বিশ্বাস করুন, আমি পাগল নই
০১.
গাঁয়ের নাম মামুদপুর। বনগাঁ দিয়ে যেতে হলে প্রথমে ট্রেন, পরে সাইকেল রিক্সা, বাস, খেয়া নৌকা এবং শেষে মাইল দুয়েক গোরুর গাড়ি নয়তো পদব্রজে যেতে হবে। আজ থেকে তিরিশ-চল্লিশ বছর আগে হলে বলা যেত গণ্ডগ্রাম, কিন্তু আর তা বলা যাবে না। বছর দশেক হল কয়েকজন ধনী লোক ট্রাকটারের সাহায্যে চাষবাস শুরু করেছেন এখানে। নিরবচ্ছিন্ন শান্তিতে দিন কাটছিল মামুদপুরের।
কিন্তু একটানা শান্তি বোধহয় কোথাও থাকতে পারে না। এক ভয়াবহ আতঙ্কে এক নিমিষেই শূন্যে মিলিয়ে গেল সমস্ত সুখ শান্তি। যদি সত্যি এটা স্বপ্ন হত তবে তার একটা বৈজ্ঞানিক যুক্তি মিলত। আর তার ফলে অবুঝ মনকে বুঝ মানানোর চেষ্টা করা যেত। কিন্তু এই ঘটনাটা একেবারেই সম্পূর্ণ আলাদা। কোনও বুদ্ধি দিয়ে এর ব্যাখ্যা মেলে না। এই ঘটনার মূল উৎস যে পার্থিব কোনও কিছু নয়, সে বিষয়ে দ্বিমতের আর কোনও সম্ভাবনা নেই এখন। গ্রামের অবশিষ্ট অধিবাসীরা বোধহয় কেউ কোনও দিনও সেই বীভৎস ভয়ংকর ঘটনাকে ভুলতে পারবে না।
পরবর্তী কয়েক পাতায় সমস্ত ঘটনাটি বিশদভাবে লিপিবদ্ধ করলাম। আমি চেষ্টা করেছি খুঁটিনাটি প্রতিটি বিষয়ের প্রতি সমান গুরুত্ব আরোপ করতে। তবে এর পরেও যদি কিছু বাদ পড়ে যায় তার জন্য আপনারা আমাকে ক্ষমা করবেন। আপাত দৃষ্টিতে তিনটে ঘটনার মধ্যে হয়তো কোনও সাধারণ যোগসূত্র পাওয়া যাবে না। কিন্তু একটু চিন্তা করে দেখুন, দেখবেন কী সুন্দর পর্যায়ক্রমে ঘটেছে ঘটনাগুলো। আপনাদের কাছে আর একটি আবেদন আমার, এই ঘটনা সম্বন্ধে যদি কেউ নতুন কিছু জেনে থাকেন তাহলে আমাকে জানাবেন। এবং এর ফলে সত্য উদঘাটনের পথ আরও সুগম হবে। আমার তো মনে হয় দুর্যোগপূর্ণ রাতের অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে বিরাট ধ্বংসের মুখে এগিয়ে চলেছি আমরা। সেদিনের কথা মনে হলে আতঙ্কে সমস্ত শরীর শিউরে ওঠে। মনে হয় কিছুই জানি না আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে। চন্দ্র অভিযানে সফল হয়েছি বটে, কিন্তু অন্যান্য গ্রহ সম্বন্ধে কতটুকু জানতে পেরেছি? মহাবিশ্বের কতটুকু জানি আমরা? তাই মনে হয় এখনও বোধহয় সময় আছে। এখনও চেষ্টা করলে হয়তো সেই ভয়ংকর ধ্বংসের কবল থেকে রক্ষা করতে পারা যায় আমাদের সুন্দর পৃথিবীকে। কিন্তু আশ্বাস দেবে কে? কে শোনাবে বাঁচার গান?
.
০২.
কয়েকটা তারা কয়েক সেকেন্ডের জন্যে অদৃশ্য হয়ে গেছল। কিন্তু কেউ লক্ষ করেনি এটা। সারাক্ষণ কে-ই বা আকাশের দিকে চেয়ে বসে থাকে? তিনজনের চোখে কিন্তু ধরা পড়েছিল তাদের এই অদ্ভুত আচরণ। প্রফেসর গোরাচাঁদ শীল ও তার সহকারী শ্রী পরিমল দেবগুপ্ত–এই দুই জ্যোতির্বিজ্ঞানী শুক্র গ্রহ নিয়ে পরীক্ষা চালাচ্ছিলেন। শ্রী সৌরেন ঘোষ কিন্তু একজন অ্যামেচার। আকাশের মায়ায় একদম মজেছেন শ্রী ঘোষ। প্রথমোক্ত দু-জনের মতে তারা অদৃশ্য হওয়া ব্যাপারটা ঘটেছে আকাশের পশ্চিম দিগন্তে। কিন্তু শ্রী ঘোষ বলেছেন যে শনি গ্রহের কাছাকাছি ঘটেছে এই ব্যাপারটা। তাহলে মনে হয় দু-মতের মধ্যে হয় একটা সত্য নয়, নয়তো দুটো ঘটনাই সত্য এবং একই সময়ে ঘটেছিল। মার্চের ২৮ তারিখে এই ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছেন শ্রী ঘোষ। আগের দিন রাতেও এক ঘটনা দেখেছেন তিনি। শনির উপরে কেমন যেন মায়া পড়েছিল ওর। তাই ২৭ তারিখে অলসভাবে শনির দিকে তাকিয়ে ছিলেন। আকাশ ছিল নির্মেদ। টেলিস্কোপের মাধ্যমে এক অপরূপ শোভায় বিকশিত হয়েছিল শনি গ্রহ ও তার বলয়। ঠিক এই সময়ে ওই অদ্ভুত ব্যাপারটা ঘটে। রাত তখন প্রায় একটা। হঠাৎ শনির সামনে এক উজ্জ্বল বিন্দু দেখা গেল। শ্রী ঘোষের মনে হল বোধহয় ভুল দেখছেন। বার দুয়েক চোখটা রগড়ে নিয়ে আবার তাকিয়ে ছিলেন শনির দিকে। কী আশ্চর্য! চোখ ধাঁধানো উজ্জ্বলতার পরিবর্তে এক কালো বিন্দুকে দেখতে পেলেন সেখানে। বিন্দুটা আস্তে আস্তে অদৃশ্য হয়ে গেল। সমস্ত ঘটনাটা ডায়েরিতে লিখে রাখলেন শ্রী ঘোষ।
২৮ মার্চ রাতে শনির দিকের টেলিস্কোপ ফোকাস করতেই আবার সেই উজ্জ্বল বিন্দুকে দেখা গেল। হঠাৎ শনির পাশের তারাটা মুহূর্তের জন্যে অদৃশ্য হয়ে আবার স্বস্থানে দেখা দিল। তার পাশের তারাটিরও সেই এক ব্যবহার। শ্রী ঘোষের মনে হল বোধহয় ভুল দেখছেন। নয়তো নির্ঘাত চোখের দোষ হয়েছে। অনেকক্ষণ লক্ষ করার ফলে একটা বিষয়ে নিঃসন্দেহ হলেন যে, না, তার দেখার ভুল না। সত্যি তারারা একে একে অদৃশ্য হয়ে আবার দেখা দিচ্ছে। আর এই অদৃশ্য হওয়া তারাগুলো শনি আর পৃথিবী সংযোজনকারী সাধারণ সরলরেখার উপর অবস্থিত। ব্যাপারটা সত্যি খুব অদ্ভুত। এটা ঠিক কী রকম জানেন, মনে করুন জেনারেল পোস্ট অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে বড় ঘড়িটা দেখছেন আপনি। আপনার চোখের সামনে অদৃশ্য হয়ে গেল, কিন্তু পরমুহূর্তে আবার দেখতে পেলেন তাকে। এ বিষয়ে আপনি নিশ্চিত যে আপনার এবং ঘড়িটার মাঝখানে দাঁড়িয়ে কেউ নিশ্চয়ই আপনার দৃষ্টিকে বাধা দেয়নি। তাহলে লোকটিকে তো আপনি দেখতে পেতেন। কিন্তু মনে করুন কোনও অদৃশ্য বস্তু আপনাদের সামনে এল যাকে আপনি দেখতে পাচ্ছেন না, অথচ অদৃশ্য বস্তুটার পেছনে ঘড়িটাকেও আপনি দেখতে পাচ্ছেন না। তার মানে ঘড়ি থেকে যে আলোক রশ্মি আপনার চোখে আসার ফলে আপনি ঘড়িটাকে দেখতে পান সেই আলোক রশ্মিকে বাধা দিচ্ছে অদৃশ্য বস্তুটা। যাক, এরকম এক ভুতুড়ে ব্যাপার প্রথমে আমার মাথায়ও ঢোকেনি। সুতরাং এই নিয়ে বেশি মাথা না ঘামিয়ে আসল বক্তব্যে ফিরে আসি। প্রফেসর শীল আর শ্রী ঘোষের মধ্যে তারা অদৃশ্য হওয়ার স্থান নিয়ে মতপার্থক্য হলেও একটা বিষয়ে কিন্তু দু-জনেই একমত। ওরা দু-জনে বলেছিলেন যে তারাগুলো অদৃশ্য হওয়াটাকে যদি এক সরলরেখায় টানা যায় তবে সে এক পৃথিবীমুখী সরলরেখা।
যাই হোক, তিনজনের কেউই বিশেষ কোনও গুরুত্ব আরোপ করেননি এর উপর। তিন পর্যবেক্ষকই ডায়েরিতে শুধু লিখে রেখেছিলেন ঘটনাটা। আর গুরুত্ব না দেওয়ার ফলেই সকলের অজান্তে এক ভয়ংকর বিভীষিকার আবির্ভাব হয়েছিল মামুদপুর গ্রামে।
এর পরের ঘটনাগুলো আমি সুকুমারবাবু এবং ক্যাপটেন বার্নওয়ালের অভিজ্ঞতা থেকে বলব। শ্রী সুকুমার ঘোষ মামুদপুর গ্রামে বসবাস করেন। গ্রাম থেকে বেশ খানিকটা দূরে সুকুমারবাবুর ক্ষেতখামার চাষবাস ঘরবাড়ি। দু-দুটো ট্রাকটর আছে ওর। বাড়ির সীমানার মধ্যে বিরাট পোলট্রি। মুরগির সঙ্গে বেশ কিছু ছাগল ও গোরুও আছে। এর মাঝখানে ছোটখাটো দোতলা বাড়ি। চারপাশ কচা আর অমরী গাছের বেড়া দিয়ে ঘেরা।
এইখানেই সেই ভয়াবহ বিভীষিকার আবির্ভাব হয়েছিল। আত্মহত্যা করার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত সুকুমারবাবুই ছিলেন সেই অবিশ্বাস্য ঘটনার একমাত্র প্রথম এবং শেষ প্রত্যক্ষদর্শী।
.
০৩.
৩০ মার্চ। সকালবেলা। খুব ভোরে ওঠার অভ্যাস সুকুমারবাবুর। ভোরের বাতাসে শীতের আমেজ। মাঠঘাট গাছপালার উপরে চাপচাপ কুয়াশা ঝুলছে। কচার ডাল দিয়ে দাঁতন করার অভ্যাস অনেক দিনের। তাই বেড়ার গায়ে লাগানো কচার ডাল ভাঙার জন্যে বাইরে বেরিয়ে এলেন সুকুমারবাবু। মাথার উপরে আকাশ ঘন মেঘে ঢাকা। তা সত্ত্বেও পূর্ব আকাশে রঙের ছোপ ধরেছে। চতুর্দিকে আলো আঁধারি খেলা। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়তে শুরু করল। কয়েক পা এগোতেই এক গভীর বিস্ময়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন সুকুমারবাবু। ভালো করে তাকালেন চারপাশে। এ অজানা আতঙ্কে ছাঁত করে উঠল মনটা। পায়ে পায়ে ঘরে ঢুকে দরজাটা ভেজিয়ে দিলেন।
সান্ত্বনা। সান্ত্বনা। তাড়াতাড়ি এসো একবার। কণ্ঠস্বরে কেমন এক ব্যস্ততার ছাপ।
স্বামীর পাশে এসে দাঁড়াল সান্ত্বনা। চোখের সামনে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। খোলা জানালা দিয়ে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। দু-জনেই বাক্যহারা। যেন ফোঁটা ফোঁটা রক্ত চুঁইয়ে পড়ছে। চারপাশের বাতাস থেকে। ঠিক বোধহয় রক্তের মতো লাল নয়। তবে মনে হয় রক্ত ধুলো বৃষ্টির সংমিশ্রণ। গাছের পাতার উপর পড়েও গড়িয়ে মাটিতে পড়ছে না ফোঁটাগুলো। কীরকম যেন আটকে আছে। তারপর আস্তে আস্তে করে পড়ছে মাটিতে। সাধারণ বৃষ্টির ফোঁটার চেয়ে বেশ ভারী এই ফোঁটাগুলো। গাছপালা, মাটি সব যেন লাল। হঠাৎ কেমন এক বিশ্রী গন্ধ ভেসে এল। দু-দিন আগে একটা মরা ইঁদুর পাওয়া গিয়েছিল ভাঁড়ার ঘরে। সেই গন্ধটার কথা মনে পড়ে গেল। মুরগি কাটার সময়কার রক্তের গন্ধও যেন এমনটা।
দরজা খুলে বাইরে হাত মেলে ধরলেন সুকুমারবাবু৷ কয়েক ফোঁটা লাল বৃষ্টি পড়ল ওঁর হাতে।
দেখো, দেখো। বলে সান্ত্বনার সামনে মেলে ধরলেন হাতটা। ঠিক যেন তিন-চার ফোঁটা বাসি রক্ত। কেমন যেন টলটল করছে। কীরকম পচা পচা গন্ধ।
আধিভৌতিক ব্যাপারে অগাধ বিশ্বাস সান্ত্বনার। তাই ভয়ে একটু পিছিয়ে গিয়ে বলল, রক্ত বৃষ্টি! এ কী সম্ভব! আমার খুব ভালো লাগছে না। দরজাটা বন্ধ করে দাও তাড়াতাড়ি।
কী বললে? রক্ত বৃষ্টি! না না, রক্ত নয়, রক্তের মতো রং। ফল বোধহয় ভালো হবে না এবার। তারপর একটু হেসে সাত্বনার দিকে ফিরে বললেন, মনে হয় লাল ধুলোর সঙ্গে বৃষ্টি মিশে এমন হয়েছে। শুধু ভয় পাবার মতো এমন কিছু নয় এটা। তারপর…
কথা শেষ করার আগেই সান্ত্বনা বলে উঠল, শোনো শোনো। ভালো করে শোনো তো।
পোলট্রি বাড়ি থেকে গোরু ছাগল মুরগির পরিত্রাহি চিৎকার শোনা গেল। সঙ্গে সঙ্গে দোতলার শোবার ঘর থেকে লাবুর বিকট চিৎকায় ভেসে এল। লাবু সুকুমারবাবুর পোষা অ্যালসেশিয়ান কুকুর।
তুমি এখানে দাঁড়াও সান্ত্বনা। কোথাও যেও না। আমি আসছি এক্ষুনি। বলে একছুটে বাইরে চলে গেলেন সুকুমারবাবু।
ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরছে লাল বৃষ্টি। অস্বস্তিকর দুর্গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। প্রথমে গোয়ালে ঢুকলেন সুকুমারবাবু। কিন্তু গোরু ছাড়া আর কেউ নেই সেখানে। পাশেই মুরগির ঘর। সেখানেও সেই এক অবস্থা। সব যেমনকে তেমন। অথচ ভীষণ ভয়ে তারস্বরে চিৎকার করছে সকলে। ওদের আশ্বস্ত করার সকল চেষ্টাই বিফল হল। সুকুমারবাবু আরও আশ্চর্য হলেন। এমন তো কখনও হয় না। এমন সময় চিৎকার করতে করতে লাবু এল ওঁর কাছে। তারপর ওঁর পায়ের কাছে বসে কুঁই কুঁই করে ডাকতে শুরু করে দিল।
কিছুক্ষণ পরে অবশ্য লাল বৃষ্টি থামল এবং আশ্চর্যের কথা, জন্তুদের চিৎকার বন্ধ হল সেই সঙ্গে।
চায়ের টেবিলে সকালের ঘটনাই আলোচনা করছিলেন সুকুমারবাবু। সান্ত্বনা একটু চুপচাপ। চায়ের কাপ থেকে অল্প অল্প করে ধোঁয়া উঠছে। টেবিলের তলায় লাবু খাবারের আশায় বসে।
জন্তুদের কথা আর কী বলব, আমরাই তো ভয় পেয়ে গেছলাম। যাক, বৃষ্টি থেমে গেছে এখন। আর ব্যস্ত হবার কিছু নেই। আমার কিন্তু কী মনে হয় জানো সান্ত্বনা, নিশ্চয় কোথাও লাল ধুলোর ঝড় হয়ে গেছে কাল।
হতে পারে, ওর আশপাশে কোথাও তো লাল মাটি চোখে পড়ল না আমার।
এই কথায় একটু চিন্তিত হয়ে পড়লেন সুকুমারবাবু। সত্যি তো, আশপাশে সব জায়গাই তো দেখা আছে। লাল মাটির চিহ্নও তো নেই কোথাও।
দেখো, আজ আর বাইরে কোথাও যেও না তুমি। আমার ভয় ভয় লাগছে। বৃষ্টি কি কখনও রক্তের মতো হয়? সান্ত্বনার গলায় ভয়ের আভাস।
দূর পাগল! তুমি যে দিন-দিন ছেলেমানুষ হয়ে যাচ্ছ! ভয়ের কী আছে এতে।
সুকুমারবাবুর আশ্বাসবাক্যকে ব্যঙ্গ করে এক প্রচণ্ড আওয়াজের সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত বাড়ি থরথর করে কেঁপে উঠল। টেবিলের উপর থেকে চায়ের কাপ-ডিস সব ঝনঝন করে মেঝেতে পড়ে গেল।
কোনও কথা না বলে দরজার দিকে দৌড়ে গেলেন সুকুমারবাবু। টেবিলটাকে আঁকড়ে ধরে ঠকঠক করে কাঁপতে লাগল সান্ত্বনা। রক্ত বৃষ্টির সঙ্গে এই আওয়াজের কি কোনও সম্পর্ক আছে! এ সবের অর্থ কী! নিশ্চয়ই ভৌতিক কোনও কিছু। এসব অনেক কথা মনে হল সান্ত্বনার। বাড়ির চারপাশে সুকুমারবাবু আর লাবুর ঘুরে বেড়াবার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে।
মিনিট দশেক পরে ঘরে ঢুকলেন সুকুমারবাবু। চোখে মুখে হতাশায় চিহ্ন।
কী, কী ব্যাপার? ভয় মেশানো স্বরে জিজ্ঞাসা করল সান্ত্বনা।
না, কিছুই দেখতে পেলাম না। মনে হয়েছিল পোলট্রি ঘরেই বোধহয় বাজ পড়ল। কিন্তু কিছু হয়নি দেখলাম। ব্যাপারটা কিন্তু বুঝতে পারছি না।
আর কোনও কথা হল না। নিঃশব্দে প্রাতরাশ সেরে ফেললে দু-জনে।
খাওয়ার শেষে সুকুমারবাবু বললেন, সামনের জমিটা দেখতে যাব। প্রয়োজন হলে, চেঁচিয়ে ডাকলেই শুনতে পাব।
কোনও কথা বলল না সান্ত্বনা। স্বামীর চরিত্র বেশ ভালো করে জানা আছে। কারোর কথাই শুনবে না এখন। তাই মিনতিভরা চোখে শুধু চাইল একবার।
লাবুকে সঙ্গে নিয়ে বেরিইয়ে গেলেন সুকুমারবাবু। মেঘমুক্ত আকাশ। সূর্যের আলোয় চারদিক ঝকঝক করছে। বাইরে বেশ গরম। এখনও লাল হয়ে আছে চারদিক।
প্রথমে গোয়াল ঘর, পরে মুরগির এবং ছাগলের ঘর পার হয়ে রাস্তাটা মাঠে এসে পড়েছে। তারপর মাঠের বুক চিরে রাস্তাটা উধাও হয়ে গেছে অনেক দূরে। বাঁ ধারের জমিটায় তাইচুং ধানের চাষ হয়েছিল এবার। একটু দূরে ট্রাকটর দুটো পড়ে আছে।
মাঠের মধ্যে দিয়ে একটু দূর যেতেই গর গর করে আওয়াজ করে উঠল লাবু। চারদিকে তাকিয়ে দেখলেন সুকুমাবাবু। অস্বাভাবিক কোনও কিছু দৃষ্টিগোচর হল না।
লাবু, কী হচ্ছে কী! আমার সঙ্গে এসো।
লাবুকে ডেকে আবার চলতে সুরু করলেন সুকুমারবাবু। হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন। গজ দশেক দূরেই এক বিরাট গর্ত। গর্তের চারপাশে ভিজে মাটি উঁচু হয়ে আছে। দেখেই বোঝা যায় অল্পক্ষণ আগেই সৃষ্টি হয়েছে গর্তটা।
ওই দিকে এক পা এগোতেই ভীষণ চিৎকার করে উঠল লাবু। তারপরে চিৎকার থামিয়ে আকাশপানে মুখ তুলে কাঁদতে শুরু করল। অ্যালসেশিয়ানের ভয় দেখো–মনে মনে এই কথা বলে এগিয়ে গেলেন সুকুমারবাবু। লাবু কিন্তু এক পা-ও এগুলো না।
গর্ত থেকে কয়েক ফুট দূরে হঠাৎ কী যেন একটা পায়ে জড়িয়ে ধরল। পা ঝাড়া দিয়ে ফেলে দিয়ে যেই এক পা এগিয়েছেন সামনের দিকে, অমনি সজোরে কী একটা এসে আঘাত করল কুমারবাবুর কপালে! সঙ্গে সঙ্গে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলেন গর্তের ওপরে। সভয়ে চোখ খুলে দেখবেন, এ কী, গর্তের মধ্যে তো পড়েননি তিনি। গর্তটার ঠিক উপরে অদৃশ্য কোনও কিছুর উপর বসে আছেন। নিচের দিকে চাইতেই বেশ কয়েক গজ নিচে তলা দেখা গেল। সুকুমারবাবু একেবারে স্তম্ভিত! হাত দিয়ে অনুভব করলেন পায়ের তলাটা। শক্ত স্টিলের মতো মনে হল।
ভয়ে উত্তেজনায় হৃৎপিণ্ডটা ছিটকে বাইরে বেরিয়ে আসতে চাইল। সমস্ত শরীর ঘামে জবজব করছে। কপাল বেয়ে ক্ষতস্থান থেকে রক্ত ঝরছে। এ কী! রক্তের ফোঁটা তো নিচে পড়ছে না। শূন্যে ভাসছে ঝুলছে। মুখ থেকে কয়েক ইঞ্চি দূরে ভেসে বেড়াচ্ছে লাল ফোঁটাগুলো। চোখ দুটো আতঙ্কে বিস্ফারিত হয়ে উঠল। আবার পায়ের তলায় হাত দিলেন। উঃ, বরফের চেয়েও ঠান্ডা! আকাশের দিকে তাকালেন একবার। না, সূর্যের আলোয় ভেসে যাচ্ছে চারদিক, তবু মনে হচ্ছে একেবারে শূন্যে হাত বোলাচ্ছেন। একটু দূরে বড় বড় নবের মতো কোনও কিছু ঠেকল হাতে। বাঁ পাশে বেশ একটা গর্ত। গর্তের মধ্যে হাতের মুঠোটা ঢুকিয়ে দিতেই অদৃশ্য হয়ে গেল সম্পূর্ণ মুঠোটা।
আর কিছু ভাবতে পারলেন না। এক লাফে মাটিতে পড়ে পড়ি-কি-মরি করে দৌড় দিলেন বাড়ির দিকে। প্রচণ্ড শব্দ-রহস্য এখন পরিষ্কার হয়ে গেল। সম্পূর্ণ এক অপার্থিব বস্তু আকাশের বুক চিরে এসে পড়েছে ওই জমির মধ্যে। কী এর উদ্দেশ্য কে জানে! রূপকথা, উপকথা থেকে তুলনীয় সব গল্পগুলো একে একে মনে পড়তে লাগল। এতে আরও ভয় পেলেন সুকুমারবাবু। মনে মনে ঠিক করলেন সানাকে জানাবেন না কোনও কিছু। তাই গোয়ালঘরের পাশে দাঁড়িয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করলেন। তারপর ধীর পায়ে ধরে ঢুকলেন।
কে, তুমি এসে পড়েছে। আমি এক্ষুনি আসছি বলে এক দৌড়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এল সান্ত্বনা। তারপর সুকুমারবাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে কেঁদে ফেলল।
রক্ত! কপাল কেটে রক্ত পড়ছে!
ছি, এতেই তুমি কেঁদে ফেললে! হোঁচট খেয়ে পড়ে গেছলাম ইটের উপর।
শুধু একবার মুখের দিকে তাকাল সান্ত্বনা। দু-চোখে জল ঢলঢল করছে। ঠোঁট দুটো ভয়ে ফ্যাকাশে। মৃদু মৃদু কাঁপছে।
তুমি–তুমি মিথ্যে বোঝাচ্ছে আমাকে। প্রচণ্ড শব্দটা–তুমি সব জানো–সব জানো তুমি। ওগো বলো–বলো আমাকে। একেবারে কান্নায় ভেঙে পড়ল সান্ত্বনা।
কোনও কথা বলতে পারলেন না সুকুমারবাবু। গলাটা শুকিয়ে কাঠ। পা দুটো থরথর করে কাঁপছে এখনও।
.
দুপুরের আহারও নিঃশষে শেষ হল। একটা অজানা আতঙ্ক বিরাট পাথরের মতো বুকের উপর চাপানো আছে যেন।
বেলা দুটো নাগাদ আবার মেঘ জমতে শুরু করল আকাশে। ঠান্ডা হাওয়া বইছে। বাতাসে এখনও পচা পচা গন্ধ।
ঘরের মধ্যে আজেবাজে কাজ করে সময় কাটাতে চেষ্টা করলেন সুকুমারবাবু। বাড়ির বাইরে গেলেন না একবারও। কোনও কিছু ভাবতে পারছেন না আর। শুধু এক চিন্তা। এর পর কী হবে? আজ সকালের ঘটনায় জীবন আর ভবিষ্যতের বিশ্বাস একেবারে হারিয়ে গেছে। এই অদ্ভুত পরিস্থিতিতে কী করণীয় আছে আর? বুদ্ধিতে তো এর ব্যাখ্যা হয় না। মাঠের মধ্যে অদৃশ্য বস্তুটা তো সম্পূর্ণ অপার্থিব। একটা আশার আলো আছে এখন। সান্ধ্য দৈনিকে যদি কোনও ব্যাখ্যা মেলে এর। বিকেলবেলায় পাওয়া যাবে কাগজ। কোনও এক নতুন ধরনের উল্কা বলে মনকে বোঝাতে চেষ্টা করলেন সুকুমারবাবু।
বেলা চারটে নাগাদ সাইকেলের বেল শোনা গেল। কাগজওয়ালা এসেছে। সুকুমারবাবু দেওয়ালে তখন একটা পেরেক মারছিলেন। তাড়াতাড়ি হাতুড়িটা রেখে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেলেন। পাশের জানালা দিয়ে কাগজওয়ালাকে দেখা গেল। কী আশ্চর্য! কাগজ হাতে নিয়ে কাগজওয়ালার সঙ্গে কথা বলছে সান্ত্বনা! না, সান্ত্বনার বাইরে একা থাকা এখন আর উচিত নয়, মনে মনে ভাবলেন সুকুমারবাবু।
সিঁড়ি দিয়ে তাড়াতাড়ি নেমে এলেন। কাগজওলাকে জিজ্ঞাসা করতে হবে এ বিষয়ে। কিন্তু সমস্ত চিন্তা এক পলকে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল, শিউরে উঠল সমস্ত শরীর। বিচিত্র এক আওয়াজ শুনতে পেলেন। অনেক রকম আওয়াজ। সাইকেলের ক্রিং ক্রিং শব্দ, পুরুষ কণ্ঠে মৃদু আর্তনাদ, আর তার পরেই স্ত্রী কণ্ঠে এক বীভৎস চিৎকার আকাশ বাতাস চিরে ফেলল। সঙ্গে সঙ্গে এক দমকা হাওয়া বয়ে গেল গাছপালায় উপর দিয়ে।
দৌড়ে বড় রাস্তায় উপরে এসে দাঁড়ালেন সুকুমারবাবু। না, কেউ কোথাও নেই। রাস্তার ধারে পড়ে আছে সাইকেলটা। বহুদূর পর্যন্ত রাস্তা ফাঁকা, ধু ধু করছে। মাঠের মধ্যে তাকালেন সুকুমারবাবু। জনমানবের চিহ্ন নেই কোনওখানে। সান্ত্বনা আর কাগজওয়ালা যেন মন্ত্রের মতো অদৃশ্য হয়ে গেছে।
সামনেই এক আশ্চর্য ব্যাপার দেখতে পেলেন। আকাশ থেকে সবুজ আলোর বন্যা নেমেছে। আকাশের দিকে তাকালেন সুকুমারবাবু। মেঘের বুক চিরে সবুজ আলো সোজা নেমে এসেছে। আস্তে আস্তে আলোটা কমে এল। আলোটা বন্ধ হতেই আকাশের বুক থেকে ফড়ফড় করে অনেকগুলো সাদা কাগজ ঝরে পড়ল মাটির উপরে। মাটি থেকে একটা কাগজ কুড়িয়ে নিয়ে দেখলেন সুকুমাবাবু। আজকের সান্ধ্য দৈনিক। কাগজওয়ালার কাগজ। কাগজটা হাতে নিয়ে বাড়ির দিকে পা বাড়ালেন। সান্ত্বনাকে যদি বাড়ির মধ্যে পাওয়া যার। পাবার কোনও আশা নেই। তবুও অবুঝ মনকে বোঝাতে পারছেন না। সান্ত্বনার নাম ধরে চিৎকার করে ডাকলেন। ডাকতে ডাকতে গলা ভেঙে গেল। কিন্তু না, কোনও সাড়া মিলল না কোথাও। সান্ত্বনা চিহ্ন নেই কোনওখানে।
জানালার সামনে একটা চেয়ারে বসে পড়লেন সুকুমারবাবু। যন্ত্রণায় মাথা ছিঁড়ে পড়ছে। চিন্তাশক্তি যেন অবশ হয়ে পড়েছে। খবরের কাগজটা মেলে ধরলেন চোখের সামনে। সমস্ত অক্ষর যেন দুর্বোধ্য ঠেকছে। হঠাৎ এক আগায় চোখ দুটো থমকে দাঁড়াল–লাল বৃষ্টি.. বাতাসের উচ্চস্তরে লাল ধুলোর অস্তিত্ব… বৃষ্টির জলে অদ্ভুত জীবাংশ আবিষ্কার করে বৈজ্ঞানিকরা স্তম্ভিত… রাসায়নিকদের মতে লাল বৃষ্টির মধ্যে বেশির ভাগ রক্ত… ঝড়ের মতো চোখ বুলিয়ে গেলেন–আকাশের বুকে বিচিত্র আলোকচ্ছটা… লাল, নীল, সবুজ, বেগুনি, হলদে… বৈজ্ঞানিকরা নীরব…।
আস্তে আস্তে বিকেল গড়িয়ে সন্ধে এল। মেঘ কেটে দু-একটা করে তারা ফুটছে আকাশের বুকে। পূর্ব দিকে এখনও কালো মেঘের সমারোহ। আকাশপানে তাকিয়ে জানালার ধারে চুপচাপ বসে রইলেন সুকুমারবাবু। দু-চোখে এক অস্বাভাবিক দৃষ্টি। প্রচণ্ড মনের জোরের জন্যেই পাগল হননি এখনও। স্ত্রী-কণ্ঠে আর্তনাদ এখনও কানে ভেসে আসছে। মাঝে মাঝে সমস্ত ঘটনাটা যুক্তি দিয়ে বোঝবার চেষ্টা করছেন। হঠাৎ মনে হল মাঝে মাঝে তো কাগজে বেরোয় যে হ্যারিকেন বা টাইফুন ঝড় অনেক সময় মানুষকে বেশ কিছু দূর উড়িয়ে নিয়ে যায়। তেমন কি কোনও ঝড়ে সান্ত্বনা উড়ে গেছে। কিন্তু আশেপাশের গাছপালার উপর তো কোনও চিহ্ন নেই। ঝড় কি শুধু ওদের দুজনকে কেন্দ্র করেই হয়েছিল? তাও কি সম্ভব! বাজপাখির মতো নিঃশব্দে ছোঁ মেরে দু-জনকে নিয়ে মেঘের বুকে লুকিয়ে পড়েছে কোন সে জীব? সমস্ত কপালে ফোঁটা ফোঁটা ঘাম জমেছে।
পরিষ্কার আকাশ। তারায় তারায় তারাময়। রহস্যের কোনও সন্ধান নেই কোনওখানে। অজস্র আলোর স্রোতের মতো মনে হচ্ছে ছায়াপথকে।
হঠাৎ চমকে উঠলেন সুকুমারবাবু। রংবেরঙের আলোকচ্ছটা ধরা পড়ল তার চোখে। লাল, নীল, সবুজ, হলদে আলোর তির যেন ছুটে বেড়াচ্ছে আকাশময়। উত্তেজনায় চেয়ারটা জানালার আরও কাছে সরিয়ে নিয়ে আসলেন। অরোরা বোরেলিসের কথা বইতেই পড়া ছিল। কিন্তু সে তো মেরুপ্রদেশেই সম্ভব। তা ছাড়া এত অল্প জায়গা জুড়ে তা হবার কথা নয়। রংগুলো আরও স্পষ্ট হয়ে উঠল। কখনও কখনও দুটো আলোর তির পরস্পর পরস্পরকে যেন আলিঙ্গন করছে। চোখ দুটো ভালো করে রগড়ে নিয়ে তাকালেন আবার। না, সেই একই দৃশ্য।
কতক্ষণ তন্ময় হয়ে আলোর নাচন দেখেছিলেন তো মনে নেই সুকুমারবাবুর। আলোর মাঝে দুটো কালো বিন্দুও ধরা পড়ছিল ওর চোখে। হঠাৎ প্রচণ্ড ঝড়ের আওয়াজে সম্বিত ফিরল। ওর চোখের সামনে দুটো কালো বস্তু আকাশের বুক চিরে সজোরে আছড়ে পড়ল। বাগানের মধ্যে। একরকম দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলেন।
মাটিতে পড়ে থাকা বস্তুটাকে খুব চেনা চেনা মনে হল। ভালো করে দেখার জন্যে ঝুঁকে পড়লেন সামনের দিকে। বিশ্রী দুর্গন্ধে গা ঘুলিয়ে উঠল। সান্ত্বনা! দোমড়ানো মোড়ানো দেহটাই তো সান্ত্বনার! সাদা রং আরও ধবধবে সাদা হয়েছে। দু-হাতে করে চিত করে দিলেন দেহটাকে। উঃ, আগুনে যেন পুড়ে গেল হাত। কিন্তু এ তো আগুন নয়। মহাকাশে সীমাহীন ঠান্ডাকে মনে হয়েছিল আগুন বলে। মাথার মধ্যে কেউ যেন কাঁসর ঘণ্টা বাজাতে শুরু করল। কান চেপে ধরলেন দু-হাতে! বন্ধ হওয়া দূরের কথা, শত সহস্র গুণ জোরে বাজতে শুরু করল কাঁসর ঘন্টা।
নিস্তব্ধ চারপাশ। গাছের একটা পাতাও নড়ছে না। সময় যেন অনড় পাথরের মতো দাঁড়িয়ে। সান্ত্বনার মৃতদেহের পাশে আর একটা বীভৎস দেহ পড়ে ছিল। মনে হয় এক খণ্ড তরল মাংসপিণ্ড। এখানে ওখানে আবের মতো ফুলে ফুলে উঠছে। দুটো লম্বা লম্বা মোটা শুড় এখনও কিলবিল করছে। ড্যাবড্যাবে চোখ দুটো আকাশপানে স্থির হয়ে আছে। ঠিক ওর পাশেই বেশ বড় একটা ধাতুর ডিস্ক!
হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ… কে বলে আমার সান্ত্বনা নেই। ওই তো, ওই তো আমার সান্ত্বনা। সান্ত্বনা, সান্তনা শীত করছে তোমার? আহা, একটা জামাও নেই গায়ে। দাঁড়াও দাঁড়াও, এক্ষুনি আসছি, দেখো এক্ষুনি তুমি গরম হয়ে উঠবে। হ্যাঁ হ্যাঁ, যাব আর আসব।
সম্পূর্ণ উন্মাদ সুকুমারবাবু। দৌড়ে রান্নাঘরের মধ্যে চলে গেলেন। বোঝা বোঝা জ্বালানী কাঠ এনে ফেললেন মৃতদেহের উপর। বিরাট এক কাঠের স্তূপ হয়ে গেল। তারপর ভরতি দু-টিন কেরোসিন এনে ঢেলে দিলেন কাঠগুলোর উপর। দেশলাই কাঠি জ্বালার সঙ্গে সঙ্গে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল আগুন। লালে লাল হয়ে উঠল চারপাশ। হাততালি দিয়ে আগুনের চারপাশে নাচতে সুরু করলেন সুকুমারবাবু। লেলিহান শিখায় আগুন জ্বলছে। আগুনের লালাভায় ভয়ংকর প্রেতের মতো দেখাচ্ছে সুকুমারবাবুকে। হঠাৎ প্রচণ্ড আওয়াজ করে জ্বলন্ত চিতার মাঝখানটা ছিটকে উঠতেই কালো মতো কিছু যেন আকাশের বুকে উঠে গেল। কয়েকটা জ্বলন্ত কাঠের টুকরো বাড়ি ছাদে গোয়ালঘরের চালের উপর পড়ল। সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই সুকুমারবাবুর। ধিকি ধিকি করে আগুন জ্বলে উঠল ঘরে।
হঠাৎ একটা কথা মনে পড়ে গেল সুকুমারবাবুর, মাথার মধ্যে হাজার কণ্ঠে চিৎকার উঠল–সেই জিনিসটা, সেই জিনিসটা। গোয়ালঘর থেকে বিরাট এক কাঠের বোঝা নিয়ে উর্ধশ্বাসে মাঠের মধ্যে ছুটে চললেন। এতক্ষণে সমস্ত বাড়িটা জ্বলে উঠেছে। সেই আগুনের আলোয় পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে গর্তটা। কাঠের বোঝাটা গর্তের উপর ফেলে দিয়ে আরও কয়েক বোঝা কাঠ নিয়ে এলেন। গর্তটার উপর ভেসে রইল কাঠগুলো। কাঠের উপর এক টিন কেরোসিন ঢেলে জ্বলন্ত এক কাঠের টুকরো ছুঁড়ে ফেলে দিলেন ওর উপর। সমস্ত মাঠ লাল আলোয় ভরে গেল। কালো ধোঁয়ার সঙ্গে সঙ্গে আগুনের শিখাও আকাশ স্পর্শ করতে চলেছে। আগুনের কাছে দাঁড়িয়ে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন সুকুমারবাবু। আগুনের হলকায় পরনের কাপড়ে আগুন জ্বলে উঠল। সেদিকে দৃষ্টি দেবার সময় নেই এখন। হাঃ হাঃ করে হেলে উঠলেন সুমারবাবু। ওই তো, ওই তো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। বিচিত্ৰদৰ্শন বহু যন্ত্রপাতি ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। যন্ত্রটার আশপাশে অনেকগুলো কিম্ভুতকিমাকার চেহারা কিলবিল করছে।
হিস্ হিস্ শব্দ উঠতে লাগল যন্ত্রটা থেকে। হাঃ হাঃ করে হাসতে হাসতে আগুনের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়লেন সুকুমারবাবু। আর তৎক্ষণাৎ বিকট আওয়াজে আগুনের স্তূপটা ফেটে চৌচির হয়ে গেল। সমস্ত মাঠময় ছড়িয়ে পড়ল জলন্ত কাঠের টুকরোগুলো।
.
০৪.
৩০ মার্চ দুপুর প্রায় দুটো নাগাদ ক্যাপ্টেন আর পি বার্নওয়াল সরকারি কাজে দিল্লি যাচ্ছিলেন। নিজেই চালাচ্ছিলেন প্লেনটা। দমদম বিমানঘাঁটি থেকে টেক অফ করার পাঁচ মিনিট পর পর্যন্ত প্লেনটার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে প্লেনটার কোনও খোঁজ না পেয়ে এক সন্ধানী দল পাঠানো হল ওর খোঁজে। ৩১ মার্চ ভোরে প্লেনটার খোঁজ পাওয়া গেল মামুদপুরে সুকুমার ঘোষের ভস্মীভূত বাড়িটার সামনে। একেবারে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেছে প্লেনটা। কিন্তু ক্যাপ্টেনের কোনও খোঁজ পাওয়া গেল না। তখন মাঠঘাট সব তন্ন তন্ন করে খোঁজা শুরু হল। ঘণ্টা খানেক পরে মাইল দুই দূরে এক মাঠের মাঝে ক্যাপ্টেন বার্নওয়ালের সন্ধান পাওয়া গেল। পাগলের মতো বিড়বিড় করে বকছেন আর এলোমেলো পায়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন ক্যাপ্টেন। ওর বক্তব্য এত অদ্ভুত অবিশ্বাস্য যে সকলে মনে করল ক্যাপ্টেন নওয়ালের বোধহয় অ্যাকসিডেন্টে মাথা খারাপ হয়ে গেছে। কলকাতায় এক বিখ্যাত নার্সিং হোম চিকিৎসার ভার নিল। কিন্তু আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান ব্যর্থ হল। বেশ কয়েক দিন পরে বিষাক্ত ক্ষতে মারা গেলেন ক্যাপ্টেন বার্নওয়াল। ওর কাছ থেকে দুটো জিনিস পাওয়া গেছিল। নার্সিং হোমে ভরতি হওয়ার পরে লেখা কয়েকটা কাগজ মৃতদেহের পকেট থেকে পাওয়া যায়। লেখা পাতা ক-টা আমি তুলে দিলাম এখানে।
আপনাদের উপরে ছেড়ে দিলাম আমার বিচারের ভার। আপনারা বিচার করুন যে আমি পাগল না হ্যালুসিনেশনে ভুগছি। জানেন, সবকিছু স্বপ্ন বলে মনে হয় মাঝে মাঝে। নিজের চোখ-কানুকে আর বিশ্বাস হয় না। দেখা, শোনার ভুল বলে হয়তো উড়িয়ে দিতে পারতাম। সমস্ত ঘটনাটা। কিন্তু আমার কাছে যে কালো ডিস্কটা আছে। ডিস্কটা তো আর স্বপ্ন নয়। না না, বিশ্বাস করুন আপনারা। আমার প্রতিটি কথা নির্জলা সত্যি। বিন্দুমাত্র আতিরঞ্জিত নয়।
৩০ মার্চ বেলা ২ টো ১০ মিনিটে প্লেন নিয়ে আকাশে উড়লাম। গন্তব্য দিল্লি। কিছুক্ষণের মধ্যে র্যাডারে ঝড়ের সংকেত পেলাম। স্তরে স্তরে মেঘ জমছে আকাশের গায়ে। সুতরাং মেঘ ছাড়িয়ে উপরে উঠে গেলাম। মেঘের আস্তরণে ঢাকা পড়ে গেল পৃথিবী। প্রথমে ছয় হাজার ফুট, তারপর সাত হাজার এবং শেষে নয় হাজার ফুট উঁচু দিয়ে প্লেন চালালাম।
অকস্মাৎ সেই অদ্ভুত ব্যাপারটা ঘটল। সবুজ আলোর বন্যায় ভেসে গেল আমার প্লেন। প্লেনের ইঞ্জিন আর পাখা পূর্ণোদ্যমে গর্জন করা সত্ত্বেও স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল প্লেনটা। অলটিমিটারের দিকে তাকালাম। এ কী! ১৩০০০-১৫০০০ মিটার… ঝড়ের মতো বেগে উপরে উঠে যাচ্ছে প্লেন! আরও আরও উপরে। এক বিচিত্র অনুভূতি বোধ করছি এখন। ঊর্ধ্বগতি রোধ করার চেষ্টা করলাম। কিছুই হল না। তাড়াতাড়ি অক্সিজেন মাস্ক আর প্রেসারাইজড বৈদ্যুতিক তাপ সমন্বিত প্রেসার স্যুট পরে নিলাম। এ দুটো আমার বরাবরের সঙ্গী। উচ্চতা এখন ৪০০০০ মিটার। এরপর মিটারটা জমে অকেজো হয়ে গেল।
সমস্ত ঘটনা এত দ্রুত ঘটছে যে আমি কী করব কিছুই ভেবে পেলাম না। প্রেসার স্যুটের মধ্যেই ঠান্ডা অনুভব করলাম। উচ্চতা এখন কত তা কে জানে! মনে হল বায়ুমণ্ডলের উচ্চস্তরে রয়েছি আমি। Absolute zero-তে হয়তো এক্ষুনি জমে যাব। সমস্ত প্লেনটা অনেক আগেই ঠান্ডায় জমে গেছে। বেশ বুঝতে পারছি পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের শেষ স্তর। উঃ, কী প্রচণ্ড ঠান্ডা! এই কি আমার শেষ!
ঠিক এমন সময়ে খুব অস্পষ্ট ক্লিক ক্লিক্ শব্দ আমার কানে এল। এখন আর চারপাশে সবুজ আলো নেই। কোনও তারাও দেখা যাচ্ছে না। হঠাৎ দেখতে পেলাম একটু দূরে দুটো মৃতদেহ ভাসছে। কনকনে ঠান্ডা স্রোত যেন বয়ে গেল মেরুদণ্ড দিয়ে। এ কী রহস্য! আমি স্বপ্ন দেখছি না তো? আমি কি মারা গেছি। ভাসমান মৃতদেহগুলো প্রতি মুহূর্তে বিভীষিকা সঞ্চার করতে লাগল।
একটা স্পষ্ট আওয়াজে উপর দিকে তাকালাম। কোনও কিছু দেখার কোনও অভিপ্রায় ছিল না আমার। কী কী দেখলাম সে নিয়ে হাজার প্রশ্ন জাগল আমায় মনে। কয়েক ফুট উপরে কিছু ধোঁয়া ধোঁয়া মেঘ ভাসছে। সত্যি কি মেঘ! মেঘ না অন্য কিছু! অবয়বহীন অতীন্দ্রিয় কোনও কিছু যেন মূর্তি পরিগ্রহ করছে আমার সামনে। ভাসমান এক জীবন্ত মেঘকে দেখছি আমি। অস্পষ্ট দু-চোখের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি যেন মন্ত্রমুগ্ধ করল আমাকে। কিন্তু সত্যি কোন চোখ ছিল কি না কে জানে! আমার মনের উপর কেউ যেন প্রভুত্ব বিস্তার করছে। ধীরে ধীরে সম্মোহিত হয়ে পড়ছি। ককপিটের বাইরে চলে আসতে আদেশ করল জীবটি।
মাটি থেকে হাজার হাজার মিটার শূন্যে প্লেন থেকে বেরোতে হবে? এটা কি আত্মহত্যার শামিল নয়? জোর করে সিটে বসে থাকার চেষ্টা করলাম। কিন্তু পারলাম না। হাত পা দেহ মন কোনও কিছুই আর আমার বশে নেই। আস্তে আস্তে ককপিটের মধ্যে দিয়ে মহাশূন্যের মধ্যে এসে দাঁড়ালাম।
আমার তো এখন নিচে পড়ে যাওয়া উচিত। কিন্তু মনে হল কোনও শক্ত কিছুর উপর দাঁড়িয়ে আছি। এখানে কোনও ঠান্ডা নেই। অজানা আতঙ্কে কেঁপে উঠলাম। চোখে মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম ফুটে উঠল। আর জীবনে এই প্রথম মৃত্যুভয়ে শিউরে উঠলাম।
অদৃশ্য চালকের নিঃশব্দ আদেশে একটা অদৃশ্য ছোট দরজার সামনে এসে দাঁড়ালাম। নিঃশব্দে দরজা খুলে গেল, দরজার মধ্যে দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলাম। একটু দূরে বায়বীয় জীবটিকে দেখা যাচ্ছে। আমার চারপাশে এ কী দৃশ্য!
অতি জটিল বিশাল এবং সুক্ষ্ম যন্ত্র এখানকার চারপাশে। দূরে বড় বড় মিটারে ডায়াল, কনট্রোল লিভার প্রভৃতি আরও কত কী! বেশির ভাগ যন্ত্র আমার কাছে দুর্বোধ্য। প্রতিটি যন্ত্রের সামনে একটি করে বায়বীয় জীব ভাসছে।
বেশ বুঝতে পারছি অতিকায় এক মহাকাশযানের মধ্যে রয়েছি আমি৷ এর চারপাশের দেওয়াল অদৃশ্য। পায়ের তলায় অদৃশ্য শক্ত মেঝে। অথচ আকাশের কোনও তারাকে দেখা যাচ্ছে না।
এগিয়ে যাবার আদেশ এল। সামনের দিকে এগিয়ে চললাম। মনের মধ্যে আর কোনও ভয় নেই। কেমন যেন এক অনাবিল শান্তি আমার দেহ মনে ছড়িয়ে পড়ছে।
এই বিচিত্র অনুভূতি কেমন করে বোঝাব আপনাদের। মুহূর্তের মধ্যে চিরাচরিত জগৎ ছেড়ে এমন এক অদ্ভুত রোমাঞ্চকর পরিবেশের সম্মুখীন না হলে কেউই বুঝবে না আমার কথা। হঠাৎ আমার সামনে ভাসমান মূর্তিটা অদৃশ্য হয়ে গেল। মনে হল এখন এক সুন্দর। স্বপ্ন দেখব আমি। সঙ্গে সঙ্গে আমার মনের উপর পর পর একাধিক অসম্ভব অবাস্তব চিত্রের প্রক্ষেপ শুরু হল। পরস্পরের ভাষা বুঝি না আমরা। অথচ কী বিচিত্র উপায়ে পরস্পরের মনের ভাষা বুঝতে পারছি!
দেখলাম এক অতিকায় বিচিত্ৰদৰ্শন মহকাশযানের ভেতরে রয়েছি আমি। আমার বায়বীয় নিয়ন্ত্রার নাম চিংকুরা। এক বিপজ্জনক অভিযানের নায়ক। শনিগ্রহের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে এর উপর। শুধু শনি গ্রহ কেন, আমাদের পৃথিবীর অস্তিত্বও এই একটিমাত্র অভিযানের উপর নির্ভর করছে।
হাজার হাজার বছর ধরে সভ্যতার ক্রমবিকাশ ঘটেছে শনি গ্রহে। শত সহস্র গ্রহে যে জীবনী শক্তির বিকাশ হয়েছে, সেই জীবনী শক্তিই শনিগ্রহে স্বচ্ছ বায়বীয় জীবনের সৃষ্টি করেছে। আজ থেকে অনেক বছর আগে নিজেদের গ্রহের গভীরে ওরা আবিষ্কার করেছিল এই মহাবিশ্বের এক দুর্লভতম আকরিক খনিজ ধাতুকে। মাত্র কয়েক হাজার টন আকরিক ধাতু আছে শনি গ্রহে৷ আর এর থেকে পরিশোধিত করে পাওয়া গেছে অতি অল্প টুসান ধাতু।
সবদিক থেকে এ এক বিচিত্র ধাতু। শূন্য ডিগ্রিতে টুসান শৈত্য নিরোধক। আবার অতিরিক্ত উত্তপ্ত হলে এ এক প্রচণ্ড বিস্ফোরক পদার্থে পরিণত হয়। এর সবচেয়ে আশ্চর্য গুণ হল যে বিশুদ্ধ অবস্থায় টুসান মাধ্যাকর্ষণ শক্তিকে সম্পূর্ণরূপে প্রতিহত করে। মানে একখণ্ড বিশুদ্ধ টুসানকে কোনও ফাঁকা জায়গায় রেখে দিলে সেই গ্রহের কেন্দ্রাতিগ শক্তিবলে মুহূর্তের মধ্যে মহাশূন্যে উধাও হয়ে যাবে। কোনও মাধ্যাকর্ষণ শক্তি ধরে রাখতে পারবে না। একেবারে স্বচ্ছ হওয়ার মতন অদৃশ্য বিশুদ্ধ টুসান ধাতুর পেছনে রাখা কোনও বস্তুকে কিন্তু দেখা যায় না এর মধ্যে দিয়ে। মানে এক কথায় বলা যায় টুসান ব্লাইন্ড স্পটের সৃষ্টি করে।
টুসানের সঙ্গে যদি অন্য কোনও ধাতু মেশানো থাকে তখন সে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির আওতার মধ্যে পড়ে। শনিগ্রহবাসীরা তাই এর সঙ্গে কিছু অন্য ধাতু মিশিয়ে বা টুসানের চারপাশে অন্য ধাতুর প্রলেপ লাগিয়ে টুসানকে অনেক কাজে লাগায়।
এই ধাতু আবিষ্কারের জন্যে অনেক খোঁজ করেছিল ওরা। কিন্তু আর কোনও নক্ষত্রের বর্ণালীর মধ্যে টুসানের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। সুতরাং এই দুষ্প্রাপ্য ধাতুকে আত্মরক্ষা এবং আক্রমণ করা এই দুই কাজে লাগিয়েছে ওরা। একটিমাত্র অতিকায় মহাকাশযান তৈরি হয়েছে অতি বিশুদ্ধ টুসান দিয়ে। ধ্বংসাত্মক রশ্মি সমেত প্রতিটি আধুনিক মারণাস্ত্রে সজ্জিত এই মহাকাশন। এ মহাকাশযান দেখা যাবে না বটে, তবে তারাদের অতিক্রম করে যাবার সময় তারাদের আলোকে প্রতিহত করে এক ব্লাইন্ড স্পটের সৃষ্টি করবে।
মহাকাশযানের মধ্যে বেশ কিছু অন্য ধাতুর বড় বড় পাত রাখা আছে। যানের ভেতর থেকে রেডিয়ো মারফত কনট্রোল করা হয় এগুলোকে। এই পাতগুলোকে মহাকাশযানের বাইরে বার করে যানের গতি নিয়ন্ত্রণ করা এবং যে কোনও গ্রহে নামা-ওঠা সম্ভব হয়।
কয়েকশো বছর আগে এই যানে করেই চিংকুরারা সৌরজগতের প্রতিটি গ্রহে অভিযান চালিয়ে তথ্য সংগ্রহ করেছিল। আমাদের সৌরজগতের বাইরে ছায়াপথের বহু দূর পর্যন্ত পাড়ি জমিয়েছে ওরা। কারণ সীমাহীন এই মহাকাশযানের গতি।
যাক, কোনও গ্রহ থেকে বিপদের কোনও আভাস না পেরে মহাকাশযানটি সদা প্রস্তুত করে রেখে দিয়েছিল ওরা।
কিন্তু সর্বনাশের দুন্দুভি বেজে উঠল একদিন। বহু দূর পর্যন্ত মহাকাশের প্রতিটি গ্রহ নক্ষত্রের ওপর তীক্ষ্ণ নজর রাখত সেন্ট্রাল অবজারভেটরি। হঠাৎ একদিন দেখা গেল পর পর কয়েকটা তারা অদৃশ্য হয়ে গেল মুহূর্তের জন্য। এবং এই অদৃশ্য হওয়া তারাগুলো আমাদের সৌরজগতের সঙ্গে এক সরলরেখায় অবস্থিত।
তারাদের এই অদ্ভুত আচরণের একটিমাত্র ব্যাখ্যাই সম্ভব। ওদের টেলিস্কোপের আওতার বাইরে নিশ্চয়ই কোনও গ্রহে টুসানের অস্তিত্ব বর্তমান। আর সেই টুসান দ্বারা নির্মিত মহাকাশযান ছুটে আসছে আমাদের সৌরজগতের দিকে। না, একটা নয়। পর পর তিনটে মহাকাশযানের অস্তিত্ব ধরা পড়তেই সমস্ত বিস্ময় ওদের দারুণ আতঙ্কে পরিণত হল।
সময় বেশি নেই আর। হিসেব করে দেখল ওরা যে আগন্তুকরা সোজা পৃথিবীর দিকে যাবে। তারপর পৃথিবীকে মূল ঘাঁটি করে ধাওয়া করবে শনির দিকে। সুতরাং যেমন করেই হোক ওদের বাধা দিতে হবে। কিন্তু বহুদিন অব্যবহারের ফলে ওদের ওই মহাকাশযানের পক্ষে এত দ্রুতগতি সঞ্চয় করা সম্ভব ছিল না। তাই অতি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বিস্ফোরকের সাহায্যে মহাশূন্যে ছুঁড়ে দেওয়া হল মহাকাশযানটিকে। তার এতে প্রাথমিক অ্যাস্কিলারেশনের কাজ হল।
পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের বাইরে সাক্ষাত হল দু-দলের। অতর্কিতে লাল রশ্মি দিয়ে আক্রমণ করল চিংকুরা। মুহূর্তের মধ্যে আক্রমণকারী প্রথম মহাকাশ যানটা সমস্ত আরোহী সমেত লালচে রঙের ছাইয়ে পরিণত হয়ে পৃথিবীর বুকে ঝরে পড়ল। আবার আক্রমণ করল চিংকুরা। কিন্তু এবারে বিফল হতে হল। দ্বিতীয় ও তৃতীয় মহাকাশযান দ্রুত নেমে এল নিচের দিকে। তারপর দ্বিতীয় মহাকাশযানকে আর দেখতে পেল না চিংকুরা। কয়েকজন যাত্রী ছিটকে বাইরে বেরিয়ে এসেছিল মহাকাশযান থেকে। শক্তিশালী দূরবীন দিয়ে ভালো করে দেখল চিংকুরা। কী এক অজ্ঞাত কারণে পৃথিবীর বুকে আছড়ে পড়েছে দ্বিতীয় মহাকাশযান। যাক, তাহলে দুটো ধ্বংস হল। এবার মহাকাশযান থেকে ছিটকে পড়া একজন শত্রুকে চৌম্বকশক্তিসম্পন্ন সবুজ রশ্মি দিয়ে ধরে নিয়ে এল। আর বন্দীর কাছ থেকেই জানা গেল আক্রমণকারীদের উদ্দেশ্য।
শত্রুদের বাসস্থানের কোনও পরিচয় মিলল না। চিংকুরার জানা গ্যালাক্সি বা নেবুলা ছাড়িয়ে মহাকাশের বহু দূরে ওদের গ্রহ। একেবারে অন্তিম মুহূর্তে নিজেদের গ্রহে টুসান আবিষ্কার করেছিল ওরা। এক বিশালকায় জ্বলন্ত নক্ষত্র ছুটে আসছে ওদের গ্রহের দিকে। নষ্ট করার মতো কোনও সময় ছিল না হাতে। সমস্ত টুসান দিয়ে তিনটে অতিকায় মহাকাশযান তৈরি করে ফেলল ওরা। সকল অধিবাসীকে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাবার পক্ষে তিনটে মহাকাশযান খুব নগণ্য। ঠিক এমন সময়ে শনি গ্রহের বর্ণালীর মধ্যে এই মহামূল্যবান ধাতুর সাক্ষাৎ পেল। ব্যাস। কর্মপদ্ধতি ঠিক হয়ে গেল। শনির টুসান থেকে আরও কয়েকটা মহাকাশযান তৈরি করে ফেললেই সব সমস্যার সমাধান হয়।
সুতরাং একদিন প্রত্যেক মহাকাশযানে হাজার জন যাত্রী নিয়ে ওরা আমাদের সৌরজগতের দিকে যাত্রা শুরু করল। ঠিক হল একটা মহাকাশযান পৃথিবীতে অবতরণ করে মারাত্মক বেগুনি রশ্মি দিয়ে সমস্ত জীবকুলকে নিশ্চিহ্ন করে দেবে। তারপর পৃথিবী হবে ওদের প্রধান ঘাঁটি। অপর দুটো মহাকাশযান যাত্রা করবে শনিগ্রহ অভিমুখে। উদ্দেশ্য, শনিগ্রহ দখল করে টুসান অধিকার করা।
একটি বাস্তব সম্ভাবনাকে আমল না দেওয়ার জন্যে ওদের দুটো মহাকাশযান ধ্বংস হল। ওরা ভেবেছিল শনি গ্রহে টুসান বুঝি এখনও আকরিক অবস্থায় রয়েছে। আর সে জন্যেই নিজেদের অজেয় ভেবেছিল। সাবধানতার কথা মোটেই মাথায় আসেনি ওদের।
এবার তৃতীয় মহাকাশযান সতর্ক হয়ে গেল। সারাদিন ধরে দুই মহাকাশযানের লুকোচুরি খেলা চলল। এদের হার জিতের উপরই নির্ভর করছে আমাদের ভবিষ্যত।
চিংকুরা একটা প্রকাণ্ড ধাতব ডিস্ক দেখাল আমাকে। চেয়ে দেখলাম ঠিক ডিস্কটার মাঝখানে আমাদের মহাকাশযানকে দেখা যাচ্ছে। বুঝলাম এটা টেলিভিশন। একটু দূরেই শত্রুদের মহাকাশযান।
কী করণীয় আছে আমার? আমাকে তোমাদের প্রয়োজনই বা কী? নিঃশব্দে এই দুটো প্রশ্ন করলাম চিংকুরাকে। উত্তরও পেলাম সঙ্গে সঙ্গে। এখানে করার আমার কিছু নেই। আমার প্রধান কাজ হল পৃথিবীর সকলকে সাবধান করে দিতে হবে। সকলকে জানাতে হবে এই বিপদের কথা।
কিন্তু আমি ফিরে যাব কী করে? প্রশ্ন করার সঙ্গে সঙ্গে কালো একটা ডিস্ক দিয়ে এর ব্যবহার প্রণালীও বলে দিল চিংকুরা।
হঠাৎ আমার মনের মধ্যে চিংকুরা বলে উঠল–দেখো দেখো। চূড়ান্ত জয় পরাজয় এক্ষুনি স্থির হবে যাবে। এবং সঙ্গে সঙ্গে বাইরের চেম্বারের মধ্যে ঠেলে ফেলে দিল আমাকে। এই ঘর পার হয়ে মহাকাশযানে প্রথম প্রবেশ করেছিলাম আমি। শেষবারের মতো চিংকুরার ধোঁয়া ধোঁয়া চেহারা দেখলাম। আমাকে ও শেষ শুভেচ্ছা জানাল। আমিও আন্তরিক ধন্যবাদ দিলাম। মনে মনে বললাম, জয়ী হও তোমরা। পরক্ষণেই আমার সামনের দরজা বন্ধ হয়ে গেল। ডিস্কটাকে মাথার উপর ধরে চিংকুরার নির্দেশমতো পরিচালনা করলাম। সঙ্গে সঙ্গে নিচে নামতে শুরু করলাম আমি। আমার পাশ দিয়ে আমার প্লেনটা এবং দুটো মৃতদেহ সমেত একটা শত্রুর মৃতদেহও ঝড়ের বেগে নিচে নামতে শুরু করল। মৃতদেহের দিকে তাকাতেই একটা জিনিস পরিষ্কার হয়ে গেল। সবুজ রশ্মি দিয়ে আমার প্লেনটা টেনে নেবার সময় পৃথিবীর বুকে এই দুই মানুষের উপর পড়েছিল রশ্মিটা। আর তাইতেই মহাশূন্যের মধ্যে আমার প্লেনের পাশে ভাসছিল মৃতদেহ দুটো।
নেমে আসার সময় আমার মনে এক ভয়ংকর দৃশ্য ফুটে উঠল। আকাশের দিকে তাকালাম। হলদে আর সবুজ রশ্মির সঙ্গে লাল আর বেগুনি রশ্মিতে আকাশ রঙিন হয়ে উঠেছে। আমার দু-পাশ দিয়ে হু হু করে বাতাস বইছে। ধীরে ধীরে নিচে নামছি। পৃথিবী এখন অনেক দূরে। মনের মাঝে চিংকুরার ছবি মাঝে মাঝে আমাকে আশ্বস্ত করছিল। আবার আকাশের দিকে তাকালাম। কিন্তু এ কী দেখলাম! শুধু লাল আর বেগুনি রশ্মি সার্চলাইটের মতো আকাশটাকে ফালা ফালা করে ফেলছে। আর কোনও রশ্মির চিহ্ন নেই কোথাও!
ডাক্তার বলেছে আমায় গ্যাংগ্রিন হয়েছে। হতে পারে। অত উচ্চতায় যে জমে যাইনি সেটাই আশ্চর্য। সবাই ভাবছে আমি পাগল। প্লেন অ্যাকসিডেন্টে মাথা খারাপ হয়ে গেছে। অনেক চেষ্টা করেছি বোঝাতে। হতে পারে ঠিকমতো সাজিয়ে গুছিয়ে বলতে পারছি না আমি। কিন্তু আমি শপথ করে বলছি আমার এই লেখার মধ্যে এক বিন্দু মিথ্যে নেই। অবশ্য আমার কথা বিশ্বাস না করলেও খুব শীঘ্রই সব কিছু বিশ্বাস করতে হবে। কিন্তু তখন আর বাঁচবার কোনও পথ থাকবে না। আপনারা শুনুন, হেরে গেছে চিংকুরা। জয়ী হয়েছে লাল আর বেগুনি রশ্মি!
স্বা: ক্যাপ্টেন আর. পি. বানওয়াল।
.
০৫.
ক্যাপ্টেন বার্নওয়ালের মৃত্যুর পর ওর গদির তলা থেকে একটা কালো ডিস্ক পাওয়া যায়। নার্স কোনও কিছু বুঝতে না পেরে ডাক্তারের কাছে নিয়ে আসে ডিস্কটাকে।
ডাক্তার উলটেপালটে দেখলেন। ব্যাস বোধহয় এক ফুট হবে। মাঝখানটা একটু উঁচু। ডিস্কটার পাশে এক ধারে খুব ছোট ছোট নব লাগানো।
নবগুলো একটু ঘোরাতেই অস্পষ্ট একটা ক্লিক করে শব্দ শোনা গেল। সঙ্গে সঙ্গে ডিস্কটার চারপাশ থেকে একটা কালো আচ্ছাদন মাটিতে খুলে পড়ল। সভয়ে হাতের দিকে চেয়ে দেখলেন ডাক্তার। কোনও কিছু নেই হাতে। অথচ স্পষ্ট অনুভব করছেন ডিস্কটাকে। পরক্ষণেই ডাক্তারের হাত ছাড়িয়ে স্কাই লাইটের কাঁচ চূর্ণবিচূর্ণ করে সজোরে আকাশে উড়ে গেল ডিস্কটা।
[প্রথম প্রকাশ: আশ্চর্য!, জুন ১৯৭১]