বিশ্বের কেন্দ্রে একজন পুরুষ
তা বেশ কয়েকশো বছর আগে হিন্দু পন্ডিত রত্নাকর ব্রহ্মাচার্য ঘোষণা করেছিলেন জ্ঞান বলে কোনো বস্তু নেই। আসলে মানুষ কিছুই শেখে না। শেখা যায় না। চারপাশের বিশ্বজগতে সমস্ত কিছুই ঘটনা, ঘটে যাচ্ছে। তার কিছু কিছু দেখে-শুনে কেউ কেউ চ্যাঁচাচ্ছে, আমি এই দেখেছি, আমি এই জানালাম।
ব্রহ্মাচার্যের শিষ্যকুল গুরুর এই সমস্ত বাতুল কথা শুনে হতাশ হয়ে পড়ল। অন্যান্য জ্ঞানপীঠের পড়ুয়াদের সঙ্গে এবার ওদের কথা বলাই দুষ্কর হবে। পাঠশালার সামান্য ছাত্ররাও জানে—দেখা, শোনা, বিশ্বাস করা, এসমস্ত থেকেই জ্ঞানের উৎপত্তি। প্রতিটি মানুষ তার সীমার মধ্যে কিছু না কিছু জানছে প্রতিনিয়ত। আর ব্রহ্মাচার্য বলেন কিনা জ্ঞান বলে কোনো বস্তু নেই। আরে এতশত যে দিনরাত ঘটছে চোখের সামনে সেও তত জ্ঞানের বিষয়।
কেউ কিন্তু সে-সময় ব্রহ্মাচার্যের আসল যন্ত্রণাটুকু বুঝতে পারেনি। বোঝা সম্ভবও ছিল না। ব্ৰহ্মাচার্য বিশাল ব্রহ্মান্ড এবং গভীর গহন মনোজগতের কথা ভেবে নিরাশ হয়ে পড়েছিলেন। শিষ্য রেবন্তকে বলেছিলেন, অমরু এক জীবনে নারী এবং অপর জীবনে পুরুষ হয়ে প্রেমের আগে-পিছের কিছু ঘটনা দেখলেন। উভয় লিঙ্গের জীবনে সংগমের বেদনা হয়ত কিছু অনুভব করলেন। কিন্তু আরেক পদ এগিয়ে গিয়ে প্রশ্ন করলে অমরু নীরব। তাহলে তুমি শেষ অবধি জানলেটা কী?
নববিবাহিত যুবক রেবন্ত চুপই রইল। ইদানীং সে বড়ো পড়াশুনায় ব্যস্ত। স্ত্রী কল্যাণীর প্রতি খুব একটা খেয়াল দিতে পারে না। কানাঘুষো শোনে ব্রহ্মাচার্যের ফাঁকিবাজ শিষ্য বীরেন্দ্রের প্রতি তার নাকি অনুরাগ জন্মেছে। গোধূলি লগ্নে ওরা নাকি দেখাসাক্ষাৎ করে সরস্বতী নদীর ধারটায়।
একদিন রেবন্ত নিজেকেও প্রশ্ন করেছে, আমার কি কোনো ভালোবাসা নেই?
ব্রহ্মাচার্যের দ্বিতীয় চিন্তাটা বড়োই ভয়ংকর। এই বিশাল বিশ্বজগতের কোনো কেন্দ্রবিন্দু আছে কিনা জানার উপায় কী? অঙ্কশাস্ত্রও যদি তার হদিশ না দেয় তবে জ্ঞানের মূল্যই বা কী?
আমরা যারা বড়ই আধুনিক এবং বড়ই জ্ঞানী, জানি শয়ে-শয়ে বছর ধরে এই প্রশ্ন তোলপাড় করেছে পাশ্চাত্যের চিন্তাকে। বিশ্বজগতের কেন্দ্র নিয়ে চিন্তার একটা বিরাট ইতিহাস সেখানে আছে। অবশেষে একটা চমৎকার বাক্যে মহাজ্ঞানী পাস্কাল বিষয়টিকে বর্ণনা করেছিলেন। বললেন, এই ভয়াবহ বিশ্বের কেন্দ্র সর্বত্র, কিন্তু তার পরিধি কোথাও নেই। পাস্কাল তাঁর সেই অনুপম বাক্যে ভয়াবহ কথাটা কিন্তু বেশ জোরের সঙ্গে ব্যবহার করেছিলেন। বিস্ময়ও যেখানে পৌঁছোয় না তা নিশ্চয়ই ভয়াবহ।
ব্ৰহ্মাচার্য যৌবনে একবার কাশীর পন্ডিত ভবাদিত্যের কাছে শুনেছিলেন যেকোনো বিশেষ কালের শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী পুরুষের নাভিমূলই সেই বিশেষ সময়ের বিশ্বের কেন্দ্র। এ ব্যাপারে অবশ্য ভবাদিত্যের মতানৈক্য ছিল কাঞ্চী প্রদেশের পন্ডিত আগ্লালুর সঙ্গে। যিনি বলতেন, কোনো বিশেষ কালের বিশ্বকেন্দ্র সে-সময়ের শ্রেষ্ঠ রূপসীর যোনিতে। ব্রহ্মাচার্য ম্লানচিত্তে সে-সমস্ত শুনেছেন। কিন্তু কিছুই জানেননি। তবে জনশ্রুতি আছে আগ্লালুর শিষ্য চেল প্রদেশের যুবরাজ বিশ্বের কেন্দ্র আবিষ্কার করার মানসে অন্তত একশো পরম রূপসী যুবতীর সতীচ্ছেদ করেন। এবং শেষপর্যন্ত পোর্তুগিজ জলদস্যু গোলায়ার শরীরে সে-কেন্দ্র খুঁজে পান। কিন্তু এ মতটুকুর সপক্ষে বলার কিছুই নেই কারণ কোচিনের অদূরে নোঙর করা গোলায়ার জাহাজ থেকে যুবরাজ জীবিত ফেরেননি। অষ্টাদশ শতকে গোলায়ার স্মৃতিকথা যখন পিয়ের লুইয়ের হাতে ফরাসিতে অনূদিত হয় তখনই কেবল পৃথিবীর লোক জানতে পারে গোলায়ার জীবনের প্রথম এবং শেষ সংগম ভারতীয় এক যুবরাজের সঙ্গে। যার পুরুষাঙ্গ এবং জিহ্বা ছিল অসম্ভব রকম দীর্ঘ। সে-যুবরাজ আচমকা বজ্রাঘাতে মারা যান সোলায়ার জাহাজ থেকে নিজের রণতরীতে ফিরে যেতে যেতে।
প্রৌঢ় বয়সে ব্রহ্মাচার্য ফের ভাবতে বসলেন বিশ্বব্রহ্মান্ড এবং জীবের যৌনজগতের আণবিক কোনো সম্পর্ক আছে কি নেই। পঠনপাঠন তাঁর গোল্লায় গেল, ছাত্রদের আশ্রম থেকে মেরে তাড়াতে লাগলেন। সতী স্ত্রী সুধাবতীকে অহর্নিশি উলঙ্গ করে দেখতে লাগলেন নারীর দেহ আসলে কী?
ব্ৰহ্মাচার্যের একটা চমৎকার পাথর ছিল। যার সহস্র কোণ দিয়ে আলো ঠিকরে পড়ে ঘর আলো করত। সম্ভবত জীবনের এই সময়টায় ব্রহ্মাচার্য আলোর বিশ্লেষণ নিয়েও ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। রেবন্তের ‘গুরুচরিত’-এ উল্লেখ আছে ব্রহ্মাচার্য ওই আলোক প্রস্তর দিয়ে সুধাবতী এবং যুবতী কন্যা সুদক্ষিণার যোনি অধ্যয়ন করতেন। স্ত্রী কন্যা উভয়েরই আপত্তি ছিল এই বীভৎস পরীক্ষানিরীক্ষায়। কিন্তু কট্টর শাস্ত্রজ্ঞ ব্রহ্মাচার্য মেয়ে লোকের আপত্তি শুনতেন না।
ঠিক এই সময় কাশীর রাজা যখন ব্রহ্মাচার্যকে উপঢৌকন পাঠানোর প্রস্তাব দেন, ব্রহ্মাচার্য দশটি কুমারী প্রার্থনা করেন। বিরক্ত এবং বীতশ্রদ্ধ কাশীরাজ এরপর পন্ডিতের মুখদর্শন অবধি বন্ধ করে দিয়েছিলেন।
দিকে দিকে রটে গেল রত্নাকর ব্রহ্মাচার্য পাগল। কেউ কেউ বলল সেয়ানা পাগল। কেউ কেউ বলল বদমায়েশ। দেখতে দেখতে ব্রহ্মাচার্যের আশ্রম বন্ধ হয়ে যায়। একমাত্র পড়ে রইল রেবন্ত। ঘরে স্ত্রী কল্যাণী ততদিনে পালিয়ে গিয়েছে দুষ্ট বীরেন্দ্রর সঙ্গে। ব্রহ্মাচার্য দিনরাত ধ্যান করেন, স্ত্রী কন্যা ঘাঁটেন আর মনে যা আসে তাই লেখেন। গুরুকে নিয়ে জীবনচরিত লেখে রেবম্ভ, অতিরিক্ত কামতাড়িত হলে সহবাস করে সুদক্ষিণার সঙ্গে।
ব্রহ্মাচার্যের সেইসব এলোমেলো লেখা ভারতীয় শাস্ত্রে বা সাহিত্যে অদ্বিতীয়। পাস্কালের ‘পাঁজে’ দেকার্তের ‘ডিসকোর্স অন মেথড’ কিংবা এক বিশেষ অর্থে নিৎসের ‘বিষণ্ড গুড অ্যাণ্ড ইভল’-এর সঙ্গেই তার তুলনা চলে। বহু আধ্যাত্মিক এবং বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের সূত্র এবং আলোচনা তাতে আছে, যদিও কোনোটারই কোনো উত্তরোত্তর বিশ্লেষণ, ব্যাখ্যা বা উত্তরণ নেই, কারণ ব্রহ্মাচার্য ধরেই নিয়েছিলেন মানুষ কিছুই জানতে পারে না। জানা সম্ভব না। শুদ্ধ বুদ্ধিসম্পন্ন লোকেরা এক-একটা জটিল সমস্যা দিয়ে নিজেদের বুদ করে রাখেন, কারণ সেটা একটা মস্ত খেলা। সমস্ত ক্রীড়ার শিরোমণি, অনুসন্ধান।
ব্রহ্মাচার্য তাঁর সেই এলোমেলো কড়চার নাম দিয়েছিলেন ‘অনুসন্ধান ক্রীড়া। কিংবা এ নাম হয়তো তাঁর মৃত্যুর পর রেবন্তরই দেওয়া। কিন্তু নামটা ভারি আশ্চর্য রকমে সংগত, এবং আধুনিক। সংগত কারণ সমস্ত লেখাটাই খেলার ছলে। আধুনিক, কেবল ভাবনার চাকচিক্যেই নয় রসেও। অনুসন্ধান ক্রীড়া’ বই-এ যৌনসংগমের তেরোটা প্রতিবেদন আছে যা বোকাচ্চিও, আরেতিনো বা কাসানেভাকে মুগ্ধ করতে পারত। অথচ এই তেরোটা বিবরণই ব্রহ্মাচার্য তাঁর এবং সুধাবতীর ক্রিয়াকান্ড থেকে ফলিয়েছেন। হালকা রসের এই শিখর থেকে কী করে আমাদের ঈশ্বর গুপ্তে পতন হল তা ভাবতেও অবাক লাগে।
‘অনুসন্ধান ক্রীড়া’ কিন্তু শেষপর্যন্ত সবচেয়ে নিকট হয়ে পড়ে গোগোলের ‘ডায়েরি অব এ ম্যাড ম্যান’-এর। কড়চার অন্তভাগের উনত্রিশটা বয়ানে ব্রহ্মাচার্যের উন্মাদনা স্পষ্ট। ব্রহ্মাচার্য স্থানে স্থানে সুধামতীকে মা ডাকছেন। শিশু হয়ে ফিরে যেতে চাইছেন ওঁর যোনিতে। গভীর বিশ্বাস জাগছে আসলে তিনিই কাশীরাজ বৈকুণ্ঠনাথ। চক্রান্তের বশে আজ তিনি ব্রাহ্মণ পন্ডিত আর পিরিলাল কাহার নামের পথেও ভিখারিটি রাজা।
ব্রহ্মাচার্য নিজের দাবির সপক্ষে খাড়া করেছেন তিনটি যুক্তি। এক, তাঁর রাজকীয় হস্তরেখা। দুই, একটা স্বপ্ন। তিন, একটা স্মৃতি। সে-স্মৃতিতে আছে কুমার রত্নাকর একটা বাঁকানো চাকু দিয়ে তাঁর আটজন পূর্বপুরুষের সুন্দর সুন্দর ছবিগুলি কেটে কেটে তছনছ করছেন। কিন্তু নবম পুরুষ, মানে নিজের ছবির সামনে এসে থমকে দাঁড়াচ্ছেন। ছবিটা ওঁর না। বৈকুণ্ঠনাথের!
ভাগ্যিস এ লেখার খাতায় বৈকুণ্ঠনাথের হাত পড়েনি। নিশ্চিত বেঘোরে প্রাণ যেত ব্ৰহ্মাচার্যের। কিন্তু তা বলে ব্রহ্মাচার্যের মৃত্যুটা কম অদ্ভুত নয়। সেটা আমরা জানতে পারি রেবন্তের লেখায়। ব্রহ্মাচার্য একটা মারণাস্ত্র আবিষ্কারের কথা লিখেছেন যাতে ঘাতক নিপীড়িতের সমস্ত যন্ত্রণা অর্ধেক কল্পনা এবং অর্ধেক অঙ্কের বলে হিসেব করতে পারেন। যন্ত্রণা দেওয়াটাও যে একটা বিশেষ শিল্প এই যন্ত্রের পরিকল্পনা তা প্রমাণ করে। ব্রহ্মাচার্য লিখেছেন, সংগমক্রিয়া যেমন একই সঙ্গে নর এবং নারীকে তৃপ্তি দেয় এই যন্ত্র একই দুর্ভোগে আবদ্ধ করবে ঘাতক এবং নিপীড়িতকে। উপরন্তু ঘাতক পল পল অনুভব করতে পারবেন তাঁর নিপীড়িতের যন্ত্রণা।
এই যন্ত্রণা কলের একটি বিশেষ অংশ ছিল রেবন্তের মতে ওই সহস্রকোণ পাথরটা। কিছু পাথুরে আয়নার কথাও লেখা আছে। তবে সবচেয়ে গুরুত্ব যেহেতু দেওয়া হয়েছে ঘাতকের মানসিকতাকে আমরা ধরে নিতে পারি ব্রহ্মাচার্য উল্লেখিত এই নিপীড়ন মূলত মানসিক। অনুমানটা আরো জোর পায় এই কারণে যে, এই যন্ত্রের প্রথম এবং শেষ বলি ছিলেন সুধাবতী যাঁর সঙ্গে ব্রহ্মাচার্যের প্রেমদ্বেষের সম্পর্কের ইঙ্গিত আমরা রেবন্তের লেখার বহু ক্ষেত্রেই পেয়েছি।
ব্রহ্মাচার্যের মৃত্যু হয় রেবন্তের হাতে। একথা রেবন্ত নিজেই কবুল করেছে তার ‘গুরুচরিত’-এ। সে-অংশের কিছুটা হালফিলে অনুবাদ আমরা এই সুযোগে পড়ে নিতে পারি।
‘গেল তিন দিন যাবৎ গুরুদেবের বিটলেমি চরমে উঠেছে। অকথ্য গালিগালাজ এবং ননাংরামি ওঁর স্বভাবে দাঁড়িয়েছে। কিছু না খেয়েও লোকটা এত পায়খানা করেন কী করে? তবে এটা এখন সুনিশ্চিত যে, গুরুদেব নির্ভেজাল মহাপুরুষ। উনি নিজের ভাবনার কোনো ছায়াপাত করতে চান না পরবর্তীকালের চিন্তার ওপর। ওঁকে এই অবসরে স্তব্ধ বা হত্যা না করলে অচিরেই ‘অনুসন্ধান ক্রীড়া চেলা কাঠের উনুনের কাজে যাবে। ভবিষ্যতের মানুষের কথা ভেবে ইদানীং আমি গুরুদেবের প্রাণ হরণের কথা চিন্তা করতে বসেছি।
তবে এখানেও একটা সমস্যা থেকে যায়। গুরুদেব হয়তো এখনই কোনো মহৎ আবিষ্কারের দোরগোড়ায় এসে পৌঁছেছেন। সে-আবিষ্কারের কিছু মৌলতত্ত্ব হাতে না আসা অবধি কাজটা বোধ হয় ঠিক হবে না। তা ছাড়া গুরুদেব বেঁচে না থাকলে গুরুমাতা এবং সুদক্ষিণার সংসারভার আমার ওপরই বর্তাবে। কোনোরকম বৈজ্ঞানিক কি দার্শনিক তত্ত্বের মূলধন হাতে না থাকলে আমার মতো অপদার্থের পক্ষে এই দায়ভার মেটানো মুশকিল। অগত্যা আরও কিছুদিন অপেক্ষা করব বলেই স্থির করলাম অপদার্থ রেবন্ত এই লেখার পর বেশ কিছুকাল অপেক্ষায় ছিল। ব্রহ্মাচার্যের মতিগতির হালচাল দেখতে দেখতে সময় কাটছিল ওর। অবশেষে ও বিরক্ত হয়ে যায় গুরুর চরিত্রের একটা অস্বাভাবিক ব্যতিক্রম দেখে। নিপীড়ন যন্ত্র সৃষ্টি করতে করতে গুরু হঠাৎ পদ্য লিখতে বসলেন কেন? যে পদ্য কিনা প্রথাসিদ্ধ কাব্যের যোজন দূর থেকে চলে যায়। কালিদাস, অমরু শ্রীভতৃহরি এসমস্ত সৃষ্টি দেখলে মূৰ্ছা যেতেন। এতে পবিত্র সংস্কৃত ভাষার শ্রাদ্ধকর্ম হচ্ছে।
সম্ভবত ব্রহ্মাচার্যের কবিতা দ্বারা নিপীড়িত হয়েই রেবন্ত গুরুকে হত্যা করে। মূঢ় রেবন্ত সেদিন বুঝতেও পারেনি। ব্রহ্মাচার্যের নিপীড়ন যন্ত্রের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম পরিশীলন ছিল এই কবিতা। সংস্কৃত কাব্যরীতির সমস্ত প্রকরণকে বর্জন করে রত্নাকর ব্রহ্মাচার্য একটা সহজ, গম্ভীর এবং গভীর কবিতার দিকে এগোচ্ছিলেন। প্রতিটি পঙক্তি সেখানে মন্ত্রের মতো সংযত এবং দৃপ্ত। প্রতিটি ভাগ দুঃখ, বেদনা এবং ঈশ্বর তথা জীবনজিজ্ঞাসায় সম্পৃক্ত। একটা মহৎ বৃত্ত যেন সম্পূর্ণ হতে চলেছে। ব্রহ্মাচার্য যেন আভাস পাচ্ছেন একটা মহান অস্তিত্ব এবং সংসারের। তিনি পুনরায় বিশ্বাস করতে চলেছেন জ্ঞান বলে একটি বিশেষ অর্থে কিছু আছে। জ্ঞান বলে তখনই কিছু থাকে যখন জ্ঞাতব্য বিষয় হল স্বয়ং ঈশ্বর কিংবা ঈশ্বরপ্রতিম কোনো দ্বন্দ্ব, কোনো সংশয়, কোনো তিতিক্ষা। রত্নাকর ব্রহ্মাচার্য এক অর্থে জ্ঞান বিষয়টিতে একটা মাত্র যোগ করতে চলেছিলেন। তার্কিকরা যখন ধরেই নিয়েছিলেন জ্ঞান হল কোনো বিষয় সম্পর্কে ধারণা, যা দেখা, শোনা, বিশ্বাসের ওপর দাঁড়িয়ে, ব্রহ্মাচার্য জাহির করতে উদ্যত হলেন, না-জানার সংশয় থেকেই জ্ঞানের সূত্রপাত। জ্ঞান ততক্ষণই যতক্ষণ জানার চেষ্টার মধ্যে যন্ত্রণা, দহন এবং সমর্পণ আছে।
কাজে কাজেই আমরা বড়ো একটা আশ্চর্য হতে পারি না যখন জানি ব্রহ্মাচার্য তাঁর কবিতাগুলি লিখেছিলেন তাঁর নিজের রক্তে। রোজ ভোরে তিনি ছুঁচ দিয়ে বুকের একটা অংশ থেকে রক্ত বার করতেন। টপটপ করে সে-রক্ত নিকোনো মাটিতে পড়ে জমাট হত, পরে খাগের কলমে জল ছুঁইয়ে চুঁইয়ে জমাট রক্ত তরল করে পদ্য লিখতেন। অতিনাটকীয় এই পদ্য লেখার পদ্ধতি কিন্তু আমরা ক্ষমা করে দিই যখন আসল পদ্যগুলি পড়ি। একেবারে অব্যর্থভাবে তখন মনে আসে ফের একজন পাশ্চাত্য পুরুষকে। রিল্কে এবং তাঁর দুয়িনো কবিতাগুলি। রত্নাকর ব্রহ্মাচার্যেরও সেই প্রশ্ন, জীবন কী এই একটা? দ্রুত এবং নশ্বর এই জীবন অনন্তের রূপরেখায় কি বদলাতে পারে? এই একটিমাত্র যাওয়া এবং আসার ইতিহাস কি মোছা যায়? দেবদূত দেখতে চাইলে কী দেখাতে পারে তাঁকে মর্ত্যজন? সাধারণ, নিয়মিত জীবনও এত বিস্ময়কর কেন? মৃত্যুই কি অতঃপর সমস্ত শুরুর শেষ? ব্রহ্মাচার্য একটা আধুনিক নামও দিয়েছিলেন এই কড়চা অঙ্গের কবিতাগুলির। রোজ রোজ লেখা কবিতা।
ব্রহ্মাচার্যকে হত্যা করার পর রেব যত্ন করে অনুসন্ধান ক্রীড়া’-র পান্ডুলিপি নিজের কাছে রেখেছিল। কিন্তু কয়েকটা পদ্য ছাড়া ব্রহ্মাচার্যের কবিতাগুলি সে নষ্ট করে ফেলে। যে দুটো একটা আমরা এখন পড়তে পাই তা সুদক্ষিণার কোমরবন্ধে লুকোনো ছিল বলে রক্ষা পেয়ে যায়। টীকাকারদের মতে সে-সমস্ত প্রেমের কবিতা ব্রহ্মাচার্য সুদক্ষিণাকে লিখেছিলেন। এইসব টীকাকারদের আরও একটা মত আছে। সুদক্ষিণার ভালোবাসা নিয়েই ব্রহ্মাচার্য এবং রেবন্তর মধ্যে আদত ঝগড়া। রেবন্ত যখন আবিষ্কার করল সুদক্ষিণার অনুরাগ দিন দিন পিতার দিকে ঘুরে যাচ্ছে তখনই সে অধৈর্য হয়ে উভয়কে এক সন্ধ্যায় কুড়োল দিয়ে ছিন্নভিন্ন করে। এবং পৃথিবীকে উলটো বোঝানোর জন্যে তার ‘গুরুচরিত’-এ একটা অন্য বিবরণ খাড়া করে।
‘আজ সকালে যখন গুরুদেব স্নান সারতে সরস্বতীর দিকে যান আমি তাঁর পিছন পিছন গেলাম। তিনি যখন উলঙ্গ হয়ে জলে নামলেন আমি এক মুহূর্তের জন্য চমকে গেলাম। ওঁর যৌনাঙ্গ অসম্ভব দীর্ঘ। উনি যখন আচমন করলেন আমি একটা ভয়ংকর দৃশ্য দেখলাম। ওঁর জিহ্বাও অমানুষিক লম্বা। কিন্তু ওই জিহ্বা তো আগে আমার এত বড়ো ঠেকেনি। তাহলে কোনো সূত্রে ইনিই কি চেল প্রদেশের সেই যুবরাজ যার কথা এখনও কেউ জানে না?
গুরুদেব যখন জলে ডুব দিচ্ছিলেন তখন আমি সহসা বানরের মতো লাফ দিয়ে ওঁর কাঁধে চড়ে বসলাম এবং ওঁর মুন্ডটা ঠেসে ধরলাম জলের মধ্যে। সে-অবস্থাতেও উনি বহুক্ষণ জীবিত ছিলেন। অতক্ষণ কোনো মানুষ পারে না। কিন্তু আশ্চর্য! উনি নিজেকে বাঁচানোর কোনো চেষ্টাই করলেন না। আমার মনে হল আমি একটা মৃত লোককে হত্য করতে উদ্যত হয়েছি।
বাড়ি ফিরে এসে আর সুদক্ষিণাকে খুঁজে পাচ্ছি না।
রেবন্ত গুরুহত্যার দিনটির বিবরণে সুদক্ষিণার কথা উল্লেখ করেছে। কিন্তু সেখানে উল্লেখ নেই সুধাবতীর। আমাদের ধারণা হয় সুধাবতীর মৃত্যু এর অনেক আগেই হয়েছিল ব্রহ্মাচার্যের নিপীড়ন যন্ত্রে। সেই নিপীড়ন যন্ত্র, যার দু-টি বিশেষ উপকরণ ওই সহস্রকোণ পাথর এবং সুদক্ষিণা। মৃত্যুটা এত সহজ অথচ অপ্রত্যাশিত ছিল যে, লোকের ধারণা হয়েছিল সুধাবতী উন্মাদ হয়ে আত্মহত্যা করেছেন। শেষের দিকে তিনি বস্ত্র বর্জন করেছিলেন। জলের দিকে তাকালে তিনি নিজের মুখের জায়গায় সুদক্ষিণার মুখ দেখতে পেতেন। সুদক্ষিণার সঙ্গে স্বামীকে সংগম করতে দেখলে মনে করতেন ওই সুদক্ষিণাই হলেন তিনি। সেই মতন তাঁর রতিতৃপ্তি ঘটে থাকত। ক্রমশ তিনি নিজের এবং সুদক্ষিণার মধ্যের তফাতটুকু হারিয়ে ফেলেন। এবং জীবনের শেষ দিনটিতে তিনি কন্যার ওপর অত্যন্ত রেগে গিয়ে সুদক্ষিণা মনে করে নিজের গলায় নিজে দড়ি পরিয়ে দেন। এরপরই ব্রহ্মাচার্যের নিপীড়ন যন্ত্র কবিতার দিকে প্রসারিত হয়।
আশ্চর্যের ব্যাপার, মার হাতে তার মৃত্যু হয়েছে ভেবে সুদক্ষিণাও এই থেকে সুধাবতীর মতো আচরণ করতে গুরু করে। স্বামীজ্ঞানে যত্ন করতে থাকে ব্রহ্মচার্যকে, এবং এক কালের প্রেমিক রেবন্তকে সন্তানের মতো বাৎসল্য প্রদর্শনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। রেবন্তের জীবনে চরম ব্যর্থতাবোধের শুরুও এইখানে।
একটা অন্য রকম ব্যর্থতাবোধও রেবন্তের মধ্যে কাজ করছে আমরা বুঝতে পারি ওর গুরুহত্যার পাদটীকা পড়লে। ব্রহ্মাচার্যের মৃত্যু ওভাবে হয়নি মেনে নিলেও রেবন্তর ওই পাদটীকাকে অবজ্ঞা করা যায় না। রেবন্ত যেখানে বলেছে, ‘গুরুদেব জলে মগ্ন থেকেও প্রতিবাদ করলেন না কেন? উনি কী ওঁর সেই পূর্বপ্রতিশ্রুত স্বপ্নে ডুবে গেছিলেন? যে স্বপ্নে গিয়ে তিনি হঠাৎ জগত্সংসারের জীবনটাকেই একটা স্বপ্ন হিসেবে দেখতে পেতেন। যে স্বপ্নে তিনি সেই ব্রহ্মাচার্য, যিনিও একটা স্বপ্নে মগ্ন আছেন। যে স্বপ্নে স্বপ্নস্থ ব্ৰহ্মাচার্য দেখতে পাচ্ছেন এক রেবন্ত তাঁকে জলে ঠেসে ধরে শ্বাসরুদ্ধ করতে উদ্যত এবং অসহায় পন্ডিত স্বপ্নের মধ্যে হাত বাড়াতেও ভুলে গেছেন।
তাহলে আমি কী শেষমেষ একটা স্বপ্নের চরিত্রকেই নিহত করলাম? তাহলে আমি যে আসল একটা মানুষ তার প্রমাণ কী? একটা স্বপ্নের চরিত্রকে তো খুন করতে পারে শুধুমাত্র আর একটা স্বপ্নের চরিত্র। কেউ কি আমায় বলে দেবে না আমি ইহজগতের জ্যান্ত রেবন্ত না রত্নাকর ব্রহ্মাচাৰ্যর স্বপ্নজগতের মায়াপুরুষ?
স্পষ্টতই অনুমান করা যায় গুরুদেবকে হত্যার পর রেবন্তরও বুদ্ধিভ্রংশ হতে শুরু করে। ‘গুরুচরিত’-এর অন্তিম অংশে তাই সে ক্রমাগত নিজের সত্তা সম্পর্কিত প্রশ্ন তুলতে থাকে। স্থানে স্থানে গুলিয়ে ফেলে তার এবং গুরুদেবের নাম-ধাম পরিচয়। এবং এইরকম এক অসংলগ্ন মুহূর্তে শেষ বারের মতো ব্রহ্মাচার্যকে উৎখাত করার জন্যে সে সরস্বতীর জলে গিয়ে নিজের মাথাটা ঠেসে ধরে। সম্ভবত সে সমানে ভেবেছিল, সে গুরুদেবকে ইহজগৎ থেকে অপসৃত করছে। পাশের লোকেরা যারা স্নানাদি সারতে ব্যস্ত ছিল নদীতে ধরেই নিয়েছিল এ বুঝি রেবন্তের এক যোগাভ্যাস। কেউ তাকে বাঁচাতে আসেনি তাই। কেবল উদ্দালক নামের এক অঙ্কনশিল্পী দৃশ্যটিকে খুব মজার ভেবে পাড়ে বসে সেটিকে একাগ্রচিত্তে এঁকে ফেলেছিল।
ব্যাপারটা যে জনৈক উন্মাদের আত্মহত্যা সেটা বোঝা যায় ‘গুরুচরিত’-এর শেষ ক-টি কথা পড়ে। রেবন্ত লিখেছিল, নিজের অস্তিত্ব নিয়ে এত সংশয়ে থাকা যায় না। আজই গুরুর মুন্ডটা শেষবারের মতো সরস্বতীর জলে চেপে ধরব। অনন্তকালের মতো। আমি বা তিনি কে যে স্বপ্ন তাতেই প্রমাণ পাবে। এ মুঠো আর আমি আলগা করব না।
জনশ্রুতি আছে রেবন্তের হাত তার নিজের গলায় এত জোরে ধরা ছিল যে হাজার চেষ্টাতেও তা আলগা হয়নি। নিজের গলা এভাবে চেপে ধরা চিকিৎসকদেরও অবাক করেছিল। অনেকের মতেই তা নাকি অপ্রাকৃতিক ব্যাপার ছিল।
তা সে যাই থেকে থাকুক এ ঘটনার পর অনেকেই রেবন্তর গুরুহত্যার বিবরণ নিয়ে ভাবতে শুরু করে। যারা রেবন্তর নিজের কথাই মেনে নিল তারা তো সহজেই সমাধান পেয়ে গেল। যারা ওর মৃত্যুর পর ব্রহ্মাচার্যের আশ্রমে গিয়ে সুদক্ষিণার কোমরবন্ধ ও তার মধ্যে গোঁজা ব্রহ্মাচার্যের পদ্যগুলি পেল, তারা নতুন কোণ থেকে ব্যাপারটা সাজিয়ে তুলতে শুরু করল। বলল, রেব কুড়োল দিয়ে সংগমরত পিতা ও কন্যাকে হত্যা করেছে। খুঁজে-পেতে এরা একটা কুড়োলও বার করল রেবন্তের কুলুঙ্গি থেকে। একটা পুরোনো তোরঙ্গ থেকে বার করল কিছু রক্তাক্ত নেকড়ার পুঁটুলি। বলল, এতে বেঁধে ছিন্নভিন্ন দেহগুলি রেবন্ত শকুনকে খাওয়াতে নিয়ে যায়। পরে স্মৃতি হিসেবে এগুলো ফিরিয়ে আনে ঘরে। কিন্তু ওই থেকেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে নদীর জলে হাত ধোয়া ওর একটা বাতিক হয়ে ওঠে। ও রকম একটা বাতিকগ্রস্ত মুহূর্তে ওর নিজেকে নষ্ট করার ইচ্ছে জেগেছিল। তাই ওই মৃত্যু।
এই দ্বিতীয় মতটার সপক্ষে এত মানুষ জুটল কী করে তা বাস্তবিকই ভাববার বিষয়। যুগ যুগ ধরে লোক অবাক বোধ করেছে এই ঘটনায়। হতাশ এবং বিরক্ত কিছু ঐতিহাসিক থেকে থেকে রেবন্তের বর্ণনাকেই সত্য বলে মেনে নিতে প্রস্তুত হয়েছেন। শেষপর্যন্ত একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছেন মহামহোপাধ্যায় লসতীশচন্দ্র শুক্ল। যাঁর সঙ্গে গিরিশ ঘোষ, রমেশ দত্ত, দীনবন্ধু মিত্র, গৌর বাউল প্রমুখের নিকট আলাপ ছিল শোনা যায়। তিনি চমৎকার আলোচনা করেছেন ব্রহ্মাচার্যের ‘অনুসন্ধান ক্রীড়া’-র একাংশের, যাকে বইটির গোধূলি পর্যায় বলা যায়। বুদ্ধি এবং অনুভবে সম্পৃক্ত এই পর্যায় সুস্থতা এবং উন্মাদনার মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে। হিন্দু পন্ডিত যেখানে লিখেছেন, সর্বশ্রেষ্ঠ খুন ভেতরের জ্বলুনি থেকে হয়। যে জ্বালা কেবল নারী সংক্রান্ত ঘটনার থেকে উঠে আসে। এইসব খুন মাঝরাতেই হওয়া শ্রেয়। খুনি যে সময় নারী এবং ঘটনাসংলগ্ন পুরুষকে একই সঙ্গে পাবে। তাদের সংগমরত অবস্থাতে আঘাত করাই পৌরুষের লক্ষণ। ভালো হয় যদি সে আঘাত তলোয়ার, কুড়োল কিংবা বল্লম দিয়ে হয়। তবে এ খুন সমাপ্ত হবে না যতক্ষণ প্রেমিক যুগলের দেহ টুকরো টুকরো করে ছিড়ে ফেলা হচ্ছে। তবে এই খুনের আদত সমাপ্তি ঘাতকের আত্মহত্যায়। কারণ সেভাবে সে তুরীয় অবস্থায় পোঁছোয়। নিজেকে শেষ করতে না পেরেই, সতীশচন্দ্র বলেছেন, রেবন্ত মিথ্যে বিবরণের আশ্রয় নেয়। তবে ওরও যে তুরীয় অবস্থা এসেছিল তা প্রকট হয় পরবর্তী ঘটনায়। ও বেশিদিন সুস্থ থাকতে পারেনি।