বিশেষ দ্রষ্টব্য – ৪

হার্মাদ! হার্মাদ! দূর সমুদ্রে হয়তো দেখা গেছে কয়েকটি জাহাজের পাল, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন কারুর চোখে পড়েছে কঙ্কালচিহ্ন আঁকা পতাকা, অমনি বাঙলা দেশের উপকূলবর্তী গ্রামে-গ্রামে রব ওঠে, হার্মাদ! হার্মাদ! পর্তুগীজ জলদস্যু আসছে বাঙলা দেশের গ্রাম জ্বালিয়ে দিতে! লুঠতরাজ করতে, ক্রীতদাস—ক্রীতদাসী নিয়ে যেতে। চোখের নিমেষে গ্রামের নারী-পুরুষ-শিশুরা হাতের সামনে যা-কিছু সম্বল টপাটপ তুলে নিয়েই ছুট, উধাও। সহস্র কণ্ঠে ভয়ের চিৎকার, হার্মাদ! হার্মাদ!

অথবা,

নর্দমায় ভনভন করছে অযুত সংখ্যক মশা। কালো জলের ওপর সরের মতো ভাসছে মশাদের শিশুসমাজ। বেশ শান্তিপূর্ণ পরিবেশ, হঠাৎ কোন দুরন্ত বালকের হাত নর্দমায় একটা ঢিল ছুঁড়ল। অমনি পিন্‌পিন্ শব্দে ছত্রভঙ্গ হয়ে উড়ে উঠল কয়েক নিযুত মশা। পিন্‌পিন্ শব্দে ওরা কী বলে তা অবশ্য এখন জানিনা।

অথবা,

আরেকটা দৃশ্য মনে পড়ল। চাইবাসার অসমতল মাঠে দেখেছিলাম একটা মরা কুক্কুরীর শরীর ছিঁড়ে খাচ্ছে বিশ-পঞ্চাশটা শকুন। অতগুলি বৃহৎ ও বিকট পক্ষী-জানোয়ারকে মাটির ওপর কাছাকাছি আগে দেখিনি কখনও। একটা টিলার আড়ালে দাঁড়িয়ে আমরা কয়েকজন দেখছিলাম, শকুন মানুষের চোখ ঠুকরে খায়—এরকম একটা ভয়ও ছিল। এমনসময় দেখলাম, আরেকটা অমিততেজা কুকুর। কুকুরটা খুব বড় নয়। ভয়ংকরও না, কিন্তু ওর ঐ দুঃসাহসী ভঙ্গিতে তীব্র গতিতে ছুটে আসা দেখে মনে হচ্ছিল কোন দীপ্ত অশ্বারোহী ছুটে আসছে পাহাড় থেকে, নারীকে উদ্ধার করার জন্য কোন মধ্যযুগের নাইট। প্রত্যেকটা শকুনের চেহারাই কুকুরটার চেয়ে বড়, কিন্তু তবু ওকে অমনভাবে ছুটে আসতে দেখে একসঙ্গে অতগুলো শকুন ক-র-র-র, ক-র-র-র শব্দ করতে-করতে উড়ে গেল। ঢালু জায়গা থেকে নেমে আসার জন্যেই বোধহয় কুকুরটার ছোটায় একটা মোমেন্টাম এসে গিয়েছিল, সহজে থামতে পারলনা, থামল বহু দূরে গিয়ে। ততক্ষণে শকুনগুলো আবার নেমে আসছে। দূরে দাঁড়িয়ে কুকুরটা একটা চাপা গর্জন করে পিছনের দু-পা দিয়ে মাটি আঁচড়াল, তারপর সেইরকম ভীমবেগে আবার ছুটে এল, আবার উড়িয়ে দিল শকুনগুলোকে!

অসংলগ্ন এই দৃশ্যতিনটি মনে পড়ল কলকাতার সন্ধেবেলা খুব একটা পরিচিত দৃশ্য দেখে। সন্ধেবেলার আলোঝলমল নগরী, পথে-পথে অসংখ্য মনোহারী দ্রব্যের মেলা। ফিরিওয়ালাদের প্রত্যেকের কী সুন্দর সুরেলা গলা, প্রত্যেকের আলাদা ভঙ্গি, সেফটিপিন, বোতাম, কলম, রেডিমেড জামা, কাগজের কুমীর, চটিজুতো, ন্যাপথালিন, অদৃশ্যকালি হঠাৎ রব উঠল, হাল্লা! হাল্লা! একনিমেষে লেগে গেল হুটোপুটি, যুদ্ধক্ষেত্রের মতো ব্যস্ততা সেসব জিনিশ গুটিয়ে চোখের পলকে অদৃশ্য হয়ে গেল রাস্তা ফর্সা করে দিয়ে। কোথায় দেখা গেছে জাহাজের পালের মতো লাল পাগড়ির ঝিলিক, কিংবা নাকে এসেছে কালো গাড়ির পেট্রলের গন্ধ—অমনি চাপা গলায় চালাচালি হয়ে যাবে, হাল্লা! হাল্লা! কেউ-কেউ ছুটে যাবে পাশের অলিগলিতে, দু-একজন আবার উঠে দাঁড়াবে সামনের কোন বাড়ির রকে। রকে উঠে দাঁড়ালেও নিরাপদ, ফুটপাতটুকু ছাড়তে হবে শুধু। অর্থাৎ, সেই যে গল্প শুনেছিলাম এক মাতালকে রাত্তিরবেলা পুলিশে তাড়া করেছে, ছুটতে ছুটতে মাতাল হঠাৎ রাস্তায় একটা চাপাকল দেখতে পেয়ে—সেখানেই সাষ্টাঙ্গে শুয়ে পড়ে জলে হাত রেখে বলেছিল, এখন আর তুমি আমাকে ধরতে পারছনা বাওয়া, এখন আমি জল-পুলিশের আন্দ্ররে। সেইরকম কোন ফুটপাতের ফেরিওলা একবার কোনক্রমে কোন বাড়ি বা দোকানের সিঁড়ির এক ধাপে বা রকে উঠে দাঁড়াতে পারলেই আর হাল্লা-জুজুকে ভয় নেই।

সাত দুগুণে চোদ্দর চার নামল, হাতে রইল পেন্সিল। আমার হাতে পেন্সিল রয়ে গেল। এক বান্ধবীর দুটি ছোট ভাইবোনকে খুশি করার জন্য দুটি ডপেন্সিল কিনছিলাম। দাম চেয়েছিল একটাকা, অনেক কষাকষি করে চোদ্দ আনায় নামিয়েছি—এমনসময় হঠাৎ লোকটা ফুটপাতে বিছানো চাদরের চারটে খুঁট একসঙ্গে ধরে দৌড়ে পালিয়ে গেল। চোদ্দর চারও আমাকে নামাতে হলনা, দুটো পেন্সিল হাতে আমি বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে কী করব বুঝতে পারলামনা। দাম না-দিয়ে চলে যাব? কিন্তু বিবেকে পিঁপড়ের কামড় অনুভব করলাম। আজকাল ধর্মবোধের সঙ্গে আমাদের বেশ ভালোরকম একটা কম্প্রোমাইজ হয়ে গেছে। এই পেন্সিলদুটোর দাম যদি একশো টাকা হত, তবে দাম না-দেবার সুযোগ পেলে বিনাদ্বিধায় তদ্দণ্ডেই টুক্ করে পাশের গলিতে সটকাতাম নিশ্চিত। কিন্তু মাত্র চোদ্দ আনা বলেই বিবেকবোধ পাদ্রীর মতো জেগে উঠেছে। তাছাড়া একটি মেয়েকে খুশি করার মতো শুভকাজের শুরুতেই অধর্ম করা উচিত নয় ভেবে আমি দাম দেবার মহৎ বাসনায় দোকানদারটির উদ্দেশে এদিক-ওদিক দৃষ্টি সঞ্চালন করলাম। দেখলাম, আমার মহাজনটি সেপাইয়ের হাতে ধরা পড়েছেন। আইনের প্রবল হাত তার কলার শক্ত করে চেপে ধরে আছে।

আমি আস্তে-আস্তে ওর কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়ালাম। ওকে পেন্সিলদুটি ফেরত দেওয়া কিংবা দাম মিটিয়ে দেওয়া সেই অবস্থায় ওর কেসের আরও বিপক্ষে যাবে কিনা বুঝতে না-পেরে একটু ইতস্তত করতে হল। সেইসময় বেশ চিত্তাকর্ষক সংলাপ-বিনিময় শুনতে পাওয়া গেল।

—এ সেপাইজি, কী হচ্ছে মাইরি। তুমি কাল আমাকে ধরেছিলে, আবার আজ ধরছ কেন?

—চল্-না, তোর সঙ্গে একটু গপ্‌প্ হবে

–-না, ওসব ইয়ার্কি ভালো লাগেনা! পরপর দুদিন ধরবে, চালাকি নাকি? আজ তো জগাকে ধরার কথা!

—তা, আমি অত আস্তে-আস্তে আসছিলাম, তুই পালালিনা কেন? আমি তো বহুৎ টাইম দিয়েছি।

—আমাকে তো আজ ধরার কথাই ছিলনা!

—জগাকে তো দেখতে পেলামনা!

—তা বলে জগার পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপাবে?

—তোকে একবার ধরে ফেলেছি, আর ছাড়ি কী করে?

—কাঁধ থেকে হাতটা তুলে নিলেই হয়!

—গাড়িতে ইন্সপেক্টার সাহেব বসে আছে।

—চলো তোমার ইন্সপেক্টারের কাছে, আমি মুকাবিলা করিয়ে দিচ্ছি। সেপাই সমেত আমার ফিরিওলা গেল অদূরে প্রতীক্ষমাণ কালো গাড়ির সামনে। ড্রাইভারের পাশে বসে ইন্সপেক্টার সাহেব হাঁটু দোলাচ্ছিলেন। সকৌতুকে জিজ্ঞেস করলেন, এটা আবার এসেছে!

ফিরিওলাটি বেশ চড়াগলায় ধমকের সুরে বলল, স্যার, এ কী অবিচার, আমাকে পরপর দুদিন ধরবে?

ইন্সপেক্টার মুচকি হেসে বললেন, তুমি ধরা পড়তে গেলে কেন?

—অন্যমনস্ক ছিলাম। তাছাড়া, আজ তো আমাকে ধরার কথাই ছিলনা!

—ধরা পড়েছই যখন, উঠে পড়ো, আর কী করবে!

—আমার মাসে পনেরো টাকা ফাইন দেবার কথা, এ মাসে আমার পনেরো টাকা হয়ে গেছে। আবার এ কী অন্যায়?

—আচ্ছা মুশকিল, তুই ধরা পড়লি তো আমি তার কী করব? এখন তো উঠে পড়, পরে দেখা যাবে।

—না স্যার, তা হয়না, এ মাসে আমার পনেরো টাকা পুরিয়ে দিয়েছি। আর বেশি হলে অবিচার করা হরে, স্যার। আজ জগাকে ধরার কথা।

—জগা কোথায়?

—ঐ ঘড়ির দোকানের রকে উঠেছে।

—হুঁ, জগা আজ ধরা দিলনা কেন? ওর খুব বাড় বেড়েছে দেখছি। বড্ড বেশি চালাক হয়ে গেছে, না। আচ্ছা পরে ওকে মজা দেখাব। আজকে তুই-ই চল্। আজ আমার দশটা কেস্ নিয়ে যাবার কথা।

—তা দশটা নেবেন, কলকাতায় কি ফিরিওলার অভাব? পরপর দুদিন একজনকে কেন! আপনারও তো স্যার দয়ামায়া আছে, পুলিশ হলেও তো স্যার, আপনিও তো মানুষ

—আচ্ছা ঝঞ্ঝাট তোদের নিয়ে। আচ্ছা, ওর কাঁধটা ছেড়ে দে। শোন, তুই সেপাইয়ের হাত ছাড়িয়ে চো-চা ছুট দিবি পাশের গলিতে। নিধিলাল তোর পেছুনে—পেছুনে ছুটবে তাড়া করে। তুই জোরে ছুটবি কিন্তু। ওর থেকে জোরে ছোটা চাই। নিধিলাল যদি তোকে আবার ধরে ফেলে তা হলে কিন্তু তোর আজ আর ছাড়া নেই। যা দৌড়ো!

তারপর দৃশ্যটা বেশ সুন্দরভাবে অভিনীত হল। পোঁটলাটা কাঁধে নিয়েই ফেরিওলাটি বেশ জোরে সেপাইয়ের হাত ঝট্‌কা দিয়ে ছাড়িয়ে ছুটল এঁকেবেঁকে। সেপাইটি পিছন-পিছন খানিকটা তাড়া করে গেল, তারপর অবিকল ভগ্নোৎসাহের ছাপ মুখে নিয়ে ফিরে এল। কালো গাড়িটা হুস্ করে ছেড়ে চলে গেল অন্য কোথাও হাল্লা করতে। দৃশ্যটি একটু আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখে আমি যৎপরোনাস্তি সুখী হলাম। গত পনেরো বছর ধরেই দেখে আসছি বিকেলের দিকে ফুটপাতের হকার ফেরিওলাদের মধ্যে অকস্মাৎ পুলিশের আবির্ভাব। তক্ষুনি ছুটোছুটি, বেড়াল ইঁদুরছানা ধরার দু-একটি ছবি। কিন্তু এসব সত্ত্বেও পথের দোকানদারি একটুও কমেনি, বরং বেড়েই চলেছে। রং-বেরং-এর সওদায় রাস্তার শোভা বৃদ্ধি পেয়েই চলেছে ক্রমশ। এখন কলকাতায় এমন শিকড়হীন দোকানীর সংখ্যা অন্তত পাঁচ হাজার এবং সস্তায় এদের কাছে থেকে ছোঁক-ছাঁক জিনিশপত্রের ক্রেতার সংখ্যা প্রতিদিন পঞ্চাশ হাজারের কম নয়। অর্থাৎ ফুটপাতের ফেরি কলকাতার অন্যতম একটি প্রতিষ্ঠান এখন। সুতরাং মাঝে-মাঝে আমার ভয় হত, ফুটপাত থেকে এদের যখন তোলাই যাচ্ছেনা, তখন পুলিশ হয়তো নিরুৎসাহ হয়ে এদের বিরক্ত করার আইনটাই তুলে নেবে। এরা সুরেলা গলায় নিজেদের জিনিশের গুণগান গাইবে নিঃশঙ্কভাবে। আমরা আর হল্লার অমন চমৎকার দৃশ্য মাঝে-মাঝে দেখতে পাবনা।

আজ বুঝতে পারলাম, সে ভয় নেই। আইন তোলা হবেনা। ও আইনটা রাখা উচিত পুলিশের রিক্রিয়েশনের জন্য। পুলিশের নীরস জীবনেও তো মাঝে—মাঝে খেলাধুলো, আমোদ-আহ্লাদের দরকার। হাল্লা গাড়ি নিয়ে এসে সেই আনন্দটুকু ওঁরা পান। পুলিশেরও তো মাঝে-মাঝে চোর-পুলিশ খেলতে ইচ্ছে হয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *