বাংলা প্রবন্ধ
Essays in English
পরিশিষ্ট

বিশ্বমনা: বাকপতি

বিশ্বমনা: বাকপতি

উত ত্বঃ পশ্যন ন দদর্শ বাচম,
উত ত্বঃ শৃন্বন ন শৃণোতি এনাম।
উতো তুঅস্মৈ তনুঅং বি সস্রে—
জায়েব পত্য উশতী সুবাসা:।।

দৃষ্টিশক্তি থাকলেই মানুষ বাককে দেখতে পায় না, শ্রবণ ক্ষমতার অধিকারী হলেই তাকে শুনতে পায় না; কিন্তু সুবেশা পতিগতপ্রাণা পত্নী যেমন নিজের স্বামীর কাছে আপনাকে প্রকাশ করে, কোনো কোনো মানুষের নিকট বাক তেমনি নিজ সৌন্দর্য্য উদঘাটিত করেছে।

রবীন্দ্রনাথ ছিলেন সেই অনন্য ও বিরল চরিত্রের মানুষ যেখানে মানবমহিমা পূর্ণমাত্রায় ও অখন্ড স্বভাবে বিরাজমান; সেই বিপুল মানসিকতার অধিকারী যার প্রসার সুদূরতম দেশে। জীবনকে তিনি গ্রহণ করেছিলেন তার সমগ্ররূপে; সমগ্ররূপেই তিনি উপলব্ধি করেছিলেন জীবনকে। তাঁর এই উপলব্ধির বিভিন্ন দিককে তিনি বিচিত্র মাধ্যমে প্রকাশ করে গেছেন। জীবনের সঙ্গে নানা ঘাত-প্রতিঘাতে তাঁর যে নানা অভিজ্ঞতা জন্মেছে, তার পরিণত প্রকাশকে তিনি মানুষের ভান্ডারে ‘চিরকালের ধন’ করে রেখে গেছেন। তিনি শুধুমাত্র একজন সাহিত্যিকই ছিলেন না; তিনি ছিলেন তারও চেয়ে বেশি। স সর্বজ্ঞঃ, সর্বম আবিবেশ—‘সকলকে জেনে, সবকিছুরই অন্তরে তিনি প্রবিষ্ট হয়েছিলেন।’ তিনি ছিলেন একাধারে কবি ও গীতিকার, সংগীতবিদ ও সুরস্রষ্টা। নর-নারীর জীবনের আশা-নিরাশা, সুখ-দুঃখ, জিজ্ঞাসাসমস্যা এবং সুপ্তজাগ্রত নানা উদ্দেশ্য-অভিপ্রায় তিনি প্রত্যক্ষ করেছিলেন; এরই বর্ণনা ছড়িয়ে রয়েছে তাঁর কাব্যে-উপন্যাসে-গল্পে-ছবিতে। খ্রীষ্টীয় নবম শতকের সংস্কৃত কবি ও সমালোচক রাজশেখর কথিত কারয়িত্রী প্রতিভা এবং ভাবয়িত্রী প্রতিভা—দুটিরই তুল্য অধিকারী ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। প্রাচীনকাল থেকে যে ক্রমবহমান সাহিত্যের ধারা পৃথিবীর মহত্তম কবি ও দ্রষ্টাগণের দানে পুষ্ট হয়ে এসেছে, সৃজনশীল লেখকরূপে সে-বিভাগে উল্লেখযোগ্য এবং কালজয়ী ভূমিকা গ্রহণ করে তিনি যেমন গৌরবের আসনে অধিষ্ঠিত, সাহিত্যের সমালোচকরূপে তেমনই তাঁর আসন প্রথম সারিতে। মানবজীবনের রহস্যের মতো ভৌতবিজ্ঞানের রহস্যে তিনি মুগ্ধ হয়েছিলেন। অধিগত করেছিলেন বিজ্ঞানের কতকগুলি মৌল তত্ত্ব। আপন অননুকরণীয় ভঙ্গীতে রবীন্দ্রনাথ সেই তত্ত্বকে আবার শিশু ও বয়স্ক সাধারণ পাঠকগণের উপযোগী করে পরিবেশন করে গেছেন। ভাষা ও সাহিত্যের সম্মুখীন হয়েছিলেন তিনি বিজ্ঞানীর দৃষ্টি ও অনুসন্ধিৎসা নিয়ে। বিজ্ঞানের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে তিনি একবার বলেছিলেন: ‘বিজ্ঞান বলতে বোঝায় একটি একক সত্তাকে (entity) ভেঙে তার উপাদানগুলিকে একটি একটি করে বিচার করে এই অখন্ড বিশ্বসংগঠনে তারা কী ভূমিকা গ্রহণ করেছে সেই তথ্যকে পরিজ্ঞাত হওয়া।’ এ হল বিজ্ঞানের বিশ্লেষণের দিক। অন্যদিকে বিজ্ঞান আবার সংশ্লেষণীও। কোনো বস্তু বা ভাব বা পদ্ধতির বিভিন্ন অংশ বা স্তর কীভাবে একটি সংহত সম্পূর্ণ রূপ লাভ করেছে, এই সম্পূর্ণতায় তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক ও স্থান কী তার সত্যানুসন্ধানও বিজ্ঞান। কবির সৃজনশীল সাহিত্যেও এই বিজ্ঞানী দৃষ্টি পরিদৃষ্ট হয়; কিন্তু সব থেকে বেশি স্পষ্ট হয়ে ওঠে তাঁর সমালোচনা সাহিত্যে। সাহিত্যের যত বিভিন্ন শ্রেণির সঙ্গে তাঁর পরিচয় ছিল প্রত্যেকটিতে তাঁর প্রয়াস ধাবিত হয়েছে এবং নিজেও কয়েকটি নূতন শ্রেণির সাহিত্য সৃষ্টি করে গিয়েছেন। সাহিত্যের আঙিনায় তিনি কী বিচিত্র ফসল না ফলিয়েছেন। গীতি-কবিতা, দীর্ঘ-কবিতা, সামাজিক-ঐতিহাসিক-সাংকেতিক নাটক, উপন্যাস, ছোটোগল্প, গদ্য-কবিতা, সাহিত্যিক-সামাজিক-রাজনৈতিক প্রবন্ধাবলী; আর কী অজস্র সেই ফলন! রবীন্দ্রনাথের সম্বন্ধে একথা জোর দিয়েই বলা যেতে পারে যে, ‘সাহিত্যের এমন কোনো রূপ ছিল না যা তাঁর প্রতিভার স্পর্শ পায় নি এবং যাকে তিনি ঋদ্ধ করতে পারেন নি এমন কিছুই তিনি স্পর্শ করেন নি।’ কবির সাংগীতিক প্রতিভা ও সিদ্ধি—দুটিই ছিল অনন্য। তাঁর উদ্ভাবিত গায়নরীতি ও সুরশৈলী বর্তমানে ‘রবীন্দ্রসংগীত’ নামে প্রখ্যাত হয়েছে। বস্তুত, ভারতীয় সংগীতের ইতিহাসে তাঁর নাম হরিদাস স্বামী, গোপাল নায়ক, আমীর খসরু, তানসেন ও ত্যাগরাজের সঙ্গেই উল্লেখ করতে হয়। জীবনের অপরাহ্ণে তিনি চিত্রকলার দিকে ঝুঁকেছিলেন; এই প্রবণতা এসেছে তাঁর পারিবারিক এবং পারিপার্শ্বিক ঐতিহ্য থেকে। আত্মপ্রকাশের মাধ্যমরূপে এর তাগিদ তিনি অস্বীকার করতে পারেন নি। কলমের আঁচড়ে ফুটিয়ে তোলা হিজিবিজি ছবি ও স্কেচ, রঙিন চিত্র ও কম্পোজিশন রেখার উপর তাঁর আধিপত্যের এবং বর্ণ ও আঙ্গিকের উপর একরকমের রহস্যময় আকর্ষণের যে পরিচয় বহন করে এনেছে ভারতের আধুনিক শিল্পকলার ইতিহাসে তা রবীন্দ্রনাথের জন্য একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান নির্দিষ্ট করে রেখেছে। তা ছাড়া, অভিনয়কলায়ও তিনি ছিলেন সিদ্ধশিল্পী, নাট্যরচনায় ও নাটক প্রযোজনায় পরম উৎসাহী। আধুনিক ভারতীয় নৃত্যকলা তাঁরই উৎসাহ ও প্রবর্তনায় পুনরুজ্জীবন ও পুনর্বিকাশ লাভ করেছে।

এইসব এবং আরো অনেক কিছু শিল্পকলা ও নন্দনতত্ত্বের জগতে রবীন্দ্রনাথের নবনবোন্মেষশালিনী প্রতিভার পরিচয়বাহী। ঋষিসুলভ প্রজ্ঞাদৃষ্টির অধিকারী ছিলেন রবীন্দ্রনাথ; লাভ করেছিলেন ইন্দ্রিয়াতীত অপ্রত্যক্ষগোচর সত্তার আভাস। মরমী ও ভক্ত কবিরূপে ভারত ও বিশ্বের মহত্তম দ্রষ্টা, ঋষি ও ভক্তগোষ্ঠীর একাসনে তিনি অধিষ্ঠিত। মানুষের মহিমাকে তিনি সর্বোচ্চ স্থান দিয়েছেন, উপলব্ধি করেছেন মনুষ্যত্বের পূর্ণবিকাশে দেবত্বের স্বরূপ। রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিত্বের এবং সাহিত্যসৃষ্টির এই বিশেষ দিকটিই বর্তমান যুগের মানুষের কাছে গভীরতম আবেদন বহন করে এনেছে বলে মনে হয়। আলোর অভাবে এ যুগের মানুষ পথভ্রষ্ট এবং যে পরম সত্তাকে সে দেখতে পায় না বা গভীরভাবে হৃদয়ংগম করতে পারে না, তাকে অস্পষ্টভাবে অনুভব করছে মাত্র। এখানে রবীন্দ্রনাথের কন্ঠে যে বাণী উচ্চারিত হয়েছে সে শুধু তাঁর একলারই নয়। এর পিছনে রয়েছে তাঁর দেশের প্রাচীন মনীষার বাণী, সে-বাণী রয়েছে উপনিষদের বেদান্ত দর্শনে, রয়েছে ভগবদগীতায়। তিনি কেবল প্রাচীন ভারতের সনাতন ধর্ম বা ‘শাশ্বত দর্শন’ মানবসাধারণের জন্য সহজবোধ্য করে ব্যাখ্যা করে গিয়েছেন।

রবীন্দ্র ব্যক্তিত্বের বাস্তবদিকগুলিও এড়িয়ে যাওয়া অথবা লঘু করে দেখা উচিত হবে না। প্রথম জীবনে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন শিক্ষাব্রতী। সে-সময় দেশের মানুষের সেবায় চিন্তা তাকে গভীরভাবে অধিকার করেছিল। ১৯০১ সালে শান্তিনিকেতনে ব্রহ্ম-বিদ্যালয় স্থাপিত হয়। তারপর সেই প্রতিষ্ঠান ১৯২১ সালে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষা দান এবং মানস ও অধ্যাত্মচর্চার ক্ষেত্রে মৌলিক ভাব ও চিন্তা বিস্তারের গতিশীল কেন্দ্ররূপে শান্তিনিকেতন পৃথিবীর সাংস্কৃতিক মানচিত্রে স্থান লাভ করে। দেশের মানুষের আর্থিক সচ্ছলতা যে তার সাংস্কৃতিক ও মানসিক অগ্রগতির বনিয়াদ একথা রবীন্দ্রনাথ বিস্মৃত হন নি। তাই দেশের সাধারণ মানুষের সাহায্যের উদ্দেশ্য নিয়ে শান্তিনিকেতনের নিকটে শ্রীনিকেতনে একটি শিল্পাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। এর নানা উদ্দেশ্যের মধ্যে অন্যতম হল গ্রামীণ শিল্পকলার উন্নতির মাধ্যমে গ্রামের অর্থনৈতিক কাঠামোটি সুদৃঢ় রাখা। ভারতের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সকল আন্দোলনের সঙ্গে তিনি সর্বদাই মনে-প্রাণে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে কর্মসূত্রে জড়িত ছিলেন।

রাজনীতির ক্ষেত্রেও রবীন্দ্রনাথের আসন ছিল পুরোভাগে। ভারতে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ও স্বাধীনতা সংগ্রামের সূচনা এবং ১৯০৫ সালে বাঙলাদেশে স্বদেশি আন্দোলনের সময় থেকেই রবীন্দ্রনাথ হয়ে উঠেছিলেন জননায়ক। বিবিধ রচনায় ও ভাষণে এবং সর্বোপরি স্বদেশপ্রেমমূলক গানে তিনি সমগ্র জনচিত্ত অনুপ্রাণিত করে তুলেছিলেন এবং জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের এমন একটি আদর্শগত পটভূমিকা রচনা করেছিলেন যার অভাবে এই আন্দোলন নিরর্থক ও প্রাণহীন হয়ে উঠতে পারত। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে ব্রতী ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের কোনো একটি বাৎসরিক অধিবেশন উপলক্ষ্যে রবীন্দ্রনাথ ঈশ্বরকে ভারতের ভাগ্যবিধাতারূপে কল্পনা করে ভারতের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে ঐক্যবিধান এবং তাঁর নানা ধর্ম ও সংস্কৃতির মধ্যে সাম্য রক্ষার জন্য ভারতকে আধ্যাত্মিক নেতৃত্ব দানের আহ্বান জানিয়ে যে প্রার্থনা-সংগীত রচনা করেছিলেন স্বাধীন ভারতে সেই গানটিকে জাতীয় সংগীতের মর্য্যাদা দেওয়া হয়েছে। ব্রিটিশ ও অন্যান্য সাম্রাজ্যবাদীগণের অসাম্য, নিষ্ঠুরতা ও শোষণের বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের বলিষ্ঠ প্রতিবাদও ইতিহাসে স্থায়ী প্রতিষ্ঠা অর্জন করেছে।

আন্তর্জাতিকতার অন্যতম প্রধান পুরোধা ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। জাতীয়তার বোধ যার গভীর নয়, যথার্থ আন্তর্জাতিক চেতনাসম্পন্ন হওয়া তার পক্ষে কখনই সম্ভব নয়। রবীন্দ্রনাথের জীবনে এই উক্তির সার্থকতার নিদর্শন প্রচুর পরিমাণে বিদ্যমান। হোমার, ভার্জিল, কালিদাস, শেকসপিয়ার, গ্যয়টে প্রমুখের মতো পৃথিবীর মহৎ কবি ও চিন্তানায়কগণের মধ্যে এর সারবত্তা লক্ষিত হয়েছে। তেমনি রবীন্দ্রনাথও ছিলেন গভীর জাতীয়তাবোধসম্পন্ন একজন ভারতীয় এবং এমনই একজন ভারতীয় যাঁর মাতৃভাষা ছিল বাঙলা। ভারতের ইতিহাস ও সংস্কৃতি এবং ভারতের সঙ্গে সম্পৃক্ত যাবতীয় মহৎ, শুভ ও স্থায়ী বস্তুর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক ছিল গভীর ও নিবিড়। কিন্তু উন্নাসিকতা তাঁর ছিল না। ‘ভ্রান্ত হোক, অভ্রান্ত হোক, আমার দেশ আমারই’ বা ‘আমার জাতি ইতিহাসের প্রাচীনতম ও মহত্তম’—এমন অনুদার দৃষ্টিভঙ্গী ছিল না তাঁর কোনোদিন। পৃথিবীর অন্যান্য দেশ ও জাতি থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে রেখে আত্মসন্তুষ্টির গজদন্তমিনারে ভারতকে বসিয়ে অপূর্ব স্বাতন্ত্র্যবোধের গৌরব ভুঞ্জনের কোনোরকম স্পৃহা ছিল না রবীন্দ্রনাথের। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে যেসব মহত্তম বাণী ও কর্ম উচ্চারিত ও সাধিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন তাদের ভারতে আবাহন করে আনার পক্ষে। পাশ্চাত্যের ভৌতবিজ্ঞান কি কারিগরী-বিদ্যা বা কেবলমাত্র পাশ্চাত্য বুদ্ধিচর্চাকেই নয়, পার্থিব ব্যাপারে, বুদ্ধির ক্ষেত্রে এবং অধ্যাত্মবিষয়ে ভারতকে সমৃদ্ধ করে তুলতে রবীন্দ্রনাথ পাশ্চাত্যের অধ্যাত্ম উপলব্ধিকেও গ্রহণ করতে চেয়েছিলেন। তাঁর স্বপ্নের ভারত, বস্তুত ইতিহাসেরই ভারত; এই ভারতে সকল সংস্কৃতি, সকল ভাষা ও সকল বিশ্বাস সমাদৃত, এক বিশ্বজনীন সুরসংগীত সৃষ্টির জন্য এখানে তাদের জন্য বিছানো এক গৌরবময় আসন।

এমনই বহুমুখী ছিল রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিত্ব। বেদ যাকে বলেছেন—বিশ্বমনা:—‘যিনি নিখিলব্যাপ্ত মানস, যিনি সার্বিক বোধসম্পন্ন’—রবীন্দ্রনাথকে সেই অভিধায় যথার্থরূপে বর্ণনা করা যেতে পারে। তিনি ছিলেন যথার্থই বিশ্বম্ভর—‘যিনি আপন ব্যক্তিত্বে মনুষ্য-জগতের সকল কিছুকেই ধারণ করেন।’ একটি বহুকোণসমন্বিত অতিকায় হীরকখন্ডের মতোই ছিল রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিত্ব—যার প্রতিটি কোণ থেকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে আলোর কণা। এই বিচ্ছুরিত ব্যক্তিত্বের সংস্পর্শে যারাই এসেছে আলোকিত হয়ে উঠেছে। তাই নাট্যকার রবীন্দ্রনাথ নাট্যরসিক ও নাট্যানুরাগীদের সঙ্গে তাদের আপন ক্ষেত্রে মিলতে পারতেন। জীবনের ব্রত হিসাবে যারা শিক্ষাকে কি সমাজসেবাকে একান্তভাবে গ্রহণ করেছে, সেই সমস্ত শিক্ষক ও সমাজবিজ্ঞানীরাও তাই সমাজসেবী রবীন্দ্রনাথ বা শিক্ষাব্রতী রবীন্দ্রনাথের গুণগ্রাহী ও অনুবর্তী হয়েছে। রাজনীতি ও জাতিগঠন সম্বন্ধে তাঁর সুস্থ চিন্তাধারা থেকে রাজনীতিক প্রেরণা সঞ্চয় করতে পারে, সংকীর্ণ-চিত্ত জাতীয়তাবাদী পারে সাধারণ মানুষের হিতের জন্য, সে-হিত অবশ্যই ভারতের মানুষকে বাদ দিয়ে নয়, বিভিন্ন জাতিসমূহের মধ্যে সহযোগিতামূলক মনোভাব গ্রহণের মতো উচ্চতর চিন্তাস্তরে উঠতে। রবীন্দ্র-প্রতিভার এই সর্বগ্রাহী বৈশিষ্ট্যই হল সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য বিষয় এবং আমার মনে হয় এর পটভূমিতে রয়েছে মানুষের প্রতি তাঁর অপরিসীম প্রীতি।

রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিত্বের এত সব বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য সত্ত্বেও নিজের সম্বন্ধে তিনি প্রায়ই বলে এসেছেন যে, তাঁর সর্বপ্রথম এবং সর্বপ্রধান পরিচয় এই যে, তিনি কবি, তিনি গায়ক—মানুষের সুখ-দুঃখ, আশা-নিরাশা, ব্যর্থতা, বেদনা, স্বপ্ন, আকাঙ্ক্ষার গান গেয়েছেন তিনি, গান গেয়েছেন তার, প্রিয় বলে মানুষ যাকে বুকে আঁকড়ে ধরেছে এবং বর্জনীয় বলে রাখতে চেয়েছে দূরে। কবিরূপে ভাষার মাধ্যমেই তাঁকে আত্ম-প্রকাশ করতে হয়। আর খুব স্বাভাবিক কারণে মাতৃভাষা বাঙলাকেই তিনি অবলম্বন করেছিলেন। ভারতের চিন্তা ও সংস্কৃতির ভান্ডার সংস্কৃত ভাষার উপরও তাঁর আধিপত্য ছিল। সংস্কৃতকে তিনি পেয়েছিলেন অতীতের উত্তরাধিকাররূপে। ইংরেজি ভাষার সঙ্গে তাঁর পরিচয়ও ছিল ঘনিষ্ঠ। বিশ্বের সর্বাধিক ব্যবহৃত ভাষা এই ইংরেজি বহির্জগতের আলো-হাওয়া বহন করে এনেছিল ভারতের অচলায়তনের অভ্যন্তরে। এই ভাষাচর্চায় তিনি যুগপৎ আনন্দ ও ফললাভ করেছিলেন। ইংরেজি ভাষার সাহায্যেই ব্রিটেন, ইউরোপ এবং সমগ্র পৃথিবীর বিশাল সাহিত্যের বিপুল ধনভান্ডারের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় সাধিত হয়েছিল।

কিন্তু মাতৃভাষাই ছিল তাঁর আত্মপ্রকাশের সর্বাধিক উপযোগী ও শক্তিশালী বাহন। কবির উচ্চতম চিন্তা, মহত্তম অনুভূতি ও অপূর্ব সুন্দর ভাবরাজি, তাঁর কবিতা ও সমালোচনা এবং চিন্তনে-গঠনে-সংহতিতে-উপলব্ধিতে সমুজ্জ্বল উপন্যাস-সমূহের অনবদ্য গীতিময় পংক্তিগুলি কবির মাতৃভাষাতেই রচিত। বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম ভাষাশিল্পীদের তিনি ছিলেন অন্যতম। রবীন্দ্রনাথের আবির্ভাবের পূর্বে বাঙলাভাষা ভারতের একটি প্রাদেশিক ভাষামাত্র ছিল, তিনি তার সকল সুপ্তশক্তিকে জাগিয়ে তোলেন। যে মাতৃভাষা ছিল পিতলের মতো ম্লানদ্যুতি তাকেই স্বর্ণকান্তিতে উজ্জ্বল করে দিয়ে যান রবীন্দ্রনাথ। মধ্যযুগীয় স্থবিরত্ব যে ভাষায় প্রায় সর্বাঙ্গ বেষ্টন করে রেখেছিল সেই ভাষারই অবসন্ন ধমনীতে প্রচুর প্রাণরক্ত ও জীবনীশক্তি সঞ্চার করে রবীন্দ্রনাথ তাকে আধুনিক ভাবপ্রকাশে বিশ্বের সকল প্রাগ্রসর ভাষার সমকক্ষ করে তুলেছিলেন। এর জন্যে একদিকে যেমন আমরা রবীন্দ্রনাথের প্রতিভা ও শিল্পনৈপুণ্যের কাছে ঋণী, তেমনি অন্যদিকে (ইংরেজি সাহিত্যের মাধ্যমে ইউরোপীয় চিন্তাধারার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত) বাঙলাভাষী মানুষের উপর পাশ্চাত্য চিন্তা ও সংস্কৃতির অভিঘাতের নিকটেও। এদিক থেকে রবীন্দ্রনাথকে দেবগুরু বৃহস্পতির সম্বন্ধে প্রযুক্ত ‘বাকপতি’ বা ‘বাক্যাধিরাজ’ নামে ভূষিত করলেই তাঁর কৃতিত্বের পূর্ণ মর্যাদা দেওয়া হয়।

বস্তুত তিনি ছিলেন যথার্থই ‘বাক্যাধিরাজ’। যে ‘বাচম’ তার সকল সুপ্ত শক্তি, সকল তেজ, সকল সৌন্দর্য্য নিয়ে সর্বপ্রথম তাঁর কাছে ধরা দিয়েছেন, রবীন্দ্রনাথ যে তাকে অত্যন্ত সার্থকতার সঙ্গে ব্যবহার করেছিলেন তাই নয়, বাঙলাভাষার চরিত্রবৈশিষ্ট্য ও ইতিহাসের উপর আলোক ক্ষেপণে যে কয়জন পূর্বসূরী সাফল্য লাভ করেছিলেন, তিনি তাঁদের অন্যতম। ১৯২৬ সালে আমার ইংরেজী গ্রন্থ The Origin and Development of Bengali Language-এর ভূমিকায় যা লিখেছিলাম এখান তা থেকে উদ্ধৃত করছি :

বৈজ্ঞানিক দৃষ্টি নিয়ে যে প্রথম বাঙালি মনীষী ভাষাসমস্যার দিকে চোখ ফিরিয়েছিলেন তিনি কবি রবীন্দ্রনাথ। ভাষাতত্ত্বের অনুরাগীদের কাছে শ্লাঘার বিষয় যে, ইনি একদিকে বাঙলাভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ লেখক এবং সর্বকালের শ্রেষ্ঠ কবি ও দ্রষ্টা; অন্যদিকে একজন তীক্ষ্ণধী ভাষাতাত্ত্বিক, যিনি ভাষারহস্যের সত্যসন্ধানে প্রগাঢ় নিষ্ঠাবান এবং আধুনিক পাশ্চাত্য ভাষাতত্ত্ববিদগণের বিচারপদ্ধতি ও আবিষ্কারসমূহের গুণগ্রাহী। বাঙলা ধ্বনিবিজ্ঞান, বাঙলা ধ্বন্যাত্মক শব্দ (onomato-poetics) বাঙলা বিশেষ্য পদ ও অন্যান্য বিষয়ের উপর রবীন্দ্রনাথের গবেষণা কয়েকটি প্রবন্ধের আকারে (বর্তমানে একটি গ্রন্থে সন্নিবিষ্ট) বাহির হয়—এদের প্রথমটির আবির্ভাব ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষদিকে এবং মাত্র কয়েক বৎসর আগে আরো কতকগুলি নূতন প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। এই প্রবন্ধগুলি বাঙালির কাছে তার ভাষা সমস্যা সমাধানের সঠিক পথনির্দেশ করে দিয়েছে বলা যেতে পারে।

আধুনিক ভারতের মহৎ চিন্তানায়কগণের অগ্রণী রামমোহন রায়ও বাঙলা ভাষার প্রতি মনোনিবেশ করেছিলেন। তাঁর ব্যাকরণে (১৮২৬ এবং ১৮৩৬ সালে প্রকাশিত) কতকগুলি অত্যন্ত মূল্যবান তথ্য তিনি লিপিবদ্ধ করে যান। কিছুটা সত্যদৃষ্টিসম্পন্ন আর কয়েকজন বাঙালি লেখক অবশ্য ছিলেন, কিন্তু তাঁদের সংখ্যা খুবই নগণ্য। তাঁদের মধ্যে চিন্তামণি গঙ্গোপাধ্যায় (১৮৮৫), নকুলেশ্বর বিদ্যাভূষণ (১৮৯৮) এবং হৃষীকেশ শাস্ত্রী (১৯০০) নাম ক-টি উল্লেখ করা যেতে পারে। রবীন্দ্রনাথের বয়োজ্যেষ্ঠ সমসাময়িক বাঙলাদেশের আর দুটি সুসন্তান বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী এবং ঐতিহাসিক ও প্রত্নতত্ত্ববিদ হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তাঁদের প্রবন্ধাবলীতে বাঙলাভাষা চর্চায় একটি যুক্তিপ্রবণ দৃষ্টিভঙ্গী প্রবর্তনের প্রয়াস করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ সহজেই রামেন্দ্রসুন্দর ও হরপ্রসাদের পথের অনুবর্তী হন এবং বাঙলা সাহিত্যের সর্বজনস্বীকৃত শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিকরূপে তাঁর প্রভাব দিয়ে মাতৃভাষা ও তার গতিপ্রকৃতির সঠিক মূল্যায়নে আগ্রহী বুদ্ধিমান বাঙালি সাধারণের মানসিকতা প্রস্তুতিতে সাহায্য করে—অবশ্য গোঁড়া মানসিকতাসম্পন্ন পন্ডিতেরা দূরত্ব বজায় রেখেই চলেছিলেন।

রবীন্দ্রনাথ আমাদের বলেছেন যে, বাঙলা তাঁর মাতৃভাষা বলে এবং চেনা পরিবেশ থেকে সচেতন প্রয়াস ছাড়াই তাকে গ্রহণ করেছিলেন বলে তিনি ধরেই নিয়েছিলেন যে এ ভাষা সকলের পক্ষেই সহজবোধ্য। কিন্তু কোনো একসময় জনৈক অবাঙালিকে এই ভাষা শেখাতে গিয়ে তিনি দেখতে পান যে, এই সহজ ভাষাটিরই নানা অব্যাখ্যাত জটিলতা মাথা ঠেলে দাঁড়াতে শুরু করেছে। এই সমস্যা তাঁকে ভাবিয়ে তুলল। তখনই এ সম্পর্কে তথ্য ও উদাহরণ সংগ্রহে লেগে যান। তাঁর এই গবেষণা থেকেই সর্বপ্রথম বাঙলাভাষার প্রামাণিক কথ্যরূপের ধ্বনিবিজ্ঞানের মৌল নিয়মগুলি নির্দিষ্ট হয়। বাঙলাভাষার ধ্বন্যাত্মক শব্দগুলি একটি বিশেষ স্বভাবের বাগরীতি; এই রীতি ইন্দো-আর্য ভাষাগোষ্ঠীর অন্যান্য শাখা এবং দ্রাবিড়ীয় ও অষ্ট্রীয় ভাষাসমূহেও দৃষ্টিগোচর হয়। রবীন্দ্রনাথই প্রথম এই শ্রেণীর শব্দগুলির প্রকৃতি ও কার্যকলাপ নিরূপণ করেন। এই গবেষণায় রবীন্দ্রনাথের মৌলিক প্রবন্ধটি অন্য আর একদিক থেকে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী কতৃক সার্থকভাবে সম্পূরিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের এই প্রাথমিক প্রচেষ্টার খুঁটিনাটির মধ্যে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। হয়তো এই বিভাগে তাঁর সত্যকার দানের পরিমাণ খুব বেশি নয়—মোটামুটি একটি যোগসূত্রে গ্রথিত কয়েকটি এলোমেলো প্রবন্ধের সমষ্টি। উল্লেখিত প্রবন্ধগুলি পরবর্তীকালে শব্দতত্ত্ব নামে পুস্তকাকারে ১৯০১ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়। কিন্তু প্রবন্ধগুলির মূল্য ভাষাচর্চার সূত্রপাতে এবং সঠিক পথনির্দেশনায়। এখানেই রবীন্দ্রনাথের কৃতিত্ব। আধুনিক ইন্দো-আর্য ভাষাসমূহের প্রথম তুলনামূলক ব্যাকরণ রচনা করে যিনি ‘আধুনিক ইন্দো-আর্য ভাষাবিজ্ঞানের জনক’ পদবাচ্য সেই John Beames-কৃত বাঙলা ব্যাকরণের একটি রসপূর্ণ সমালোচনাও করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কী গভীর নিষ্ঠায় যে রবীন্দ্রনাথ ভাষাবিজ্ঞান এবং ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাসমূহের তুলনামূলক ব্যাকরণচর্চা করেছিলেন তার উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যেতে পারে যে, এই বিষয়ে শিক্ষিত বিখ্যাত জার্মান পন্ডিত Karl Prugmams কৃত চার খন্ডে সমাপ্ত বিরাট গ্রন্থটির ইংরেজি অনুবাদ তিনি পড়েছিলেন। কবির নিজের হাতে পেনসিল চিহ্ন দেওয়া ও মন্তব্য লেখা সেই গ্রন্থের একটি খন্ড শান্তিনিকেতন গ্রন্থাগারে আমি দেখেছি।

প্রসঙ্গত বলা উচিত যে-বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ, রবীন্দ্রনাথের দীর্ঘজীবনে কোনোসময়ই ক্ষুণ্ণ হয়নি। বালক বয়সেই বিজ্ঞানে তাঁর হাতেখড়ি। এই সময় কবির পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ আকাশের গ্রহনক্ষত্রের সঙ্গে তাঁর পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। ১৯২৭ সালে তিনি মালয়, ইন্দোনেশিয়া ও শ্যামদেশ ভ্রমণে বহির্গত হন, সে-সময় তাঁর ভ্রমণসঙ্গী হওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। এই ভ্রমণে বেরিয়ে পড়াশোনা করার জন্যে তিনি কলকাতার বড়ো বড়ো বই-এর দোকান ঘেঁটে বহু বই কিনেছিলেন। এর মধ্যে ছিল Today and Tomorrow গ্রন্থমালার আঠারো থেকে কুড়ি খন্ড বই। ইংরেজিতে লেখা বিজ্ঞান বিষয়ক এই ক্ষুদ্র গ্রন্থমালায় ভৌতবিজ্ঞান ও মনোবিজ্ঞানের সর্বাধুনিক তথ্যের আলোচনা থাকত। কবির এই জ্ঞানলিপ্সা আমাতেও সংক্রামিত হয় এবং আমি এদের মধ্যে অন্তত আধডজন বই পড়ে ফেলার সময় ও সুযোগ পেয়েছিলাম।

বাঙলা ভাষাতত্ত্ব ও সমস্যার চর্চায় রবীন্দ্রনাথ কখনোই ক্ষান্ত হননি এবং সময় ও সুযোগমতো এই বিষয়ে ভাবনা-রসোজ্জ্বল প্রবন্ধ রচনা করে এসেছেন। বাঙলা ছন্দের জটিল প্রসঙ্গের ব্যাখ্যা করেছেন আপন বিশিষ্ট ভঙ্গীতে। কবির আলাপ-আলোচনায়, বিশেষ করে আমি যখন তাঁর সঙ্গে থাকতাম, বাঙলা ব্যাকরণের নানা বৈশিষ্ট্য ও সমস্যার অবতারণা হত এবং আমরা সর্বদাই কবির মতামত ও উক্তি থেকে নতুন আলোকলাভের অপেক্ষায় থাকতাম; কবিও সরস কৌতুকবিচ্ছুরিত অনবদ্য ভঙ্গীতে সর্বদা আমাদের আশা চরিতার্থ করতেন। আমার লেখা The Origin and Development of the Bengali Language গ্রন্থখানি পাঠ করে কবি আমার প্রতি পরম সম্মান প্রদর্শন করেছেন। আমার পক্ষে অত্যন্ত গৌরবের কথা এই যে, এই গ্রন্থে অনুসৃত আমার দৃষ্টিভঙ্গী, বিচারপদ্ধতি ও গৃহীত সিদ্ধান্ত কবির প্রশংসা অর্জন ও সমর্থন লাভ করেছে। কতকগুলি রচনায় কবি তা প্রকাশও করেছেন। আমার এই কাজের জন্য যে তিনি আমার প্রতি বিশেষ স্নেহ পোষণ করতেন তার প্রচুর নিদর্শন আমি পেয়েছি।

কবির এই স্নেহ আমার জীবনে এক পরম গৌরব। কিন্তু আমার বিশ্বাস কবির স্নেহের উৎস রসবর্জিত শুষ্ক পান্ডিত্যে নয়, বরং মানুষ ও তার পরিবেশের প্রতি আগ্রহই যে আমার ভাষাচর্চার সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত এই ধারণাই তাঁর স্নেহের মূলে। এ বিষয়ে আমার নিজের স্পষ্ট কোনো ধারণা ছিল না। কিন্তু রবীন্দ্রনাথেরই প্রথমে এদিকে দৃষ্টি পড়ে এবং তখনই আমি এ বিষয়ে সচেতন হই। আমার এত সব কথা বলার উদ্দেশ্য হল, মানবপ্রীতিই যে কবিকে ভাষার উদ্ভব ও কার্যকলাপের প্রতি আগ্রহশীল করে তোলে সেই সত্যটির উপর গুরুত্ব আরোপ করা।

বাঙলাভাষা সম্বন্ধে কবির পরবর্তীকালের আলোচনা ১৯৩৮ সালে গ্রন্থাকারে বাঙলাভাষা-পরিচয় নামে প্রকাশিত হয়। বইটি কবি আমার নামে উৎসর্গ করেন এবং উৎসর্গপত্রে আমাকে ‘ভাষাচার্য’ বলে আখ্যাত করেন। কবির দেওয়া এই অনুষ্ঠানহীন উপাধি আমি পরম মূল্যবান জ্ঞান করে সগর্বে নিজের নামের সঙ্গে ব্যবহার করে আসছি। যথার্থ পন্ডিতজনোচিত বিনয় প্রকাশ করে কবি এই গ্রন্থে নিজেকে ‘পায়ে-চলা পথের ভ্রমণকারী’ বলে পরিচয় দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ভাষারাজ্যের রাজপথ ও গলিপথে বিচরণ করে তিনি আপন মতামত ব্যক্ত করে চলেছেন, উদ্দেশ্য পাঠকগোষ্ঠীর মধ্যে ভাষারাজ্যের অনুরূপ ভ্রমণরসিক গড়ে তোলা। গ্রন্থটির সূচনায় তিনি লিখেছেন,

মানুষের মনোভাব ভাষাজগতের

যে অদ্ভুত রহস্য আমার

মনকে বিস্ময়ে অভিভূত করে

তারই ব্যাখ্যা করে এই

বইটি আরম্ভ করেছি।

তাই দেখি, কবির মধ্যে বাকরহস্যের প্রতি বিস্ময়বোধ যেমন বিদ্যমান, তেমনি সেই রহস্যকে ভেদ করবার সচেতন ইচ্ছা ও প্রয়াস। অন্যান্য আর অনেক বিষয়ের মতোই ভাষারাজ্যেও রবীন্দ্রনাথ তাই সমান মরমী, সমান চিন্তাশীল, সমান বিজ্ঞানদৃষ্টিসম্পন্ন।

প্রবন্ধের প্রথম উদ্ধৃত ঋগ্বেদের সূক্তটির অনুপম বর্ণনা অনুযায়ী রবীন্দ্রনাথ সত্যকার অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে বাককে দর্শন ও শ্রবণ করেছিলেন এবং বাকও তার সকল মাধুর্যে মন্ডিত হয়ে, পতি ও বল্লভসকাশে প্রেমমুগ্ধা জায়ার মতোই কবির কাছে ধরা দিয়েছিলেন। সকল দিক দিয়ে তিনি তাই বাকপতি, বাগবল্লভ। বিশ্বের যা কিছু মানুষের কৌতূহলের সামগ্রী সে-সমস্ত দিকেই ধাবিত হয়েছে কবির বাধামুক্ত মন; বাকপ্রীতি কবির সেই বিপুল বিস্তৃত মানসিকতারই একটি অঙ্গ। রবীন্দ্রনাথ তাই বিশ্বমনা:, আবার বাকপতিও।।

শতবার্ষিক জয়ন্তী উত্সর্গ গ্রন্থে মুদ্রিত

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *