চতুর্থ খণ্ড (স্নেহের দীপঙ্কর আচার্য এবং সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায়)
পঞ্চম খণ্ড (বন্ধুবর স্নেহপ্রতিম শ্রী নিতীশ রায় ও বউদিকে)
4 of 6

বিশ্বকাপ ভাঙল

বিশ্বকাপ ভাঙল

বিশ্বকাপের কুফল ও সুফল সম্পর্কে নাতিদীর্ঘ একটি প্রবন্ধ লিখ।

ছেলেটি লিখছে। আমার বাবা অতিশয় গেতো। সংসারের ব্যাপারে কোনওকালেই তাঁর তেমন গা ছিল না। দম দিয়ে যতটুকু করানো যায়। সংসার অফিস হলে বাবার কবেই চাকরি চলে যেত। আমার মা বাবার ‘বস’। বাবা তাঁর পেয়ারের লোক, মন্ত্রীদের যেমন পেয়ারের লোক থাকে ঠিক সেইরকম। তাই বাবার চেয়ারটা আছে। তা না হলে, কবেই দখল হয়ে যেত। বিশ্বকাপের ঠিক পঁচিশ দিন আগে আমাদের টিভি চোখ বোজাল। বাবা বললেন, ‘আপদ গেল। সিরিয়ালের ঠেলায় সিরিয়াস কোনও কাজ করার উপায় ছিল না। বিশ্বকাপ আসছে। মহাভারতে কর্ণবধ হবে। দুর্যোধনের ঊরুভঙ্গ হবে। বাড়িতে হাহাকার পড়ে গেল।

আমরা যে-দোকান থেকে টিভি কিনেছিলুম, তাঁরা এখন আর চিনতে পারেন না। সেইটাই তো নিয়ম। মাল বেচে দিয়েছি। মামলা মিটে গেছে। নিজের ম্যাও নিজে সামলাও। গরজ আমার। দোকানের মালিক দারোগার মতো মুখ করে বললেন, ‘ও সব পেটি কেস নিয়ে মাথা ঘামাবার সময় আমার নেই। এখন পেটি-পেটি নতুন টিভি বিক্রি হচ্ছে। গেরান্টি শেষ হয়ে গেছে তো! গন্ধমাদন ঘাড়ে করে নিয়ে গিয়ে কোম্পানির সার্ভিসিং-এ ফেলে দিয়ে এসো।’

আমি মোলায়েম করে বলুলম, ‘জেঠু, সে যে অনেক দূরে। ক্যামাক স্ট্রিটে। আপনি না দেখলে কে দেখবে।’

তিনি ভীষণ রেগে গেলেন। ফটাং করে পানমশালার ডাব্বা খুলে এক চামচে মুখে ফেলে বললেন, ‘হু ইজ ইওর জেঠু। দিস ইজ দোকান। আই হ্যাভ নো ভাইপো। গো টু ক্যামাক স্ট্রিট। পুট ইট অন দেয়ার ঘাড়।’

আমি উচ্চিংড়ের মতো এক লাফে দোকানের বাইরে। মিষ্টি মুখের মিষ্টি কথায় ব্যবসাদারের চিঁড়ে ভেজে না। তিনি এলো খোঁপা এক সুন্দরীকে, পরপর সাতটা টিভি ‘অন’ করে লেকচার দিতে শুরু করলেন। মহিলার হাতে ধরিয়েছেন ঠান্ডা বোতল। তিনি টিকলি ঠোঁটে নল ঠেকিয়ে সুড়ুৎ সুড়ুৎ টানছেন। মাথা দুলিয়ে হাসছেন। খোঁপা ঘাড়ে লাথি মারছে। ইয়ারিং দুলছে। মনে মনে বললুম, ‘ম্যাডাম, ওই একবারই। তিন টাকার বোতল আর দেবে না। গ্যারান্টি পিরিয়াডে, তিনবার আমাদের টিভি হেঁচকি তুলেছিল। এক এক খেপে দু-তিন মাস করে মালমশলা হয়ে গুদামে গুমখুন হয়েছিল।

খুঁজে খুঁজে ক্যামাক স্ট্রিটে গেলুম। বোম্বের কোম্পানি। এখানে সার্ভিসিং। মিলিটারি মেজাজে বললেন, ‘একশো টাকা জমা দিয়ে ডায়েরি করে যান। যবে হোক লোক যাবে।’

‘দাদা, কবে যাবে?’

‘নো দাদা বিজনেস। সময় হলে যাবে। নো দাদা, নো ভাই।’

আমি আর একটু তেল দেওয়ার চেষ্টা করে এক দাবড়ানি খেলুম, ‘আমাদের লাঞ্চের সময় হয়ে গেছে, ক্লিয়ার আউট, ক্লিয়ার আউট?’

বিশ্বকাপের প্রথম সুফল, মানুষ চেনা যায়। কোন মানুষ। যাঁরা ভারতের ব্যবসা চালাচ্ছেন।

সাতদিন আমরা হাঁ করে বসে রইলুম, বসে আছি পথ চেয়ে, কখন আসেন টিভি মেকানিক। একদিন তিনি রাত সাতটা, সাড়ে সাতটার সময় স্কুটার ফটফটিয়ে এলেন। আমাদের এলাকা তখন লোডশেডিং এর কম্বলের তলায়। আমরা তখন মোমবাতি মন্ত্রীর গুনগানে ব্যস্ত। সেদিন সকালেই ফেরিঅলা হাঁকছিল। ঠিক যেন বলছিল—প্রেমিক চাই, প্রেমিক চাই। ঘোর অন্ধকারে মানুষ আর কি চাইবে, প্রেমিক ছাড়া। পরে আর একটু ভালো করে শুনে বুঝলাম, মাদুর চাই, পাটি চাই।

সেই অন্ধকারে মেকানিক ভদ্রলোককে আমরা প্রায় ভারতের রাষ্ট্রপতির মতো সম্বর্ধনা জানালাম। খালি সাতবার কামান দাগা ছাড়া। আমাদের আদর আপ্যায়নে তাঁর ব্যবসায়িক ভিত আদৌ টলল না। তিনি স্কুটার থেকে অবতীর্ণই হলেন না। কিড়কিড়ে গলায় বললেন। ‘লোডশেডিং? তাহলে আর কি হবে? আমরা জনে জনে তাকে নানারকম খাদ্যদ্রব্যের লোভ দেখাতে লাগলুম গরম কফি প্যাস্ট্রি, কড়াপাক সন্দেশ। খেতে খেতেই আলো চলে আসবে। কোনওরকমে তাঁকে ধরে রাখার চেষ্টা। সেই বলে না, কলা দাও, মূলো দাও, ভবি ভোলার নয়। ‘পরে দেখা যাবে বলে ফুড়ফুড় করে স্কুটার ছুটিয়ে দিলেন। প্রিয়জন শ্মশানে চলে গেলে মানুষ যেমন সাশ্রুনয়নে দূয়ারপথে দাঁড়িয়ে থাকে, আমরাও সেইরকম অপস্রিয়মাণ স্কুটারের লাল আলোর দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলুম।

বিশ্বকাপের সুফল অজ্ঞানকুলশীল, প্রিয় থেকে প্রিয়তর হয়। প্রিয়েরও অধিক।

তিন দিন পরে আবার তিনি এলেন, মোটামুটি সেই একই সময়ে। সেই একই লোডশেডিং এর অন্ধকার। সেকালের মানুষ অভিশাপ দিতেন—তোর বংশে সন্ধ্যার বাতি দেওয়ার কেউ থাকবে না। সেইসব অভিশাপ ফলছে আমাদের জীবনে—নো কেরোসিন, নো গ্যাস, নো ইলেকট্রিসিটি। এবার আর তিনি স্কুটার থামালেন না। বোঁ করে স্কুটার ঘুরিয়ে ফডড় করে চলে যেতে যেতে বললেন, ‘আমার পক্ষে আর আসা সম্ভব নয়। টিভিটাকে পাঠিয়ে দেবেন আমাদের সেন্টারে। আমার সাজানো বাগান শুকিয়ে গেল’ ভাব নিয়ে আমরা বসে রইলুম। মা বললেন ‘অপদার্থ!’ কার প্রতি প্রযুক্ত হল এই অতি প্রচলিত মনোহর বিশেষণটি জানা দরকার,

‘কে অপদার্থ মা?’

অন্ধকারে বোমা ফাটল, ‘কে আবার? তোমার বাবা। কর্ণবধ হয়ে গেল!’

‘আর আমাদের বিশ্বকাপ।’

ঘুটঘুটে অন্ধকারে বসে ইতালির বিশ্বকাপ দেখো। কোন দেশে জন্মেছে খেয়াল আছে? এমন দেশটি কোথাও তুমি পাবে না কো খুঁজে? মুখপোড়া।’

‘কে মা?’

‘সবাই, সবাই। যারা ভোট দেয়। যারা গদিতে যায় সবাই।’

বিশ্বকাপের সুফল—ক্লাসলেস সোসাইটিকে চিনতে সাহায্য করে। আমরা সবাই মুখপোড়া। আমরা সবাই রাজা। অনেকটা সেইরকম। অমৃতস্য পুত্রা: নই, মুখপোড়া।

রাতে আমাদের মিটিং বসল। টিভিটাকে গাড়ি ভাড়া করে ক্যামাক স্ট্রিটে দিয়ে আসার একটা খরচ আছে। আচ্ছা, দিয়ে আসা হল। তারপর? মাল পড়ে রইল গাদায়। কবে ডেলিভারি দেবে তার কোনও স্থিরতা নেই। যা সব মিলিটারি মেজাজ। তাগাদা দিতে গেলে, বাজারে ষাঁড়ের গায়ে যেভাবে গরমজল ঢালে সেইভাবে হয়তো জলই ঢেলে দেবে। তাহলে?

মা বললেন, ‘আমি ওসব জানি না, দুর্যোধনের ঊরুভঙ্গ, আই মাস্ট সি। সমস্ত নারী জাতির অপমানের প্রতীক ওই ঊরু। সামনের রবিবার টেবিলের ওপর সকাল ন’টার সময় আমি চলন্ত টিভি চাই। সে নতুন হোক, পুরোনো হোক আমার জানার দরকার নেই।’

‘মা, আমাদের বিশ্বকাপ?’

‘যারা চায়ের কাপ ছাড়া কিছু জানে না, তাদের আবার বিশ্বকাপ।’

বিশ্বকাপের সুফল, প্রত্যেকের কাছেই প্রত্যেকের মুরোদ ধরা পড়ে যায়।

বাবা বললেন, ‘বেস্ট হল, একজন টিভি মেকানিককে ধরে আনা। দেখা যাবে কিছুই হয়তো হয়নি। পেছনটা খুলবে, একটা ফুঁ মারবে, সব ঠিক হয়ে যাবে।’

মা বললেন, ‘এ তোমার মানুষের শরীর নয় যে ঝাড়ফুঁকে ঠিক হয়ে যাবে। এর নাম টিভি। এক জোচ্চোর কোম্পানি। তখনই বলেছিলুম, বিজ্ঞাপনে মজে মোরো না।

শেষে, মা নিজের গরজেই এক এক্সপার্ট ধরে নিয়ে এলেন। তিনি যত সহজে পেছনটা খুলতে পারলেন, তত সহজে গোলমালটা ধরতে পারলেন না। গলদঘর্ম অবস্থা। এর মধ্যে, চঞ্চল পড়ুয়ার মতো বিদ্যুৎ বার কয়েক এল আর গেল। শেষে তিনি বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘সেটটা আমি আমার ওয়ার্কশপে নিয়ে যাই।

মা বললেন, ‘সে তো হবে না ভাই। তাহলে, তোমাকে আমি কেন নিয়ে এলুম। আমাকে দিদি যখন বলো, তখন না সরানো পর্যন্ত, তোমার তো মুক্তি নেই।

এ যেন সেই কথা—দেহে যখন ঢুকেচ, মৃত্যুর আগে পর্যন্ত মুক্তি নেই।

তিনি প্রায় কেঁদে ফেলেন। বিশ্বাস করুন, এখানে হওয়ার হলে হয়ে যেত। কেস খুব সিরিয়াস। হাসপাতালে নিতেই হবে।

বিশ্বকাপের সুফল নিজেদের বরাত জানা যায়।

বাবা বললেন, ‘আমাদের যা বরাত, আমাদের কোনও কাজ তো সহজে হওয়ার নয়। ও দেখবে বিশ্বকাপও শেষ হবে টিভিও ঠিক হবে, তার আগে নয়।

পরের দিন গিয়ে দেখা গেল, টিভি নাড়িভুঁড়ি খোলা অবস্থায় পড়ে আছে। জনডিস না বিকোলাই বোঝা যাচ্ছে না। মা খানিক চিৎকার চেঁচামেচি করে বিকল্প একটা রঙিন টিভি ম্যানেজ করলেন। আমারটা দেবে তোমারটা নিয়ে যাবে এ যেন সেই ‘ হোস্টেজ’-এর মতো। তোমারটা ধরে রাখলুম। আমারটা আগে ছাড়ো।’

সেই মেকানিক ভদ্রলোক বললেন, ‘বউদি, এই যে টিভিটা নিয়ে যাচ্ছেন, এটার সবই ভালো, কেবল একটাই ব্যায়রাম, স্ক্রিনটা মাঝেমাঝে প্যানোরামিক হয়ে যায়। লম্বা ফালির মতো। তখন করবেন কি? কষে ব্রহ্মতালুতে মারবেন গোটাকয় থাপ্পড়। নিজের ব্রহ্মতালুতে নয়, টিভির ব্রহ্মতালুতে।

বাড়িতে আনন্দের জোয়ার বয়ে গেল। মা হো তো অ্যায়সি। কেমন একটা টিভি ম্যানেজ করে নিয়ে এল। সাদা-কালো নয়, রঙিনের বদলে রঙিন। বাবা বললেন, ‘তুমিই আমার একমাত্র বউ।’ মা এমন একটা মুখের ভাব করলেন, যেন এইমাত্র এভারেস্টের মাথায় উঠে ভারতের পতাকা ওড়ালেন। আমারা একবার কোরাসে গেয়ে উঠলুম, জয় হে, জয় হে, জয়, জয়, জয়, জয়, জয়, হে।

আমরা কর্ণ-বধ দেখতে বসলুম। একেশ্বরবাদীর মতো, এই টিভিটায় একটাই মাত্র রং আসে। সে রং হল সবুজ। গোটা পরদা জুড়েই শুরু হয়েছিল অর্জুন আর কর্ণের তীর ছোড়াছুড়ি। যেই কর্ণ রথ থেকে লাফিয়ে নামলেন, অমনি টিভিও নেমে পড়ল। পাড়ের ফালির মতো একটুকরো জায়গায় অত বড় একটা করুক্ষেত্র। কর্ণের মুখ দু পাশে লম্বা বেসবলের মতো হয়ে গেল। সেই প্রচণ্ড উত্তেজনার মুহূর্তে সবাই চিৎকার করে উঠলেন, মার থাপপড়, মার থাপ্পড়। আমি অমনি উঠে গিয়ে দমাদ্দম চাঁটা মারতে লাগলুম। ছবি এই বড় হয়, এই ছোট হয়। তখন পালা করে থাপ্পড় মারা শুরু হল। দেখা গেল, এই টিভি বিদ্যুতে চলে না, চলে থাপপড়ে।

বাবা বললেন, ‘জীবনে অনেক বাঁদর দেখেছি, এমন বাঁদর কখনও দেখিনি।’ টিভির ডানদিকের নীচে একটা চৌকো মতো জায়গায় একসার ফুটো। একটা ফুটোয় একটা প্ল্যাস্টিকের খড়কে কাঠি। সেই কাঠিটা বের করে মা একেবারে বাঁদিকের প্রথম ফুটোয় ঢুকিয়ে কান চুলকোবার মতো করে কুড়কুড়ি দিতে লাগল। ছবি বড় হল, শব্দ চলে গেল। নি:শব্দে কর্ণের মুণ্ডু কাটা গেল। কোনও বিলাপ নেই, কোনও আস্ফালন নেই।

বাবা বললেন, ‘মৃত্যু নি:শব্দে হওয়াই ভালো। এ তো বিয়ে নয় যে ঢাকঢোল বাজাবে।’

বিশ্বকাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান দ্বিতীয় চ্যানেলে। দ্বিতীয় চ্যানেল অনেক সাধ্যসাধনার পর এল। বাবা বললেন, ‘এ কী রে? এ তো ছানা কেটে গেছে।’

সত্যিই তাই। সেই ফালি স্ক্রিন। ঘোলের প্লেটে চরিত্ররা সব সাঁতার কাটছে। উদ্বোধনী খেলা শুরু হল। আমাদের টিভির কল্যাণে সবই যেন কমিক স্ট্রিপ। অর্ধেকটা আবার অন্ধকারে। সেখানে কি যে হচ্ছে, বোঝার উপায় নেই। ছবিটাকে যেন মিক্সারে ফেলা হয়েছে। সব গোল হয়ে ঘুরছে। চোখ জ্বলে যাচ্ছে। থেকে থেকে সব উঠছে। বাথরুমে গিয়ে চোখে জলের ঝাপটা দিয়ে আসছে।

অনেক খোঁচাখুঁচির পর ট্যাক্সি চেপে আমাদের টিভিটা এল। সবই না কি ঠিক হয়ে গেছে। বিকল্প টিভি সরে গেল। টেবিলে বসল আমাদেরটা। সবাই বললেন, ‘আ:, ঘরের ছেলে ঘরে এল। তোমার বাবা তুলনা হয় না। তুমি যেন দেবদূত।’

সুইচ দেওয়া হল। এক ঝলক ছবি এসেই, পটাং করে একটা শব্দ হল। সব অন্ধকার। আমরা সবাই হ্যয় হ্যয় করে উঠলুম, ‘কি হল গো।’

তিনি গম্ভীর মুখে পেছনটা উদোম করলেন। উঁকিঝুঁকি মেরে বললেন, ‘যা:, সর্বনাশ হয়ে গেছে। ওই যে ট্যাক্সিতে নিয়ে এলুম, রাস্তায় যা অবস্থা। বললুম আস্তে চালাও। ঝালাই খুলে গেছে। তাতাল আছে।

গরজ বড় বালাই। আমরা ছুটলুম তাতালের সন্ধানে। পাওয়া গেল। তিনি কিছুক্ষণ টুপুর টাপুর করে এটা ঝাললেন, ওটা ঝাললেন কাঁচকলা হল। টিভি বোদা মেরে রইল। ওরে বাপরে দেরি হয়ে গেল। আমার আর একটা কল আছে।’ মেকানিক ঠিকরে বেরিয়ে গেলেন। টিভির পেছনটা খোলাই রইল। বিকল্প টিভিটা তার পাশে এসে বসল। কিল, চড়, ঘুষি চলতে লাগল। গোলের মুখে বল আসা মাত্রই টিভি ভয়ে কাঁপতে থাকে। পরদা বিবর্ণ সাদা হয়ে যায়। কিছুক্ষণ দেখার পরই মনে হয় অন্ধ হয়ে যাব।

বাবা বললেন, ‘এক মাস এইভাবে খেলা দেখলে আমরা ব্লাইন্ড হয়ে যাব।

আমাদের পাড়ায় এক পরোপকারী যুবক আছে। ‘তারা মা’ আর আমার মা, দুজনেই ভক্ত। ছ’ফুটেরও বেশি লম্বা তার এই দৈর্ঘ্য দেখলে মনে বেশ একটা প্রশান্তি আসে। আগে তাঁর পুরোটাই আমরা পেতুম, ইদানীং অর্ধাঙ্গিনী এসে থ্রি-ফোর্থই নিয়ে নিয়েছেন। মাঝেমধ্যে তাঁর ওয়ানফোর্থ বাইরে আত্মপ্রকাশ করে। সেও কম নয়। সেই যুবক করুণ মুখে দেখে বললেন, ‘ভাগনে কি হয়েছে?’

সব শুনে বললেন, ‘এই তুচ্ছ ব্যাপার। আমি এখুনি একজনকে পাঠাচ্ছি, যে কাটা টিভি, ফাটা টিভি সবই জোড়া লাগাতে পারে নিমেষে।’

তিনি একটা ব্রিফকেস হাতে এলেন বিকেলবেলা। সরেজমিন তদন্ত করে বললেন, ‘এখুনি, এক মুহূর্তে করা যেত, কিন্তু আগে যিনি খুলেছিলেন, তিনি দুটো ট্রানজিস্টার সরিয়েছেন। সেই দুটো আনতে হবে, তার নম্বর দেখে অরিজিন্যাল মাল আনতে হবে কোম্পানি থেকে। তারপর দেখা যাবে।’ আমাদের মাথায় হাত। বাবা অমনি বললেন, ‘এই, আমার এক বউ হয়েছিল। সব সর্বনাশ করে দিলে।’ এক রাউন্ড খাইখাঁচা হয়ে গেল। বাবার সঙ্গে ঘিঞ্চিকিড়ি হলে, মা ভীষণ ভালো রাঁধেন, নানারকম রাঁধেন কিন্তু নিজে উপোস করে থাকেন। সে অনশন সহজে ভাঙানো যায় না। এক ভিসিয়াস সার্কেলের মতো হয়ে দাঁড়ায়। কীরকম? একটু ব্যাখ্যার প্রয়োজন আছে। উপবাসের পর হঠাৎ ভারী কিছুই খেতে নেই। তাহলে পরের দিনও উপোস। দু’দিন উপোসের পর তো আর সাংঘাতিক অবস্থা। পেট তো একেবারেই খালি। সেই পেটে হঠাৎ কিছু পড়া মানে ভোঁচকানি লেগে যাওয়া। এটা আমার মায়ের ভাষা। মা আবার তাঁর মায়ের কাছ থেকে শিখেছেন। বংশপরম্পরায় চলে আসছে। অভিধানে নেই। আমার মায়ের বংশ আবার উপোসের বংশ। মা আমাদের ভোঁচকানির প্যাঁচে ফেলে আমরণের দিকে ঠেলার চেষ্টা করবেন। কারণ উপোস ভাঙার চেষ্টা করলে ভোঁচকানি লেগে মৃত্যু, আর না ভাঙবার চেষ্টা করলে অনাহারে মৃত্যু। এ যেন নেপালির ভোজালি। খাপ থেকে বের করলে রক্ত না নিয়ে ঢুকবে না। আমাদের তখন একটাই পথ—হোমিওপ্যাথি। বিষে, বিষে বিষক্ষয়। আমরাও অনশন শুরু করি। কম্বলে বসে রামধনু গাইতে থাকি রঘুপতি রাঘব রাজারাম, দানাপানি না পেয়ে যায় যাক প্রাণ। রঘুপতি রাঘব রাজারাম।

বাবাকে বললুম, ‘কি বোকার মতো কাজ করছ। বিশ্বকাপ যে ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে। তুমি না বলেছিলে একমাস কাপডিশ ভাঙাভাঙির মধ্যে যাবে না। পরিবেশ ফাউল করবে না। এক মাস লাগাতার আমাদের রাত জাগতে হবে। খেয়াল আছে তোমার। মা অনশন করলে কি হবে। প্যাচ, আপ, প্যাচ আপ।

বাবার হুঁশ হল। তিনি অমনি বলতে লাগলেন, ‘আমার একমাত্র ভালো মানুষ বউটা, যার সার্ভিসে আমাদের এত লপচপানি, তাকে এইভাবে যে ট্র্যানজিস্টারের চোট দিয়ে যেতে পারে সে মানুষ নয়, মনুষ্যরূপী বরাহ। নিপাত যাক, নিপাত যাক, বাবাকে প্রায়ই মিছিলে যেতে হয়। বাঙালি তো আসলে কাঙালি। সপ্তাহে একবার অন্তত অফিসপাড়া প্রদক্ষিণ করতেই হয়। ছুটির সময় গেট বন্ধ করে, সকলকে আটকে মিছিলে পোরা হয়। একটু হাঁটাও হয়। গলা সাধাও হয়—চলবে না, চলবে না। নিপাত যাক, নিপাত যাক। নিপাত যাকটা আন্তরিকভাবে সাধা ছিল বলে মায়ের অন্তর স্পর্শ করল। তিনি সব ফেলে ছুটলেন ট্রানজিস্টার উদ্ধারে।

তিন দিন গেল। আমরা চড়, চাপড় মেরে মেরে গোটা ছয়েক ঝাপসা ম্যাচ দেখলুম। প্রত্যেকের পাশেই আইড্রপস। চোখ যায় সে-ও ভালো তবু দেখব! প্রচারে, প্রচারে ছয়লাপ। ইতালি মাঠে উড়বে। জার্মানির পাঁচিল ভাঙা স্ট্রেংথ। ব্রাজিলের পায়ে গিটকিরি। আর্জেন্টিনার পায়ে গমক। স্পেনের পায়ে লয়কারি। রাশিয়ার ম্যারাথন। এমন দৌড়বে, মাঠ ফুরিয়ে যাবে।

বিশ্বকাপের সুফল; বিশ্বশান্তি আনতে না পারুক, পারিবারিক শান্তি আনতে পেরেছিল।

অবশ্য সব বাড়িতে নয়। আমাদের পাড়ায় একটা মজার বাড়ি আছে। সেই বাড়িতে ঝগড়া চলে পারমুটেশন কম্বিনেশানে। বাপ-ছেলে, বাপ-ছেলের বউ, বাপ-মা, মা-ছেলের বউ। কখনও সবাই একসঙ্গে, ফুল কনসার্ট।

ব্রাজিল, আর্জেন্টিনার খেলার দিন সকাল থেকেই ওই বাড়িতে ঠুসঠাস চলছিল। সন্ধের দিকে ঝেঁপে শুরু হয়ে গেল। সব ফ্রন্টই ওপেন হয়ে গেল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকের মতো। যত রাত বাড়ে ততই ফায়ারিং বাড়ে। ম্যাচ যখন শুরু হল তখন ধুন্ধুমার। টিভি চলছে, ঝগড়াও চলছে। বাবা বলছেন ছেলেকে, ‘তোমার বউ যদি মনে করে থাকে মাথায় পা দিয়ে চলবে, আমি সেই পা থেঁতো করে দোব। আমার মাথাটা ন্যাশনাল হাইওয়ে নয়।’ বাড়ির প্রবীণা বলছেন, ও গো, তোমরা চুপ করো গো। তোমাদের পায়ে পড়ি গো। পাড়ার লোক এরপর তোমাদের দূর করে দেবে।’

কর্তা বললেন, ‘পাড়ার লোকের আমি খাই পড়ি!’

এরই মাঝে কর্তা চিৎকার করে নাতিকে জিগ্যেস করলেন, ‘ব্রাজিলের কি অবস্থা! এনি গোল?’

কর্তার ছেলে উত্তরটা দিলেন, ‘তোমার ব্রাজিল আর সে ব্রাজিল নেই। হেরে ভূত হবে।’

‘আরে চল। মরা হাতি লাখ টাকা। পায়ে পেলের টাচ। আই অ্যাম এ বরন সাপোর্টার অফ ব্রাজিল।’

ছেলে এক হুঙ্কার ছাড়ল, ‘অ্যাই অ্যাম এ বরন সাপোর্টার অফ আর্জেন্টিনা।’

কর্তা অমনি ভীষণ চিৎকার করে বললেন, ‘ওরে আমার ম্যারাদোনা রে! তোর বউকে আগে বাগে রাখ।’

‘তোমার মুখটাকে আগে বাগে রাখো।’

নাতি চিৎকার করল, ‘দাদু ব্রাজিল আর একটু হলে গোল দিচ্ছিল।’

নাতির বাবার এক ধমক, ‘অ্যায়, তুই কার সাপোর্টার?’

নাতি বুক ফুলিয়ে বললে, ‘দাদুর সার্পোটার।’

চড়ের শব্দ। চিল চিৎকার। প্রবীণার আর্তনাদ, ‘ওরে গেল রে! সব গেল।’

বিশ্বকাপের কুফল; যাঁরা ঝগড়া করতে চান বিশ্বকাপকে সাক্ষী রেখে, রাত আড়াইটে পর্যন্ত চালাতে পারেন। বিশ্বকাপ দিনের দৈর্ঘ্য বাড়িয়েছিল।

আমাদের আসল টিভিটা অবশেষে অরোগ্যলাভ করে ফাইনালের আগেই। আবার যেন না যায়, মা সত্যনারায়ণ মানসিক করলেন। বিল হল আড়াইশো। কোম্পানি ধমক মেরে একশো গায়েব করেছে। সাড়ে তিনশো। ছবি তখনও মসলিনের মতো মিহি হয়নি। মিহিদানার মতো দানাদানা। ভদ্রলোক অ্যান্টেনা ইন্সপেকশান করে এলেন। সে দশভুজা নেই, মাত্র দ্বিভুজ। বাবা তখন মিহি ফুটবল দেখার জন্যে দিলদরিয়া। নতুন পাখা বসে গেল। আড়াইশো।

বিশ্বকাপের সুফল। তুচ্ছ টাকা পয়সার হিসেব থেকে কর্তাদের মুক্তি দেয়। দিলদরাজ করে।

টিভির থেকে ছয় কি সাত হাত দূরে একটা ডিভান পাতা রয়েছে। একসঙ্গে চারজন স্বচ্ছন্দে বসা যায়। দু’পাশে আরও অনেক বসার জায়গা। বিশ্বকাপের মায়ফেল বসেছে। বাবা হঠাৎ বলে উঠলেন, ‘আচ্ছা, বলতে পারো, কেন এত কষ্ট পাচ্ছি। সকলেই উদগ্রীব। সংসার যাকে ঘিরে ঘুরছে সেই মানুষটা কীসে কষ্ট পাচ্ছে জানা দরকার, ‘তোমার কি চোখের কষ্ট হচ্ছে? একটু চোখ বুজিয়ে শুয়ে পড়ো না। চোখ তো ছানাবড়া হয়ে আছে। সব খেলাই তো একরকম। আমাদের উল বোনার মতো। সাতটা সোজা একটা উলটো। সাত-আট পা এগোলে কি ল্যাং খেয়ে উলটে গেল। এদিকে যায় ওদিকে যায়, বল নিয়ে হেলুনি মারে কড়ার আলুর মতো। গোলপোস্টের সঠিক ধারণা তো কারোর নেই। চওড়া কতটা, কতটা উঁচু। গোলপোস্ট স্বর্গে থাকে না, মর্তে। মারছে বেধড়ক শট, বল বেরিয়ে যাচ্ছে শূন্যে। ইলেকট্রনিক গোলপোস্ট না হলে গোলের আশা কম। চোখে জলপটি লাগিয়ে চিৎ হয়ে প্রাণে আগে বাঁচো।’

বাবা বললেন, ‘আরে এসব কষ্ট আমি গ্রাহ্য করি না। আমি কষ্ট পাচ্ছি সার্পোটার হয়ে। কেন যে ব্রাজিলকে সাপোর্ট করে বসে আছি। কে বলেছিল আমাকে ব্রাজিলের সাপোর্টার হতে। মারাদোনার এখন স্টার তুঙ্গে।’

আমরা সাতজন বসে আছি শহর কলকাতার এক পল্লীতে। অথচ আমরা এক একজন এক এক দলের সার্পোটার হয়ে বসে আছি। মা বললেন, ‘রোজ সকালে গীতা পড়ছ, জানো তো কর্মে আমাদের অধিকার কর্মফলে আমাদের অধিকার নেই। খেলা দেখাই হল কর্ম। কর্মফল গোল নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছ কেন? নিরাসক্ত হয়ে যাও।’

আমার পিসতুতো ভাই মারাদোনার সাপোর্টার। পাড়ার ছেলেরা তার বাড়ির সামনে সাড়ম্বরে মারাদোনার কুশপুত্তলিকা দাহ করে গেল। পাড়ার ব্রজেনবাবু আমাদের বাড়িতে টিভি দেখতে আসেন মানবিক কারণে। স্ত্রী অসুস্থ। রাত আড়াইটে পর্যন্ত টিভি চালালে বধুহত্যার দায়ে পড়তে হবে। তিনি ডবল ব্যারেল গানের মতো, ডবল ব্যারেল একটা ফ্লাস্কে কফি নিয়ে আসেন। বললেন, ‘লাস্ট চা খেয়েছি সেই সিক্সটিতে। তারপর আর ছুঁইনি। তখনও পর্যন্ত ছিল—টু বাড অ্যান্ড এ লিফ। এখন তো হোল ট্রি। পুরো গাছটা মুড়িয়ে মেশিনে ঢুকিয়ে কিমা করে দেয়।’

সেই কফি আমরা চুমুকে চুমুকে খাই আর যে যার মতো এক একটা দেশের সার্পোটার হয়ে দম বন্ধ করে বসে থাকি।

আমার এক কাকা বসামাত্রই ঢুলতে থাকেন। রোজই তাঁকে বলো হত না ঘুমিয়ে পুরো খেলাটা দেখতে পারলে পঞ্চাশ টাকা দেওয়া হবে। প্রথমটায় তিনি খুব চেষ্টা করতেন, শেষে ধ্যুততেরিকা টাকা বলে সোফায় গিয়ে লম্বা হতেন। নাক ডাকাবার আগে জড়ানো গলায় বলতেন, ‘হোয়াট ইজ ইন এ ফুটবল।’

সামনের রাস্তায় চাপা অথচ গম্ভীর গলায় শোনা গেল হরিধ্বনি। বাবা চমকে উঠলেন, ‘কে গেলেন?’

সত্যবাবু।

‘অ্যাঁ সে কি! ফাইনালটা না দেখেই চলে গেলেন।’

বিশ্বকাপের সুফল! সবকিছু বাঁধা হয়েছিল বিশ্বকাপের সুরে। পারিবারিক সম্প্রীতি বেড়েছিল। প্রতিটি সন্ধ্যায় পরিবারে নেমে আসত উৎসবের পরিবেশ। ছোট ছোট সমস্যা, ছোট অসুখ সবই আমরা ভুলতে পেরেছিলুম। সকালবেলা বাড়িটাকে মনে হত শিবির। এ এখানে, সে ওখানে, সে ওখানে লম্বা হয়ে পড়ে আছে। ভাতে ভাতেও কারও আপত্তি ছিল না।

বিশ্বকাপের কুফল! এক একটা বিশ্বকাপ মানে আমাদের চির অন্ধকার। সব পাওয়ার প্ল্যান্ট ভেঙে চুরমার। লোডশেডিং-এর বিশ্বরেকর্ড, বাইশ ঘণ্টা, বাহাত্তর ঘণ্টা, আটচল্লিশ ঘণ্টা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *