বিপুল গভীর মধুর মন্দ্রে কে বাজাবে সেই বাজনা! উঠিবে চিত্ত করিয়া নৃত্য , বিস্মৃত হবে আপনা । টুটিবে বন্ধ মহা আনন্দ , নব সংগীতে নূতন ছন্দ , হৃদয়সাগরে পূর্ণচন্দ্র জাগাবে নবীন বাসনা । সঘন অশ্রুমগন হাস্য জাগিবে তাহার বদনে । প্রভাত-অরুণকিরণরশ্মি ফুটিবে তাহার নয়নে । দক্ষিণ করে ধরিয়া যন্ত্র ঝনন রণন স্বর্ণতন্ত্র , কাঁপিয়া উঠিবে মোহন মন্ত্র নির্মল নীল গগনে । হা হা করি সবে উচ্ছল রবে চঞ্চল কলকলিয়া চৌদিক হতে উন্মাদ স্রোতে আসিবে তূর্ণ চলিয়া । ছুটিবে সঙ্গে মহাতরঙ্গে ঘিরিয়া তাঁহারে হরষরঙ্গে বিঘ্নতরণ চরণভঙ্গে পথকন্টক দলিয়া । দ্যুলোক চাহিয়া সে লোকসিন্ধু বন্ধনপাশ নাশিবে , অসীম পুলকে বিশ্ব-ভূলোকে অঙ্কে তুলিয়া হাসিবে । ঊর্মিলীলায় সূর্যকিরণ ঠিকরি উঠিবে হিরণবরন , বিঘ্ন বিপদ দুঃখ মরণ ফেনের মতন ভাসিবে । ওগো কে বাজায় , বুঝি শোনা যায় , মহা রহস্যে রসিয়া , চিরকাল ধরে গম্ভীর স্বরে অম্বর- ' পরে বসিয়া । গ্রহমণ্ডল হয়েছে পাগল , ফিরিছে নাচিয়া চিরচঞ্চল — গগনে গগনে জ্যোতি-অঞ্চল পড়িছে খসিয়া খসিয়া । ওগো কে বাজায় কে শুনিতে পায় , না জানি কী মহা রাগিণী! দুলিয়া ফুলিয়া নাচিছে সিন্ধু সহস্রশির নাগিনী । ঘন অরণ্য আনন্দে দুলে — অনন্ত নভে শত বাহু তুলে , কী গাহিতে গিয়ে কথা যায় ভুলে , মর্মরে দিনযামিনী । নির্ঝর ঝরে উচ্ছ্বাসভরে বন্ধুর শিলা-সরণে । ছন্দে ছন্দে সুন্দর গতি পাষাণহৃদয়-হরণে । কোমল কণ্ঠে কুল্ কুল্ সুর ফুটে অবিরল তরল মধুর , সদাশিঞ্জিত মানিকনূপুর বাঁধা চঞ্চল চরণে । নাচে ছয় ঋতু , না মানে বিরাম , বাহুতে বাহুতে ধরিয়া শ্যামল স্বর্ণ বিবিধ বর্ণ নব নব বাস পরিয়া । চরণ ফেলিতে কত বনফুল ফুটে ফুটে টুটে হইয়া আকুল , উঠে ধরণীর হৃদয় বিপুল হাসি-ক্রন্দনে ভরিয়া । পশু-বিহঙ্গ কীটপতঙ্গ জীবনের ধারা ছুটিছে । কী মহা খেলায় মরণবেলায় তরঙ্গ তার টুটিছে । কোনোখানে আলো কোনোখানে ছায়া , জেগে জেগে ওঠে নব নব কায়া , চেতনাপূর্ণ অদ্ভুত মায়া বুদ্বুদ সম ফুটিছে । ওই কে বাজায় দিবস-নিশায় বসি অন্তর-আসনে , কালের যন্ত্রে বিচিত্র সুর — কেহ শোনে কেহ না শোনে । অর্থ কী তার ভাবিয়া না পাই , কত গুণী জ্ঞানী চিন্তিছে তাই , মহান মানব-মানস সদাই উঠে পড়ে তারি শাসনে । শুধু হেথা কেন আনন্দ নাই , কেন আছে সবে নীরবে ? তারকা না দেখি পশ্চিমাকাশে , প্রভাত না দেখি পুরবে । শুধু চারি দিকে প্রাচীন পাষাণ জগৎ-ব্যাপ্ত সমাধিসমান গ্রাসিয়া রেখেছে অযুত পরান , রয়েছে অটল গরবে । সংসারস্রোত জাহ্নবীসম বহু দূরে গেছে সরিয়া । এ শুধু ঊষর বালুকাধূসর মরুরূপে আছে মরিয়া । নাহি কোনো গতি , নাহি কোনো গান , নাহি কোনো কাজ , নাহি কোনো প্রাণ , বসে আছে এক মহানির্বাণ , আঁধার-মুকুট পরিয়া । হৃদয় আমার ক্রন্দন করে মানব-হৃদয়ে মিশিতে — নিখিলের সাথে মহা রাজপথে চলিতে দিবস-নিশীথে । আজন্মকাল পড়ে আছি মৃত জড়তার মাঝে হয়ে পরাজিত , একটি বিন্দু জীবন-অমৃত কে গো দিবে এই তৃষিতে ? জগৎ-মাতানো সংগীততানে কে দিবে এদের নাচায়ে! জগতের প্রাণ করাইয়া পান কে দিবে এদের বাঁচায়ে! ছিঁড়িয়া ফেলিবে জাতিজালপাশ , মুক্ত হৃদয়ে লাগিবে বাতাস , ঘুচায়ে ফেলিয়া মিথ্যা তরাস ভাঙিবে জীর্ণ খাঁচা এ । বিপুল গভীর মধুর মন্দ্রে বাজুক বিশ্ববাজনা! উঠুক চিত্ত করিয়া নৃত্য বিস্মৃত হয়ে আপনা । টুটুক বন্ধ , মহা আনন্দ , নব সংগীতে নূতন ছন্দ — হৃদয়সাগরে পূর্ণচন্দ্র জাগাক নবীন বাসনা ।