১৪
–কী, অমন চেহারা কেন? ঘোড়ার পিঠে চেপে এলেন নাকি?
—হ্যাঁ, ঘোড়ায় চেপে নাচতে-নাচতে এলাম।
— এই ভরদুপুরে?
—আর জি কর হাসপাতালের পাশের রাস্তা দিয়ে বাসে চেপে এলে সকলকে নাচতেই হবে ভাই। আজ দশ বছর নেচে নেচে অফিসে আসছি।
—তা, রাস্তাটার নাম উদয়শঙ্কর রোড দিয়ে দিন-না।
— দিলাম। আর আমার বাড়ির পাশের রাস্তাটা তাহলে বৈজয়ন্তীমালা লেন! দুজন লোকের এই কথোপকথন আমাকে শুনতে হল। অনেক অপরিচিত লোকের সম্পূর্ণ অনাবশ্যক কথাবার্তা আমরা শুনতে বাধ্য। কারণ, বাস-ট্রামে-ট্রেনে মুখ বুজে যাওয়া আমাদের স্বভাব নয়। একা থাকলে অপরের কথা না শুনে উপায় নেই। কার পিসশাশুড়ির গেঁটে বাত হয়েছে, কিংবা কার ন কাকিমার আপন ছেলে—না, না— আপন ন কাকিমার ছেলে বিলেত থেকে ফিরেছে কিংবা মন্দিরা নাম্নী কোন্ বালিকা অধ্যাপকের দিকে তাকিয়ে হেসেছে— এইসব শুনে যাই, যতক্ষণ না আমার সঙ্গে কোন বন্ধু জোটে। তখন আমরাই আবার সরবে ঐরকম কোন কথা শুরু করি।
তবে, একটা জিনিশ লক্ষ করেছি, সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত চেহারার লোকদের কাছ থেকে মাঝে-মাঝে দু-একটা চমৎকার রসিকতা শোনা যায়। দেশের অবস্থা যখন খুব বেশি খারাপ, নানান অনটন–রসিকতার মাত্রা তখন বেড়ে যায়। রাগারাগির বদলে হাসাহাসিতেই বাঙালিরা বেশি পারংগম বোধহয়। মাস দুয়েক আগে, বাসে এক ভদ্রলোককে বলতে শুনেছিলাম—তিনি তখনো সর্ষের তেল খান নিজেই সর্ষের ফুল থেকে বানিয়ে। কিন্তু অত সর্ষের ফুলই বা পাচ্ছেন কোথায়? নিজের দুচোখ থেকে। উচ্চাঙ্গের রসিকতা নয়, কিন্তু বলার ভঙ্গি!
ঐরকম ভাবেই এক ডাক্তারের গল্প শুনেছি। ডাক্তারের এক রোগী এসেছে, তার বিষম মাথাধরার অসুখ। কিছুতেই সারছেনা। অনেক চিকিৎসা করা হল। শেষে ডাক্তার বললেন, ‘আপনার ব্রেনটা খুলে রেখে যান, ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করে দেখি।’ রোগী ভদ্রলোকের মাথা থেকে সবটুকু ব্রেন খুলে একটা কাচের বাসনে রাখা হল, ডাক্তার তাকে বললেন এক মাস বাদে আসতে। তারপর এক মাস যায়, দুমাস যায় রোগী আর আসেনা ডাক্তারের কাছে। ডাক্তার নিজেই পড়লেন মহা চিন্তায়। লোকটার হল কী? মরেই গেল, না কী হল? আর যদি বেঁচে থাকে, ‘তবে ব্রেন ছাড়া কাজকর্ম করছে কী করে? অথচ লোকটার কোন সন্ধান নেই। অনেকদিন বাদে ডালহাউসি স্কোয়ারে লোকটিকে দেখতে পেলেন ডাক্তার। গাড়ি থামিয়ে ডাকাডাকি শুরু করে দিলেন, ‘ও মশাই, শুনছেন, শুনছেন! — কাছে এসে ভাবলেশহীন মুখে লোকটি বলল, ‘কী ব্যাপার?’
—আচ্ছা লোক তো আপনি, আর এলেননা? আপনার ব্রেন যে আমার কাছে রয়ে গেছে!
–থাক্। ওটা আর আমার দরকার নেই। আমি সরকারি অফিসে চাকরি পেয়ে গেছি।
ওড্হাউসের অনুকরণ, তাতেও ক্ষতি নেই। দুজন লেখক একদিন আমাকে বলেছিলেন, পৃথিবীতে সব রসিকতা শেষ হয়ে গেছে, খাঁটি নতুন রসিকতা নাকি হবার আর উপায় নেই। আমিও একটি বিদেশী প্রবন্ধে পড়েছিলাম, পৃথিবীতে সত্যিকারের নতুন কোন ‘গল্প’ আর বানানো সম্ভব নয়। এগারো রকমের বেশি প্লট হতে পারেনা। এখন শুধু পরিবেশ নতুন হবে। সেইজন্যেই হয়তো পুরোনো রসিকতায় আর একটি লোককে নতুন করে খুশি হতে দেখলাম। সম্প্রতি বাসের ভাড়া বাড়ায় তিনি দুঃখিত হননি। মহা খুশি হয়ে বন্ধুকে বলছেন, ‘আমার ভাই ভালোই হল, আগে হেঁটে অফিসে যাওয়া-আসা করে চব্বিশ নয়া পয়সা বাঁচাতাম, এখন হেঁটে গেলে বাঁচবে তিরিশ পয়সা। বাস ভাড়া আরও বাড়লে আমার ব্যাঙ্কে বহু টাকা জমবে।’
আর-একটি সুন্দর কথা শুনেছিলাম এক বৃদ্ধের মুখে। হাতে একটি দেড় কিলো রুইমাছ ও কয়েকটি নধর ফুলকপি। একজন জিজ্ঞেস করল, ‘কী গণেশ-দা, এই বাজারে অত বড় মাছ? বাড়িতে মচ্ছব নাকি?’ ‘না ভাই, বুড়ো হলাম, ছেলেটাকে চাকরিতে ঢোকাতে হবে তো! এখন থেকে সাহেবকে নিজের গাছের রুইমাছ আর পুকুরের ফুলকপি না দিলে চলবে কী করে?’
আর চিড়িয়াখানায় সেই লোকটির চাকরি করার গল্প? কে না জানে ঐ গল্প। একদিন ট্রামে বসে একজন লোককে ঐ গল্পটিই বলতে শুনে এমন বিরক্ত হচ্ছিলাম। সবচেয়ে খারাপ লাগে জানা-রসিকতা অপরের মুখে শুনতে? নিজে বার-বার বলতে খুব খারাপ লাগেনা যদিও। কিন্তু গল্পটার শেষ শুনে বুঝলাম, বক্তা একজন সত্যিকারের শিল্পী। পাঠক, ধৈর্য ধরে আর-একবার শুনুন। বক্তা অবশ্য কানাই নামে তার কোন-এক চেনা লোকের নামে গল্পটা চালাচ্ছিলেন। অর্থাৎ কানাই এম. এ. পাশ করেও কোন চাকরি পাচ্ছিলনা। তারপর, তার এক মুরুব্বি তাকে চিড়িয়াখানায় ঢুকিয়ে দিল। চিড়িয়াখানার শিম্পাঞ্জিটা মরে গেছে, তার খাঁচায় শিম্পাঞ্জির ছাল পরে কানাইকে থাকতে হবে। কয়েকদিন বেশ মনোযোগ দিয়ে কাজ করেও কানাই ওপরওলার মন পেলনা। (নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী যে বিষণ্ণ শিম্পাঞ্জিকে নিয়ে কবিতা লিখেছেন— তা বোধহয় ঐ ছদ্মবেশী কানাইকে দেখেই) ওপরওলা এসে ধমকে কানাইকে বললেন, এরকম মানুষের মতো চুপ করে বসে থাকলে তার চাকরি যাবে। সুতরাং তারপর থেকে দর্শক এলেই নেচে—কুঁদে কানাই খুব খেলা দেখাতে লাগল। তার ধরে ঝুলে ডিগবাজি খেয়ে তার কসরত হল দেখবার মতো। শেষে একদিন দর্শকদের মধ্যে দেখতে পেল ওর কলেজের সহপাঠিনী অরুণা সান্যালকে। কোনদিন অরুণার মন পায়নি কানাই। আজ তাকে খুশি করার জন্য শিম্পাঞ্জি-বেশী কানাই মহা লম্ফঝম্প জুড়ে দিল! তারপর একবার হঠাৎ ঝোঁকের মাথায় গিয়ে পড়ল পাশের খাঁচায়। সে খাঁচাটা বাঘের। বাঘ খাঁটি হালুম গর্জন করে এক লাফে এসে পড়ল ভয়ে আধ-মরা কানাইয়ের কাছে। তক্ষুনি তাকে না খেয়ে ভালো করে শুঁকে দেখতে লাগল। তারপর কানাইয়ের কানের কাছে মুখ এনে বাঘ বলল, ‘ভয় নেই দাদা, আমিও বাংলার. এম.এ.!’