বিশ্বমামার খুদে বন্ধু

বিশ্বমামার খুদে বন্ধু

সাপ দেখলে সবচেয়ে ভয় পান বিশ্বমামা, আর সবচেয়ে ভালোবাসেন পিঁপড়ে। একবার শান্তিনিকেতনে একটা সাপ দেখে বিশ্বমামা এমন দৌড় লাগালেন যে…। সাপের জন্য তিনি খোঁড়া হয়ে রইলেন কয়েকটা দিন।

না, তাঁকে সাপে কামড়ায়নি। কিন্তু ভয় পেয়ে দৌড়োতে গিয়ে তিনি আছাড় খেয়ে পড়লেন, তাতেই মচকে গেল গোড়ালি।

বড়োদের তো দৌড়োবার অভ্যেস থাকে না। তাই তাদের যখন-তখন ভয় পেয়ে দৌড়োনো উচিত নয়।

তা ছাড়া সাপ দেখলে দৌড়োলেই বেশি বিপদ। তখন তেড়ে গিয়ে কামড়ে দিতে পারে। চুপ করে একজায়গায় দাঁড়িয়ে থাকলে তারা কিছু করে না।

বিশ্বমামা এত বড়ো পন্ডিত, তিনি এটা জানেন না?

সেবারে পায়ে ব্যাণ্ডেজ বেঁধে শুয়ে থাকতে থাকতে বিশ্বমামা বলেছিলেন, হ্যাঁ, জানি, জানি, সবই জানি। তবু সাপ দেখলেই আমার মাথা গুলিয়ে যায়।

সেবারে জার্মানিতে বিশ্বমামার একটা জরুরি মিটিং-এ যাবার কথা ছিল, আর যাওয়াই হল না।

গত মাসে আমরা পিকনিকে গেলাম কাকদ্বীপে। বিশ্বমামাকে নিয়ে যাবার খুব ইচ্ছে ছিল। বিশ্বমামা গেলে অনেক মজার মজার গল্প শোনা যায়। তা ছাড়া খুব চেপে ধরলে আইসক্রিমও খাওয়ান সবাইকে।

কিন্তু বিশ্বমামাকে সে পিকনিকের কথা বলতেই তিনি আঁতকে উঠে বললেন, ওরে বাবা, কাকদ্বীপ। ওখানে যখন-তখন সাপ বেরোয়!

আহা, সাপের ভয়ে কেউ বুঝি কাকদ্বীপে যায় না? কত লোক তো ওখানে থাকে, তারা কি সাপের কামড়ে মরছে? আমরা দিব্যি পিকনিক করে এলাম, একটাও সাপ দেখিনি।

সেই যে শান্তিনিকেতনে একবার সাপ দেখে পা মচকে ছিলেন, তারপর থেকে আর শান্তিনিকেতনেও যেতে চান না। একমাত্র শীতকাল ছাড়া। শীতকালে সাপ বেরোয় না।

শান্তিনিকেতনে বর্ষাকাল কী সুন্দর। রাস্তায় কাদা জমে না। অজস্র ফুল ফোটে আর অনেক দূর থেকে বৃষ্টি আসছে দেখা যায়। আমাদের মিনু মাসিদের বাড়ি আছে সেখানে, কতবার যেতে বলেন বিশ্বমামাকে, তিনি কিছুতেই যাবেন না।

বিশ্বমামার সাপের ভয় যেমন বেশি বেশি, তেমনি পিঁপড়েদের প্রতি ভালোবাসাও খুব বেশি।

ছোট্ট ছোট্ট পিঁপড়েদের যখন-তখন যেখানে-সেখানে দেখা যায়। কোথা থেকে যে ওরা আসে, তা বোঝার উপায় নেই। পিঁপড়ে দেখলেই বিশ্বমামা মুগ্ধভাবে তাকিয়ে থাকেন।

আমাদের বলেন, দেখেছিস, পিঁপড়েরা কী সুন্দর, কী অপূর্ব!

পিঁপড়ে আবার সুন্দর হয় কী করে, তা আমি বুঝি না। ওইটুকু ওইটুকু পিঁপড়ে, কামড়ে দিলে বেশ জ্বালা করে।

বিশ্বমামা যে-টেবিলে যন্ত্রপাতি সাজিয়ে কাজ করেন, একদিন সেই টেবিলের ওপরেও দেখা গেল সারি সারি পিঁপড়ে।

বিশ্বমামা সেগুলো মারলেন না, সরালেন না, কিছু করলেন না, শুধু তাকিয়ে রইলেন আর আমাকে বললেন, বল তো নীলু, এই পিঁপড়েগুলো এখানে এসেছে কেন?

তা আমি কী করে জানব? পিঁপড়েরা কেন আসে তা কি কেউ বলতে পারে?

বিশ্বমামা বললেন, কাল আমি এখানে বসে কাজ করতে করতে একটা কেক খেয়েছিলাম। কিছু তো গুঁড়ো টেবিলে পড়বেই। আমি ভালো করে পরিষ্কার করেছি। তবু একটু একটু গুঁড়ো তো টেবিলের ফাঁকে ফাঁকে থেকে যাবেই। পিঁপড়েগুলো এসেছে সেই টুকরোগুলো খুঁজতে। এটা একটা আশ্চর্য ব্যাপার না?

পিঁপড়েরা খাবার খুঁজতে আসবে, এতে আর আশ্চর্য হবার কী আছে? এসব পোকামাকড় আর জন্তুজানোয়ারই তো খাবার খুঁজে বেড়ায়?

বিশ্বমামা বললেন, আমি যে এখানে বসে কাল কেক খেয়েছি, তা পিঁপড়েরা কী করে জানল? তখন তো এখানে একটাও পিঁপড়ে ছিল না? সব পরিষ্কার করার পরেও যে একটু একটু কেকের গুঁড়ো থেকে যাবে, তাই-ই বা ওরা টের পেল কী করে? কে ওদের খবর দেয়?

অনেক সময় দেখা যায়, একলা একলা একটা পিঁপড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এইরকমভাবে ওরা সব জায়গায় খাবার খুঁজে বেড়ায়। একজন খোঁজ পেলেই অন্যদের ডেকে আনে।

আমার দাদা বিলুর আবার একটা বাতিক আছে।

একদিন একটা ছোট্ট লাল পিঁপড়ে ওর চোখের পাতায় কামড়ে দিয়েছিল, সেই থেকে পিঁপড়েদের ওপর ওর খুব রাগ।

পিঁপড়ে দেখলেই ও মারে।

হাত দিয়ে মারে না, জল ঢেলে ঢেলে পিঁপড়েদের নর্দমায় ঢুকিয়ে দেয়। এটা ওর একটা খেলার মতন।

একদিন বিলুদা দেওয়ালে জল ঢেলে ঢেলে পিঁপড়ে মারছিল, তা দেখতে পেয়ে বিশ্বমামার কী রাগ! বিলুদাকে প্রায় মারতে গিয়েছিলেন।

বিশ্বমামা এমনিতে হাসিখুশি মানুষ, সহজে রাগেন না।

সেদিন বললেন, তুই কী করছিস বিলু, তা তুই জানিস? তোর থেকেও বুদ্ধিমান একটা প্রাণীকে তুই মারছিস?

বিলুদা বলেছিল, বিশ্বমামা, তুমি আর বাড়াবাড়ি কোরো না। মানুষের চেয়ে পিঁপড়ের বুদ্ধি বেশি?

বিশ্বমামা বললেন, নিশ্চয়ই। তোর এত বড়ো একটা মাথা, তার মধ্যে অনেকখানি ঘিলু মানে ব্রেন আছে। আর পিঁপড়ের মাথাটা একটা আলপিনের ডগার চেয়েও ছোটো, তার মধ্যে ইংরেজি ফুলস্টপের চেয়েও ছোটো ওর ঘিলু। তাই দিয়েই পিঁপড়ে কত কিছু বোঝে। কীরকম লাইন বেঁধে চলে। সবাই মিলে কাজ করে, নিজেদের মধ্যে কক্ষনো মারামারি করে না। আরও কত গুণ আছে। তাহলে তুলনা করে দেখ!

বিলুদা বলল, কিন্তু আমার চোখের ওপর কামড়াবে কেন? আমার চোখটা কী ওর খাবার জিনিস?

বিশ্বমামা বললেন, সকালে ভালো করে চোখ-মুখ ধুয়েছিলি? নিশ্চয়ই কিছু লেগেছিল? আমার চোখে তো পিঁপড়ে কামড়ায় না।

নীলুর চোখে কামড়ায়?

বিশ্বমামা ইচ্ছে করে কেকের গুঁড়ো, বিস্কুটের গুঁড়ো ছড়িয়ে রাখেন ঘরের এক কোণে। সেখানে তো পিঁপড়ে আসবেই। কাজের ফাঁকে ফাঁকে বিশ্বমামা সেই পিঁপড়েদের আনাগোনা দেখেন।

ওগুলো যেন তাঁর পোষা পিঁপড়ে।

মিনু মাসি একদিন এসে বললেন, আমার ছেলের জন্মদিন এবারে শান্তিনিকেতনের বাড়িতে হবে। নীলু, তোদের কিন্তু আসতেই হবে।

আমি আর বিলুদা তো সঙ্গেসঙ্গে রাজি।

বিশ্বমামা গেলে ভালো লাগত, কিন্তু উনি তো শান্তিনিকেতনে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন।

মিনু মাসি বললেন, এখন তো নভেম্বর মাস, শীত পড়ে যাবে। এখন আর বিশ্বর ভয় কী? ওকে বুঝিয়ে বল!

বিশ্বমামার বাড়িতে গিয়ে দেখি, একটা কম্পিউটারের সামনে বসে চিঠি পড়ছেন। এখন তো আর বিদেশ থেকে চিঠি পিয়োন দেয় না। কম্পিউটার দেখলেই পাওয়া যায়।

বিশ্বমামা বললেন, ডাক এসেছে, অস্ট্রেলিয়ায় যেতে হবে।

আমি বললুম, এই তো ক-দিন আগে ঘুরে এলে সেদেশ থেকে।

বিশ্বমামা বললেন, একবার গেলে বুঝি আবার যাওয়া যায় না? আগেরবার গিয়েছিলাম নিউজিল্যাণ্ড।

বিশ্বমামা সত্যিই সারাবিশ্ব টহল দিয়ে বেড়ান। বৈজ্ঞানিক হিসেবে দিন দিন তাঁর নাম বাড়ছে।

শান্তিনিকেতনে যাবার কথা শুনে বললেন, নভেম্বর মাস, ভালো করে শীত তো পড়েনি, এখন ওসব সাপের জায়গায় যাব না।

আমি বললুম, কলকাতার থেকে শান্তিনিকেতনে আরো আগে শীত আসে। ওখানে রাত্তিরে কম্বল গায়ে দিতে হয়।

অনেক বলে-কয়ে বিশ্বমামাকে রাজি করানো গেল।

অস্ট্রেলিয়ায় যাবার আগে সাতদিন সময় আছে। তার মধ্যে দু-দিন শান্তিনিকেতনে।

মিনু মাসির ছেলে বিল্টুকে তিনি ভালোবাসেন খুব। বিল্টু এবার চার বছরে পা দেবে।

তার জন্মদিনের জন্য বিশ্বমামা কিনে ফেললেন একটা এরোপ্লেন। আসল নয়, খেলনা। সেটা কিন্তু ঘরের মধ্যে উড়তে পারে।

মিনু মাসিরা চলে গেলেন আগেই।

আমি আর বিলুদা বিশ্বমামার সঙ্গে গেলুম শনিবার। বোলপুর স্টেশনে নেমে সাইকেল-রিকশা।

মিনু মাসির বাড়ি অনেকটা দূর। বেশ ফাঁকা ফাঁকা জায়গায়।

সে বাড়ির সামনে সাইকেল-রিকশা থামতেই দেখি হুলুস্থুলু কান্ড চলছে।

বাড়ির সামনে বাগানে একগাদা লোক, তারা উত্তেজিতভাবে কী যেন বলাবলি করছে।

মিনু মাসিও রয়েছেন সেই ভিড়ের মধ্যে। আমাদের দেখেই কাকে যেন বললেন, এই, এই, বিশ্বকে এখন কিছু বোলো না, বোলো না!

কিন্তু রমেন মেসো বোধহয় সেটা শুনতে পাননি।

তিনি এগিয়ে এসে বললেন, সাংঘাতিক কান্ড হয়েছে, ঘরের মধ্যে একটা…ওঃ হো, বিশ্ব, বিশ্ব, না, না, তেমন কিছু নয়।

আমি জিজ্ঞেস করলুম, ঘরের মধ্যে একটা চোর ঢুকে বসে আছে?

বিশ্বমামা গম্ভীরভাবে বললেন, চোর নয়, সাপ। তাই না?

রমেন মেসো চুপ।

বিশ্বমামা বললেন, আগেই বলেছিলুম, নভেম্বরে শীত পড়ে না। এখন তো রীতিমতন গরম। এই সময় সাপ বেরোয়। আমি আর ও বাড়িতে ঢুকছি না। পরের ট্রেনেই ফিরে যাচ্ছি।

মিনু মাসি দৌড়ে কাছে এসে বললেন, দাঁড়া বিশ্ব। সাপ কিনা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। ইঁদুর- টিঁদুরও হতে পারে।

বিশ্বমামা বললেন, ইঁদুর আর সাপের চেহারা কী একরকম? কে দেখেছে? মোট কথা, আমি আর থাকছি না এখানে।

মিনু মাসি বললেন, শোন, শোন, তোকে এ বাড়ির মধ্যে ঢুকতে হবে না। সামনের বাড়িটা খালি। ওটা আমাদেরই এক বন্ধুর বাড়ি। ওটা আমরা নিয়েছি। তুই ও বাড়িতে থাকবি। এখানে একটা কিছু ব্যবস্থা হয়ে যাবেই। পুলিশে খবর দিয়েছি।

বিশ্বমামা বললেন, পুলিশ এসে সাপ তাড়াবে? এরকম হাসির কথা জন্মে শুনিনি।

বিশ্বমামাকে নিয়ে যাওয়া হল উলটোদিকের বাড়িতে।

আমরা রয়ে গেলাম এই বাগানে।

ঘটনাটা শোনা গেল।

বারান্দায় খেলা করছিল বিল্টু। তাকে পাহারা দিচ্ছিল এ বাড়ির কাজের লোক রঘু।

সে হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠেছিল সাপ সাপ বলে।

মিনু মাসি ছুটে এসে কিন্তু কোনো সাপ দেখতে পাননি।

রঘুর মুখ ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। সে দু-হাত ছড়িয়ে বলেছিল এই এত বড়ো সাপ। আর একটু হলেই বিল্টুকে কামড়ে দিত।

রঘু চেঁচিয়ে উঠতেই সাপটা ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়েছে।

মিনু মাসি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ঘরের মধ্যে উঁকি দিয়েও দেখতে পাননি সাপ।

ঘরের মধ্যে একটা খাট, তার তলায় একটা মাদুর গোটানো রয়েছে। সাপটা নাকি ঢুকে বসে আছে ওই মাদুরের মধ্যে। মস্ত বড়ো সাপ। ফণা তুলেছিল!

রঘু সত্যি বলছে না মিথ্যে বলছে, তা কী করে বোঝা যাবে?

মিনু মাসি বিল্টুকে জিজ্ঞেস করলেন, তুই সাপ দেখেছিস?

বিল্টু একগাল হেসে বলেছিল, ছাপ! মত্ত বড়ো ছাপ।

বিল্টু নিজে দেখেছে না রঘুর কথা শুনে বলছে, তা বোঝার উপায় নেই। বিল্টুটা খুব দুষ্টুও হয়েছে।

কিন্তু ঘরে মাদুরের মধ্যে যদি একটা সাপ ঢুকে থাকে, তাহলে তো ও ঘরে ঢোকাই যাবে না! ওই ঘর দিয়েই অন্য ঘরে যেতে হয়।

সবাই ভেতরে ঢুকতে ভয় পাচ্ছে।

পুলিশকে খবর দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তারা আসবে কেন?

তারা চোর-ডাকাত ধরারই সময় পায় না।

শান্তিনিকেতনে সাপুড়েও নেই।

সুরুলে নাকি একজন লোক সাপ মারায় ওস্তাদ, একজন লোক গিয়েছিল তাকে ডেকে আনতে।

লোকটি ফিরে এসেছে। সাপ-মারা লোকটির দারুণ জ্বর, সে আসতে পারবে না।

তাহলে উপায়?

বিশ্বমামাকে গিয়ে সব ঘটনা জানালাম।

বিশ্বমামা বললেন, আমি ও বাড়ির ধারে-কাছেও আর যাচ্ছি না। মিনুদিকে বল, সবাই মিলে এবাড়িতে চলে আসুক।

কিন্তু ওই ঘরেই যে অন্নপ্রাশনের সব জিনিসপত্র রয়েছে।

বিশ্বমামা বললেন, বিকেল বেলা ফেরার ট্রেন কখন রে?

এবারে বিলুদা বলল, বিশ্বমামা, তুমি সাপের নাম শুনে কাপুরুষের মতন পালিয়ে যাবে? ওই ঘরের কাছাকাছি না-যাও, একটা কিছু বুদ্ধি দাও!

বিশ্বমামা বললেন, যারা সাপ তাড়াবার জন্য পুলিশ ডাকে, তাদের আমি কী বুদ্ধি দেব।

আমি বললুম, গ্রামে তো আজকাল সাপের ওঝাও পাওয়া যায় না। তাহলে কি ডাক্তার ডাকতে হবে?

বিলুদা বলল, দূর বোকা? সাপে কামড়ালে ডাক্তাররা চিকিৎসা করে, ডাক্তাররা কী সাপ ধরে নাকি? ডাক্তাররাও সাপ দেখলে ভয় পায়—

বিশ্বমামা হো-হো করে হেসে উঠলেন।

হাসতে হাসতে বললেন, সাপের জন্য পুলিশ, ডাক্তার, এবার কী বলবি মন্ত্রী ডাকার কথা!

তারপর বললেন, শোন—

বিল্টু চলে এসেছে এঘরে। কী যেন খাচ্ছিল, সে হাতটা চাটছে এখন।

বিশ্বমামা আমাদের শুধু ‘শোন’ বলে থেমে গেলেন। বিল্টুকে কাছে ডেকে আদর করতে করতে বললেন, কী খাচ্ছিস রে, বিল্টু।

বিল্টু বলল, চিনি, চিনি!

বিশ্বমামা বললেন, আহারে, খিদে পেয়েছে বুঝি? তোকে কেউ চকলেট দেয়নি, সন্দেশ দেয়নি। শুধু চিনি খাচ্ছিস! আমি বিকেলে বেরিয়ে চকলেট কিনে দেব।

আমি বললুম, বিশ্বমামা, তুমি কী বলছিলে যেন?

বিশ্বমামা বললেন, সাপটারও খিদে পেয়ে থাকতে পারে। ওকেও কিছু খাবার দেওয়া উচিত।

বিলুদা বলল, সাপেরা কি খায়? দুধ আর কলা।

বিশ্বমামা বললেন, ওটা বাজে কথা। কে রটিয়েছে কে জানে! সাপ দুধও খায় না, কলাও খায় না। ওরা কোনোরকম ফল খেতে পারে না। দুধও চেটে খাবার ক্ষমতা সাপের নেই।

তবে কী খাবে?

বিশ্বমামা বিল্টুর নকল করে বললেন, চিনি, চিনি।

তারপর বললেন, সাপটাকে এক বাটি চিনি খাওয়াতে পারবি? মিষ্টি খেতে সবাই ভালোবাসে।

বিলুদা বলল, সাপকে কী করে চিনি খাওয়াব? কাছে গেলেই তো কামড়ে দিতে পারে।

বিশ্বমামা বললেন, কাছে যেতে হবে কেন? একবাটি চিনি জোগাড় করে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে সবটা চিনি ছুড়ে দে মাদুরটার ওপর। যা, এক্ষুনি গিয়ে ব্যবস্থা কর। কী হল আমাকে এসে জানাবি।

দৌড়ে গিয়ে মিনু মাসিকে কথাটা জানাতেই তিনি বললেন, সাপ চিনি খায়, জন্মে শুনিনি। তা ছাড়া, খেতে-টেতে দিলে ও তো আরও বেরুতে চাইবে না।

আমি বললুম, তবু, বিশ্বমামা বলেছেন যখন!

মিনু মাসি আর আপত্তি করলেন না। মানুষটা যে খুব জ্ঞানী, তা তো সবাই জানে।

বিশ্বমামা কী ভেবে কোন কথাটা বলেন, তা আগে বুঝতে দেন না।

রমেন মেসো নিজে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে একবাটি ভরতি চিনি ছুড়ে দিলেন মাদুরটার ওপর।

কিছুই হল না। মাদুরটায় কোনো নড়াচড়াও টের পাওয়া গেল না।

কেউ কেউ বলল, বাজে কথা, সাপ-টাপ কিছু ঢোকেনি।

আর কেউ কেউ বলল, ঢুকলেও তা হয়তো বেরিয়ে গেছে আবার কোন ফাঁকে।

কেউই কিন্তু সাহস করে ঘরের মধ্যে ঢুকে মাদুরটা টেনে দেখতে চাইছে না।

বিশ্বমামা চিনি ছোড়ার কথা শুনে বললেন, ঠিক আছে। দু-ঘণ্টা অপেক্ষা কর। আর দু-একজন দরজার কাছে পাহারায় থাকুক। যদি মাদুরের মধ্যে সাপটা লুকিয়ে থাকে, তাহলে ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে সাপটা বেরিয়ে আসতে বাধ্য।

রমেন মেসো তাঁর ডান্ডার ডগায় সেটাকে তুলে নিয়ে ফেলে দিয়ে এলেন অনেক দূরে….

রমেন মেসোর সঙ্গে আমি আর বিলুদা রইলুম দরজার কাছে পাহারায়।

সত্যি সাপটা ওখানে আছে কী নেই, তা না-জেনে কিছুতেই স্বস্তি পাওয়া যাবে না।

রমেন মেসোর হাতে একটা লোহার ডাণ্ডা, আমার আর বিলুদার হাতে লাঠি।

বিল্টুও এখানে আসবেই আসবে, তাকে জোর করে আটকে রাখা হয়েছে অন্য বাড়িটায়।

দু-ঘণ্টাও লাগল না।

তার আগেই মাদুরটায় একটু নড়াচড়া শুরু হল। তারপর খুব জোরে ওলটপালটের মতন।

তারপর সড়াৎ করে সেখানে থেকে বেরিয়ে এল একটা মস্ত বড়ো সাপ।

সাপটা তারপর আর এগোতেই পারছে না। এমনভাবে একবার এদিক আর একবার ওদিক করছে, যেন অন্ধ হয়ে গেছে।

আমরা লক্ষ করিনি, কখন যেন ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়েছে রাশি রাশি পিঁপড়ে। কোথায় এত পিঁপড়ে থাকে কে জানে।

চিনির জন্য এত পিঁপড়ে এসে জুটেছে, সাপটার সারাশরীরও ঢেকে গেছে পিঁপড়েতে।

যে সাপ দেখে মানুষ ভয় পায়, সে সাপও পিঁপড়েদের কাছে অসহায়।

বেচারি সাপটাকে আর মারতেও হল না। সে অত পিঁপড়ের কামড়ে একেবারে নেতিয়ে পড়েছে।

রঘু সবটা সত্যি বলেনি। ও সাপটা বেশ বড়ো বটে, কিন্তু মোটেই ফণা তুলতে পারে না। বিষাক্তও নয়।

অনেকেই বলল, ওটা একটা দাঁড়াশ সাপ, ওকে মেরে লাভ নেই। ওরা ব্যাং আর পোকামাকড় খায়, মানুষকে সাধারণত কামড়ায় না। কামড়ালেও মানুষ মরে না।

রমেন মেসো তাঁর ডাণ্ডার ডগায় সেটাকে তুলে নিয়ে ফেলে দিয়ে এলেন অনেক দূরে।

সব শুনে বিশ্বমামা বললেন, দেখলি, দেখলি, কেন আমি পিঁপড়েদের এত প্রশংসা করি? ওরা আমার বন্ধু।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *