২০
ভিড়ের মধ্যে তীক্ষ্ণ, তেজি মেয়েগলার আওয়াজ শুনতে পেলাম, ‘নো, আ আম নট গননা সীট দেএর, আ আম অল্ রাইট!’
লম্বা ট্রামের একপাশে আমি, অন্যদিকে এই ঘটনা। আমি ছটফটিয়ে উঠলাম। তৎক্ষণাৎ অকুস্থলে উপস্থিত হতে ইচ্ছে হল আমার, কিন্তু অত ভিড় ঠেলে সামনে এগুবার সাধ্য তখন বাতাসেরও নেই। ইচ্ছে হল, ‘লোকের কাঁধের ওপর উঠে উঁকি মেরে দেখি। যদিও কথাটা সাধারণ, এর মধ্য থেকে রোমাঞ্চকর কাহিনীর সূত্র আবিষ্কার করার কোন কারণ নেই। নিশ্চিত কোন মহিলাকে দেখে—লেডিজ সীটে বসে থাকা পুরুষেরা, পাশাপাশি দুটি সীটে চারজন পুরুষ এ ওর মুখের দিকে তাকিয়েছে, কেউ জানালায় মুখ ফিরিয়েছে, কেউ অন্ধ ও বধির সেজেছে, প্রত্যেকেই আসলে একাগ্র হয়ে ভেবেছে, আঃ, অন্য সীটটা খালি করুক-না, …আর সেই সময় ঘর্মাক্ত, পিষ্ট দাঁড়িয়ে থাকা পুরুষরা জিঘাংসার মনোবৃত্তিতে বলেছে, কর্কশ গলায়, ‘এই-যে, দেখতে পাচ্ছেননা, লেডিজ সীটটা ছাড়ুন!’–আর তখন দুই সীটের লোকেরা আড়চোখে তাকিয়ে দূরত্ব মেপেছে—কোন আসন দণ্ডায়মান অপেক্ষমাণ মেয়েটির সবচেয়ে কাছে সেই অনুযায়ী দুজন লোক প্রবল অনিচ্ছা সারাশরীরে ফুটিয়ে গা মোচড়াতে-মোচড়াতে—মুখে, ঈশ্বর জানেন, কী বিড়বিড় করতে-করতে উঠেছেন। আর তখন এবংবিধ লাঞ্ছনার পর, সেই রমণী যদি আত্মসম্ভ্রমশীলা হন, বলেছেন, থাক, আপনারাই বসুন, আমি বসবনা। এ তো খুব সাধারণ কাণ্ড! প্রতিদিনের অসংখ্য। কিন্তু আমি অন্যরকম গন্ধ পেয়েছিলাম। কারণ, গলার আওয়াজটা অত্যন্ত জোরে, কোন মেয়ের পক্ষে। ইংরেজি উচ্চারণ বিদেশি ধরনের, ‘নো’ কথাটা এমনভাবে বলেছে, যেন সংস্কৃতের মতো বিসর্গ আছে, নোঃ।
তখন ওখানে গুঞ্জন চলছে, মেয়েটি আরও কিছু বলল, বোঝা গেলনা। আমি অতিকষ্টে আঙুলে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আরও তিন ইঞ্চি লম্বা হয়ে কণ্ঠস্বরের অধিকারিণীকে একপলক দেখতে পেলাম। সঙ্গে-সঙ্গে চমৎকৃত হতে হল।
জ্বলজ্বলে হলদে রঙের স্কার্ট-ব্লাউজপরা একটি কুচকুচে কালো মেয়ে। খুব সম্ভবত নিগ্রো, বয়েস উনিশ-বাইশ, ট্রাম একটা মিশনারি কলেজের সামনে একটু বেশি থেমেছিল, হয়তো সেখানকার ছাত্রী। মুখ দেখে মনে হল, মেয়েটি কোন কারণে খুব রেগে গেছে, আঁটস্বাস্থ্যে উদ্ধত শরীর, সকালবেলার আপিস-মুখো ট্রামে একটি মূর্তিমান ব্যতিক্রম। এইসব জল-রঙ মানুষ, যাদের পকেটে ময়লা রুমাল, ফর্সা জামার নিচে ছেঁড়া গেঞ্জি, পালিশ করা জুতোর মধ্যে ফুটো মোজা যাদের জীবনে একমাত্র উত্তেজনা সহযাত্রীর পা মাড়িয়ে দিয়ে খানিকটা ঝগড়াঝাঁটি করা (সবসময় ভেতরে-ভেতরে সজাগ থেকে, মারামারি পর্যন্ত না-এগোয় ) তাদের মধ্যে ঐ নিগ্রো মেয়েটি, ওর ঐ অটুট কালো শরীর ও হলদে পোশাক মিলে যেন একটা রঙের হৈ-হৈ পড়ে গেছে, তাছাড়া ঐ তেজি, দ্বিধাহীন সরল কণ্ঠস্বর। একটুকরো আবার শুনতে পেলাম : ইউ পিপ্ল হেইট মী! আমার আন্তরিক বাসনা হল ঐ দৃশ্য কাছাকাছি গিয়ে উপভোগ করি কিংবা অংশ নিই, কিন্তু এমন ভিড়, আঃ অসম্ভব! মেয়েটি কেন বলছে, লোকে ওকে ঘৃণা করছে? যদি ওর সঙ্গে দু-একটা কথা বলতে পারতাম!
আমি বিদেশি নারী-পুরুষ দেখলেই অযাচিতভাবে কথা বলার চেষ্টা করি। দেখেছি তাতে ওরা খুশিই হয়। আমাদের দেশের যেসব লোক বিদেশে গেছে, তাদের অভিজ্ঞতা এই যে বিদেশের রাস্তায় হঠাৎ কোন লোক ডেকে কথা বললে খুব ভালো লাগে। তাতে মনে হয়, ওদেশের সাধারণ লোকও তাকে গ্রহণ করেছে, স্বীকার করছে। কিন্তু আমাদের দেশে বিদেশিদের সঙ্গে এমন ব্যবহার সচরাচর করা হয়না, সঙ্গে পাই আমি চেষ্টা করি, আমার ইনজিরি জ্ঞানের জন্য লজ্জা হয়না, আমি বাঙালিদের সঙ্গে ভুল ইংরেজি বলে ফেললে লজ্জা পাই, সাহেব-মেমদের না। এখানে ভিড় ঠেলে এগুতে না পারার দুঃখে মরমে মরে গেলাম। একবার চেষ্টা করে নাকে গুঁতো খেয়ে চক্ষে অন্ধকার দেখছি।
অথচ ওখানে কেউই মেয়েটির সঙ্গে স্পষ্ট কথা বলছেনা। অনেকেই পরোক্ষে উক্তি করছে। কেউ-বা বাংলায় মন্তব্য, ওরে বাবা কী তেজ রে … কালো মেমসাহেবদের চোট’ সাদা মেমদের তিনগুণ বেশি হয় … আপিসের টাইমে ওঠা কেন বাবা!
আমি তখনই ঠিক করলাম, নেমে যাবার সময় মেয়েটির সঙ্গে কথা বলতে হবে। এখন এগিয়ে যাবার যখন কোন উপায় নেই। তাছাড়া সবাইকে গোঁত্তা মেরে ঠেলেঠুলে গিয়ে মেয়েটির সঙ্গে কথা শুরু করলে পঞ্চাশজোড়া চোখ আমার দিকে চেয়ে থাকবে। কে কী মন্তব্য করে, তাই বা ঠিক কি! থাক্। ততক্ষণ আমি মেয়েটির সঙ্গে মনে-মনে কথা বলা শুরু করলাম। আমাদের কাল্পনিক সংলাপ নিম্নরূপ:
আমি: তুমি কি অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান না নিগ্ৰো?
মেয়েটি: (তখনো মুখে ক্রোধ) অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান? কী বিশ্রী এই কথাটা। তোমরা এ-নামটা বদলাতে পার না। একটা জাতকে উল্লেখ করার সময়, সবসময় তাদের কুৎসিত জন্মবৃত্তান্তটাও উল্লেখ করতে হবে! না, আমি তোমাদের ঐ সো—কল্ড অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান নই।
—ও, তবে নিগ্রো বুঝি?
—নিগ্রো? ছি, ছি, তোমাদের লজ্জা করেনা? ‘নিগ্রো’ কোন জাতের নাম হয় বুঝি? তুমি নিজে কি মঙ্গোলিয়ান না ড্রাভিডিয়ান? আমি একজন আফরিকান! সাউথ আফরিকা আমার দেশ।
–ও, আচ্ছা, মাপ চাইছি। কিন্তু তুমি বড্ড রেগে আছ। ওখানে কী হয়েছিল? কেউ খারাপ ব্যবহার করেছিল?
–বিশেষ কিছু না, এমন খারাপ ব্যবহার তো তোমাদের দেশে সবাই করছে!
—কেন, একথা বলছ কেন?
–তোমরা কালো লোকদের ঘেন্না করো। বিদেশের কালো লোকদের। তোমরা নিজেরাও যদিও কালো। তুমি নিজেই তো আবলুষ কাঠের মতো কালো। আমি একটু আহত হয়ে মনে-মনে সংলাপের মধ্যেও আরও মনে-মনে বললাম, যাঃ এটা কী বলছ, আমার চেনাশুনো মেয়েরা তো আমাকে বেশ ফরসাই বলে। তা যাকগে, এই ট্রামের মধ্যে কালো-সাদার কী দেখলে?
আমাকে দেখেই দুটো লোক ধড়পড় করে সীট ছেড়ে উঠে দাঁড়াল—
—ওঃ, হো-হো, তুমি বুঝি এটা জাননা? এতে কালো-সাদার কী আছে? মেয়েদের দেখলে আমাদের দেশের গাড়ি-টাড়িতে সৌজন্য দেখিয়ে জায়গা ছেড়ে দেওয়া হয়।
–ডোন্ট টক রট। ওসব জানি, এতদিনে জেনে গেছি–কতটা সৌজন্য আর কতটা বাধ্যতামূলক। কিন্তু দুটো লোক উঠল কেন? একজন উঠলেই তো আমি আর-একজনের পাশে বসতে পারি!
এবার আমি, মনে-মনেই যখন কথা, তখন একটু ইয়ার্কির লোভ সামলাতে পারলামনা। বললাম, তোমাকে এমন সুন্দর দেখতে, তোমার জন্য তো গাড়িসুদ্ধু সকলেরই জায়গা ছেড়ে উঠে দাঁড়ানো উচিত ছিল!
মেয়েটি একটু মুচকি হেসে বলল, তোমার এটা বাজে খরচ হল। যাক, আমি আগেও দেখেছি, আমি বসলে পাশে আর কেউ বসেনা। অত্যন্ত ভিড়ের গাড়িতেও একটা জায়গা ফাঁক পড়ে থাকে!
—তুমি ভুল বুঝেছ। অচেনা মেয়ের পাশে এসে বসে পড়া আমাদের দেশে এখনও চালু হয়নি। তুমি কালো বলে বা নিগ্রো … থুড়ি আফরিকান বলে নয়। শুধু-শুধু তুমি একটা ধারণা করে বসে আছ যে, কালো বলে লোকে তোমাকে অপছন্দ করছে!
—শুধু-শুধু? তুমি জান তোমাদের একজনের বাড়িতে নেমন্তন্ন খেতে গিয়েছিলাম। সেখানে একটা বাচ্চা আমাকে দেখে ভয় পেয়ে কেঁদে ফেলেছিল।
–সে একধরনের কাঁদুনে বাচ্চা থাকে। যে-কোন অচেনা লোক দেখলেই কাঁদে। আমেরিকান বা জাপানি হলেও কাঁদত।
–খুব লুকোবার চেষ্টা করছ। আমাদের দক্ষিণ আফরিকায় সাদা লোকরা আমাদের কুকুরের মতো ঘেন্না করে। সেইজন্য বাবা-মা আমাকে পড়াশুনোর জন্য পাঠালেন ভারতে। তোমাদের শুনেছিলাম জাতিভেদ প্রথা আছে। কিন্তু বর্ণবিদ্বেষও কম নেই। তোমরা সবাই কালো একটু রঙের হেরফের, এরই মধ্যে যে এক পোঁচ ফর্সা, তার অহংকারে মাটিতে পা পড়েনা। জান, আমাদের ক্লাশের একটি বাঙালি মেয়ে বলছিল, তার দিদির বিয়ে হয়নি, কারণ রং কালো।
—সে নিশ্চয়ই শুধু কালো নয়, সেইসঙ্গে নাক খ্যাঁদা, কাঠিকাঠি হাত-পা, বেঁটে। এমনিতে সুশ্রী আর স্বাস্থ্যবান হলে শুধু কালো রঙের জন্য আজকাল আর বিয়ে আটকায়না। এই ধরো-না, তোমার তো রং কালো কিন্তু তোমার মতো এমন সুন্দর চেহারার মেয়ে যদি বিয়ে করতে রাজি হয় তবে এদেশে হাজার ছেলে তোমাকে বিয়ে করতে চাইবে।
–যাও, যাও, শুধু ঠাট্টা করছ। কালো রঙের জন্য আমার মোটেই লজ্জা নেই। তোমাদের থাকতে পারে। আমি কালো রংকেই সবচেয়ে সুন্দর মনে করি।
হঠাৎ দেখি ট্রাম ওয়েলিংটনে এসেছে, আর সেই মেয়েটি ভিড় ঠেলে নামার চেষ্টা করছে। আমার চমক ভাঙল। এতক্ষণ মনে-মনে কথা বলছিলাম এবার মেয়েটির সঙ্গে সত্যিই দু-একটা কথা বলতে হবে। আমিও টুপ করে নেমে পড়লাম। কী করে কথা আরম্ভ করি? মেয়েটি নেমে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। তারপর দেখি পানের দোকানে গিয়ে কী যেন জিজ্ঞেস করছে, দোকানদার বুঝতে পারছেনা। এই সুযোগে আমি কাছে গিয়ে বলি, ‘তোমায় কোন সাহায্য করতে পারি?’
মেয়েটি কালো মুখ আলো করে এক ঝলক হেসে বলল, ‘এখানে ডকটরস লেন এই নামের রাস্তাটা কোথায় বলতে পার?’
—হ্যাঁ, নিশ্চয়ই? কাছেই তো! আমিও ঐ দিকে যাচ্ছি আমার সঙ্গে আসতে পারো।
—ধন্যবাদ।
কয়েক পা একসঙ্গে চলার পরই নাকি বন্ধুত্ব হয়ে যায়। তাই আমি জিজ্ঞেস করি, ‘ট্রামে কি তোমার কোন অসুবিধে হয়েছিল?’
–বিশেষ কিছু না। সামান্য ব্যাপার। আমার হঠাৎ মাথা গরম হয়ে যায়—!
দেখলাম মেয়েটি বিশেষ কথা বলতে উৎসাহী নয়। কিন্তু ইতিমধ্যে তো মনে—মনে কথা বলে আমি ওর চরিত্র তৈরি করে ফেলেছি। মনে হল, আমার রং যথেষ্ট কালো নয় বলেই বোধহয় মেয়েটি আমাকে পছন্দ করছেনা।
পার্কের ওপাশে একটি সাহেব দাঁড়িয়েছিল। টকটকে ফর্সা রং। সুপুরুষ, স্বাস্থ্যবান। ইওরোপীয় সম্ভবত, উচ্চবিত্ত অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানও হতে পারে! সাহেবটি এই মেয়েটিকে দেখে চেঁচিয়ে উঠল, ‘হাই জেনি!’
মেয়েটি ওকে দেখতে পেয়েই চঞ্চলা, গতিশীলা হয়ে গেল। এক ছুটে গিয়ে সাহেবটির বাহুলগ্না হল। আমাকে একটা বিদায় জানাবার কথাও মনে পড়েনি। আমি হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। ওরা দুজনে একসঙ্গে এগিয়ে গেল খানিকটা, তারপর কী মনে করে মেয়েটি হঠাৎ পিছন ফিরে আমার উদ্দেশে হাত নেড়ে দিল একবার।