বিশেষ দ্রষ্টব্য – ১৭

১৭

নিউমার্কেটে অনেকে যায় রকমারি মনোহারী জিনিশপত্র দেখেশুনে কিনতে। আবার কেউ-কেউ যায়–যারা কিনতে এসেছে, তাদের দেখতে। আমার বন্ধু হরিশ ঐ দ্বিতীয়দলের। হাওড়ার দিকে একটা ইস্কুলে পড়ায় হরিশ, থাকে ঐ দিকেই। কিন্তু প্রত্যেকদিন সন্ধেবেলা তাকে চৌরঙ্গি এলাকায় দেখা যাবে। বিলিতি সিনেমা হলগুলির সামনে–কোনটার কখন শো ভাঙে তার মুখস্থ, চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে, যেন কাকে খুঁজছে–অথবা কেউ আসবে ওর জন্য–এমন প্রতীক্ষার মুখে তাকায় চৌদিকে তারপর যখন সকলেই ঢুকে যায় হলের মধ্যে–ও তখন ছোট্ট একটু হেসে এগিয়ে যায়। শ্লথ পায় ঘুরতে-ঘুরতে নিউমার্কেটের মধ্যে যায়, বারবার চক্কর দেয়, গভীর মনোযোগ দিয়ে হাস্যোজ্জ্বল মুখগুলি দেখে, প্রত্যেকটি মুখ, এমন অধ্যবসায় ওর যে কোন দোকানের মধ্যে ঢুকে যে তরুণী মহিলাটি অনেকক্ষণ ধরে কিছু কেনাকেটা করছেন যার শুধু পিঠটুকু দেখা যাচ্ছে আমাদের হরিশ কোন ছুতোয় গ্লাসকেসের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে সেখানে, সেই মহিলাটির মুখ না-দেখা পর্যন্ত নড়েনা। ততক্ষণে সিনেমা—হলগুলিতে ইন্টারভ্যাল শুরু হয়েছে, সুতরাং ব্যস্ত হয়ে হরিশ আবার বেরিয়ে যায়, ভিড়ের মধ্যে মিশে একটা সিগারেট ধরিয়ে এমন ঘন-ঘন টানতে থাকে যে মনে হবে হরিশও হল থেকে বেরিয়েছে ইন্টারভ্যালে, সিগারেট শেষ করেই আবার ঢুকে যাবে। তারপর দমকা ঝড়ে সবকটা শুকনো পাতা উড়ে যাবার মতো ঘণ্টা শুনে টিকিট-কাটা নারী-পুরুষেরা এক মুহূর্তে উধাও হয়ে যাবার পর—সম্পূর্ণ ফাঁকা আলো-ঝলমল প্রবেশপথে একা দাঁড়িয়ে থাকে হরিশ। একটু পরে আস্তে—আস্তে বাসস্টপে এসে অনেকগুলো বাস ছেড়ে দেয়। বেশ আসক্ত এবং প্রীতিভরা চোখে পথের বিশেষ-বিশেষ চলন্ত মূর্তিকে খুঁটিয়ে দেখে -। একসময় বাস ধরে বেশ খুশি মনে বাড়ি ফিরে যায়। ভুলেও কোনদিনও কোন সিনেমা-হলের ভেতরে ঢোকেনি, নিউমার্কেট থেকে একটিও জিনিশ কেনেনি আজ পর্যন্ত।

পর-পর তিনদিন হরিশের সঙ্গে আমার একই জায়গায় একই সময়ে দেখা হবার পর জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী রে, তুই এখানে রোজ কী করিস?’

—বেড়াতে আসি।

—শালকের ছুতোর পট্টি থেকে তুই রোজ চৌরঙ্গিতে বেড়াতে আসিস? হরিশের বয়েস প্রায় তিরিশ, দোহারা ছিপছিপে চেহারা, টিকোলো নাক, বিবাহিত, বাড়িতে ডিমওয়ালা এলে প্রত্যেকটি ডিম জলে ডুবিয়ে পরীক্ষা করে তবে কেনে, জামা ছিঁড়ে গেলে শীতকালে কোটের নিচে পরবার জন্য আলাদা করে জমিয়ে রেখে দেয়, এ-বছরের দোলের জামা কেচে তুলে রাখে আগামীবারের দোলের জন্য, রাস্তায় চারটে পয়সা কুড়িয়ে পেলে সঙ্গে-সঙ্গে দুটো পয়সা দেয় ভিখিরিকে— এ-হেন হরিশ রোজ চৌরঙ্গিতে নিছক বেড়াতে আসে? শুনে কীরকম আশ্চর্য লাগে। কিন্তু তখন দাঁড়িয়ে কথা বলার সময় নেই হরিশের। চলতে শুরু করেছে, আমাকে সঙ্গে আসতে বলে। ওর সঙ্গে-সঙ্গে আমিও পূর্ববর্ণিত ভ্ৰমণ—দর্শন সমাপ্ত করি, চোখদুটো বিস্ময়ের চিহ্ন করে। আমার দেখা পেয়ে বিরক্ত হয়নি, বরং একটু খুশিই হয়েছে হরিশ, মনে হল। বলল, ‘সন্ধের দিকে আগে একটা টিউশানি করতাম, ছেড়ে দিয়েছি। এখন এখানে রোজ বেড়াতে আসি। মনটা বেশ ভালো থাকে।’

–কেন, এখানে রোজ-রোজ কী দেখার আছে?

–দেখতে জানলেই দেখা যায়। কত সুন্দর-সুন্দর মেয়ে-পুরুষ এখানে …

–তা ঠিক। কিন্তু–

—চোখ জুড়িয়ে যায়, ভাই! সারা কলকাতার ছাঁকা জিনিশ দেখতে পাওয়া যায় যে-কোন সন্ধেবেলা চৌরঙ্গিপাড়ায় এলে। এই সিনেমা-হলগুলোতে, নিউমার্কেটে কেউ খারাপ পোশাক পরে আসেনা। খারাপ চেহারারও কেউ আসেনা বড়-একটা। আমার বড় ভালো লাগে দেখতে এদের।

—সে কী রে, শুধু-শুধু ভালো জামাকাপড়-পরা মেয়ে-পুরুষ দেখতে—

–মেয়ে-পুরুষটা কথার কথা। আমি আসি শুধু মেয়েদেরই দেখতে, ফ্র্যাঙ্কলি বলছি।

–এটা একটা কাজের কথা বটে। কিন্তু তুই তো বেশ স্পষ্ট স্বীকার করলি।

–করবনা কেন? সুন্দর জিনিশ দেখার মধ্যে লজ্জার কী আছে? সারা কলকাতার মধ্যে মাত্র এ-জায়গাতেই তুই একসঙ্গে এত সুন্দর মেয়েদের দেখতে পাবি। স্বাস্থ্যবান, মুখে হাসি মাখানো, কী সুন্দরভাবে পোশাক পরতে জানে, প্ৰসাধন করতে জানে। চক্‌চকে মুখ—কিন্তু পাউডার কিংবা পেন্ট দেখতে পাবিনা। কারুকে দেখতে প্রজাপতির মতো, কেউ চন্দনা পাখি, কেউ হিরামন। তন্বী, শ্যামা, শিখরিদশনা, পক্কবিম্বাধরোষ্ঠী, চকিতহরিণীপ্রেক্ষণা ইত্যাদি-ইত্যাদি সংস্কৃত বিশেষণের সবরকম নায়িকা দেখতে পাবি এখানে। দেখলে চোখ সুস্থ হয়। থাকি ভাই বস্তির পাশে–সেখানে দিনরাত নোংরার মধ্যে চেল্লাচেল্লি, ইস্কুলে দেখতে হয় কতকগুলো হাড়-জিরজিরে ছেলে, পথেঘাটে সবসময় ভিখিরি-ফিকিরি আর কুচ্ছিৎ মানুষের মেলা ও-সব দেখতে-দেখতে চোখ পচে যায়। এখানে এসে তাই রোজ খানিকটা সৌন্দর্য দেখে যাই। তুই অবশ্য বলতে পারিস, কেন, সৌন্দৰ্য কি শুধু মেয়েদেরই মধ্যে? প্রকৃতির—

—না, আমি তা বলতামনা।

–অন্য-কেউ বলতে পারে। কিন্তু কী জানিস, কয়েকদিন গঙ্গার ঘাটে কিংবা শিবপুরের বাগানে প্রকৃতি দেখতেও গিয়েছিলাম। পোষালনা। গাছপালার প্রধান দোষ ওরা বদলায়না। একইরকম। কিন্তু প্রত্যেকটি মেয়ে আলাদা। এমনকী, এক—একটা মেয়ে এক-একদিন আলাদা। জানিস, আজকাল আমি নভেল-নাটকও পড়িনা। পড়ার দরকার হয়না। এখানে এতগুলো গল্পের নায়িকা। এদের মুখের দিকে তাকিয়ে আমি বোঝার চেষ্টা করি কোন্ মেয়েটি স্বামীর গরবে গরবিনী, কে লুকিয়ে প্রেম করছে, কার স্বামী লম্পট, কার সঙ্গে দেখা হয়ে গেছে অনেকদিন পর ছেলেবেলার প্রেমিকের, কে হঠাৎ দেখতে পেল নিজের প্রেমিকের সঙ্গে অন্য মেয়েকে। আমি সব বুঝতে পারি। পেরে লুকিয়ে হাসি। ঐ যে মেয়েটাকে দেখছিস একা-একা উদাসিনীর মতো ব্লাউজপিস্ কিনছে পরশুদিনই ওকে দেখেছি একটা সুন্দর ছেলের হাত ধরে ঘুরতে, হাসতে-হাসতে গড়িয়ে পড়ছিল তার গায়ে। আজ ওর দুঃখে আমার মনে কষ্ট হচ্ছে। তুই আসবি মাঝে-মাঝে?

যখন কলেজে পড়তাম একসঙ্গে, তখন হরিশ বলত, সব মেয়েই গুপ্তচর। সবকটা মেয়েই স্পাই, জানিস? ও বেশ জোর দিয়ে বলত। ওরা পৃথিবীতে এসেছে শুধু খবর বার করে নেবার জন্য। মেয়েরা জানেনা এমন-কোন জিনিশ আছে? এমন-কোন ছেলেকে দেখেছিস–যে মেয়েদের কাছ থেকে কিছু লুকোতে পেরেছে? মেয়েরা কাছে এসে ছলাকলা দিয়ে হেসে অভিমান করে ছেলেদের পেটের সব খবর বার করে। পেট বা হৃদয় যাই বলিস।

ছাত্রজীবনে আমি শব্দতত্ত্ব নিয়ে খুব মাথা ঘামাতাম। হরিশের এই অভিনব থিয়োরিরও গূঢ় কারণ আমি শব্দতত্ত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করেছিলাম। সেসময়ে আমরা খুব ফিল্ম দেখতাম হরিশও ছিল পাঁড় সিনেমাখোর, অবশ্য যদি অন্য কেউ ওর টিকিট কাটত। ভালো-ভালো বই এলে ও কারুকে ওর টিকিট কাটার জন্য প্রায় হাতে-পায়ে ধরত। সেসময়ে আমাদের হৃদয়েশ্বরী ছিল ইনগ্রিড বার্গমান। ওকে মনে হত স্বর্গের দেবী। ছায়াছবিতে ওর হাসি, অশ্রু আমাদের ঘন-ঘন হৃৎকম্প ঘটাত। ইনগ্রিড বার্গমানের একটা ছবিও বাদ দিতামনা। ওর নামের আদ্যক্ষর দুটি নিয়ে আমরা আদর করে ওকে ডাকতাম আই বি। আই বি আই বি থেকে স্পাই ভাবা খুব সহজ, সেই থেকেই হরিশের কাছে সব মেয়েই স্পাই। কিন্তু হরিশ একসময় সব মেয়েদের গুপ্তচর ভাবত, এখন দেখছি ও-ই মেয়েদের পেছনে গুপ্তচরগিরি করে বেড়াচ্ছে। পুরোনো কথা মনে পড়তেই হঠাৎ আর—একটি কথা মনে পড়ল। আমি বিষম উৎসাহে বললাম, ‘হরিশ, আই বি কলকাতায় এসেছে।’

–কে?

—তোর মনে নেই। ইনগ্রিড বার্গমান। কাগজে ওর আসার খবর পড়েছিলাম, আজ দুপুরে দেখলাম গ্র্যান্ড হোটেল থেকে বেরুচ্ছে। ওঃ, এখনো কী রূপ।

–জানি। হরিশ বিমর্ষ গলায় বলেই চুপ করে গেল।

–কী রে। ইনগ্রিডকে একবার দেখতে ইচ্ছে করে না? এত সৌন্দর্য দেখবার ইচ্ছে।

—দেখেছি কাল সন্ধেবেলা নিউমার্কেটে। কী হতাশ হয়েছি কী বলব। এখানে যত রূপসী মেয়েদের দেখি কারুকে চিনিনা, নাম জানিনা—কিন্তু ওদের ব্যক্তিগত জীবনের কথা কল্পনা করতে আমার ভালো লাগে, মনে-মনে আমি ওদের সম্পর্কে গল্প বানাই। কিন্তু যাকে আগে থেকেই মনে-মনে জানি তাকে স্বচক্ষে দেখলে কী খারাপ লাগে! ইনগ্রিড সম্পর্কে সব জানি, কটা বিয়ে, কটা ছেলেমেয়ে ইত্যাদি। কিন্তু সিনেমায় ওকে মনে হত নন্দন কাননের অপ্সরী। জারের হারানো মেয়ে চিরযৌবনা আনাস্টাসিয়া। কাল তাকে নিজের চোখে দেখলাম এরকম সাধারণ নগণ্য কুচ্ছিৎ মেয়ে কম দেখেছি। একবার হাই তুলল, দেখলাম, ওফ

—কী হল রে।

—হাই তোলা অবস্থায় দেখলাম। একটা বিকট মুখ। ঘোড়ার মতো দুটো বিরাট মাড়ি। কেন যে দেখলাম ওকে। ওর সারা মুখে যা মাখানো দেখলাম–তা স্বর্গীয় সুষমা নয়, নিরবচ্ছিন্ন বোকামি। আমি আর-কোন কল্পনার রূপসীকে কাছ থেকে দেখতে চাইনা। কেন ওর কথা মনে করিয়ে দিলি? বাড়ি যাই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *