বিশ্বনবীর স্নেহচ্ছায়ায়

বিশ্বনবীর স্নেহচ্ছায়ায়

রসূলে–আকরম ইসলাম প্রচার করে চলেছেন নিত্য-নব উৎসাহ নিয়ে, নিত্যনতুন প্রেরণা নিয়ে। তওহীদের বাণী শান্তির ললিতবাণী পৌঁছে দিচ্ছেন মক্কার ঘরে ঘরে। আত্মীয়-অনাত্মীয় নারী পুরুষ নির্বিশেষে।

কিন্তু মক্কাবাসীরা সে ললিতবাণী অন্তর দিয়ে গ্রহণ করছে না। তাদের মর্মমূলে ঝংকৃত হচ্ছে না। তাঁর বিপক্ষতাই করে চলেছে এবং নিত্য-নতুনভাবে হিংসায় মেতে উঠেছে, সে মহাবাণীর কণ্ঠরোধ করতে। এ জগতে বারবার দেখা গেছে যে, সাধারণ সংগ্রাম-সংঘাতের চেয়ে, সাধারণ হিংসা-দ্বেষের চেয়ে ধর্ম নিয়ে হিংসা-দ্বেষ, সংগ্রাম- সংঘাত ও হানাহানি বহু বহু গুণে মারাত্মক হয়ে উঠে, তীব্র হয়ে উঠে।

ইসলামপন্থীদের উপর মক্কার বিপক্ষ দলের হিংসা দিন দিন প্রবলতর হয়ে উঠেছিল। রসূলে-আকরম চিন্তা করলেন, কী উপায়ে এ নিগ্রহনিপীড়ন সাময়িকভাবে প্রতিরোধ করা যায়। মুসলিমদের জীবন রক্ষা করা যায়।

এ সময় ইয়ারিবের একটা সংখ্যাগরিষ্ঠ বাসিন্দা ইসলাম গ্রহণ করেছিল। ইয়াবিই পরবর্তীকালে পবিত্র মদিনা নগরী নামে মানচিত্রে চিহ্নিত হয়েছে। এইসব নও-মুসলিম হযরত ও তাঁর সাহাবাদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে তাঁদেরকে আমন্ত্রণ জানালো, তাদের ইয়ারিব শহরে হিজরত করতে। আঁ-হযরতও বিবেচনা করলেন, আপাতত ইয়ারিবে হিজরত করাই যুক্তিযুক্ত। ইসলামের অমর জ্যোতি দিগ-দিগন্তে ছড়িয়ে প্রশস্ত ক্ষেত্র হিসেবে মদিনাই উপযুক্ত স্থান বিবেচিত হলো।

আঁ-হযরত নির্দেশ দিলেন, মুসলিমরা এক-একজন বা দু’জন করে চুপে চুপে মদিনায় হিজরত করবে, যাতে মক্কাবাসীদের দৃষ্টি এদিকে আকৃষ্ট না হয়। তার পর সুযোগ বুঝে তিনিও হিজরত করবেন।

এ নির্দেশের সুযোগ সর্বপ্রথম গ্রহণ করেন আবু সালমাহ্ আবদুল্লাহ ইবনে আশহাল। তাঁর পরে হিজরত করেন বিলাল, যিনি রসূলে আকরামের ময়ান হিসেবে ইসলামের ইতিহাসে প্রখ্যাত এবং আম্মার, ইয়াসির ছিলেন বিলালের সহগামী। তাঁদের পরই ওমর হিজরত করেন। এ সম্বন্ধে তাঁর উক্তিই উল্লেখযোগ্য :

আয়াশ ইবনে আবি রাবিয়া এবং হিশাম ইবনে আল-আস হিজরতে আমার সহগামী হবেন স্থির হয়। আপোষে আমরা যুক্তি করি যে, যদি আমাদের মধ্যে কেউ যথাসময়ে বের হতে না পারি, তাহলে বাকি দুজন তার অপেক্ষা না করেই রওয়ানা দেব। শেষ পর্যন্ত আমি আয়াশ বের হয়ে পড়ি, হিশাম থেকে যায়। অতঃপর ভাগ্যে যা ছিল, তা ঘটে। আমরা দুজনে চলতে চলতে কুবায় উপস্থিত হই। আয়াশ ইবনে রাবিয়া পরে মাকে নিয়ে যাওয়ার জন্যে মক্কায় ফিরে আসে, কিন্তু কোরায়েশরা তখন তাকে বন্দী করে ফেলে এবং তার ভাগ্যে যা ছিল, তাই ঘটে।

মদিনায় বসবাসের ব্যবস্থা যথেষ্ট ছিল না। এ জন্যে অধিকাংশ মুহাজেরীন মদিনা থেকে দুতিন মাইল দূরবর্তী কুবায় অবস্থান করতো। ওমর এখানেই আগমন করেন ও রাফাহ্ ইবনে-আবদুল মনাযিরের আতিথ্য গ্রহণ করেন। ওমরের পর প্রায় সব সাহাবাই হিজরত করেন। শেষে হিজরত করেন খোদ রসূলে আকরম আবুবকর সিদ্দীককে সঙ্গে নিয়ে। সেদিন ছিল রবিউল আউয়াল মাসের বারো তারিখ, শুক্রবার। রসূলে-আকরম প্রথমে জুমার নামায আদায় করেন ও পরে শহরে প্রবেশ করেন। এ দিন ছিল ইয়ারিবের স্বর্ণদিন এবং এ দিন থেকে তার নামকরণ হয় মুদিনাতুন নবী। তওহীদের ধ্রুব জ্যোতি অতঃপর মদিনা থেকেই দিগ্‌বিদিকে ছড়িয়ে পড়ে।

মদিনায় আগমনের পর আঁ-হযরতের প্রধান কাজ হলো মুহাজেরীনের পূনর্বাসন করা। তিনি আনসারদের একত্র করে আনসারী ও মুহাজেরীনকে ইসলামের ধর্মীয় বন্ধনে গ্রথিত করেন। এই নয়া ভ্রাতৃত্বের মহান বৈশিষ্ট্য ছিল আধুনিক কমিউনিজম-এর চেয়েও প্রগতিপন্থী। তার দরুন প্রত্যেক আনসারী একজন মুহাজেরকে গ্রহণ করে এবং ধর্মভাই হিসেবে নিজের সম্পত্তি অর্থ ও অন্যান্য সম্পদ স্বেচ্ছায় তার সঙ্গে সমভাগে গ্রহণ করেন। এই ভ্রাতৃত্বের বন্ধনকালে আঁ-হযরত দুই পক্ষের সামাজিক অবস্থা ও মর্যাদার দিকে লক্ষ্য রাখেন, তার ফলে প্রত্যেক মুহাজেরের জন্যে তিনি সম্মান সামাজিক মর্যাদায় আনসারীকে নির্বাচিত করেন। এভাবে ওমরের ধর্মভাই হিসেবে নির্বাচিত হন ওবান্ ইবনে-মালিক, যিনি বনি-সলিম গোত্রের সরদার ছিলেন।

আঁ-হযরত মদিনাতে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করলেও ওমর অন্য বহু সাহাবার মতো কুবাতেই বাস করতে থাকেন। কিন্তু একদিন অন্তর তিনি নিয়মিতভাবে মদিনায় রসূলের সাহচর্যে সারাদিন অতিবাহিত করতেন এবং মধ্যবর্তী দিনগুলিতে থাকতেন তাঁর আনসার-ভাই ওবান্ ইবনে-মালিক। ওমর তাঁর নিকট থেকে শ্রবণ করতেন সে-দিনের আঁ-হযরতের মুখ নিঃসৃত বাণী।

মদিনায় হিজরতের পর মুসলিমদের জীবন শান্তিতে নিরুপদ্রপে এবং স্বাভাবিক গতিতে চলতে থাকে। তখন সুযোগ আসে ইসলামের ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলি বিধিবদ্ধ করার ও যথারীতি পালন করার। মক্কার মুসলিমদের জীবন ছিল সর্বদাই সঙ্কটাপন্ন, তার দরুন আত্মরক্ষাই ছিল প্রথম নীতি। এ জন্যে রোযা, যাকাত, জুম্মার নামায, ঈদের নামায, সাদকায়ে ফিতর তখনও নির্দিষ্ট হয় নি। নামাযও যথাসম্ভব সংক্ষিপ্ত করা হতো। এবং এশার নামায ব্যতীত অন্য সব সময়ে মাত্র দুই রাকাতে সীমিত ছিল। এমনকি তখনও নামাযে সাধারণ আহ্বান কী পদ্ধতিতে করা যায়, তাও স্থিরীকৃত হয় নি। এ জন্যে রসূলে আকরাম সর্বপ্রথমে এ পদ্ধতিটি স্থির করতে মনস্থ করেন। ইহুদীরা বিউগল বাজায়, খ্রিস্টানরা বাজায় ঘণ্টা; অনেক সাহাবা এই রকম একটা বাদ্যযন্ত্র বাজাবার প্রস্তাব দেন। বিশ্বনবী যখন এ বিষয়ে একটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেওয়ার বিষয়ে চিন্তা করছেন তখন ওমর উপস্থিত হয়ে প্রস্তাব করেন : আপনি একজন লোককেই এ কাজে নিযুক্ত করেন। তাঁর ইঙ্গিতে আঁ-হযরত সমাধানের সূত্র পান এবং বিলালকে নির্দেশ দেন আযান দিতে। তখনই বিলাল তাঁর বিশিষ্ট সুমধুর আযান ধ্বনিতে দিগ-দিগন্ত ভরিয়ে তোলেন। বাদ্যযন্ত্রের পরিবর্তে মানুষের গলার স্বর পেল এ মহৎ সম্মান।

আযান হচ্ছে প্রতি ওয়াক্তের নামাযের ভূমিকা। সালাতের একটি বিশিষ্ট অঙ্গ এবং ইসলামের একটি গৌরবিত অপরিহার্য অনুষ্ঠান। ওমরের গৌরবিত কৃতিত্ব হচ্ছে একটি ধর্মীয় মহৎ বিধির ইঙ্গিত দান করা।

হিজরত থেকে শুরু করে রসূলে-আকরমের ওফাত বা তিরোভাব পর্যন্ত ন্যূনাধিক দশ বছরের ইতিহাস প্রধানত বিশ্বনবীরই ইতিহাস। এ সময়ে অন্য সব সাহাবার মতো ওমরও বিশ্বনবীরই নির্দেশ ও ইচ্ছামতো চালিত হতেন এবং তাঁর সত্তাতেই নিজেকে বিলীন করে দেওয়া সৌভাগ্য মনে করতেন। এ জন্যে ওমরের এ কয় বছরের কাহিনী বিশ্বনবীর জীবনেতিহাসের সঙ্গে এবং ইসলামের প্রচারকল্পে যেসব নীতিও গ্রহণ করতে হয়েছে, যে-সবের বিস্তৃত বিবরণ দেওয়ার সুপ্রশস্ত হচ্ছে বিশ্বনবীর জীবনী। কিন্তু এ কথায় সন্দেহের অবকাশ নেই যে, যে-সবে ওমরের ছিল সক্রিয় অংশ এবং তাঁর ভূমিকাও ছিল উল্লেখযোগ্য। এখানে সে-সব ঘটনার সংক্ষিপ্ত উল্লেখ মাত্র দিয়ে ওমরের ভূমিকার উপরেই বিস্তৃত আলোকপাত করা হবে এবং তার দ্বারা ওমরের ব্যক্তিত্ব ও চরিত্র ফুটিয়ে তোলার প্রচেষ্টা করা যাবে।

হিজরতের পর মক্কার কোরায়েশকুল চিন্তা করলো, মুসলিমরা মদিনায় সংখ্যা বৃদ্ধি ও শক্তি সঞ্চয় করবার সুযোগ পাবে, অতএব এখনই তাদেরকে সমূলে নিপাত করা উচিত। তারা মদিনা আক্রমণ করার উদ্দেশ্য প্রস্তুতি চালাতে লাগলো এবং দু-তিনবার সামান্য সৈন্য নিয়ে মদিনায় উপর হামলা করবার চেষ্টাও করলো। কিন্তু আঁ-হযরত পূর্বেই সংবাদ পেয়ে তাদের মোকাবিলা করার জন্য প্রস্তুত ছিলেন।

হিজরীর দ্বিতীয় সনে (৬২৪ খ্রি.) প্রসিদ্ধ বদরের যুদ্ধ বাঁধে। এ যুদ্ধের প্রধান কারণ হচ্ছে, আবু সুফিয়ান সিরিয়া থেকে বাণিজ্য শেষে কোরায়েশদিগকে আশু সংবাদ পাঠান যে মুসলিমরা তাঁর পণ্য-সম্ভার লুট করতে মনস্থ করেছে এবং সংবাদ মিথ্যা হলেও মক্কাবাসীরা প্রায় সাড়ে নয়শো সৈন্য নিয়ে মদিনা আক্রমণ করতে অগ্রসর হয়। রসূলে- আকরম মাত্র তিনশো তেরজন যোদ্ধা নিয়ে আক্রমকদের মোকাবিলা করতে অগ্রসর হন। মদিনা থেকে ছয়টি মনযিল পথের দূরে বদর প্রান্তরে এ যুদ্ধ হয় এবং বিধর্মীরা সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত হয়। মুসলিম পক্ষে ছয়জন মুহাজেরীন ও আটজন আনসার নিহত হয়। এ যুদ্ধে ওমর বরাবর আঁ-হযরতের দক্ষিণহস্তরূপ ছিলেন। আরও উল্লেখযোগ্য যে এ যুদ্ধে ওমরের গোত্র বানু আদির কেউ কোরায়েশ পক্ষে যোগ দেয়নি ওমরের বারোজন আত্মীয় তাঁর সঙ্গে যোগ দেয় এবং ওমরের গোলাম মাহজা ছিল এ যুদ্ধের প্রথম শহীদ। কোরায়েশ পক্ষের একজন সম্ভ্রান্ত নেতা ও ওমরের মাতুল আস্-ই-ইবনে-হিশাম-ইবনে মুগিরাহ্ যুদ্ধকালে ওমরের হাতেই নিহত হন। কোরায়েশ পক্ষের সত্তরজন মুসলিমদের হাতে বন্দী হয়। যুদ্ধ বন্দীদের নিয়ে কি করা যায়, এ সম্বন্ধে রসূলে-আকরম সাহাবাদের মতামত আহ্বান করেন। আবুবকর সিদ্দীক প্রস্তাব করেন, বন্দীরা সকলেই জ্ঞাতি গোত্রের, অতএব কিছু মুক্তি-মূল্য নিয়ে ছেড়ে দেওয়াই শ্রেয়। ওমর এ প্রস্তাবের বিরুদ্ধতা করে বলেন, ইসলামের প্রশ্ন যেখানে জড়িত, সেখানে জ্ঞাতি গোত্রের কথাই ওঠে না। তাদের সকলকেই প্রাণদণ্ড দেওয়া উচিত; রসুলে-আকরম এ ক্ষেত্রে করুণাই দেখান, আবুবকরের যুক্তি গ্রহণ করে মুক্তি-মূল্যের বিনিময়ে সকলকেই মুক্তি দান করেন। এ সময়ে কোরআনের যে অংশটি নাযেল হয় সেটি স্মরণীয়: যমীনের উপর সুদৃঢ় আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত বন্দীদেরকে অধিকারে আনা কোনও নবীর পক্ষে সঙ্গত হয় না। (সূরা আনফাল-৬৭)

বদরের যুদ্ধে শোচনীয় পরাজয় বরণ করে কোরায়েশরা প্রতিশোধ নিতে মরিয় হয়ে উঠে। আবু সুফিয়ান তো প্রতিজ্ঞাই করে বসেন, যে পর্যন্ত না বদরের দাদ তোলা হয়, ততদিন তিনি গোসলই করবেন না। কোরায়েশ নেতাদের অনুরোধে তিনি পরবর্তী যুদ্ধের সমস্ত ব্যয়ভার বহন করতে রাজী হন। অতঃপর দুশো অশ্বারোহী সাতশো ঢাল ধারী ও একুশ শো পদাতিক, মোট তিন হাজার সৈন্যের বাহিনী নিয়ে আবু সুফিয়ান মদীনার দ্বারদেশে হানা দিলেন। দক্ষিণ-বাহুর সেনানায়ক ছিলেন বীরকেশরী খালিদ বিন-ওয়ালিদ এবং বাম বাহুর অধিনায়ক ছিলেন ইকরামা-বিন-আবুজিহিল। বলা বাহুল্য তাঁরা তখনও ইসলাম কবুল করেন নি। আঁ-হযরত মাত্র সাতশো সৈন্য নিয়ে মদিনা থেকে বের হয়ে ওহোদ পর্বতের সানুদেশে উপস্থিত হন। যুদ্ধ আরম্ভ হলে মুসলিমরাই প্রথমে শত্রুদেরকে সকল দিক থেকে বিধ্বস্ত করতে থাকেন ও একেবারে বিপর্যস্ত করে ফেলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে মুসলিম বিজয় সুনিশ্চিত দেখে ছত্রভঙ্গ হয়ে লোভার্তের মতো লুণ্ঠনে মেতে উঠলেন। আর সুযোগসন্ধানী রণকুশলী খালিদ সহসা পশ্চাৎ থেকে বজ্রের মতো ঝাঁপিয়ে পড়লেন মুসলিমদের উপর। মুসলিমরাও আক্রমণের জন্যে মোটেই প্রস্তুত ছিলেন না। তাঁরা একেবারে বিধ্বস্ত হয়ে পড়লেন। এমনকি তীব্র বিশৃঙ্খলার মধ্যে এমন রবও উঠে গেল, আঁ-হযরত শহীদ হয়েছেন।

ওমর তালহা প্রভৃতি মহারথিগণ তখন কিংকর্তব্যবিমূঢ়। আনাস-বিন-নযর বললেন আঁ-হযরতের শাহাদাৎ হলেও যুদ্ধে বিরতি দেওয়া সঙ্গত হবে না। যা হোক, তাঁরা প্রাণপণে যুদ্ধ চালাতে লাগলেন এবং আঁ-হযরত জীবিত আছেন শোনামাত্রই তাঁর নিকটে উপস্থিত হলেন। তাদের হেফাজতে হযরতের নিরাপত্তা নিশ্চিত হলো। খালিদ একদল সৈন্য নিয়ে পুনরায় হযরতের উপর হামলা করতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিন্তু তখন হযরতের জ্ঞান ফিরে এসেছে, তিনি চিৎকার করে উঠেন: হে আল্লাহ্! লোকগুলি যেন এখানে না আসতে পারে। ওমর ঝটিতে একদল আনসার ও মুহাজের নিয়ে খালিদকে বাহিনীসহ বহু দূরে বিতাড়িত করে দেন।

আবুসুফিয়ান চিৎকার করতে থাকেন : মুহাম্মদ এই দলে আছে? হযরত সাহাবাদের ইঙ্গিত দেন, চুপ করে থাকতে। আবুসুফিয়ান পুনরায় হাঁক দিলেন : আবুবকর ও ওমর কি এই দলে আছে? তখনও কোনও প্রত্যুত্তর দেওয়া হলো না। আবুসুফিয়ান উল্লাসে মত্ত হয়ে চিৎকার করে উঠেন : তারা সবাই নিহত হয়ে গেছে। তখন ওমর আর নিশ্চুপ থাকতে অক্ষম হয়ে চিৎকার করে উঠেন : আমরা সবাই এখানে জীবিত আছি, শুনে রাখো আল্লাহ্র দুশমন! আবুসুফিয়ান তখন চিৎকার করলেন : হুবলের জয় হোক! আঁ- হযরত ওমরকে নির্দেশ দেন প্রত্যুত্তর দিতে : আল্লাহ্ সর্বশক্তিমান এবং চিরগৌরবময়!

ওহাদের যুদ্ধ হয় তৃতীয় হিজরীতে। এ বছরের শাবান মাসে আঁ হযরত ওমর-কন্যা হাসাকে বিবাহ করেন। হাসা বিধবা হলে ওমর আবুবকরকে অনুরোধ করেন হাসাকে পুনর্বিবাহ করতে। আবুবকর নীরব থাকেন। তখন ওমর অনুরোধ করেন ওসমানকে, কিন্তু ওসমানও নীরব থাকেন। তাদের দু’জনেরই নীরব থাকার কারণ এই ছিল যে, তাদের অবগতিতে আঁ-হযরত পূর্বেই হাস্সাকে বিবাহ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন।

হিজরতের পর আঁ-হযরত মদিনার ইহুদী কবিলাদের সঙ্গে একটা সন্ধি করেছিলেন। কিন্তু তারা ইসলামকে সুনযরে দেখতো না এবং সঙ্গোপনে ষড়যন্ত্র করতো। বানু নাদির নামে ইহুদী গোত্র ছিল ইসলামের ভীষণতম শত্রু। চতুর্থ হিজরীতে আঁ-হযরত আবুবকর ও ওমরকে নিয়ে তাদের নিকট যান কোনও এক বিষয়ে সাহায্য চাইতে। এ সময়ে তারা আমর-বিন-জাহাশ নামক এই ইহুদীকে একটি ঘরের মটকায় তুলে দেয় সবার অলক্ষ্যে, এই কুমতলবে যে, সে আঁ-হযরতের মাথায় একটা শিলাখণ্ড নিক্ষেপ করবে। হযরত ষড়যন্ত্রটির আভাস পেয়েই স্থানত্যাগ করেন ও তাদের নির্দেশ দেন মদিনা ত্যাগ করতে। তারা যুদ্ধ করতে প্রস্তুত হলে তাদেরকে পরাস্ত করা হয় ও শহর থেকে দূর করে দেওয়া হয়। তাদের একটি অংশ সিরিয়ায় প্রস্থান করে। কিন্তু বাকী অংশ খাইবারে বসতি স্থাপন করে ও সেখান থেকে কোরায়েশদের উত্তেজিত করতে থাকে, পুনরায় মুসলিমদেরকে হামলা করতে। পুনরায় দশ হাজার সৈন্যের এক বিরাট বাহিনী নিয়ে কোরায়েশ-নেতা আবুসুফিয়ান মদিনার দিকে অগ্রসর হন (৫ হিজরী, ৬২৭ খ্রি.)। আঁ-হযরত মদিনার বহির্দেশে সালা পর্বতের নিকটে একটি খন্দক কেটে মদিনার নিরাপত্তা নির্দিষ্ট করেন। এ জন্যে এটিকে বলে খন্দকের যুদ্ধ। মদিনার অবরোধ চলে প্রায় মাসাধিককাল এবং প্রত্যেক সাহাবা একটি নির্দিষ্ট এলাকা সংরক্ষণের ভারপ্রাপ্ত হন। ওমর যেখানে ছিলেন, সেখানে পরবর্তীকালে একটি মসজিদ নির্মিত হয় তাঁরই নামাঙ্কিত হয়ে। একবার শত্রুপক্ষ প্রচণ্ডবেগে ওমরের নির্দিষ্ট এলাকায় আক্রমণ করে, কিন্তু তিনি তাদের গতিরোধ করেন। আর একবার শত্রুপক্ষের সঙ্গে যুদ্ধে তাকে এমনি ব্যতিব্যস্ত থাকতে হয় যে, আছরের নামাজের সময় পার হয়ে যায়। শত্রুপক্ষকে বিতাড়িত করে ওমর আঁ-হযরতের নিকট উপস্থিত হয়ে বিষয়টি তার গোচরে আনেন, কিন্তু হযরত বলেন, তিনিও আছরের নামাজ তখনও পড়েন নি। যা হোক, ইহুদী ও কোরায়েশদের মধ্যে বিভেদ উপস্থিত হওয়ায় তারা নিজেরাই ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়।

ষষ্ঠ হিজরীতে (৬২৮ খ্রি.) রসূলে আকরম হজের উদ্দেশ্যে কাবার দিকে রওনা হন। তখন তিনি নির্দেশ দেন, যাতে কোরায়েশরা যুদ্ধের সন্দেহ না করে, প্রত্যেকে নিরস্ত্র হয়ে যাবে। কিছুদূর পথ অতিক্রম করে ওমরের প্রতীতি জন্মে এই রকম নিরস্ত্রভাবে মক্কায় যাওয়া নিরাপদ নয়। তিনি রসূলে আকরমকে এ অভিমত ব্যক্ত করলে হযরত তার যৌক্তিকতা উপলব্ধি করেন এবং মদিনা থেকে অস্ত্রাদি সংগ্রহ করিয়ে দেন। মক্কার নিকটবর্তী হলে সংবাদ আসে যে, কোরায়েশরা মুসলিমদেরকে শহরে প্রবেশ করতে না দেওয়ার বদ্ধপরিকর। আঁ-হযরত ওমরকে অনুরোধ করেন, দৌত্যগিরি করে মীমাংসা করতে। ওমর বলেন, কোরায়েশরা তাঁর ভীষণতম দুশমন এবং তাঁর কোনও আত্মীয় মক্কায় নেই তাঁর সহায়তা করতে। শেষে ওসমানকে পাঠানো হয়। কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যে ওসমান ফিরে না আসায় গুজব রটে, তিনি শহীদ হয়েছেন। এ সংবাদ পেয়েই হযরত চৌদ্দশত সঙ্গীকে শপথ করান, বিধর্মীর বিরুদ্ধে জেহাদ করতে। ওমর পূর্বাহ্নেই জেহাদের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন এবং পুত্রকে দিয়ে এক আনসারীর একটি অশ্বও সংগ্রহ করেছিলেন। শপথের কথা শুনেই তিনি হযরতের নিকট উপস্থিত হয়ে শপথ নেন। কোরআনে এই শপথ অনুষ্ঠান ‘বায়আত-উল-শাজারাহ্’ নামে উক্ত হয়েছে (সুরা ফাত্‍হ্-১৮)

কোরায়েশরা হযরতকে কিছুতেই মক্কায় প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না, এ সিদ্ধান্তে অটল রইলো। বেশ কিছুদিন সংগ্রাম-সংঘাত চললো, তারপর হোদায়বিয়ার সন্ধি স্বাক্ষরিত হয়। তার দু’টি প্রধান শর্ত ছিল এই : সে-বছর মুসলিমরা বিনা হজে মদিনায় ফিরে যাবেন, কিন্তু পরবর্তী প্রত্যেক বছর মক্কায় হজ করতে পারবেন ও তদুপলক্ষে মাত্র তিন দিন শহরে অবস্থান করতে পারবেন। দ্বিতীয়ত: দশ বছরের জন্যে যুদ্ধবিরতি ঘোষিত হবে। কিন্তু এই সময়ে কোনও কোরাইশ দল ত্যাগ করে হযরতের সঙ্গে মিলিত হলে তাকে কোরায়েশরা ফেরত পাবে, কিন্তু কোনও মুসলিম কোরায়েশদের হাতে পড়লে তাকে ফেরত দেওয়া-না-দেওয়া তাদের ইচ্ছাধীন থাকবে। দ্বিতীয় শর্তটি ওমরের মনঃপুত হয় নি। তিনি সোজা হযরতের সমীপে উপস্থিত হয়ে বাদানুবাদ করেন :

হে রসূলুল্লাহ! আপনি কি আল্লাহর নবী নন?

নিশ্চয়ই আমি নবী।

আমাদের দুশমনরা কি বহুত্ববাদী মূর্তিপূজক নয়?

নিশ্চয়ই তারা তাই বটে।

তা’হলে আমরা কেন আমাদের ধর্মকে হেয় করবো।

আমি আল্লাহর নবী এবং আমি তাঁর বিধি-বহির্ভূত কাজ করি না।

এই বাদানুবাদের প্রকৃত প্রশ্ন ছিল: নবীর কোন কার্যসমূহ মনুষ্যোচিত পর্যায়ের আর কোন্‌গুলি নবীজনোচিত পর্যায়ের। ওমর এই সূক্ষ্ম প্রশ্নের নিগূঢ় সমাধান সম্যক অনুধাবন করতে সক্ষম হয়েই বিশ্বনবীর সঙ্গে এই বাদানুবাদে লিপ্ত হয়েছিলেন। পরে অবশ্য ওমর নিজের হঠকারিতা ও আঁ-হযরতের প্রতি আচরণের জন্যে বিশেষ অনুতপ্ত হন এবং রোযা, নামায, দান ও দাসমুক্তি করে প্রায়শ্চিত্ত করেন।

যাহোক, সন্ধি যথারীতি লিখিত ও স্বাক্ষরিত হয় এবং ওমরও অন্যবিশিষ্ট সাহাবাদের সঙ্গে স্বাক্ষর দেন। এই সন্ধির পর মুসলিম ও অমুসলিমরা অবাধে অসঙ্কোচে পরস্পর মেলামেশা শুরু করে এবং তার ফলে ইসলামের আদর্শিক শিক্ষা ও মহিমা সহজেই অমুসলিম চিত্তে প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। তার ফলে এই হয় যে, মাত্র দুবছরের এতো অধিক সংখ্যক লোক ইসলাম কবুল করে, যা গত আঠারো বছরেও সম্ভব হয়নি। অনেকের মতে এটাই ছিল হযরতের প্রকৃত উদ্দেশ্য, যা ওমর প্রথমে উপলব্ধি করতে পারেন নি। এ জন্যেই হোদায়বিয়ার সন্ধি কোরানে ‘মহাবিজয়’ হিসেবে সূরায়ে ফাহ্-এ উল্লিখিত হয়েছে : নিশ্চয়ই আমরা তোমাকে দান করলেম এক সুস্পষ্ট বিজয় (আয়াত-১)।

এ-পর্যন্ত অমুসলিম নারীকে বিবাহ করায় মুসলিমদের বাধা ছিল না। কিন্তু এ সময় এ ওহী নাযেল হয়: এবং তোমরা মোশরেক নারীকে বিবাহ করবে না, যতক্ষণ না সে ঈমান আনে (সূরা বকর-২২১)। ওহী নাযেল হওয়ার পরই ধর্মনিষ্ঠ ওমর আপন দুই অমুসলিম স্ত্রী কারিবা ও উম্মেকুলসুম-বিনতে জরুলকে তালাক দেন। তারপর বিবাহ করেন সাবিত বিতে-আবিল-আফলাহ্ কন্যা জমিলাকে।

খয়বরের যুদ্ধ হয় সপ্তম হিজরীতে (৬২ খ্রি.)। বানু নাদির গোত্রের যে অংশ খয়বরে বসতি করে, তারা ক্রমাগত ইসলামের বিরোধিতা করতে থাকে। তারা অন্য আরও কয়েকটি ইহুদী গোত্রের সমর্থন লাভ করে ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র করতে থাকে। এজন্যে ইহুদীদের শক্তি একেবারে লুপ্ত করে দেওয়ার বিশেষ দরকার অনুভূত হয়, কারণ তারাই ছিল মুসলিমদের শান্তি ও নিরাপত্তার নিরন্তর ও স্থায়ী অন্তরায়। আঁ-হযরত চৌদ্দশো পদাতিক ও দুশো অশ্বারোহী সৈন্য নিয়ে তাদের দমন করতে খয়বরে অগ্রসর হন। যুদ্ধের প্রথম স্তরে আবুবকর সেনানায়ক নিযুক্ত হন, কিন্তু তিনি বিফল হয়ে প্রত্যাবর্তন করেন। তখন ওমর সেনানায়ক হয়ে দুদিন তুমুল যুদ্ধ করেন, কিন্তু কোনও ফল লাভ হয় না। তখন আলী ইসলামের পতাকাধারী নিযুক্ত হন এবং বিপক্ষদলের সেনাপতিকে হত্যা করে খয়বর জয় করেন। খয়বরের ভূমিগুলি যুদ্ধরত মুসলিমদের মধ্যে বন্টন করে দেওয়া হয়। সাম্‌মাগ নামদেয় একখণ্ড ভূমি ওমরের অংশে পড়ে। সেটিকে তিনি ‘ফি সাবিলিল্লাহ্ বা ধর্মার্থে দানের উদ্দেশ্যে পৃথক করে রাখেন। এটিই পরবর্তীকালে ওয়াফের মৌল ভিত্তি হিসাবে স্বীকৃত ও নির্দিষ্ট হয়।

এই বছরেই ওমর আঁ-হযরতের নির্দেশে ত্রিশজন সৈন্য নিয়ে হাওয়াযিন্ গোত্রের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। কিন্তু তার উপস্থিতিতেই তারা বিনা যুদ্ধে পলায়নপর হয়।

অতঃপর প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক ঘটনা হচ্ছে, মক্কা বিজয়। অষ্টম হিজরীতে (৬৩০ খ্রি.) এ মহা বিজয় লাভ হয়।

হোদায়বিয়ার সন্ধির অন্যতম শর্ত ছিল যে আরবের গোত্রসমূহের পূর্ব স্বাধীনতা থাকবে, কোরায়েশ অথবা মুসলিম পক্ষে যোগ দেওয়া। খযাহ্ গোত্র মুসলিম পক্ষে এবং বানু-বকর গোত্র কোরায়েশ পক্ষে থেকে পরস্পর আপোষহীন দ্বন্দ্বে লিপ্ত থাকতো। হোদায়বিয়ার সন্ধির কিছুকাল পরেই এই গোত্র দুটির পুরাতন বিরোধ জেগে ওঠে এবং কোরায়েশদের গোপন সহায়তায় বানু-বকর গোত্র খযাহ্ গোত্রকে এভাবে লাঞ্ছিত ও নিপীড়িত করতে থাকে যে, খুযাহ্ গোত্রীয়রা পবিত্র কাবায় আশ্রয় নিলেও স্থান মাহাত্ম্য লংঘন করেও তাদের উপর অত্যাচার করতে থাকে। তখন খুযারা আঁ-হযরতের শরণভিক্ষা করার সিদ্ধান্ত করে। আবু সুফিয়ান এ সবের ইঙ্গিত পেয়ে পূর্বেই আঁ- হযরতের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন ও পুনরায় শান্তি স্থাপনের প্রস্তাব দেন। আঁ-হযরত এ প্রস্তাবে নীরব থাকেন। তখন আবু সুফিয়ান আবুবকর ও ওমরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং বিষয়টির নিষ্পত্তির জন্যে তাঁদের হস্তক্ষেপ প্রার্থনা করেন; কিন্তু ওমর এমন রূঢ়ভাবে বিষয়টি চাপা দেন যে, আবু সুফিয়ান একেবারে আশাহীন হয়ে পড়েন।

আঁ-হযরত মক্কায় যাওয়ার প্রস্তুতি করতে থাকেন ও রমযান মাসে প্রায় দশ হাজার লোকের একটি বাহিনী নিয়ে মদিনা ত্যাগ করেন। পথিমধ্যে আব্বাস আঁ-হযরতের অগ্রগামী হয়ে মক্কায় দৌত্যগিরি করতে যান। পথে আবুসুফিয়ান তাঁর সঙ্গে দেখা করেন এবং আব্বাস প্রস্তাব করেন : আমার সঙ্গে নবী করিমের নিকট চলো, আমি তোমার জন্যে শান্তি চেয়ে নেব, অন্যথায় তোমার কল্যাণ নাই। আবুসুফিয়ান এ সুযোগের সদ্বব্যবহার করতে আব্বাসের সহগামী হন। কিছুদূর অতিক্রম করার পর তাঁরা ওমরের সম্মুখীন হন; এবং তাঁদের দেখেই তাঁর সন্দেহ হয়, আব্বাস নিশ্চয়ই আবুসুফিয়ানের জন্যে সুপারিশ করতে তাকে নিয়ে যাচ্ছে। ওমর তাদের পূর্বেই আঁ-হযরতের সমীপে উপস্থিত হয়ে আরয করেন : ইসলামের এই শত্রুকে হত্যা করার ভার আমার উপর দিন, আজ সে যখন আমাদের মুঠোয় এসেছে।’ আব্বাস প্রত্যুত্তর দিলেন:”ওমর! আবুসুফিয়ান যদি তোমার গোত্রজ হতো এবং আব্দ্ মান্নাফ বংশের না হতো, তাহলে তুমি তার রক্তপাত করতে এতো অধীর হতে না।” ওমর জওয়াব দিলেন: “আল্লাহর নামে বলছি, যখন তুমি ঈমান আনো তখন আমি এতো আনন্দিত হয়েছিলেম যে, আমার পিতা ও খাত্তাব ইসলাম কবুল করলে তার অর্ধেক আনন্দও পেতাম না।” শেষ পর্যন্ত আঁ-হযরত আব্বাসের সুপারিশে আবুসুফিয়ানের জীবন দান করেন।

রসূলে-আকরম বীরবেশে মক্কায় প্রবেশ করেন বিনা বাধায়, বিনা রক্তপাতে। কাবাগৃহের দ্বারদেশে তিনি যে মর্মস্পর্শী বক্তৃতা দেন, তাতে একদিকে ফুটে উঠেছে ইসলামের প্রতি তাঁর অকুণ্ঠ নিষ্ঠা, অন্যদিকে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর উদার হৃদয়ের বিশালতা ও মানবতার প্রতি অপূর্ব মমত্ববোধ। কোরআনের শাশ্বত বাণী সত্য এসেছে, অসত্য বিদূরিত হয়েছে। অসত্য অদৃশ্য হতে বাধ্য’ উদাত্ত স্বরে ঘোষণা করে তিনি শত্রু-মিত্র নির্বিশেষে সকল মক্কাবাসীর জীবন নিরাপদ ঘোষণা করলেন। তারপর ওমরকে সঙ্গে নিয়ে আঁ-হযরত সাফা পাহাড়ের শীর্ষদেশে আরোহণ করে মক্কাবাসীদেরকে বায়আত করলেন। দলে দলে মক্কাবাসী তাঁর নিকট ঈমান আনলো। ওমর সে সময় আঁ-হযরতের পাশে কিছুটা নিম্নস্থানে বসেছিলেন। পুরুষরা বায়আত করলে পর নারীরা উপস্থিত হলো। কিন্তু আঁ-হযরত অনাত্মীয় নারীর হস্তস্পর্শ করতে অনিচ্ছুক হয়ে ওমরকে আদেশ দেন তাদেরকে বায়আত করাতে। তখন মক্কার নারীকুল ওমরের হাতে হযরতের নামে বায়আত করে।

নবম হিজরীতে (৬৩১ খ্রি.) প্রবল গুজব রটতে থাকে যে, রোমক-সম্রাট আরব আক্রমণের উদ্দেশ্যে প্রস্তুতি গ্রহণ করছেন। আঁ-হযরতও প্রস্তুত হতে লাগলেন। কিন্তু তখন দুর্ভিক্ষ ও অভাব-অনটনের সময় থাকায় তিনি প্রত্যেক সাহাবাকে অনুরোধ করেন, অর্থ দিয়ে ও সঞ্চিত সব রকম সম্পদ দিয়ে সাহায্য করতে। যার যা সামর্থ হযরত সমীপে উপস্থিত করেন। ওমর তাঁর যাবতীয় সম্পদের অর্ধেক উপস্থিত করেন। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে, এ সময় আবুবকর সিদ্দীক তাঁর অর্থ-সম্পদ হযরত সমীপে উপস্থিত করলে হযরত জিজ্ঞাসা করেছিলেন: ‘পরিবারবর্গের জন্য কি রেখে এসেছেন?’ আবুবকর হাসিমুখে উত্তর দেন: ‘আল্লাহ ও তাঁর রসূলকে রেখে এসেছি, তাই যথেষ্ট।’ তখন ওমর দুঃখ করে বলেছিলেন: ‘আমি আবুবকরকে কোনও দিন দানখয়রাতে ছাড়িয়ে যেতে পারি নি।’

এই বছরেই আঁ-হযরতের পারিবারিক জীবনে এমন একটি অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে, যার দরুন সকল সাহাবাই ক্ষুব্ধ ও বেদনার্ত হয়ে ওঠেন। কাহিনী এই যে, এই সময় রসূলে-আকরম পূর্ণ এক মাসব্যাপী আপন পত্নীগণের সাহচর্য থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকেন এবং তাঁর এইরূপ নিস্পৃহ ভাব থেকে সাহাবাগণ মসজিদে বলাবলি করতে থাকেন, রসূলুল্লাহ পত্নীদেরকে তালাক দিয়েছেন। কিন্তু কারও সাহস হয় নি, হযরতকে এ সম্বন্ধে সুজাসুজি প্রশ্ন করতে। তখন ওমর নবীগৃহে গমন করেন ও বারবার উচ্চস্বরে হযরতের সাক্ষাৎ প্রার্থনা করেন। কিন্তু কোনও জওয়াব মেলে না। তখন ওমর আরও উচ্চস্বরে বলেন: “হযরত রসূলুল্লাহ মনে করেছেন, আমি হাফসার জন্যে সুপারিশ করতে এসেছি। আল্লাহ্র কসম! তা নয়। যদি রসূলুল্লাহ হুকুম দেন, তবে আমি হাসার শিরশ্ছেদ করতেও প্রস্তুত।’ একথা শুনে আঁ-হযরত তখনই ওমরকে ডেকে নেন। ওমর জিজ্ঞাসা করেন: ‘হুজুর কি পত্নীদেরকে তালাক দিয়েছেন?’

হযরত জওয়াব দেন: ‘না।’

তখন ওমর বলেন: ‘তাহলে আমি হুজুরের অনুমতি নিয়ে এ আনন্দময় সংবাদ মুসলিমদের জানিয়ে দিই, তারা বেদানার্ত হয়ে মসজিদে অপেক্ষা করছে।’

প্রসঙ্গক্রমে এখানে উল্লেখযোগ্য যে এ অপ্রীতিকর ঘটনার সময় ওমরের হস্তক্ষেপে আঁ-হযরতের অন্যতম পত্নী উম্মে সালমা কিঞ্চিত বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন, ওমরের সব বিষয়েই হস্তক্ষেপ এতই বাড়াবাড়ি হয়ে উঠেছে যে, আঁ-হযরতের পারিবারিক বিষয়েও তিনি মাথা গলাচ্ছেন। এটা তিনি হযরত ও তাঁর স্ত্রীদের ব্যক্তিগত ব্যাপারের মধ্যেই সীমিত রাখলেই ভালো হয়। যাহোক ঘটনাটি থেকে একথা সুস্পষ্ট যে, ওমর আঁ- হযরতের কতোখানি অন্তরঙ্গ হয়ে উঠেছিলেন।

এগার হিজরীতে আঁ-হযরতের ওফাত হয়। ওফাতের পূর্বে তিনি কারও মতে দশদিন, কারও মতে তেরদিন রোগ ভোগ করেন। ওফাতের চারদিন পূর্বে তিনি সমবেত মুসলিমদেরকে ইঙ্গিতে আদেশ দেন : ‘কাগজ কলম আনাও, আমি তোমাদের শেষ শিক্ষা দিয়ে যাই, যার দরুন তোমরা কখনও বিপথে চলবে না।’ এ নির্দেশে উপস্থিত সাহাবাদের মধ্যে মতভেদ উপস্থিত হয়। কোনো কোনো সাহাবা বলেন : “কাগজ কলম আনাও, হুজুর এমন শিক্ষা দিয়ে যাবেন, যাতে বিপথে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে না।’ কিন্তু বাকী কয়েকজন সাহাবা, যাঁদের মুখ্য ব্যক্তি ওমর ছিলেন, এ মতের প্রতিবাদ করে বললেন, ‘এখন রসূলুল্লাহ্ তকলিফ হচ্ছে, আমাদের নিকট কোরআন রয়েছে, আমাদের পক্ষে তাই যথেষ্ট।’ নবী-করীম এ মতভেদ লক্ষ্য করে বললেন: ‘আচ্ছা! তোমরা এখন যাও, নবীর সম্মুখে এ-রকম মতান্তর শোভনীয় নয়।’ তারপর তিনি চুপ করে যান। এ থেকে অনুমিত হয়, আঁ-হযরত ওমরের কথাতেই বেশি সন্তুষ্ট হয়েছিলেন, কারণ ওমরের চারিত্রিক নির্মলতা ও মহত্ত্ব সম্বন্ধে তাঁর লেশমাত্র সন্দেহ ছিল না।

এরপর রসূলে-আকরম মাত্র চারিদিন জীবিত ছিলেন। মৃত্যুদিন তাঁর জীবনীশক্তি এরূপ পূর্ণতেজে প্রদীপ্ত হয় যে, উপস্থিত সকলেরই ধারণা জন্মে, আঁ-হযরত সম্পূর্ণরূপে সুস্থ হয়ে গেছেন। আবুবকর এ-রকম ধারণা করে মদিনা থেকে দূরবর্তী দুমাইল তফাতে আপন আলয়ে নিশ্চিন্ত মনে ফিরে যান। ওমর কিন্তু হযরতের পাশে রয়ে গেলেন। সেদিন ছিল এগারে হিজরীর ১২ই রবিওল আওয়াল সোমবার (৮ই জুন, ৬৩২ খ্রি.)। বেলা প্রায় দ্বিপ্রহরের সময় বিবি আয়েশার গৃহে আঁ-হযরতের শেষ নিশ্বাস নির্গত হয়। তাঁর দাফন হয় পরদিন অপরাহ্নে বিবি আয়েশার গৃহাভ্যন্তরেই।

আঁ-হযরতের ওফাতে মুসলিমদের অন্তর-মন কী পরিমাণ বেদনার্ত হয়ে উঠেছিল, তার পরিমাপ অসম্ভব। প্রচলিত কাহিনী এই যে, ওমর এতোখানি জ্ঞানহারা হয়ে পড়েন যে, মসজিদে-নববীতে উপস্থিত হয়ে তিনি চিৎকার করে ওঠেন; “যে কেউ বলবে যে, আঁ-হযরতের ওফাত হয়েছে, আমি তার গর্দান নেব।’ কিছুক্ষণ পরেই আবুবকর উপস্থিত হন এবং হযরতের শরীর লক্ষ্য করে তাঁর প্রতীতি জন্মে, দেহে প্রাণ নেই। তখন তিনি হযরতের অনিন্দ্যসুন্দর পবিত্র কপালদেশ চুম্বন করেন ও বলেন: ‘জীবনে তুমি সুন্দর ছিলে, মরণেও তুমি সুন্দর।’ তারপর আবুবকর সমবেত শোকার্ত জনতাকে লক্ষ্য করে বলেন: “যে ব্যক্তি মুহম্মদের পূজারী ছিল, সে জেনে রাখুক, মুহম্মদের ওফাত হয়েছে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহকে মা’বুদ জানে, সে জেনে রাখুক, আল্লাহ্ চিরজীবী ও মৃত্যুহীন।

অতঃপর আবুবকর রসূলের মৃত্যু-সম্পর্কিত একটি কোরআনের বাণী পাঠ করেন। আর তা শ্রবণ করেই হযরত ওমর জ্ঞানহারা হয়ে ভূমিতে পড়ে যান। কিছুক্ষণ পর যখন তাঁর জ্ঞান ফিরে আসে, তখন তাঁর মনে এই চিন্তাই সর্বপ্রথমে আসে, অতঃপর মুসলিমদের ভাগ্যে কী হবে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *