বিলেতে সাড়ে সাতশ দিন – ৫

পাঁচ

এ বিজন প্রবাসে একটি বছর কেটে গেলো। ভালো লাগুক আর না লাগুক, পছন্দ করি বা না করি বাকি দিনগুলোও কাটবে। নদীর স্রোতের মতোই সময় কারও জন্যে অপেক্ষা করে। সুতরাং একদিন আমার এ প্রবাস শেষ হবে। সেদিনের প্রতীক্ষায় প্রতি দিন প্রতি রাত আনন্দ-বেদনায় কাটছে।

এই একটি বছর বহুরূপী ইংলণ্ডের নানা রূপ দেখছি। দেশের যারা মানুষ তাদের চোখে দেশ যেমনভাবে ধরা দেয় বিদেশীর চোখে ঠিক তেমনভাবে ধরা দেয় না! বিদেশীরা বিদেশে পা দিয়ে যা দেখে নিজের দেশের সঙ্গে তাকে মিলিয়ে নিতে চায়। ফলে যা দেখে তা তাদের চোখে অনেক সুন্দর এবং বিচিত্রভাবে ফুটে ওঠে। বিদেশের বিচিত্রতাই বিদেশীর মনকে সজাগ রাখে, চিত্তকে রাখে উন্মুখ করে।

মাটি আর প্রকৃতির রসেরূপে গড়ে ওঠা ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে। এ জীবনে কত জায়গা বেড়ালাম, কত দেশ দেখলাম, কত মানুষের সঙ্গে মিশলাম। সে সব দেশের নরনারীর সঙ্গে করলাম ভাব বিনিময়। তাদের মনের গহন কোণে ঠাইও পেলাম। মুগ্ধ হলাম দুনিয়ার মানুষের বহু বিচিত্র আত্মপ্রকাশ দেখে। কিন্তু সবার চেয়ে বেশী মুগ্ধ করলো আমাকে যে দেশে যাই সেই দেশের হাওয়া আর প্রকৃতি। তার মাটির রং মাঠের রূপ। বনজঙ্গল আর পাহাড় পর্বতের কমনীয় অনির্বচনীয়তা।। গত জুন মাসে গিয়েছিলাম রিচমণ্ড বেড়াতে। লণ্ডন থেকে রিমণ্ড বেশী দূর নয়। টিউব ট্রেন কি বাসে ঘণ্টা দেড়েকের পথ। টেম্‌স নদী দিয়ে লঞ্চেও যাওয়া যায়। টেস নদীর পাশ দিয়ে উঁচুনীচু পাহাড় ও সমতল ভূমির ওপর রচিত স্বাস্থ্য-নিবাস রিচমৎ। তার পরিধি চারদিকে মাইল কয়েক হবে। মহারাণী ভিক্টোরিয়া গ্রীষ্মকালে প্রাণ ভ’রে এ জায়গায় সৌন্দর্য পান করবার জন্যে মাঝে মাঝে নাকি এখানে এসে থাকতেন। ফুলের আর গাছ পালার শোভায় সারা ইংলণ্ডকে স্বর্গ বলে মনে হয়। রিচম সেই স্বর্গের প্রথম শ্রেণীতে পড়ে। নদীর পাশ দিয়ে ছায়াঘেরা ঘন সবুজ বনানী। বনের মাঝে মাঝে ফাঁকা জায়গা। ডালপালার ফাঁক দিয়ে সোনালী সূর্যের স্নিগ্ধ কিরণ এসে চুমো দিচ্ছে সেখানকার সবুজ ঘাসে ভরা মাটিকে। তার ওপরে অগণিত ইংরেজ তরুণ-তরুণী রৌদ্রস্নানের জন্যে নিজেদেরকে মেলে ধরেছে। পাশের ঝোঁপঝাপে ছেলেমেয়েরা খেলছে লুকোচুরি। দেখে মনে হচ্ছে এ কোন এক স্বর্গরাজ্যে এসেছি। এখানে বোধ হয় দুঃখ বেদনা কোনদিন কাউকে স্পর্শ করে না।

পাশেই উঁচু পথ। পথের নীচে তরু ছায়া ঘেরা ফুলবাগানের মধ্যে ইংরেজ হুরপরীদের। লীলার মেলা। তার নীচে লক্ষ্মী টেমস। মাথা থেকে পা পর্যন্ত লতাপাতায় ঢাকা দুপারের সবুজ গাছ-পালার পা চুমে টেম্‌স এঁকে বেঁকে তার পথ করে মিশে গেছে দূরের বনের মধ্যে। রিচমণ্ডে বন আর নদীর শোভা অপরূপ। পথের ওপর দাঁড়িয়ে টেমসের পানির ওপর প্রতিফলিত রোদের ঝিলিমিলি আর তার মৌনরূপ দেখে অভিভূত হয়ে গেলাম।

পথ বেয়ে ক্রমে ওপরের দিকে উঠে গেলাম। কিছুদূর পায়ে চ’লে আমরা কয়েক বন্ধুতে মিলে রিচমণ্ডের হরিণগুলোর ছায়াঘেরা কুঞ্জের মধ্যে এসে পৌঁছলাম। এখানকার হরিণ না পোষা, না বন্য। কেউ এদের শিকার করতে পারে না। ওরা রাজার রক্ষিত। যে ওদের ক্ষতি করবে, তাকে কিছুদিনের জন্যে শ্রীঘর ঘুরে আসতে হবে। সে ভয়ে ওদের। কেউ ছোয় না। বনের পাশে অবারিত মাঠ। তাতে কচি ঘাস। এটিই ওদের চারণ ক্ষেত। বনের পাশে এসে দেখলাম অগণিত ধেড়ে-বাড়ি ও শিশু হরিণ মিলেমিশে কচি ঘাসে মুখ লাগিয়ে চলছে আর কেউবা গাছের নীচে জিরিয়ে নিচ্ছে। দুরে আমাদের সাড়া পেতেই ওরা সচকিত হয়ে উঠলো। আমি ওদের ছবি নেবার জন্যে একটি বাচ্চার একেবারে কাছে এসে পড়েছিলাম। নির্দোষ হরিণশিশু তার রাজ্যে দ্বিপদের এ-অভাবিত সমাগম বোধ করে প্রথমটা বোধ হয় হকচকিয়ে গিয়েছিলো। তাল সামলে নিয়ে দৌড় দিতে যাবে, এমন সময় আমার ক্যামেরায় ওদের চকিত সজাগ ধাবমান রূপ আমি ধরে নিলাম।

ইংলণ্ডে বৃষ্টি হয় প্রচুর। এখানকার বৃষ্টি আমাদের দেশের মতো মুষলধারায় বর্ষে না। ঝিপ বিপ করে ক্ষণে আসে ক্ষণে নেই। ক্ষণে ক্ষণে থাকা আর না-থাকা বৃষ্টি এখানে একরকম সারা বৎসরই চলে। বর্ষা বলে এদের আলাদা কোন ঋতু নেই। সে জন্যেই এখানকার তরুলতায় জীবনের আর সজীবতার ছাপ সুস্পষ্ট। নিদারুণ শীতই সে জীবনের দুরন্ত দুশমন। নইলে প্রকৃতির জীবনে এখানে অনন্ত যৌবন। এ কারণেই বোধ হয়, এখানকার ঘাসের এত বাড়। লেকের পাড়ের, পার্কের আর পশু চারণের ক্ষেত নয় এমন বাগানের ঘাস কাটবার জন্যে ঘাস কাটার যন্ত্র নিয়ে মালীদের নিত্য তৈরী থাকতে হয়। তবু গ্রীষ্মে-বসন্তে ঘাস কেটে শেষ করতে পারে না ওরা। গ্রীষ্মকালে তরুণ-তরুণীরা দলে দলে রোদ পোয়াতে এসে ঘাসের ওপর আরাম করে শুয়ে থাকে।

এ দেশের লোকের জীবনে এ ঘটনা এতো স্বাভাবিক যে, ওরা সেদিকে চেয়েও দেখে না। বিদেশীদের চোখে তা এতো অস্বাভাবিক যে, সে দৃশ্য এড়িয়ে গ্রীষ্মকালে ঘাস সংলগ্ন পথ চলা তাদের সাধ্যের অতীত হয়ে ওঠে। এদের জীবনে এ বেয়াড়াপনা আমরা পছন্দ করি আর না করি এখানকার ঘাসের মধ্যে যে মাদকতা আছে, তা অস্বীকার করি কি করে? দূরে দেখলাম এক ইংরেজ পরিবার (স্বামী-স্ত্রী বলেই মনে হলো) তাদের সঙ্গে দুটো ছেলে মেয়ে নিয়ে ঘাসের মধ্যে নিজেদের মেলে দিয়েছে। বাচ্চা দুটো ওদের বাবার বুকের উপরে চড়ে দুরন্ত দৌরাত্ম শুরু করেছে। আর ওদের মা বাবার মুখে প্রকাশ পাচ্ছে কি নিবিড়

আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উর্দুর অধ্যাপক ডাক্তার মাসুদ হোসেন আর দিল্লীর জামেয়া মিল্লিয়ার অর্থনীতির অধ্যাপক মিঃ আকেল ছিলেন আমার সঙ্গী। পথ চলতে গিয়ে আমরা এতো ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম যে, বিশ্রাম না নিয়ে আর পারলাম না। একটা কাগজ বিছিয়ে শুয়ে পড়লাম রিচমণ্ডের মাটিতে। ওপরে অনন্ত নীল আকাশ। নীচে ঘন বিস্তীর্ণ সবুজ ঘাসের শদ কম্প। আর চারিদিকে ছায়াঘেরা তরুশ্রেণীর স্বপ্নরাজ্য। এর গণ্ডী ডিঙিয়ে গেলেই শোনা যায় বৃহত্তর লণ্ডনের যন্ত্র ও যানবাহনের কোলাহল আকাশ ভেদ করে ওপরে উঠছে। অথচ রিচমণ্ডে শব্দহীন স্তব্ধতার সরু পাড় একটা নিঃসাড় স্বপনের রেখা টেনে দিয়ে কোন্‌ সুদূরে মিলিয়ে যেতে চাইছে। তারই মাঝে বিশ্রাম করতে গিয়ে কখন যে ঘুমে ঢলে পড়েছি জানি না।

লণ্ডনের দক্ষিণে সুন্দরের লীলানিকেতন যেমন রিচম, উত্তরে তেমনি হ্যামষ্টেডহিথ। রিচমণ্ডের শোভা বাড়িয়েছে সেখানকার টেম্স। হ্যামষ্টেডহিথের শোভা উঁচু নীচু মাটির ঢিবি আর তার উপরে বহুকাল লালিত তরুশ্রেণী। এর উঁচু নীচু দিয়ে চলে গেছে অসংখ্য পায়ে চলার পথ। তাতেই বেড়েছে এখানকার সৌন্দর্য। সুন্দরের কবি কীটস্ মুগ্ধ হয়ে এখানে। বাসা বেঁধেছিলেন। এখানেই তিনি তাঁর প্রেমিকা ফ্যানী ব্রাউনের সাক্ষাৎ পান। Beauty is truth, Truth beauty (সুন্দরই সত্য এবং সত্যই সুন্দর) ব’লে কবি কেন সুন্দরের সাধনায় নিজেকে ডুবিয়ে দিয়েছিলেন, হ্যামষ্টেডহিথে এলে তার কিছুটা আভাস পাওয়া যায়। জুন জুলাইয়ের পল্লবছায়া ঘেরা হামডেহিথে প্রণয়ী ও প্রণয়িণীদের কলকাকলি মুখরিত সুমধুর গুঞ্জন যার কানে একবার প্রবেশ করছে সে বুঝবে এখানকার প্রত্যেক তরুণই কবি কীটুস আর প্রত্যেক তরুণীই যেন ফ্যানী ব্রাউন।

আমাদের দেশে ঋতু ছ’টা। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত। ইংলণ্ডের ঋতু সংখ্যা চার। শীত, বসন্ত, গ্রীষ্ম আর হেমন্ত। শীত গ্রীষ্মের মধ্যে বসন্ত আসে তার ফুলের পসরা নিয়ে। রূপের বাহার হঠাৎ মেলে ধরে এদেশী ও বিদেশীদের চোখ ঝলসে, মন লুটে নিয়ে আবার দু’দিনের মধ্যেই মিলিয়ে যায়। গ্রীষ্ম এখানকার ‘মধুকাল,’ কয়েকমাস জুড়ে এখানকার নরনারীর চিত্তফুলবনে মধুচক্র রচনা করে। শীত নরকের শামিল। শীত আর গ্রীষ্মের মাঝখানে হেমন্ত। পূর্ণতা ও বার্ধক্যের প্রতিরূপ। সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর জুড়ে থাকে এই ঋতুটি। কবি কীটস তার বিখ্যাত কবিতা ‘Ode to Autumn’-এ ঋতুটিকে “Season of mists and mellow fruitfulness” বলে বন্দনা করেছেন।

একটি বছরে ইংলণ্ডের নানারূপই চোখে দেখলাম। দেখলাম বসন্ত কাল থেকে এখানকার সবুজের জীবনমুক্তি। গ্রীষ্মকালে সবুজেরা ভরা যৌবন। প্রকৃতি ও মানুষের দেহে মনে সে সবুজ আনন্দের আগুন ধরিয়ে দিয়ে গেলো। আমাদের সোনার বাংলার সবুজের ছড়াছড়ি নিয়ে জগৎসভায় আমরা করি গর্ব, কিন্তু ইংলণ্ডের গ্রীষ্মকালীন আভা ও লাবণ্য যে, দেখেছে সে আর এ গর্ব করবে না। এ দ্বীপটিতে খোদা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ঢেলে দিয়েছেন। আর খোদার ওপরে খোদকারী করেছে ইংরেজরা।

সারা ইংলণ্ডকেই বেহশতের একটি বাগানের মতো করে সাজিয়েছে এরা। ইংলণ্ডরূপী স্বর্গোদ্যানে একচ্ছত্র আধিপত্য করে রং-এর মধ্যে সবুজ। মার্চ থেকে এর আরম্ভ আর সেপ্টম্বরে এর পরিণতি। ক’মাস ধরে প্রাকৃতিক শোভা ধীরে ধীরে উপভোগ করলে মনে হয় হেমন্তকালে এখানকার সবুজ গাঢ় হ’তে হ’তে যেন ঘন নীল রূপ ধরে। চোখ আর তার দিকে মেলে রাখা যায় না। ধাঁধিয়ে আসে। তারপর আসে আবার রূপ বদলের পালা। হেমন্তকাল যেন জীবনের পরিণতির আর বিদায়ের বাণী ঘোষণা করতেই এসেছিলো।

বছর শেষ হয়ে আসছে। চাষীরা ফসল কেটে মেড়ে ঘরে তুললো। লোকেরা আসন্ন শীতের সঙ্গে যুদ্ধ করবার জন্যে কয়লা নিয়ে এসে ঘরে মুজদ করেছে। দখিনা বাতাস দিন দিন শীতের আভাস বয়ে নিয়ে আসছে। গাছের পাতা জীর্ণ হয়ে ঝরে পড়েছে। গাছগুলো নেড়া হতে চললো। আর কিছুদিন পরেই যেন জীবনের আভাস বদ্ধ হয়ে আসবে।

ছয়

বৃষ্টি-নেশাভা লণ্ডনের সন্ধ্যা বেলায় ছোট্ট ঘরটিতে বসে জানালার ফাঁক দিয়ে আকাশের দিকে চেয়ে আছি। যতদূর চোখ যায় শুধু দেখছি লণ্ডনের বাড়ীঘরগুলোর চিমনী থেকে ধোঁয়া বেরুচ্ছে। ধোয়ায় আর মেঘে ঢাকা লণ্ডন পাথরের মতো বুকের উপর চেপে বসেছে। মনে মনে ফিরে গেলাম আট হাজার মাইল দূরে, রাজশাহীর আর্যপল্লীর যে বাসাটায় আমার পরিজনেরা বাস করছে সেখানে।

ওখানে হয়তো এরও চেয়ে ঘন কালো মেঘ করেছে। বাংলাদেশের আষাঢ়ের মেঘ-যেমন গম্ভীর তেমনি কালো। হয়তো নেমেছে ঘন বর্ষা। অবিরল ধারা বর্ষণের মধুর রোল গানের অনুরণনের মতো কেঁপে কেঁপে তাদের হয়তো নিদ্রাকাতর করে দিয়েছে।

এখানকার মেঘ আমার দেশের মেঘের মতো অতো সুন্দর নয়। তেমন কালো হয়ে জমাট বাধে না। সারা আকাশ ছেয়ে গম্ভীর হয়ে পানির ভারে নুয়ে পড়তে চায় না। গুরুগম্ভীর মধ্বনি এখানকার মেঘে তেমন শোনা যায় না। বিদুৎ চমকায় না। বুকের মধ্যে বিভীষিকার সৃষ্টি হয় না। হঠাৎ আলোর ঝলকানি লেগে আশপাশ ঝলসে ওঠে না।

আমি এদেশের লোক নই। দেশে থাকতে বিলেত দেখার শত সাধ বুকে পোষণ করলেও বিলেতে এদের কোন জিনিসকেই তাই আপন করে দেখতে পারলাম না। এখানকার প্রকৃতির কথা পরে বলছি। কিন্তু এদের মেঘে কোনো বৈচিত্র্য দেখতে পাইনে। আমার শিক্ষয়িত্রী মিস্ ইভান্সের সঙ্গে এ নিয়ে যখন তর্ক করি তখন তার নিজের দেশের। প্রকৃতির কথা বলতে গিয়ে তাকে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠতে দেখি।

বছর খানিক আগে মিস্ ইভান্স ভারতে গিয়েছিলেন। দিল্লীর খররৌদ্রের তাপ ছিল তাঁর। অসহ্য। প্রতি সকালে উঠেই তার মনে হতো কোথায় তার ইংলণ্ড-আর ইংলণ্ডের আকাশ। মেঘের মধ্যে জেগে ওঠা আর কুয়াশা বরফ ও বৃষ্টির মধ্যে পথা চলা। ছেলেবেলা থেকে এ পরিবেশে তিনি মানুষ হয়েছেন। ছত্রিশ বছরের জীবনে নিজের দেশের এই আবহাওয়ায় ছত্রিশটি শীত-গ্রীষ্ম কাটিয়েছেন। হিন্দুস্থানের মাটিতে পা দিয়ে জ্বলন্ত রোদের তাপ সহ্য করে ইংলণ্ডের স্নিগ্ধ রোদ আর আঁধার ঘেরা কুহেলীর জন্যে তার মন কেন যে উতলা হয়ে উঠতো, আমার এক মাসের অভিজ্ঞতা থেকে আজ তা ভাল বুঝি।

মা, মাতভাষা আর মাতভূমির মতো আর কিছু কি এমন মিষ্টি আছে? সে জন্যেই বাংলাদেশের কথা বলতে গিয়ে বাংলার কবি লিখেছেন–

এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি,
সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভূমি।

গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত-এ ছয় ঋতুর লীলা নাকি আমাদের দেশে। কিন্তু এখানে শীত, গ্রীষ্ম ও বর্ষা ছাড়া শরৎ, হেমন্ত ও বসন্ত কখন আসে, কখন যায় তা চোখেই পড়ে না। আর বর্ষা সেতো সারা বছর লেগেই আছে। বেচারা শীতের বোধ হয় কেউ সাথী নেই। তাই সে আমাদের দেশেও একা। শরৎ, হেমন্ত ও বসন্তের কাজ তিনটি বড়ো ঋতুর পাশে থেকে সেতু যোজনা করা। ফারুনে কোকিল ডাকলে বসন্ত আসে, কি বসন্ত এলে কোকিলের সুর শোনা যায়, এ নিয়ে এখন হয়তো আমাদের দেশে আর কেউ তর্ক করবে না। আধুনিক কালের কোকিল বলেই নাকি সে দুপুর রাতে ডাকে। দিন দুপুরেও ডাকে। শীতেও ডাকে। বর্ষায়ও ডাকে তবু বসন্ত আসে তা বুঝতে পারি যখন দেখি গাছে সবুজের সমারোহ। পুরানো পাতা ঝরে যায় আর কচি কিশলয়ে কাঁপন লাগে। কিন্তু ফাল্গুন আসতে না আসতেই ঘোড়া ছুটিয়ে আসে চৈত্রের খর দিন।

ইংলণ্ডের বসন্তকাল কিন্তু ভিন্ন ধরনের। মার্চ মাস শেষ হতে না হতেই তরুলতায় পাতার মুকুল দেখতে পেলাম। আজ এ গাছে চাই তো দেখি যেখানে যতটুকু পাতা বেরোনো সম্ভব তাতেই অঙ্কুর গজিয়ে উঠেছে। কাল যদি খেয়াল করি তো দেখি আরও বেড়ে গেছে। পরের দিন দেখি আরও এমনি করে সপ্তাহ কি পক্ষ কালের প্রস্তুতির ভেতর দিয়ে শীতের প্রকোপে নিষ্প্রাণ তরুলতায় অকস্মাৎ একদিন প্রাণ সঞ্জীবিত হয়ে উঠতে দেখলাম। মূত্যের মধ্যে জীবন কি করে সঞ্চারিত হয় আর প্রকৃতিতে সে জীবন কি করে তরঙ্গায়িত হয় ইংলণ্ডে ঋতুরাজ বসন্তের সমাগম চোখে না দেখলে তা বিশ্বাস করা যায় না। সন্ধ্যায় এক রকম দেখি তো সকালে অন্য রকম। আরও সুন্দর, আরও ভালো। প্রকৃতির যে দিকে চাই সেদিকেই দেখি যেন সুন্দরের আগুন লেগে আছে।

ছোট ছোট গাছে পাতা নেই। শুধু ফল। অনাবিল সৌন্দর্যের এই খেলা দেখার জন্য এখানকার পার্কগুলোয় রাশি রাশি টাকা খরচ করা হচ্ছে। ডালপালার হাত পা মেলে দেওয়া আমাদের মাথা সমান উঁচু ফুলের গাছ সারি সারি সাজানো। কতকগুলোতে শুধু সাদা ফুল। কতকগুলোতে লাল, নীল, হলদে, বেগুনি। ভারি ভালো লাগে তার নীচে গিয়ে দাঁড়াতে। পুঁথিপত্রে বেহেশতের ফুল বাগানের এ ধরনের বর্ণনা পাওয়া যায়। ইংলণ্ডের বসন্ত আর গ্রীষ্মকাল দেখলে ইংলণ্ডকেই বেহেশত বলে মনে হওয়া কিছু বিচিত্র নয়।

রিজেন্ট পার্ক আমার বাসার কাছ থেকে মিনিট তিনেকের পথ। প্রকৃতির শিল্প সৌন্দর্যের দিক দিয়ে এটি লণ্ডনের সেরা পার্ক। এ পার্কের গোলাপের বাগানের খ্যাতি বিশ্বজোড়া। বাগানটি রাণী মেরীর নামের সঙ্গে জড়ানো। জুন, জুলাই এ দু’মাস গোলাপ ফুলের। সম্রাজ্ঞী মেরীর গোলাপোদ্যানের গোলাপেরা কেউ ফুটেছে-কেউ বা ফুটে রৌদ্র স্নানরত নরনারীর চোখ জুড়োচ্ছে, মন ভোলাচ্ছে। নানা রং-এর এতো গোলাপ এক সঙ্গে পাশাপাশি ফুটতে দেখলে নিতান্ত অরসিকের প্রাণও রসোচ্ছল হয়ে উঠবে তাতে বিচিত্র কি? রোদে ভরা ছুটীর দিনগুলোতে রিজেন্ট পার্ক ও কিউ গার্ডেনে এখানকার মালীদের হাতে গড়া গোলাপ বাগের জান্নাত পরিবেশ দেখে মন জুড়িয়ে যাচ্ছে। অপরিমেয় ফুলের রঙে চোখে লাগছে নেশা আর ফুলেরই মনোরম স্নিগ্ধ গন্ধে বাতাস হয়েছে মোহকর। এ মাধুরী তিলে তিলে উপভোগ করতে গিয়ে এর মাদকতার মধ্যে নিজেদেরকে এলিয়ে দিয়ে মধুর মধ্যে মৌমাছির মতো এরা যে কি ভাবে জড়িয়ে গেছে না দেখলে তা বোঝা যায় না।

বসন্ত ও গ্রীষ্মের এক এক মাসে এক এক রকম ফুল এখানকার বৈশিষ্ট্য। আবার একই ফুলের কতো যে বৈচিত্র্য তা বলে শেষ করা যায় না। এপ্রিল মাসে দেখলাম লাইলাক ফুলে রিজেন্ট পার্ক ছেয়ে গেছে। বেগুনী আর আসমানি রঙের লাইলাক। কবি এলিয়েটের বড় প্রিয় ফুল। মৃত্যুর ভেতর থেকে জীবনের বার্তা বয়ে নিয়ে আসে বলে কবি লাইলাককে বলেছেন জীবনের সঞ্জীবনী। আমারও লাইলাক ভালো লাগলো। তার কারণ ইংলণ্ডের এতো ফুলের মধ্যে শুধু লাইলাকেই গন্ধ পেলাম।

মে মাস ছিল টিউলিপ, উইলো, May’s Blossoms, চেষ্টনাট আর ডেইজীর। টিউলিপ আমাদের দেশের ধুতুরা ফুলের মতো। কেবল ফুলটুকু ছাড়া আর কিছুর সঙ্গে ওর সাদৃশ্য আঁকা যাবে না। পাতার সঙ্গে নয়, পাঁপড়ি বা দল কিছুরই সঙ্গে নয়। বাইরে কিছুটা সাদৃশ্য আছে, এতটুকু বলা যায়। আকারে টিউলিপ ধুতুরা ফুলের চেয়ে অনেক ছোট। বলিহারী যাই টিউলিপের রং দেখে। কোনো জায়গায় দুধের চেয়েও সাদা। কোনো জায়গায় রক্তের চেয়ে লাল। কোনোটায় বেগুনি, কোনোটায় জাফরানী, কোনোটায় ধূপছায়া। কোনোটা দুধে আলতা মাখানো। কোনোটা হলুদ। কোনোটায় থাকে প্রজাপতির গায়ের রেখাটানা বিচিত্র রংয়ের কারুচিত্র। থাকের পর থাক। টিউলিপে টিউলিপময়। ইংরেজ জাত শুধু নিজেদের স্বাস্থ্য ও সাম্রাজ্যের চর্চা করেনি, প্রকৃতিকে মুঠোর মধ্যে বন্দী করে তৃপ্তি পাবার অপরূপ ব্যবস্থাও করে রেখেছে। ফুলের যে এরা কি ভক্ত এবং ফুলের রঙে যে এদের কি আনন্দ এ থেকে এ কথাই বার বার মনে পড়ে।

এদের মেয়েদের অফিসে কাজ করতে হয়। বাইরে ছুটতে হয়। পুরুষের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলতে হয়। লম্বা চুল নিয়ে প্রসাধন করা তাই এদের ধাতসহ নয়। এদেশের মেয়েদের সৌন্দর্য সাধনার মধ্যে ইউটিলিটির প্রশ্ন জড়িয়ে আছে। তাই পুরুষের মতো এরা চুল হেঁটে চুলের মধ্যে নানা কারসাজি করে চুলকে করেছে ছোট। নারী এবং প্রকৃতি-দুইয়ের মিলে দেশের শোভা। নারী যখন তার দিকে বিদায় দিতে গিয়ে শ্রীকে কেটে ছোট করে আনলো তখন প্রকৃতিকে ভার নিতে হলো দেশের শ্রী রক্ষার। উইলো গাছের মাথা থেকে পা পর্যন্ত যে একরাশ চুল ঝুলতে দেখা যায় এও বোধ হয় সে জন্য। এদেশের মেয়েদের মাথার চুল হয় লাল, সাদা না হয় কটা! কালো ক্কচিৎ দু’একটির। তাই কালো চুলের জন্যে এদেশের লোকের এত আগ্রহ। কিন্তু উইলোর মাথার চুল সবুজ। আমাদের দেশের লাউ আর শসা গাছ মাচায় যে লতার সাহায্যে প্যাঁচ বাঁধিয়ে নিজেকে রক্ষা করে, উইলোর মাথায় চুল সে রকম লিকলিকে। লতার মতো। পাত্রী নেই, শুধু লতা।

মেজ ব্লসম মে মাসের খাস ফুল। গাছগুলো আমাদের দেশের মেহেদি গাছের মতো। কোনোটা কিছুটা বড়ো। কোনোটা বা ছোট ঝনঝনে গাছে পাতার সঙ্গে যেমন একহারা। হলুদ ফুল লেগে থাকে তেমনি মে’জ ব্লসম ফুলের রূপ। ফুলের চমৎকার রং বেশ চোখে লাগার মতো।

বাকী রইলো চেস্টনাট আর ডেইজী। বৃহতু ও ক্ষদ্রত্বের দিক থেকে দুটি দুই প্রান্তে। চেষ্টনাট কাঠবাদামের গাছ পার্কগুলোতে সুদক্ষ শিল্পর প্ল্যানমতো সারি সারি যে কত দাঁড়িয়ে রয়েছে তার শেষ নেই। শীতকালে যে ভাবে এরা শুকিয়েছিল, আমাদের দেশ হলে বেশ ভাল জ্বালানি হতো। কিন্তু বসন্ত আসতে না আসতে প্রকাণ্ড চেষ্টনাট গাছের পাতায় পার্কগুলো ছায়া সুনিবিড় হয়ে উঠলো। পাতার ফাঁকে ফাঁকে আমাদের কাশফুলের মতো শিষ মাথায় নিয়ে তাদের শ্বেতফুল বাতাসের ভারে থর থর করে কাঁপছে। একেই বলে জীবনের আবেগ। দৈত্যের মতো প্রকাণ্ড গাছ স্নিগ্ধতায় ও সৌন্দর্যে মাথায় একরাশ ফুল নিয়ে মনোরম হতে চাইছে।

মাটিতে যদি চাইছি-দেখছি ঘাসেও ফুল। অবিমিশ্র ঘাস কোথাও নেই। শিশির বিন্দুর মতো ফুলের অনন্ত শ্বেত কণিকা ঘাসের মুখ উজ্জ্বল করে রেখেছে। সবার পিছে, সবার নীচে, সবহারাদের মাঝে ঘাস এখানে ছোট হয়ে নেই। সবার আনন্দের ভাগ সেও যাতে ভোগ করতে পারে তার জন্যে তারও বুক ফুলে ভরে রয়েছে। এই ঘাস ফুলের অণু পরামাণুগুলোর নাম ডেইজী। অরি মেয়েদের কানফুলের মতো যেগুলো সেগুলো ক্রোকাস। মিষ্টতায় ভরা ফুল দুটো। পায়ের তলায় চুড় চুড় করে ভেঙে পড়তে চায়।

এপ্রিল, মে ও জুন-এই তিন মাসে ইংলণ্ডের সৌন্দর্য চোখ ভরে দেখেছি। এপ্রিলে এর সূচনা আর সেপ্টেম্বরে পরিণতি। জুন জুলাই আগষ্ট এখানকার গরম কাল। এখানকার গরম মানে আমাদের দেশের মাঘ বাদ দিয়ে তার আগের ও পরের মাসগুলোর শীত আর কি। তাও আবার একটানা নয়। দিনের কোন অংশ বেশ একটু গরম। ঘন্টা দুই পরে আবার ঠাণ্ডা। কখনো বেশী, কখনো কম। দিন কয় যদি এক রকম সহনীয় (সে জন্যই আমাদের কাছে আরামপ্রদ) গরম পড়লো তো আর দিন কয় আবার ঠাণ্ডা হয়ে গেলো। এই ঠাণ্ডা ও গরমের হারজিত খেলা নিয়ে ইংলণ্ডের গ্রীষ্মকাল। শীতের তুলনায় বড্ডো মিষ্টি

মনে পড়ছে ১৯৫০ সালের আঠারোই সেপ্টেম্বরের কথা। সেদিন ছেড়ে এসেছিলাম। শ্যামল সবুজ সোনার দেশ পূর্ব বাংলাকে। ঢাকা থেকে লণ্ডন উড়ে আসবার পথে এক জার্মানীর মিউনিক ছাড়া পূর্ব বাংলার সবুজের মতো সবুজের সঙ্গে আর কোথাও দৃষ্টি বদল হয়নি। লণ্ডনে পৌঁছে দেখেছিলাম তখনও গাছে গাছে পাতা ছিল। মাথায় একরাশ আঁকড়া চুল নিয়ে বিচিত্র ফুল ফুলের গাছগুলো তখনও সবুজের আভা ছড়াচ্ছিল। সেপ্টেম্বর মাস ইংলণ্ডে বয়সের ভারে জীর্ণ হয়ে আসে। ও মাসে এখানকার গ্রীষ্মের অন্তিম দশা বলেই নবাগত আমাদের চোখে তার বার্ধক্য-সুন্দর রূপ চোখে পড়েনি।

কিন্তু মে মাস থেকে ইংলণ্ডের প্রকৃতিতে একি শুরু হলো। আমাদের সবুজ এদের সবুজের কাছে ফিকে হয়ে যায়। আমাদের ধান ক্ষেতের ওপর দিয়ে বাতাস যখন ঢেউ খেলে যায় তখন হাল্কা মনোহর সবুজের কম্পন মাঠের প্রত্যন্তপ্রদেশে পর্যন্ত ছড়িয়ে যেতে দেখি। তাতে মন ভরে। চোখ জুড়োয়। এদের ধান ক্ষেত নেই, কেননা ভাত এদের খাবার নয়। পার্কের সবুজ আর নীল দৃশ্য দেখে লোভ হ’ল এদের গ্রাম আর মাঠের শোভা দেখতে। কোচে চড়ে সেদিন কেমব্রিজ বেড়িয়ে এলাম। আমাদের দেশের গ্রামছাড়া ঐ রাঙা মাটির পথ আমাদের মন ভুলোয়, কিন্তু এদেশের মাঠের মাঝখান দিয়ে পিচ ঢালা পথের বুকের ওপর দিয়ে বাদশাহী কোচগাড়ী যখন ছুটে চলে তখন দুপাশের গাছপালার সবুজ ফুলের অনন্ত বৈচিত্র্য আর লতাপাতার ঘননীলিমা চোখের ওপর মধুর-মায়া অঞ্জন লাগিয়ে দিয়ে যায়। দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ। খাড়া উঁচু, সোজা নীচু বা একটানা সমতল নয়। লালচে আঠার মতো চিকন মাটির উঁচু নীচু তরঙ্গ তুলে তার বুকের ওপর একটু জিরিয়ে নেবার জন্যে আমাদেরকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। তাতে কোথাও বাজরার ক্ষেত। কোথাও সরিষার ফুলের মতো সারা মাঠ ছাড়ানো ফিকে আর গাঢ়ো হলুদের বিছানা পাতা। সব কিছু যেন প্ল্যান করা। খাড়া টিলে। তার মাথায় কত কালের ঘন বন। আপনা থেকে গজিয়ে উঠলেও মনে হচ্ছে যেন কুশলী হাতের পরশ পেয়ে থরে থরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার পাশে গোচারণ ভূমি। তার নীচে বহু বিচিত্র শস্যক্ষেত। অপরূপ শ্যামলে সবুজে, বেগুনে হলুদে, নীলে লালে আর বিচিত্র আভায় প্রভায় গায়ে গায়ে লেগে থেকে সৌন্দর্যের সে কি প্লাবন বইয়ে দিচ্ছে। প্রকৃতির এতো রূপ এতো নিটোল স্বাস্থ্য, মে জুনের ইংলণ্ড না দেখলে কখনও কি তা বিশ্বাস করা যায়?

সব চেয়ে ভালো লাগছে এখানকার মানুষগুলোর অবসর বিনোদনের পালা দেখে। সোম থেকে শুক্র পর্যন্ত ভূতের মতো এরা কাজ করে। আর শনি রবিবার জীবনের লঘু স্বচ্ছ দিকে নজর দেয়। মনকে সহজ ভাবে ছেড়ে দিতে পারার মধ্যে বোধ হয় এরা অদ্ভুত মাদকতার স্বাদ পায়। সপ্তাহের শেষের এ দু’দিন ধরে এরা দেহ ও মনকে দেয় বিশ্রাম আর লঘু পরিহাস রসের ভেতর দিয়ে করে জীবনী-শক্তির সঞ্চয়। ব্যক্তি ও জাতীয় জীবনকে সমৃদ্ধ করে তোলার জন্যে আর পাঁচ দিন ধরে সেই জীবনীশক্তির করে ব্যয়। এদের মতো দায়িত্বশীল জাত পৃথিবীতে দুটো নেই। যার যতটুকু কাজ সুদে আসলে তার সবটুকু সুন্দর করে নিজের মনেই সে করে যাবে। কাউকে কিছু বলতে হবে না। কোনো তাগাদা দিতে হবে না। জীবন শুধু কাজে নয়, শুধু ঢিলে অবসর বিনোদনেও নয়। বিশ্রাম না নিলে, স্বাস্থ্য চর্চা না করলে, সাতদিনের এক দিনও হালকা ছন্দে নিজেকে ভাসিয়ে দিতে না পারলে মানুষের দেহের মেশিন মনের সঙ্গে সমান তালে চলতে পারে না। ইংরেজরী জীবনে কাজ করবার জন্যেই সপ্তাহে দুটো দিন এমন করে আনন্দস্রোতে ভাসবার চেষ্টা করে।

এসে অবধি ক’টা মাস সূর্যের মুখ ভালো করে দেখতে পাইনি। মন তাই বড়ড়ো ভার হয়ে থাকতো। ঘোলাটে আঁধারের ভেতর থেকে সূর্যের ক্ষীণ হাসিটুকু একটু ক্ষণের জন্যে চোখে পড়লেও মনের ভার কিছুটা হালকা হতো। জুন মাসের ইংলণ্ড সম্বন্ধে আমার ধারণী বদলাচ্ছে। এ মাসটিতে সবই মনোহর। সবই এ ক’মাসের ধারণা আমার বদলে দিলো। সকাল চারটায় সূর্য উঠে যায়। রাত্রি দশটায় সন্ধ্যা হয় না। শীতকালে বেলা তিনটায় রাত হতো। একে মেঘের আঁধার। তাতে রাতের আঁধার। তাই বাতি জ্বালিয়ে দোকানপাট চলতো, অফিসের কাজ-কাম হতো। বাতি জ্বালিয়েই দিনের বেলা স্কুল কলেজের লেখাপড়া চলতো। কিন্তু এখন রাত্রি দশটা পর্যন্তও সূর্যের আলোতে ঘর ভরে থাকে। তাই দিনের বেলায় খেয়ে-দেয়ে ছেলেমেয়েদের রাতের ঘুম ঘুমুতে হয়।

সে যা হোক। সূর্যের স্নিগ্ধ রোদে ক’দিন থেকে সারা ইংলণ্ড বিধৌত হচ্ছে। নর নারীর শরীর থেকে শীতের কাপড়ের ভার নেমে গিয়ে স্বভাব-ছন্দে তাদের চলার সুযোগ দিয়েছে। মানুষের মুখে হাসি দেখতে পাচ্ছি, সবচেয়ে ভাল লাগছে এখানকার মেয়েদের স্বাস্থ্য। দুঃখ হয় আমাদের দেশের মেয়েদের কথা ভেবে। ঘরের কোণে চিরবন্দিনী তারা। ধর্ম আমাদের যতটুকু না শাসন করলো, আমাদের দেশের অন্ধ সংস্কার তারও চেয়ে বেশী করে খোদার দেওয়া দুনিয়ার আলো বাতাস থেকে তাদের করলো বঞ্চিত। আর মেয়েরাও এমন যে, জীবনে অধিকার পেলেও তারা এতকালের সংস্কার ছেড়ে সহজভাবে জীবনকে গ্রহণ করতে পারলো না। এদের সমাজ ব্যবস্থার জন্য এরা জীবনকে সহজভাবে গ্রহণ করতে পেরেছে। সমাজ রাষ্ট্র ও সংসার জীবনে প্রতিপদে নারী পুরুষের সমকক্ষ বলে এদের নারী জীবন পথে মুক্তছন্দে ভাসতে পেরেছে। এদের মন্দ দিক নয় বরং যেটা ভালো সেটা যদি আমরা গ্রহণ করতে পারি তাতে আমাদের দেশে মঙ্গল বৈ অমঙ্গল নেই। কিন্তু যা বলছিলাম। এ মাসটা ধরেই দেখছি প্রতি শনি রবিবারে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত শুধু মাত্র প্রয়োজন মতো কাপড়-চোপড় প’রে বাড়ীর কর্তা গিন্নী থেকে আরম্ভ করে ছোট কচি বাচ্চারা পর্যন্ত পার্কে এসে রোদ পোয়াচ্ছে। রোদ স্বাস্থ্যের জন্য অতি প্রয়োজনীয়। সূর্য যখন এতোকালের কৃপণতার পর মাস খানিক ধরে অকৃপণভাবে আলো দিতে লেগেছে তখন তার কিরণ তো মন প্রাণ ভরে পান করা চাই।

প্রকৃতিতে যখন এমন সৌন্দর্যের সমারোহ, বিচিত্র-রঙে যখন সারা ইংলণ্ড রাঙা হয়ে উঠলো, সবুজে নীলে মিতালি পাতানো যখন স্বদেশীদের তো বটেই, আমাদের মতো বিদেশীদের মনেও এদেশকে ভালোবাসার নেশা জাগালো তখন প্রকৃতির প্রাণ-সঞ্চারক সূর্যের আলো, এ স্নিগ্ধ মধুর কিরণ মনপ্রাণ ভরে পান না করলে খোদার দেওয়া এ নেয়ামতের মূল্যই হৃদয়ঙ্গম করা যাবে না। তাই বুঝি ইংলণ্ডে এতো পার্ক। এত ফুল। এতো বিশ্রামকুঞ্জ। আর গ্রীষ্মকালকে কেন্দ্র করে মর্ত্যজীবনের মাধুরী পানের এতো আয়োজন। ইংলণ্ডের গ্রীষ্মকালের খ্যাতি দুনিয়াজোড়া। শীতের মতো প্রাণ-সংহারক বলে নয়, মিগ্ধ রোদে-ভরা মধুর বলে।

সাত

একদিন গেলাম ‘ফয়েল্‌স’-এ। ‘ফয়েল্‌স’ পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো বইয়ের দোকান। লণ্ডন চেয়ারিংক্রস রোডের ওপর অবস্থিত। প্রতিদিন হাজার হাজার বই বিক্রি হচ্ছে, তবু লাখ খানেক বই সব সময় ওদের ঘরে মজুদ থাকে। এ থেকে বোঝা যায় দোকানটি কত বড়ো। এর নানা বিভাগ। এক এক ভাগে এক এক রকম বই। ভ্রমণ বিভাগে গিয়ে কিনলাম বার্নার্ড শ’র সর্বশেষ ছড়ার বইটি। শ’ তার নিজের গ্রামের নানা জিনিসের নানা ছবি তুলছিলেন। প্রতেকটি ছবির নীচে তার নিজের লেখা ছোট ছোট একটি করে কবিতা। আপন দেশ ও গ্রামের প্রতি ভালোবাসার ছাপ বহন করছে। কবিতাগুলো অত্যন্ত সহজ ভাষায় লেখা। তাতে তার শেষ জীবনের আবেগ নিজের গ্রামের ছোটখাট জিনিসের প্রতি ঝরে পড়েছে। তারএ ছড়াগুলো বুঝতে আমাদের শিশুদেরও অসুবিধা হবে না।

এ বিভাগ থেকেই কিনলাম পৃথিবীর একটি ‘ওয়াল ম্যাপ’। এ বিরাট বিচিত্র পৃথিবীতে কতো রকমের দেশ এবং প্রতি দেশে কতো বিচিত্র মানুষ বাস করছে ম্যাপের দিকে চাইলেই তা জানবার কৌতূহল জাগে। ভূগোল পড়তে গেলে সে কৌতূহল হয় আরও তীব্র। সে জন্যেই ছেলেদের জন্যে অমন আকর্ষণীয় করে ‘ওয়াল ম্যাপ তৈরী করেছে এরা। সাগর, মরুভূমি পাহাড়, পর্বত আর মানুষের বাসস্থান, এ নিয়েই তো বিশাল পৃথিবী। মানুষ যে দেশে বাস করে শুধু সে দেশের ম্যাপটি দেখলে তার মনে নিজের দেশের বিরাটত্ব সম্বন্ধে গর্ব হওয়া স্বাভাবিক। দুনিয়ার ম্যাপ অনবরত কাছে থাকলে আর তার ওপর নজর বুলালে তখন অন্যান্য দেশের তুলনায় নিজের দেশের আয়তন মনের মধ্যে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আর দুনিয়ার অন্যান্য দেশগুলোর কথা জানবারও আগ্রহ হয়। ষ্ট্যাম্প সংগ্রহ করার অভ্যাস থাকলে বিভিন্ন দেশের ষ্ট্যাম্প নাড়তে নাড়তে সে সব দেশ এ রকম দুনিয়ার ম্যাপ থেকে চোখের সামনে ভেসে ওঠে। আর সমগ্র পৃথিবীতে জলভাগের তুলনায় স্থলভাগ যে কতো অল্প সে কথাও প্রতিক্ষণে ভালো করে মনে পড়ে যায়।

এর পরে গেলাম ছেলেদের বিভাগে। সেখান থেকে নার্সারী রাইমের একটি বই কিনলাম। যেখানে কচি বাচ্চাদের রাখা হয়, ইংরেজীতে তাকে বলা হয় নার্সারী। বিলেতে নিজ বাড়ীতে ছেলেমেয়ে খুব কম হয়, হাসপাতালেই তার সমস্ত আয়োজন। তারপর তাদেরকে রাখবার নানা জায়গা এবং স্কুল আছে। বাচ্চারা কিছুটা বড়ো হতে থাকলে তাদেরকে সেখানে রাখা হয়। এ ধরনের নার্সারীগুলোতে নানারকম ছড়া বলে তাদের আনন্দ দেবার ব্যবস্থা করা হয়। বিলেতের সব শিশুই যে ও রকমভাবে মানুষ হয় তা নয়, তবু ছড়াগুলোর উৎপত্তি এ রকম ভাবেই হয়েছে। এখন সারা দেশময় এগুলো ছড়িয়ে গেছে। সারা দেশের মায়েরা বা মেয়েরা ছেলেমেয়েদের এ সব ছড়া বলে সোহাগ করে ঘুম পাড়ায়।

নীচে ছেলে ভুলানো দুটি ইংরেজী ছড়ার নমুনা দেওয়া গেল—

(১)

Dance to your Daddy
My little baby;
Dance to your Daddy
My little lamb.
You shall have a fishy:
In a little dishy;
You shall have a fishy
When the boat comes in.

নীচের ছড়াটি আরও সুন্দর ও সুরময় :

(২)

Robin Hood, Robin Hood,
Is in the mickle wood?
Little John, Little John
He to the town is gone.
Robin Hood, Robin Hood.
Is telling his beads.
All in the green woods.
Among the green weeds,
Little John, Little John,
If he comes more
Robin Hood? Robin Hood,
He will fret full sore!

আমাদের দেশেও যে এ রকম ছেলে ভুলানো ছড়া নেই তা নয়। যেমন

ছেলে ঘুমালো পাড়া জুড়ালো, বর্গী এলো দেশে
বুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনা দিব কিসে!
ধান ফুরালো পান ফুরালো খাজনা দিব কি
আর কটা দিন সবুর কর রসুন বুনেছি

কিংবা,

দোল দোল দোলনি,
রাঙ্গা মাথায় চিরুণি
বর আসবে এখনি
নিয়ে যাবে তখনি
কেঁদে কেন মরো
আপনি বুঝিয়া দেখ
কার ঘর করো।

এ ধরনের ছেলে ভুলানো ছড়া দুনিয়ার সব দেশেই আছে। নার্সারী রাইম ইংলণ্ডেব সেই ছেলে ভুলানো ছড়া। এ দেশের ছেলেদের মন কি ভাবে গড়ে ওঠে, দোলনার সুরের সঙ্গে মায়েরা কি ভাবে ছেলেদের সোহাগ করে এ নার্সারী রাইমগুলো থেকে তার কিছুটা আভাস পাওয়া যায়।

এদের শিশু বিভাগ থেকে ‘স্লিপিং বিউটি’ বলে আর একটা ছবির বই কিনলাম। গল্পটি ছবির সাহায্যে বলে দেওয়া হয়েছে। গল্পের অর্থ উদ্ধার করার জন্যে ছবিই শিশুদের পথপ্রদর্শক। আমাদের দেশে ছেলেমেয়েদের এ সুবিধা কোথায়? আমাদের যারা বই লেখেন তাদের অধিকাংশেরই দূরদৃষ্টির অভাব আছে বৈকি? শিশুমনের উপযোগী করে ছবি দিয়ে সরল ভাষায় তাদের মনোরঞ্জন করার কোন ব্যবস্থা তারা করতে পারেন না। এযে শুধু লেখকদের দোষ তা নয়, প্রকাশকরা আজও যথারীতি বই-এর ব্যবসা শিখলেন না। কলকাতাতে তবু কিছুটা হয়, আমাদের কথা আর না-ই বললাম। বিলেতের সঙ্গে তুলনা করে তা নিয়ে দুঃখ করি না। শিক্ষার প্রসারের সঙ্গে দু-দশ বছর পরে হলেও এ পথ ধরে আমাদের এগোতে হবে, নইলে আমাদের দেশের উন্নতি হবে কি করে?

তার মন কি চায় কোনো দেশের শিশুই তা নিজে বুঝে না। অদ্ভুত রহস্যময় তাদের মনোজগৎ! বয়সের সঙ্গে সঙ্গে এক একটি নতুন জিনিস যখন তাদের দৃষ্টিপথে পড়ে, নতুনের সঙ্গে পরিচয়ে মনের কলি যখন প্রতিদিন বিকশিত হয়ে থাকে, তখন কি যে আনন্দ হয় তাদের, সে আনন্দ শুধু শিশুমনেই ধরা পড়ে। বড়োদের তাতে কোনো আকর্ষণ থাকে না। এ কারণেই শিশুর জগৎ স্বতন্ত্র। অত্যন্ত সাধারণ অথচ দুয়ে। শিশুমন তৈরী করার জন্যে ইংলণ্ড শিশুসাহিত্যের প্রতি যে ভাবে নজর দিয়েছে, তা দেখে এ জাতের প্রতি ভক্তিমুগ্ধ হয়ে যাই।

বাদশাহ হারুনর রশীদের সময়ের মুসলিম জগতের ‘হাজার এক রাত্রির’, বা ‘আলেপ লায়লার গল্প বাংলাতে আমরা যাকে বলি আরব্য উপন্যাস, শিশুমনের উপযোগী করে ইংলও তার যে কতো সংস্করণ করেছে তার ঠিক পাইনে। তার ইংরেজী কত সহজ। এমনি করেই তো এরা আপন ভাষা শেখে। জগতের সেরা জিনিসগুলো সম্বন্ধে এদের ছেলেমেয়েদের ধারণা হয়। দুনিয়ার সাহিত্যে যেখানে যা কিছু ভালো জিনিস আছে আগে ওদের ছেলেমেয়েদের উপযোগী করে এরা তার একটা সংস্করণ করবে, পরে অন্য কথা। জার্মানীর গ্রি’স ফেয়ারী টেলস্, সুইসফ্যামলী রবিন্সন, স্ক্যানডিনেভিয়ার হ্যাঁন্স্ এ্যাণ্ডারসনের পরীর গল্প, এসব তো দুনিয়ার সেরা শিশুসাহিত্য। আমাদের দেশের ক’জন। অভিভাবক এ সব বইয়ের নাম জানেন? আর কটা ছেলেমেয়েরই বা পৃথিবী বিখ্যাত এসব গল্পের বই পড়ার সৌভাগ্য হয়?

ইংরেজ জাতের মতো এমন নিশ্চুপ জাত দুনিয়াতে আর নেই। মনে হয় এরা যেন বোবা। আমাদের দেশের রাস্তাঘাটে চেনা অচেনা লোককে দু’দণ্ড দাঁড়িয়ে বেশ আলাপ করতে দেখি। সাধারণ কুশল থেকে শুরু করে মায় চাকুরী বাকুরীর মাইনে ও হাঁড়ির খবর পর্যন্ত জিজ্ঞেস করতে দেখি। এতে যে জিজ্ঞেস করে এবং যে জবাব দেয়-দু’জনেই সমান অংশ গ্রহণ করে। সমান আনন্দ পায়। আমাদের দেশের মানুষের জীবন ধীর, শান্ত। মন্থরতায় ভরা। চলছে তো চলছেই। গল্প করছে তো করছেই। শিক্ষা নেই। তাই রাস্তায় দাঁড়িয়ে এতো সময় হেলায় অপচয় করতে পারে। ঘরে বসে অকারণ পরচর্চায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিতে পারে। যৌবনে অনাবশ্যক অলস কল্পনায় মূল্যবান সময় নষ্ট করতে পারে। জীবনের গতি যেখানে গরুর গাড়ীর মতো সেখানে সময় সম্বন্ধে টনটনে জ্ঞান। আমাদের দেশের লোকের কি করে হবে? অদ্ভুত এ ইংরেজ জাত। রাস্তায় বেরোলে দেখি শুধু জন ও যানস্রোত চলছে। নদীস্রোতের মতোই তাদের গতি। কোথাও বিশ্রামের অবকাশ নেই। সুতরাং পথে দাঁড়িয়ে পরিচিত লোকেরাও যে একটু সুখ-দুঃখের গল্প করবে তার আর ফুরসৎ কোথায়? ট্রেনে, বাস টিউবে হাজার লোক পাশাপাশি বসেছে। আমাদের দেশের মতো কেউ কারো সঙ্গে গল্প করে না। ট্রেন কিংবা জাহাজে চলতে গিয়ে কেউ কারুর খবরের কাগজটাও চেয়ে পড়ে না। একজনকে খবরের কাগজ পড়তে দেখলে আর একজন গলা বাড়িয়ে তার খবরের কাগজের উপর নজর দেয় না। অদ্ভুত আত্মনির্ভরশীল স্বাধীন জাত। এ শিক্ষা তারা মা বাবার কাছ থেকে শিশু বয়স থেকেই পেয়ে আসছে। শৈশবে তারা যা শেখে, সারা জীবনে জ্ঞাতে অজ্ঞাতে তারই চর্চা করে যায়।

একটি ইংরেজ পরিবারের সঙ্গে আলাপ হলো। তাদের বাড়ীতে ছোট ছোট চারটি ছেলেমেয়ে আছে। তারা যে গোলমাল করে না, তা নয়। তবে আমাদের শিশুদের মতো অতোটা নয়। যতটুকু করে তাতেই দেখি ওদের মা-বাবারা অতিষ্ঠ। তাই বলে আমাদের মতো ওরা ছোটদের পিঠে গোটা দু’চার রাম কিল বসিয়ে দেয় না। তাদেরকে বাগ মানাবার স্বতন্ত্র কৌশল ওরা আবিষ্কার করেছে। যে ছেলেমেয়ে বাড়ীতে যতো কম গোলমাল করবে তার জন্যে পুরস্কারের ব্যবস্থা রয়েছে। আমাদের দেশে ছেলেমেয়েদের মধ্যে যেখানে গোলমালের প্রতিযোগিতা চলে সেখানে এদের চলে চুপ থাকার প্রতিযোগিতা।

এ শুধু একটি বাড়ীর ধর্ম নয়। ইংরেজ জাত এমন করেই তাদের ছেলেমেয়ে মানুষ করে। ছেলে বুড়ো সকলের জন্যেই আশ্চর্য হাসির খোরাক থাকে এখানকার নাম করা ‘পাঞ্চ (Punch) নামক একটি পত্রিকায়। শিশুমনের একটি চমৎকার অদ্ভুত ব্যাপার দেখলাম তাতে। গত সিকি শতাব্দীর মধ্যে ইলংকে দু’দুটো মহাযুদ্ধের তাল সামলাতে হয়। ফলে আগে যেখানে এদের জীবনে ছিল স্বচ্ছন্দ-সচ্ছলতা, এখন সেখানে প্রতি পরিবারেই খরচপত্রের টানাটানি দেখা যাচ্ছে। শিশুদেরও চুপ থাকার জন্যে বৃত্তি ও পুরস্কার তাতে করে ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। কতকগুলো শিশু এরই জন্যে এক কনফারেন্সে মিলিত হয়েছে। তাদের একজনের এক এক রকম মস্ত অভিযোগ। একজন বলছে, ড্যাডির জুতোটা এনে দিলে আগে যেখানে ছু পেনি বকশিস পেতাম এখন সেখানে কমে গিয়ে হয়েছে দু’পেনি। আর একজন বলছে, মা যখন রান্না করে তখন আমি চুপ করে থাকলে তার জন্যে আগে বখশিশ পেতাম দু’পেনি; এখন পাই তার বদলে শুধু মিষ্টি কথা। এমনি করে সকল শিশু মিলে তাদের মা-বাবার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে। এর প্রতিকার কিভাবে করা যায় তা ভাবছে। শেষে ঠিক হলো, ট্রেড ইউনিয়নের মতো একটি মিলিত ফ্রন্ট খোলার আর স্ট্রাইক করার কথা। যুদ্ধের ফলে এদের সাধারণ মানুষের জীবনের মানও যে কতোটা নেমে এসেছে, বড়োদের লেখা শিশু মনের সুন্দর প্রকাশ থেকে তা বেশ বোঝা যায়। আরও। দেখি শিশু বয়স থেকে এরা কি করে চুপ করে থাকতে শেখে। বড়ো হবার সঙ্গে সঙ্গে চুপ। থাকাটা তাদের স্বভাবে পরিণত হয়। তাই দেখা যায় এরা কথা বলতে জানে না। পাশাপাশি ঘরে ইংরেজদের সঙ্গে সারা জীবন কাটিয়ে দিলেও ওরা যেচে আলাপ করবে না। তাই বলে যে ওদের মায়া মমতা নেই, প্রাণ নেই তা নয়। একবার যদি ওদের সঙ্গে নিজে এগিয়ে গিয়ে কোনো রকম আলাপ করতে পারা যায়, তা হলে দেখা যাবে ওরাই সব চেয়ে বড়ো বন্ধু হয়ে গেছে। ইংরেজ চরিত্রের এ বৈশিষ্ট্যের জন্যেই আজও এরা এতো বড়ো।

আট

ছেলেমেয়েদের প্রতি মা-বাবার স্নেহ যত্ন তাদের জীবনের পথে এগিয়ে যাবার জন্যে কতো যে উপকারী, আমাদের দেশের অধিকাংশ মা-বাবাই তা জানে না। ছেলেমেয়েদের স্কুলে দিয়ে দিলেই গতানুগতিক ভাবে দিন আসে, দিন যায়। আসে পরীক্ষার পর পরীক্ষা। ছেলেমেয়েরা হয়ত পাশও করে। ওপরের ক্লাশে ওঠে। মা-বাবা মনে করে ছেলে-মেয়েদের বেশ লেখাপড়া হচ্ছে। তাদের কর্তব্য পালন করা হচ্ছে। তাতেই তারা সান্ত্বনা পায়। ধনী ও সচ্ছল মধ্যবিত্ত পরিবারে দেখি অনেকে তাদের পুত্রকন্যাদের জন্যে গৃহ শিক্ষকও রাখে। তাতে মা-বাবার সান্ত্বনার পরিমাণ বাড়ে। সন্তানের প্রতি দায়িত্ব শোধ হলো বলে তারা আরও বেশী আনন্দ পায়। অর্ধশিক্ষিত এমন কি শিক্ষিত পরিবারেও দেখেছি মা-বাবা ধমূকে ধমকে তাদের শিশু সন্তানদের পড়তে বসায়। কাছে বসে তাদের পড়াশুনার অতি তদারক করতে গিয়ে শেষে মারধর করে মনে করে বেশী পড়ানো হলো। এতে ছেলেমেয়ের পড়াশোনা তো হয়ই না, পড়াশোনার প্রতি ভালোবাসা বা আগ্রহও তাদের জন্মে না। বরঞ্চ, পড়ার নামে ঐ কাঁচা বয়সে তাদের রীতিমতো ভয় ধ’রে যায়। ফলে আমাদের দেশের যে কতো অগণিত শিশুমতি বালক-বালিকা জ্ঞানরাজ্যের দ্বার পর্যন্ত পৌঁছতে পারে না তার হিসাব আর কে রাখে? তাছাড়া লেখাপড়ার জন্যে যে পরিবেশের প্রয়োজন আমাদের দেশে কয়টা বাড়ীতেই বা তা আছে? যে বাড়ীতে একসঙ্গে তিন চারটা ছেলেমেয়ে ভাইবোন। পড়ছে, একত্রে পড়তে বসলে তারা তো চেঁচিয়ে পড়তে গিয়ে হাট বসায়। এর ওপরে আছে পড়াশুনার স্বতন্ত্র ঘরের অভাব। যেখানে ছেলেমেয়েরা পড়ছে সেখানেই হয়তো অভিভাবকেরা, সদাশয় গুরুজনেরা বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে সংসারের কথাবার্তা আরম্ভ করলেন। ব্যবসা-বাণিজ্যের হিসেব নিকেশ করলেন, বাজারের ফর্দ তৈরী করলেন কিংবা প্রতিদিনের আলাপ-আলোচনা করলেন। পড়ুয়াদের কচি মন বই-এর পাতায় আর গেলো না। তারা। পার্শ্বের গল্প সল্প, হাসিঠাট্টা, মশকরা ও ইয়ারকির দিকে সহজেই আকৃষ্ট হলো। এতো সব অসুবিধা ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের ভেতর দিয়েও যে আমাদের দেশের কিছু ছেলেমেয়ে লেখাপড়া শিখে বড়ো হচ্ছে, তাদের কথা ভাবলে সত্যিই আশ্চর্য হয়ে যাই! তারা যতো না পরিবেশের সৃষ্টি, তার চেয়ে বেশী তারা দেশের প্রতি খোদাতায়ালার দান।

যদি কোনোদিন আমাদের দেশের সব ছেলেমেয়ে যথার্থ লেখাপড়া শিখে মানুষ হয় সে। দিন হয়তো তাদের ছেলেমেয়ে কি নাতি-নাতনীরা আর অসুবিধায় পড়বে না। তাই মনে হয় দেশের সকলের শিক্ষা ছাড়া দেশের কোনো কল্যাণই হতে পারে না।

এখানে দেখছি, এরা এদের ছেলেমেয়েদের মানুষ করার জন্য কি যত্ন না নিচ্ছে। যারা আজ শিশু কিছু দিন পরে তারা বড়ো হয়। বুড়ো হয়। বুড়োরা শিশুদের জায়গা ছেড়ে দিয়ে বিদায় নেয়। এজন্যে এদের দেশে এদের কালের শিশুদের মানুষ করে গড়ে তুলতে এমন করে মন দিয়েছে। শিশু মায়ের পেটে থাকতেই মায়ের এবং শিশুর যত্ন নিতে শুরু করে এখানকার সরকার। এদের সরকার সত্যিই জনসাধারণের সরকার অর্থাৎ এদের প্রত্যেকটি লোকের যাতে ভালো করা যায় সে জন্যেই প্রাণপণ চেষ্টা করে সরকার। এদেশে বিনা চিকিৎসায় কেউ মারা যেতে পারবে না। অসুস্থ হলে বাড়ীর নিকটবর্তী ডাক্তারের কাছে কিংবা হাসপাতালে যাও। ডাক্তারের ভিজিট লাগে না। সরকার তাকে বেতন দিচ্ছে। লোকের উপকারের জন্য আছে ডাক্তার। ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসে ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন নিয়ে যে কোন ঔষধের দোকানে গেলে বিনা পয়সায় ওষুধ পাওয়া যাবে। যে জাত রোগের হাত থেকে মানুষকে বাঁচানোর জন্যে এতোটা করে যাচ্ছে সে জাত তার ভবিষ্যৎ বংশাবলীর স্বাস্থ্য যাতে ভালো হয় তার জন্য চেষ্টা করবে, সে তো জানা কথা।

এখানে শিশুর জন্মের আগে থেকেই তার মার যত্নের ভেতর দিয়ে শিশুর যত্নের শুরু হ’লো। তখন খাওয়া দাওয়া, পথ্যাপথ্যের দিকে নজর রাখা এবং শরীরের কি পরিমাণ উন্নতি হচ্ছে সে জন্যে নিয়মিতভাবে ওজন নেওয়ার কতো কতো যে বন্দোবস্ত এদেশের আছে, দেখে তার কূল পাইনে। ধনী দরিদ্র নির্বিশেষে প্রতি শিশুকে তার একটা নির্দিষ্ট বয়স অবধি কমলার রস, খাঁটি মধু এবং নানা পুষ্টিকর খাবার বিনামূল্যে বিতরণ করে এদেশের সদাশয় সরকার। ছয় সাত কি আট বছর পর্যন্ত এক একটা শিশুকে মনে হয় একেবারে পুতুলের মতো। চেহারা যেমনই হোক তার স্বাস্থ্য ও শরীরের গড়নের দিকে দেখলে শুধু চেয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। শিশুর কমনীয়তা, লাবণ্য ও স্বাস্থ্য ইংলণ্ডে যেমন দেখা যায় ইউরোপের অন্য কোন দেশে আবার তেমনটি নয়। প্যারিসেরও শিশু দেখলাম, কিন্তু ইংলণ্ডের শিশুদের মতো এমন ‘ঢল ঢল কাঁচা অঙ্গের লাবণি’ আর কোথাও নজরে পড়লো না।

এ ছাড়া ইংলণ্ডের অধিকাংশ মা-বাবাই তাদের নিজেদের শিশু সন্তানের প্রতি যথাবিহিত নজর রাখে। এখানকার শিশুদের জন্যে অবৈতনিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক। কিন্ডার গার্টেন এবং মন্টেসরী প্রথায় এদের শিশুরা লেখা পড়া শেখে। শিশুদের এ স্কুলগুলো শিক্ষার দিক থেকে দুরন্ত শাসনে বাধা নয়। এগুলো তাদের খেলা ঘরের মতো। যে সব মা-বাবা জাতীয় জীবনের এবং নিজেদের আর্থিক উন্নতির জন্যে বাইরের কাজ করতে বাধ্য হয় তারা হয়তো নিজেদের শিশুদের দিকে তেমন নজর দিতে পারে না; এমন মা-বাবারা তাদের ৩/৪ বছরের শিশুদের নার্সারীতে পাঠায়। নার্সারী এবং কিণ্ডার গার্টেন স্কুলগুলোতে নানা রকম খেলাধূলা ও খাবার দাবারের আয়োজন আছে। স্কুল থেকেই বিনা খরচায় তাদেরকে ছড়া ও পড়ার বই দেওয়া হয়। খেলাধূলা ও পড়াশোনা হয় স্কুলের ভেতরেই। স্কুলের বাইরে গেলে কি বাসায় ফিরে এলে স্কুলের পড়াশোনার জন্যে তাদের আর দুর্ভোগ পোয়াতে হয় না। শিশুরা স্কুলের নামে উৎফুল্ল হয়। আমাদের দেশের মতো পড়াশোনা শিশুদের ওপর ভার হয়ে দাঁড়ায় না। সেখানে স্কুল জীবন এবং পড়াশোনা তাদের অফুরন্ত আনন্দের উৎস হয়ে রয়েছে।

মা-বাবারা তাদের শিশুদের যাতে মারধর না করে তার জন্য শিশুদের প্রতি নিষ্ঠুরতা নিবারণী (Society for Preventing Cruelty to Children) বহু সমিতি আছে। মা বাবাদের অযথা উৎপাত থেকে এ সমিতিগুলো শিশুদের রক্ষা করার ব্যবস্থা করে। শিশুদের ওপর কর্তত্বের সীমা লঙ্ঘন করলে মা বাবাদের অনেক সময় শাস্তিও পেতে হয়। আমাদের কাছে এ খবর যেমন বিস্ময়কর তেমনই অদ্ভুত।

শিশুদের যথারীতি মানুষ করে তুলবার জন্যে এদের মনের দিকে নজর দিয়েছে সারা ইংলণ্ড। শিশুর মন একটা অদ্ভুত জগৎ। শিশুরা তো শিশুই। তাদের মন কি চায়, কি তাদের প্রয়োজন তারাই কি সব সময়ে বোঝে, না তাদের মা বাবাই সব জানে! তাদের মনের চাহিদা মেটানোর জন্যে শিশু জগতের মনোবৈজ্ঞানিকদের এখানে কতো যে গবেষণী তার আর অন্ত নেই। এখানে হয় সারাটা দেশকেই শিশুর আনন্দ নিকেতন করে গড়ে রাখা হয়। তাদের এক এক বয়সের উপযোগী এক এক রকম খেলনার সাহায্যেই এদেশ একদিনে শিশুদের বশ করতে চেয়েছে, অন্যদিকে আবার তারই সাহায্যে তাদের মনোজগতের সামনে তাদের অগণিত আপনার জগতের রহস্য খুলে ধরেছে।

লণ্ডনের ছোট বড়ো অধিকাংশ দোকনেই শিশুদের জন্যে স্বতন্ত্র বিভাগ আছে। বড়ো বড়ো দোকান ‘সেলফরীজ’, অস্টিনরীড়’, আর্মী নেভী’ প্রভুতিতে আবার শিশুদের আছে টয় টাউন (Toy Town), যার অর্থ শিশুদের খেলনার শহর। এক একটা দোকান যে কতো বড়ো তা বলে শেষ করা যায় না। এদের একটা বড়ো দোকানে ঢাকার সবগুলো বড়ো দোকান আর তাদের মালপত্র সব ধরে যাবে। সুতরাং কোনো দোকানে খেলনার শহর যদি } কিছু থাকে তাহলে সেটা যে একটা শহর বিশেষ তা সহজেই ধারণা করা যায়। এক একটা দোকানে এ ধরনের এক এক ‘টয় টাউনে ছেলেমেয়েদের প্রয়োজনের চেয়ে অপ্রয়োজনীয় জিনিসই বেশী রয়েছে। তাতে কতো রকমের কাঠের ঘোড়া, উড়োজাহাজ আর মোটর। কাগজ অথবা কাঠের সাহায্যে শিশু যাতে আনন্দ পায় এমন রূপকথার, পরী রাজ্যের আরব্যোপন্যাসের গল্প কাহিনীগুলোর নানা খেলনার সহজ ও সুলভ সংস্করণ তৈরী করে রাখা হয়েছে। এদেশেও আলিবাবা ও চল্লিশ চোরের গল্পের আবেদন কম নয়। সম্পূর্ণ গল্পটা পিচবোর্ড ও ছবিতে বই-এর আকারে গেঁথে দেওয়া হয়েছে। ছোট ছোট বাচ্চাদের পড়াশোনার দরকার হয় না। গল্প শোনার সঙ্গে ছবি দেখেই সব বোঝে। আর বড়দের চেয়েও বেশী আনন্দ পায়। ওদের শিশুরা যাতে আসল আনন্দ পায় এবং সঙ্গে সঙ্গে মন তাদের বিকশিত হয়ে ওঠে তার প্রতি জোর দিয়েই খেলনা তৈরীর পেছনে ওদের কারিগরেরা নজর দিয়েছে মনোবৈজ্ঞানিকের মতো।

নয়

লণ্ডনে একদিন দেখতে গেলাম এখানকার এক বিখ্যাত ‘জু’। লণ্ডন শহরের বুকের ওপর রিজেন্ট পার্ক, তারই মধ্যে এখানকার চিড়িয়াখানা। সওয়া শ বছর আগে এ চিড়িয়াখানার গোড়াপত্তন হয়। এতোদিনে ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে এটি। আজকের যারা শিশু, তারাই হলো আগামীকালের নাগরিক। ইংরেজ জাত সেই শিশুদের কি ভাবে চোখে দেখিয়ে হাতে কলমে শিখিয়ে ভবিষ্যৎ নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলছে তা না দেখলে ভালো করে বোঝা যায় না। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের জীব-জানোয়ার আর তার আবহাওয়ার কথা ভূগোলে পড়ে শিখা যায়। পরীক্ষা পাশের জন্যে মুখস্থ করতে হয়। কিন্তু যদি নানান দেশের জীব জানোয়ার আর সে সব দেশের প্রাকৃতিক পরিবেশ এক জায়গায় চোখে দেখতে পাওয়া যায় তা হলে কি ভালোই না লাগে। মুখস্থ করতে হয় না। চোখে দেখেই সব কিছু শিখে নিতে পারা যায়। রিজেন্ট পার্কের ‘জু’-তে গিয়ে দুনিয়ার অধিকাংশ দেশেরই জীব-জানোয়ার দেখলাম। আবার যে দেশের জীব-জানোয়ার তাকে রাখাও হয়েছে ঠিক সে দেশেরই আবহাওয়া তৈরী করে। জিরাফ, হাতী, বাঘ, সবগুলোর জন্যে গরম ঘর। বরফের দেশ দক্ষিণ মেরু। সেখানকার সাদা ভালুকগুলোর জন্যে পাহাড়ের মত উঁচু ঘর। তার আবহাওয়াও রীতিমত ঠাণ্ডা। পাহাড়ের গর্তে যে সব জানোয়ার থাকে, নকল পাহাড় তৈরী ক’রে তার মধ্যে গর্ত কেটে তাতে সে সব দেশের বড়ো বড়ো ছাগল কি ভেড়া জাতীয় বড়ো বড়ো শিংওয়ালা প্রাণীগুলোকে রাখবার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সমুদ্রের মধ্যে যে সব জানোয়ার পাওয়া যায় তার কতকগুলোকে বলে Sea Lion–সমুদ্রের সিংহ আর কি। সেগুলোকে রেখেছে পাহাড়ের নীচে সমুদ্রের মতো চওড়া গভীর গর্তে পানির মধ্যে। এই ‘জলসিংহ’ গুলো আমাদের পদ্মার শুশুকের মতো।

আমাদের দেশে যে সব পাখী দেখা যায়, সেগুলোকেও দেখলাম এখানে। মায় শকুন পর্যন্ত। বাশের জঙ্গলে কিংবা ছোট খালে বিলে আমাদের গ্রামে যে সব দোয়েল শ্যামা পাখী দেখা যায়, তারাও বাদ যায় নি। তাদের থাকবার জায়গা করা হয়েছে আমাদের গ্রামাঞ্চলের বাঁশঝাড়ের মতো বাঁশ ঝাড় আর তার পাশে সে রকমের খাড়িতে। ভারি ভালো লাগলো নিজের দেশের পাখীগুলোকে এখানে এমন ভাবে দেখে।

আগে বললাম, সওয়া শ বছর আগে এ চিড়িয়াখানার গোড়াপত্তন হয়। জিরাফ আসে ১৮৩৪ সালে। শিম্পাঞ্জী, জলহস্তী ও সাপ ১৮৫০-এ। হাতীগুলো শীতকালে থাকে ঘরের মধ্যে। গরমের সময় বাইরে। তখন দর্শকেরা হাতীতে চড়ার শখও মিটিয়ে নিতে পারে।

চিড়িয়াখানাটা একটি বড়ো রাস্তার দু’ধারে গড়ে ওঠেছে। নীচে দিয়ে একটি সুড়ঙ্গ এপাশ ওপাশকে যোগ করেছে। সব চেয়ে ভালো লাগলো সাপের ঘরগুলোতে গিয়ে। মনে হলো যেন ছবির দেশে পৌঁছলাম। ঘরের মধ্যে যে দেশের সাপ সে দেশের ছবি আর সে দেশের তাপ। বালুর উপরে কত কত সাপ শুয়ে আছে, দেখে বিস্মিত হলাম। আমাদের দেশের কোনো কোনো সাপ নাকি গাছে থাকে। শোনা যায় ওরা নাকি উড়ে এসে মানুষের কপালে কামড়ায়। সত্যি কামড়ায় কি না জানিনা। তবে চিড়িয়াখানাতে এসেও ওরা তাদের পরিবেশ হারায়নি গাছের ডালে নিজের রং-এ রং মিশিয়ে গা ঢাকা দিয়ে আছে।

এদেশের ছেলেমেয়েরাও চিড়িয়াখানার প্রত্যেকটি জীব-জন্তু সম্বন্ধে খুব উৎসুক। তারা প্রায়ই তাদের দেখে আসে। কিছু দিন আগে বি. বি. সি. থেকে প্রচার করা হলো চিড়িয়াখানার পাণ্ডাদের মধ্যে বড়ো পাণ্ডাটির খুব অসুখ। পাণ্ড গ্রীষ্মপ্রধান দেশের একটি জন্তু। ছোট্ট ভালুকের মতো দেখতে। মাথাটা সাদা লোমে ঘেরা। কান ও চোখের কাছে কালো লোম। মনে হয় যেন শো কেসে রাখা একটি পুতুল। রিজেন্ট ‘জু’তে অনেকগুলো পাণ্ডা ছিল। তার মধ্যে বড়োটি ছিল চীন দেশের। চীনদেশের নাম তো তুয়াং চুয়াং, চিং চং, হো হো এসব ধরনের। চীন থেকে আনা হয়েছিল বলে বড়ো পাণ্ডটির নাম লিয়েন হো। তার খাবারের অসুবিধা হওয়ায় শরীরে ভিটামিন কম পড়ে। ফলে তার অসুখ হয়। তবে সে খায় কি? বাঁশের ডগা। তাও আবার কচি হওয়া চাই। বি. বি. সি. থেকে লিয়েন হোর অসুখের কথা প্রচারিত হবার পর কর্তৃপক্ষ সেদিনই ১৭টা টেলিফোন পায়। প্রত্যেকেই বলে সে অসুস্থ পাণ্ডার খাবার যোগাবে।

এরা জীব-জানোয়ারকে শুধু খাঁচায় বন্দী করেই রাখেনি। তাদের স্বাস্থ্যের প্রতিও নজর রেখেছে। তাদের প্রতি ইংরেজ জাতের কতো দরদ। আমরা একদিন লিয়েন হোকে দেখতে গেলাম। মনে ভাবলাম বেচারা বোধ হয় এতোদিনে শেষ হয়ে গেছে। ওখানে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম। চিড়িয়াখানার লোকেরা বললো, পেনিসিলিন, গ্লুকোজ আর ভিটামিন ইনজেকশন দিয়ে ওকে সারিয়ে তোলা হয়েছে। আমাদের দেশে মানুষ চিকিৎসার অভাবে মরে। আর এখানে পশুরও সুচিকিৎসার অভাব হয় না।

এ চিড়িয়াখানার মধ্যে ছোট শিশুদের জন্যে নানা রকমের সুন্দর আর শান্ত স্বভাবের জীব-জানোয়ার দিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে আর একটি চিড়িয়াখানা। ছাগল, লুমড়ি, হরিণের বাচ্চা, ক্যাঙ্গারু, এরাই এখানে বেশী। ছেলেমেয়েরা এদের খাবার দেয়, বিনিময়ে ছেলেমেয়েদের সঙ্গে ওরা খেলা করে। পশু ও মানুষের বাচ্চাদের নির্দোষ খেলা আর বিমল আনন্দের বহর দেখে আশ্চর্য হলাম।

রিজেন্ট ‘জু’তে ইতিহাস শেখানোরও ব্যবস্থা করে রেখেছে এরা। কিউ গার্ডেনস-এর কথাও এর সঙ্গে মিলিয়ে নিতে হবে। জু’তে নানা দেশের জীব-জন্তু আর কিউ গার্ডেনস-এ দুনিয়ার নানা দেশের গাছপালা। মনে পড়ছে শিবপুর বোটানিক্যাল গার্ডেনের কথা। সেখানে একটা বট গাছ আছে বহুদূরব্যাপী। ঝুরি নেমে নেমে আয়তন আর পরিধি ক্রমেই বড় হয়ে গেছে। আমার ছেলেবেলায় এমনি একটা অশ্বথ গাছ দেখেছিলাম মুর্শিদাবাদ জেলার খয়রামারী গ্রামের পার্শ্বে। আমাদের দেশের লোক প্রকৃতির কোনো জিনিসের যত্ন জানে না। মূল্য বোঝে না। শুনেছিলাম কিছুদিন পরে নানা লোকে গাছটির এক একটা ‘ব’ কেটে নিয়ে জ্বালানি করেছে। বিলেতে এসে আমাদের দেশের সঙ্গে এ দেশের লোক যতোই মনে মনে তুলনা করছি বার বার ততোই মনে পড়ছে নানা দিক থেকে আমরা যে কতো পেছনে আছি শুধু সে কথা। আমাদের দেশ দুশো বছর শাসন করে টাকা পয়সা লুটে নিয়ে সে টাকা দিয়ে ওরা সব কিছু গড়েছে। এর মধ্যে কিছুটা সত্যি আছে ঠিকই, কিন্তু আমাদের দেশের টাকা থাকলেও সৃষ্টি করার, কোন তাগিদই দেশের লোকের চরিত্রের মধ্যে নেই। আমরা যেখানে ক্ষয় করি এরা সেখানে জমা করে জাতির ভবিষৎ গড়ে তোলে।

যাক, কি কথায় কি কথা এসে পড়লো। বলছিলাম কিউ গার্ডেনস্-এর কথা। সেন্ট্রাল লণ্ডন থেকে প্রায় মাইল বিশেক দূরে বাগানটি। নানা দেশের ফুল আর গাছপালা নিয়ে ভরা। ইংরেজরা ফুল ভালোবাসে। কতো যে ভালোবাসে তার পরিচয় পাওয়া যায় এদের দরিদ্রতম ব্যক্তিরও বাড়ীর সামনে একটি ছোট বাগান দেখে। বাড়ীর সামনে একটি ছোট্ট বাগান দেখে। নিজের হাতের গড়া বাগান। মার্জিত রুচির পরিচয় আছে তাতে। নিজেই কেটে হেঁটে সুন্দর করে রেখেছে। সেই ইংরেজ জাত দুনিয়ার সব দেশের ফুল আর গাছপালাকে, যে দেশের গাছপালা সে দেশেরই আবহাওয়া তৈরী করে, এখানে বাঁচিয়ে রাখার ব্যবস্থা করেছে। কাঁচের বড়ো বড়ো ঘরের মধ্যে গরম দেশের গাছগুলা ঠাই পেয়েছে। নারিকেল গাছও বাদ যায়নি। মনে হলো এরা দুনিয়ার ওপর শুধু রাজত্বই করেনি, জগতের সকল বৈশিষ্ট্য ও সম্পদ মুঠোর মধ্যে বন্দী করে এনে নিজের দেশের ঐশ্বর্য বাড়িয়েছে।

এ বাগানেও একটা যাদুঘর আছে। কাঠের আস্তানা এটা। দুনিয়ার সকল দেশেরই কিছু কিছু শুকনো কাঠ আছে এখানে। দেখলাম ক্যালিফোর্নিয়া থেকে একটা গাছ কেটে আনা হয়েছে। প্রকাণ্ড চওড়া। গাছটি প্রায় দেড় হাজার বছরের। হযরত মোহাম্মদের জন্ম। সাল ৫৭০ থেকে নিয়ে নেপোলিয়ানের উত্থান পর্যন্ত এর বয়স। পদ্মার চরের বালির ওপর যেমন পানির ঢেউয়ের দাগ পড়ে গাছটির গায়েও দেখলাম প্রতি বছর তেমন করে এক একটা দাগ রেখে গেছে! বয়সের চিহ্ন বটে। এমনি করেই কালে কালে মানুষ নানা জাতের পশুপাখী গাছপালা সব কিছু নিয়ে দুনিয়াটা বুড়ো হচ্ছে। এ বৃদ্ধ প্রাচীন পৃথিবীকে ধরে রেখে এরা এদের জাতিকে এর বৈশিষ্ট্য শেখানোর ব্যবস্থা করে রেখেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *