৭
মাস্টারমশাই ছাত্রীকে পড়াচ্ছিলেন, এমন সময় দপ্ করে আলো নিবে গেল। ছাত্রী খাতায় নোট লিখছিল, মাস্টারমশাই ডিক্টেট করছিলেন, আলো নিবতেই মাস্টারমশাই অকস্মাৎ চুপ করে গেলেন। ছাত্রী মুখ তুলে জানলার বাইরে দেখল, যতদূর দেখা যায় অন্ধকার, এমনকী আকাশের চন্দ্র-নক্ষত্রসমাজও বিদ্যুৎ-সংযম পরিকল্পনায় অংশগ্রহণ করছে। পরবর্তী ঘটনা বিবৃতির আগে, দু-একটি প্রাসঙ্গিক আলোচনা করা যায়।
আলোটা দপ করে নিবে গেল। এই বাক্যটি দিয়েই অধিকাংশ সময় আলো নিবে যাবার বর্ণনা হয়। যদিও, যখন আলো নেবে, তখন দপ্ করে কেন, কোন—রকম শব্দই আমি কখনও শুনিনি। বৈদ্যুতিক আলো নেবে নিঃশব্দে, কোম্পানির কোন নোটিশও না-পেয়ে। কোন শব্দ হয়না, তবু বর্ণনার সময় ‘দপ্ করে’ শব্দটা ব্যবহার করতে হয়। অর্থাৎ বিদ্যুতে পুরো অভ্যস্ত হইনি এখনও, আমাদের মনে আছে আজও প্রদীপ-যুগের স্মৃতি। প্রদীপের শিখা হঠাৎ হাওয়া লেগে কয়েকবার কেঁপে, সত্যিই একটা শব্দ করে, দপ্ করে নিবে যেত। এখন, মাথার ওপর চড়া বাল্ব, বিনা ঝড়-জলে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে নিবে যায়, তবু আমরা দপ্ করে প্রদীপ নিবে যাওয়ার শব্দ পাই। বিজলির অভাবে সারা শহর অকালে অন্ধকার হয়ে গেল, কিন্তু খবরের কাগজে তার বর্ণনা ‘শহর নিষ্প্রদীপ’। মনে-মনে হয়তো আমরা প্রদীপের যুগে ফিরে যেতে চাই, গেলে ভালো হত, জীবন হয়তো আরেকটু সুস্থ হত রহস্যময় আলো-আঁধারিসহ; এখন হয় কর্কশ চড়া আলো, অথবা ছিদ্রহীন অন্ধকার। যাক্।
মাস্টারমশাই যুবা-পুরুষ, সদ্য এম. এ. পাশ, ভদ্র, লাজুক। ছাত্রীকে তিনি মন দিয়ে পড়াতেই আসেন, নবেল-নাটকের গৃহশিক্ষকদের মতো ছাত্রীর হৃদয় নিয়ে টানাটানি করার বিন্দুমাত্র প্রচেষ্টা নেই। ছাত্রীটি বি. এ. পরীক্ষা দেবে, নম্র, সুন্দরী, অপ্রগল্ভা। পড়াশুনো ছাড়া মাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে আর যে দু-চারটি কথা হয়, সেগুলি সরল কৌতুকের, কেউ কারুর সীমান্ত আক্রমণ করেনা। বাড়ি, বুঝতেই পারা যায়, ধনী পরিবারের, এবং যুবতী কন্যার জন্য যুক শিক্ষক নিয়োগ করা থেকে অনুমান করা যায়, আধুনিক, উদার, রুচিমান।
অমন হঠাৎ আলো নিবে যেতেই কিছুক্ষণ দুজনে সম্পূর্ণ নিঃশব্দে বসে রইলেন। একটু পরেই মাস্টারমশাই অস্বস্তি বোধ করতে লাগলেন, এখন তাঁর কী করা উচিত কিছুতেই ঠিক করতে পারলেননা। এখন কি তাঁর চলে যাওয়া উচিত? কিন্তু, যদি পাঁচ মিনিট পরেই আলো জ্বলে ওঠে? তিনি এসেছেনও মাত্র দশ মিনিট আগে। হয়তো একটু অপেক্ষা করে দেখা উচিত, আলো জ্বলে ওঠে কিনা। অথচ অন্ধকার ঘরে একটি যুবতীর সঙ্গে বসে থাকা শোভন কিনা, বুঝতে পারলেন—না। অন্ধকার আমাদের দেশে ট্যাবু, আলাদা ঘরে যুবতী ছাত্রীকে নির্জনে পড়ানো যায়, কিন্তু অন্ধকারে বসে থাকা? ওঁর কি উচিত উঠে গিয়ে জানলার পাশে দাঁড়ানো, অথবা বাইরে গিয়ে, অথবা মেয়েটিকে বলা, তুমি একটু বাইরে যাও! কিন্তু মেয়েটি চুপ করে বসে আছে। অন্ধকারে তার মুখ দেখা যাচ্ছেনা, একটুও টের পাওয়া যাচ্ছেনা তার চোখের ভাষা। যখন দুজনের মনেই কোন পাপ নেই, তখন, শুধু এই অন্ধকারের জন্যেই মেয়েটিকে বলা, ‘তুমি একটু বাইরে যাও’—যদি খুব বিশ্রী শোনায়, যদি মনে হয় মাস্টারমশায়ের মনে পাপ ছিল বলেই এ কথা বললেন! যদি ওঁরা ভাবেন, লোকটা লেখাপড়া শিখেও বর্বর, সংস্কৃতিহীন, নইলে অমন ইঙ্গিত করে? শুধু বসে থাকায় কী দোষ? আমার তো কোন দোষ নেই, মাস্টারমশাই ভাবলেন, কিন্তু এরকম-ভাবে বসে থাকাটাই দোষের কিনা আমি কী করে জানব? দারুণ অস্বস্তিতে লাজুক মাস্টারমশাইয়ের মাথা ঝিনঝিন করতে লাগল। চেয়ারে বসে থাকা খারাপ, না উঠে যাওয়া খারাপ দেখাবে, না মেয়েটিকে উঠে যেতে বলা খারাপ—এই সংশয়ে তিনি পাথর হয়ে গেলেন।
মেয়েটি চুপ করে বসে ছিল। একবার তার চেয়ার সরাবার শব্দ হল। চেয়ারটা সামনে টেনে আনার না পিছনে সরিয়ে নেওয়ার, তা বোঝা গেলনা। মেয়েটি কী ভাবছে কেউ জানেনা। হয়তো সে কৌতুকে হাসছে মিটিমিটি অথবা অনার্সের যে প্রশ্নটির নোট লিখছিল, সেটাই ভেবে যাচ্ছে মগ্ন হয়ে। মুখ দেখলেও মেয়েদের মনের কথা জানা যায়না, আর অন্ধকারে? তাছাড়া, সমুদ্র ও অন্ধকার—এই দুই বিরাটের সামনে মেয়েরা সম্পূর্ণ বদলে যায়। অত্যন্ত চেনা মেয়েও যখন সমুদ্রে স্নান করতে নামে, তখন আর তাকে চেনা যায়না, যেন শরীরে খেলে যায় অসংখ্য বিদ্যুৎ, অসীম রহস্যের সঙ্গে অসীমা হয়ে খেলা করে। পুরুষরা জলে নামলেও পুরুষ, কিন্তু যে কোন মেয়ে জলে নেমেই জলকন্যা। তেমনি অন্ধকার। অন্ধকারে মেয়েরা কী ভাবে কেউ জানেনা। সব মেয়েকেই সকালবেলা একরকম দেখতে, বিকেলবেলা আরেকরকম, কিন্তু অন্ধকারে মেয়েদের কীরকম দেখায়, আরও রূপসী না হঠাৎ খুব কুৎসিত—আজ পর্যন্ত কোন পুরুষ জানতে পারেনি। মেয়েটি একবার শুধু বলল, উঃ কতক্ষণে যে—। মাস্টারমশাই একটা অস্ফুট শব্দ করলেন। আবার দুজনে চুপ।
মেয়েটির মা রেফ্রিজারেটারে পুডিং জমেছে কিনা দেখছিলেন, এমনসময় আলো নিবে যেতেই তিনি ভাবলেন, শুধু কি এ বাড়ি? তৎক্ষণাৎ শুনতে পেলেন সমস্ত পাড়া জুড়ে অন্ধকারের মধ্যে একটা সোরগোল। আজকাল যা হয়েছে, কথা নেই বার্তা নেই—এই ভেবে তিনি গাড়িবারান্দার ওপরে এসে দাঁড়ালেন। উনি এখনো ফেরেননি, এর মধ্যে এসে যাওয়ার কথা, কিন্তু গাড়ি নিয়ে যদি বেরিয়ে পড়ে থাকেন, তবে এই অন্ধকার রাস্তায় গাড়ি চালানো! কিন্তু একটু বাদেই তিনি বুঝতে পারলেন, ঠিক স্বামীর জন্য চিন্তা করছেননা তিনি। অন্য একটা কী বিষয়ে যেন তিনি উদ্বিগ্ন, কিন্তু, সেটা মনে পড়ছেনা। কিছুতেই মনে আসছেনা। ও-হো। হঠাৎ মনে পড়ল, রেবা মাস্টারমশাইয়ের কাছে পড়ছে। সঙ্গে-সঙ্গেই আরকিছু না-ভেবে চলে এলেন রেবার ঘরের দিকে। দরজার কাছে এসেই কিন্তু থমকে দাঁড়ালেন। রেবার ঘরের দরজা খোলা, কিন্তু ভারি পরদা ঝুলছে। ভিতরে অন্ধকার, কোন শব্দ নেই। এ সময় কি তাঁর ঘরে ঢোকা উচিত? ওদের পড়বার সময় তিনি কোনদিন ও ঘরে ঢোকেননা, আজ অন্ধকার হয়েছে বলেই তিনি ঢুকলে কি ওরা ভাববেনা যে একটা কুৎসিত সন্দেহ এসেছে ওঁর মনে। ছি ছি! নিজের মেয়ে রেবাকে তিনি চেনেন, সেদিক দিয়ে কোনরকম দুশ্চিন্তা নেই। আর, যে পড়াতে আসে, সেই শুভেন্দু, গরিবের ছেলে হলেও বেশ ভদ্র, কোনদিন মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলেনা। অন্ধকার হয়েছে বলেই ঘরে ঢুকে পড়াটা সত্যি খুব খারাপ হবে। তবু মন থেকে অস্বস্তি গেলনা। তিনি তো খারাপ ভাবছেননা একটুও। কিন্তু চাকরবাকর কিংবা পাড়া-প্রতিবেশী যদি অন্ধকার ঘরে মাস্টার আর ছাত্রী বসে আছে এই নিয়ে আড়ালে হাসি-ঠাট্টা করে! ভাবতেও তাঁর শরীর জ্বলে গেল। একবার ভাবলেন, মেয়েকে বাইরে থেকে ডাকবেন। কিন্তু সেটা আরও খারাপ দেখাবে, ওরা ঠিক বুঝতে পারবে, ওরা কি ভাববেনা যে তাঁর মনটা নোংরা? একটা উপায় ছিল, যদি একটা মোমবাতি নিয়ে ওদের ঘরে দিয়ে আসা যেত! সেটা খারাপ দেখাতনা। কিন্তু, পরপর ক’দিনই আলো নিবছে, রোজই মোমবাতি কেনার কথা ভাবছেন, অথচ, দিনেরবেলা মনেই পড়েনা। এজন্য নিজের ওপরই রাগ হল তাঁর। কী করবেন, না ভাবতে পেরে একটু সরে ওখানেই দাঁড়িয়ে রইলেন তিনি। খানিকটা পর মাস্টারমশাই বললেন, আরেকটু দেখি, যদি না-জ্বলে, আমি তাহলে চলে যাব। মেয়েটি কোন উত্তর দিলনা। মাস্টারমশাই আবার বললেন, আমি এখানে সিগারেট খেলে তোমার অসুবিধা হবে?
—কী আশ্চর্য, এতক্ষণ ধরাননি কেন? এই কথা বলে ছাত্রীটি খিলখিল করে অনেকক্ষণ ধরে হাসতে লাগল।
ফস্ করে দেশলাই জ্বলে উঠল। কাঠিটা যতক্ষণ জ্বলে, ধরে রেখে, তারপর সেটা ফেলে দিলেন চায়ের প্লেটে। তারপর সিগারেট টানতে গিয়ে মাস্টারমশাই সবিস্ময়ে লক্ষ করলেন, তাঁর হাত কাঁপছে। আশ্চর্য তো, কোন কারণ নেই, তবু। তারপরই তিনি ভাবলেন, রেবাকে এই সামান্য কথাটা জিজ্ঞেস করায় এতক্ষণ ধরে হাসছে কেন?