৮
আমাদের বাড়িতে একটা বিড়াল আছে। বিড়াল ঠিক নয় বিড়ালী। বছর বারো—চোদ্দ বয়েস হবে। এই ক’বছরে ওর বাচ্চা হয়েছে আশি থেকে একশোটা। এই বাচ্চাগুলো গেল কোথায়? আমাদের বাড়িতে একটাও নেই।
বিড়াল অনেকে ভালোবাসেন, আবার অনেকেই বিড়াল দেখলে চেয়ার—টেবিলে উঠে নৃত্য করেন। ঐ আত্মসুখসর্বস্ব জন্তুটাকে দেখলে আগে আমারও ঘৃণা হত। ছেলেবেলায় গুল্লি দিয়ে টিপ্ করা কিংবা কালীপুজোর সময় ল্যাজে ফুলঝুরি বেঁধে দেওয়া ছিল আমার প্রিয় খেলা।
আমাদের বিড়ালটা আমাদের বাড়িতে এসেছিল অদ্ভুতভাবে। রাত্তির বেলা হঠাৎ দেখি ঘরে ঢুকে আছে। তখন খুবই বাচ্চা আমরা সকলে তাড়া করছি বার করে দেবার জন্য, একটা সাদা উলের বলের মতো বিড়ালটা ছুটোছুটি করছিল। হঠাৎ একসময় ঘরের মাঝখানে এসে চিৎপটাং হয়ে শুয়ে প্রার্থনার ভঙ্গিতে হাত দুখানা তুলে এমন জুজুল করে তাকাল যে আমরা তৎক্ষণাৎ হেসে ফেললাম। মা বললেন, ‘থাক্, থাক্, আজ আর তাড়াতে হবেনা।’ আমার মা বিড়াল পছন্দ করতেননা কখনও, কিন্তু বাচ্চাটা তারপর দু-তিনদিন মায়ের পায়ে-পায়ে ঘুরে অবলীলাক্রমে মায়ের আদর কেড়ে নিলে। বাবা ছিলেন অত্যন্ত গম্ভীর এবং রাশভারী। আমরা সবাই ভয় করতাম। মাঝে-মাঝে বাবা জলদকণ্ঠে বাচ্চাটাকে ধমকে দিতেন। কিন্তু তবুও বাচ্চাটা যেদিন নিতান্ত অবহেলার সঙ্গে বাবার ব্যক্তিত্বকে অবজ্ঞা করে বাবার থালা থেকেই ইলিশ মাছের মুড়ো তুলে নিল—সেদিন আমরা যথার্থই খুশি হয়েছিলাম। সেই থেকে বিড়ালটা আমাদের বাড়িতে রয়ে গেছে।
এক বিখ্যাত ফরাসি লেখকের উপন্যাসে পড়েছিলাম, মানুষ জন্তু-জানোয়ার পোষে নিজের অহংকারে সুড়সুড়ি দেবার জন্য। প্রত্যেক মানুষই অন্য কোন একজনের উপর আধিপত্য বিস্তার করতে চায়। যাকে সে খাওয়াবে, আদর করবে এবং দরকার হলে পদাঘাত করবে। আগে ক্রীতদাসের উপর এরকম করা যেত। ক্রীতদাস-প্রথা উঠে যাবার পর অনেকে তখন স্ত্রীর উপর এই বীরত্ব ফলাতেন। এখন স্ত্রীরাও স্ত্রী-স্বাধীনতার কথা জেনে গেছেন। বরং এখন পুরুষদেরই ক্রীতদাস বানাবার চেষ্টা তাঁদের। সুতরাং এখন জন্তু-জানোয়ারের ওপরই এই ইচ্ছেটা মেটানো যায়। অনেকে মহা আহ্লাদে কুকুর বেড়াল পাখি পোষে। কুকুর পোষা তো প্রায় সামাজিক প্রথার মতো দাঁড়িয়েছে।
আমার এক বন্ধুর পোষা বিড়ালের নাম শ্বেতকরবী। নাম শুনেই ভালোবাসার বহর বোঝা যায়। কৃষ্ণকলি, দধিমুখী, সুন্দরী এমন নামও শুনেছি। এক অপুত্ৰক দম্পতির তিনটি মার্জার সন্তান দেখেছি—যারা আমাদের চেয়ে অনেক ভালোভাবে খেয়ে-শুয়ে আছে।
আমাদের বিড়ালটা ঠিক পোষা নয়, বাড়িতে আছে এই পর্যন্ত। ওর নাম ‘কুচু’—কেন বা কে এই নাম দিয়েছিল, মনে নেই। নিতান্ত সাধারণ চেহারা, শরীরটা সাদা, ল্যাজ এবং কানের কাছে কালো-খয়েরি। আমাদের গয়লার সঙ্গে ভাব জমিয়ে রোজ খানিকটা ফ্রি দুধের বরাদ্দ জুটিয়েছে, তাছাড়া চেয়ে-চিন্তে চুরি—জোচ্চুরি করে খেয়ে খেয়ে বেশ কেঁদো শরীর হয়েছে। এক-একদিন রাত্রে চার—পাঁচটা বিড়ালের সঙ্গে মহা হল্লা করে গুণ্ডামি করে—তখন মারধোর দিই। বড়-বড় ইঁদুর ধরে—কিন্তু ইঁদুর ধরা আমরা মোটেই পছন্দ করিনা। ইঁদুর মারলেই সেই বীরত্ব আমাদের দেখাবার জন্য রক্তমাখা থ্যাৎলানো ইঁদুর মুখে করে ঘরের মধ্যে, কখনও-বা বিছানায় নিয়ে আসে। তখন ধরে মার দিই, মাথা নিচু করে মার খায়। এ-সবকিছুর পরও যখন নিতান্ত অকারণে কোন-কোন সময় এসে পায়ে মাথা ঘষে, তখন মন্দ লাগেনা। কিন্তু আমি কুচুকে নিয়ে কিছু লিখতে বসিনি, ওর বাচ্চাগুলো সম্বন্ধে কিছু লিখতে চাই।
বছরে দু-তিনবার ওর বাচ্চা হয় এবং কোনবারই দু-তিনটের কম নয়। এতদিনে ওর শাবকসংখ্যার শতপূর্তি হয়েছে নিশ্চয়ই। বাচ্চাগুলো বাড়িতে রাখিনি— রাখলে বাড়ির অবস্থা কী হত কল্পনাও করা যায়না। আমরা কবে উচ্ছেদ হয়ে গিয়ে এ বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত হত সুদৃঢ় বিড়াল-সমাজ! বাচ্চাগুলো কোথায়? কয়েকটির কথা জানি, বাকিগুলোর কথা জানতেও চাইনা।
যখন বাচ্চা হয়, তখন বিড়ালীর ক্রুদ্ধ এবং কাতর চোখ সত্যিকারের দেখার মতো। গর্ভিণী এখানে-সেখানে ঘোরে, ছটফট করে, নিরালা খোঁজে। বাচ্চা হবার পর বাঘিনীর মতো আগলে থাকে–তখন চোখ দেখলে হঠাৎ মনে হয় ওরও বুঝি একটা হৃদয় আছে, যা দুঃখিত কিংবা প্রীত কিংবা কৃতজ্ঞ হতে জানে।
বাচ্চাগুলি একটু বড় হলেই মায়ের টান কমে আসে। তারপর মা-টাই একদিন খাবারের ভাগ নিয়ে বাচ্চাদের সঙ্গে ঝগড়া শুরু করে দেয়। আমাদের কুচুর খানিকটা আত্মসম্মান জ্ঞান আছে। ওরই মুখের গ্রাস যখন কোন সন্তান এসে কেড়ে নেয়, তখন ও মারামারি শুরু করেনা বটে, কিন্তু গর্র্ শব্দে অত্যন্ত বিরক্তি প্রকাশ করে। তখন আস্তে-আস্তে ওদের বিদায় করতে হয়। কখনো পুষবার জন্য নিয়ে যায় অনেকে–কেউ-কেউ সত্যিই পোষে–কেউ-কেউ আবার ফিরিয়ে দিয়ে যায়। তুলোর মতো নরম গা, সব বিড়াল-বাচ্চাকেই প্রথমে সুন্দর দেখায়। অনেকে শখ করে বাড়িতে নিয়ে বেড়াল পোষা শুরু করতে চায়। তারা বলে, ‘ইস, এমন সুন্দর বাচ্চাগুলোকে রাস্তায় ছেড়ে দিয়ে মেরে ফেলবে? না, না, আমাকে দাও। আহা, অবলা জীব।’— কিন্তু প্রত্যেক সংসারেই দু-একজন থাকে যারা বিড়াল দুচোখে দেখতে পারেনা। তাছাড়া, বাচ্চারা লম্বা হয়ে, পুরুষ হলে—কদাকার ভারী মুখ নিয়ে যখন মাছ চুরি শুরু করে, তখন আর মায়া থাকেনা, তখন আবার আমাদের বাড়িতে ফেরৎ দিতে আসে অতিষ্ঠ হয়ে। সবগুলোকেই আমরা রাস্তায় ছেড়ে দিয়ে আসি। মেথর কিংবা ঝিকে পয়সা কবুল করে ওদের বলি দূরের কোন পাড়ায় গিয়ে ছেড়ে আসতে। কখনো আমাকেই বাধ্য হয়ে ও দায়িত্ব নিতে হয়। মা ভাইবোনেরা প্রতিবার আপত্তি করে—কিন্তু আপত্তি শুনলে চলেনা। আমাদের কুচুকে আমরা হাজার চেষ্টা করেও প্রেম করা বন্ধ করতে পারিনা। এবং তিন—চারমাস পরপর ওর বাচ্চা হবেই। ওদের জন্য কোন জায়গা নেই, কিন্তু নিজের বাড়িকেও কেউ মার্জারশালা করতে চায়না। একটা মাটির ভাঁড়ে কিছুটা দুধ, কয়েক টুকরো পাউরুটি এবং থলিতে বাচ্চাগুলি নিয়ে আমি বেরিয়ে পড়ি, যাবার পথে ওদের নানারকম গল্প বলি : ভয় কী তোদের, তোদের এমন দেশে নিয়ে যাচ্ছি, যেখানে কেউ দুধের কড়াইতে ঢাকা দেয়না, পথে-পথে সেখানে মাছ ছড়ানো। খুব ভালো থাকবি।
তারপর কোন মাঠের মধ্যে নামিয়ে—ভয় কী, কোন ভয় নেই, আমি আবার আসব–এইসব বলে বুঝিয়ে, পিছন ফিরে চোখ বুজে ছুটে পালিয়ে যাই। অনেকসময় এতদূরে নিয়ে যাই যে ফেরার সময় আমি নিজেই রাস্তা খুঁজে পাইনা।
আমার বন্ধু সত্যময় একটা সুন্দর দেখে বাচ্চা বাড়ি নিয়ে গেছে। এখন ওর নানান্ গুণপনা নিয়ে খুব উচ্ছ্বাস দেখায়। কিন্তু ওর যে কত বড় ভবিষ্যতের ক্ষতি হল এ কথা ভেবে আমি মাঝে-মাঝে অত্যন্ত দুঃখিত বোধ করি। কারণ, ওরটাও মাদী বেড়াল!
যখন চোখ ফোটেনা, তখন বাচ্চাগুলিকে ভারি নিষ্পাপ দেখায়। যখন একটু বড় হয়ে সারা বাড়িতে খেলে বেড়ায়, নীল কালির ফোঁটার মতো চোখ তুলে তাকায়, পরস্পর দাঙ্গা করে, অকারণে দৌড়োয় তখন যাতে ওদের প্রতি কোনক্রমে মায়া না-পড়ে যায় তার চেষ্টা করি। যে কোন শিশুই সুন্দর কারণ তারা যুক্তিহীন।
বাচ্চা হবার পর কয়েকদিন ওদের মা অনেক গম্ভীর হয়ে যায়, চুরি-জোচ্চুরি করেনা! গরর-গর্র্ করে ওদের সহবৎ শেখায়, টুটি ধরে এখানে-সেখানে নিরাপদে নিয়ে যায়, সমস্ত শরীর পরিচ্ছন্ন করে। তারপর অল্প কিছুদিন পরই ওদের দূর করে দিয়ে আসতে হয় যখন ওদের দৌরাত্ম্য সহ্য করা যায়না। আমার কাকা অফিস যাবার জন্য পাটভাঙা জামাকাপড় পরে খেতে বসেছেন এমনসময় উড়ন্ত কোন পোকা ধরবার জন্য ঝাঁপ দিয়ে একটা বাচ্চা সোজা এসে পড়ল মাছের ঝোলের বাটিতে। খাওয়া তো নষ্ট হলই, ঝোল ছিটকে জামাকাপড়ও গেল। এইরকম অসংখ্য। অথচ বাচ্চাটাকে মারলে, ও তার কারণই বুঝবেনা, অসহায় সারল্যে তাকিয়ে থাকবে।
বিদায় করে দিলেও দু-একটা পথ চিনে ফিরে আসে। তখন আবার ফেলে আসতে হয়। আবার আসে, আবার ফেলতে হয়। সে এক অসহ্য অভিযান! ফিরে আসবার কী এক পরম দাবি ওরা বোধ করে বুঝতে পারিনা। যেখানে ওদের ফেলে আসা হয় কিছুদিন আমি সে-পথ দিয়ে হাঁটিনা কোন দিন ভুল করে গিয়ে পড়লে মিঞাও-মিঞাও ডাক শুনে চমকে পালিয়ে যাই। কোন দিন আর দেখতে পাইনা কোন বিড়ালহীন গৃহে দৈবাৎ ওরা স্থান পেয়েছে এই ভেবে খুশি হবার চেষ্টা করি। কোন দিন হয়তো দেখি বাচ্চা ছেলেরা ল্যাজে দড়ি বেঁধে টানাটানি করে খেলছে। আমি ধম্কে ছাড়িয়ে দিই
তাও খুব নৈর্ব্যক্তিকভাবে। বুঝতে দিইনা, আমারই বাড়ির বাচ্চা। তাহলে যদি ফিরিয়ে দিতে আসে! ছেলেদের ধমক দেবার সময় গলায় জোর পাইনা, কারণ ছেলেদের হাত থেকে বাঁচিয়ে ওদের কোন্ নিরাপদ জায়গায় রাখব তা তো জানিনা।
বাচ্চা হারাবার পর মা-বিড়ালী কয়েকদিন কী কাতরভাবে কেঁদে-কেঁদে ঘোরে –সেই কথা মনে পড়ে। কিন্তু কী করব, আমার কিছু করবার নেই।
এক-একদিন দেখি, রাস্তার মাঝখানে একটা বেড়ালবাচ্চা গাড়ি চাপা পড়ে চ্যাপ্টা হয়ে মরে পড়ে আছে। সেই সুন্দর কচি শরীরটা এখন কী ভয়ংকর। একটুক্ষণ চুপ করে দাঁড়াই। আমার ছোট বোন এই বাচ্চাটাকে কত ভালোবাসত, মনে পড়ে। রাত্তিরে আমার পায়ে কত খুনসুটি করেছে এই বাচ্চাটা, আমার মা এক-একদিন নিজে না-খেয়ে সম্পূর্ণ দুধের বাটিটা ঠেলে দিয়েছেন এদের দিকে। এ কথা ভেবে তৎক্ষণাৎ সরে পড়ি।
তারপর যে রাস্তায় যাই, শুনি মিউ-মিউ। তাকিয়ে দেখি, আমাদের বাচ্চা কিনা। না। অন্য কোথাও গেলেও সেই মিউ-মিউ। কলকাতার গলিতে-গলিতে। আমাদের বাড়ির বাচ্চা কিংবা তার বাচ্চার বাচ্চা কিংবা কয়েক হাজার অন্য বাচ্চা। হয় ট্রাম লাইনের পাশে থ্যাৎলানো অথবা অসহায়ভাবে ঘুরছে। বৃষ্টির সময় দেখি ভিজে জড়সড় হয়ে এক কোণে বসে কাঁপছে, কাকগুলো জ্যান্ত শরীরেই ঠোকরাতে চাইছে। আমাকে পালিয়ে যেতে হয়– কারণ আমার কিছু করবার নেই। আমি ওদের নিরাপদ আশ্রয় দিতে পারবনা।
যুদ্ধের সময় বোমার শব্দে পাগল হয়ে লন্ডনে বারো হাজার বিড়াল পথে—পথে ঘুরেছে কাগজে এ খবর পড়েছিলাম। কলকাতার পথে-পথে অসংখ্য মার্জারশিশুর ডাক আমাকে না পাগল করে দেয়!