বিশ
আমাদের দেশে বারো মাসে তেরো পার্বন লেগেই আছে। আজ মুসলমানদের ঈদ, কাল মোহররম, পরশু নবী-দিবস, তার পরের দিন শবেবরাত, শবে কদর। আর হিন্দুর দোল, দুর্গোৎসব, কালীপূজা, লক্ষ্মীপূজা, সরস্বতী পূজা। বৌদ্ধদের বৈশাখী পূর্ণিমা। ব্রাহ্মদের মাঘোৎসব। এর যেন আর বিরাম নেই। আবার খৃষ্টানদের যে কিছু নেই তা নয়। তাদের গুডফ্রাইডে, ইষ্টার মনডে, কৃসমাস এ সব আছে। বছরের ক্যালেণ্ডার ধরে এ সবের জন্য নির্দিষ্ট দিনে স্কুল-কলেজ আমাদের বন্ধ রাখতে হয়। এর ওপরে প্রকৃতির বিধান অনুসারে এতোদিন আমরা গ্রীষ্ম ও হৈমন্তিক অবকাশ ভোগ কম্বরে এসেছি। এখন আবার শুধু বিধানই নয়, তার শাসন চলছে আমাদের ওপরে। যার জন্য এতোকাল প্রকৃতিকে খেয়ালী বলা হয়েছে, তার সে খেয়াল এখন নিত্য নিয়মে পরিণত হলো। আজ বন্যা, কাল ঝড়-এও যেন নিয়মিত হয়ে এলো। ঘাড়ে যখন এগুলো চেপে পড়ে তখন এরও জন্যে স্বতন্ত্র অবকাশ নিতে হয়। এ ছাড়া আছে আজ অমুক মারা গেছেন দাও ছুটি। কাল কোন নেতা মারা গেছেন, দাও ছুটি। পরশু দিন দেশের কোন নাম করা লোক মারা গেছেন- সাহিত্যিক, দার্শনিক কি অন্য কেউ, অমনি দাও ছুটি। কোন মাননীয় ব্যক্তি স্কুল-কলেজ পরিদর্শন করতে এসেছেন, দাও ছুটি। বিশেষ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খেলাধূলায় কোন ট্রফি জিতেছে, ছাত্রেরা শতকরা হার ভালো রেখে পরীক্ষা পাশ করেছে, কোন ছাত্র বিশেষ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে নাম করে পাশ করেছে, তাতেও ছুটি চাই- অন্ততঃ সেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছুটি।।
এর ওপরে আছে ছেলেদের প্রয়োজন ও ইচ্ছে মতো ছুটি ঘোষণা করার অধিকার। কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তাদের দ্বন্দ্ব। তাদের দাবী না মানলে তারা ধর্মঘট করবে। ক্লাশে আসবে না, পড়াশোনা শিকেয় তোলা রইলো। এ ছাড়াও আমাদের জাতীয় চরিত্রের প্রতিফলন দেখি আমাদের ছাত্রদের মধ্যে। ধরুন আমাদের আড্ডা দেওয়ার অভ্যাসের কথা। পড়ার সময় হোক কি খেলার সময় হোক, অকাজে হোক কি কাজ ভুলে হোক, পরিচিত হোক কি স্বল্প-পরিচিত হোক, দু’জন আমরা এক জায়গাতে হলেই এঁড়ে তর্কে হাট লাগাই। চেঁচিয়ে একাকার করি। সময় অসময় জ্ঞান নেই, কাজ ক্ষতি করে পড়াশোনা ক্ষতি করে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটাই। তারপর পরীক্ষার সময় রাত জেগে দিনরাত্রি খেটে স্বাস্থ্যেরও ক্ষতি করি, সঙ্গে সঙ্গে নিজের লেখাপড়ারও। অবস্থা দাঁড়াল হয় লেখাপড়াই ছাড়ি না হয় লেখাপড়াই আমাদের ছেড়ে যায়। এ অবস্থায় আমাদের দেশের ছাত্রেরা যে কতটুকু পড়াশোনা করে আর কি করে যে তাদের ছাত্রধর্ম তারা পালন করে, আমি তাই ভেবে বিস্মিত হয়ে যাই। আরও বিস্মিত হই যে এর ভিতর দিয়েও যথার্থ মানুষ হোক বা না হোক লেখাপড়া করুক বা না করুক, পরীক্ষা পাশ করে কিছু কিছু ছেলে বেরুচ্ছে।
এখানে এসে দেখি মানুষের অভ্যাসের মধ্যে সর্বত্রই একটা শৃখলা। এরাও আমোদ প্রমোদ করে। এরাও হাসে-খেলে। এরাও আডী দেয় (ছাত্রদের অবশ্য ধর্মঘট করতে দেখিনি, রাজনীতিতে বাস্তব অংশ গ্রহণ করতে তো নয়ই হয়তো এদের প্রয়োজন হয় না বলেই) কিন্তু সবই যেন সময় ধরে ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে মিলিয়ে। কোথাও যেন অনিশ্চিয়তা নেই। এক একটা প্রতিষ্ঠান থেকেই যেন মনে হচ্ছে সমগ্র জাতীয় জীবনটা ঘড়ির কাটা ধরে যখনকার যেটা ঠিক সেই মতে এগিয়ে চলেছে।
এদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটা শিক্ষা বৎসরে তিনটে টার্ম। অক্টোবর থেকেই সাধারণতঃ শিক্ষা বৎসর শুর। অক্টোবর থেকে বড়ো দিনের বন্ধের পূর্ব পর্যন্ত প্রথম টার্ম। জানুয়ারীর প্রথম কি দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে শুরু করে মার্চের শেষ কি এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত দ্বিতীয় টার্ম। মাঝখানে হপ্তা দুয়েকের অবকাশ। আর তৃতীয় বা শেষ টার্ম এপ্রিলের মাঝামাঝি থেকে জুন পর্যন্ত। এরপরে জুলাই আগষ্ট সেপ্টেম্বর দীর্ঘ তিন মাস ধরে গ্রীষ্মের বন্ধ। টার্ম চলতে থাকাকালীন আর কোনো ছুটি নেই। একটি দিনের জন্যও নয়। ধর্মের জন্যও নয়, কোনো গৌরবজনক কর্মের জন্যও নয়। এমন কি কারুর মৃত্যুর জন্যও নয়। বার্নার্ডশ মারা গেলেন, খবরে কাগজগুলোতে বড়ো বড়ো করে হেড় লাইন বেরোলে, ‘A genious passes away”- ব্যাস এ পর্যন্তই। সাহিত্যের ছাত্রেরা তাদের স্বতন্ত্র ক্লাব বা প্রতিষ্ঠানগুলোতে তার জন্যে শোকসভা করলো। তাঁর সাহিত্য ও সৃষ্টি নিয়ে আলোচনা করলো; তার মৃত্যুর কিছুদিন পর তার বাসগৃহ এক স্থায়ী জাতীয় পরিদর্শনীতে পরিণত হলো। কিন্তু স্কুল-কলেজের ছুটিছাটা সে কোথায়? অথচ খবর পেলাম আমাদের দেশের স্কুল-কলেজ, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ও বার্নার্ড শ’র প্রতি সম্মান দেখানোর জন্য বন্ধ দেওয়া হয়েছিল। একটি ইংরেজ ছেলের সঙ্গে এ নিয়ে কথা বললাম। আমাদের দেশে এ জন্যে স্কুল কলেজ বন্ধ দেওয়া হয়েছে, শুনে সে তো অবাক। আমি বললাম, “দেখ, আমরা কি রকম উদার। অপর দেশের মনীষীর প্রতিও আমরা কি রকম শ্রদ্ধাশীল। সে বললে, * তোমরা অলস বলেই একটা লোকের প্রতি শ্রদ্ধা দেখাও কাজ পালানোর অবসর খুঁজ। আমরা তাঁর স্মৃতির প্রতি সম্মান দেখাই তার কথা মতো কাজ করে। একটি দিনের জন্যেও কাজ বন্ধ করে নয়।
কিছুদিন যেতে না যেতে রাজা ষষ্ঠ জর্জও মারা গেলেন। এক সকালে জেগে উঠে দেখলাম, যে কাগজই খুলি সে কাগজেই প্রথম পৃষ্ঠায় বড়ো বড়ো ব্যানারে হেড লাইন দিয়ে লেখা, “The king is dead,’ ভাবলাম স্কুল-কলেজ থেকে আপিস-আদালত আজ বুঝি সব বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু কোথায়? কোথাও কিছু হয়েছে বলে তো মনে হলো না। স্কুল কলেজ যেমন চলছিল ঠিক তেমনি চলতে লাগলো। ক্লাশে বক্তৃতা তেমনি হলো। ছাত্র-ছাত্রীরা ক্লাশ করলো। রিফেক্টরীতে (খাবার ঘর) গেলো। সময় মতো কমনরুমে আলাপ আলোচনা করলো। চা খেলে। আবার যে যার পড়া শুনা করতে লাইব্রেরীতে ঢুকলো। এদের কাছে ব্যক্তি নয়, জাতিই যে বড়ো পদে পদে তার প্রমাণ পাচ্ছি। ব্যক্তি তার নিজের কাজ শেষ করে পরপারে পাড়ি দিলো। জাতিকে এখন এগিয়ে যেতে হবে। অবসর রচনা ক’রে কারো স্মৃতিভার বুকে পুষে, এমনকি একদিনের জন্যে বসে থাকতে গেলেও জাতীয় জীবনের শক্তি ও সাধনার যে কী অপচয় হয়, তার হিসেব করলে শুধু তাদের কেন, আমাদেরও চোখ স্থির হয়ে আসবে। কৃষি প্রধান দেশ আমাদের। হিউমিডিটি ভরা আবহাওয়ায় বসে বসে আমরা ঝিমুতে ভালবাসি। বাণিজ্যিক লাভ ক্ষতির হিসেব করে জীবনকে যাচাই করে দেখি না। সে দৃষ্টিভংগী থেকে জীবনকে গড়েও তুলি না।
‘টার্ম টাইমে’ কোনো ছোট-খাটো ছুটি নেই বলে পড়ার সময়ে ছাত্রের যথারীতি পড়াশোনা করে। এ পড়াশোনার নাম জ্ঞান-সাধনা, শুধু পরীক্ষায় পাশের আয়োজন নয়। সকাল সাতটা থেকে সাড়ে সাতটার ভেতর প্রাতঃক্রিয়াদি সেরে পেটপুরে নাস্তা করে ছুটছে সব লাইব্রেরীর দিকে। আটটা থেকে দশটা দুঘন্টা লাইব্রেরীতে বেশ পড়াশোনা করা গেলো। তারপর ক্লাশ শুরু হলো। যে যার ক্লাশে গেলো। মাঝখানে একটার সময় লাথের। জন্যে একটা বড়ো রকমের ব্রেক। আপন আপন স্কুলের রিফেক্টরীতে ছেলেমেয়েরা দলে দলে মিলেমিশে একই সঙ্গে লাঞ্চ খাচ্ছে। খেতে খেতে গল্প করছে। খাওয়া শেষেও বন্ধু বন্ধুতে, বন্ধু ও বান্ধবীতে মিলে মিষ্টি আলাপ-প্রলাপে বেশ জিরিয়ে নিচ্ছে।
সে যাক। লাঞ্চের পর আবার চারটে পর্যন্ত যথারীতি পড়াশোনা। হয় ক্লাশ, না হয় লাইব্রেরী। তারপর সামান্য কিছুক্ষণের জন্য চায়ের ব্রেক। এ সময় চা খাওয়া উপলক্ষে কমনরুমে গিয়ে ছেলেমেয়েরা আড্ডা দিচ্ছে। গল্পগুজব করছে। করছে খেলাধূলা। তারপর আবার পড়াশোনা। এবার ক্লাশ ততটা নয় যতটা নিজেদের লাইব্রেরীতে পড়া। রাত্রি-আট নয়টা পর্যন্ত লাইব্রেরী খোলা থাকে। পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রীরা তার যথারীতি সদ্ব্যবহার করতে পারে। করবেই বা না কেন? কোনো কোনো ব্যাধি যেমন সংক্রামক, তেমনি কোনো কোনো ভাল কাজের মধ্যেও সংক্রামক বীজ রয়েছে। লণ্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেট লাইব্রেরীতে ঢুকলেই মনে হয় অনাদিকাল ধরে প্রবাহিত বিশ্বের যত জ্ঞান এখানে যেন বন্দী হয়ে আছে। আর সেখান থেকে জ্ঞানের নানা মণিমাণিক্য কুড়িয়ে তোলবার কাজে জ্ঞান সাধকেরা ব্যাপৃত রয়েছে। এ দেখে বাড়ীতে ফিরতে ইচ্ছে করে না, ইচ্ছে করে দুনিয়া ভুলে শুধু জ্ঞানের তপস্যা করতে।।
একদিন গেলাম অক্সফোর্ড বেড়াতে। ইউনিভার্সিটি টাউন অক্সফোর্ড কলেজগুলোর দালান বাইরে থেকে ভারী কালো কালো ঠেকলো। ইংরেজ জাত যে ট্রডিশন প্রিয় তার কমপক্ষে একটা পরিচয় পাওয়া যায় দশ নম্বর ডাউনিং স্ট্রীটে এদের প্রধান মন্ত্রীর বাড়াটা দেখলে, আর অক্সফোর্ড কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে থেকে কলেজগুলোর দালানগুলো দেখলে। দ্বাদশ ত্রয়োদশ শতাব্দীর চিহ্ন ধরে তারা ধীরে ধীরে রহস্যময় হয়ে উঠেছে। ইংরেজরা এদের কালো রূপের তাই পরিবর্তন করে না, ভাঙলে চুরলেও না। মেরামত করতে হলেও রূপের কোন বদল করা হয় না। ফলে প্রাচীনতার ছাপ থাকে তেমনি অক্ষুণ্ণ। ইউনিভার্সিটির মিউজিয়াম, শেল্ডােনিয়ান থিয়েটার লাইব্রেরী, সেনেট, বড়লিন কলেজ ঘুরে ঘুরে দেখলাম। এখানকার ছাত্র-শিক্ষকদের হুড় গাউন ইত্যাদি একাডেমিক পোশাক পম্বরে ক্লাশ করা বেশ আকর্ষণীয়। বাইরে বেরোলেও এখানকার ছাত্ররা সপরিচয়ে বেরোয়। তা দেখে চোখ জুড়োয়, মন প্রফুল্ল হয়।
এখানকার ছাত্র-ছাত্রীদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রার প্রণালী আর আনন্দোপভোগের উৎস দেখলাম! মিষ্টি সবুজ ঘাস। বড়ো মিষ্টি রোদ। ভেজা ভাবের কোথায়ও কোনো নাম গন্ধ নেই। সব শুকনো। ছেলেমেয়েরা ঘাসের উপর পাশাপাশি শুয়ে রোদ পোয়াচ্ছে। বছর বিশ বাইশের কতকগুলো ছেলেকে দেখছি তাদের সমবয়সী একটি মেয়ের পা রুমাল দিয়ে নিজের পায়ের সঙ্গে বেঁধে কয়েক দলে ভাগ হয়ে রেস খেলছে। কোন দল ফাষ্ট হচ্ছে। কোন দল আছাড় খাচ্ছে। একে অপরের গায়ে পড়ে লুটোপুটিও করছে। আর হাসির হররায় চারদিক যেন ফেটে পড়তে চাইছে। পাশে কৃত্রিম লেক। ছেলেমেয়েরা মিলে মিশে নৌকা বাইচ খেলছে। এরপর পানি ছিটাচ্ছে। এক দল সুযোগ বুঝে আড়াল খুঁজে অন্য দলের চোখ এড়াচ্ছে।
মাঝে মাঝে কেমব্রিজ আসি বেড়াতে। কেমব্রিজও ইউনিভার্সিটি টাউন। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনেও অনেক অনেক কলেজ। এক এক কলেজ এখানে অন্য কলেজের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে। কে কেতো মনীষী তৈরী করেছে তা নিয়ে। ক্রাইষ্ট কলেজের ছাত্র ছিলেন মিল্টন আর ডারউইন। ট্রিনিক কলেজই কেমব্রিজের সবচেয়ে বড়ো এবং বিখ্যাত। নিউটন, টেনিসন, বাইরন এবং পণ্ডিত নহেরু এ কলেজেরই ছাত্র। আর সেন্ট জনস কলেজের ছাত্র ওয়ার্ডসওয়ার্থ। তারা যেখানে থাকতেন, সেখানে এদের নাম খোদাই করে দেয়া হয়েছে। কারুর ছবিও রাখা হয়েছে। এ মনীষীদের স্মৃতি এখানকার বর্তমান ছাত্রদের যথেষ্ট প্রেরণা দেয়, আর এ সব কলেজে পড়াশোনা করলে গর্বেও যেমন বুক ভরে উঠে, নিজেকে তৈরী করবার জন্য মনে মনে প্রস্তুতিও চলে তেমনি।
টার্মটাইমে সোম থেকে শুক্রের শেষ কি শনির অর্ধেক দিন পর্যন্ত নিয়ম শৃঙ্খলার ভেতর দিয়ে পড়ুয়াদের জীবন কাটে। সপ্তাহের বাকী দেড় দিন এদের নিজের। তখন এরা বিশ্রাম করছে নাচ গান করছে। আমোদ-প্রমোদ করছে। বেড়াতে বেরোচ্ছে। পার্কে না হয় সী বিচে না হয় বাইরে কাউন্টিগুলোর দিকে কোথাও। এ ছাড়া আছে টার্ম শেষের বল নাচ আর নানা রকমের সামাজিকতা।
একুশ
পড়াশুনার অভ্যাস কিংবা অনভ্যাসের সাহায্যে পরিচয় পাওয়া যায় একটা মানুষ কিংবা একটা জাতির মন এবং বুদ্ধিবৃত্তির। কেউ যদি কোন কিছু পড়াশুনা করে এবং কিছু জানার আগ্রহও তার না থাকে তাহলে মানুষ হলেও তাকে কোন পর্যায়ের মানুষ বলবো? আর পড়াশুনা করলে যে যা পড়ে বা যে ধরনের খবরাখবর রাখে, তার দ্বারা তার মনের কাঠামোর পরিচয় পাওয়া যায়। তার ভবিষ্যৎ মানসের উন্নতি বিধানের পথও তার সাহায্যে গড়ে উঠে।
এখানকার ছাত্রছাত্রী বা শিক্ষক শিক্ষয়িত্রীদের কথা বলছি না, কারণ পড়াই তাদের ধর্ম। কিন্তু জীবন ধারণের যে কোন পথই এরা বেছে নিক না কেন, এখানকার সাধারণ নরনারীরও পড়াশুনার প্রতি বেশ ঝোঁক আছে। একুশ বছরের ওপরে যাদের বয়স, তাদের মধ্যে একেবারে অক্ষরজ্ঞান-বর্জিত লোক সারা গ্রেটব্রিটেনে শতকরা দু’জনের বেশী নেই। এদের সংখ্যাও ধীরে ধীরে কমে আসছে। আর একুশ বছরের নীচে যারা; তারা তো এ হাল আমলের মানুষ। কমপক্ষে লিখতে ও পড়তে শেখা এদের কর্তব্য।
এদেশের লোক অবসর সময় কাটানোর জন্যে যে পড়তে ভালোবাসে তার নজীর তো দেখছি প্রতি পদে পদে। টিউবে, বাসে, ট্রেনে তাদের দেখছি নেহাত সামনের স্টপে নামবার আতঙ্ক না পেয়ে বসলে, হয় খবরের কাগজটা না হয় রুচি অনুসারে একটা না একটা বই খুলে পড়তে শুরু করেছে। যেটা পড়ছে সেটা বই কি খবরের কাগজ যাই হোক না কেন, অন্ততঃ সে মুহূর্তের জন্যে তার নিজেরই। আমাদের দেশের মতো তার সহযাত্রী কি যাত্রিীর কাছ থেকে চেয়ে নেওয়া নয়।
ইংলণ্ডে ছোট বড়ো ভেদে দৈনিক, সান্ধ্য ও রবিবারের কাগজগুলো নিয়ে প্রায় শ দেড়েক খবরের কাগজ আছে। এদের মধ্যে অবশ্য গুটিকতক খুব বেশী চলে। এগুলো হচ্ছে জাতীয় দৈনিক কাগজ, রবিবারের প্রধান প্রধান কাগজ আর ম্যনিচেষ্টার গার্ডিয়ানের মতো কয়েকটি বিখ্যাত আঞ্চলিক কাগজ।
রবিবারের কাগজগুলোর মধ্যে News of the worldই সব চেয়ে জনপ্রিয় এবং তার চাহিদাও সে অনুপাতে খুব বেশী। প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে প্রায় দু’কোটি লোক এ কাগজ পড়ে থাকে। ইংলণ্ডের প্রায় পাঁচ কোটি লোকের মধ্যে এক রকম অর্ধেক লোকেরই চাহিদা মেটায় এ কাগজটি। পুরুষের চেয়ে মেয়েরাই আবার এ কাগজটি বেশী করে পড়ে। এতে খেলাধুলার সংবাদ, সামাজিক ও রাজনৈতিক আলাপ আলোচনা কিছু কিছু থাকে, কমপক্ষে দু’জন নামজাদা লেখকের দু’টো নামকরা লেখা থাকে। কিন্তু সবচেয়ে বেশী থাকে মুখরোচক সংবাদ।
News of the world-এর পরে রবিবারের কাগজগুলোর মধ্যে নাম করতে হয়। People এবং Sunday Pictorial-এর। People-এর পাঠক সংখ্যা এক কোটি সাড়ে কুড়ি লাখের মতো আর Sunday Pictorial পড়ে থাকে প্রায় এক কোটি পনের লাখ লোক। এ ক’টা কাগজ অবশ্য খুব হালকা এবং সাধারণ মানুষের রুচির অনুগামী। মার্জিত রুচি বিশিষ্ট ও শিক্ষিত লোকদের কাছে এগুলোর আবেদন তেমন নয় যেমন Observer কিংবা Sunday Times-এর। অথচ এগুলোর পাঠকসংখ্যা আগেরগুলোর তুলনায় উল্লেখযোগ্য। ভাবেই কম। Observer পড়ে প্রায় তের লাখ লোক, আর Sunday Times যারা পড়ে তাদের সংখ্যা ষোল লাখের বেশী নয়।
দৈনিক কাগজগুলোর মধ্যে Daily Express-এর পাঠক সংখ্যা সবচেয়ে বেশী, প্রায় কোটি খানিক। Daily Mirror-এর চুরানব্বই লাখের মতো। Daily Mail-এর চুয়ান্ন লাখ। Daliy Herald-এর একচল্লিশ লাখ। News Chronicle-এর পঁয়ত্রিশ লাখ। Daily Telegraph-এর সাতাশ লাখ। অথচ সবচেয়ে উন্নতমানের কাগজ যেটি সেই Time-এর পাঠক সংখ্যা সবচেয়ে কম–আনুমানিক সাত লাখের মতো।
Daily Express যে এতো প্রিয়, তার কারণ News of the World-এর মতোই এ দৈনিকটির মান নীচে। বড়ো হেড লাইন দিয়ে কাগজটি মুখরোচক এবং লোমহর্ষক সংবাদ ছাপে। মনে পড়ে, একদিন সকালে উঠে কাগজটি হাতে নিতেই চোখে পড়লো বড়ো করে হেড লাইন দিয়ে ছাপা For them he lived, for them he died, নীচে চোখ বুলোতেই দেখি বস্তী অঞ্চলের একটি ঘরে আগুন লাগে। সে বেড়ে আগুনে তার স্ত্রী ও পাঁচ ছেলে মেয়ে একই সঙ্গে মারা যায়, আর সেও প্রাণপণ চেষ্টায় তাদের উদ্ধার করতে গিয়ে মারা পড়ে। এ ধরনের সহজে পড়া যায় আর সহজেই ভোলা যায় এমন সব সংবাদ এ কাগজটিতে ছাপা হয় বলেই এ কাগজটি জনপ্রিয়।।
সান্ধ্য কাগজগুলোর অধিকাংশ আরও মুখরোচক এবং আরও মজার। পথের ক্লান্তি এবং নিঃসঙ্গতা যাতে দূর হয় এবং কিছুক্ষণের জন্য অন্ততঃ বাইরের জগৎ ভুলে ওর মধ্যে মনটাকে একটু সহজভাবেই ধরে রাখা যায়, এমন খবর ছাপে এ কাগজগুলো। কুকুরের রেস, ঘোড়ার রেস, ফুটবল পুল, অন্যান্য জুয়োখেলার ফলাফল, নারীঘটিত খবর, সিনেমা, থিয়েটার, ব্যালে, প্যানটোমাইম, কনসার্ট ইত্যাদির খবর এ সব কাগজের মূল অবলম্বন। কিছুটা প্রয়োজন আর অনেকটাই কিছু একটাতে ক্ষণিকের জন্যে মন আর চোখ দুটোকে
আটকে রাখার ব্যবস্থার জন্যে অধিকাংশ সান্ধ্য কাগজই বেশ কাজে লাগে। মনে আছে, পাকিস্তানের কোন এক প্রধান মন্ত্রী আমেরিকার পথে সস্ত্রীক লণ্ডনে অবস্থান করছেন। তার স্ত্রী কোন এক নারী-মজলিসে কি একটা প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, “আমি ঠিক মনে করে বলতে পারছি নে, আমার কতোটা চাকর-চাকরানী আছে। তারপর তিনি গুণবার ভান করলেন, ‘এক দুই, তিন, চার, পাঁচ, ছয়, শেষে বললেন, হবে বোধ হয় গোটা চল্লিশেক। তারপর তিনি বললেন, তাকে কোনো কাজ করতে হয় না, তবে ফুলটুল তোলেন আর সাজান।’ এ সংবাদ কয়েকটি সান্ধ্যকাগজে ফলাও করে ছাপা হলো ‘She has forty servants, still she does the flowers.’
সাময়িক কাগজগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে নাম করতে হয় The Listener-এর। এটি সাপ্তাহিক কাগজ। বি.বি.সি. থেকে যে সব কথিকা প্রচার করা হয় তার সেরা কথিকাগুলো Listener-এ ছাপা হয়। মাত্র তিন পেনি দাম এ কাগজটির। বিষয়বস্তুর মূল্যমান বিচারে অবিশ্বাস্যভাবে সস্তা। বার্সাও রাসেলের ‘রেইথ লেকচার্স, ফ্রেড হয়লির ‘Nature of Universe’ সম্পর্কে বক্তৃতা, অধ্যাপক তাসকি, অধ্যাপক হিত্তি প্রমুখ খ্যাতনামা বিশেষজ্ঞের বক্ততা একবার শুনে তার মর্ম গ্রহণ করা সহজ নয়। Listener এমন সব বক্তৃতা ছেপে সস্তায় পরিবেশন করে দেখে বিশেষজ্ঞদের জ্ঞান-সাধনা থেকে সাধারণ মানুষও বেশ উপকৃত হয়।
খবরের কাগজের পর বই পুস্তকের কথা উল্লেখ করতে হয়। প্রতি বছর ইংলণ্ডে অন্তত হাজার পনের নতুন বই বেরোয়। বিভিন্ন বিষয়ের ওপর বই লেখা হয়। প্রতি বছর যত বই বেরোয়, তার সবগুলোই যে সমান বিক্রি হয় তা নয়, তবু বই কেনাবেচার হিসেব থেকে দেখা যায় যে, লাখে লাখে বই কাটছে। আবার যে পরিমাণ বই কেনা হয়, পড়া হয় তার চেয়ে বহুগুণ বেশী পরিমাণে। তার কারণ, প্রত্যেক বছরে যতো বই বেরোচ্ছে, তাঁর শতকরা আশি ভাগ বইই কিনছে পাবলিক লাইব্রেরীগুলো।
ইংলণ্ডের মতো পাবলিক লাইব্রেরী, সংখ্যা এবং সুব্যবস্থার দিক থেকে দুনিয়াতে খুব বেশী নেই। সুব্যবস্থার দিক থেকে দুনিয়াতে ইংলণ্ডের লাইব্রেরীগুলোর খ্যাতি আছে। গ্রেটব্রিটেন এবং উত্তর আয়ার্ল্যাণ্ডের মাত্র হাজার বাষট্টি লোক এমন অঞ্চলে বাস করে যেখানে কিছুদিন আগে পর্যন্ত দেখা গেছে যে, তাদের জন্যে লাইব্রেরীর কোনো বন্দোবস্ত করা হয় নি। সমগ্র লোকসংখ্যার তুলনায় এ আর ক’জন? এ হিসেব মতে দেখা যাবে শতকরা একজনের আটভাগের এক ভাগ লোকের জন্যই লাইব্রেরীর ব্যবস্থা নেই। সমগ্র জনসংখ্যার বাকী স্ত্রীপুরুষ, ছেলেবুড়ো নির্বিশেষে সকলেরই জন্যে লাইব্রেরীর ব্যবস্থা আছে। এবং প্রত্যেক মহল্লায় বই নেওয়া দেওয়া এবং পড়ারও আশাতীত সুবন্দোবস্ত করা হয়েছে। ফলে পড়ার এমন সুযোগ থাকার জন্যে পড়ার ইচ্ছে না থাকলেও সব শ্রেণীর নরনারীই আপন রুচি অনুসারে বই পড়ে। তাতে তাদের মন প্রফুল্ল থাকে, আর সাংস্কৃতিক জীবনের মানও উঁচু হয়ে উঠে। সাধারণ মানুষ ট্যাক্স দিচ্ছে। ট্যাক্স দিতে তাদের কষ্ট হলেও তার প্রতিদানে তারা যা পায়, ট্যাক্সের তুলনায় নানাদিক থেকে তার মূল্য অনেক বেশী। ট্যাক্স পেয়ার’দের ট্যাক্স থেকেই অন্যান্য জিনিসের মতো তাদের সাংস্কৃতিক এবং মনোজীবনের মান উন্নত করবার জন্যে সরকার এ ধরনের লাইব্রেরী করে দিয়েছে। ব্যক্তি বিশেষ বই কিনছে, কিন্তু তার চেয়েও বেশী পরিমাণে বই কিনছে এ লাইব্রেরীগুলো। ফলে নানা বিষয়ে প্রতি বছর হাজার হাজার বই বেরোচ্ছে। লেখকদের বুদ্ধিবৃত্তি খুলছে। লেখাটাকে পেশা হিসেবে তারা গ্রহণ করতে পারছে। সে পেশায় মানোন্নয়ন করার জন্য তাদের মনপ্রাণ তারা ঢেলে দিচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে শত শত প্রকাশকও বই-এর ব্যবসায় বিত্তশালী হচ্ছে।
এ সব দেখে শুনে মনে হয়, আমরা কোথায়? আমাদের দেশে স্কুলপাঠ্য বই ছাড়া অন্য বই বেরোয় না। লেখকেরা লিখলেও প্রকাশক নেই ছাপাবার, ফলে যা হবার তা হচ্ছে। আমাদের সাংস্কৃতিক জীবনের কোন পরিচয় আমরা পাচ্ছি না। আমাদের বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ সাধিত হচ্ছে না। চিন্তা ও মননশীলতার জগতে আমরা পিছিয়ে যাচ্ছি। আমরা নামে মাত্র আজাদী পেলাম, কিন্তু পৃথিবীর অন্যান্য স্যা জাতিগুলোর তুলনায় মানুষ হিসেবে জাতি হিসেবে যে তিমিরে সে তিমিরেই রয়ে গেলাম।
বাইশ
ইংরেজদের মত খেলাধূলা প্রিয় জাত দুনিয়াতে আর দ্বিতীয় আছে কিনা সন্দেহ। খেলাধূলার ভেতর দিয়ে একটা জাত যে কিভাবে গড়ে উঠতে পারে, তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ইংরেজরা।
খেলা যে শুধু আমোদ-প্রমোদের জন্যে, কি কাজকর্মের চাপ থেকে নিজেকে একটু দূরে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে ফাঁকা মাঠে কি খেলার জন্যে নির্ধারিত ঘরের ভিতরেই জীবনের গতানুগতিকতা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যে, তা নয়। খেলাতে মন প্রফুল্ল হয়, স্বাস্থ্য গড়ে উঠে, আর সব চেয়ে বেশী করে গড়ে উঠে মানুষের খেলোয়াড়োচিত মনোবৃত্তি, তার ব্যক্তি এবং জাতীয় চরিত্র। খেলার এক একটা টিমে যে কয়জন মানুষ থাকে তাদের মধ্যে। পারস্পরিক সমঝোতার দরকার হয়। একে অন্যেকে বুঝতে গেলে প্রথমেই আসে। স্বার্থত্যাগের কথা। টিম এবং জাতির জন্যে না খেলে শুধু নিজের জন্যে খেলতে গেলেই পরাজয় অনিবার্য। এক একজন লোক যত বড়ো খেলোয়াড়ই হোক না কেন, টিমকে অবহেলা করে কৃতিত্ব জাহির করতে যেই এগিয়েছে, অমনি দেখা গেছে তার সীমাবদ্ধ ক্ষমতা শেষ হয়ে আসছে। অথচ নিজে একা নাম কেনার লেভি না করে টিম এবং দেশের নামের জন্যে খেলতে গেলেই দেখা যাবে হয় সকলে এক সঙ্গেই জয়ী হচ্ছে, না হয় টিম হিসেবেই একত্রে বিজিত হচ্ছে। এতে মিলেমিশে দায়িত্ব গ্রহণ করার জন্যে খেলোয়াড়দের মন তৈরী হয়। তাছাড়া নিয়মানুবর্তিতা এবং শখলা সম্পর্কে জ্ঞানও খেলার ভেতর দিয়ে ছেলেবেলা থেকে মানুষের মনে যেমন করে গেঁথে যায়, এমন আর কিছুতে সম্ভব নয়। এতে আরও আছে, খেলাকে খেলা বলে ধরে নিয়ে জীবনকে সহজভাবে গ্রহণ করার শিক্ষা। অতি জয়ে উল্লাস খেলার মধ্যেই স্বাভাবিক। সে জয়কে ভবিষ্যৎ জয়ের পথে প্রেরণা দেবার উপক্রম হিসেবে যতোটা গ্রহণ করা যায়, বসে বসে তার স্মৃতি রোমন্থন করার দিক থেকে সে পরিমাণে ততোটা সমর্থন করা যায় না। আবার পরাজিত হলেও হা হুতাশ করে সময় ক্ষেপণ করা খেলার কোনো বিধানেই নেই। খেলার অর্থ সুস্থ প্রতিযোগিতা, জীবন ও প্রতিবেশকে সহজভাবে গ্রহণ ও বর্জনের শিক্ষা। জীবনের প্রতি এ দৃষ্টিভংগী গড়ে তুলতে খেলা মানুষকে প্রেরণা যোগায়। খেলার মাধ্যমেই ইংরেজ এ দৃষ্টিভংগীর অধিকারী।
দেশীয় প্রকৃতি আর ভৌগোলিক পরিবেশ ইংরেজদের জীবনের গতি নির্ধারণ করেছে। আর সে জীবন বিকাশের পরিপোষক খেলাধুলার সৃষ্টি করেছে এরাই। ইংরেজদের প্রিয় খেলাগুলো ক্রিকেট, ফুটবল, রাগবী, টেনিস আর নৌকা বাইচ। এক একটি খেলাকে অবলম্বন করে এদের কতো ক্লাব আর কতো-না প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে, আর একটা খেলার জন্যে এক অঞ্চল অন্য অঞ্চলের সঙ্গে বুনো বেড়ালের মতো কি ভাবেই না প্রতিযোগিতা করে, তা না দেখলে বা ভেতরে ওর না ঢুকলে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় না।
একদিন দেখছি লণ্ডন শহরের পশ্চিমাঞ্চল বিচিত্র এক ধরনের কোচে ভরে উঠলো। তার ভেতর বিচিত্র পোশাকে সজ্জিত নরনারী দেখেই বোঝা যাচ্ছে, এরা ইংলণ্ডের অধিবাসী নয়। লণ্ডনের তো নয়ই। শুনলাম ইংলণ্ড ও স্কটল্যাণ্ডের মধ্যে ফুটবল প্রতিযোগিতা হবে। তা দেখবার জন্যে আর স্কটল্যান্ডের সমর্থন করার জন্যে হাজার হাজার স্কচ নরনারী এসেছে লণ্ডনে। সে জন্যেই এত কোচের আমদানী। পরে শুনলাম স্কচেরা দু’গোলে ইংলণ্ডকে হারিয়ে দিয়েছে। স্কচদের বিজয়োল্লাস দেখে কে? হাতে এক ধরনের ডুগডুগী নিয়ে লণ্ডনার্সদের নাক বরাবর বাজাতে বাজাতে তারা তাদের বিজয়-গৌরব ঘোষণী করে যাচ্ছে। সে যে কি উল্লাস, তা কি বলে বুঝাবো।
লণ্ডনের এফ. এ. কাপ প্রতিযোগিতা সে তো এক বিখ্যাত ব্যাপার। এফ. এ. কাপের ফাইনাল খেলা দেখবার জন্যে কত লোক যে বছরের পর বছর প্রতীক্ষা করছে তার ইয়ত্তা নেই। ইংলণ্ডের সেরা ‘সকা’ (Soccer) প্রতিযোগিতা এটি। এ্যাষ্টনভিলা, আরসেনাল ম্যানচেষ্টার ইউনাইটেড, নিউক্যাসল ইউনাইটেড প্রভৃতি বিখ্যাত “সকা’ (ফুটবল) ক্লাবগুলোর মধ্যে এফ. এ. কাপ খেলার যে প্রতিযোগিতা হয়, প্রথম বিভাগ লীগের খেলায়ও ততটা নয়। আর এ টিমগুলোর যে কোনোটির খেলাই দেখবার মতো। দেখে জীবনব্যাপী স্মরণ রাখার মতো। অবিভক্ত ভারতের কলকাতার বিখ্যাত ও দুর্ধর্ষ মোহামেডান দলই এদের কোনো কোনোটির ধারে কাছে আসার যোগ্যতা অর্জন করেছিল। এখনকার পাক ভারতের টিমগুলোর কথা নাইবা বললাম।
ফুটবল এদের জাতীয় খেলা। তেমনি জাতীয় খেলা রাগা(রাগবী) আর ক্রিকেট। ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা অবশ্য ইংলণ্ডের এখন একচেটিয়া নেই। অষ্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, ওয়েষ্ট ইণ্ডিজ, নিউজিল্যাণ্ড, পাকিস্তান এবং ভারতেও ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা যথেষ্ট। অষ্ট্রেলিয়া ইংলণ্ডের কাছে যতবার টেষ্টে হেরেছে, ইংলণ্ড অষ্ট্রেলিয়ার কাছে হেরেছে তারও চেয়ে বেশী করে। বহুদিন ধরে হারতে হারতে দীর্ঘদিন পর এই তে সম্প্রতি ইংলণ্ড অষ্ট্রেলিয়ার কাছ থেকে এ্যাসেজ উদ্ধার করলো। তবু ক্রিকেটের জন্মভূমি হিসেবে আজও ইংল্যণ্ডের গৌরব অক্ষুণ্ণ এবং ক্রিকেটের জন্মদিন থেকে, বলতে কি, ইংলণ্ডই এক রকম একে লালন পালন করে আসছে। ভাঙা গড়ার ভেতর দিয়ে স্বনামখ্যাত এম. সি. সি (মার্লিবোন ক্রিকেট ক্লাব) এখনও সমানভাবেই টিকে আছে। ক্রিকেট ভক্ত, কি ক্রিকেট ফ্যান নরনারীর সংখ্যা এখানে প্রতি দশজনে একজন কি তার চেয়েও বেশী বেড়ে চলেছে। আমার এক ইংরেজ বন্ধুর সঙ্গে একদিন ওদের জাতীয় খেলা-ধূলা নিয়ে আলাপ করছি। কথায় কথায় সে বললে, ‘ভারত আমরা ছেড়ে এসেছি তাতে দুঃখ নেই; পাক-ভারত আমাদেরকে তাড়িয়েছে তাও সত্যি, কিন্তু ওরা আমাদের ক্রিকেটকে যে আঁকড়ে ধরেছে। তাতেই আমি খুশী।
ইংলও চারিদিকে সাগর পরিবেষ্টিত বলে বাইরের জগতে বেরোতে হলেই সমুদ্র ছাড়া ইংরেজদের আর গতি নেই। সেজন্য সমুদ্রকে এরা ভয় করে না, তাকে জয় করবার সাধনা এদের ছেলেবেলা থেকে। পার্কে মাঠে ঘাটে কৃত্রিম লেক কি নদী নালা তৈরী করে হাঁটি হাঁটি পা পা টলি টলি গা’র বয়সের শিশুদের ধরে এরা নৌকা চালানো শেখায়। নদী নালার সঙ্গে তাদের পরিচিত করে তোলে। তারপর বয়স হতে না হতেই সাগরের সঙ্গে মুখোমুখি করিয়ে দেওয়া হয়। সাগরের কথা বলতেই ইংরেজরা তার সঙ্গে কেমন যেন এক প্রীতির সম্পর্কে গদগদ হয়ে উঠে। এ কারণেই বোধ হয় নৌকা বাইচও এদের জাতীয় খেলাগুলোর অন্যতম। প্রতি বছরের অক্সফোর্ড ও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতায় সারা ইংলণ্ডে একটা কাপরূপ স্পন্দন অনুভূত হয়। বছরের একটি দিনের অল্প কয়েক মিনিটেই যে খেলার পরিসমাপ্তি, তার জন্যে সারা বছর ধরে এ বিশ্ববিদ্যালয় দ’টির ছেলেরা প্রস্তুতি চালায়। কতো তার আয়োজন। প্রথমতঃ নয় নয়টি সক্ষম প্রতিযোগী খুঁজে বের করা হয়। তারপর উপযুক্ত শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে চলে বছর ধরে ওদের শরীর চর্চা ও নিয়ম পালন। শরীরের ওজন বাড়ছে কি কমছে, শরীর হালকা হচ্ছে, না ভারী হয়ে যাচ্ছে, সেদিকে রাখতে হয় এদের বিশেষ দৃষ্টি। এ কঠিন নিয়ম ও সংযমশাসনের ভেতর দিয়ে প্রতীক্ষিত প্রতিযোগিতার জন্যে এদের তৈরী করা হয়। অবশেষে আসে রেসের দিন। সেদিন দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের নয় দু’গুণে আঠারটি ক্রুর শুধু যে নামধামই ওদের আপন আপন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে গ্রথিত হয় তা নয়, ইংলণ্ডের জাতীয় জীবনের ইতিহাসে অল্প কিছুক্ষণের সংগ্রামের ভেতর নিয়ে যারা আর একটি পাতা যোজনা করে দিচ্ছে তাদের প্রত্যেকের হাত পা প্রভৃতি শরীরের প্রত্যেকটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মাপও লেখা হয়ে যায়। ওদের শরীরের উক্ত বর্ণনা থেকে দু’চার দশ বছর অথবা ওদের মৃত্যুর পরেও যে কোন সুদক্ষ ভাস্কর ওদের প্রস্তরমূর্তি গম্বড়ে দিতে পারে। টেমস নদীতে পাটনী ব্রিজের কাছে রেস আরম্ভ হয়। নেহায়েত খারাপ আবহাওয়ার জন্যে রেস যদি বাতিল না হয়ে যায়, তাহলে রেস দেখার জন্য পাটনী থেকে মোটলেক পর্যন্ত টেমূসের পাঁচ মাইল ব্যাপী এ ঘুরপাক খাওয়া দুম্বতীর ঘিরে মেঘবৃষ্টি মাথায় করে থোক, কি স্বচ্ছ পরিষ্কার আকাশের নীচেই হোক, সমগ্র ইংলণ্ডই একরকম ভেঙ্গে পড়ে।
১৯৫১ সালে অক্সফোর্ড-কেমব্রিজের রেস দেখলাম। রেসের দিন মনে হলো ইংলণ্ডের সব নরনারীই, ছেলে বুড়ো সকলেই যেন টেমসের দু’পারের পাঁচ মাইল কম্বরে দশ মাইল ঘিরে ভেঙ্গে পড়েছে। কোথাও তিল ধারণের স্থান নেই। কেউ কেব্রিজের পক্ষ নিয়েছে। কেউ নিয়েছে অক্সফোর্ডের। নদীর দু’পাশে গগনবিদারী চীৎকার আর উল্লাস। আর নদীর মধ্যে উভয় দলের প্রতিযোগীদের মধ্যে সে কি প্রাণপণ প্রতিযোগিতা। অক্সফোর্ডের নৌকার মুখ একটু আগে বাড়ে তো কেমূব্রিজ মরিয়া হয়ে তার আগে বেরোয়; আবার অক্সফোর্ড মরণমুখী টান টানে। নৌকার এ টান তো নয়, জাতীয় জীবন সংগ্রামেই অমর হয়ে বাঁচবার জন্যে আঠারো জন ইংরেজ সন্তানের সে কি দুঃসাহসিক অভিযান। এদের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে এদের মাথার উপরে আকাশে উড়ছে রয়াল এয়ার ফোর্সের এ্যারোপ্লেন। পেছনে এদেরকে অনুসরণ করছে নেভির ছোট একটি বহর। সঙ্গে দুর্ঘটনা মোকাবেলা করার আয়োজন। ব্রড়কাষ্টিং এবং টেলিভিশনের সুচারু ব্যবস্থা। কেমব্রিজ জিতলো বারো নৌকার ব্যবধানে।
খেলাধুলায় প্রতিযোগিতা তো সর্বত্রই হয়। সে প্রতিযোগিতার মধ্যে নির্মল সুস্থ ভাবও অনেক জায়গায় লক্ষ্য করা যায়। সেখানে এদের যে খুব বৈশিষ্ট্য আছে তা মনে করি না, কিন্তু এ সব খেলাধূলা বিশেষ করে এ নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণকারীদের পেছনে সমগ্র দেশের এমন গণসমর্থন সহসা চোখে পড়ে না। এ বোট রেস শুধু যে উভয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মুষ্টিমেয় কয়েকটি ছেলের তা নয়, সমগ্র জাতিরই। সমগ্র জাতিই তাদের জয়-পরাজয়ে সমানভাবে তাদের বেদনার বা আনন্দের অংশীদার হয়ে ওঠে।
তেইশ
পয়লা জেমস তখন ইংলণ্ডের রাজা। সেকালের ইংলণ্ডে প্রটেষ্টান্ট ও ক্যাথলিকদের মধ্যে বাগড়া বিবাদ লেগেই থাকতো। পার্লামেন্টেও প্রটেষ্টান্টদের একচেটিয়া অধিকার। গাই ফক্স ছিলেন ক্যাথলিক। তিনি সাধারণ মানুষেরই একজন। মনে মনে বুদ্ধি আঁটলেন পার্লামেন্ট হাউসটাই একেবারে উড়িয়ে দিতে হবে। দিনটা ছিল পাঁচই নভেম্বর। পার্লামেন্টহাউসে বারুদ দিয়ে আগুন দিতে যাবেন, এমন সময় তার পরিকল্পনা ফাস হয়ে। গেলো। তিনি সঙ্গে সঙ্গে ধরা পড়ে গেলেন। সেদিন থেকে প্রতি পাঁচই নভেম্বর রাত্রে ইংলণ্ড গাই ফকুসের উৎসব উদযাপন করছে। এ উৎসব অবশ্য গাই ফকসের স্মৃতি রক্ষার জন্যে নয়, বরঞ্চ পার্লামেন্ট যে বেঁচে গেলো তার আনন্দোৎসব পালন করার জন্যে।
এটা ইয়ুথ ফেষ্টভ্যাল। ছেলেমেয়ে আর যুবক যুবতীদের উৎসব। দু’এক মাস আগে ছোটো ছেলেমেয়েরা মুখে কালি ঝুলি মেখে তার প্রস্তুতি চালায়। বেকার ষ্ট্রীট ষ্টেশনের কাছে এক সন্ধ্যায় আনমনে ঘুরছি। কয়েকটি দশবারো বছরের ছেলেমেয়ে কালিঝুলি মেখে কিম্ভূতকিমাকার রূপ ধরে ‘Penny for a Guy’ ‘Penly for a Guy” করতে করতে আমার কাছে ছুটে এল। পেনি না পেলে আমাকে কিছুতেই ছাড়বে না ভাবখানা এ রকম। বুদ্ধিমানের মতো ওদের দুজনার কৌটায় দুটো পেনি দিয়ে সরে পড়তেই দেখি আর একদল আমার দিকে ছুটে আসছে। আমি দ্রুত পাশ কেটে সরে পড়লাম।
অবশেষে পাঁচই নভেম্বরের রাত এলো। সবেবরাতের রাতে পটকা ফোঁটানো দেখেছি। কিন্তু এখানে সে কি পটকা ফোঁটানো! পটকা আর তবড়ির আওয়াজে কান ঝালাপালা হয়ে গেলো। আগুনের খেলায় দেখছি লণ্ডন শহর যেন মেতে উঠেছে। স্কুল কলেজের ছেলেমেয়েরাই এ খেলায় অগ্রণী। গাওয়ার স্ত্রীটে ইউনিভার্সিটি কলেজের সামনে এসে দেখি যেন কলেজের দালানেই আগুন লেগে গেছে। আগুনের শিখা যেন গগন স্পর্শ করতে চায়। তার পাশে ছেলেমেয়েরা একত্রে মিলেমিশে নাচছে আর গান গাইছে। হাত তালি দিচ্ছে আর অনেকটা আমাদের সাঁওতালি নাচ নাচছে। একদল নাচতে নাচতে মেতে উঠেছে, অন্যদল তখন তাদের লক্ষ্য করে পটকা কি চড়বড়ি ছুঁড়লো। কারুর জামা কাপড়ের মধ্যে চড়বড়ি ঢুকলো। কেউ হয়তো লাফিয়ে উঠে চিৎকার করে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো।
আমাদের দেশের অনেক জায়গায় যেমন মহররমের মিছিল হয়; এক একটা দল এক জায়গা থেকে বের হয়ে একটা নির্দিষ্ট জায়গা প্রদক্ষিণ করে কিংবা সব দলই এক জায়গায় এসে জামায়েত হয়, তেমনি দেখছি লণ্ডনের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এসে এ উৎসব মিছিলে যোগ দিয়েছে। তারা নিজেদের এক একটা খোলা বাস নিয়েছে। বাস সাজিয়েছে নানাভাবে। তাতে নানা পোষ্টার। এক একটা পোষ্টারের ভাষা এক এক রকম। কোনটায় লেখা England 49th State of the U.S.A., কোনটায় হয়তো খাদ্য মন্ত্রীর সমালোচনা। কোনোটায় রক্ষণশীলদের প্রতি ব্যঙ্গ, কোনোটায় শুধু আমোদ ও বিভীষিকা সৃষ্টির জন্যেই বীভৎস সাজসজ্জা। লণ্ডনের আকাশও আলোয় আলোয় আলোকিত হয়ে উঠেছে।
সামনে যাচ্ছে এ ধরনের খোলা বাস! তারই পেছনে চলেছে ভিন্ন ভিন্ন কলেজের ছেলেমেয়ে ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে। ভিড়ের চাপে কেউ হারিয়ে না যায় কিংবা ছিটকে না পড়ে সেজন্যে তারা নিজ নিজ কোমরে দড়ি বেঁধেই নিজ প্রতিষ্ঠানের বাসের অনুগামী হয়ে ছুটছে। ভিড়ের মধ্যে কেউ যে দড়ি বাঁধা অবস্থাতেই ছুটতে গিয়ে আছাড় খেয়ে পড়ছে
তা নয়।কিন্তু ও পড়াতেই আর ভিড়ে চাপা খাওয়াতেই তাদের আনন্দ। এতে কেউ আহত হচ্ছে, কাউকে হয়তো হাসপাতালে যেতে হচ্ছে। কিন্তু হিসেব করে চলতে কাউকে দেখছি না। জীবনের জোয়ার যখন আসে, যৌবনের উচ্ছল আবেগ যখন মানুষকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়, তখন জীবনকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলা আর যৌবনের ভাণ্ডার থেকে অফুরন্ত ঐশ্বর্য ছড়িয়ে যাওয়াতেই বোধ হয় যুবক-যুবতীর চরম আনন্দ।
চব্বিশ
বিলেতে এসে খেয়াল না করলেও প্রথমেই যা বিদেশীদের চোখে পড়ে এ দেশের পুলিশ তার একটি। গলা থেকে পা পর্যন্ত কালো ওভারকোট ঢাকা, মাথায় টোপ পরা দৈর্ঘ্যে প্রস্থে মানানসই মানুষগুলো পথের মোড়ে মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে। হাজার হাজার লোকে চলাফেরা করছে, তার মধ্যে এ লোকগুলো সবার আগে চোখ পড়ে তাদের শরীর ও স্বাস্থ্যের জন্যে। পুলিশের কাজ করার জন্য বাছাই করে লোক নেওয়া হয়। শরীরের নির্দিষ্ট একটা মাপ ছাড়া কেউই পুলিশ হতে পারে না।
পুলিশ সম্পর্কে আমাদের দেশে সাধারণ একটা ভয়ই আছে। ইংরেজরা লাল পাগড়ী পরা পুলিশ দিয়েই আমাদের প্রায় দুশো বছর শাসন করে গেলো। আমাদের দেশের মেয়েরা কোলের বাচ্চাদের শাসন করতে আর কান্না থামাতে যুযুর ভয় দেখিয়ে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে পুলিশেরও। আমরা যে পরিবেশে মানুষ সে পরিবেশে, বিশেষ করে শতাব্দীর বিশ কি তিরিশ সালের দিকে বুদ্ধি হলেই দেখেছি পুলিশের কারণে অকারণে শুধু মানুষ ধরে নিয়ে যেতো। একে মায়ের দেখানো ভয় তার ওপর বুদ্ধি হবার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশদের লোক ধরার তৎপরতা দেখে মনে মনে যে সংস্কার জন্মে গেছে, বড়ো হয়ে মন যখন বিচারসহ হয়েছে তখনও অজ্ঞাতসারে পুলিশ সম্বন্ধে কেমন একটা বিরূপ ধারণা আমাদের ভেতরে রয়েই গেছে। এ ধারণা বদ্ধমূল হয় গ্রামাঞ্চলে দারোগা জমাদারদের দুর্বিষহ অত্যাচার আর ঘুষ নেওয়ার জারিজুরি দেখে। এরা যে আমাদের দেশের Essential Service-এর লোক, এদের অনেকের অবাঞ্ছিত ব্যবহার দেখে সে কথা মনেই পড়ে না।
বিলেতে পুলিশগুলোর এ রকম পোশাক-পরিচ্ছদ আর বপু দেখে ভয় যেন আরও ঘন, হয়ে উঠে। কিন্তু ভয় ভাঙে একবার এদের সংস্পর্শে এলেই। পথে বেরিয়ে পথ হারিয়ে এদেরকে কিছু জিজ্ঞেস করে এদের কাছ থেকে যে ব্যবহার পেয়েছি তা এতো মিষ্টি যে, তাতে মুগ্ধ না হয়ে পারি নি। লণ্ডনের পথ ঘাট লণ্ডনের খাস অধিবাসীদেরও জানার কথা নয়; পুলিশেরা যতো জানে ততো আর কেউ নয়। জানা থাকলে তো কথাই নেই সঙ্গে সঙ্গে এমন নির্দেশ দেবে যে, অন্ধও তার গন্তব্য পথ খুঁজে বের করতে পারবে। আর জানা না থাকলে নিজের নোট বুক কি পুঁথি পাজি খুঁজে ফোন করে একটা না একটা তথ্য সে উদ্ধার করে দেবেই। এমন মিষ্টি কথায় সে লোককে তুষ্ট করে দেয় যে তার কথা শুনে মনে হয় সে যেন তার পরম হিতাকাফী বন্ধু। বহু দিন আমার এ অভিজ্ঞতা হয়েছে। ঐ শালপ্রাংশু দেহের মধ্যে এতো মিষ্টি মন যে কারুর থাকতে পারে, এদের সংস্পর্শে না এলে সহসা তা। বিশ্বাসই করা যায় না।
ভারী ভালো লাগে ওদের বাচ্চাদের রাস্তা পার করার দৃশ্য দেখতে। বাচ্চারা দলে দলে স্কুলে যাচ্ছে। কি স্কুল থেকে ফিরছে। পথে হয়তো পিঁপড়ের সারি মতো বাস টেক্সির স্রোত চলছে। কয়েক মিনিট অন্তর ক্ষণিকের জন্য গাড়ী যখন থামে, বড়ো মানুষেরা সে ফাঁকে রাস্তা থেকে রাস্তান্তরে পার হয়ে যেতে পারে। বাচ্চাদের পক্ষে সব সময় তা সম্ভব নয়। তাছাড়া সময় মতো তাদের স্কুলেও যেতে হবে। তাই পুলিশ তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসে। তারা পথের মোড়ে হুইশেল দিয়ে গাড়ীর বহর থামিয়ে দেয়। বাচ্চারা সে ফাঁকে রাস্তা পার হয়ে যায়। আর পুতুলের মতো ছোট ছোট বাচ্চাদেরকে ওরা কোলে বুকে করে নিজেরাই সুন্দর পার করে দিচ্ছে। পুলিশদের হাতে পড়ে ওদের কোলে চড়ে বাচ্চারা যে কতো নিরাপদ বোধ করছে তা ফুটে ওঠে ওদের চোখে মুখে।
এছাড়া ইংলণ্ডের কটল্যাওইয়ার্ড চুরি ধরতে আর দুষ্টের দমন করতে, আর সবার উপরে গোয়েন্দাগিরি করতে দুনিয়া বিখ্যাত। ইংলণ্ডে যে ডিটেকটিভ গালগল্প গল্লোপন্যাস। গড়ে উঠেছে, তার সূত্রপাত দেখি স্কটল্যাণ্ডইয়ার্ডের অদ্ভুত ও দুঃসাহসিক কাজের মধ্যে। ছোটখাটো চুরি যাকে আমরা হেঁচড়ামি বলি এমন কিছু বিলেতে লাখে একটি হয় কিনা। সন্দেহ। যে সব দুঃসাহসিক ও রোমাঞ্চকর চুরি ডাকাতি হয়, স্কটল্যাণ্ডইয়ার্ড তার চেয়েও রোমাঞ্চকর পদ্ধতিতে তার মোকাবিলা করে। এতে তাদের বুদ্ধির দীপ্তির পরিচয় পাওয়া যায়, আর পাওয়া যায় দুঃসাহসিক কাজে লিপ্ত হওয়ার মানসিকতা।
বিলেতে পুলিশেরা রুজির পথ হিসেবে এ চাকরি গ্রহণ করলেও শুধু চাকরির জন্যেই যে চাকরি করা ওরা তা করে না। এ চাকরিতে এদের আনন্দ আছে। দেশ এবং মানব সেবার ব্রত নিয়েই ওরা এ করতে আসে। নইলে বিপদে আপদে মানুষ চরম ভরসাস্থল হিসেবে পুলিশের আশ্রয়ে ছুটে আসবে কেন? পুলিশ এ দেশের মানুষের জ্ঞাতি, তাদের বন্ধু। সে জন্যে সমাজও পুলিশদের সুনজরে দেখে। সমাজেও তাদের নাম আছে।
মনে পড়ছে, আমি আর আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উর্দুর রীডার ডাক্তার মাসুদ হোসেন একদিন কেমুব্রিজ থেকে ট্রেনে করে লণ্ডনে ফিরছি। আমাদের কামরায় কেমব্রিজ অঞ্চলের কৃষক পরিবারের একটি সরল শান্ত মেয়ে উঠলো। সেও আসছে লণ্ডনে। Excuse Ine বলে অপরিচয়ের ব্যবধান ঘুচিয়ে যেই তার সঙ্গে কথাবার্তা শুরু করলাম, অমনি মেয়েটির গ্রাম্য সরলতা এবং কথাবার্তার অকৃত্রিম আবেদন মন স্পর্শ করলো। প্রথম পরিচয়ে ইংরেজকে ব্যক্তিগত প্রশ্ন করতে নেই তা জানি। কিন্তু কৌতূহল দমন করতে না পেরে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার মা বাবা বেঁচে আছে? সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললে, ‘বাবা গত যুদ্ধে মারা গেছেন, তবে মা আছেন।
জিজ্ঞেস করলাম, “তোমার আর ভাই বোন নেই?’
সে উত্তর করলে, ‘আমার আর দুটি ভাই আছে।’
–’তারা কি করে?’
–‘এক ভাই চাষবাসের কাজ করে সে বাড়ীতেই থাকে। আর এক ভাই পুলি-শ ম্যান।’
‘পুলিশম্যান’ শব্দটি দ্বিতীয় অক্ষরটির উপরে চাপ দিয়ে তাকে বিশেষ ভাবে দীর্ঘায়িত করে এক অদ্ভুত ভঙ্গীতে সেটি উচ্চারণ করে মেয়েটি যে এক তৃপ্তিভরা সৃষ্টি দিয়ে আমাদের দিকে চাইলো, তাতে পুলিশম্যানের বোন হতে পারার গৌরবে তার বুক যে ভরে উঠেছে, আমাদের কাছে তা আর লুকানো রইল না।