– ডারুইনকে মেনেও বলা চলে কয়েক হাজার বছরের মধ্যে অন্তত দৃষ্টিগ্রাহ্য কোনো পরিবর্তন হয়নি।
কিন্তু মানুষের জীবনেতিহাস অন্যরূপ। তার দৈহিক গঠন ও মানস সম্পদ তাকে প্রেরণা দিয়েছে প্রকৃতির আনুগত্য অস্বীকার করতে ও প্রকৃতির উপর স্বাধিকার বিস্তার করতে। তাই মানুষের প্রয়াস কৃত্রিম জীবন রচনার সাধনায় নিযুক্ত। প্রকৃতিকে জয় করার, প্রাকৃত সম্পদের উপযোগ সৃষ্টি করার সংগ্রামই মানুষের জীবন প্রচেষ্টার ইতিহাস। কাজেই মানুষের ইতিহাস–ক্রম পরিবর্তন, ক্রম আত্মবিস্তার ও ক্রমাগত এগিয়ে যাওয়ার ইতিকথা। অতএব মানুষের জীবনযাত্রায় ও চিন্তায় চিরস্থায়ী কিছু অসম্ভব, অনভিপ্রেত, এমনকি দুর্লক্ষণ। মানুষের এই অগ্রগতির আঞ্চলিক ও গোত্রীয় ধারায় দৈশিক-কালিক প্রতিবেশের প্রয়োজনে গড়ে উঠেছে সমাজ, ধর্ম, রাষ্ট্র প্রভৃতি যৌথ জীবনে আবশ্যক রীতি-নীতি-পদ্ধতি কিংবা আইন ও আদর্শ। পুরোনো যখন উপযোগ হারিয়েছে, জীর্ণপত্রের মতোই তা হয়েছে জীবন ধারণের পক্ষে অকেজো। তখন প্রয়োজনবুদ্ধি আবার সৃষ্টি করেছে নতুনতর রীতি-নীতি ও আদর্শ। এমনি করে লোকপ্রবাহ এগিয়ে এসেছে আজকের দিনে। এ তত্ত্ব বোঝে না কিংবা বুঝতে চায় না বলেই পাঁচ-সাত হাজার বছর আগের জীবন-চেতনা ও জীবন-রীতি যেমন সুলভ, আবার এই তত্ত্ব-সচেতন বলেই আজকের দিনে গ্রহলোক জয়কামী মানুষও দুর্লভ নয়। তাই মানুষের ইতিহাস পুরোনো চেতনা আর নতুন চিন্তার দ্বন্দ্ব-সংগ্রামের ইতিবৃত্তেরই নামান্তর। যেখানে পুরোনো চেতনা প্রবল, সেখানে অগ্রগতি ব্যাহত; যেখানে নতুন চিন্তা তীব্র ও আগ্রহ অমোঘ, সেখানে দ্বন্দ্ব-সংঘাত অতিক্রম করেই এগিয়েছে মানুষ। ঋতুবদল যেমন কালের পরিচায়ক ও পরিমাপক, তেমনি পাথেয় পরিবর্তনও চলমানতার লক্ষণ। শীত-বৃষ্টি রৌদ্রে যেমন পরিচ্ছদ ও আশ্রয় অভিন্ন নয়, তেমনি দেশ-কালভিত্তিক জীবনে দেশান্তর ও কালান্তর নতুন প্রয়োজন বোধের জন্ম দেয়। এ প্রয়োজনে সাড়া না দিলে জীবনে নেমে আসে বদ্ধতার বিকৃতি, অচলতার গ্লানি। প্রয়োজন-চেতনার অভাব কিংবা প্রয়োজন-অস্বীকৃতি জীবনের গতিশীলতা অস্বীকারের অপর নাম। মানুষের জীবন যে স্বরচিত এবং মানুষকে যে স্বশিক্ষিত হতেই হবে– এ বোধের অভাবেই অধিকাংশ মানুষ অচলতায় স্বস্তি খোঁজে–চিরন্তনতায় চায় আশ্বস্ত হতে। কিন্তু মানুষ যে সচল প্রাণী–জড়তা যে তার ধর্ম নয়–চলমানতাতেই যে তার জীবন-সত্য নিহিত, তা সে বুঝতে না চাইলেও প্রকৃতি আঘাত হেনে তাকে জানিয়ে দেয়। প্রকৃতির আঘাত আসে দুর্ভিক্ষ, মড়ক, দারিদ্র্য, অসততা, পীড়ন ও অপ্রেমরূপে। তখনই দেখা দেয় দ্বন্দ্ব, সংঘাত, বিদ্রোহ, পীড়ন, বিপ্লব ও সগ্রাম–আনে নতুন মতবাদ, নীতিবোধ, আদর্শ কিংবা ধৰ্মৰ্মত। এ জন্যেই যে স্থানিক প্রয়োজনে জরথুস্ত্রর কিংবা হযরত মুসা-ঈসা-বুদ্ধ-বর্ধমানের ধর্মমতের উদ্ভব, ও পরিবর্তিত পরিবেশে সে-প্রয়োজনের অবসানে স্বস্থানেই সেসব ধর্মমত হয়েছে বিলুপ্ত। আবার সে-সব ধর্ম দেশান্তরে গৃহীত হয়েছে বটে কিন্তু নতুন শক্তি হিসেবে সমাজে কিংবা মনে স্বদেশের মতো বিপ্লব ঘটায় নি। হযরত ইব্রাহিম থেকে মাও সে-তুঙ অবধি সবাই পুরোনো-দ্রোহী ও নতুনের প্রতিষ্ঠাতা।
মনের দিক দিয়ে মানুষ তিন শ্রেণীর এক শ্রেণীর লোক পথ চলে পথের দিশা খোঁজে, আর এক শ্রেণীর মানুষ গড়া-পথে বাহনে চলতে উৎসুক, আর তৃতীয় শ্রেণীর লোক চলতেই চায় না– তারা দোলনায় দুলে চলার আনন্দ পায়। প্রথম শ্রেণীর লোক দুর্লভ। দ্বিতীয় শ্রেণীর লোকও স্বল্প। তৃতীয় শ্রেণী দলে ভারী। তাই দীর্ঘকাল দ্বন্দ্ব-সংগ্রাম করে তাদের তাড়িয়ে নিতে হয় নতুন মঞ্জিলে। এ কারণে পৃথিবীর সবচেয়ে অগ্রসর সমাজও অতিক্রান্তকালের তুলনায় বেশি এগুতে পারেনি।
আত্মরক্ষা ও জীবিকা আহরণের প্রয়োজনে আদি যুগের মানুষ অনুভব করে সহযোগিতা ও সহ-অবস্থানের গরজ। তারই ফলে যে-সংহতিবোধ জাগে তার বহি:রূপ গোত্রীয় ঐক্য। এই গোত্রীয় সংহতি-চেতনা কালে ধর্মীয় ঐক্যবোধে রূপান্তর লাভ করে অভিন্ন মতবাদীর সাম্প্রদায়িক সংহতি গড়ে তোলে,–তারপরে তা রূপ নিয়েছে দৈশিক কিংবা রাষ্ট্রিক জাতীয়তায়। ইদানীং এ চেতনা রাজনৈতিক আদর্শ বা মত ভিত্তিক সম্প্রদায়ও গড়ে তুলছে। এ চেতনা কোনো কোন যুগে দেশ-কালের প্রয়োজন মিটিয়েছে, মানুষের সাময়িক কল্যাণ এনেছে। কিন্তু এ চেতনা মানুষকে চিরকাল অনুদার, অসহিষ্ণু, স্বার্থপর, হিংসুটে, অমানবিক ও দ্বপরায়ণ রেখেছে। এ হয়তো প্রাণীকে প্রাণ-ধর্মে নিষ্ঠ রাখে–জীবন-সংগ্রামে হয়তো হিংস্র বলিষ্ঠতাও দান করে, কিন্তু মানবিক গুণের বিকাশ সাধনে–উদার মানবতাবোধে দীক্ষা গ্রহণে সহায়তা করে না।
আঠারো শতক থেকে য়ুরোপীয় বিজ্ঞানবুদ্ধি ও জীবনচেতনা পৃথিবীকে দ্রুত এগিয়ে দিয়েছে– এ জন্যে আগে যে-মতাদর্শের উপযোগ থাকত হাজার বছর ব্যাপী–এ যুগে তা পঞ্চাশ বছরেই হয়ে পড়ে অকেজো। তাই যে-ধর্মমত মধ্যযুগ অবধি আঞ্চলিক মানুষের কল্যাণ এনেছে, তা আজ হয়ে উঠেছে মানব ও মানবতার দুশমন। যে-জাতীয়তাবোধ উনিশ-বিশ শতকে য়ুরোপীয় জীবনে আবে হায়াত রূপে প্রতিভাত-তা আজকের মানুষ ও মানবতার বড়ো শত্রু। যে-গণতন্ত্র ব্যক্তি মানুষের মুক্তি ও স্বাতন্ত্র স্বীকৃতির আদর্শ সংস্থা বলে অভিনন্দিত, সেখানেও মানুষ ধনবল ও বাহুবলের দাস; যে-সাম্যবাদ বা সমাজতন্ত্র চরম মানবতাবোধের পরম দান বলে পরিকীর্তিত, তাতেও মানুষের জীবন যতটা যান্ত্রিক ততটা মানবিক নয়। ব্যক্তি মাত্রই রাষ্ট্রকলের যন্ত্রাংশ কিংবা মজুর–সে যন্ত্র যারা ধনবলে বা বুদ্ধিবলে চালানোর অধিকার পায়, তারাই উপভোগ করে সাময়িক স্বাধীনতা ও স্বাতন্ত্র-আগের যুগে এ স্বাধীনতা ও স্বাতন্ত্র যেমনটি ছিল সম্রাট, শাসক ও সামন্তের। কাজেই পরিবর্তিত ব্যবস্থায়ও ব্যক্তি মানুষের মুক্তি আসেনি। কেউ পড়েছে ধনগত পীড়নের চাপে, কেউ রয়েছে দলগত নির্যাতনের তাপে। তাই বঞ্চিতজনের বিক্ষুব্ধ আত্মার চিৎকার ও দ্রোহ সর্বত্র বিরাজমান–আর্তনাদ আর সংগ্রামও কোথাও কোথাও দৃশ্যমান। বলতে গেলে সারা পৃথিবীর শাসিত মানুষ আজ Time Bomb-এর মতো–সুপ্ত আগ্নেয়গিরির মতো, অনুকূল পরিবেশে যোগ্য নেতৃত্বে সামান্য উত্তেজনায় জ্বলে উঠবে–নিজেরা পুড়বে আর পোড়াবে স্বীকৃত ও প্রতিষ্ঠিত সমাজ, ধর্ম, নীতি ও রাষ্ট্রব্যবস্থাকে। ধর্মীয় ঐক্য-চেতনার, মতবাদের অভিন্নতার কিংবা রাষ্ট্রিক জাতীয়তাবোধের ভিত্তিতে গড়া সরকারি ব্যবস্থা এখন আর মানুষের অভাব মোচন করতে কিংবা চাহিদা মেটাতে পারছে না। গোটা পৃথিবীর সমস্যা সমাধানের সামগ্রিক প্রয়াস-প্রসূত কোনো উপায় বের না হলে এর ইতি হবে না। সাধারণ মানুষ সমস্যাই কেবল অনুভব করে, সমাধানের উপায় জানে না। তাই এ দায়িত্ব চিন্তানায়ক, কর্মীপুরুষ ও শাসকগোষ্ঠীর। পৃথিবীর বহুদেশ আজ শিল্পায়িত ও শিল্পদ্রব্যে সমৃদ্ধ, অন্যগুলোও একই লক্ষ্যে অগ্রসরমান। তাই বাজার মন্দা। কাজেই অর্থনৈতিক সমস্যা আজ জাতীয় বা রাষ্ট্রীয় সমস্যা নয়- বিশ্ব-সমস্যা। ফলে এ সমস্যার সমাধান কোনো এক রাষ্ট্রের পক্ষে কখনো সম্ভব নয়। তাই ধর্ম, জাতীয়তা ও রাষ্ট্রিক স্বাতন্ত্রের বন্ধন-মুক্ত হয়ে একই মিলন-ময়দানে সব মানুষকে এসে দাঁড়াতে হবে। অসমানে একত্রিত হতে পারে বটে–কিন্তু মিলতে পারে না। কাজেই সাম্য ও সমদর্শিতার নীতিতে আস্থা রেখে লিলামুক্ত চিত্তে সদিচ্ছা নিয়ে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে মানবিক সমস্যার সমাধানে।
নইলে বাড়বে মানুষের অন্তর্দাহ-সংঘাত হবে তীব্র ও গভীর, সংগ্রাম হবে ব্যাপক ও আত্মধ্বংসী-ভাঙ্গার গানই শুনতে হবে সর্বত্র। তার লক্ষণও পষ্ট হয়ে উঠেছে নানা দেশে। বীট হিপ্পী আন্দোলন থেকে বর্ণাঙ্গা অবধি সব কিছুতে সেই বিষেরই বিস্ফোট দৃশ্যমান।
আধুনিক পরিভাষায় এই বিক্ষোভ-বিদ্রোহকে বলে শ্রেণী-সংগ্রাম কিংবা দলগত সংগ্রাম। যারা স্বার্থবাজ ধূর্ত আর যারা নির্বোধ তারা ক্রান্তিকালের যে কোনো বিক্ষোভ, বিদ্রোহ ও বিপর্যকে অবক্ষয় বলে আখ্যাত করে বিজ্ঞোচিত বিশ্লেষণ-সামর্থ্যে আত্মপ্রসাদ লাভ করে। সমাজে যেখানে একশ্রেণীর বিপর্যয়ে অন্যশ্রেণীর সুদিনের সূচনা করে, যেখানে দুই প্রতিপক্ষের সংগ্রামে এক পক্ষ কাহিল হয়, সেখানে দেশ বা জাতির জীবনে সামগ্রিক অবক্ষয় কোথায়? অতএব অবক্ষয় বলে কিছু যদি থাকেও তা শ্রেণীগতজাতিগত নয়।
জনসংখ্যা ও যন্ত্রশক্তির বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাড়বে মানুষের অভাব, প্রসারিত হবে প্রয়োজনবোধ, বিস্তৃত ও বিচিত্র হবে জীবনচেতনা, দেখা দেবে নতুন নতুন সমস্যা, জটিল হবে জীবনপদ্ধতি। সময়মতো সমাধান খুঁজে না পেলে জাগবে বিক্ষোভ ও বিদ্রোহ, আসবে বিপর্যয় ও বিশৃঙ্খলা, দেখা দেবে দ্বন্দ্ব ও সংঘাত, শুরু হবে সগ্রাম– একে অবক্ষয় বলা চলে না–এ তো চলমানতার অবশ্যম্ভাবী প্রসূন। জীবন থাকবে সচল আর প্রয়োজন থাকবে স্থির–একি কখনো হয়।
উপায় বের করতেই হবে–পুরোনো কখনো নতুন মানুষের প্রয়োজন মিটাতে পারে না। অতীত কখনো বর্তমানের চাহিদা পূরণ করতে সমর্থ নয়, তা-ই যদি হতো তাহলে তো নিত্য বর্তমানই থাকত কাল–তার না থাকতো অতীত, না থাকতো ভবিষ্যৎ–এমনকি এ কালভাগ থাকতো অকল্পনীয়।
তাই পরিহার করতে হবে অতীতের ধর্ম, সমাজ, রাষ্ট্রবোধ, পুরোনো ন্যায়-নীতি ও আদর্শ চেতনা। বাঁচার উপায় বের করতেই হবে–এমনকি তা যদি Flamingo-দের মতো আত্মহত্যার মাধ্যমেও করতে হয়, তাহলেও। বাঁচার তাগিদে আগেও কোনো প্রাণী মারতে বা মরতে দ্বিধা করেনি। আজো করবে না, বাঁচার জন্যেই আজো মানুষ মরতে ও মারতে প্রস্তুত। অন্ন ও আনন্দের ভারসাম্য চাই আজ। বাস্তব পন্থা অবলম্বন না করে হৃদয়বেদ্য মহৎ ও বৃহৎ বুলির চাতুরী দিয়ে ভোলানো যাবে না আজকের মানুষকে। এমনি বুলি শোনাইবে ব্যর্থ পরিহাস। আমাদের ভুললে চলবে না, যে বিজ্ঞান দর্শন, শিল্পকলা প্রভৃতির স্রষ্টা হলেও মানুষ প্রাণী–আর সব কিছুর স্থান জীবের জৈব চাহিদার পরে। Old order must change yeilding place to new.