বিশেষ দ্রষ্টব্য – ২৪

২৪

জীবনে একবারই মাত্র কিছুদিনের জন্য আমি একটা দামি কলম ব্যবহার করেছিলাম। একটি ১৮ কারেট সোনার নিব-দেওয়া শেফার্স কলম। আমার বাবা খুব-একটা উদার, মুক্তহস্ত পুরুষ ছিলেননা। বিশেষত ছেলেদের উপহার-টুপহার দেবার দিকে তাঁর কোন ঝোঁক ছিলনা। কিন্তু সেবার আমার ম্যাট্রিক পরীক্ষার আগে বাবা হঠাৎ দিলদরিয়াভাবে ঘোষণা করলেন, অনেকটা সর্বসমক্ষেই, যে আমি যদি একবারেই ম্যাট্রিক পাশ করতে পারি, তবে আমাকে তিনি একটা দামি কলম কিনে দেবেন। ওরকম আকস্মিক ঘোষণার কারণ, আমি ভেবে দেখেছি, তাঁর নিশ্চিত দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে আমি কিছুতেই পাশ করতে পারবনা, আমি পাশ করলে বিশ্বসংসারে একজনও ফেল করবেনা সে-বছর, সুতরাং রীতিমতো উদারতা দেখাবার সুযোগে, তিনি ওরকম একটা দামি ঘোষণা করে ফেলেছিলেন। এবং তারপর থেকে, আমি দেরি করে বাড়ি ফিরলে বা দুপুরে সিনেমায় পালিয়ে গেলে কিংবা ইতিহাস-বই চাপা দিয়ে গোয়েন্দা গল্প পড়ার সময় ধরা পড়লে বাবা আর আমাকে বকুনি না-দিয়ে, মৃদু, রহস্যময় হাসি হেসে বলতেন, পাশ করলে আমি কিন্তু সত্যিই একটা কলম কিনে দিতাম।

অনেক অসম্ভব ব্যাপারই পৃথিবীতে ঘটে। আমার বন্ধুরা যদিও এখনো অনেকে বিশ্বাস করেনা, কিন্তু একথা সত্যিই, আমি কিন্তু ম্যাট্রিকটা অন্তত ঠিকই পাশ করেছিলাম এবং সেবার, ঐ প্রথম বারেই।

আমার পাশ করার খবরে বাবা বোধহয় খানিকটা বিমর্ষ হয়েই পড়েছিলেন। কয়েকদিন খুব মন-মরা অবস্থায় দেখেছি। এমনকী, অন্যের সঙ্গে আলাপ করতে শুনেছি পর্যন্ত, যে, আজকাল নাকি পরীক্ষা-টরিক্ষার স্ট্যান্ডার্ড এত নিচে নেমে গেছে, গোরু-গাধাও পাশ করে যায়! তাঁদের আমলে, যখন উইলসন্ সাহেব ছিলেন—ইত্যাদি।

যাই হোক, শেষপর্যন্ত একটা কলম কিনে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। শৌখিন, শেফার্স কলম। কলমটা আমি সবসময় পকেটে নিয়ে ঘুরতাম, বন্ধুবান্ধবের মধ্যে বসে গল্প-গুজব করার সময় অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে কলমটা পকেট থেকে বার করে হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করতাম, কাগজে হিজিবিজি কাটতাম। আসল উদ্দেশ্য ছিল, কলমটা সকলকে দেখানো, আমি যে পরীক্ষায় পাশ করেছি তার নির্ঘাৎ প্রমাণ।

আমার জীবনের সেই একমাত্র শৌখিন কলম পকেটমার হয়ে যায় অল্পদিনের মধ্যেই। কিন্তু সেজন্য আমার দুঃখ হয়নি। আমার বাবার ধারণা ছিল, ম্যাট্রিক পরীক্ষার পর যে মাস-তিনেক ছুটি থাকে, সেই সময়টাতেই অধিকাংশ ছেলে—মেয়ে বখে যায়। ইউনিভার্সিটির অত্যন্ত অন্যায় এতদিন ছুটি রাখা। ঐসময় ছেলেরা লেখাপড়া করেনা, অলস মাথা শয়তানের কারখানা, ঐসময়টাতেই প্রেম-ট্রেম করার দিকে মন যায়। এইসব কারণে, বাবা আমাকে ঠিকপথে রাখবার জন্য একটিও পয়সা হাতখরচ দিতেননা। তাছাড়া, ঐরকম দামি কলম কিনে দেবার পর আর অর্থব্যয়ে তাঁর একেবারেই মতি ছিলনা বোধহয়। এবং উনি বিশ্বাস করতেন যে, প্রেম-টেম করার সময় পয়সা খরচ করতে পেলে ছেলেরা বিড়ি—সিগারেটও খেতে শেখে, সুতরাং পয়সা না-পেলেই আর ওপথে যাবেনা। আমাকে তিনি ট্রামের একটা মাসিক টিকিট কিনে দিয়েছিলেন, যাতে আমি গাড়ি-ভাড়ার ছুতো করেও একটা পয়সা চাইতে না-পারি। কিন্তু আমার হাতে তখন বাজার করার ভার ছিল, এছাড়া রেশন আনা, আমার খুব একটা দৈন্যদশা ছিলনা।

একদিন একটা ট্রাম-স্টপে দাঁড়িয়ে আছি। সদ্য দোতলা রঙিন বাস বেরিয়েছে তখন কলকাতায়, অথচ আমি তাতে উঠতে পারিনা আমাকে ট্রামেই যেতে হয়। সেদিন একটা চমৎকার নীল রঙের বাস এসে থামল আমার সামনে, জানলার পাশে একটি মেয়ে বসে আছে। আহা কী রূপ, মনে হল বিশ্বসংসারে এর চেয়ে রূপসী মেয়ে আর নেই। আমি তৎক্ষণাৎ যেন বিশ্বসংসার ভুলে গেলাম! মনে হল, এই সুন্দরীকে আর-একটু সময় দেখতে না-পেলে আমার জীবনই বৃথা। ট্রামের টিকিট থাকা সত্ত্বেও আমি লাফ দিয়ে বাসে উঠলাম। ঠেলে ঠুলে সেই সুন্দরীর পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। কিন্তু, বেশিক্ষণ মোহিত হবার সুযোগ পেলামনা, কারণ মেয়েটি তার পরের স্টপেই নেমে গেল। বিষণ্ণ দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমি পকেটে হাত দিলাম, দিয়েই চমকে উঠলাম, আমার বুকের মতো বুক-পকেটও ফাঁকা। পেনটা উধাও। ট্রামের টিকিট থাকা সত্ত্বেও বাসে ওঠার ঐ ফল। কিন্তু আমি দুঃখ করিনি। সুন্দরী নারীর জন্যে সেই প্রথম আমার আত্মত্যাগ।

জীবনে আমার পকেট মারা গেছেও সেই একবার। আর কখনো না। তার প্রধান কারণ অবশ্য, আমার পকেট স্বভাবতই ফাঁকা থাকে, কলম আর জোটেনি। কিন্তু পকেট মারা না-গেলেও একটি পকেটমারের সঙ্গে আমার খুব আলাপ হয়েছিল।

বিকেলবেলা ভিড়ের বাসে আসছি, শিয়ালদা পেরুবার পর, হঠাৎ আমার নাকের কাছটা একটু চুল্কে উঠল। নাকটা চুলকোতে গিয়ে কী যেন একটা ব্যাপারে আমার খুব অস্বস্তি লাগল। একটা কী যেন রহস্য। আমার একহাতে বাসের হ্যান্ডেল ধরা, একহাত নিজের পকেটে। তবে কোন্ হাতে আমি নাক চুলকোলাম? আমার তো তিনটে হাত হতে পারেনা! এই তো টের পাচ্ছি পকেটে নিজের সেই হাত, আর-একহাতে সত্যিই হ্যান্ডেল ধরে আছি, আর-একটা হাতে এই মাত্র নাক চুলকোলাম। তাহলে? আসল ব্যাপারটা বুঝতে পেরেই আমি বিদ্যুৎগতিতে নাক চুলকোনো হাতটা দিয়ে পকেটের হাতটা চেপে ধরলাম। পকেটের মধ্যে দুটো হাতে খুব হুড়োহুড়ি হতে লাগল, কিন্তু, আমি প্রবলভাবে দৃঢ় মুষ্টিতে সেই হাতটা ধরে আছি। মুখে কিছু বলিনি। সেই হাতটা অনুসরণ করে, সেই হাতের মালিককে দেখলাম। আমারই পাশে দাঁড়ানো রোগা চেহারার একটি যুবক। আমার পকেটে কিছুই ছিলনা, কয়েকটা বাজে কাগজপত্র আর খুচরো পয়সা, কিন্তু সেই অনধিকার—প্রবেশকরা হাতটি আমি পকেটের মধ্যেই ধরে রেখেছি, এ-অবস্থায় একবার ‘চোর’, ‘পকেটমার’ বলে চেঁচিয়ে উঠলেই সবাই বাসের সব-কটা লোক, ছেলেটাকে মেরে একেবারে ছাতু করে দেবে। যে-সব লোক কোনদিনও দুর্গাপুজো, কালীপুজো কিংবা রবীন্দ্র-জন্মোৎসবে চাঁদা দেয়না, তারাও পকেটমারকে মারার সময় চাঁদা দিতে এগিয়ে আসে।

তখনও বজ্রমুষ্টিতে হাতটা ধরা, তাকিয়ে দেখি ছেলেটির চোখে বিষম মিনতি মাখানো। অর্থাৎ কিছু তো নিতে পারেনি, এই অবস্থায় ওকে যেন আমি আর মার না-খাইয়ে ছেড়ে দিই। আমি চোখ দিয়ে ওকে ভস্মসাৎ করলাম প্রায়। মুখে একটুও কথা হলনা। কিন্তু চোখে-চোখে আমাদের কথা হল কিছুক্ষণ। ছেলেটি চোখ দিয়ে আমার কাছে ক্ষমা চাইছে। আমি চোখ দিয়ে ওকে ধমকাচ্ছি। যে—কোন মুহূর্তে ওকে মার খাওয়াতে পারি। হঠাৎ দেখি ছেলেটির চোখ দিয়ে সত্যি—সত্যিই এক ফোঁটা জল গড়িয়ে এল। তখন হাসি পেল আমার। আমি বন্দী হাতটাকে মুক্তি দিলাম পকেট থেকে। ছোকরাটা সঙ্গে-সঙ্গে বাস থেকে নেমে গেল।

কিন্তু সেই যে ছেলেটির চোখে-চোখে এতক্ষণ তাকিয়েছিলাম, ফলে ছেলেটির মুখ আমার মনে আঁকা হয়ে গেল। সম্ভবত ওর মনেও আমার মুখ।

একদিন বাসে উঠতে যাচ্ছি, পাশ থেকে একজন বলে উঠল, ‘ওঃ, আপনি এ-বাসে উঠছেন? থাক্, তাহলে আমি আর উঠবনা!’ তাকিয়ে দেখি সেই পকেটমার ছেলেটা, আমার দিকে তাকিয়ে হাসল। আমিও হাসলাম। আরও একদিন বাসের ভিড়ের মধ্যে ওর সঙ্গে আমার দেখা। এবারও ছেলেটা বলল, ‘আমি নেমে যাচ্ছি স্যার, কিছু বলবেননা।’ চট্ করে সত্যিই নেমে গেল।

তারপর থেকে ছেলেটার সঙ্গে প্রায়ই আমার দেখা হত। একদিন অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে গল্পও করেছিলাম। পকেটমারদের জীবনের সুখ-দুঃখের কথা কিছু শুনতে হয়েছিল। ওদের অভাব-অভিযোগ, ওদের প্রতি পুলিশের অবিচার। সেদিন একটা জিনিশ লক্ষ করেছিলাম, প্রত্যেকেরই যে-কোন ব্যাপারে নিজস্ব অনেক দাবি থাকে। ওর দাবি শুনে মনে হল, পকেটমার-সমাজেরও জীবিকার একটা প্রোটেকশান দরকার, ওদের কাজের বোনাস ও ইনক্রিমেন্ট, এবং সাধারণ লোকের পকেটে যথেষ্ট টাকা থাকা ও মানুষজনের চরিত্র কিছুটা আপনভোলা ও উদাসীন করে দেওয়া সরকারেরই দায়িত্ব। নইলে ওদের জীবিকা চলবে কী করে? এই যে, এখন বেশির ভাগ লোকের পকেটেই টাকা থাকেনা—এটা তো একটা নিশ্চিত সরকারি ষড়যন্ত্র, পকেরমারদের জব্দ ও বেকার করার জন্য।

আমি ছেলেটিকে বললাম, ‘ওসব কথা থাক্। শুনেছি তোমাদের সারাদিনের সব রোজগার এক জায়গায় জড়ো হয়। তারপর পেন, ঘড়ি ইত্যাদি বিক্রি করার ব্যবস্থা হয় একসঙ্গে। ভাই, আমার একটা শেফার্স কলম চুরি গিয়েছিল বাসে। তোমাদেরই কারুর কাজ। সেটা আমায় ফেরত দিতে পার? আমি সেটার দাম দিতেও রাজি আছি। কিন্তু, ওটা আমার বাবার স্মৃতিচিহ্ন।’

—আপনার পেন? কবে গেছে?

–বছর তিন-চার আগে।

—ওঃ, অতদিন আগের জিনিশ পাবেননা। এরপর কিছু চুরি গেলে–আমায় বলবেন। আপনার জিনিশ আমি ঠিক ফেরত দিয়ে দেব।

–কিন্তু ওটাই দেখো-না চেষ্টা ক’রে। আমার কলমের গায়ে আমার নাম লেখা আছে। ওটা আমার বাবা দিয়েছিলেন। বাবা মারা গেছেন, তাই ওটা আমি রাখতে চাই।

—না স্যার, ওটা পাবার কোন চান্স নেই। আপনি অন্য কলম চান তো বলুন। খুব ভালো কলম এনে দেব ঐ শেফার্সই।

–না না, সে দরকার নেই। তোমাদের কাছ থেকে কলম নিয়ে মরি আর-কি! শেষে রাস্তায় কোন লোক নিজের কলমটা চিনতে পেরে …

–আপনার কলমটা কোথায় মারা গেছে?

–কলেজ স্ট্রিটে, এক শীতকালের সন্ধেবেলা।

—হুঁ, ওটা গগনলালের এলাকা। আচ্ছা, দেখব এখন গগনলালকে জিজ্ঞেস করে।

–দেখো-না, ওটা আমার খুব শখের!

—আপনি যাবেন গগনদার বাড়ি?

–আমি যাব? সে কি হে?

—হ্যাঁ স্যার, গগন আমাদের মতো নয়, রীতিমতো ভদ্দর লোক, বিরাট তিনতলা বাড়ি। তিনপুরুষ ধরে ওদের এই ব্যবসা। উনিই তো আমাদের সর্দার।

–যাঃ! তিনপুরুষ ধরে পকেটমারের ব্যবসা?

—বিশ্বাস করুন! বাড়িসুদ্ধু সকলের। আপনি যদি প্রতিজ্ঞা করেন, কারুকে বলবেননা, তবে আপনাকে আমি গগনদার বাড়িতে নিয়ে যেতে পারি। অবশ্য, পুলিশকে হাত করা আছে গগনদার!

সত্যরক্ষার খাতিরে আমি গগনলাল সামন্তের বাড়ির ঠিকানা জানালামনা। কিন্তু সেখানে গিয়েছিলাম। গগনলাল সামন্ত একটি মধ্যবয়স্ক ঘাড়-ছাঁটা লোক, দেখলে মনে হয় রাজনীতি করেন। আমাকে তিনি খুব-একটা পছন্দ করলেননা। আমার সঙ্গীর দিকে আড়চোখে বারবার ভ্রুকুটি করলেন। আমার সঙ্গী সারা দেহটা মুচড়ে অশেষ কৃতজ্ঞতার ভঙ্গিতে জানাতে লাগল, যে একদিন আমি ওর প্রাণ বাঁচিয়েছি, সেইজন্যই–মানে সামান্য একটা উপকার, কলমটা আমার বাবার স্মৃতি— ইত্যাদি।

গগনলাল বললেন, ‘চারবছর আগের কলম পাবার কোন উপায় নেই। এরপর যদি আবার কোন ‘ ইত্যাদি। সেইসঙ্গে পকেটমারের সর্দার আমাকে একটি উপদেশও দিলেন, ‘ট্রামে-বাসে সাবধান হয়ে চলাফেরা করাই ভালো, বুঝলেন!’

কথা হচ্ছিল বাড়ির সদর দরজায় দাঁড়িয়ে। এমন সময় হিলতোলা জুতোর টক্‌টক্ শব্দ করতে-করতে একটি ঝলমলে পোশাক-পরা যুবতী বেরিয়ে এল বাড়ি থেকে। একঝলক তার দিকে তাকিয়েই চারবছর আগের সেই সন্ধেবেলার স্মৃতি মনে পড়ল। হ্যাঁ, কোন সন্দেহ নেই, এই সেই বাসের মধ্যে জানালার ধারে বসে—থাকা সুন্দরীর মুখ। যা দেখে আমি মোহিত হয়েছিলাম। হ্যাঁ, নিশ্চিত, কোন সন্দেহ নেই। মেয়েটিকে দেখেই আমার মনে হল, আমার যদি আর-একটা কলম থাকত, আমি ওর পায়ে অর্ঘ্য দিতাম আবার।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *