৯
পিছন থেকে কাঁধে টোকা মারতেই লোকটি চমকে উঠল। সঙ্গের মেমসাহেবটি বলল, ‘টেক কেয়ার ডার্লিং।’
লোকটি রেলিংয়ের ওপর বেশ কায়দায় ব্যালেন্স করে দাঁড়িয়ে ক্যামেরা বাগিয়ে ধরেছিল। দূরে এক বুড়ি শুয়ে আছে ফুটপাতে, বোঝা গেল লোকটির ক্যামেরার একচক্ষু ঐ-দিকেই। বললাম, ‘ভিখিরির ছবি তুলছ বুঝি? যাঃ– এটা কি একটা সাবজেক্ট হল? চলো, তোমায় ভালো-ভালো ভিখিরির জায়গায় নিয়ে যাচ্ছি।’
লোকটি তাড়াতাড়ি রেলিং থেকে নেমে দাঁড়িয়ে ক্যামেরাটা বন্ধ করবার চেষ্টা করল। আমি বললাম, ‘কী, আর ছবি তুলবে না? আমি তোমাকে ভালো জায়গায় নিয়ে যাব।’
মেমসাহেবটি বলল, ‘আর য়ু সীরিয়াস?’
একগাল হেসে বললাম, ‘তা না তো কী? তোমরা সাহেব-মেমরা এসে কী ছবি তুলতে চাও, আমি জানিনা? তোমরা নিজেরা কি সে-সব খুঁজে পাবে? চলো, আমি আসল-আসল জায়গায় নিয়ে যাব। কী একটা বুড়ির ছবি তুলছ? এ কি আর কলকাতার ভিখিরির ছবি হল? ফিরে গেলে তোমার দেশের লোক বিশ্বাস করবে? মনে করবে ফেক্, গট-আপ। সত্যিই যে ভারতবর্ষে এসেছিলে, তার প্রমাণ দিতে হবে তো! আমি তোমাকে এমন জায়গায় নিয়ে যাব—
—তুমি প্রথমটা ভয় ধরিয়ে দিয়েছিলে। সাহেবটি বলল, ‘আমাদের এমব্যাসির লোক বলে দিয়েছে—ভিখিরি-টিখিরির ছবি তুললে অনেকসময় এখানকার লোক ক্ষেপে যায়। ক্যামেরা কেড়ে নেয়, অনেকসময়—’
—তাহলে তো প্রাণ হাতে করে ছবি তুলছ, বলো! তা ক্যামেরা-ট্যামেরা কেড়ে নেয় অনেকসময় ঠিকই। মারধোরও করে। তাছাড়া সাধু কিংবা যোগীরা অভিশাপ দিয়ে ভস্ম করে দিতে পারে। সাপুড়ে গায়ে সাপ ছুড়ে দিতে পারে–
–যাঃ, ওসব নিশ্চয়ই গল্প।
— মোটেইনা। সাপুড়ে আর যোগীরা কলকাতায় ঘুরে বেড়ায় এটা গল্প? মোটেইনা—বিশ্বাস করো! আজ হয়তো এক্ষুনি দেখতে পাবনা। দু-একদিন সময় পেলে তোমায় নিশ্চয়ই ক্যামেরার ফুটো দিয়ে দেখিয়ে দিতাম প্রকাশ্য রাস্তায় সাপ খেলানো হচ্ছে। ভালুক-নাচওলা দুপুরের রোদে ভালুকের গায়ে হেলান দিয়ে ঘুমুচ্ছে গাড়িবারান্দার নিচে। বাঁদর নাচও অহরহ। গঙ্গার ঘাটে অসংখ্য সাধু আর যোগী। যাই হোক, তোমাকে এক্ষুনি যা দেখাতে পারব তাও কম নয়। আমি সঙ্গে আছি–ভয় নেই। তুমি টেলিভিশন না সিনেমার–
ওসব কিচ্ছুনা। আমি শুধু নিজের কালেকশনের জন্যে। জানো তো ছবি তোলার বিষয় নতুন না-হলে ভালো লাগেনা। কলকাতার এইসব বাড়ি ঘর বা অন্য কিছু নতুন কী আর। বরং এইরকম রাস্তায় লোক শুয়ে থাকবার দৃশ্যই আমাদের কাছে নতুন।
— নিশ্চয়ই। এসো আমার সঙ্গে। গাড়িতে হবেনা, হেঁটে যেতে হবে। এসো, মেম, সাহেব।
লোকটি বৃষস্কন্ধ, শালভুজ, ফরসা দৈত্য একটি। কোন্ দেশের জিজ্ঞেস করিনি। সব সাহেবই আমার কাছে সমান। মেমটি এমন রংচঙে পোশাক পরেছে–যেন একটা হীরামন পাখি। এমন আলতোভাবে হাঁটছে যেন শরীরটা হাল্কা তুলোর মতো। স্বাস্থ্য আর রূপে ঝলমল করছে দুজন। সেই সঙ্গে ঐশ্বর্য। এমন চমৎকার সংসর্গে কিছুক্ষণ কাটালেও মনটা ভালো লাগে।
আমি প্রথমেই ওদের নিয়ে গেলাম মৌলালির মোড়ে। সেখানে একটি কুষ্ঠরোগী বসে, জানতাম। কুষ্ঠরোগী হিসেবে একেবারে নিখুঁত, শরীরের অধিকাংশ জায়গাতেই ব্যাজে জড়ানো, শুধু একটা হাত আর মুখটুকু খোলা। সেখানে দগ্দ করছে ঘা। একটা কাঠের বাক্সে বসে থাকে আর একটি বাচ্চা ছেলে সেটা টানতে-টানতে ভিক্ষে চায়। মেমটি স্বামীর বাহু চেপে ধরে অস্ফুট গলায় বলল ‘ও মাই–নো, নো!’
আমি বললাম, ‘কীরকম সাবজেক্টটা? ভালোনা? আগে এরকম আর পেয়েছ?’ লোকটি বিনা শব্দে পরপর দুটো স্ন্যাপ নিল। তারপর সিগারেট ধরিয়ে বলল, ‘ইনক্রেডিবল।’
আমি বললাম, ‘চলো কাছেই আরেকটা জায়গায়! সেখানে পাবে, যাকে তোমাদের ইংরেজিতে বলে, ‘চোখের ভোজ’।’ শিয়ালদার দিকে এগোলাম। যাবার পথেই অবশ্য ফাউ হিসেবে আরেকটি উত্তম বিষয় পাওয়া গেল। বউবাজারের মোড়ের কাছে সেই খোঁড়া ষাঁড়টি, প্রায়ই যাকে দেখি, পিছনের পা টেনে চলে, ভারি শান্ত মুখখানি, অনেকটা—বাবুর মতো। ষণ্ড প্রভু তখন যে প্রাকৃতিক কাজটি প্রকাশ্য রাস্তায় করছিলেন, তার জন্য সবচেয়ে ভদ্র শব্দ বোধ হয়, ডিহাইড্রেটিং। ক্যামেরা গোটাবার পর সাহেবটিকে জানালাম, এটা সে সত্যিকারের একটা দুর্লভ দৃশ্য পেয়েছে। কারণ, একসময় যদিও কলকাতার পথঘাট ছিল যণ্ডদের কৃপার অধীন, কিন্তু এখন অনেক সরিয়ে ফেলা হয়েছে, পুণ্যার্থীদের এখন অনেক খুঁজতে হয় ওদের দর্শন পাবার জন্য।
শিয়ালদাতে মনের মতো দৃশ্যই পাওয়া গেল। বাচ্চা ছেলেমেয়েগুলো কোনক্রমে দৈবাৎ প্যান্ট-জামা পরে ফেলেনি! যথারীতি উলঙ্গ হয়েই ছোটাছুটি করছিল। সাহেব-মেম দেখে সক্কলে এসে ভিক্ষের জন্য ছেঁকে ধরল। দুপুরের সময় খুপরি ঘরগুলোর সামনে উনুন জ্বালিয়ে ছাইভস্ম রান্না শুরু হয়ে গেছে, কঙ্কালসার বুড়ো-বুড়িরা গড়াগড়ি দিচ্ছে মাটিতে, যুবতী মেয়ে নেই একটিও। চতুর্দিকে একটা বিশ্রী ভাপসা গন্ধ। পাশ দিয়ে সুবেশ ভদ্রলোক-ভদ্রমহিলারা ট্রেন ধরতে বা ট্রেন থেকে নেমে সবেগে ছুটে যাচ্ছেন। সব মিলিয়ে একটা অত্যন্ত নিস্পৃহ আবহাওয়ার জন্যই দৃশ্যটি অসাধারণ। বললাম, ‘তোমার মুভি ক্যামেরা আনা উচিত ছিল!’
—এরা কারা?
–নাম শোননি? পূর্ব বাংলার রিফিউজি। এ আর কটা দেখছ এ যাবৎ সব মিলিয়ে এসেছে পঁচাত্তর লক্ষ অর্থাৎ সাড়ে সাত মিলিয়ান। তুলে নাও ছবি।
—এরা জন্তুর মতো এরকমভাবে থাকে! এরাও তো আফটার অল, মানুষ! এদের থাকার ব্যবস্থা করা যায়না?
—এই তো চমৎকার ব্যবস্থা। তুমি কি ভাবছ, এ-দেশের আদি বাসিন্দারা সবাই এর চেয়ে ভালো আছে? এখনও তো বস্তিগুলো দেখনি। তাও দেখাব!
রাস্তায় বেরিয়ে কিছুদূর হাঁটবার পর লোকটি নিজেই আমাকে একটা দৃশ্য দেখালো। একটা বাড়ির সামনে বিরাট লাইন পড়েছে। ঠেলাঠেলি, হট্টগোল, পাশে লাঠি হাতে সেপাই। লোকটি বলল, ‘ও কিসের কিউ? বাড়িটা দেখে তো সিনেমা—থিয়েটার বলে মনে হয়না? তবে কি কোন মিউজিয়াম?’ আমি সেদিকে তাকিয়ে বললাম, ‘না, তবে ওটার ছবি তুলে লাভ নেই।’
—কেন? লোকটি ভাবল, আমি বুঝি কোন কিছু গোপন করছি।
বললাম, ‘ওরকম লম্বা লাইন তো তোমাদের দেশেও পড়ে শুনেছি সিনেমা—থিয়েটারে। সুতরাং লাইনের ছবি আর নতুন কী? আসল জিনিশটা তো আর বোঝাতে পারবনা! ওখানে রেশন কার্ড দেওয়া হচ্ছে।’
—তা দিয়ে কী হবে?
— ঐ-কার্ড দেখিয়ে খাবার পাওয়া যাবে।
—ইউ মীন, ফ্রি? মেমসাহেব জিজ্ঞেস করলেন।
ওদের মুর্খতা দেখে হাসি চেপে রাখা কষ্ট। অথচ মুখের ওপর হো-হো করে হেসে ওঠা ভদ্রতা নয়। তাই বললাম, ‘কেন, তোমাদের দেশে কি খাবারদাবার বিনা পয়সায় পাওয়া যায় নাকি? কী এমন দেশ থেকে এসেছ হে?’
— না না না। তবে পয়সা দিয়ে খাবার কেনার জন্য অতখানি লম্বা লাইন? সেটা দেখেই একটু অবাক লাগছে। কোন বিশেষ খাবার-টাবার নাকি? সী ফুড, অর…
—নাঃ! স্রেফ চাল গম। যাক, ও নিয়ে সময় নষ্ট কোরোনা। দৃশ্য হিশেবে এটাতে কোন মজা নেই।
মেমসাহেবকে বাইরে দাঁড় করিয়ে আমি আর সাহেবটি চট করে একটা বস্তির মধ্যে একপাক ঘুরে এলাম। সে-ও খুব চটপট ছবি তুলে এনেছে, বেশ পাকা হাত। সহস্র সচকিত চোখকে প্রশ্রয় দিয়ে আমরা বেশিক্ষণ দাঁড়াতে চাইনি। অবশ্য, খুব সহজে কাজটা মেটেনি। বস্তির মধ্যে কাঁচা নর্দমা উপছে উঠে গলিটা ছপ্ছপে হয়ে উঠেছিল কাদা, এঁটো-কাঁটা, আরও কয়েকটি দুরুচ্চার্য ময়লায়। আমি চটিজোড়া খুলে হাতে নিয়েছিলাম, বাইরে এসে চাপাকলে পা ধুয়ে নিলাম। কিন্তু বিদেশিটির জুতোজোড়া কাদায় মাখামাখি। আমি সেজন্য দুঃখ প্রকাশ করলাম। বললাম, ‘তুমি বলছিলে তুমি ইতিহাসের ছাত্র ছিলে। তাহলে, নিশ্চয়ই জান, ভারতবর্ষ কতবড় সভ্য দেশ—পাঁচ হাজার বছর আগেও আমাদের মহেঞ্জোদারো—হরপ্পার মানুষরা নর্দমা ব্যবহার করতে জানত। এবং মজা কী জান–পাঁচ হাজার বছর পরেও আমাদের নর্দমাগুলো মহেঞ্জোদারো-হরপ্পার মতোই আছে অবিকল। ঐ যে দেখলে গোরুর গাড়ির জন্য ট্র্যাফিক জ্যাম হয়ে গেছে। কিন্তু এ-কথা কি জান–আমাদের দেশের লোক যখন প্রথম গোরু দিয়ে গাড়ি টানতে শেখে — তখন তোমরা কোথায় ছিলে? তোমরা তখন গুহায় থাকতে কিংবা গাছের ডালে বাঁদর হয়ে ঝুলতে! কিন্তু আমরা এখনও গোরুর গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছি। সেই ট্র্যাডিশান সমানে চলেছে!’
বিদেশিটি বলল, ‘ওয়েল নীল, তোমাকে অনেক ধন্যবাদ। কিন্তু, আজকের পক্ষে যথেষ্ট হয়েছে। আমার স্ত্রী অসুস্থ বোধ করছেন। এবার হোটেলে ফিরব ভাবছি।’ মেমসাহেবটি একপাশে চুপ করে দাঁড়িয়েছিল। সত্যি এতখানি হাঁটাহাঁটি বোধহয় জীবনে করেনি। সোনার অঙ্গে ক্লান্তির ছাপ পড়েছে। টটস্ করছে চোখদুটো। আমার হাত ধরে বেশ আন্তরিকভাবে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, ‘সত্যি, তুমি নিজের কাজ নষ্ট করে আমাদের সঙ্গ দিলে। অনেক ধন্যবাদ। এবার যাই।’
—সেকি! এর মধ্যেই চলে যাবে? আমি তো আরও কত জায়গায় নিয়ে যাব ভেবেছিলাম। দেখাতাম শ্মশানে মড়া পোড়ানো, সাধু-সন্ন্যাসী খাঁটি ‘ইয়োগী’, রেড ল্যাম্প ডিস্ট্রিক্ট হাজার হাজার মেয়ে যেখানে নিজেদের দেহ পণ্য করছে, আরও দেখাতাম রাত্তিরবেলা রাস্তায় সার বেঁধে কী করে লোকেরা ঘুমোয় অর্থাৎ যা তোমরা এ দেশ সম্বন্ধে শুনে আস, সত্যি-সত্যি সেই সব জিনিশ। আরও অনেক বিচিত্র জিনিশ দেখাতাম অফিস-ফেরত ট্রাম-বাস, কলকাতার পাঁচ মাইলের মধ্যে মশার ঝাঁক …। দুঃখ রয়ে গেল, তোমাদের সাপ—খেলা বা ভালুক-নাচ দেখাতে পারলামনা। কিন্তু সত্যিই ওসব এখনও আছে, বিশ্বাস করো।
মহিলাটি খুব কোমল গলায় আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি তোমার দেশের এ-সব খারাপ জিনিশ আমাদের দেখাতে চাইছ কেন?’
–খারাপ ভালো জানিনা। আমাদের কলকাতায় বিখ্যাত ঐতিহাসিক কোন স্মৃতিচিহ্ন নেই, সমুদ্র পাড় নেই— ঠিক দেখার জিনিশ কিছু নেই। এইসবগুলোই আসলে দেখার। এ দেশে আয়রন কার্টেন নেই —তোমরাও যা খুশি দেখতে পারো– শুধু বিদেশে যাতে বেশি ঘোরাঘুরি করতে না হয়, তাই আমি সাহায্য করছিলাম।
—কিন্তু এ-সব ছবি দেখালে বিদেশে তোমাদের দেশের দুর্নাম হবে, মনে করনা?
— মোটেইনা। এ দেশের যা সত্যিকারের চেহারা, তা লুকিয়ে লাভ কী? ভারতবর্ষ বলতে কি শুধু তাজমহল আর অজন্তা-ইলোরা আর কোনারক—খাজুরাহো? এ দেশে অসংখ্য ভিখিরি আর উপোসী মানুষ আছে, তা কি গোপন করার কথা? আজ পৃথিবীর প্রায় সব দেশ থেকে ভারতবর্ষ খাবার নিচ্ছে দাতব্য হিসেবে, টাকা ধার করছে এ তো জানা কথা। সুতরাং দেশের আসল চেহারা লুকিয়ে লাভ কী?
–ওঃ আচ্ছা, মাফ করো আমাদের। এ-আলোচনায় যেতে চাইনা। আজ যাই। আমাদের বন্ধুত্বের চিহ্ন হিসেবে তোমাকে একটু কিছু উপহার দিতে পারি?
—হ্যাঁ, তোমাদের দুজনের একটা করে ছবি পাঠিয়ে দিয়ো। আমি একটা রূপকথার বই লিখছি বাচ্চাদের জন্য। তোমাদের ছবি দুটো ছেপে দেব ওতে, রূপকথার দেশের মানুষ হিশেবে।
ওরা দুজনেই সমস্বরে বলে উঠল, ‘নো, নো, ইউ আর কিডিং। তুমি বোধহয় গোড়া থেকেই ঠাট্টা করছ আমাদের সঙ্গে!’