২
আমি রাস্তার এপারে, রাস্তার ওপারে একজন অল্পচেনা লোককে দেখতে পেলাম। যথোপযুক্ত ভঙ্গিতে অল্প হেসে জিজ্ঞেস করি, ভালো আছেন? তারপর আবার চলতে শুরু করেছিলাম, লোকটি ওপার থেকে কী যেন চেঁচিয়ে উঠলেন। ঠিক লক্ষ করিনি, ভদ্রলোক আবার বেশ চেঁচিয়ে বললেন, না, ভালো নেই।
দাঁড়াতেই হল। লোকটি রাস্তা পেরিয়ে কাছে এসে হাসি-হাসি মুখে বললেন, না, ভালো নেই! বুঝতে পারলেন, আমি ভালো নেই?
এবার আমি কী বলব, বুঝতে না-পেরে চুপ করে ছিলাম। তাছাড়া যাঁরা ভালো থাকেননা, তাঁরা নিজেরাই নিজেদের ভালো না-থাকার কথা শতমুখে বলবেন জানি। লোকটি কিন্তু একটু সামান্য হেসে বললেন, বিশেষ কিছুনা, ‘ভালো আছি’ শুনলেই তো চলে যেতেন, তাই ‘ভালো নেই’ বললাম। তবু একটু দাঁড়ালেন।
এবার আমিই হাসলাম। কিন্তু মুশকিল এই, লোকটির নাম আমার মনে পড়ছেনা, কোথায় আলাপ কিছুই মনে পড়ছেনা, মুখখানা সামান্য চেনা-চেনা। এরকম চেনা লোক পথেঘাটে অসংখ্য থাকে। পরিচয়ের গাঢ়তা অনুযায়ী সম্ভাষণ হয়। যেমন প্রাথমিক স্তরে ভ্রূ-নৃত্য। এই স্তরের লোকদের সাধারণত দূর থেকে দেখতে পেলে অন্যমনস্ক হবার ভঙ্গি করতে হয়, অত্যন্ত উদাসীনের মতো পথের পোস্টার পড়তে-পড়তে দুজনে দুজনকে অতিক্রম করে যাই। দৈবাৎ চোখাচোখি হয়ে গেলে ভুরুদুটো একবার নাচানো। এরপরের স্তরের সঙ্গে দেখা হলে ভ্রূদ্বয়ের ছুটি। সেখানে চোখ ও মুখে মোনালিসা ধরনের সুপ্ত হাসি এঁকে একবার তাকানো, বড়োজোর অস্ফুটভাবে বলা, ভালো! এর উত্তর শোনার জন্য থামতে হয়না, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই উত্তর আসেনা।
তৃতীয় স্তরের সম্ভাষণই সবচেয়ে বিপদজনক। সেখানে এক মিনিট দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করতে হয়, কী খবর?—এই চলে যাচ্ছে আর কী! সত্যি, যা গরম পড়েছে! ও তাই নাকি! আচ্ছা, চলি!—এসব লোকের সঙ্গে দেখা হলে প্রায়ই মনে পড়েনা, লোকটির সঙ্গে আগে ‘তুমি’ কিংবা ‘আপনি’ কোন্টা বলতাম। তখন ভাববাচ্যের আশ্রয় নিতে হয়।—কী করা হয় আজকাল? কোথায় যাওয়া হচ্ছে? কলকাতার বাইরে থাকা হয় বুঝি? কথা বলার সময়েই মনে-মনে হিসেব করতে হয়, যথেষ্ট ভদ্রতাসূচক সময় ব্যয় করা হয়েছে কিনা এর সঙ্গে!
এরপর যাঁরা, তাঁদের সঙ্গে কোন-না-কোন সূত্রে যথেষ্ট ঘনিষ্ঠতা থাকার কথা, অথচ মনে-মনে নেই, মুখেও বিশেষ কিছু বলার নেই। আত্মীয় বা বন্ধুর বন্ধু বা প্রেমিকার অন্য প্রেমিক। এঁদের সঙ্গে দেখা হলে যথেষ্ট উল্লাসের ভঙ্গিতে বলতে হয়, আরে কী খবর! দেখাই নেই যে! চেহারাটা খারাপ হয়ে গেছে দেখছি!—তারপর, অমুক কেমন আছে? ওখানে আর গিয়েছিলেন? এইসব কথা বলার সময় এমন ভাব করতে হয় যেন ওঁকে দেখে আমি সমস্ত বিশ্বসংসার বিস্মৃত হয়েছি। তারপর সূক্ষ্মকোণী চোখে হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে অকস্মাৎ সমস্ত শরীর ঝাঁকিয়ে বলে উঠি, আরেঃ তিনটে বেজে গেছে! ইস, একটা বিশেষ কাজ আছে, ভুলেই গিয়েছিলাম। চলি। আবার দেখা হবে। অ্যাঁ?—এরপর অত্যন্ত দ্রুতভাবে কিছু দূর গিয়ে চলন্ত ট্রামে উঠে পড়তে পারলে সবচেয়ে ভালো হয়।
টাকা ধার করিনি, চুরি করিনি, ঝগড়া করিনি, কোনরূপ অন্যায় করিনি, তবু অনেক লোককে দূর থেকে দেখেই রাস্তার ছায়ার ফুটপাথ ছেড়ে রোদ্দুরের ফুটপাথে চলে যেতে হয়। এই এড়িয়ে যাবার কারণ আরকিছুই-না, অকারণে বাক্যব্যয় বা ভুরু নাচানোর অনিচ্ছা। একেক সময় হয়তো আমার মেজাজ খারাপ বা মন বিষণ্ন, তবু হঠাৎ কারুকে দেখে জোর করে মুখে হাসি ফোটাতে গা রি-রি করে।
অবশ্য এর উল্টোটাও আছে। কোন গণ্যমান্য ব্যক্তি বা উচ্চপদস্থ লোক আমাকে দেখেই চোখ ফিরিয়ে পথের শোভা নিরীক্ষণ করছেন বা সোজাসুজি চোখের দিকে তাকিয়েও না-চেনার ভান করছেন, তখন নিজেকেই এগিয়ে যেতে হয়, নমস্কার ঠুকে বিগলিত হাস্যে বলতে হয়, আমাকে চিনতে পারছেন? তাঁর সম্বন্ধে প্রশ্ন করতে হয় অতি আন্তরিকভাবে, শব্দ নির্বাচন করতে হয় অতি সাবধানে, যাতে প্রতিটি বাক্যই হয় প্রচ্ছন্ন স্তুতি। আর, অন্তরীক্ষসঙ্গীতের মতো সর্বক্ষণ তো বিগলিত হাস্য আছেই। পুরো দৃশ্যটির এককথায় সারমর্ম এই : সময়কালে যেন আপনার কৃপার ছিঁটেফোঁটা পাই!
সবচেয়ে অস্বস্তিকর লাগে যদি পনেরো-কুড়ি বছর পর হঠাৎ কারুর সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। হয়তো স্কুলে ক্লাস সিক্স-সেভেনে সে ছিল আমার প্রাণের সুহৃদ্, সে আমাকে টিফিনের সময় অসুখের ভান করে ছুটি নেওয়া শিখিয়েছিল, সে আমার জন্য সিনেমায় ছ-আনার লাইনে জায়গা রাখত। তার সঙ্গে বদলাবদলি করে যত রাজ্যের রগরগে গোয়েন্দা গল্প, পরে অশ্লীল বই পড়তে শুরু করি, আমার ঘুড়ির সুতোয় মাঞ্জা দেবার সময় সে টিপ্নি ধরত। তারপর পনেরো বছর কেটে গেছে, কেউ কারুর খবর রাখিনা, পরস্পরের জীবন এখন কোথায় বেঁকে গেছে কেউ কিছু জানিনা। গলার আওয়াজ বদলে গেছে, চেহারা বদলে গেছে। দেখা হলে কথা বলার কিছুই থাকেনা। দুজনে দুজনের দিকে তাকিয়ে মনে পড়ে সেই ইজের ও গেঞ্জি পরা খালিপায়ের বাল্যকাল, পরস্পরের সেই চেহারা আমরা দেখি নিঃশব্দে। যদিও আজ মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছি দুজন ভদ্র সভ্য, পুরো-প্রস্থ পোশাকপরা পুরুষ, কী কথা বলব জানিনা, দেখা হলেই তো আর বাল্যের কথা শুরু করা যায়না; সেই ঘুড়ির মাঞ্জা কিংবা শেষপাতা-ছেঁড়া গোয়েন্দা গল্পের কথা। আমরা চুপ করে থাকি, দু-একটা মামুলি কথা বলে বিদায় নিই। অমন একদা—প্রাণের-বন্ধুর সঙ্গে গলা জড়িয়ে একটাও কথা বলা হলনা দেখে ভিতরটা হাহাকার করে।
অবশ্য বহুদিন-পর-দেখা সব ছেলেবেলার বন্ধুই অমন বাল্যে ফিরে যায়না। অনেকে ঘোরতর সংসারী হয়ে গেছে, ওসব কিছুই মনে নেই হয়তো, পান চিবুতে—চিবুতে যাচ্ছেতাই সব প্রশ্ন করে। বিশেষ করে একটি প্রশ্নের জন্য আমি সবসময় শঙ্কিত থাকি। শুনলেই রাগ হয়, বিশেষত সে প্রশ্নের উত্তর জানিনা বলেই বহুদিন পর ক্ষণিকের জন্য দেখা, আবার বহুদিন দেখা হবেনা, তবু ঐটুকু সময়ের মধ্যেই আমাকে অত্যাচার না-করলে যেন ওদের আশা মেটেনা। যেমন, এ কথা সে কথার পর ওরা জিজ্ঞেস করবেই, এখন কী করছিস?
উত্তরে আমি বলি, এখন? এখন একটু মানিকতলায় যাব।
—না, না, কোথায় আছিস?
— দমদম।
এতেও ওরা একটুও দমিত হয়না। তাকায়না আমার নিষেধ-আঁকা চোখে। এরপরেও জিজ্ঞেস করে, কোথায় গেলে তোর সঙ্গে দেখা হবে? আমি বলি, একদিন দমদম আমার বাড়িতে আয়-না।
কিন্তু এসব শুনে তৃপ্তি হয়না ওদের। ওদের যেন জীবনমরণ নির্ভর করে একটা বিশেষ কথা জানার ওপর। এরপর বলে, কী কাজ করছিস?
তখনও এড়িয়ে যাবার প্রাণপণ চেষ্টায় আমি উদাস ভঙ্গিতে বলি, জীবনের সত্যিকারের কাজ এখনও কিছুই শুরু করিনি ভাই! কিন্তু ঐ নিরেটের দল তখন প্রায় ক্ষেপে উঠে জিজ্ঞেস করে, কোথায় চাকরি করছিস বল-না!
‘বেকার’ শব্দটা আমি মোটেই পছন্দ করিনা। কোথা থেকে ঐ অবাঙালি শব্দটা বাংলাভাষায় জুড়ে বসল কে জানে। অথচ এর আর কোন প্রতিশব্দও নেই। ‘চাকরি করিনা’, বলব? উঁহু, এতেও কাজ হয়না, বলে দেখেছি। তাতেও ঐ থান—ইট-দিয়ে-তৈরি-করা মাথারা জিজ্ঞেস করে, অ, বিজনেস করছিস বুঝি?
এরপর অত্যন্ত রূঢ়ভাবে সঙ্গে-সঙ্গে বিদায় নিয়ে চলে যাই।
মেয়েদের সঙ্গে দেখা হলে এসব ঝঞ্ঝাট নেই। অধিকাংশ মেয়েই পথে দেখা হলে চিনতে পারেনা। মেয়েদের একটা বিচিত্র সীমাজ্ঞান আছে। যে মেয়ের সঙ্গে তার বাড়িতে আলাপ, অথবা কোন-না-কোন ফাংশনে, সে শুধু তার বাড়িতে বা ঐধরনের কোন ফাংশনেই চিনতে পারবে, অন্য কোথাও নয়। এছাড়া, বিয়ের আগে যার সঙ্গে পরিচয়, বিয়ে হয়ে যাবার পর তাকে তো আর চিনতে পারার রীতিই নেই। আরেকধরনের মেয়ে আছে যারা মুখোমুখি পথে দেখা হলে চোখ নামিয়ে নেবে সঙ্গে-সঙ্গে, তারপর একটু পরে আরেকবার তাকাবে স্থিরভাবে কয়েক সেকেন্ড, তারপর আবার চোখ নামিয়ে হাঁটতে শুরু করবে। ভাবখানা এই, আমি যদি আগে কথা বলি, তাহলেই তিনি দয়া করে আমাকে চিনতে পারবেন। এসব ক্ষেত্রে আমি কথা বলিনা। না, আগে লক্ষ করি, মেয়েটির মুখে চেনা-হাসি আছে কিনা।
আরেকদল মেয়ে পথে সামনাসামনি দেখা হলে একদম চিনতে পারেনা, কিন্তু চলন্ত গাড়ি, বাস বা ট্যাক্সি থেকে দেখলে চেনামুখে হাসে, অনেকসময় হাত নাড়ায়। কিন্তু কখনো থামেনা। তারা দ্রুত চলে যাবে বলেই এক মুহূর্ত চেনার ভান করে। জীবনে একবারমাত্র একটি মেয়ে আমার সামনে জিপ গাড়ি থামিয়ে বলেছিল, একী আপনি এখানে? আসুন আমার সঙ্গে।
যে মেয়েরা দেখা হলেই হাসিমুখে চিনতে পারে, তাদের সঙ্গে কথা খোঁজার কোন সমস্যাই নেই। তাদের সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাসস্টপে দাঁড়িয়ে কথা বলা যায়, অথবা চায়ের দোকানে, অথবা বাড়ি পৌঁছে দেওয়া পর্যন্ত। দুজন পুরুষবন্ধুতে দেখা হলে আড্ডা হয়না, খোঁজ পড়ে তৃতীয়ের বা চতুর্থের; কিন্তু একটি মেয়ের সঙ্গে একটি ছেলে কথা বলতে পারে দীর্ঘক্ষণ, প্রেম না-করেও, কী কথা কে জানে।
এই সমস্ত অলিখিত নিয়ম আছে সম্ভাষণের, এই কলকাতা শহরে। প্রত্যেকটি চেনা লোক বিভিন্ন স্তরে ভাগ করা। এদের জন্যে কোন লিস্ট বানাতে হয়না, দেখা হলেই মনে-মনে তৎক্ষণাৎ ঠিক হয়ে যায় শুধু ভূ-নৃত্য, না হাসি, না এক মিনিট, না চায়ের দোকান পর্যন্ত। প্রতিদিন একরকম, কোন নড়চড় নেই। যার সঙ্গে শুধু ‘কী খবর’ বলেই চলে যেতে হয়, কোনদিন তার সত্যিকারের খবর শোনার আগ্রহ হয়না।
আজ আমার শুকনো ‘ভালো আছেন?’ প্রশ্নের উত্তরে লোকটির রাস্তা পেরিয়ে আসা এবং এসে বলা, ‘না ভালো নেই’, শুনে আমার অবাক না-হলে চলেনা। কী আশ্চর্য, লোকটি কি সভ্যসমাজের লোক নয়? জানেনা যে, লোকটি সত্যিই ভালো আছে কিনা সে সম্পর্কে আমার বিন্দুমাত্র কৌতূহল নেই, খারাপ থাকা বিষয়ে তো নয়ই।
আমি ঠোটে হাসি এঁকে অত্যন্ত অপ্রসন্ন মনে দাঁড়িয়ে থাকি। লোকটি বলে, জানেন, রমলা আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। না, না, আসলে, আমিই রমলাকে ছেড়ে চলে এসেছি! ভালো থাকব কী করে বলুন।
লোকটির নাম আমার কিছুতেই মনে পড়েনা। তাছাড়া, রমলা বিষয়ে তো আমি কিছুই জানিনা। কে রমলা? কোথাকার রমলা? কে তাকে ছাড়ল, কেনই—বা…। না, রমলা নামের কারুকে আমি চিনিনা। এই লোকটাকেই-বা কীভাবে চিনি? মনের প্রতিটি কোণে আমি তখন ওয়ারেন্ট নিয়ে জোর তল্লাস চালাচ্ছি
হঠাৎ মনে পড়ল, লোকটি একটি ওষুধ কোম্পানির সেল্সম্যান, বছরতিনেক আগে চিনতাম—কথার মধ্যে-মধ্যে চশমার ব্রিজটা হাত দিয়ে টিপে ধরার অভ্যেস দেখে লোকটির পরিচয় আমার মনে পড়ল, লোকটির ব্যক্তিগত জীবন তো আমার জানার কথা নয়।
লোকটি আমার কাছাকাছি সরে এসে বলল, খুব খারাপ আছি, বুঝলেন! আপনি পুলিশে চাকরি করেননা তো?
আমি বিস্মিতভাবে ‘না’ বলি।
—যাক্। আমাকে পুলিশে খুঁজছে। সবসময় স্পাই ঘুরছে আমার পেছনে জীবনটা অতিষ্ঠ করে দিলে।
—কেন? হঠাৎ—
—আর বলবেন-না! ওদের ধারণা, আমি রমলাকে পাচার করে দিয়েছি। হেঃ! আমি রমলার কে মশাই? আমি তো তাকে ছেড়ে চলে এসেছি। দেখুন—না, মটরগাড়িও চড়িনা আজকাল। মাছ-মাংস খাইনা। রাত্তিরে আসে যদিও। রোজ রাত্তিরে বিরক্ত করতে আসে। গায়ে সেই কালোরঙের কটকী শাড়ি, পায়ে আবার বাঈজীদের মতো নূপুর, সারারাত ধরে ঝমঝম ঝমঝম, ঝমঝম্ ঝমঝম্ ঝম্
যাক। লোকটা পাগল হয়ে গেছে! আমি ভেবেছিলাম, কী না কী। সভ্যসমাজ বুঝি বদলে গেল। ‘ভালো আছেন?’-এর উত্তরে ‘ভালো নেই’ বলা শুরু হল বুঝি। তা নয়, সভ্যসমাজ ঠিকই আছে, ভ্ৰূ-নৃত্য আর স-দাঁত হাসি। এ লোকটাই শুধু আলাদা, নেহাৎ একটা পাগল।