বিশেষ দ্রষ্টব্য – ২২

২২

শুনেছি ফরাসি দেশে পাঁচশো ফ্রাঁর নোটের ( ওল্ড ফ্রাঁ ) একটা ডাকনাম আছে : মিজারেবল। অর্থাৎ যন্ত্রণা! কারণটি এই, শুনতে যদিও পাঁচশো টাকা, কিন্তু ওর দাম আসলে পাঁচ টাকা। অত বড় একখানা নোট, অত টাকার ছাপমারা—কিন্তু কিছুই কিনতে পারা যায়না বিশেষ। পকেটে হাত ঢুকিয়ে এরকম একটা পাঁচশো ফ্রার নোট হঠাৎ বার করে খাঁটি প্যারিসিয়ান ঝংকার দিয়ে ওঠেন, ‘ও, বন্ ফরতুন্! ম্যাদ! মিজারেবল! ( অনুবাদ : ওঃ, এ যে দেখছি লাখ টাকা! গু-গোবর! যন্তোন্না! )

ঐরকম নাম পাঁচশো টাকার (অর্থাৎ বর্তমানের পাঁচ টাকার ) নোটেরই ভাগ্যে পড়ার একটা অপ্রত্যক্ষ কারণ আছে। ফরাসি দেশই বোধহয় পৃথিবীর একমাত্র দেশ যেখানে সাহিত্যিকদের ছবি ছাপা হয় টাকার নোটে। রাসিন, কর্নেই ভলতেয়ার, ভিক্টর উগোর ছবি আছে বিভিন্ন নোটে। পাঁচশো ওল্ড ফ্রাঁর নোটে। ভিক্টর উগোর ছবি। এবং উগোর বিখ্যাত বই ‘লে মিজারেল্’-এর স্মৃতির ঐ পরিণতি জনতার মুখে-মুখে।

সে যাই হোক, সকলেই জানেন, ফরাসিরা স্বভাবতই অতিশয়োক্তিপরায়ণ। আমাদের দেশে কিন্তু পাঁচ টাকার অনেক দাম। সেজন্য, আচমকা চৌরঙ্গির বাসস্টপে দাঁড়িয়ে রাস্তা থেকে একটা পাঁচ টাকার নোট কুড়িয়ে পেয়ে আমি ভীষণ খুশি হয়ে গেলাম। এই পাঁচ টাকায় আমি এখন একটা গোটা রাজ্য কিনতে পারি। কলকাতার পথে-ঘাটে টাকা-পয়সা ছড়ানো এরকম প্রবাদ বহুদিন হল সারা ভারতবর্ষে প্রচলিত যেজন্য বিভিন্ন প্রদেশ থেকে দলে-দলে লোক কলকাতায় ছুটে এসেছে ভাগ্য ফেরাতে। কথাটা মিথ্যে কী, এখনো তো অনেক ধনী ব্যক্তির মড়া পোড়াতে নিয়ে যাবার সময় পথে-পথে খইয়ের সঙ্গে পয়সা ছড়ানো হয়। তবে এই পাঁচ টাকার নোটটি নিশ্চয়ই শ্মশানযাত্রীরা ছড়ায়নি। কোন অতিব্যস্ত লোকের পকেট থেকে পড়ে গেছে অসাবধানে। খাঁটি পরিষ্কার পাঁচ টাকা জাল নয়, এমনকী, আজাদ হিন্দ ফৌজের টাকাও নয়। আমি বিনা দ্বিধায় তুলে নিলাম।

আগে নিতামনা। বাবা-মা, গুরুজনেরা এরকম একটা কুসংস্কার ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন যে, কুড়ানো পয়সা নিতে নেই। পয়সা কুড়িয়ে নিলে নাকি পকেট থেকে তার ডবল আবার বেরিয়ে যায়। অনেকদিন এই কুসংস্কারটা রক্ষা করেছিলাম আমার চোখ বিশ্রী রকম ভালো বলে অনেক কিছু দেখতে পাই—নর্দমার পাশে চকচকে সিকিটাও চোখ এড়ায়না। কিন্তু কখনো তুলিনি। আমার সততার একটি উদাহরণ দিচ্ছি। একবার মৌলালি থেকে কলেজ স্ট্রিট যাবার খুব দ্রুত দরকার ছিল। নয়া পয়সার অত্যল্প আগের যুগ, পকেটে আমার একটি নিঃসঙ্গ এক আনি, অথচ বাস ভাড়া সাত পয়সা। মৌলালি থেকে বৌবাজার সমান দূর, ওখান থেকে বাসের ভাড়া এক আনা। কিন্তু ওটুকু হেঁটে যাবার ধৈর্য ছিলনা, সময় ছিলনা। সুতরাং ঠিক করেছিলাম, ঐ কয়েক স্টপ বাসের হ্যান্ডেল ধরে ঝুলতে—ঝুলতে কন্ডাক্টরকে ফাঁকি দিয়ে চলে যাব তারপর বউবাজার থেকে টিকিট কাটালেই হবে। কিন্তু এমন নিরাশ হলাম– একটা বাস এল অস্বাভাবিক ফাঁকা বিকেলবেলা ওরকম ফাঁকা বাস আসা অবিচার ছাড়া কী যেখানে মানুষের হ্যান্ডেল ধরে ঝুলে যাবার সুযোগ নেই। অগত্যা মনমরা হয়ে ভিতরেই ঢুকতে হল একটা বসবার পুরো জায়গা পেয়ে গেলাম পর্যন্ত, এবং দেখলাম, পায়ের কাছে একটা চকচকে আনি পড়ে আছে। তাড়াতাড়ি পকেটে হাত দিয়ে দেখলাম, না, আমারটা ঠিক আছে, এই দ্বিতীয়টি ঈশ্বরপ্রেরিত। সুতরাং ঐ আনিটা তুলে নিয়ে সাত পয়সা ভাড়া দিলেই সব ঝঞ্ঝাট মিটে যায়। কিন্তু ঐ-যে আমার ধর্ম ও সততা বোধ, কুড়ানো পয়সা নেবনা। আমি পয়সাটাকে জুতোর তলায় চাপা দিয়ে রাখলাম—মতলবখানা এই যে, বউবাজার পেরিয়ে গেলে আমি ঐ পয়সাটা ব্যবহার না-করে আমার নিজস্ব এক আনারই টিকিট কাটব। আর তারসঙ্গে কন্ডাক্টর এলে আমি পয়সাটাকে পা দিয়ে দূরে ঠেলে দিয়ে তাকে বলব, আমার পয়সাটা, পড়ে গেছে, তুলে দিন তো! তারপর ওর হাত দিয়েই তুলিয়ে, আমি না-ছুঁয়ে, টিকিট কাটব সাত পয়সার, উড়ো খই যাবে গোবিন্দের কাছে। কন্ডাক্টর দরজার মুখে দাঁড়িয়ে দন্তারবিন্দ প্রস্ফুটিত করে তার পার্টনারের সঙ্গে গল্প করছে। যথারীতি বউবাজারে বাস পৌঁছুতেই হুড়মুড় করে উঠল বহু লোক নতুন যাত্রী, পুরোনো যাত্রীরা মিশে গেল। কন্ডাক্টর পরে এসে আমার টিকিট চাইতে আমি অম্লানবদনে কাটলাম এক আনার। তারপর পা সরিয়ে বললাম, এখানে কার পয়সা আছে, আপনি তুলে রাখুন!

এখন আর ওসব ভাবিনা। ঝট্ করে পাঁচ টাকাটা তুলে নিলাম। পকেট থেকে ডবল বেরিয়ে যাবার সম্ভাবনা কবে ঘুচে গেছে। এখন পকেট খুবই শোচনীয় অ্যানিমিয়ায় ভুগছে। তাছাড়া পাঁচ-পাঁচটি টাকা, এই টাকা ইচ্ছে করলে সূর্যের আলো গাঢ় করে দিতে পারে, সু-বাতাস বইয়ে দিতে পারে, আলো জ্বেলে দিতে পারে অন্ধকার ময়দানে। পাঁচ টাকা অর্থাৎ এখন পাঁচশো পয়সা– এই কথা ভাবলেই তো সংখ্যাতত্ত্বের এক আশ্চর্য ভোজবাজি ঘটে যায়–মনে হয় কী বিপুল এর পারচেজিং ‘পাওয়ার’। পাঁচশো পয়সায় ফুচকা পাওয়া যাবে আড়াইশো—চিনেবাদাম অন্তত এক হাজার। ছোলা আজকাল কিনতে পাওয়া যায়না, নইলে তা-ও পাওয়া যেত তিন-চার হাজার। সারা মাসের খবরের কাগজ কিনে যাবতীয় সু-সংবাদ ভোগ করা যেতে পারে। অথবা—চিড়িয়াখানা দেখতে যাওয়া যায় কুড়িবার। কিংবা বাসে চাপা যায় অন্তত পঞ্চাশবার। এ-তো গেল শৌখিন ব্যবহারের কথা, নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিশের জন্যও কীরকম কাজে লাগতে পারে। পাঁচশো পয়সার গম পাওয়া যাবে তেরো হাজারটি, চাল একুশ হাজার। চিনি পাওয়া যেতে পারে তিন লক্ষ তিরিশ হাজার টুকরো। ভাবলে মাথা ঘুরে ওঠে। যদি গুলি সুতো কিনি, পাঁচশো পয়সায় সাড়ে চার মাইল লম্বা সুতো আসতে পারে আমার অধিকারে। পাটকাঠি কিনলে ঘরভর্তি পাটকাঠি। মোমবাতিও পাওয়া যেতে পারে অন্তত পঞ্চাশটা। স্কুলের ছাত্রদের যদি রচনা লিখতে দেওয়া হয়, তোমাকে পাঁচ—পাঁচশো পয়সা দিলে কী করবে তাহলে তারা নিশ্চয়ই লিখবে—এই পয়সায় একটা নাইট স্কুল খুলে’ দেবে—কিংবা গ্রামে-গ্রামে বিদ্যুৎ এনে দেবে কিংবা কিনে ফেলবে ঘুড়ির দোকানের যাবতীয় ঘুড়ি।

ঐ বিপুল মুদ্রার আর সদ্‌ব্যবহার করা যায় একটি বই কিনে। যে-কোন বই নয় একটি পঞ্জিকা। পঞ্জিকা মেনে চললে সারা বৎসরের জন্য নিশ্চিন্ত। একাদশী অমাবস্যার উপবাস, যাত্রা নাস্তি, অশ্লেষা-মঘা, আজ অলাবুভক্ষণ নিষেধ, কাল বার্তাকু মানা, এই-এই দিন আমিষ বর্জন। এমন মনের সুখে দিন কাটাবার, আর কী পথ আছে। ছেলেবেলায় আমাদের ইস্কুলের দারোয়ানের মুখে যেমন তার আহার্যতালিকা শুনেছিলাম—ভাত, ভাত-সেদ্ধ আর ভাতের তরকারি। সেইসঙ্গে নুন তো আছেই। অর্থাৎ চার-কোর্সের ডিনার। যেদিন খুব শৌখিনতা করার ইচ্ছে হত সেদিন মরিয়া হয়ে রাখত পুঁইশাকের দেখনাই। অর্থাৎ সকালবেলা পুঁইশাক রেঁধে সেটা না-খেয়ে, শুধু দেখে-দেখে খাওয়া। রাত্রিবেলা সত্যিকারের পুঁইশাকসমেত ভোজ।

দেখনাই প্রসঙ্গে ছেলেবেলার আর-একটি গল্প মনে পড়ল। পূর্ববঙ্গ থেকে কলিকাতায় আসবার পথে গোয়ালন্দের স্টিমারঘাটের হোটেলে গরম-গরম ইলিশমাছের ঝোল দিয়ে ঐশ্বরিক খাদ্য পেতাম ছপয়সায়। হোটেলে সাধারণের জন্য দুরকম রেট ছিল। ভাত, খেসারির ডাল ও বেগুন কুমড়োর তরকারি এই নিরামিষ খাবারের জন্য তিন পয়সা। আর মাছের ঝোলসমেত ছপয়সা। আর—একটা বিশেষ রেটও ছিল। মাছের দেখনাই। অর্থাৎ নিরামিষের সঙ্গে একটা প্লেটে মাছও রেখে যাবে একটা, কিন্তু প্লেট থেকে মাছ না-ছুঁয়ে শুধু ঝোলটুকু ঢেলে নিয়ে, মাছটা দেখে-দেখে ভাত খাবার পর আবার মাছটা ফেরত দিলে চার পয়সা। আমাদের পাশে এক পাইকার এসে খেতে বসে দেখনাই-এর অর্ডার দিয়েছে। পরম পরিতৃপ্তি সহকারে খেয়ে উঠে আবার মাছটা ফেরত দিয়ে ঢেকুর তুলে ম্যানেজারের কাছে দাম দিতে গেছে। গোয়ালন্দের ইলিশের তো ঝোলেই আদ্দেক স্বাদ। ম্যানেজার তাকে চার্জ করল পাঁচ পয়সা। পাইকার তো রেগেই অস্থির। একি অন্যায় কথা, তার বেলা নতুন রেট, চার পয়সার জায়গায় পাঁচ পয়সা চাওয়া হচ্ছে তার কাছে। ম্যানেজার ঝিমুচ্ছিল, চোখ না তুলেই বলল, ও হালার বাই হালা, দেহি নাই বুঝি! তুই যে চসছোস্। ( অনুবাদ : ওরে স্ত্রীর ভ্রাতাস্য ভ্রাতা, আমি বুঝি দেখিনি। তুই যে মাছটা চুষে নিলি একবার! )

বাসস্টপে দাঁড়িয়ে পাঁচশো পয়সার নোটখানির বিপুল সম্ভাবনার কথা ভেবে আমি বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। তখন মনে পড়ল, কিছুদিন আগে কাগজে একটি খবর বেরিয়েছিল যে, বীরভূম জেলার কোন্ চৌকিদার যেন এখনও দশটাকা মাইনে পায় মাসে। তাই নিয়ে খানিকটা টিপ্পনি আর হা-হুতাশ করা ছিল। কিন্তু কেন? ভেবে অবাক হলাম। দশ টাকা—একহাজার পয়সা কি কম হল নাকি। ওর থেকেই লোকটা কত পয়সা জমাচ্ছে, কে জানে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *