বিশ্বমামার ম্যাজিক
বিশ্বমামা বললেন, আয় তো রে নীলু আর বিলু। তোদের একটা ম্যাজিক দেখাই। কাছে আয়, কাছে আয়। হাতে বাড়িয়ে দে। আমাদের বিশ্বমামা সারাবিশ্ব ঘুরে বেড়ান। কখন যে কোথায় থাকেন, তার ঠিক নেই। কখনো হনুলুলু, কখনো ম্যাডাগাস্কার। ওঁর নামের সঙ্গে স্বভাবটা বেশ মিলে গেছে। বিশ্বমামা নিজেই বলেন, জানিস, ছোটোবেলায় আমি যখন খুব দুষ্টুমি করতাম, তখন বাবা আমাকে বকুনি দিয়ে বলতেন, ছেলে একেবারে বিশ্ববখাটে হয়েছে! দেখ, আমি সত্যি সত্যি তাই হয়েছি।
এবারে তিনি গিয়েছিলেন হিমালয়ের কোন এক দুর্গম অঞ্চলে।
তাতে আমরা বেশ নিরাশই হয়েছিলাম। কারণ বিদেশে গেলে বিশ্বমামা আমাদের জন্য অনেক রকম চকোলেট আর টফি আনেন। প্রত্যেকবার নতুন নতুন ধরনের। সেই জন্য উনি ফিরলেই আমরা ওঁর চারপাশে লোভে লোভে ঘুরি। মা বারণ করে দিয়েছেন, কিছুতেই বিশ্বমামার কাছে থেকে কিছু চাওয়া চলবে না, কারণ, তাহলে সবাই হ্যাংলা বলবে। আর বিশ্বমামাও এমন, ফেরার পরই যে আমাদের চকোলেটগুলো ভাগ করে দেবেন, তা নয়। নিজের কাছে রেখে দেবেন আর এমন ভাব দেখাবেন, যেন কিছুই আনেননি। তারপর দু-দিন-তিন দিন পর হঠাৎ সেগুলো বার করবেন।
এবারে যে চকোলেট আনেননি, তা তো বোঝাই যাচ্ছে। হিমালয়ে তো আর চকোলেট পাওয়া যায় না।
বিদেশের বদলে হিমালয়ে কেন গিয়েছিলেন, তা-ও বলা মুশকিল। বিশ্বমামা যে সরাসরি কোনো প্রশ্নের উত্তর দেন না।
বিলুদা জিজ্ঞেস করেছিল, উনি উত্তর দিয়েছিলেন, ঘাস রং করতে!
এমন অদ্ভুত কথা কেউ শুনেছে? ঘাস রং করা মানে কী? ঘাসে আবার কেন লোকে রং লাগাতে যাবে?
যাই হোক, বিশ্বমামার ম্যাজিক দেখার জন্য আমি আর বিলুদা কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়ালাম।
বিশ্বমামা একটা হাতে মুঠো করে কী যেন ধরে আছেন। সেটা দেখাবার আগে তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, হ্যাঁরে নীলু, তোর ছোটোকাকার কিডনিতে পাথর হয়েছিল। অপারেশন করে সত্যি একটা পাথর পাওয়া গিয়েছিল, তাই না?
যাই হোক, বিশ্বমামার ম্যাজিক দেখার জন্য আমি আর বিলুদা কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়ালাম।…
আমি মাথা নেড়ে বললাম, হ্যাঁ, আমি দেখেছি! মাঝারি সাইজের একটা গুলির মতন।
বিশ্বমামা বললেন, সেই পাথরটার গন্ধ শুঁকে দেখেছিস?
আমি বললাম, না তো, গন্ধ শুঁকব কেন?
বিশ্বমামা এবার বিলুদাকে জিজ্ঞেস করলেন, বিলু, ছুঁচো দেখেছিস? ছুঁচোর গায়ে কেন গন্ধ থাকে বল তো!
বিলুদা বলল, তা আমি কী করে জানব?
বিশ্বমামা বললেন, জানিস না। ও, তাহলে আর কী করে হবে!
বিলুদা বলল, ছুঁচোর গায়ে কেন গন্ধ থাকে তা জানি না বলে তুমি আমাদের ম্যাজিক দেখাবে না?
বিশ্বমামা বললেন, হ্যাঁ, দেখাব ম্যাজিক। যদি ধরতে পারিস, তাহলে আজ সন্ধ্যেবেলা চাইনিজ খাওয়াতে নিয়ে যাব। আর যদি না-পারিস, তাহলে পাঁচটা করে অঙ্ক কষতে হবে।
বিশ্বমামা বসে আছেন একটা টেবিলের একধারের চেয়ারে। আমরা টেবিলের অন্য ধারে।
তিনি বললেন, একে একে আয়। আগে কে?
বিলুদা সব ব্যাপারেই আমার ওপর সর্দারি করে। ও তো আগে যাবেই। মুখে কিছু না-বলেই আমাকে ঠেলে এগিয়ে গেল।
বিশ্বমামা যে হাতটা মুঠো করা সেটা লুকোলেন টেবিলের তলায়। অন্য হাতটা দিয়ে বিলুদার বাঁ-হাত আর ডান হাত একবার করে টিপে টিপে দেখলেন। তারপর বললেন, ডান হাতটাই ঠিক আছে।
বিলুদার ডান হাতটা টেবিলের তলায় নিয়ে কী যেন করলেন। তারপর বললেন, ঠিক আছে। এবার তোর ডান হাতের তালুর গন্ধ শুঁকে দেখ তো বিলু!
বিলুদা হাতখানা নাকের কাছে নিয়ে এল! তার মুখখানা কেমন যেন অদ্ভুত হয়ে গেল। একটা গন্ধ সে পাচ্ছে বটে, কিন্তু চিনতে পারছে না।
বিশ্বমামা বললেন, একটা গন্ধ পাচ্ছিস?
বিলুদা মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, হ্যাঁ।
বিশ্বমামা বললেন, তোর হয়ে গেল। এবার নীলু তুই আয় কাছে।
আমি পাশে দাঁড়াতেই বিশ্বমামা আমারও দু-হাত টিপে দেখলেন। তারপর বাঁ-হাত নিয়ে গেলেন টেবিলের তলায়। কী যেন একটা শক্ত মতন জিনিস ঘষে দিলেন আমার হাতের তালুতে।
আমি হাতটা নাকের কাছে নিয়ে এসে গন্ধ শুঁকলাম। আমারও অচেনা লাগল গন্ধটা। কিন্তু বেশ তীব্র গন্ধ।
বিশ্বমামা বললেন, ব্যস হয়ে গেছে! কী ব্যাপারটা হল বুঝলি?
বিলুদা আপত্তি জানিয়ে বলেন, এ আবার কী ম্যাজিক? তুমি আমার ডান হাতে কিছু একটা ঘষে দিল। তাতে গন্ধ মাখানো ছিল, তাই আমার হাতে গন্ধ হয়েছে। এতে বোঝার কী আছে?
বিশ্বমামা বললেন, ওঃ হো, আসল কথাটাই বলিনি বুঝি! বিলু, তোর ডান হাতে জিনিসটা ঘষেছি তো? ডান হাতে গন্ধ হতেই পারে। এবার বাঁ-হাতটা শুঁকে দেখ! বাঁ-হাতে তো কিছু ঘষিনি?
বিলুদা নিজের বাঁ-হাত শুঁকল। আমিও আমার ডান হাতটা শুঁকলাম। সত্যি তো, অন্য হাতেও গন্ধ এসে গেছে! এ তো সত্যি আশ্চর্য ব্যাপার।
বিশ্বমামা নিজের বাঁ-হাত তুলে দেখালেন। সে হাতে কিছু নেই। ডান হাতটা মুঠো করা অবস্থায় উঁচু করলেন। তারপর মুচকি হেসে বললেন, তোদের একটি হাত ঘষে দিলাম। সেই হাতের গন্ধ এত তাড়াতাড়ি শরীরের মধ্যে দিয়ে অন্য হাতে চলে এল কী করে? এই হল ম্যাজিক। যা:, চিন্তা কর গিয়ে! বিকেলের মধ্যে বলতে না-পারলে কিন্তু চাইনিজ খাওয়াতে নিয়ে যাব না!
আমরা দু-জন সারাদুপুর ভাবলাম। মাথামুন্ডু কিছুই বোঝা গেল না। বিলুদা আমার ছোড়দির একটা সেন্টের শিশি লুকিয়ে নিয়ে এসে তার থেকে খানিকটা এক কানে মেখে বললেন, নীলু, আমার অন্য কানটা শুঁকে দেখ তো, গন্ধ এসেছে কিনা!
আমি শুঁকে দেখলাম, না। গন্ধ-টন্ধ কিছু নেই। একদিকের গন্ধ কি কখনো অন্য দিকে যেতে পারে? বিশ্বমামার হাতে তাহলে কী অত্যাশ্চর্য জিনিস ছিল?
ডাল, ঝিঙে-পোস্ত আর ইলিশমাছ দিয়ে অনেকখানি ভাত খেয়ে বিশ্বমামা এখন লম্বা হয়ে ঘুমোচ্ছে। নাক ডাকছে প্রচন্ড। বিশ্বমামার মতন এত বড়ো নাক আমি আর কোনো মানুষের দেখিনি। ওঁর গায়ের রং ফরসা বলে আমরা ওঁর আর একটা নাম দিয়েছি—নাকেশ্বর ধপধপে। অত বড়ো নাক, বেশি জোরে তো ডাকবেই।
বিলুদা বলল, কীরে, নীলু, তুই ম্যাজিকটা বুঝতে পারলি না?
আমি বললাম, তুমি পেরেছ?
বিলুদা বললেন, এসব ম্যাজিক-ফ্যাজিক ধরে ফেলা তো ছোটোদেরই কাজ। মাথা ঘামাব না কেন? চাইনিজ খাবি কী করে?
—তুমিও খেতে পারছ না।
—এক কাজ করবি নীলু? আমি দেখেছি বিশ্বমামা হাতের সেই জিনিসটা বালিশের নীচে রেখেছে। টপ করে একটু বার করে নিয়ে দেখ না।
—যদি জেগে ওঠে? খুব রেগে যায়?
—এত নাক ডাকছে, এখন ঘুম ভাঙবেই না।
—তাহলে তুমি বার করে আনো।
—এসব ছোটোদের কাজ। আমি পাহারা দিচ্ছি। ঘুম ভাঙলেই ওকে অন্য কথা বলে ভোলাব। তুই জিনিসটা নিয়ে আয়!
আমি খুব আস্তে আস্তে গিয়ে বালিশের তলায় হাত ঢোকালাম, একটা শক্ত মতন কিছু ঠেকল। বার করে এনে দেখি, সেটা একটা মুরগির ডিমের মতন জিনিস। ওপরে লোম রয়েছে। কিন্তু এমনই শক্ত যে মনে হয় একটা গোল পাথরকে লোমওয়ালা চামড়া দিয়ে মুড়ে বাঁধানো।
বিলুদা ফিসফিস করে বললেন, কস্তুরী! কস্তুরী! হরিণের পেটে থাকে।
কস্তুরীর কথা আমিও শুনেছি। রবীন্দ্রনাথের কবিতায়ও পড়েছি :
পাগল হইয়া বনে বনে ফিরি আপন গন্ধে মম, কস্তুরী মৃগসম!
কিন্তু কস্তুরী বলে যে সত্যিই কিছু আছে তাও জানতাম না, কোনোদিন চোখেও দেখিনি!
বিলুদা বললেন, রেখে দে ওটাকে, আবার জায়গায় রেখে দে! তাহলে আজ চাইনিজ খাওয়া হচ্ছেই।
এই সময় বিশ্বমামা জেগে উঠে বসলেন। বিলুদা বললেন, কস্তুরী! বুঝে গেছি!
বিশ্বমামা বললেন, কস্তুরী? বটে! কস্তুরী কাকে বলে জানিস?
বিলুদা বললেন, হ্যাঁ, জানি। এক ধরনের হরিণের পেটে হয়।
বিশ্বমামা বললেন, বা:! কস্তুরী চিনিস দেখছি। হিমালয়ের এক ধরনের হরিণ যাদের বলে মাস্ক ডিয়ার, তাদের পেটে হয়। জানিস নীলু, তুই যেটা ধরে আছিস, সেটাকে বলতে পারিস, আমাদের দেশের সেরা কস্তুরী। আর হিমালয়ের হরিণদের পেটে কস্তুরী পাথর জন্মাচ্ছে না। আমি এবার সে ব্যবস্থা করে এসেছি।
বিলুদা বলল, সে কী! তুমি এটা করলে কেন? কস্তুরী তো খুব দামি জিনিস।
বিশ্বমামা হঠাৎ রেগে গিয়ে বললেন, দামি জিনিস। তাই লোকে এই বেচারা সুন্দর হরিণগুলোকে মেরে মেরে শেষ করছে, তারপর পেট কেটে কস্তুরী বার করবে! কেন, ওরা কী দোষ করেছে? মানুষের কিডনিতে যেমন পাথর হয়, ওই হরিণদেরও নাড়িকোশে পাথর জন্মায় আপনা-আপনি। সেই জন্য মানুষ ওদের মারবে? খবরের কাগজে পড়েছিলাম। হিমালয়ে লোকে প্রচুর ওই হরিণ মারছে কস্তুরীর লোভে! তা পড়েই আমার গা জ্বলে গেল। মনে মনে বললাম, দেখাচ্ছি মজা! আমি এমন একটি কেমিক্যাল আবিষ্কার করলাম, যাতে ওই পাথর গলে যায়। সেই পাথর নিয়ে চলে গেলাম হিমালয়ে।
বিলুদা বললেন, তুমি তোমার সেই ওষুধ হরিণ ধরে ধরে ইঞ্জেকশান দিলে নাকি?
বিশ্বমামা বললেন, তা তো আর সম্ভব নয়! গোপনে ঘুরে ঘুরে দেখলাম, ওই হরিণগুলো ঠিক কোন জায়গায় থাকে আর কী ধরনের ঘাস খায়। সেই ঘাসের ওপর আমার ওষুধ ছড়িয়ে দিয়েছি বেশ করে। সেই ঘাস খেয়ে কয়েক দিনের মধ্যে ওদের পেটের সব পাথর গলে গেছে। শুধু তাই নয়, এরপর যে বাচ্চা জন্মাবে, তাদেরও কস্তুরী হবে না। শিকারিরা এর পরেও দু-তিনটে হরিণ মেরেছিল, পেটে কিছু পায়নি। ওই হরিণ মারা এমনিতেই নিষেধ। এখন সবাই বুঝে যাচ্ছে, কস্তুরীর জন্য শুধু শুধু অত সুন্দর হরিণ মেরেও আর কোনো লাভ হবে না।
আমি বললাম, তাহলে আর কস্তুরীর গন্ধ কেউ পাবে না?
বিশ্বমামা বলল, কেন পাবে না? সিভেট নামে এক ধরনের বেড়াল আর মাস্ক র্যাট নামে এক ধরনের ইঁদুরের পেটেও ঠিক এই রকম গন্ধওয়ালা পাথর হয়। সত্যি কথা বলছি, ইঁদুর মারলে আমার কোনো আপত্তি নেই। তা ছাড়া এখন কস্তুরীর গন্ধওয়ালা কেমিক্যাল তৈরি হয়, তার নাম সিভেটোন। কিছু কিছু ওষুধও তৈরি হয় এটা দিয়ে।
বিলুদা জিজ্ঞেস করল, তাহলে আজ আমরা কোথায় চাইনিজ খেতে যাচ্ছি?
বিশ্বমামা বললেন, আগে আমার ম্যাজিকটার কী হল সেটা বল! এখনও তো পারিসনি!
বিলুদা বলল, এ তো খুব সোজা! কস্তুরীর খুব তীব্র গন্ধ তুমি এক হাতে মাখিয়ে দিলে, তাই অন্য হাতে গন্ধ পাওয়া গেল।
বিশ্বমামা হা হা করে হাসতে হাসতে বললেন, মোটেই না। হল না। এ কী তুই বীজ পুঁতলি হাওড়ায় আর গাছ গজাল কলকাতায়! কস্তুরী কেন, পৃথিবীর কোনো গন্ধই এক হাতে লাগালে তারপর সারাদেহ ঘুরে সেটা অন্য হাতে পৌঁছোতে পারে না।
আমি আর বিলুদা পরস্পরের দিকে তাকালাম।—তাহলে?
বিশ্বমামা বললেন, বুঝতে পারলি না তো? আমার ডান হাতে ছিল কী, ওই কস্তুরীটা? আর অন্য হাতে? কিছুই না। আমায় যদি কেউ এই ম্যাজিকটা দেখাত, তাহলে আমি সেই ম্যাজিশিয়ানের বাঁ-হাতের গন্ধ শুঁকে দেখতাম।
বিলুদা বলল, তার মানে?
বিশ্বমামা বললেন, এই যে কস্তুরীটা দেখছিস, এটায় আসলে বেশি গন্ধই নেই। এর লাল চামড়া তুলে ফেলে জিনিসটা তুলে ফেলা হয়। তখনই ভালো গন্ধ বেরোয়। ওই জন্য হরিণরা যখন স্নান করে, কিংবা বৃষ্টিতে ভেজে, তখনই নিজের গায়ের গন্ধটা ঠিক ঠিক পায়। খানিকটা কনসেনট্রেড কস্তুরীর নির্যাস আমি আমার বাঁ-হাতে লাগিয়ে রেখেছিলাম। ওই হাত দিয়ে যা করব তাতেই গন্ধ হবে। ওই হাত দিয়ে আমি তোদের অন্য হাত দুটো ধরেছিলাম, মনে নেই!
বিলুদা বলল, তুমি আমাদের ঠকিয়েছ?
বিশ্বমামা বললেন, ঠকিয়েছি কীরে, এটাই তো ম্যাজিক। তাহলে চাইনিজ খাওয়া হল না। পাঁচখানা করে অঙ্ক কষতে হবে। অঙ্কগুলো যদি রাইট হয়, তখন না-হয় চাইনিজ খাওয়ার কথা আবার ভেবে দেখা যাবে!