বিশ্বাস! বিশ্বাস! বিশ্বাস!
“সব্বাই কি তাঁকে ধরতে পারে?”
সর্বনাশ! এ আপনার কি প্রশ্ন ঠাকুর! আমরা এই ঘা-খাওয়া, পোড়-খাওয়া মানুষের দল, টুকটুক করে তাঁর সন্ধানেই যে চলেছি! সব ক্ষত, সব জ্বালা তিনি জুড়িয়ে দেবেন। জীবনে যত অপমান সহ্য করেছি, সব তিনি ভুলিয়ে দেবেন। সব অভাব পূর্ণ করবেন। অপরিমিত গৌরবে ভরিয়ে দেবেন এই অগৌরবের জীবন। তাঁকে ধরতে পারব না? এ কেমন সংশয়!
তুমি কোন্ থাকের মানুষ?
আজ্ঞে! থাক মানে?
শোন! ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যাওয়াই ভাল, তাঁর ইচ্ছে নয় যে, সবাই তাঁকে পাক। “তিনি ভাল লোক করেছেন, মন্দ লোক করেছেন, ভক্ত করেছেন, অভক্ত করেছেন, বিশ্বাসী করেছেন, অবিশ্বাসী করেছেন। তাঁর লীলার ভিতর সব বিচিত্রতা, তাঁর শক্তি কোনখানে বেশি প্রকাশ, কোনখানে কম প্রকাশ। সূর্যের আলো মৃত্তিকার চেয়ে জলে বেশি প্রকাশ, আবার জল অপেক্ষা দর্পণে বেশি প্রকাশ।” বুঝলে কিছু?
আজ্ঞে হ্যাঁ। নিজের দিকে তাকাই। আমি মাটি, না জল, না আয়না? মাটি হলে জল হতে হবে, জল হলে আয়না। আমার অনুসন্ধান আছে, ভক্তি আছে। সেখানেও আপনার একটি কথা আছে—”আবার ভক্তদের ভিতর থাক থাক আছে, উত্তম ভক্ত, মধ্যম ভক্ত, অধম ভক্ত।” তাহলে দেখতে হচ্ছে, আমি কোন্ থাকের ভক্ত! ভক্ত ঈশ্বর মানে। সে অবিশ্বাসী নয়। তবে? আপনি বলেন : “অধম ভক্ত বলে, ঈশ্বর আছেন—ঐ আকাশের ভিতর অনেক দূরে। মধ্যম ভক্ত বলে, ঈশ্বর সর্বভূতে চৈতন্যরূপে—প্রাণরূপে আছেন। উত্তম ভক্ত বলে, ঈশ্বরই নিজে সব হয়েছেন, যাকিছু দেখি ঈশ্বরের এক-একটি রূপ। তিনিই মায়া, জীব, জগৎ—এইসব হয়েছেন, তিনি ছাড়া আর কিছু নাই।”
ভাগবতের কথা—
“সর্বভূতেষু যঃ পশ্যেদ্ ভগবদ্ভাবমাত্মনঃ।
ভূতানি ভগবত্যাত্মন্যেষ ভাগবতোত্তমঃ।।”
সর্বভূতে ঈশ্বর আছেন, এ যদিও বা মানতে পারি, সবাই ঈশ্বর এটি মানতে সামান্য দ্বিধা হয়। মনে হয় শয়তানও আছে। অবিশ্বাসী ঈশ্বর, অত্যাচারী, মানব- নিগ্রহকারী, মদ্যপ, চরিত্রহীন, পরস্বাপহারী, খুনি ঈশ্বরে কেমন করে বিশ্বাস করি!
সেই বিশ্বাস যতদিন না আসছে ততদিন আমার কিছু হলো না। উপলব্ধিই ঈশ্বর। যতক্ষণ ‘আমি’ আছে ততক্ষণ ‘তিনি’ নেই। বিগুণ, নিৰ্গুণ সত্তাকে নিজের দর্শনের সঙ্কীর্ণতায় নানা রঙে রাঙিয়ে তুলে সাদা, কালো, নীল সবুজ করে তুলছি। নিজেকে বিচারকের আসনে বসিয়ে নিজের বেঠিক বুদ্ধিযন্ত্র দিয়ে সৃষ্টিকে বিচার করছি। ভক্তের দৃষ্টি আর বিচারকের দৃষ্টি এক নয়। বিচারক বলে—’আমি আর আমার।’ এইটি অজ্ঞান। ভক্ত বলে—’তুমি আর তোমার।’ এইটি জ্ঞান। নদী যখন ভেসে যায় তখন পথ, ঘাট, খাল, বিল, নালা-নর্দমা সব একাকার, “আব্রহ্মস্তম্বপর্যন্তং সর্বং কৃষ্ণশ্চরাচরম্।” (নারদপঞ্চরাত্র)
তোমার এত ভাল-মন্দ, জগৎ-যন্ত্রণা নিয়ে মাথা ঘামাবার কি দরকার হে বাপু! তোমার চাহিদাটা কি! তোমার বিশ্বাসটাকে জাগাও। আমি জানি, তোমার অসুখটা কি! তুমি সংসারী, আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা। তোমার শঙ্কা—পরিবার, পরিজনকে বয়ে নিয়ে যেতে পারবে কিনা! রোজগার থাকবে কিনা! ছেলে মানুষ হবে কিনা! মেয়ের বিবাহিত জীবন সুখের হবে তো! অবসর নেওয়ার পর কে তোমাকে দেখবে! যাবতীয় উদ্বেগে তুমি সদা বিচলিত। তোমার লোভ আছে, উচ্চাকাঙ্ক্ষা আছে। তোমার দ্বেষ, ঈর্ষা আছে। গুরুবাক্যে তোমার একশ ভাগ বিশ্বাস নেই। তোমাকে যদি হাজারবার বলি, ঈশ্বর আছেন, সত্যই আছেন, তাঁকে দেখা যায় এই আমি যেমন তোমাকে দেখছি; তুমি ঘাড় নাড়বে, তারপর তোমার নিজের বিচার প্রয়োগ করে ভাববে, তা কি কখনো হয়! কেবল মুখে বলে, ঈশ্বর আছেন, তাঁর ইচ্ছায় এসমস্ত হচ্ছে, বিষয়ীরা শুনে রাখে—বিশ্বাস করে না।
“বিষয়ীর ঈশ্বর কেমন জান? খুড়ী-জেঠীর কোঁদল শুনে ছেলেরা যেমন ঝগড়া করতে করতে বলে, ‘আমার ঈশ্বর আছেন।’ সমর্পণ যদি পুরোপুরি হয় তাহলে আর কোন ভয় থাকে না। যদু মল্লিককে আমি বলেছিলুম, বুঝেছি, তুমি রামজীবনপুরের শীলের মতো—আধখানা গরম, আধখানা ঠাণ্ডা। তোমার ঈশ্বরেতেও মন আছে, আবার সংসারেও মন আছে।”
এই আধখানা হলেই মহা বিপদ। এই কথাটি বুঝে নাও, তিনিই সুমতি দেন, তিনিই কুমতি দেন। তিতো-মিঠে ফল কি নেই? কোন গাছে মিষ্ট ফল, কোন গাছে তিতো বা টক ফল। তিনি মিষ্ট আমগাছও করেছেন, আবার টক আমড়াগাছও করেছেন। তাঁর মায়ার ঈশ্বর্য। সৎ, অসৎ, ভাল, মন্দ, পাপ, পুণ্য। তাঁর সৃষ্টিতে সবই হতে পারে—এই বিশ্বাস থাকলেই হলো; আমি যা ভাবছি তা-ই সত্য, আর সকলের মত মিথ্যা—এরূপ ভাব আসতে দিও না। তারপর তিনিই বুঝিয়ে দেবেন।
তাঁর কাণ্ড মানুষে কি বুঝবে? অনন্ত কাণ্ড! তাই আমি ওসব বুঝতে আদপে চেষ্টা করি না। শুনে রেখেছি তাঁর সৃষ্টিতে সবই হতে পারে। তাই ওসব চিন্তা না করে কেবল তাঁরই চিন্তা কর। হনুমানকে জিজ্ঞাসা করেছিল, আজ কি তিথি, হনুমান বলেছিল, ‘আমি তিথি নক্ষত্র জানি না, কেবল এক রাম চিন্তা করি।’
ঘোলাটে জগতের আবর্ত আমাকে আর বিচলিত করবে না হয়তো; কিন্তু আমার সংশয়, আশঙ্কা, দুশ্চিন্তা, বিচলন ইত্যাদির কি হবে!
তাহলে আবার শোন, বিদ্যার আমি, ভক্তের আমি, দাস আমি, ভাল আমি থাকে। বজ্জাত আমি চলে যায়। আত্মার সাক্ষাৎকার হলে সব সন্দেহ ভঞ্জন হয়। ভক্তির তমঃ আন। বল, কি! রাম বলেছি, কালী বলেছি, আমার আবার বন্ধন; আমার আবার কর্মফল। গানে বলছে-
“আমি দুর্গা দুর্গা বলে মা যদি মরি।
আখেরে এ-দীনে না তারো কেমনে,
জানা যাবে গো শঙ্করী।
নাশি গো ব্রাহ্মণ, হত্যা করি ভ্রূণ,
সুরাপান আদি বিনাশী নারী।
এ-সব পাতক, না ভাবি তিলেক, ব্রহ্মপদ নিতে পারি।”
“বিশ্বাস! বিশ্বাস! বিশ্বাস! গুরু বলে দিয়েছেন, রামই সব হয়ে রয়েছেন; ‘ওহি রাম ঘট ঘটমে লেটা!’ কুকুর রুটি খেয়ে যাচ্ছে। ভক্ত বলছে, ‘রাম! দাঁড়াও, দাঁড়াও রুটিতে ঘি মেখে দিই।’ এমনি গুরুবাক্যে বিশ্বাস
“হাবাতেগুলোর বিশ্বাসই হয় না! সর্বদাই সংশয়! অহঙ্কার থেকে বিচার, বিচার থেকে সংশয়। অহঙ্কার যাওয়া বড় শক্ত। অশ্বত্থগাছ, এই কেটে দিলে আবার তারপর দিন ফেকড়ি বেরিয়েছে। যতক্ষণ তার শিকড় আছে ততক্ষণ আবার হবে।
“আমি হাজরাকে যা বলেছিলুম তোমাকেও তাই বলছি,
“কাউকে নিন্দা কর না।”
“নারায়ণই সব রূপ ধরে রয়েছেন। দুষ্ট খারাপ লোককেও পূজা করা যায়।”
“দেখ না কুমারীপূজা। একটা হাগে মোতে, নাক দিয়ে কফ পড়ছে এমন মেয়েকে পূজা করা কেন? ভগবতীর একটি রূপ বলে।”
“ভক্তের ভিতর তিনি বিশেষরূপে আছেন। ভক্ত ঈশ্বরের বৈঠকখানা।”
“অন্তর্বহির্যদিহরিস্তপসা ততঃ কিম্!”