১৫
এমনসময় ধাক্কা লাগল। ল্যান্ডো গাড়িটা দিশাহারা হয়ে প্রথমে সবগুলো চাকা বেঁকে,—সেইসময় প্রবল হায়-হায় ধ্বনি জনতার পিছন দিকে গড়িয়ে যেতে লাগল বেগে, আর ঐ প্রবল, তেজী, দৃপ্ত বেগবান পুরুষ অশ্ব সেই টানে পিছিয়ে যাচ্ছে, সামনের দুটি পা শূন্যে তুলে থামাবার চেষ্টা করল পিছিয়ে যাওয়া গতি। পারলনা। কোচোয়ান আগেই মাটিতে পড়ে গেছে। চি-হি-হি আর্তকণ্ঠ না আক্রোশের হুংকার কী জানি। অমন শক্তিমান ঘোড়া, পিছনের দুই পা ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে সর্বশক্তি দিয়েও রুখতে পারলনা নিজেকে বা গাড়িটা। চিৎ হয়ে পড়ে গেল। তৎক্ষণাৎ ওর চারপাশে মানুষের গোল বৃত্ত।
আমি দোতলার জানালা দিয়ে দেখছিলাম। বৃষ্টি না-হওয়া মেঘের কোমল ছায়ায় চমৎকার সন্ধেবেলা দোতলা বাসের জানালার পাশে বসতে পাওয়ার গর্বে আমি বাসের মানুষদের দিকে আর একবারও তাকাইনি। টিকিটের পয়সা হাতে নিয়ে বাঁ-হাত বাড়িয়েছিলাম অবহেলায়। যেন ওজন্য আমাকে বিরক্ত না-করা হয়। আমি সর্বক্ষণ বাইরে তাকিয়ে ছিলাম। তাকিয়ে মেঘ দেখছিলামনা অবশ্য, মেঘে কারুর মুখের ছায়া না-ভাসলে বেশিক্ষণ দেখাও যায়না, আমি নিচের দিকে তাকিয়ে খানিকটা করুণার দৃষ্টিতে মন্থর মানুষের স্রোত দেখছিলাম।
সেইসময় ঘোড়ার গাড়িটা আমার চোখে পড়ে। ল্যান্ডো বা টমটম কী বলে ওগুলোকে আমি ঠিক জানিনা, এক-ঘোড়ার গাড়ি, গাড়ির রং মসৃণ চকচকে কালো, ঘোড়ার রং সাদা–পুরো সাদা নয়, শিরদাঁড়াব্যাপী লালচে প্যাচ, কোচোয়ানের মাথায় মুরেঠা, তক্মা-আঁটা পোশাকে পিছনে দাঁড়িয়ে হুঁসিয়ার-দার। উত্তর কলকাতার দু-একটি বনেদী বাড়িতে এখনো কয়েকটি এরকম গাড়ি আছে জানি, কিন্তু সহসা চোখে পড়েনা, এ গাড়িটাকে দেখে মনে হয় যেন অকস্মাৎ ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে উঠে এল।
গাড়িটা দেখার সঙ্গে-সঙ্গেই আমার প্রবল ইচ্ছে হল, গাড়িটার মধ্যে যিনি বা যাঁরা আছেন তাঁদের দেখার জন্য। এইসব অভিমানী, পরাজিত তবু মুখে অহংকারের হাসি-ফোটানো মানুষদের দেখতে এখনো খুব কৌতূহল হয়। বনেদীবাড়িগুলো থেকে এইসব জুড়িগাড়ির চল বন্ধ হতে শুরু করে মোটরগাড়ি আসবার পর–এখন অবশ্য, সেসব বাড়ির অনেকেরই আর জুড়ি বা মোটর কোনটা রাখারই সামর্থ্য নেই। মনে আছে, একবার আমি আমার এক বন্ধুর বাড়ির অন্দরমহলের শয়নঘরে গিয়েছিলাম। বন্ধুটির পূর্বপুরুষ কলকাতার অভিজাত সমাজের একজন ছিলেন। ওদের রং-জ্বলা কুৎসিত বিরাট বাড়িটির খিলান ও মণ্ডপ, ধুলোয় ঢাকা ঝাড়লণ্ঠন দেখলে কিছুটা আঁচ পাওয়া যায়। কিন্তু দেখেছিলাম, বন্ধুটির মা রান্না করছিলেন একটা বেনারসি শাড়ি পরে। পুরোনো খাঁটি, ভারি চমৎকার, অত্যন্ত দামি শাড়ি—কিন্তু ওর মাকে রান্নাঘরে দেখে সেই মুহূর্তে বুঝতে পেরেছিলাম, ওদের দারিদ্র্য কত নৃশংস জায়গায় এসেছে, দারিদ্র্যের এমন বীভৎস রূপ আমি শিয়ালদার ফুটপাথে মরে-থাকা ভিখারির মধ্যেও দেখিনি। বন্ধুর মা আমাকে দেখে কিছুটা যেন অপ্রস্তুত হয়েছিলেন, পায়ে হাত দিয়ে যখন প্ৰণাম করি, তিনি আশীর্বাদ করার সময় একটু হেসেছিলেন, চাপা বিষাদময় ক্রুদ্ধ অভিমানের হাসি।
ল্যান্ডোর আরোহীদের সহজে দেখতে পাইনি। পর্দা ফেলা ছিলনা, কিন্তু ঘোড়াটা দুলকি চালে ছোটার বদলে বেশ জোরে দৌড়োচ্ছিল। কখনো ডবল—ডেকারের পাশাপাশি আসেনি। ভালো জাতের, বোধহয় একেই ওয়েলার ঘোড়া বলে, ঘোড়াটার মধ্যে যেন পাল্লা দেবার স্পৃহা এসেছিল। মাঝে-মাঝে আমাদের বিরাট দৈত্যের মতন বাস হুস্ করে ওকে পেরিয়ে বহুদূর এগিয়ে যাচ্ছে, ঘোড়াটা তখন গ্রীবা ফিরিয়ে দেখছে। আবার স্টপে এসে বাস থামার সময় লোকের ভিড়, জেনানাদের ওঠা-নামার অবকাশে টক্ টক্ টক্ শব্দে ঘোড়ার গাড়ি আমাদের পেরিয়ে যাচ্ছে, ঘোড়াটা তখন আর অবহেলায় বাসের দিকে চেয়েও দেখছেনা। একবার কী-একটা কারণে পথ আটক, বাস ও ল্যান্ডো দুটোই থামল, ঘোড়াটার থেমে থাকা যদিও পছন্দ নয় অসহিষ্ণুভাবে মাটিতে পা ঠুকছে। তখন আমি আরোহীদের দেখতে পেয়েছিলাম।
একটি নবীনা নারী ও একজন প্রবীণ পুরুষ। দুজনের বয়সের ব্যবধান অন্তত পঁচিশ। অর্থাৎ মেয়েটির বয়েস কুড়ি থেকে পঁচিশ হলে, পুরুষটি পঁয়তাল্লিশ থেকে পঞ্চাশ। যে-রকম হয়, দুজনেই অত্যন্ত গৌর বর্ণের, সুকুমার স্বাস্থ্য, মেয়েটি সেই জাতের সুন্দরী যাদের মুখ বিনা প্রসাধনেও অত্যন্ত উজ্জ্বল দেখায়, ওর চোখ দুটি নিশ্চিত লক্ষণ সেনের কাটা দিঘির জলের মতো কালো ও গভীর– আমি ভালো করে না দেখতে পেয়েও বুঝেছিলাম।
মানুষের স্বভাবই এই, সকলেরই কিনা জানিনা, অন্তত আমার–কোনও অচেনা নারী-পুরুষ একসঙ্গে দেখলেই তাদের সম্পর্কটা মনে-মনে ভাবা। বাক্ দত্ত-দত্তা, প্রেমিক-প্রেমিকা, দিদির বর ও স্ত্রীর বোন, স্বামীর বন্ধু ও বন্ধুপত্নী, দাদার বন্ধু ও বন্ধুর বোন, দুই শত্রুপক্ষ অর্থাৎ স্বামী-স্ত্রী ইত্যাদি, এসব জানার আমার কোনও দরকার নেই, একটি যুগলকে এই কয়েক মিনিট দেখছি আর হয়তো জীবনে দেখবনা–ওদের সম্পর্ক জেনে কী লাভ আমার, তবু মন এসব যুক্তি মানেনা, মাথার মধ্যে আন্দাজের পাশাখেলা চলে। মোটরগাড়ির যাত্রীদের দেখে আন্দাজ করা খুব শক্তও নয়, গাড়ি বা ট্যাক্সিতে দুজন নারী-পুরুষ যখন কঠিন মুখে দুজন দুদিকে চোখ ফিরিয়ে বসে থাকে, তখন নিশ্চিত বোঝা যায় ওরা স্বামী—স্ত্রী, একটু ঘনিষ্ঠ, পথচারীদের সম্বন্ধে উদাসীন, কিছুটা বিসদৃশভাবে বসে-থাকা যুগল দেখলে গোপন সম্পর্কের কথা মনে আসে।
কিন্তু এদের দেখে কিছুই বোঝা যায়না। এরা ঠিক কঠিন মুখে নয়, কিন্তু চাপা রাশভারী গাম্ভীর্য নিয়ে এবং হেলান দিয়ে নয়, দুজনেই উন্নতদেহে বসে আছে। যেন পথ চলতে প্রগল্ভতা, কথা বলা, ওদের মানায়না। ওরা পিতা-পুত্রী, ভাই—বোন, স্বামী-স্ত্রী যা-কিছু হতে পারে।
বাধা সরে যেতেই আবার গাড়ি চলতে আরম্ভ করল। অসহিষ্ণু ঘোড়াটা এবার ছুটতে লাগল খুব জোরে। যেন এবার আর কিছুতেই সে ডবল-ডেকারকে এগিয়ে যেতে দেবেনা। এবারই সত্যিকারের প্রতিযোগিতা, কেউ হ্যান্ডিকাপ পায়নি, একই খড়ির দাগ থেকে দৌড় শুরু করেছে। ঘোড়াটার জন্য আমার মায়া হল, অমন সুন্দর জন্তুটা—ঘোড়ার মতো সুন্দর প্রাণী আর বোধহয় পৃথিবীতে একটিও নেই —যার শরীরে প্রতিটি অঙ্গ সুষম, অমন সুন্দর জন্তুটা হেরে যাবার দুঃখ পাবে! মনে-মনে ভাবলাম, হেরে গেলেও তোর দুঃখ নেই রে, মরে গেলেও তুই গতির প্রতীক হিশেবে বেঁচে থাকবি চিরকাল, এই ডবল-ডেকারও বোধহয় হর্স-পাওয়ার দিয়ে মাপা। ঘোড়াটা তবু জেতার দারুণ চেষ্টায় ছুটছিল। সামনেই ট্রাফিকের লাল আলো, বাস আস্তে-আস্তে থেমে গেল, ঘোড়াটা লাল আলো মানলনা, কী জানি কোচোয়ান থামাবার চেষ্টা করেছিল কিনা, ছুটে এগিয়ে গেল।
এমনসময় ধাক্কা লাগল। ক্রস রোড থেকে আরেকটা ডবল-ডেকার, ঘোড়ার চি-হি-হি-র চেয়েও তীব্র যান্ত্রিক শব্দ উঠেছিল বাসের ব্রেক কষার। আমরা স্পষ্ট দেখলাম দৃশ্যটা। ধাক্কা যেন লাগেইনি প্রায়, শেষমুহূর্তে ব্রেক কষে বাস থামার আগে ল্যান্ডো গাড়িটাকে যেন শুধু আলতোভাবে কোণাকুণি ছুঁয়ে দিল। তাতেই গাড়িটা ঝাঁকানি দিয়ে বেঁকে জোরে পিছিয়ে আসতে লাগল, ঘোড়াকে পিছন দিকে টেনে কোচোয়ান নিচে পড়ে গেছে, ঘোড়াটা অসহায়ভাবে দু-পা তুলে দাঁড়িয়ে পড়েও থামতে পারলনা, পিছিয়ে আসতে-আসতে চিৎ হয়ে পড়ে গেল। ঘোড়া কি জীবনে পিছু হটেছে, অভ্যেস নেই, পড়ে তো যাবেই। যাক, দুর্ঘটনা সামান্য। আমি তৎক্ষণাৎ পথে নেমে এসেছিলাম। কীজন্য ঠিক জানিনা। দেখা গেল একজন মানুষেরও প্রাণ যায়নি, পিছনের লোকটি আগেই লাফিয়ে নেমে গিয়েছিল, কোচোয়ান ওপর থেকে পড়ে গেলেও শুধু মাথা ফেটেছে, রক্তাক্ত মুখ কিন্তু জ্ঞান আছে, সুতরাং প্রাণের ভয় নেই। প্রৌঢ় ও যুবতীটি গাড়ি থেকে নেমে পাশাপাশি চুপ করে দাঁড়িয়ে আছেন, প্রৌঢ়ের একটি হাত থুতনিতে রুমাল চেপে ধরা, যুবতীটি অক্ষত, আগেরই মতো শান্ত। শুধু ঘোড়াটা চিৎ হয়ে ছটফট করছে, ওঠার সাধ্য নেই।
মানুষের যদিও দুটি চোখ, কিন্তু একই সঙ্গে দুচোখে দুপাশের দুটি দৃশ্য দেখা সম্ভব নয়। কিন্তু আমি কী করে দেখেছিলাম জানিনা—একই সঙ্গে আমি ঐ শান্ত যুবতী ও মুমূর্ষু ঘোড়াকে দেখেছিলাম প্রতিমুহূর্ত। এমন একটা কাণ্ডের পরও কী করে অমন অবিচলিত, শান্ত হয়ে ছিল, একটুও ব্যস্ত হয়নি, উত্তেজিত হয়নি—স্থির চোখে মেয়েটি দেখছিল অত বড় জন্তুটার মৃত্যুর ছটফটানি। মেয়েটি এমন কিছু অসাধারণ নয়, সাধারণ সুন্দরী নারী—এমনকী ওর মাথার কাছে সিনেমার পোস্টারে যে নায়িকার মুখচ্ছবি আঁকা ছিল–তার কাছে সৌন্দর্য প্রতিযোগিতায় এ মেয়েটি নিশ্চয়ই হেরে যাবে–তবু অমন কমনীয় গাম্ভীর্য ও পেল কোথায়, কী করে নির্নিমেষে দেখতে পেরেছিল একটা পুরুষ প্রাণীর মৃত্যু? মেয়েটি এমনভাবে দাঁড়িয়েছিল—যেন কলকাতার কোনও পথে আগে সে কখনো দাঁড়িয়ে থাকেনি এতগুলো চোখের সামনে–এবং এরকমভাবে দাঁড়িয়ে থাকা যে ওকে মানায়না–সে-সম্বন্ধে ও পূর্ণ সচেতনা।
আর ঘোড়াটা মহাকাব্যের করুণতম দৃশ্যের সৃষ্টি করেছিল। ঐ বলশালী, বিশাল, জোয়ান অশ্ব চিৎ হয়ে পড়ে প্রাণপণে চেষ্টা করছে উঠে দাঁড়াবার। মুখে বল্লা, চামড়ার ফিতের জটের মধ্যে আটকে থেকে ছিঁড়ে উঠে দাঁড়াবার প্রয়াস, প্রকাণ্ড সাদা পেটটা যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাচ্ছে, বিশাল চোখ ঘুরছে অসহায়, বিহ্বল, প্রবল ত্রাসে। ঘোড়া কোনদিন বসেনা, শোয়না, চিৎ হয়ে পড়া মানে তো নিশ্চিত মৃত্যু। এমনভাবে পা ছুঁড়ছে যে, কারুর সাহস নেই ওকে তুলে দেবার চেষ্টা করে।
হঠাৎ আমার মনে হল, এই যেন কলকাতার শেষ ল্যান্ডো গাড়ির শেষ ঘোড়া অবলুপ্তির আগে আরেকবার শেষ চেষ্টা করছে উঠে দাঁড়াবার। ওর সুদৃশ্য দেহের বলবান পেশীগুলো ফুলে-ফুলে উঠছে চেষ্টায়। পারবেনা, তা তো জানিই, কিন্তু এত পায়-হাঁটা মানুষের ভিড়ের মধ্যে ওর ঐ পতন, মৃত্যুর চেয়েও করুণ। ঘোড়াটার মুখ দিয়ে সাদা গেঁজলা বেরিয়ে শরীর নিথর হয়ে গেল।
একটাও মানুষ মরেনি শুধু নিতান্ত একটা ঘোড়া, এ খবর জেনে নিশ্চিন্ত ভঙ্গিতে ছত্রভঙ্গ হল কৌতূহলী জনতা।