বিশুর কান্ড

বিশুর কান্ড

খুব ছেলেবেলায় আমরা একবার নরসিংহপুর বলে একটা জায়গায় বেড়াতে গিয়েছিলাম। জায়গাটা খুব দূরে নয়, কলকাতা থেকে গাড়ি করেই যাওয়া যায়, কিন্তু ভীষণ গ্রাম গ্রাম মতন। গাড়ি থেকে নেমে পায়ে হেঁটে যেতে হয় দু-মাইল, সেই রাস্তাটা এত সরু যে সেখান দিয়ে গোরুর গাড়িও চলে না। রাস্তার দু-পাশে কত রকম গাছপালা, খুব সবুজ, আর সেখানে কী সুন্দর গন্ধ পাওয়া যায়। এরকম গন্ধ আমরা কলকাতায় পাই না। মাঝে মাঝে বাঁশ- ঝোপ আর তাতে কঁ-ড়-ড়-ড় কঁ-ড়-ড়-ড় শব্দ।

সেই জঙ্গল পেরিয়ে খানিকটা ফাঁকা জায়গা, সেখানে আমাদের বড়ো মামার বাড়ি। বড়ো মামা আমাদের নেমন্তন্ন করেছিলেন। বড়ো মামার দোতলা বাড়ির পাশেই তিনটে বড়ো বড়ো ধানের গোলা, আর একটু দূরেই মস্ত বড়ো একটা পুকুর। সেই পুকুরের ওপাশে জঙ্গল। সন্ধেবেলা সেখানে শেয়াল ডাকে।

দু-দিন পরেই রাত্তিরবেলা সেই জঙ্গলের মধ্যে একটা বিকট শব্দ শোনা গেল। তখন আমরা খেতে বসেছি। ওখানে তো ইলেকট্রিকের আলো নেই, হ্যারিকেন, তাতে একটুখানি জায়গা মোটে আলো হয়, দরজার বাইরেই ঘুটঘুটে অন্ধকার। খেতে বসে আমরা সবাই গল্প করছি, এমন সময় সেই বিকট শব্দটা উঠল। শব্দটা এমনই বিচ্ছিরি আর এত জোরে যে আমরা সবাই চমকে উঠলাম। বাবা ঠিক সেই সময় মাছের মুড়ো চিবুচ্ছিলেন। চমকে ওঠার জন্য তাঁর গলায় কাঁটা ফুটে গেল।

মা বলল ওমা ওটা কী ডেকে উঠল?

বড়ো মামা ভুরু কুঁচকে বসে আছেন। বাবা কথা বলতে পারছেন না, শুধু মুখ দিয়ে আঁ আঁ করে শব্দ করলেন। বাবার গলায় যে কাঁটা ফুটে গেছে, সেটা অন্য কেউ লক্ষই করল না, কেননা, পুকুরের ধার থেকে আবার সেই রকম শব্দ উঠল।

মা ভয়ে চোখ বড়ো বড়ো করে বলল, ওমা, বাঘ ডাকছে নাকি?

বড়ো মামা বললেন, বাঘ? বাঘ এখানে কোথা থেকে আসবে! নিশ্চয় বিশুর কান্ড। বিশু! এই বিশু!

বিশু বড়ো মামার বড়ো ছেলে। আমার চেয়ে তিন-চার বছরের বড়ো। তখন ক্লাস সেভেন পড়ে। ভীষণ দুরন্ত। সন্ধেবেলা পুকুরে সাঁতার কেটে তার একটু জ্বর মতন হয়েছে বলে সে দুধ-মুড়ি খেয়ে শুয়ে পড়েছে।

বড়ো মামিমা বললেন, দেখেছ, এই জ্বর-গা নিয়ে ছেলেটা আবার রাত্তিরবেলা বেরিয়েছে! নিশ্চয়ই কোনো হাঁড়ির মধ্যে মুখ দিয়ে ওরকম শব্দ বার করে আমাদের ভয় দেখাচ্ছে।

বাবা আবার বললেন, আঁ আঁ!

কিন্তু আমরা বাবার কথার মানে কিছুই বুঝতে পারলাম না।

বড়ো মামা বিশুকে ডাকতে ঘরের বাইরে গেলেন, অমনি বারান্দা থেকে বিশু সাড়া দিল। পুকুরধার থেকে এত তাড়াতাড়ি তো সে চলে আসতে পারবে না!

ততক্ষণে বাবার গলা থেকে কাঁটা বেরিয়ে গেছে। বাবা বললেন, আমি তখন থেকে বলছি, ওটা বাঘ।

মা বলল, কই, তুমি আগে কিছু বলোনি তো!

অমনি আবার সেই শব্দটা শোনা গেল।

মা আর বড়ো মামিমা ভয়ে মাটিতে শুয়ে পড়লেন, আমার বুক একবারে কেঁপে উঠল। কার যেন পায়ের ধাক্কা লেগে উলটে গেল হ্যারিকেনটা। সবাই একসঙ্গে চিৎকার করে উঠল দরজা বন্ধ করে দাও, দরজা বন্ধ করে দাও।

বড়ো মামা খুব সাহসী। তিনি দাঁড়িয়েই রইলেন বারান্দায়। গম্ভীরভাবে বললেন, বিশু, আমার টর্চটা নিয়ে আয় তো!

বড়ো মামা টর্চ নিয়ে পুকুরপারে দেখতে যাচ্ছিলেন, সবাই মিলে জোর করে তাঁকে ধরে রাখা হল। চিড়িয়াখানায় যেমন বাঘের ডাক শুনেছি, ঠিক সেই রকম হুম-আঁ হুম-আঁ আওয়াজ হল আরও কয়েকবার, তারপর সেটা মিলিয়ে গেল জঙ্গলের মধ্যে।

পরদিন সকালে নরসিংহপুর গ্রামে দারুণ হইচই! অনেকেই সেই বাঘের ডাক শুনেছে। কিন্তু কেউ ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না। এদিকে তো কোনোদিন বাঘ আসেনি। এখান থেকে সুন্দরবন অনেক দূরে। মাঝখানে একটা বড়ো নদী আছে। সেই নদী পেরিয়ে বাঘ আসবে কী করে? কেউ কেউ বললেন, হয়তো কোনো সার্কাস পার্টির বাঘ পালিয়ে এসেছে।

মা ভয় পেয়ে সেই দিনই নরসিংহপুর থেকে চলে আসতে চাইছিলেন। বাবা ধমক দিয়ে বললেন, ছি: তোমার এত ভয়? তোমার ভাই থাকেন এখানে, আর তুমি পালিয়ে যেতে চাইছ?

আমি রাত্তিরবেলা বাঘের ডাক শুনে ভয় পেয়েছিলাম ঠিকই, কিন্তু দিনের বেলা বেশ মজা লাগছিল। সত্যিকারের একটা বনের বাঘ আমাদের মামার বাড়ির এত কাছে এসেছিল, এটা একটা দারুণ ব্যাপার না?

সেদিন রাতে আর বাঘটার ডাক শোনা গেল না। সবাই ভাবল বাঘটা চলে গেছে। কেউ কেউ বলল, বাঘ মোটেই আসেনি, ওটা অন্য কিছুর ডাক। হয়তো হুতুম প্যাঁচার। কিন্তু কেউ যে জঙ্গলের মধ্যে গিয়ে দেখবে, সে সাহস নেই। সে গ্রামের কারুর বন্দুকই নেই যে! পাশের গ্রামে এক শিকারি থাকেন, তাঁকে খবর দেওয়ার কথা বলেছিল দু-একজন।

তার পরদিন খালধারে সাঁকোর কাছে একটা মরা মোষ পাওয়া গেল। তলপেটের কাছে মাংস খুবলে কে যেন খেয়ে নিয়েছে। নিশ্চয়ই বাঘের কান্ড। তাহলে বাঘটা যায়নি!

সন্ধের পর কেউ আর ভয়ে ঘর থেকে বেরোয় না। বিকেলবেলা বড়ো মামা পাশের গ্রামে চলে গেলেন, সেই শিকারিকে ডেকে আনতে।

কিন্তু তার আগেই বিশু একটা কান্ড করে বসল। সন্ধেবেলা আমরা ঘরের মধ্যে গুটিসুটি মেরে বসে আছি। অপেক্ষা করছি। কখন বাঘের ডাক শুনতে পাব। হঠাৎ এক সময় দেখা গেল, আমাদের মধ্যে বিশু নেই। বিশু কোথায় গেল? খোঁজ, খোঁজ, খোঁজ! কিন্তু সারাবাড়ি খুঁজেও বিশুকে পাওয়া গেল না।

বড়ো মামিমা ভয় পেয়ে বললেন, এই রে, বিশুটা একলা একলা জঙ্গলে বাঘ দেখতে যায়নি তো?

বাড়িতে তিনজন লোক কাজ করে, তারা এই বাড়িতেই ঘুমোয়। বড়ো মামিমা বললেন, তোরা একটু খুঁজে দেখ না বিশু পুকুরধারে গেছে কিনা!

ওরা ভয়ে যেতে চায় না। বলল, খালি হাতে কি কেউ বাঘের কাছে যায়, মা ঠাকরুন?

বড়ো মামিমা কাঁদতে লাগলেন। তখন সেই তিনজন লোক আর আমার বাবা একটা মশাল জ্বেলে আস্তে আস্তে এগোলেন পুকুরের দিকে আর চিৎকার করে ডাকতে লাগলেন, বিশু, বিশু!

একটু বাদে সেই ডাকের উত্তর এল ভয়ংকর গলায় হুম-অঁ, হুম-অঁ! অমনি সবাই দৌড়ে বাড়ির মধ্যে ফিরে এসে দরজায় খিল দিল। বড়ো মামিমা ভাবলেন বিশুকে বুঝি বাঘে খেয়েই ফেলেছে। তিনি কাঁদতে লাগলেন খুব জোরে জোরে। বাঘের হাঁকটা ক্রমশ এদিকেই এগিয়ে আসতে লাগল। আমরা ভয়ে ঠক ঠক করে কাঁপতে লাগলাম।

এরপর যা হল, আর খানিকটা আমি নিজের চোখে দেখেছি, খানিকটা কানে শোনা।

বিশুর তো দারুণ সাহস! সে সত্যিই একলা একলা বনের মধ্যে ঢুকেছিল বাঘ দেখবার জন্য। ওর বুদ্ধি আছে, পাছে ও বাঘটার মুখোমুখি পড়ে যায়, তাই একটা মস্তবড়ো জারুল গাছে উঠে বসেছিল। বাঘটা সেদিন সন্ধের পরই এসে বসে আছে পুকুরধারের জঙ্গলে। আর এমনই কান্ড, এক সময় বাঘটা এসে সেই জারুল গাছটাতেই গা ঘষতে লাগল। অত বড়ো বাঘের গা ঘষায় কাঁপতে লাগল গাছটা। আর নীচে সত্যিকারের বাঘ দেখে বিশুরও গা-হাত-পা কাঁপছিল। একসময় সে হাত-পা ছেড়ে ধপাস করে পড়ে গেল নীচে, একেবারে বাঘের পিঠের ওপর। বাঘ হুম-আঁ করে ডেকে উঠল। এর আগে কেউ তো বাঘের পিঠে চাপেনি, তাই বাঘ প্রথমটায় বুঝতে পারল না ব্যাপারটা। টেনে ছুট দিল। আর বিশুও ভয় পেয়ে জড়িয়ে ধরল বাঘের গলা! বাঘ বিরক্ত হয়ে জোরে ডাকতে ডাকতে ছুটল।

ক্রমশ বাঘ চলে এল পুকুরের এ-পার। আমরা তখন ভাবছি, বাঘ বুঝি আমাদের বাড়ি আক্রমণ করতে আসছে। হুড়মুড় করে আমরা উঠে গেলাম দোতলায়। সিঁড়িতে লোহার গেট। বাবা বললেন, বাঘ কিছুতেই সে গেট ভেঙে ওপরে উঠতে পারবে না।

দোতলা থেকে আমরা দেখলাম এক অদ্ভুত দৃশ্য। আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে ছুটে গেল বাঘ, আর তার পিঠের ওপর গলা জড়িয়ে শুয়ে আছে বিশু। আমরা প্রথমে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারিনি। কিন্তু সত্যিই আমাদের চোখের সামনে দিয়ে বাঘের পিঠে চেপে চলে গেল বিশু। বড়ো মামা দেওয়ালে কপাল ঠুকতে লাগলেন, আমার মাও কাঁদতে লাগলেন।

…তার পিঠের উপর গলা জড়িয়ে শুয়ে আছে বিশু…

বিশু কিন্তু বাঘের পেটে যায়নি। ফিরে এসেছিল সম্পূর্ণ সুস্থভাবে। সে এক মজার ব্যাপার। বিশু বাঘের পিঠে চেপেই বুঝতে পেরেছিল, একবার সে মাটিতে পড়ে গেলেই বাঘ তাকে খেয়ে ফেলবে। পিঠের ওপর থেকে তো বাঘ তাকে খেতে পারবে না! তাই সে খুব জোরে ধরে ছিল বাঘের গলা।

এদিকে ওই বাঘটা সত্যি একটা সার্কাস থেকে পালিয়েছিল। দুষ্টুমি করে ঘুরে বেড়াচ্ছিল ক-দিন। পিঠের ওপর একটা মানুষ বসে পড়ায় সেও ভয় পেয়ে গেছে। ছুটতে ছুটতে সোজা হাজির হল কুড়ি মাইল দূরে সেই সার্কাসের তাঁবুতে। সেখানকার লোকজন ওদের দেখতে পেয়ে বিশুকে নামিয়ে নেয়। বাঘটা তখন পোষা বিড়ালের মতন ল্যাজ নাড়তে থাকে।

বিশু অবশ্য বলে, ওটা মোটেই সার্কাসের বাঘ ছিল না। ওটা ছিল খাঁটি সুন্দরবনের বাঘ। একসময় বিশুকে নিয়ে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *