বিল্টুদের বাড়ির সবাই

বিল্টুদের বাড়ির সবাই

বারান্দায় বসে একটা গল্পের বই পড়ছে বিল্টু৷ শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা ডিটেকটিভ গল্প৷ ধরলে আর ছাড়া যায় না৷

বিল্টুর বয়েস এখন এগারো৷ এখন সে একটা-দুটো বড়দের বইও পড়তে শুরু করেছে৷ তবে বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’ পড়ার চেষ্টা করেছিল, সেটা বেশ শক্ত লেগেছে, শেষ করতে পারেনি সবটা৷ আর একখানা বড়দের বই বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পথের পাঁচালী’ সে শেষ করে ফেলেছে, এক জায়গায় তার কান্নাও পেয়েছিল৷

খুব মন দিয়ে বইটা পড়ছে বিল্টু৷ এমন সময় কী যেন একটা পোকা ভন-ভন করছে তার কানের কাছে৷

সেটা একটা মৌমাছি৷

অনেকের ধারণা, মৌমাছি মানুষকে কামড়ে দেয়৷ মোটেও না৷ মৌমাছির পেছনে হুল আছে, সেই হুল বসিয়ে দিলে বেশ জ্বালা করে৷ কিন্তু মৌমাছি এমনি এমনি মানুষের গায়েও বসে না, হুলও ফোটায় না৷ মৌমাছিরা মানুষদের চেনেই না৷ তারা চেনে ফুল, লতাপাতা, গাছপালা এই সব৷ কখনো কখনো ভুল করে মানুষের কাছাকাছি চলে আসে৷ একটু হাত-টাত নাড়লেই চলে যায়৷

বিল্টু এত গভীর মনোযোগ দিয়ে বই পড়ছে যে মৌমাছিটার দিকে তাকিয়েও দেখল না৷ মৌমাছিটা যে কেন তার কাছেই এসে গুনগুন করছে, তা কে জানে!

বিল্টু একটু বাদে বিরক্ত হয়ে বই থেকে চোখ তুলল, তারপর মৌমাছিটাকে দেখেই হাতের মোটা বইটা দিয়ে ফটাস করে মারল সেটাকে৷

মৌমাছিটা মেঝেতে পড়ে যেতেই বিল্টু জুতো পরা পা দিয়ে সেটাকে চাপড়ে দিল৷ ব্যাস, মৌমাছিটার জীবন শেষ৷ বিল্টু পা দিয়ে ঠেলে দিল সেটাকে৷

ঠিক তখুনি বিল্টুর দিদি শ্রেয়া এল বারান্দায়৷

শ্রেয়ার বয়েস উনিশ, সে কমপিউটার সায়েন্স পড়ে আবার ভালো গানও গায়৷ তার বয়েসি অনেক মেয়েই এখন চুল কেটে ফেলে, শ্রেয়ার কিন্তু পিঠ পর্যন্ত লম্বা চুল৷ সে জিনসও পরে, শাড়িও পরে৷

এই সময় শ্রেয়া বাগানের ফুলগাছে জল দেয়৷ তাদের শান্তিনিকেতনের বাড়িতে অবশ্য মালি আছে, তবু শ্রেয়া নিজের হাতে গাছে জল দিতে ভালোবাসে৷ সে কোনো কোনো গাছের গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করে৷ কী যেন কথা বলে তাদের সঙ্গে৷

শ্রেয়া বলল, তুই কী মারলি রে বিল্টু?

হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে আবার বলল, এ মা, এ তো একটা মৌমাছি৷ তুই এটাকে মারলি কেন? ইশ!

বিল্টু বলল, বড্ড কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান করছিল৷ আর একটু হলে কামড়ে দিত৷

শ্রেয়া বলল, মোটেই কামড়াত না৷ একলা একলা মৌমাছি কোনো মানুষকে কক্ষনো হুল ফোটায় না৷

শ্রেয়া সেটাকে হাতে তুলে নিয়ে ফুঁ দিল৷ যদি এখনো বাঁচানো যায়৷ নাঃ, কোনো উপায় নেই, একেবারে শেষ৷

শ্রেয়া সেটাকে নিয়ে নেমে গেল বাগানে৷ রেখে দিল একটা ফুলগাছের নীচে৷

বিল্টু আবার পড়তে শুরু করেছে৷ হঠাৎ শুনল, কানের কাছে আবার গুনগুন শব্দ৷ এই রে, আবার একটা এসেছে নাকি?

কিন্তু কোনো মৌমাছি বা পোকা-টোকা দেখা গেল না৷

বই পড়তে পড়তেও বিল্টুর একবার মনে হল, সে একটা মৌমাছিকে মেরেছে বলে কী অন্য মৌমাছিরা প্রতিশোধ নিতে আসবে? তাকে কামড়াবে?

সে বইটা মুড়ে ভালো করে দেখল৷ না, আর কোনো মৌমাছি নেই৷ অন্য মৌমাছিরা এত তাড়াতাড়ি জানবে কী করে?

তা ছাড়া, তার মনে পড়ল, তার দিদি একদিন বলেছিল, পোকা-মাকড়দের স্মৃতিশক্তি খুব কম৷ তারা কিছু মনে রাখতে পারে না, প্রতিশোধ নিতেও আসে না কক্ষনো৷

নিশ্চিন্ত হয়ে সে আবার বই পড়ায় মন দিল!

একটু বাদে সে আবার কানের কাছে গুনগুন শব্দ পেল, কিন্তু এবারেও কোনো মৌমাছি দেখা গেল না৷

বিল্টু বিরক্ত হয়ে ভাবল, ওটা লুকিয়ে থাকছে কোথায়?

পরক্ষণেই তার মনে হল, মৌমাছিরাও কি মরে গেলে ভূত হয়? ওই মৌমাছিটা ভূত হয়ে আসছে বলে সেটাকে দেখা যাচ্ছে না!

বিল্টুর মা একটা কলেজে কেমিস্ট্রি পড়ান৷ বাবাও ইতিহাসের অধ্যাপক৷ খাবার টেবিলে একসঙ্গে বসে অনেক কথা হয়৷ সেইজন্য বিল্টু জানে, মানুষ মরলেও ভূত হয় না৷ ওসব গল্প৷ পোকা-মাকড়ের মৃত্যুর পর ভূত হবার কোনো প্রশ্নই ওঠে না৷

তবু মাঝে মাঝে ভূতের কথা মনে হয় কেন? গা-টা ছমছম করে৷

কোনো মৌমাছি দেখা যাচ্ছে না, অথচ গুনগুন শোনা যাচ্ছে, কী ব্যাপার! বিল্টু বই বন্ধ করে ভেতরে চলে গেল৷

বাগানে একটা লন আছে, সেখানে বিকেলবেলা ঘাসের ওপর সতরঞ্চি পেতে সবাই মিলে চা খাওয়া হয়৷ প্রথমে মুড়ি-বাদাম আর আলুর চপ, তারপর চা৷ বিল্টু এখনো চায়ের দলে ওঠেনি, তার জন্য হরলিকস৷

চায়ে চুমুক দিয়ে শ্রেয়া বলল, জানো মা, আজ বিল্টু একটা মৌমাছি মেরেছে৷

বিল্টু হঠাৎ ফুঁসে উঠে বলল, মেরেছি, বেশ করেছি৷ তার জন্য মায়ের কাছে নালিশ করার কী আছে? মালির ছেলেও তো কাল দুটো আরশোলা মেরেছে!

শ্রেয়া বলল, আরশোলা মানুষের কী উপকার করে জানি না৷ কিন্তু মৌমাছি কী করে তা জানিস?

বিল্টু বলল, জানব না কেন? মৌমাছি মানুষের জন্য মধু তৈরি করে! একটা মরে গেলে কী হয়েছে?

মা কিছু না বলে হাসলেন৷ শ্রেয়া বলল, তুই কিচ্ছু জানিস না৷ মৌমাছি মানুষের জন্য মধু তৈরি করবে কেন? ওদের কি দায় পড়েছে? ওরা কত ফুল থেকে একটু একটু করে মধু জোগাড় করে এনে মৌচাকে রাখে৷ নিজেদের জন্য৷ মানুষ সেগুলো চুরি করে৷ মৌচাক ভেঙে নিয়ে আসে৷

বিল্টু বলল, তাহলে মধু না খেলেই হয়৷ আমি অত মধু ভালোবাসি না৷ তার চেয়ে ঝোলাগুড় ভালো৷

শ্রেয়া বলল, মধু না হলেও আমাদের চলে৷ কিন্তু পৃথিবী থেকে যদি সব মৌমাছি শেষ হয়ে যায়, তা হলে কী হবে জানিস? পৃথিবীতে আর একটাও ফুল ফুটবে না!

এ কথা শুনে বিল্টু একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল৷ ফুল তো এমনি এমনি ফোটে৷ চতুর্দিকে কত ফুল৷ তার সঙ্গে মৌমাছিদের কী সম্পর্ক?

সে বলল, ভ্যাট! বাজে কথা৷

এবার মা মাথা নেড়ে বললেন, না, বাজে কথা নয়৷ ফুলগুলো মৌমাছিদের মধু দেয়৷ তার বদলে মৌমাছিরা নতুন নতুন ফুল ফোটায়৷

ব্যাপারটা বিল্টু ঠিক বুঝতে পারল না৷ সে একটু ভাবতে না ভাবতেই শ্রেয়া আবার বলল, ফুল না ফুটলে কী হবে বল তো? আমরা আর খেতে পাবো না!

আবার একটা চমক! ফুল না ফুটলে খেতে পাবো না৷ আমরা কি ফুল খাই নাকি? কুমড়ো ফুল আর বকফুল ভাজা হয় মাঝে মাঝে অবশ্য৷ সে আর ক’দিন?

দিদির কথা বিশ্বাস করা যায় না৷ তাই সে মাকে জিজ্ঞেস করল, মা, এ কথাটা সত্যি? আমরা কি শুধু ফুল খাই?

মা বললেন, ফুল খাই না বটে৷ ফল তো খাই৷ ফুল থেকেই তো ফল হয়৷ সব গাছেই আগে ফুল, তারপর ফল৷

পুকুরধারে একটা আমগাছে অনেক বোল এসেছে৷ সেদিকে আঙুল দেখিয়ে শ্রেয়া বলল, ওই যে আমের বোল দেখছিস, তাকে বলে আমের ফুল৷ ওর থেকে দেখবি ছোট্ট ছোট্ট আম হবে৷ তারপর বড় হলে সেগুলো পাকবে৷ যে আমগাছে সব বোল ঝরে যায়, সে গাছে আমও হয় না৷

মা হঠাৎ চেঁচিয়ে বললেন, এই, এই, গেটটা বন্ধ কর৷

বাইরে থেকে একটা গরু ঢুকে পড়েছিল; বিল্টু আর মালির ছেলে দিবাকর দু’জনেই ছুটে গেল৷ গরুটা তার মধ্যে মুখ বাড়িয়ে একটা গাঁদাফুলের গাছ পুরোটা খেয়ে নিয়েছে!

দিবাকর একটা লাঠি দিয়ে গরুটাকে মারতে যেতেই শ্রেয়া বলে উঠল, এই এই, মারিস না, মারিস না৷ গেটের বাইরে বার করে দে!

মা বললেন, মানুষ কত খারাপ দ্যাখ৷ আমরা গরুর দুধ খাই, আবার গরুকে মারতে যাই! ছিঃ!

শ্রেয়া বলল, মৌমাছিরা যদি আর না থাকে, তা হলে আমরা আর গরুর দুধও খেতে পারব না, জানিস তো?

বিল্টু এবার বুঝতে পারল, তার সঙ্গে মজা করা হচ্ছে৷

সে ধুৎ বলে সেখান থেকে উঠে চলে গেল৷ দিদিটা মাঝে মাঝে এমন সব অদ্ভুত কথা বলে! মৌমাছি আর গরুর দুধ!

সন্ধের সময় বাবার বন্ধু বরেনকাকু আড্ডা দিতে আসেন মাঝে মাঝে৷ বাবা অবশ্য কাল কলকাতায় গেছেন, আজই সন্ধের ট্রেনে ফেরার কথা৷

বাবা আর বরেনকাকু এলেন একসঙ্গেই৷

এর মধ্যে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেল৷ এখন আকাশ পরিষ্কার৷ কয়েকটা তারাও ঝিকমিক করছে৷ তালগাছগুলোতে শোনা যাচ্ছে হাওয়ায় শর শর শব্দ৷

এই সময় সবাই মিলে বসা হয় সামনের বারান্দায়৷

কথায় কথায় বরেনকাকু বললেন, জানো, আজ কী হয়েছে? আমাদের মালির ছেলেটাকে একটা বোলতা কামড়ে দিয়েছে!

মা বললেন, ও মা, তাই নাকি? বোলতার তো খুব বিষ আছে! কী হল ছেলেটার?

বরেনকাকু কিছু বলার আগেই বাবা আপন মনে হেসে উঠলেন৷

কারুকে বোলতা কামড়াবার কথা শুনে কেউ হাসে নাকি? সবাই তাকাল বাবার দিকে৷

বাবা কিছু বলার আগেই বিল্টু শ্রেয়াকে বলল, এই দিদি, তুই যে বলেছিলি মৌমাছি কামড়ায় না? বোলতা আর মৌমাছি তো একই!

শ্রেয়া বলল, মোটেই এক নয়৷ বোলতাদের গা হলদে, আর ওরা বেশ বোকা হয়৷ এত গাছপালা থাকতেও বোলতারা মানুষের বাড়ির দরজা কিংবা জানলার পাশে বাসা বানাতে যায়৷ বাড়ির লোক কাছাকাছি গেলে অনেক সময় কামড়ে দেয়৷

বরেনকাকু বললেন, হ্যাঁ, বোলতা আর মৌমাছি এক নয়৷ মৌমাছিরা একা একা থাকলে সাধারণত কামড়ায় না৷ মানে, হুল ফোটায় না৷ তবে, মানুষ যখন মৌচাক থেকে মধু চুরি করতে যায়, তখন ওরা ঝাঁক বেঁধে তাড়া করে আসে৷ মানুষের তো বুদ্ধি বেশি, তারা তখন খুব ধোঁয়া ছড়ায়৷ মৌমাছিরা ধোঁয়া সহ্য করতে পারে না৷ তারা তখন বাধ্য হয়ে ফিরে যায়৷

শ্রেয়া জিজ্ঞেস করল, ছেলেটা এখন ভালো আছে?

বরেনকাকু বললেন, হ্যাঁ, আজকাল ভালো ভালো মলম বেরিয়েছে৷ চট করে সেরে যায়৷

মা এবার বাবার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি তখন হঠাৎ হাসলে কেন?

বাবা বললেন, আমার সেই গল্পটা মনে পড়ে গেল৷ বোলতার গল্প৷ খুব সম্ভবত তারাপদ রায়ের লেখা৷ তোমরা জানো, সেই গল্প?

বরেনকাকু বললেন, তারাপদ রায়ের লেখা? শুনি তো, শুনি তো গল্পটা!

বাবা বললেন, হাজারিবাগে একটা বাঙালি ফ্যামিলি থাকে, তাদের বাড়ির একটা ছোট ছেলেকে হঠাৎ বোলতা হুল ফুটিয়ে দিল৷ ছেলেটা বিল্টুর চেয়েও অনেক ছোট৷ সে তো যন্ত্রণায় চিৎকার করছে, ভদ্রলোক তখন ছেলেটাকে কোলে নিয়ে ছুটলেন এক ডাক্তারখানায়৷ সেখানে গিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, ডাক্তারবাবু, একে বোলতা কামড়েছে৷ শিগগির একটা ব্যবস্থা করুন৷

ডাক্তার তো বিহারি, তিনি বাংলা জানেন না৷ তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কেয়া হুয়া?

ভদ্রলোক এবার বললেন, ইসকো বোলতা কামড়ায়া৷

ডাক্তার বোলতা মানেও বুঝলেন না৷ তিনি আবার বললেন, কেয়া?

ভদ্রলোক এবার বললেন, হামলোগ তো বোলতাকো বোলতা বোলতা হ্যায়৷ আপলোক বোলতাকো কেয়া বোলতা হ্যায়!

সবাই হো-হো করে হেসে উঠল৷

বিল্টু সঙ্গে সঙ্গে বলল, মা, তখন দিদি কেন বলল, একটা মৌমাছি মরলে আর কোনো গরুর দুধ পাওয়া যাবে না?

এবার সবাই হেসে উঠল আরও জোরে৷

শ্রেয়া বলল, আমি মোটেই বলিনি, একটা মৌমাছি মরলে! তুই সব কথাটা শুনলিই না বোকারাম!

মা শ্রেয়াকে একটু ধমক দিয়ে বললেন, এই, তুই ভাইকে বোকারাম বললি যে? তোর বুঝি খুব বুদ্ধি?

তারপর বিল্টুর পিঠে হাত রেখে বললেন, শোন, আমি ব্যাপারটা ভালো করে বুঝিয়ে দিচ্ছি৷ মৌমাছিরা তো আছেই, তা ছাড়া প্রজাপতি, ভিমরুল—এই সব যারা উড়ে বেড়ায় আর ফুলের ওপর গিয়ে বসে দেখেছিস তো? এরা এক ফুলের পরাগ অন্য ফুলে নিয়ে যায়৷ ফুলের ওপর যে হালকা গুঁড়ো গুঁড়ো জিনিস থাকে, তাকে বলে পরাগ৷ ওই পরাগ বদলাবদলি হয় বলেই নতুন নতুন গাছ জন্মায়, আবার ফুল ফোটে৷ এখন, শুনলি তো, মৌমাছিরা ধোঁয়া সহ্য করতে পারে না৷ যদি কখনো পৃথিবীতে কেউ বিষাক্ত ধোঁয়ার বোমা-টোমা ফেলে, তাহলে প্রজাপতি, ভ্রমর, মৌমাছিরা সব মরে যাবে৷

শ্রেয়া বলল, তাহলে আর ফুলও ফুটবে না৷ গাছও জন্মাবে না৷ গরুরা খাবে কী? গোরু যদি খেতে না পায়, তা হলে দুধ দেবে কী করে?

বিল্টু বলল, গোরু তো গাছ খায় না, ঘাস খায়!

শ্রেয়া বলল, ঘাসও তো একরকম গাছ৷ ঘাসে ছোট্ট ছোট্ট ফুল ফোটে দেখিসনি? সেই ফুলেও প্রজাপতি বসে৷

বরেনকাকু বললেন, ওরে বাবা, বিল্টু, সে রকম হলে আমরাও কিছু খেতে পাবো না৷ তুই জানিস কি, আমরা যে ভাত খাই, রুটি খাই, সেগুলোও গাছের ফল থেকে আসে৷ ধান গাছের ধান থেকে চাল হয়, আর গম গাছের গম থেকে হয় আটা৷ ঘাস-টাস যদি আর না জন্মায়, তাহলে ধান গাছ, গম গাছও আর হবে না৷

বাবা বললেন, শহরের ছেলেরা অনেকেই এসব জানে না৷ আমরা যখন ইস্কুলে পড়তাম, তখন ক্লাসের কিছু কিছু ছেলে ভাবত, ধান গাছ থেকে বুঝি কাঠের তক্তা হয়৷

বরেনবাবু জিজ্ঞেস করলেন, বিল্টু, তুই ধান গাছ চিনিস তো?

বিল্টু বলল, হ্যাঁ, ট্রেনে যাবার সময় দু’পাশেই তো দেখি৷

বিল্টু এখনও দিদির কাছে হেরে যেতে রাজি নয়৷

সে বলল, আচ্ছা মা, দিদি যে আরশোলা দেখলেই বিছানার ওপর লাফিয়ে ওঠে আর চেঁচিয়ে বলে, মার, ওটাকে মার! তার বেলা বুঝি কিছু হয় না?

শ্রেয়া বলল, আরশোলা কি মানুষের কোনো উপকার করে! বিতিকিচ্ছিরি! দেখলেই গা গুলিয়ে ওঠে৷ আরশোলারা ফুলের ওপর বসে না, গাছপালার ব্যাপারে ওরা কোনো সাহায্য করে না৷ মেরে মেরেও ওদের শেষ করা যায় না৷

বরেনকাকু বললেন, শুনেছি তো অ্যাটম বোমা পড়লে আমরা সবাই শেষ হয়ে যাব৷ কিন্তু আরশোলারা তবু শেষ হবে না৷

বাবা বললেন, যথেষ্ট হয়েছে৷ এবার সবাই মিলে খাবার ঘরে গিয়ে বসলে হয় না? এসব শুনেই আমার খিদে পেয়ে যাচ্ছে৷

বিল্টুর জন্য এখন আলাদা বিছানা হয়েছে৷ সে আর মায়ের পাশে শোয় না৷ সে তো এখন বড় হয়ে গেছে৷

আলো নেভাবার পরও তার ঘুম এল না কিছুক্ষণ৷ সে শুনতে পেল একটা গুনগুন শব্দ৷ এই রে, ঘরের মধ্যে একটা মৌমাছি ঢুকে পড়েছে নাকি?

দিদি যাই-ই বলুক, ঘর থেকে মৌমাছিটাকে না তাড়ালে সে কিছুতেই ঘুমোতে পারবে না৷

ধড়মড় করে উঠে সে আলো জ্বালল৷

কোথায় মৌমাছি? কিচ্ছু নেই৷ তবু গুনগুন শব্দ শোনা যাচ্ছে৷ দেয়ালে শুধু একটা জাম রঙের মথ ডানা মেলে বসে আছে৷ মথরা তো কোনো শব্দ করে না৷ কক্ষনো মানুষের গায়েও বসে না৷ ওরা খুব ভালো৷

তবে?

কয়েক মুহূর্তের জন্য বিল্টুর শরীরটা ভয়ে কাঠ হয়ে গেল৷ সেই মৃত মৌমাছিটা প্রতিশোধ নিতে এসেছে?

তারপরই বিল্টু মনে মনে বলতে লাগল, মা বলেছে, মানুষ মরলে ভূত হয় না, মৌমাছিরাও মরলে ভূত হয় না৷ ওই শব্দটা বাজে! একদম বাজে!

আলো নিভিয়ে সে শুয়ে পড়ল৷ ঘুমও এসে গেল একটু বাদে৷

ঘুমের মধ্যেও বিল্টু স্বপ্ন দেখল, একঝাঁক মৌমাছি তাকে তাড়া করে আসছে৷ সে তো মধু চুরি করতে যায়নি, তবু তাড়া করছে কেন? ভয় পেয়ে বিল্টু দৌড়োল৷

কিন্তু মৌমাছিরা তো অনেক তাড়াতাড়ি উড়ে আসতে পারে৷

একেবারে বিল্টুর মাথার ওপরে এসে গেল সেই ঝাঁক৷

কিন্তু তারা বিল্টুকে কামড়াল না, মানে হুল ফোটাল না৷ উড়ে গেল মাথার ওপর দিয়ে৷

তারপর বিল্টু দেখল, শুধু সেই একঝাঁক নয়, আরও ঝাঁকের পর ঝাঁক মৌমাছি উড়ে আসছে, চলে যাচ্ছে অনেক দূরে৷ তারপর ঝাঁক ঝাঁক প্রজাপতি, ঝাঁক ঝাঁক ভিমরুল৷ সব উড়ে যাচ্ছে দিগন্তের দিকে৷

এই রে, এরা সবাই পৃথিবী ছেড়ে চলে যাচ্ছে নাকি? রাগ করেছে? কিংবা অভিমান? আর ফিরবে না?

তা হলে কি পৃথিবীতে আর ফুল ফুটবে না? নতুন নতুন গাছ জন্মাবে না? মা যে রজনীগন্ধা আর যুঁই ফুলের চারা লাগিয়েছেন, সেগুলোও আর বাঁচবে না?

বিল্টু হাত তুলে বলতে গেল, এই যেও না, যেও না! কিন্তু তার গলা দিয়ে আওয়াজ বেরুল না৷ বেরুলেই বা কি, ওরা কি মানুষের ভাষা বোঝে?

হঠাৎ বিল্টুর কান্না এসে গেল৷ ঘুমের মধ্যে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল বিল্টু!

একটু বাদেই পাশের ঘর থেকে মা উঠে এলেন৷ হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন তার মাথায়৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *