বিশেষ দ্রষ্টব্য – ৬

নববর্ষের রাত্রে আমরা কয়েকজন শ্মশানে ছিলাম। না, মড়া পোড়াতে যাইনি। কোন উদ্দেশ্য ছিলনা। এমনিই।

গত বৎসরটাকে শ্মশানে পুড়িয়ে এলাম এমন ছেলেমানুষী ধারণাও ছিল—না আমাদের। সারা রাত ঘুরতে-ঘুরতে কখন শ্মশানে পৌঁছে গেছি জানিনা। কেউ কোন পরামর্শও করিনি। হয়তো, শ্মশানের পাশে ভোর দেখতে ভালো লাগে, এমন গোপন অন্তর্নিহিত ইচ্ছে ছিল।

সেইখানে, ঐ জীবন্ত মেয়েটিকে দেখতে পাই। আলো ফোটেনি, কিন্তু গরম জিলিপি ভাজা শুরু হয়ে গেছে। ‘জয় হোক মহারাজ’, বলে শিবপ্রতিম সাধু, ভিখারি হয়ে দাঁড়াল। পাশে ষণ্ড। শ্মশানবন্ধুরা গাঁজা খেয়ে চোখ লাল করে সিনেমার গল্প নিয়ে হাসাহাসি করছে। স্নান সেরে শীতে বাঁশপাতার মতো কাঁপতে-কাঁপতে ছুটে যাচ্ছে কয়েকজন। একজন চিৎকার করে গেয়ে উঠল ‘যে জন গৌরাঙ্গ ভজে, সে হয় আমার প্রাণ রে—’। বাঙলা দেশের ভোরবেলার একমাত্র গান।

অনেকক্ষণ থেকেই একটা দুর্বোধ্য শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। অন্ধকারে শব্দের মানেও ভালো করে বোঝা যায়না। একটু আলো ফুটলে যেন মনে হল একটি কচি মেয়ের গলা, আর একটি বৃদ্ধের। দুটোই খুব অসহায়! আশেপাশে তাকিয়ে কিছু দেখতে পেলামনা। নতুন বছরের প্রথম দিনের সূর্যটাও ভালো করে উঠতে পারলনা, এমন কুয়াশা।

জিলিপির পর চা। চিনির বদলে আখের গুড়ের তৈরি হলেও অমৃতের মতন স্বাদ। কেননা, ঐ ভাঁড়ের সোঁদা গন্ধ। কেননা অমন শীতে শুকনো-হয়ে-আসা ঠোঁটে আগুন-আগুন গরম তাপ। বিশ্ববিখ্যাত হোটেলগুলিতে সারারাতব্যাপী যে নববর্ষ উৎসব হল, তার চেয়ে আমাদের উপভোগ কম ছিলনা, ঐ শেষরাত্রির ভাঁড়ের চায়ে।

‘আপনাদের মড়া পুড়েছে?’ একজন জিজ্ঞেস করল আমাদের।

—না, একটু বাকি আছে।

—কতক্ষণ?

—ঠিক জানিনা। কখন মরবে তা তো বুঝতে পারছিনা।

লোকটি বুঝতে না-পেরে বিরক্ত মুখে চলে গেল।

সিগারেট কিনতে চায়ের দোকানের উত্তাপ ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে আসতে সেই দৃশ্যটা দেখতে পেলাম। একটি আট-নবছরের মেয়ে। লোকটির সারা কপালে চন্দনের ছাপ, স্নান করার পর তখনও ভিজে কাপড়, অসম্ভব ভয়ার্ত মুখ। মেয়েটির দিকে হাত জোড় করে সে বলছে, ‘হামাকে ছেড়ে দে, হামাকে ছেড়ে দে।’ মেয়েটি খুঁ-খুঁ করে নিচু গলায় কাঁদছে।

দুষ্কৃতির গন্ধ পেয়ে তাড়াতাড়ি এগিয়ে গেলাম। একটু ভারিক্কি গলায় আমরা প্রশ্ন করলম, ‘কী ব্যাপার?’

লোকটি ব্যাকুলভাবে আমাদের দিকে ফিরে বলল, ‘বাবু হামাকে রসা করুন। হামি বে-ঝঞ্ঝাট মানুষ।’

মেয়েটির দিকে তাকিয়ে দেখলাম। কী অসাধারণ সুন্দর মেয়েটা। এমন রূপ, যার দিকে পাপী থেকে সাধু যে কেউ একবার তাকালে আর চোখ ফেরাতে পারেনা। যেন এইমাত্র ভোরবেলা একটি ফুল ফুটে উঠল। একমাথা ঝাঁকড়া চুল, ফেটে পড়ছে রং, ঝরনার জলের মতো টলটলে দুটো কালো চোখ। সামান্য একটা সুতির জামা পরে শীতে কাঁপছে, শীর্ণ হাতের মুঠিতে চেপে ধরেছে লোকটির কাপড়।

এমন দৃশ্য চট্ করে চোখে পড়েনা। আমরা ঘটনাটা জানবার জন্য তখুনি খুব ব্যগ্র হয়ে পড়লাম। অবাঙালি বৃদ্ধটি বলল যে, সে ভোর চারটের সময় রোজ গঙ্গাস্নান করতে আসে। আজও আসছিল, এমনসময় দেখতে পেল পাশে-পাশে ঐ মেয়েটি আসছে। সেই চিৎপুর থেকে সঙ্গে-সঙ্গে এল একটাও কথা না-বলে। তারপর সে যখন কালী মাঈজির সেবার জন্য বাতাসা কিনতে দাঁড়িয়েছিল, মেয়েটিও তখন দাঁড়িয়েছে। অমন লছমির মতো সুন্দরী মেয়েটিকে দেখে তার মায়া হয়েছিল, সে খোঁকিকে নাম জিজ্ঞেস করেছিল। মেয়েটি কোন উত্তর দেয়নি, শুধু শীতে কেঁপেছে। সে তখন দুটো মেঠাই কিনে দিয়েছে ওকে। তারপর স্নান সেরে মন্দিরে এসে মাকে প্রণাম করে শিবের মাথায় জল দিয়ে এসে দেখে মেয়েটি তখনও দাঁড়িয়ে। ওকে দেখামাত্র মেয়েটা এসে ওর পাশে আবার চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। বৃদ্ধটি তখন মেয়েটার থুতনি ধরে একটু আদর করে বলেছে, ‘খোঁকি, আপনা বাবা-মার কাছে যাও, একেলা ঘুরসো কেন?’ মেয়েটি তখনও কোন উত্তর দেয়নি। তখন তার মনে হয়েছে, আ-হা, মেয়েটা বুঝি বাপ-মা হারা। নইলে কেউ শীতের রাতে ছেড়ে দেয়। সে তখন দয়া করে মেয়েটাকে একটা চৌয়ান্নি দিয়েছে। কিন্তু, তারপর থেকে মেয়েটা আর তার সঙ্গ ছাড়ছেনা। ‘হামার কী বিপদ বাবু, হামি একে নিয়ে কোথায় যাব?’

বৃদ্ধের কথা শুনতে-শুনতে ভয়ে আমার বুক কেঁপে উঠছিল। আমার মনে হচ্ছিল, তখুনি আমার ও জায়গা ছেড়ে চলে যাওয়া উচিত। হারানো ছেলেমেয়েদের মুখ দেখতে আমার বিষম অস্বস্তি হয়। রাস্তায় দুর্গাপূজার প্যান্ডেলে, একজিবিশনে—কোথাও কোন হারানো ছেলেমেয়ের কথা শুনলেই আমি মুখ ফিরিয়ে নিই। ঐ হারানো মুখ আমি দেখতে চাইনা। তাহলে, সারাদিন ঐ মুখ আমার মনে গেঁথে থাকে, কিছুতেই ভুলতে পারিনা। ঐসব হারানো ছেলেমেয়েরা বাড়িতে সত্যিই কখনো আবার পৌঁছয় কিনা জানিনা। অন্তত আমাদের সাধ্য নেই ওদের ফিরিয়ে দেবার। খবরের কাগজের হারানো-প্রাপ্তি-নিরুদ্দেশও কখনো পড়িনা আমি। কাগজে শুধু নিরুদ্দেশ-সংবাদই থাকে কখনো ফিরে আসার খবর থাকেনা। মাকে মৃত্যুশয্যায় ফেলে বাবা কিংবা দিদিমার অন্নজল ত্যাগ করিয়ে ঐ যারা নিরুদ্দেশ হয়, তারা আবার সত্যিই কোনদিনই ফিরে আসে কিনা তা না-জানতে পেরে এমন তীব্র অস্বস্তি হয় আমার। তার চেয়ে ওসব কথা না-জানাই ভালো।

কিন্তু এখানে আর উপায় নেই। এখানে মেয়েটির মুখ দেখে ফেলেছি। অমন এক-বিশ্বের মায়া-মাখানো মুখ। আমরা জিজ্ঞেস করলাম, ‘খুকি, তোমার নাম কী? ‘

মেয়েটি একটা তীক্ষ্ণ কর্কশ আঁ-আঁ শব্দ করল। মেয়েটি কালা এবং বোবা। বিপন্নভাবে দৃঢ়মুষ্টিতে চেপে আছে লোকটার কাপড়। ভোরবেলার হাওয়ায়, আমাদের তখন খুবই শীতের কাঁপুনি লাগার কথা কিন্তু মেয়েটার গায়ে শুধু একটা পাতলা জামা দেখে আমরা শীত অনুভব করতে ভুলে গিয়েছিলাম। আমাদের কারুর গায়ে আলোয়ান ছিলনা। মেয়েটির জন্য কিছু-একটা করা দরকার। কিন্তু কী করব আমরা বুঝতে পারলামনা। ব্যাকুল চোখে তাকিয়ে মেয়েটি চাইছে একটা আশ্রয়, একটা ঘরের ভিতরের তাপ।

বৃদ্ধটি বলল, ‘হামিকে বাঁচান বাবু। এ আমার কী বিপদ হল। আভি গিয়ে মালিকের দুকান না-খুললে মালিক খেঁচাখেঁচি করবে। লিকিন, একে জোর করে ছাড়িয়ে কী করে যাই সক্কালবেলা, একী মায়া ভগবানের।

আমরা বললাম, ‘এ তো তোমার সঙ্গেই যেতে চায়।’

‘না, বাবু, হামি একলা মানুষ, দুকানঘরে মাথা গুঁজরে থাকি। একে কোথায় নিয়ে যাব?’ লোকটার গলায় নিষ্ঠুরতা ছিলনা, ছিল অসহায়তা।

—যাও-না, মেয়ের মতো মানুষ করবে।

—এ বাঙালির মেয়েকে নিয়ে কোথা যাব।

—বোবা আবার বাঙালি কী?

—না বাবু, হামার উপায় নেই।

তারপর সে মেয়েটির দিকে ফিরে কাকুতিভরা গলায় বললে, ‘হামাকে দয়া কর্ মা। ছেড়ে দে। এই-নে আর একটা চৌয়ান্নি। সক্কালবেলা হামাকে অধর্ম করাসনি।’

মেয়েটির জন্য আমরাও অনুভব করছিলাম। কিন্তু আমাদেরও ঔদার্য এত বেশি নয় যে, একে নিজের দায়িত্বে সঙ্গে নিতে পারি, বা নিজেদের বাড়িতে নিয়ে যেতে পারি। রাস্তায় তখন কিছু লোক চলতে শুরু করেছে। কয়েকজন কৌতূহলী হয়ে উঁকি মেরে দেখে যেতে লাগল। ‘আহা, এমন ফুটফুটে মেয়েটা কাদের গো, হারিয়ে গেছে বুঝি?’

আমরা জনে-জনে অনুনয় করতে লাগলাম, কেউ মেয়েটাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে চায় কিনা। কেউ রাজি নয়। মায়া সবারই আছে—কিন্তু আজকাল আর দয়ামায়ার আবেগে সামর্থ্যচিন্তা ছাড়িয়ে যায়না।

অত ভোরবেলা মেয়েটির জন্যে কী করা সম্ভব আমরা ভেবেই পেলামনা। বিশেষত যে মেয়ে কোন কথা বলতে পারেনা। বাবা-মার ঠিকানা খুঁজে বার করার উপায় নেই—চেহারা দেখলে মেয়েটিকে ভালো ঘরেরই মনে হয়। অব্যক্তভাবে আমরা সকলেই এ কথা ভাবলাম যে এবার আমাদেরও আস্তে-আস্তে সরে পড়তে হবে। এ ছাড়া উপায় নেই। মহত্ত্ব দেখাতে গিয়ে কি এই মেয়েটার বোঝা আমাদের ঘাড়ে চেপে যাবে? মেয়েটি কী বুঝলে জানিনা, সে বৃদ্ধটির কাপড় ছেড়ে হঠাৎ এসে আমার হাত চেপে ধরল। বোবা হলে কি মনের ভাষা বুঝতে পারা যায়? কী ঠাণ্ডা আর নরম হাত, ঐ হাত ছাড়িয়ে যাবার শক্তি পৃথিবীর কারুর নেই বোধহয়। বুঝতে পারলাম মাড়োয়ারিটি কেন এতক্ষণ এমন অসহায় বোধ করছিল।

আমার হাত ধরামাত্র তখুনি আমার মনে পড়ল পুলিশের কথা। পুলিশের হাতে তো হারানো ছেলেমেয়েদের সঁপে দেওয়া যায়। তাহলে তো মেয়েটিও বাঁচবে, বাঁচবে আমাদেরও বিবেক নামক গোলমেলে পদার্থটি।

মেয়েটিকে হাঁটিয়ে নিয়ে চললাম আমাদের সঙ্গে, ওর ভাষা তো জানিনা আমরা কেউ। মেয়েটা অনবরত গলা দিয়ে খুঁ-খুঁ করে কান্নার মতো আওয়াজ করছে। ওর চুলের মধ্যে হাত বুলিয়ে দিতে-দিতে বললাম, ‘ভয় নেই, ভয় নেই।’ কী বুঝল ও-ই জানে।

থানা পর্যন্ত যেতে হলনা। কাছেই একটি কনস্টেবলকে দেখতে পেলাম। হয়তো সে সারারাত এই শীতে জেগে পাহারা দিচ্ছে। সারা মুখে মাথায় ফেট্টি বাঁধা, কান জড়ানো, শুধু চোখদুটি আর নাকের আগাটুকু খোলা। আমরা সদলে এর সামনে দাঁড়ালাম। সারা রাত জেগে যারা একলা পাহারা দেয় তারা সবসময় কী ভাবে, এ সম্বন্ধে আমার অনেক দিনেরই কৌতূহল। কী করে ওরা ঘুম তাড়ায়? কার যেন উপন্যাসে পড়েছিলাম, সম্ভবত দুমার, বাস্তিলের নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে কারাকক্ষে একজন কয়েদী পাগল হয়ে যাবার হাত থেকে নিজেকে কীভাবে রক্ষা করেছিল, কীভাবে সবসময় নিজেকে ব্যস্ত রাখত। সে ছটা আলপিন ছুঁড়ে দিয়েছিল সেই অন্ধকার ঘরে—তারপর, দিনের পর দিন ব্যগ্র হয়ে খুঁজত সেইগুলো অন্ধকারে, কয়েক মাস পর খুঁজে পেলে, সবকটা আলপিন আবার ছড়িয়ে দিত; আবার খোঁজা। কলকাতার একটি পুলিস কনস্টেবল একদিন মধ্যরাত্রে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, সেদিন কী তিথি। হয়তো সে প্রত্যেক রাত্রেই সেদিনের তিথি নিয়ে গণনা-গবেষণা, নিজের সঙ্গে তর্কাতর্কি করে কাটাত। কিন্তু, আজ যে পুলিশটির দেখা পেলাম, এর মতো দার্শনিক পুলিশ আমি কখনো দেখিনি। সে অল্পক্ষণেই আমাদের চোখ খুলে দিল।

তার সামনে পুরো ঘটনাটি ভাঙা-ভাঙা হিন্দিতে বিবৃত করে আমরা তাকে অনুরোধ করলাম, মেয়েটিকে থানায় নিয়ে যেতে। পুলিসটি একটি কথাও বললনা। সোজা চোখ মেলে তাকিয়ে রইল। যেন একটি পাথরের মূর্তি। আমরা রেগে গেলাম। কড়া গলায় বললাম, ‘কি, কথা কানে যাচ্ছেনা?’ লোকটি ধীরে-সুস্থে কান থেকে তিন ফেট্টি মাফলার খুলে ফেলে বলল, ‘আবার বলুন!’ অর্থাৎ সত্যিই তার কানে কথা যায়নি। এবং সে বাঙালি। গোড়া থেকে আবার বলতে হল। পুলিশটি একটুও বিচলিত না-হয়ে ঠাণ্ডা গলায় যেন একটু ব্যঙ্গের সুরে বলল, ‘আপনারা তো যা করার করেছেন, এবার বাড়ি যান।’

—কেন? ওকে থানায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কিনা আমরা দেখতে চাই।

—কোন লাভ নেই।

—তার মানে?

—কী দরকার থানায় নিয়ে গিয়ে?

—আপনাকে তা কে বিচার করতে বলেছে? নিয়ে চলুন।

লোকটি মাথা থেকে আরেকটা ফেট্টি খুলে ফেলল। তারপর আগের চেয়েও নিরুত্তাপ গলায় বলল, ‘কেন রাগ করছেন?’

আমরা লোকটির অদ্ভুত ব্যবহার দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। মেয়েটা শীতে কাঁপছে, সেদিকে ও ভ্রুক্ষেপও করছেনা। অন্তত থানায় গেলে ঘরের গরমটুকু পেত। আমরা বললাম, ‘আপনি ওকে নিয়ে যাবেন কিনা?’

লোকটি এবার চিবিয়ে-চিবিয়ে বলল, ‘কোন লাভ নেই। আমি সাতদিন ধরে ওকে দেখছি—ছুটে-ছুটে যে-কোন লোকের সঙ্গে যেতে চায়। কেউ নেয়না। ও হারিয়ে যায়নি। বাপ-মা নিশ্চয়ই ওকে ইচ্ছে করে ছেড়ে দিয়েছে। ও আস্তে—আস্তে ভিখিরি হয়ে যাবে—বোবা বলে বরং ভিক্ষে বেশিই পাবে—তা ছাড়া দেখতেও সুন্দর। ওর চলে যাবে।’

তারপর আমাদের দিকে চোখ ফেলে আবার বলল, ‘আপনারা ওকে দেখে এত ব্যস্ত হয়ে উঠলেন কেন? ওর বয়সী ভিখিরি আগে দেখেননি? আজ হঠাৎ আপনাদের মায়া উথলে উঠল কেন? কিন্তু যাদের চোখে দেখতে পাননি দেশে তো এরকম হাজার-হাজার ভিখিরি আছে, ওকে আজ চোখে দেখলেন বলে, আর যারা…’

আমি সঙ্গে-সঙ্গে এক ঝটকায় মেয়েটির হাত ছাড়িয়ে নিলাম। আমরা বন্ধুরা চোখাচোখি করলাম। আজ হারায়নি, মেয়েটা তাহলে আগেই হারিয়ে গেছে! ভোরের মায়া কেটে যাচ্ছে, আমরা এবার দিনেরবেলার বাস্তববুদ্ধিসম্পন্ন কাজের মানুষ হয়ে পড়ি।

বোবারা মনের ভাষা ঠিকই বোঝে। মেয়েটি আমাদের বুঝতে পেরে ওর সেই দুর্বোধ্য গলায় কেঁদে উঠল। আমরা কেউ ঘড়ি দেখতে লাগলাম মনোযোগ দিয়ে, কেউ পকেটে হাত ঢুকিয়ে মন নিবিষ্ট করলাম যেন মনটা ঢুকে গেছে পকেটে, কেউ তাকালাম আকাশের দিকে যাতে মেয়েটার সঙ্গে আমাদের আর চোখাচোখি না-হয়। মেয়েটা একটা পাগলা ইঞ্জিনের মতো কর্কশ চিৎকারে কাঁদতে-কাঁদতে ছুটে গেল হঠাৎ। আমরা ওকে দূরের কুয়াশায় মিলিয়ে যেতে দেখলাম।

হাঁটতে-হাঁটতে আমরা চলে এলাম বড় রাস্তায়। শহর জেগে উঠেছে পুরোপুরি। এবার আমরা বন্ধুরা এক-একজন এক-একদিকে চলে যাব। কাল দিনেরবেলায় আমরা যেরকম মানুষ ছিলাম, আজও সেইরকমই রয়ে গেলাম। মাঝখানে এই শেষরাত্তিরের ঘটনাটুকু কেউ আর কখনও আলোচনা করবনা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *