বিশেষ দ্রষ্টব্য – ১৩

১৩

আবদুল সকালবেলা এসে বলল, ‘আপনার কাছে বিদায় নিতে এলাম, আবার কবে দেখা হয় না-হয়।’

আবদুলের মতো এমন চমৎকার ছেলে আমি খুব কম দেখেছি। সেই দুর্লভ ধরনের মানুষ যারা হাসতে-হাসতে দুঃখের কথা বলতে পারে। আমার চেয়ে বয়েসে বেশ ছোট, এবার বি.এ. পরীক্ষা দেবে, পড়াশুনোয় খুব ভালো, এরইমধ্যে ইংরিজি খবরের কাগজে চিঠি লেখা শুরু করেছে। দেখতে সুন্দর নয় আবদুলকে — মুখের গড়ন খানিকটা চৌকো ধরনের, অস্পষ্ট চামড়ার রং, সীমাবদ্ধ চোখ, তাছাড়া সেলুনে কায়দার চুলের ছাঁট দিতে শেখেনি একেবারে ভিড়ের মধ্যে মিশে যাবার মতো চেহারা। কিন্তু মুখে এমন একটা ঝলমলে কৌতুক লেগে থাকে সবসময় যে, ওর মুখের দিকে তাকালেই দর্শকের মুখেও একটা প্রসন্নতা আসতে বাধ্য। চব্বিশপরগনার একটা গ্রাম থেকে কলকাতায় এসেছে লেখাপড়া করতে–ওদের আত্মীয়-পরিজনের মধ্যে কেউ কোনদিন ইস্কুল-মাদ্রাসা পার হয়নি, আবদুলই প্রথম এসেছে বিশ্ববিদ্যালয়ে, ওর বাবা এখনো চাষের কাজ করে। বাড়ি থেকে পয়সাকড়ি দেবার সামর্থ্য নেই—কলকাতায় থাকে এখানে-সেখানে, কোন চাল-চুলো নেই—ডিস্ট্রিক্ট স্কলারশিপ পায় ১৫ টাকা—সেটা মূলধন করে সারা মাস মাথা খাটিয়ে চালিয়ে দেয় অর্থাৎ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্পের চরিত্রের মতো গাঁয়ের ছেলে শহরে এসে খেয়ে না-খেয়ে লেখাপড়া শেখার জন্য প্রাণপণ করেছে। কোনদিন হয়তো, ও আমাকে এসে বলল, ‘আপনি পান খান, নীলুদা?

—মাঝে-মাঝে দু-একটা। কেন বলো তো?

–কাল একটা অদ্ভুত জিনিশ আবিষ্কার করলাম। কাল রাত্রে পকেটে দশ নয়াপয়সা ছিল তো, ভাবছিলাম কী করি, কী করি। ক্ষিদে লেগেছিল চার পয়সার ছাতু খেলাম, বুঝলেন। মুখটা একটু বিশ্রি-বিশ্রি লাগছিল তারপর, তাই চার নয়া দিয়ে একটা মিঠে পান খেলাম। তখন জানেন, ভারি আশ্চর্য, বোধহয় পানের সঙ্গে ছাতুর একটা কেমিক্যাল রি-অ্যাকশান হয়, পেট ভরে গেল—আর মনটাও খুব ভালো হয়ে গেল—কীরকম যেন ফুরফুরে লাগতে লাগল—ভাবলাম উড়তে উড়তে বাড়ি যাই। আপনি একদিন ছাতুর সঙ্গে পান খেয়ে দেখবেন?

আবদুলের সঙ্গে কথাবার্তা আমাকে একটু সাবধানে বলতে হয়। ওর সরলতার কাছে প্রতিমুহূর্তে আমার অপমানিত হবার ভয় থাকে। গতকাল রাত্রে যে শেষ দশ নয়াপয়সা নিয়ে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা করেছে আজ সে কোন্ মহাশূন্য নিয়ে গবেষণা করবে–সে-সম্পর্কে আমার প্রশ্ন করা চলবেনা। প্রত্যেকের জীবন তার নিজের–তবু আমরা অপরের জীবন নিয়ে কথা বলার জন্য আকুলি-বিকুলি করি।

আমিও আবদুলকে সৎপথে আনার জন্য কিছু-কিছু চেষ্টা করেছি। গ্রামের ছেলে, আগে বিড়ি-সিগারেট খেতনা, আমিই সিগারেট ধরিয়েছি—এখন, এই মাস-দুয়েকের মধ্যেই ছাই ঝাড়ার সময় দিব্যি আঙুলে টুকি আওয়াজ করতে শিখে গেছে। টিউশানি করতে গিয়ে কী কী উপায়ে পড়ানো ফাঁকি দিতে হয়, সে-সম্পর্কেও উপদেশ দিয়েছি ওকে। ট্রামে-বাসে ভাড়া না-দেবার আমার নিজস্ব পদ্ধতিগুলি শুনে-শুনেও ও এখনো ঠিকমতো রপ্ত করতে পারেনি যদিও। এছাড়া, আর-একটি কথা আমি ওকে প্রায়ই বলে থাকি, ‘পড়াশুনো ছেড়ে দাও আবদুল, পড়াশুনো করে কী হবে?’ এর উত্তরে ও একটা বেয়াড়া ধরনের প্রশ্ন করে, ‘পড়াশুনো না-করে কী হবে, সেটা আগে বলুন!’ পড়াশুনো ছেড়ে গ্রামে ফিরে গিয়ে বাবার সঙ্গে মিলে চাষবাস করা অনেক ভালো –সেটা ও কিছুতে বুঝবেনা। অর্থাৎ একাকীত্ব, মুক্তি, আত্মপ্রকাশ ইত্যাদি কয়েকটা আধুনিক সাহিত্যের অসুখ ওর মধ্যে ঢুকে গেছে। ও এখন নাগরিক জীবন চায়।

অনেকদিন আবদুলের সঙ্গে দেখা হয়নি। হঠাৎ এসে ও বিদায় নেবার কথা বলতে একটু আবাক হলাম। জিজ্ঞেস করলাম, ‘গ্রামে ফিরে যাচ্ছ নাকি?’

—না, বিদেশে। পাকিস্তানে। ঢাকা যাব।

— বেড়াতে? কবে ফিরবে?

—আর ফিরব না। ওখানেই থেকে যাব।

আমি, হঠাৎ চুপ করে গেলাম। বুঝলাম, নিশ্চয়ই একটা-কিছু গুরুতর ঘটেছে! সামান্য কারণে আবদুলের মতো ছেলে বিমর্ষ হয়না। আবদুল কিন্তু পরমুহূর্তেই হেসে উঠে বলল, ‘কী, জিজ্ঞেস করলেননা, কেন যাচ্ছি?’

বললাম, ‘তুমিই বলো-না।

—একা-একা থাকি। আজকাল বড় মন খারাপ লাগে।

–ঢাকায় কোন মেয়ের সঙ্গে প্রেম হয়েছে বুঝি?

—প্রেম তো এখানেই একটা মেয়ের সঙ্গে হয়েছিল, মুসলমান বলে পাত্তা দিলনা। না, ইয়ার্কি নয়, নীলুদা আজকাল টাকা-পয়সা একদম কুলিয়ে উঠতে পারছিনা। তাছাড়া সবসময় একটা অস্বস্তি।

—অস্বস্তি?

—কী জানেন, কাগজে টিউশনির বিজ্ঞাপন দেখে-দেখে হয়তো গেলাম সব কথাবার্তা হল, যেই নাম জিজ্ঞেস করল, অমনি হেসে ফেলল আবদুল — লোকগুলো এমন মজার, চট করে মিথ্যে কথাও বানাতে পারেনা। বলে, ‘এখন টাকার টানাটানি কয়েকমাস মাস্টার রাখব না এখন!’ আসলে সব ঠিক হবার পর আমি মুসলমান শুনেই যে এমন মজার মুখ করে লোকেরা …

–অনেক মুসলমানও তো বাড়িতে প্রাইভেট টিউটর রাখে, সেখানে যাওনা কেন?

—আমি মুসলমান বলেই কেন মুসলমানের কাছে যাব? আমি মানুষ, যে—কোন মানুষের কাছে যাব।

–অত আদর্শ রাখলে চলেনা আবদুল। বেঁচে থাকা হচ্ছে সবচেয়ে বড় কথা। মুসলমানের কাছে গেলে যদি চাকরি পাও সেখানেই যাবে!

—তাও গিয়েছিলাম। কিন্তু জানেন তো, এদেশে মধ্যবিত্ত মুসলমান নেই। বুদ্ধিজীবী মধ্যবিত্ত শ্রেণী আছে হিন্দুদের মধ্যেই। আর বড়লোক মুসলমানেরা এক অদ্ভুত চীজ। সত্যি বলছি। তারা থাকে সাহেবী কায়দায় তারা চায় প্যান্টকোট—পরা ইংরেজি-বলা মাস্টার তা হিন্দু মুসলমান অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান যাই হোক—না। আমার মতো ইস্তিরি না-করা জামা, ময়লা ধুতি পরা মাস্টার চায়না। অথচ আমি কি ইংরিজি খারাপ জানি?

—বড়লোক হিন্দুরাও তাই। দুনিয়ার এমন-কোন বড়লোক নেই, যে নিজের বাড়িতে ময়লা জামাকাপড়-পরা মাস্টার রাখতে চায়।

আবদুল সরল হেসে বলল, ‘কী মুশকিল, টাকা না পেলে প্যান্টকোট কিনব কী দিয়ে?’ ওর বলার ভঙ্গিতে আমাকেও হেসে উঠতে হল।

–একজন দোকানদারের কাছে গিয়েছিলাম— খাওয়া-থাকার বদলে দোকানের হিশেবপত্র রাখতে হবে। লোকটা সব ঠিক করার পর আমি মুসলমান শুনে বললে কী জানেন? বললে, ভাই তোমাকে না নেবার কোন যুক্তিই নেই কিন্তু তবু নিতে পারছিনা। মাপ করো ভাই। লোকটার কাচুমাচু মুখ দেখে এমন মায়া হল আমার সত্যি খুব ভালো লোকটা, কিন্তু সংস্কারের কাছে অসহায়। আবার দু-একজন চোখ রাঙায়ও বটে, স্পষ্ট অপমান করে কিন্তু তাতেও কিছু মনে করিনা। ও তো স্বাভাবিক। মানুষ তো আর একরকম হয়না। এখন কারুর কাছে যেতেই লজ্জা হয়। নিজের নাম বলতে যদি লজ্জা হয় তার চেয়ে খারাপ কিছু আছে? সেইজন্য জানেন, সবসময় একটা অস্বস্তি লাগে, কীরকম কষ্ট হয়, বুকের মধ্যে যেন ফোঁটা-ফোঁটা রক্ত পড়ছে অনবরত। নিজেকে খুব একা মনে হয়।

আমি চুপ করে ভাবতে লাগলাম, আবদুল কি একাই এরকম পরিস্থিতিতে পড়েছে না ওর মতো সব মুসলমান ছেলেদেরই এ-অবস্থা? কী জানি! এমনও হতে পারে, আবদুলের একাকীত্ববোধের সঙ্গে ধর্মভেদের কোন সম্পর্ক নেই। কাফকা কিংবা কামুর লেখাটেখা পড়েই বোধহয় এসব মাথায় ঢুকেছে! হয়তো এসব সাহিত্যের অসুখ। কিন্তু অস্বস্তির কারণ যখন ও নিজেই বার করেছে তখন সেইটাই সত্য। অন্য কোন ধারণা কি ওকে কোন সাহায্য করতে পারবে? কিন্তু ঢাকায় গেলেই ওর এই ভাব সেরে যাবে ও কী করে ভাবল?– সে কথা ওকে জিজ্ঞেস করলাম।

—জানিনা ওখানে গেলেই কেটে যাবে কিনা। তবু দেখা যাক্। জানেন, এখানে তো আমার কোন বন্ধুও নেই। কলেজে একটা ছেলের সঙ্গে খুব বন্ধুত্ব হল— বনেদি ব্রাহ্মণবংশের ছেলে অনেক কিছু জানে, অনেক আলোচনা করতাম দুজনে। ছেলেটাকে মনে হত সত্যিকারের উদার। ওর সঙ্গে কথা বলে আনন্দ পেতাম। একদিন বিকেলে একটু একা-একা লাগছে, ওর বাড়িতে গেলাম। ছেলেটা এমন তিনতলা জানলা থেকে উঁকি মেরে বলল, খুব ব্যস্ত, দেখা করতে পারবে না। আচ্ছা দেখুন তো কী বোকা আমার কী ক্ষতি হল ওকেই তো নিজের সঙ্গে জোচ্চুরি করতে হল! আর-একটা ছেলে বাড়িতে ডেকে নিয়ে গিয়ে খুব আদরযত্ন করে খাওয়ায় মাঝে-মাঝে খাতিরের ঠেলায় আমি ব্যতিব্যস্ত—পাড়ার লোককে ডেকে-ডেকে পরিচয় করিয়ে দেয় যে, আমি মুসলমান। ব্যাপারটা কী বুঝতে পারলেন তো? আমি ঠিক বুঝে নিয়েছি—মহত্ত্ব দেখানো। তারপর আর আমি যাইনা, কেন যাব বলুন!

আবদুলের কথা বলার বিশেষ গুণ এই যে কোন বিদ্রূপ বা দুঃখের চিহ্নমাত্র নেই। কথার ঝোঁকে কথা বলে যায়।

–জানেন নীলুদা, মুসলমানরা আরও খারাপ। আমি তো অনেক চাষাভুষো গরিব লোকের সঙ্গে মিশে দেখেছি! গরিব হিন্দুদের মধ্যে সাধারণত মুসলমানদের সম্পর্কে কোন রাগ বা এড়িয়ে যাবার ভাব নেই। কিন্তু মুসলমানদের মধ্যে আছে। আমি তো মুসলমানদের বস্তিতে থাকি। দেখেছি হিন্দুদের ওপর সবসময়েই একটা রাগ আর হিংসে নিয়ে কথা বলে। খুব খারাপ!

–স্বাভাবিক এটাও। ওরা এদেশে সংখ্যালঘু—তাই হয়তো ভাবতে পারে ওদের ওপর অবিচার করা হচ্ছে।

—শুধু তাই না, কুসংস্কারও বেশি। শিক্ষিত ছেলেদের মধ্যেও আছে। আমি কয়েকটা মুসলমান ছেলের মেসে বসে রবীন্দ্রনাথের ব্রহ্মসঙ্গীত গাইছিলাম ওরা কী বলল জানেন? আমি হিন্দুর গান গাইছি!

–আমি এরকম কথা কখনো শুনিনি! এটা তোমার বাজে কথা। আমি অনেক মুসলমান ছেলেকে জানি যারা রবীন্দ্রসঙ্গীত বলতে পাগল!

—আপনারা একটা ছোট গণ্ডির মধ্যে থাকেন তার বাইরে একটা বিরাট বাংলা দেশ আছে। আমি অনেক মুসলমানকে বলতে শুনছি যে রবীন্দ্রনাথ বা জীবনানন্দ দাশ হিন্দু সাহিত্য লিখেছেন—। কিন্তু কোন হিন্দু কি কখনো বলে, নজরুল ইসলাম বা মুজতবা আলী ইসলামি সাহিত্য লিখেছেন? কখনো বলে না! আমাদের মধ্যে এরকম কুসংস্কার বেশি আছে।

–বলুক-না, তাতে কী ক্ষতি হয়েছে? তোমার তা নিয়ে অত মাথা ঘামাবার কী দরকার?

–আপনি আমাকে খুশি করার জন্য সত্যি কথাটা এড়িয়ে যেতে চাইছেন!

আমি হঠাৎ অত্যন্ত চটে গিয়ে বললাম, ‘বাজে বোকো না! তুমিও আমাকে খুশি করার চেষ্টায় মুসলমানদের নিন্দে করতে শুরু করেছ।’ আবদুল চটপট উত্তর দিল, ‘আপনি একথাটা রাগের মাথায় না ভেবে বললেন!

আমি একটু অনুতপ্ত হয়ে চুপ করে রইলাম। তারপর বললাম, ‘আবদুল, আমার বন্ধুদের মধ্যে কেউ হিন্দু কেউ মুসলমান কিন্তু কখনো তা মনেও পড়েনা। তুমি আজ সকালে এসে হঠাৎ এসব প্রসঙ্গ তুললে কেন? আমি কি জানিনা, দেশে এ-সমস্যা আছে? থাকবেই। দুই জাত বা দুই ধর্ম বা দুরকম গায়ের রঙ —যে-কোনো একটা হলেই হল …এরকম মানুষ কোথাও শান্তিতে পাশাপাশি থাকতে পারেনা। ঝগড়া-মারামারির জন্য মানুষের একটা তো খেলনা চাই। তুমি আমি পাশাপাশি বসে থাকলে যুক্তিতর্ক মেনে কত কথা হবে। কিন্তু যেই দুপাশে দুটি জনতা, বা দুটো দেশ—অমনি আর কোন যুক্তি টিকবেনা। এসব নিয়ে আর ভাবতে চাইনা কারণ জানি তোমার বা আমার ইচ্ছে-অনুসারে কিছুরই বদল হবেনা। আজ গোটা পৃথিবীতে সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের ইচ্ছে-অনুযায়ী, কোন দেশেরই রাজনীতি চলছেনা।

—রাজনীতি ছেড়ে দিন, সাধারণ মানুষ?

— সেখানেও ঐ সংখ্যালঘু সংখ্যাগুরুরা এই দুই দলে রেশারেশি, অবিশ্বাস, ঘৃণা থাকবেই। সংখ্যালঘুরা সবসময়ে মনে করবেই তারা নির্যাতিত, সত্যিকারের নির্যাতিত হোক বা না-হোক। এদেশে মুসলমানরা, পাকিস্তানে হিন্দুরা, আমেরিকায় নিগ্রোরা, সাইপ্রাসে তুর্কিরা, ইউরোপে ইহুদিরা। আচ্ছা, ওটা ভুলে যাও। মনে করো কবি আর অকবি—এই দু-দল। সারা পৃথিবীতেই কবিরা সংখ্যালঘু, অকবিদের কাছে নির্যাতিত। কবি শুনলে প্রেমিকার বাবা বাড়ি থেকে দূর করে দেয়, অপিসে চাকরি হয়না, বইয়ের দোকানে মুখ বাঁকায়, মাছওলা ঠকায়, রাস্তায় পুলিশে তাড়া করে, বাড়িওলা বাড়ি ভাড়া দেয়না—

আবদুল হেসে বলল, ‘আপনি কথাটা অন্যদিকে নিয়ে যাচ্ছেন।’ তারপর ছেলেমানুষের মতো উত্তেজিত হয়ে আবদুল বলল, ‘আমি লোককে বোঝাতে চাই। কেন মানুষে-মানুষে এমন তফাত হবে ধর্মের জন্য? আমি এখানে পারলামনা, হেরে গেলাম। ঠিক করেছি, পাকিস্তানে গিয়ে মুসলমানদের বোঝাব। মুসলমানরা বেশি পেছিয়ে আছে আমি ওদের বোঝাব—পাকিস্তানে আমার বেশি স্বাধীনতা থাকবে।

—স্বাধীনতা কথাটা কত ছোট!

—কেন?

–তুমি মুসলমান বলে শুধু মুসলমানদের বলতে পারবে—তারা ভুল করছে। হিন্দুদের পারবেনা! আমি দৈবাৎ হিন্দুর ঘরে জন্মেছি–এখন আমি যদি বলতে যাই, মুসলমানদের বোরখা-পরা কিংবা পর্দা-প্রথা খারাপ কিংবা বাঙালি মুসলমানদের নাম কেন বাংলাভাষায় রাখা হয়না, অমনি বলা হবে আমি অনধিকার চর্চা করছি। আমাকে ওরা মারতে আসবে। তুমি যদি আবার বল, হিন্দুদের বিয়ের সময় মেয়েদেখানো প্রথা কিংবা বিধবাদের ঝিয়ের মতো খাটানো, কিংবা জাতিভেদ-প্রথা খারাপ–তবে তোমার নিস্তার নেই। তাও তো এ-সব সামাজিক প্রথা, ধর্ম নিয়ে তো কথাই বলা যাবেনা। আমি হিন্দুধর্ম সম্পর্কে গুষ্টির পিণ্ডি করে যা-খুশি বলতে পারি, কিন্তু ইসলামের নিন্দে করতে পারবনা। আবার, তুমি ইসলামের দোষত্রুটি দেখাতে পারো, কিন্তু একবার হিন্দুদের মূর্তি-পূজা নিয়ে কথা বলে দেখ দেখি! এর নাম স্বাধীনতা, আবদুল?

—তা হোক! তবু আমাদের যতটা সাধ্য চেষ্টা করা উচিত।

একটুক্ষণ চুপ করে রইলাম, দুজনেই। তারপর আবদুল গাঢ়স্বরে বলল, ‘চলে যাচ্ছি, আর আপনাদের সঙ্গে কখনো দেখা হবে কিনা, কী জানি। মনটা খারাপ লাগছে।’

বললাম, ‘চলো, তোমাকে এগিয়ে দিয়ে আসি।’

সিঁড়ি দিয়ে নামবার সময় যতদূর সম্ভব চেষ্টা করলাম আবদুলকে অন্যমনস্ক করে দেবার, তবু ওর চোখ পড়ে গেল। আমাদের ফ্ল্যাটবাড়ির সিঁড়ির তলায় অন্ধকার জায়গায় একটি পরিবার এসে আশ্রয় নিয়েছে–সেদিকে তাকিয়ে ও জিজ্ঞেস করল, ‘এরা কারা? আগে তো দেখিনি।’

বললাম, ‘কী জানি, চলো তাড়াতাড়ি, বাস এসে গেছে।’

—ইস্, সিঁড়ির নিচের ঐটুকু জায়গায়, এখানেও ভাড়াটে নাকি?

–জানিনা, চলো চলো।

–বাঃ, এক বাড়িতে আছেন, জানেননা।

–কী জানি লক্ষ করিনি। চলো, আমার একটু তাড়া আছে।

ততক্ষণে আমরা বাড়ির বাইরে এসেছি। আবদুল হঠাৎ থেমে গিয়ে বলল, ‘আপনি যেন কিছু লুকোচ্ছেন!

নিজের লজ্জার কথা বলব কী করে? ওরা আমার পিসীমা আর তাঁর ছেলেমেয়ে। নিজের ঘরে জায়গা দিতে পারিনি, সিঁড়ির তলায় আছেন– একথা কি আর সকলকে বলা যায়?

—নীলুদা, আমি দূরে চলে যাচ্ছি শুনে অমনিই আপনি আমাকে পর-পর মনে করছেন। ওরা কোথা থেকে এসেছেন?

—পাকিস্তান থেকে! কিন্তু, আবদুল, তুমি পাকিস্তান চলে যাচ্ছ– সেই সময়ই পাকিস্তান থেকে একটা হিন্দু পরিবারের চলে আসা নিয়ে আলোচনা করা অত্যন্ত ভালগার। আমি চাইনা। এরকম তো চলছে, জানই। সে নিয়ে আর কথা বলে কী হবে?

আবদুলের মুখ মুহূর্তে বিষণ্ন হয়ে গেল। ওখানে দাঁড়িয়ে থেকেই বলল, ‘ওঁরা কেন চলে এলেন? আবার কি কোন গণ্ডগোল শুরু হয়েছে?

–না।

—আপনি সত্যি কথা বলুন।

—সত্যিই বলছি। আমি বারবার ওদের জিজ্ঞেস করেছি—কোন দাঙ্গা হয়েছে কিনা, কেউ ভয় দেখিয়েছে কিনা–নইলে এতকাল পর কেন চলে এলেন। কিছুই হয়নি। এমনিই। দাঙ্গা হয় সাধারণত শহর-অঞ্চলে। ওঁরা এসেছেন ফরিদপুরের একটা গ্রাম থেকে–সেখানে আমিও জন্মেছি–সেখানে এপর্যন্ত কোনদিন দাঙ্গা হয়নি।

—এমনি কেউ আসেনা। কেন চলে এলেন তবে?

—তুমিও তো এমনিই যাচ্ছ। অস্বস্তি! পিসেমশাই বুড়ো হয়েছেন– ওঁর বড় ছেলেটা মারা গেছে–মুসলমানদের হাতে নয়, কলেরায়। তবু, দেশের জমিজায়গায় দিন চলে যেত। কিন্তু পিসীমার এক মেয়ে বড় হয়েছ–তার জন্যেই এখানে চলে আসা। কয়েকটা ছোকরা নাকি দিনরাত ঘুরঘুর করত, উড়ো চিঠি দিয়েছে, রাত্তিরবেলা মেয়েকে চুরি করে নিয়ে যাবে বলে শাসিয়েছে। কী এমন অস্বাভাবিক এটা? ওঁরা কি জানেননা যে, সোমখ মেয়েদের পিছনে ছোকরাদের ঘোরাঘুরি এখানেও বেশি ছাড়া কম নয়? তাছাড়া, এই শহরতলি—অঞ্চলের ছোকরারা উড়ো চিঠি না-দিয়ে এমনিতেই মেয়েদের ছিনিয়ে নিয়ে যায়। তবে, এখানে এসে কী লাভ হল, এখানে খাবার সংস্থান নেই, তবু কেন এলেন? কারণ কী জান, সন্দেহ আর অবিশ্বাস। আসবার সময়, গ্রামের অনেক মুসলমান নাকি বলেছে, যাবেননা, আপনারা গ্রামের শেষ ব্রাহ্মণ, আপনারা যাবেননা। তবু কেন এসেছেন? সেই সংখ্যালঘু হবার অপমানবোধ। ভেবেছে দিনদুপুরে মেয়ের হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলেও গ্রামের একটা লোকও তখন প্রতিবাদ করবেনা। সন্দেহ আর অবিশ্বাস! তুমি যাকে আধুনিক ভাষায় বললে, অস্বস্তি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *