বিলেতে সাড়ে সাতশ দিন – ১৫

পনের

লণ্ডনে পাকিস্তানের হাই কমিশনের বেসমেন্টের রেস্তোরাঁয় বসে একদিন লাঞ্চ খাচ্ছি। পাকিস্তানী এবং ভারতীয় ছেলেরা মুখের স্বাদ বদল করতে প্রায়ই এখানে খেতে আসে। রেস্তোরাঁর অধিকারী এক বিত্তশালী পাকিস্তানী। পাকিস্তান থেকেই বাবুর্চি আমদানী করা হয়েছে। পরিবেশনকারিণীরা সব কয়টিই ইংরেজ। আমরা কয় বন্ধু মিলে এক টেবিলে বসে খাচ্ছি। পাশে বিলেতে নবাগত এক পাঞ্জাবী শ্ৰেষ্ঠীকে দেখছি খেতে। ভদ্রলোক সিদ্ধ খাবারের দেশ বিলেতে রসনা-পরিতৃপ্তিকর দেশী পোলাও কোরমা পেয়ে গোগ্রাসে গিলছেন। তাঁর কোরমা ফুরিয়ে যাওয়াতে হাতের তুড়ি দিয়ে ‘ওয়েট্রেস’ এর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললেন- Waitress. give me a plate of this- কোরমার দিকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন।

পরিবেশকারিণী ইংরেজ তরুণী ভদ্রলোকের সম্ভাষণের ধারা দেখে রীতিমতো চটে গেছে তা বুঝতে পারলাম তার চোখে মুখে বিরক্তির আভাস দেখে। কাজ যখন করতেই হবে, তখন তার কথা না শুনে বেচারী পারেই বা কি করে? বিরক্তির সঙ্গেই এক প্লেট কোরমা সে ভদ্রলোকটিকে এনে দিল। মেয়েটি ভদ্রলোকটির কাছ থেকে অন্তত একটা মামুলি ধন্যবাদ পাবারও আশা করছিলো। ধন্যবাদ যে দিতে হবে সে জ্ঞানটুকু ভদ্রলোকটি লণ্ডনে এই প্রথম এবং সদ্য-আগত বলে হয়তো আয়ত্ত করতে পারে নি। বুঝলাম দেশে বহু চাকর-বাকর খাঁটিয়ে খান। তাদের কাছ থেকে সেবা আদায় করেন টাকার দাবীর জোরে। তাদেরও যে ব্যক্তিত্ব আছে এবং পারিশ্রমিকের ওপরেও শ্রমের একটা মর্যাদা যে দিতে হবে, আমাদের দেশের আর পাঁচজন বিত্তশালী লোকের মতো তিনিও তা জানেন না। এ ইংরেজ মেয়েটিকে ধন্যবাদ দেওয়া তে দুরের কথা তিনি কোরমা পেয়ে আবারও নির্বিকারভাবে গিলে যেতে লাগলেন। আমরা খাচ্ছি। বন্ধুদের পরস্পরের প্রতি মুখ চাওয়া চাওয়ি করছি। ভদ্রলোক এবং তরুণীটির পরস্পরের ব্যবহার দেখে মুচকি মুচকি হাসছি। আর ভাবছি, শেষ পর্যন্ত মেয়েটি কি করে।

ভদ্রলোকের দ্বিতীয় প্লেট কোরমাও খাওয়া হলো। তিনি আবারও পূর্বের ভঙ্গীতে হাতের তুড়ি মেরে যেই ইংরেজ তরুণীটির দৃষ্টি আকর্ষণ করতে গেছেন, অমনি মেয়েটি। ক্ষোভে অভিমানে একেবারে হাউইয়ের মতো ফেটে পড়ে বললো, Gentleman, don’t you know manners? এ রকমের যে কিছু একটা হবে, ওর চোখে মুখে আসন্ন ঝড়ের আভাস দেখে তা বুঝতে পেরেছিলাম। তাই বিস্মিত হইনি। কিন্তু যাকে লক্ষ্য করে এসব কাণ্ড ঘটে গেল, তিনি কিন্তু কি অন্যায় করেছেন তা তখনও বুঝতে পারেননি। এবার মেয়েটিকে দেখলাম। ক্রোধ তার কমে এসেছে। অভিমানে নাকের ও চোখের কোণ-ঘেঁষা কান্না চেষ্টা করেই বেচারী চেপে যাচ্ছে।

এ বিশ্রী কাণ্ডটা আমরা আর এগুতে দিলাম না। উভয় পক্ষকেই সামলে নিলাম। ভাবছি, মেয়েটি এরকম ক্রোধেই বা ফেটে পড়লো কেন? আর লজ্জায় অভিমানে কান্নাই বা চাপলো কেন। ভদ্রলোকের সম্বোধনের ধারায় মেয়েটির শালীনতাবোধ এবং আত্মমর্যাদায় আঘাত লেগেছে। আমাদের দেশের ঝি-চাকরের মতো সে কারো ঝি নয়। সেবাদাসী তো নয়ই। সে ঘন্টা ধরে খাটতে এসেছে। সে শ্রম করবে আর তার শ্রমেরই দাম নেমে। কিন্তু শ্রম করবার সময় মানুষ হিসেবে এবং ব্যক্তিবিশেষ হিসেবে তার মর্যাদা, সেও যে Miss অমুক এ বোধ কোন ক্রমেই সে ক্ষুণ হতে দিতে চায় না। এরকম ক্ষেত্রে ইংলণ্ডের আর পাঁচজন নরনারীর মতোই Miss Waitress. would you give me a plate of ইত্যাদি ধরনের একটা সম্বোধন সে আশা করেছিলো। প্রথমত, সে তা পায় নি। দ্বিতীয়ত, পরিবেশন করার পর ভদ্রলোকটির কাছ থেকে সৌজন্যসূচক একটা ধন্যবাদও স্বভাবতই সে পেতে পারতো, তাও পায়নি। আত্মসচেতন মেয়েটির এতে রাগ হবার কারণই বটে। তাই দ্বিতীয় কি ততীয় বারে একই জিনিস বারংবার ঘটতে দেখে নিজেকে সামলাতে না পেরে এ অভিমানিনী মেয়েটি রেস্তোঁরা ভরা এতগুলো লোকের মধ্যে একটি নাটকীয় দৃশ্যের নায়িকা রূপে ফুটে উঠেছে।

এ রকম ক্ষেত্রে সব ইংরেজ নারী পুরুষই যে এমন দৃশ্যের অবতারণা করে তা নয়। ইংরেজদের হোটেল রেস্তোরাঁয় বহু বিদেশী নিত্য খানাপিনা করছে। সকলেই যে ইংরেজদের আদব, তরীকা বা etiquette জানে তাও নয়। তবে এরকম হলে কেউ নিজেকে সামলাতে পারে, কেউ পারে না। কিন্তু একটি কথা সত্য যে, সকলেই এ আচার আচরণের ত্রুটি-বিচ্যুতি লক্ষ্য করে। তার কারণ, ইংরেজদের তীক্ষ্ণ আত্মসচতেনতা বা আত্মমর্যাদাবোধ। এ ব্যক্তি-স্বাতন্ত্রের যুগে এখানকার সাধারণ নরনারীও এক একটি ব্যক্তিবিশেষ। তারা এক একটি Individual. তাদের এ বৈশিষ্ট্য-বোধ থেকে অপরে তাদেরকে সম্মান করুক, তাদের মর্যাদা রক্ষা করুক, এও যেমন তারা চায়, তেমনি অপরকেও তারা যথাযোগ্য সম্মান দেয়। এ পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধই হলো ইংরেজদের নাগরিক জীবন বোধের গোড়ার কথা।

অনুভূতি যে তাদেরকে অপরের প্রতি কতো বিবেচনাশীল এবং সহানুভূতিসম্পন্ন করে তুলেছে, তা বলে শেষ করা যায় না। সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন চলাফেরা, ওঠা বসা, কাজকর্ম দিয়ে জাতীয় চরিত্রের বিচার করা যায়। আমি কিছুদিন ধরে একটি মধ্যবিত্ত ইংরেজ পরিবারের সঙ্গে বাস করছি। কর্তা, গিন্নী, দুটি সোমত্ত মেয়ে, একটি স্কুলে পড়ুয়া আর একটি লণ্ডন বিশ্ববিদ্যালয়গামী ছেলে নিয়ে এই পরিবারটি। মেয়ে দুটির একটি নার্স আর একটি নাচের শিক্ষয়িত্রী। স্থানীয় একটি নাচের স্কুলে সে নাচ শেখায়। এদের বড়ো ভাইয়ের নাম ডেরিক হার্ড। লণ্ডনে আমার সঙ্গে এক হোষ্টেলে থাকে। গরমের ছুটিতে কিছুদিনের জন্যে সকলেই একত্রে বাস করছে। এদের মা বাবা ভাই বোনদের প্রত্যেকের শিক্ষা এবং জীবিকার পথ আলাদা। প্রত্যেকের জন্যই স্বতন্ত্র ঘর। আপন আপন ঘরে প্রত্যেকেরই দেখছি রেডিও সেট রয়েছে। সন্ধ্যার পরে যে যার ঘরে ঢুকে আপন আপন। কাজে মনোনিবেশ করলো। সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের ঘরে রেডিও চলতে লাগলো। কিন্তু এক ঘরের রেডিওর আওয়াজ অন্য ঘরে শোনা গেল না। ডেরিকের বড়ো বোনকে জিতে করলাম, এতো ধীরে রেডিও ছেড়েছ কেন?’ সে বললে, ‘ধীরে কোথায়? এর চেয়েও ধীরে ছাড়লে আমি যদি শুনতে পেতাম তা হলে তাই করতাম। আমার রেডিও আমারই রুচি অনুসারে আমারই শোনার জন্যে। অন্য কেউ শোনার জন্যে আমাকে তো অনুরোধ করেনি। জোর করে আমি যদি শোনাতে যাই, তা হলে তারা শুনবে তো নাই, বরং মনে মনে বিরক্ত হবে। তাদের অসুবিধে হবে।’

দেখছি, মিস্ হার্ড শুধু তার নিজের কথাই বলছে না, তার জাতের প্রতিনিধি হিসেবেই যেন সে আমার কাছে তার বক্তব্য পেশ করছে। কোন ইংরেজ বাড়ীতে জোর করে অপরের বিরক্তি উৎপাদন করে কোন রেডিও চালাতে কি শোরগোল করতে দেখলাম না।

যা বলছিলাম। উত্তর লণ্ডনের ওয়েষ্টবিয়ার রোডের এক পোলিশ পরিবারের পেইং গেস্ট হিসেবে আমি কিছুদিন বাস করেছি। আমাদের সঙ্গে এই পরিবারে এক ইংরেজও বাস করতেন। ডিনার টেবিলে বসে এর সঙ্গে নানা প্রকার খোশগল্প করতাম। এক রাত্রিতে পরীক্ষার দুর্ভাবনায় আমার ঘুম আসছে না। ঘরের মধ্যে আমি পাইচারী করছি। এপ্রিলের রাত্রি। তখন দুটো বাজে। আর ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই ভোর হবে। আকাশ পরিষ্কার আছে বলে হয়তো সূর্যের মুখ দেখতে পাবো। শঙ্কা হ্রাস অস্বস্তিতে মন আমার ভরে উঠেছে। ঘরে থাকতেও ভালো লাগছে না। বাইরে গিয়েই বা নিষ্কৃতি কোথায়? মনের এই দোলায়মান অবস্থায় আমার ঘরের দরজা খুলতেই দেখি একটা ছায়ার মতো সূন্ন পদাথ সন্তর্পণে রেলিং ধরে ধ’রে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে যাচ্ছে। মনে খটকা জাগলো। এত রাত্রে এতো চুপিসারে কে এমন গোপন অভিসার ক’রে ফিরছে? তাকে অনুসরণ করলাম। আস্তে আস্তে উপরে উঠতে দেখি সেই ইংরেজ ভদ্রলোক অত্যন্ত সন্তর্পণে দরজা খুলে তার নিজের ঘরে ঢুকে পড়লেন। আমি আর তাকে বিরক্ত করলাম না। বুঝলাম, এতো রাত্রে বাইরে থেকে এসেছেন বলেই এ সতর্কতা। এ না করে ভাড়া দিয়ে এখানে থাকেন বলে, অথবা নিজের ঘর বলে তার দাবী প্রতিপন্ন করার জন্যে ধমাধম আওয়াজ ক’রে সিঁড়ি দিয়ে উঠে ‘জোরসে দরজা খুলে আরও বেশী জোরে দরজা লাগিয়ে ধড়াম করে বিছানায় পড়তে পারতেন। কিন্তু তাহলে এ বাড়ীতে যে আরও মানুষ আছে এবং এতো রাত্রে সকলেই যে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন থাকতে পারে, এ বিবেচনা তার আছে বলে বোঝানো যেতো না। তাই চোরের মতো চুপিসারে তিনি উপরে উঠে গেলেন। ভাগ্যিস চোর বলে আমি চেঁচিয়ে উঠে কোন অনাসৃষ্টি কাণ্ড বাধাইনি।

অপরের প্রতি বিবেচনাশীলতা ইংরেজের এমনি মজ্জাগত এবং জীবনধারার অঙ্গীভূত হয়ে গেছে যে, অনেক সময় তার বাড়াবাড়িও কম দেখিনি। একদিন সেলফরীজ-এ গিয়ে কতকগুলো টুকিটাকি জিনিস কিনলাম। খুচরা পয়সা ছিল না, তাই কাউন্টারের ভদ্রমহিলাটিকে একটি পাউণ্ড দিলাম। তিনি তার পাওনা রেখে চেঞ্জগুলো আমাকে ফিরিয়ে দিচ্ছেন। কয়েকটি শিলিং আর অনেকগুলো পেনি আমার হাতে দিতে গিয়ে একটা করে কয়েন আমাকে দেন, আর বলেন, “থ্যাঙকিউ আর একটি দেন, আর বলেন, “থ্যাঙকিউ। এ থ্যাংকস দিতে দিতে ভদ্রমহিলা ক্লান্ত হয়ে শেষে সংক্ষিপ্ত পথ ধরলেন-”কিউ-কিউ কিউ’।

ইংরেজের জাতীয় চরিত্রের এ-বৃহত্তম নাগরিক চেতনা প্রতিফলিত হতে দেখি তার খুঁটিনাটি আচার আচরণে, Manners এবং etiquette-এ। শোবার ঘরে কি বসার ঘরে থুথু ফেলে এরা দেওয়ালকে চিত্রিত করে না। এমন কি রাস্তাঘাটেও সাধারণত এদের থুথু ফেলতে কি নাক ঝাড়তে দেখা যায় না। প্রয়োজন হলে হয় রুমালে ফেলে বাড়ীতে নিয়ে এসে সেটি নিজেই কেচে নয় কিংবা এমন কোন জায়গায় ফেলে যেখান থেকে কোন রকম রোগজীবাণু সংক্রামিত হতে না পারে। ঠিক তেমনি ডিনার কি লাঞ্চটেবিলে বসে খাবার শেষে আর পাঁচ জনের সামনে দাঁতে লেগে থাকা খাবারের কণা বের করবার জন্যে দাঁতের ফাঁকে ফাঁকে কাউকে খেলাল চালাতে দেখলাম না। খেলাল করার প্রয়োজন যে এদের হয় না তা নয়, কিন্তু সেটা এরা সারে পাশের ‘ওয়াশিংরুমে গিয়ে। কাশি বা হাঁচি যে এদের আসে না তা নয়, কিন্তু মানুষের সামনে হাঁচি দিলে Excuse me ব’লে দোষটা এরা সারিয়ে নেয়। ক্লাশে প্রফেসারের বক্তৃতা শুনতে শুনতে ক্লান্ত ছাত্রছাত্রীকে অনুরূপ ক্ষেত্রে আমাদের দেশের ছাত্রছাত্রীদের মতো শিক্ষকের সামনে বসে থেকে বোয়াল মাছের মতো হা করে হাই তুলতে কি খাবি খেতে দেখলাম না।

কোনো জায়গায় আলোচনা সভা চলছে কিংবা একের অধিক লোকজন ব’সে কোনো রকম ঘরোয়া আলোচনাই চালাচ্ছে হয়তো। সে রকম ক্ষেত্রে একজন কথা বলা শুরু করলে যতোক্ষণ পর্যন্ত তার কথা শেষ না হয়, ততক্ষণ আর কেউ কথা বলবে না। সকলেই একসঙ্গে কথা বলবার চেষ্টা করে আসর গরম করে তুলবে না-অবশ্য যদি না কোনো দুষ্টবুদ্ধি প্রাণোদিত হয়ে কেউ আলোচনা সভা ভণ্ডুল করে দিতে চায়। কোনো কমন রুমে কিংবা লোকবহুল কোনো ঘরে আমাদের দেশ থেকে এ পরিবেশ-অনভিজ্ঞ কোনো মানুষকে যদি হঠাৎ এনে ছেড়ে দেওয়া যায়, তাহলে এতোগুলো লোকের এক সঙ্গে সমাবেশ অথচ চেঁচামেচি না করে তাদের পার্শ্ববর্তী লোকের সঙ্গে পরস্পরকে ফিস ফিস করতে দেখে তারই বিরুদ্ধে এরা কোনো ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে কিনা তা ভেবেই সে হতচকিত হয়ে যাবে। এদের জাতীয় চরিত্রের এ গুণগুলোর কথা যতোই ভাবি, ততোই মুগ্ধ ও বিস্মিত না হয়ে পারি না। ব্যক্তি ও জাতীয় জীবনের এ যে মহৎ গুণ সে কথা অস্বীকার করবে কে?

ষোল

মানুষকে কষ্ট থেকে বাঁচানোর জন্য পথ থেকে একটি কাটা সরিয়ে দেওয়া ইসলামে ঈমানের লক্ষণ। অপরের প্রতি বিবেচনা থেকেই এই ধর্মপ্রবণতার জন্ম। ইংলণ্ডের সাধারণ মানুষের মধ্যে এ গুণের যথেষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়।

আমাদের বাড়ীর পাশেই ঘরের কোনো জিনিস ফেলে রাখবার উপায় নেই। ঘটি, বার্টি, হেঁসে, বটি যাই কোনো ঘরের বাইরে ছেলেপুলেরা খেলতে খেলতে ফেলে আসুক না, দদণ্ড পরে সেগুলো খুঁজতে গিয়ে কি আর পাওয়া যাবে? দোতলা, তেতলা থেকে কাপড়-চোপড় যদি বাতাসে পড়ে যায়, দু’দণ্ড পরে খোঁজ নিলে সেগুলো কি আমরা আর ফিরে পাই?

ইংলণ্ডের মানুষ এ ধরনের মানসিক অশান্তি ও আতঙ্ক থেকে মুক্ত। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর থেকে ইংলণ্ডের বাজারের মতো বড়ো বড়ো দোকানগুলোর খোলা মেলা জায়গা থেকে কিছু কিছু জিনিস অবশ্য উধাও হতে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু অসতর্কতার জন্যে কখন কোন্ জিনিসটা না জানি হারিয়ে যায়, এ আতঙ্কে সব মানুষের মন অস্থির থাকে না। ইংলণ্ড যে বড়ো চুরি এবং বড়ো ডাকাতি থেকে একেবারে মুক্ত তা নয়। সেখানেও সংঘবদ্ধভাবে বড়ো বড়ো চুরি ডাকাতি হয়। তবে সে চোর ডাকাতদের নজরে থাকে ‘মারি তো হাতী আর লুট তো ভাণ্ডারের দিকে। মাছি মেরে তারা হাত গন্ধ করতে চায় না। ফলে সাধারণ মানুষের মনের স্বস্তিবোধ নষ্ট হয় না। ইদানিং ইংলণ্ডের বড়ো বড়ো শহরগুলোতে নানান জাতির লোক এসে বসবাস করছে। সে জন্যে ছোটখাটো চুরি এবং ‘ক্রাইম’ কিছু কিছু বাড়ছে। এর জন্যে দায়ী খাস ইংলণ্ডের লোকেরা অবশ্য নয়।

লণ্ডন, ম্যানচেষ্টার এবং ডাণ্ডি প্রভৃতি শিল্পাঞ্চলগুলোতে আমাদের নোয়াখালি, চট্টগ্রাম এবং সিলেটের অনেক লোক স্থায়ীভাবে বসবাস করছে। এদের অধিকাংশই এসেছে। জাহাজের খালাসী হয়ে। কিন্তু জীবনের বিচিত্র স্বাদ পাওয়ায় এখান থেকে আর দেশে ফিরে যায় নি। ম্যানচেষ্টারে নোয়াখালির একটি লোকের সঙ্গে আমার কথা হচ্ছিল। তার মাসিক আয় আমাদের হিসাবে শ চারেক টাকা। আমাদের দেশে মাসে সে গোটা পঞ্চাশেক টাকা পেলেই নিজেকে ভাগ্যবান মনে করতো। আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম, এতো টাকা তুমি কি করে উপায় করো?’ সে বললে, “জানেন, এখানকার লোকগুলো ভারী বোকা। আর মেম সাহেবগুলো আরও বেশি; শনি রবিবারে আমি ফুটপাথে নাইলন বিক্রি করি। যে দাম বলি তাতেই কেনে। কোন দর দস্তুর করে না। আমি যে দামে কিনি তার চেয়ে যে অনেক বেশী দাম নিই তার জন্য কিছু একটু বলেও না। বুঝলাম, একে তো খাস ইংরেজরা। স্বদেশে কোনো জিনিসের দর করে না, তার ওপর সপ্তাহ শেষে শ্রমিক শ্রেণীর লোকেরা মাইনার কাঁচা টাকা হাতে পেয়ে আপনার শক্তি মতো দেদার খরচ করে। এরই ফলে এদের শ্রীবৃদ্ধি, কিন্তু আর কতোদিন বাইরের লোকেরা এদেরকে এমন করে ঠকাবে?

এক লণ্ডন শহরে প্রতিদিন বাসে, ট্রেনে এবং টিউবে যে কতো লোক চলাফেরা করছে, তার সংখ্যা গণনা করা সহজ ব্যাপার নয়। শীতের আর অনিশ্চিত আবহাওয়ার দেশ ইংলণ্ড। সে জন্যে অধিকাংশ মানুষই হাতের গ্লভস, বর্ষাতি, ওভারকোট, ছাতা ইত্যাদি সাজ-সরঞ্জাম নিয়ে চলাফেরা করে। কতো লোক যে ভুল করে কতো জিনিসপত্র ছেড়ে যাচ্ছে, তা দেখে চোখ স্থির হয়ে যায় লণ্ডন ট্রান্সপোটের লষ্ট প্রপার্টি অফিসে গেলে। যে যা কিছু ফেলে যাচ্ছে, সব গিয়ে জমা হচ্ছে এ অফিসে। একজন ভুল করে কোন জিনিস ফেলে গেল বলে আর একজন হৃষ্টচিত্তে সেটি ঘরে নিয়ে এসে নিজের বলে দাবী করবে না, বরং সে সহায়তা করবে জিনিসটি যেন মালিকের কাছে কিংবা লষ্ট প্রপার্টি অফিসে ঠিকমতো পৌঁছে সে জন্যে। আপন আপন জিনিসের পরিচয় ও বর্ণনা দিয়ে এ অফিস থেকে জিনিসের মালিক তার জিনিস উদ্ধার করে নিয়ে আসছে। দেশের সাধারণ মানুষ যদি সহায়তা না করে, তাহলে এমন বিহিত ব্যবস্থা গড়ে তোলা কোনো প্রতিষ্ঠানের পক্ষে সহজ নয়, সম্ভবও নয়।

এ প্রসঙ্গে আমার নিজের জানা একটি ছোট ঘটনার কথা বলি। একদিন আমার এক বন্ধুর সঙ্গে পাকিস্তানের হাইকমিশন থেকে এক ট্যাক্সি করে কয়েক জায়গা ঘুরে ফিরে বাসায় এলাম। তিনি তার কতকগুলো কাজের জন্যে সেদিন সকালেই তার এ্যাকাউন্ট থেকে পঞ্চাশটি পাউও তুলে মানিব্যাগে করে নিয়ে বেরিয়েছিলেন। অন্য কতকগুলো কাজের চাপে পড়ে সেদিনের মতো তিনি আর টাকা খরচ করতে পারেন নি। কথা বলতে বলতে আর মানিব্যাগটা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে কখন যে টাকা শুদ্ধ মানিব্যাগটি টাক্সিতে ফেলে রেখেছেন, তা তিনিও খেয়াল করেন নি, আমিও না। কয়েকটি জায়গা ঘুরে ফিরে আমরা যখন বাসায় পৌঁছলাম, তখন রাত্রি দশটা হবে। নিশ্চিন্তে রাত্রি কাটিয়ে সকাল বেলায় ব্রেকফাষ্ট খেয়ে আমরা যখন বাইরে বেরোতে যাচ্ছি, তখন উনি পকেটে হাত দিয়ে দেখেন, টাকাটা শুদ্ধ তার মানিব্যাগ নেই। শুনে আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল। তিনিও এমন কিছু বড়ো লোক নন। দেশে স্ত্রী পুত্র ফেলে এসেছেন একটা ডিগ্রী নিয়ে দেশে ফিরে নিজের ক্যারিয়ার ভালো করার জন্যে। হঠাৎ ট্যাক্সিতে এতগুলো টাকা হারানোর বেদনা তারও চোখে মুখে ফুটে উঠতে দেখলাম। তাকে কি বলে সান্ত্বনা দেবো ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। গতকাল ট্যাক্সিতে হাতে করে মানিব্যাগ নাচাতে নাচাতে সেখানেই যে অন্যমনস্কভাবে সেটি ফেলে আসা হয়েছে, তাতে কোন সন্দে রইলো না। কিন্তু এখন সে ট্যাক্সি ড্রাইভারকেই বা পাওয়া যায় কি করে? তার ট্যাক্তির নাম্বার নেওয়া হয়নি, জানিও না। তাকেও আমরা চিনি না, সেও আমাদের চেনে না। তাছাড়া আমাদের নামিয়ে দেওয়ার পর সে যে অন্য আরোহী নিয়ে চলাফেরা করেনি তারই বা নিশ্চয়তা কি? সে আরোহীই যে হাতে পেয়ে এমন মুফতের মাল মেরে দেয় নি, তাই বা কি করে বলি? নানা দুর্ভাবনায় এবং অশান্তিতে আমাদের সেদিনটা কাটলো। পরের দিন সকালে দেখি সেই ট্যাক্সি ড্রাইভার স্বয়ং আমাদের বাসস্থানে মানিব্যাগ শুদ্ধ এসে হাজির হয়েছে। সে রাত্রে আমাদেরকে আমাদের বাসস্থানে রেখে যাওয়ার পর আরও দু’জন আরোহীকে সে তাদের গন্তব্যস্থানে পৌঁছে দেয়। পরদিন সকালে গাড়ী নিয়ে বেরনোর সময় এ মানিব্যাগ তার নজরে পড়ে। খুলে দেখে তার ভেতরে এ টাকাগুলো রয়েছে। মানিব্যাগেও নাম ঠিকানা কিছু লেখা নেই। কার ঐ মানিব্যাগ কিছু ঠিক করতে না পেরে সেদিন যত লোক সে ভিন্ন। ভিন্ন জায়গায় নামিয়েছে, সে সব জায়গায় ঘুরে ঘুরে সারাদিন খুঁজে কোনো কুলকিনারা না। পেয়ে আজ সকালে আসে আমাদের খোঁজে এবং ওটা যে আমাদেরই বিশেষভাবে সে তথ্য জেনে আমাদের হাতে টাকা শুদ্ধ মানিব্যাগটা সঁপে দিয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। যথার্থ মালিকের হাতে এ টাকাগুলো তুলে দিতে পারায় সে যে কি আনন্দ পেয়েছে, তার মুখ দেখেই বুঝতে পারলাম।

এ মানুষটির সততা দেখে আমি বিস্মিত হয়ে গেলাম। দরিদ্র ইংরেজ। ট্যাক্সি চালিয়ে। এমন কিইবা সে পায়? নিশ্চয় আর্থিক স্বচ্ছলতার ভেতরে তার জীবন কাটে না। সুতরাং মুত এ টাকাটি পাওয়াতে তার আনন্ম হবার কথা। তাছাড়া না খেটে দু’চারদিন বেশ। “আরাম করার কথা। কিন্তু তা না করে সে কিসের জন্যে এ অজানা অচেনা লোকগুলোর পেছনে ধাওয়া করে ফিরেছে। যতোই একথা ভাবছি, ততোই সাধারণ ইংরেজের সততায় এবং মহত্ত্বে মুগ্ধ হয়ে উঠেছি।

এ রকম ঘটনা যে আমাদের দেশে কখনও ঘটে না তা নয়। চাকায় একবার আমার এক বন্ধুর পকেট থেকে একটা ডায়রি পড়ে যায়। তাতে তার নাম ঠিকানা, সাংসারিক আয়ব্যয়ের হিসেব, প্রয়োজনীয় নানা টুকিটাকি টাকা ছিল। আর ছিল গোটা কুড়ি টাকা। বন্ধুটি মনে করেছিলেন, এ টাকা কয়টির জন্যেই তিনি তাঁর নোট বইটি আর ফিরে পাবেন না। নইলে হয়তো ওটা পাওয়া যেত। মৌলবী বাজারের এক দোকানদার সেটা পান এবং মালিকের হাতে টাকা শুদ্ধ ফিরিয়ে দেবার জন্যে তিনি ভয়ানক ব্যতিব্যস্ত হয়ে ওঠেন। নোট বইটিতে বন্ধুটির পরিচিত যতো লোকের টেলিফোন নম্বর লেখা ছিল ভদ্রলোক নিজের গাটের পয়সা খরচ করে সব জায়গায় টেলিফোন করেন এবং অবশেষে এক জায়গায় যথার্থ মালিকের খোঁজ পেয়ে তার হারানো ধন তাঁর কাছে ফিরিয়ে দিয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেন। এমন লোক যে আমাদের দেশে নিতান্ত বিরল তাও নয়। তবু দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর থেকে অভাবের তাড়নায় হোক, কি বড়োদের অসততার জন্যেই হোক আমাদের দেশে এর বিপরীত ধরনের ঘটনাই বেশী ঘটছে।

লণ্ডনে আর একদিনের কথা বলি। নতুন এসেছি। পথ ঘাটও তেমন চিনি না। দু’মিনিটের পথ যাই দশ মিনিটে। সাউথ লণ্ডনে কি একটা অফিসেরে খোঁজ করে ফিরছি। রাস্তার এধারে ওধারে তাকাই। খুঁজে পাই না। সাহস করে কাউকে যে জিজ্ঞেস করবো, এমনও ভরসা হয় না। যাট পয়ষট্টি বছরের এক বৃদ্ধ পাশের দোকান থেকে অনেকক্ষণ ধরে আমার এ অসহায় অবস্থা লক্ষ্য করছিলো। শেষটায় আমি কি খুজছি এবং আমাকে কোনভাবে সাহায্য করতে পারে কিনা, সে কথা উঠে এসে জিজ্ঞেস করলো। অমুক অফিসে যেতে চাই তাকে বলতেই অফিস খুঁজে বের করবার জন্যে সে চঞ্চল হয়ে উঠল। ওকে একে জিজ্ঞেস করে লোকজন জড়ো করে সে একটা হুলস্থুল কাণ্ড বাধিয়ে তুললো। ভদ্রলোকের কাণ্ড দেখে আমি যে কি বিব্রত বোধ করতে লাগলাম, তা আমিই জানি। শেষ পর্যন্ত আমাকে ঠিক মতো অফিসে পৌঁছে দিয়ে সে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো।

ইংলণ্ডে এসে অবধি খবরের কাগজগুলোতে বিদেশীদের এ ধরনের অভিজ্ঞতার কথা হরদম পড়ছি। দেশে থাকতেও বিলেত ফেরতদের কাছ থেকে এ ধরনের কথা অনেক শুনেছি। এ লোকগুলো কিন্তু দেশের চালক নয়। বিদ্বান বুদ্ধিমান এবং রক্ষণশীল ইংরেজও নয়। এরা এ দেশের সাধারণ মানুষ। এরাই দেশের অধিকাংশ। সুতরাং এরাই তো দেশ। যে দেশে এ রকম লোকের সংখ্যা বেশী, সে দেশের অধঃপতন সহজে আসে না এবং মরতে বসেও যে সে দেশ বেঁচে ওঠে, ইংলণ্ড তার নিদর্শন।

সতের

সাধারণ ইংরেজ ছাড়াও আর এক রকমের ইংরেজ আছে, যারা সাধারণের বিপরীত অর্থাৎ অসাধারণ। এরা যে সংখ্যায় খুব বেশী তা নয়, তবু দেশের ভাগ্য নির্ধারণে, রাজ্য পরিচালনায়, সংস্কৃতির সেবায়, শিক্ষার আদর্শ রক্ষায় এবং বুদ্ধির সাহায্যে জীবিকা নির্বাহে এদের কিছু কিছু পরিচয় পাওয়া যায়। দেশ এবং জীবনের সমস্যার দিকে এরা চোখ মেলে দেখে রক্ষণশীল দৃষ্টিভংগী দিয়ে। এরা যে ইংরেজ সে অহমিকা বোধ এদেরকে এক মুহর্তের জন্যও ছেড়ে যায় না। এরা মিথ্যা কথা বলে না। তাই বলে সত্য কথাও বলে না। যা বলে তার বিবিধ ব্যাখ্যা হয় আর অন্যলোকে যাকে বলে মিথ্যা, এ ইংরেজরা তাকে বলে “ডিপ্লোমেসী’। চোখে-মুখে এদের দৃঢ়তাব্যঞ্জক ভাষা দেখা যায়। ব্যবহারে নমনীয়তা এবং কোমলতা থাকলেও তা সহজবোধ্য নয়। এদের ব্যবহার নিতান্ত ফর্মাল। এদের সঙ্গে বন্ধুত্ব হলেও তা যেন সহজে গাঢ় হতে চায় না। অন্যের আচরণে কোন্‌টি কখন যে এদের কাছে রূঢ় হয়ে দাঁড়ায়, তাও বলা মুস্কিল। এদের ব্যবহারের উপরের এ আবরণ ভেদ করে হৃদয় জয় করা রীতিমত সময়সাপেক্ষ এবং আয়াসসাধ্য ব্যাপার। এরা কারুর প্রতি বিরক্ত হলে আমাদের মতো ক্রোধে ফেটে পড়ে না। সম্পূর্ণভাবে মন না খুলে আভাসে-ইঙ্গিতে তা প্রকাশ করে। এসব ইংরেজ স্বদেশে তো এক রকম থাকে, কিন্তু রাজ্যশাসন করতে বিদেশে বেরোলো তাদের অভ্যাস ও আচরণ সবই বদলে যায়। সুয়েজের এপার পর্যন্ত তারা দেশী আচরণই বজায় রাখে, কিন্তু সুয়েজ পার হলেই তারা যেন খোলস ছেড়ে নতুন করে উগ্র হতে থাকে।

বিশর বলে আমার এক মিশরীয় সহপাঠী বন্ধুর কথা মনে পড়ছে। ভদ্রঘরের একটি ইংরেজ মেয়ের সঙ্গে তার প্রণয় হয়। প্রায় বছরখানিক ধরে কোর্টশিপ চলার পর তাদের প্রণয় যখন গাঢ় হয়ে উঠলো, তখন পরিণয়ের প্রস্তাব এলো মেয়েটির দিক থেকেই। বিশ্বর তার মা-বাবাকে লিখে পাঠায়। বিদেশীর সঙ্গে ছেলের বিয়ে দিতে তার মা-বাবা রাজী হন না। এতে মেয়েটি ক্ষুব্ধ হয়ে বিশরকে বলে, ‘আমি বিদেশী না তুমি?’ বিশর উত্তর দেয়, ‘ইলণ্ডে অবশ্য আমি, কিন্তু মিশরে?’

সেখানেও আমি ইংরেজ, আমি বিদেশী নই’_মেয়েটি উত্তর দেয়।

বিশরের বন্ধু বলে আমিও এ মেয়েটিকে জানতাম। ইনষ্টিটিউট অব এডুকেশনে সে এম.এ. পড়তো। মেয়েটি একে ভদ্রঘরের তাতে শিক্ষিত। আঘাত খেয়ে এভাবে সে গোখরো সাপের মত ফণা তুলে ধরেছে, তবু সত্যকে স্বীকার করতে চায়নি।

আঠারো

পোশাকের ভেতর দিয়ে এক এক জাতির জাতীয়তা ফুটে বেরোয়। পোশাকের ব্যাপারে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের আঞ্চলিক কিছু বৈশিষ্ট্য থাকলেও এরা মোটামুটি আন্তর্জাতিক। পুরুষের সুট আর নারীর স্কার্ট আর ব্লাউজই হলো এদের প্রচলিত পোশাক। সুট যে সব সময়ই পুরোপুরি হয় তা নয়। ওয়েষ্ট লণ্ডনে রাসেল স্কোয়ার, টুরিংটন স্কোয়ার, বৃটিশ মিউজিয়াম প্রভৃতি স্থানের কয়েক বর্গ মাইল নিয়ে একটা ব্লুমসবেরী অঞ্চল গড়ে উঠেছে। ভৌগোলিক সীমারেখা কিংবা ডাক বিলির শাসন বিধানের জন্য লণ্ডনের যে আঞ্চলিক বিভাগ আছে, সে বিভাগ মতে মসবেরির সন্ধান পাওয়া যাবে না। তথাকথিত এক অদ্ভুত শ্ৰেণীর বুদ্ধিজীবীদের খেয়ালের সৃষ্টি ঐ অঞ্চলটি। বহুকাল থেকে এ নামেই পরিচিত। আর এ অঞ্চলের বুদ্ধিজীবীদের সে বিশেষ শ্রেণীটা পরিচিত Bloomsbury Intellectual. সংক্ষেপে B. নামে। পোশাক পরিচ্ছদে এরা কিদ্ভুতকিমাকার। প্যান্ট এক রং এর তো জ্যাকেটু অন্য রং এর। জুতো এক রং এর তো টাইএর রং ভিন্ন। সাধারণ ইংরেজের চুলের যে পরিচর্যা দেখা যায় এদের তা থাকে না। চুল হয়তো কদিন ধরে ঠিকমতো হ্রাস করা বা আঁচড়ানোই হয়নি। দাড়ি হয়তো প্রতি তিনদিন অন্তর কি সপ্তাহে দুবার শেভ করা হচ্ছে। খোঁচা খোঁচা দাড়ি নিয়ে ভিন্ন রং আর ততোধিক ভিন্ন মাপের ট্রাউজার, জ্যাকেট আর টাই ইত্যাদি পরে B.I-রা পথে বেরোন। পোশাক পরিচ্ছেদে, এ রকম অদ্ভুত প্রকৃতির জীব ইংলণ্ডের অঞ্চলবিশেষে কিছু কিছু পাওয়া যায়। নইলে পুরুষের পোশাকে সর্বত্রই একটা সমতা রয়েছে।

পোশাকের ব্যাপারে ইংরেজদের সংস্কার (কুসংস্কারও বলতে পারি) কম নয়। স্লিপিং সুট পরে শোবার ঘরের বাইরে বেরোনো যাবে না। ঘরের বাইরে পা রাখতে গেলেই ড্রেসিং গাউন গায়ে ফেলে বেরোনোর রীতি। ঘরেও স্লিপিং সুট পরিহিত অবস্থায় থাকলে স্ত্রী। কি বিবাহ সম্পর্ক অচল এমন নারী ছাড়া অন্য নারীর আনাগোনা রীতি-বহির্ভূত। মনে পড়ছে বেকার স্ট্রীট ষ্টেশনের নিকটবর্তী একটি বোর্ডিং হাউস-২৯নং নাটিংহাম প্লেসের কথা। এক স্কচ ল্যাণ্ডলর্ড আর আইরিশ ল্যাওলেড়ি দু’জনে মিলে এটি চালান। উভয়ের মধ্যেকার সম্পর্ক রহস্যাচ্ছন্ন। বিদেশী এবং এদেশেরও অনেক নরনারী পেইংগেষ্ট হিসেবে এখানে থাকে। একদিন আমাদেরই এক দেশী বন্ধু তার ঘরে দেশী ভাত তরকারী রান্না করে খাচ্ছে। দূর সম্পর্কের এক চাচাত বোন তার অতিথি। ভালো কাপড় চোপড় নষ্ট হবে ভেবে বেচারী সুট পরে নি। তার কামরা বন্ধ করে বোনের সঙ্গে মিলে সে পাকসাক করছে স্লিপিং-সুট অর ড্রেসিং গাউন পরে। বিড়াল খুঁজবার ভান করে ল্যাণ্ডলর্ড তার দরজায় টোকা দিয়ে ঢুকেই চেঁচিয়ে হুলস্থুল কাণ্ড বাধিয়ে তুললো। সে যে নিয়ম ভেঙ্গে শোবার ঘরে পাক করে খাচ্ছে তার জন্য নয়; সে আছে স্লিপিং সুট পরে। এ অবস্থায় তার কামরায় দিনে-দুপুরে এক তরুণী। এ দেখে তার পিলে চমকে গেছে। সে তো একেবারে পুলিশ ডাকতে উদ্যত। আমরা তাড়াহুড়া করে ছুটে গিয়ে তাকে বুঝিয়ে বললাম আমাদের দেশের রীতির কথা। কিন্তু কে কার কথা শোনে! শেষ পর্যন্ত আমাদের বন্ধুকে দিন কয়েকের মধ্যেই এ বাড়ী ছেড়ে যেতে হলো।

অদ্ভুত এদের সংস্কার। ড্রেসিং গাউন পরে খাবার টেবিলে আসা যাবে না, এমন কি। ড্রইংরুমেও না। জ্যাকেট দিয়ে ঢাকা না থাকলে ট্রাউজারের ওপরের বেসে কি গ্যালিস পরে কোনো ভদ্রমহিলার সামনে বেরোনো যাবে না। সী বীচে গিয়ে পরিচিত অপরিচিত নরনারী অর্ধনগ্ন অবস্থায় একই সঙ্গে রোদ পোয়াচ্ছে, সমুদ্র-স্নান করছে। তাতে আপত্তি নেই কিন্তু ড্রইংরুমে স্নানের পোশাক পরে কোন ভদ্রমহিলার সামনে কোনো পুরুষ যদি হঠাৎ এসে পড়ে, তাহলে তখনই সে মূৰ্ছা যাবে।

পুরুষের বেলায় পোশাক সম্বন্ধে যে বিধান বা শাসনই থাক না কেনো, মহিলাদের বেলায় তার সাত খুন মাফ প্রাকৃতিক নির্বাচনের রীতি অনুসারে টিকে থাকার জন্যে, অথবা পুরুষের চিত্ত জয় করে সিংহীর মতো তার বুকে বিরাজ করার জন্যে এরা যেন একে অন্যের সঙ্গে সৌন্দর্য প্রতিযোগিতায় নেমেছে। ইংলণ্ড তথা ইউরোপের পুরুষ প্রকৃতির নির্মমতা থেকে বাঁচবার জন্যে পোশাকের আবরণে নিজেকে করলো গোপন, আর প্রকৃতি ধর্মী নারী তার চোখ জুড়াতে, তাকে মাতিয়ে আর তাতিয়ে তুলতে ভাজে ভাজে নিজেকে আগী করে তার মুঠি মুঠি ঐশ্বর্য ছড়িয়ে দিয়ে গেলো।

উনিশ

যদি ইটালীকেই আধুনিক চিত্রশিল্পের লালন ক্ষেত্র বলে ধরা হয়, তাহলে অনুকৃত শিল্পের তথা মনোকল্পিত সৃষ্টির সূতিকাগার ধরতে হয় গ্রীসকে। প্রাচীন গ্রীকরা ছিল পেগান অর্থাৎ দেহাত্মবাদী। দেই পূজা থেকে যেমন বিধাতার উদ্দেশ্য সফল হলো, পৃথিবী আবাদ হলো, তেমনি মানুষের মনে তীর কাম্য ও পূজ্য মানুষকে সুন্দর করে তোলবার জন্য ধীরে ধীরে জন্ম নিল সুন্দরের চর্চা ও সাধনা। দেহকে উপেক্ষা করে নয় বরং সে দেহকেই স্বতন্ত্র মহিমায় ভূষিত করার জন্য, দেহকে পূজার দেবী করে তোলবার জন্য দেহের অধিকারীর মন জয় করার সাধনা চললো যুগ যুগ ধরে। বিধাতার সৃষ্টি নরনারী এবং নগ্ন প্রকৃতিকে মানুষ সাজালো তার চিত্তের রং, রূপ, রস ও রেখা দিয়ে। সুন্দর করে প্রতিমা গড়লো প্রিয়জনের। আর আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে তার প্রিয়জনকে করলো চিত্রে রূপায়িত। কাব্যে সংগীতে সাহিত্যে তার আত্মার আকাঙ্ক্ষা এবং চিত্তের ভাব ও ভাবনাকে শব্দ সম্বলিত করে সুন্দর করে দিয়ে গেল। চিত্তের এ সাধনায় শিল্প সাধক ইউরোপ যে সার্থকতা লাভ করেছে, তা বুঝি এর শিল্পীদের সৃষ্টি–বৈচিত্র্য দেখে আর তাদের জনপ্রিয়তা দেখে।

ইংলণ্ডে এসে অবধি এখানকার জীবনধারার এক একটি দিকের সঙ্গে যতই না পরিচিত হচ্ছি, ততোই নতুন চিন্তাভাবনার পথ মুক্ত হচ্ছে। ইউরোপের অন্যান্য শিল্পের তুলনায় চিত্র শিল্পের সমাদর বোধ হয় বেশী। ইটালী, ইল্যাণ্ড, স্পেন, ফ্রান্স প্রভৃতি দেশের চিত্রশিল্পের বিশেষ সমারোহ দেখা যায়। এর মধ্যে চিত্রশিল্পের দিক থেকে ইটালীর আধিপত্য বেশী। র‍্যাফায়েল, মাইকেল এ্যাঞ্জেলো, লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি প্রমুখ বিশ্ব-বিশ্রুত শিল্পীরা ইটালীর সন্তান। বিশ্বের সাধারণ মানুষও এঁদের নামের সঙ্গে যতটা পরিচিত ততটা আর কার সঙ্গে নয়। ইউরোপের দেশগুলোর এক এক নগরীকে কেন্দ্র করে এক এক সময়ে চিত্রশিল্পের এক একটি ধারার সূচনা হয়েছে আর তার প্রভাব পড়েছে অন্যান্য দেশগুলোতে। শুধু ইউরোপের কথাই বা বলি কেন, ললিত কলার পূজারী বিশ্বের অন্যান্য জাতিগুলোও ইউরোপের নগর বিশেষের শিল্প-ধারায় কম প্রভাবান্বিত হয়নি। ফ্লোরেন্স, পিজা, ভেনিস, রোম প্রভৃতি নগরীতে প্রাথমিক রেনেসাঁস যুগের শিল্পকলার বিশেষ চর্চা হয়। ললিতকলার অনুসারী অন্যান্য জাতিগুলো এতে যেমন মুগ্ধ হয়েছে, তেমন সাধনার পথে এগিয়ে যেতে প্রেরণাও কম পায়নি।

ইংরেজরা দেশী বিদেশী ছোট বড়ো সকল শিল্পীর শিল্প-সাধনাকে জনপ্রিয় করার জন্য যে প্রয়াস পেয়েছে, তার পরিচয় পাওয়া যায় তাদের শিল্পাগারগুলো পরিদর্শন করলে। ন্যাশনাল গ্যালারী, রয়্যাল একাডেমী অব আর্টস গ্যালারী স্টেট গ্যালারী প্রভৃতি স্থায়ী শিল্পাচার তো লণ্ডনে রয়েছেই, তার ওপর খ্যাতনামা শিল্পীদের একটা না একটা শিল্প প্রদর্শনী আজ এখানে কাল সেখানে লেগেই আছে।।

আমি শিল্পী নই কিংবা শিল্প-সমালোচকও নই। ললিতকলার একজন সাধারণ ভক্ত হিসাবে আমি এগুলো প্রচার করি। বিশ্ব বিশ্রত এ শিল্পীদের অঙ্কিত ছবিগুলো দেখে যে কথাটা আমার প্রথম মনে পড়ে তা হচ্ছে সৃষ্টি সম্পর্কে স্রষ্টাদের সুস্পষ্ট ধারণা। প্রাকৃতিক দৃশ্য, পৌরাণিক গাল-গল্প ঐতিহাসিক ঘটনা এবং মানব-জীবনের বিশিষ্ট মুহূর্তগুলো এদের তুলির এবং মনের স্পর্শ পেয়ে নির্বিশেষে হয়ে উঠেছে বাস্তব। নিত্য পরিবর্তনশীল জগতে এদের মনের সৃষ্টি যেভাবে রূপায়িত হয়েছে সেখানে পরিবর্তন নেই, কালস্রোতও নেই–সৃষ্টি ও স্রষ্টা একাকার হয়ে অমরতা লাভ করেছে। মুগ্ধ হচ্ছি এসব চিত্র-শিল্পের বৈশিষ্ট্য দেখে। শিল্পীমনের ভাবকল্পনা মনের রং তুলির আঁচড়ে এমন ব্যঞ্জনা পেয়েছে যে, এক একটি চিত্রের ভেতর দিয়ে অনির্বচনীয়তা উপছে পড়তে চাইছে। তা শিল্পীর প্রতি দর্শকের মনকে একদিকে যেমন শ্রদ্ধায় ভরে তোলে, অন্যদিকে ছবিগুলোর ওপরের জৌলুস একটা বিস্ময়রসে তার চিত্তকে তেমনি চমৎকৃত করে দেয়।

১৯৫২ সালের শেষের দিকে রয়্যাল একাডেমী অব আর্টস-এ লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির পঞ্চশত বার্ষিকী স্মরণোৎসব উপলক্ষে তার শিল্পকৃতির একটি প্রদর্শনী হচ্ছিল। এখানে তার আঁকা নরনারী জীবজানোয়ার এবং প্রাকৃতিক দৃশ্যাদির কিছু স্কেচ দেখার সুযোগ পেলাম। মানব এবং জীবদেহ সম্বন্ধে তার গভীর জ্ঞান, তাদের আবয়বিক পরিমিতি এবং স্বাস্থ্যের প্রাচুর্য এসব ড্রইং-এর ভেতর দিয়ে যে কিভাবে ফুটে উঠেছে, তা না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না।

শুধু লণ্ডনই নয়, ফ্লোরেন্স রোম ভার্সাই পারী প্রভৃতি ইউরোপের নামকরা শহরগুলোর সর্বত্রই চিত্রশিল্পের সমাদর দেখা যায়। সৃষ্টি সার্থকতা স্রষ্টার নিজের মনে। কিন্তু সে সৃষ্টির যদি কদর না হয় যদি তার সমঝদার খুঁজে না পাওয়া যায়, দেশ বিদেশের লোকে যদি তার সৃষ্টির রস ও গুণ গ্রহণ না করে, তাহলে সৃষ্টি হয় ব্যর্থ, স্রষ্টার হয় অপমৃত্যু। ইউরোপে চিত্রশিল্পের যথারীতি সমাদর হয় বলেই এ শিল্পও স্বাভাবিকভাবেই স্বতংস্ফূর্ত হয়ে পড়েছে। বড় লোকেরা করেছে এর পৃষ্ঠপোষকতা আর সাধারণ মানুষ করেছে এর গুণ গ্রহণ। বিশেষ বিশেষ চিত্রশিল্প প্রদর্শনীতেই যে শুধু সাধারণ মানুষ প্রতিদিন ভীড় করছে তা নয়, স্থায়ী চিত্র গ্যালারীগুলোতেই দেখছি সাধারণ নরনারীর নিত্য আনাগোনা এরাই এদের শিল্পের সমঝদার, গুণগ্রাহী আর রসবেত্তা। সকল মানুষের চিত্ত জয় করতে পেরেছে বলেই ইউরোপে রাস্তার পেভমেন্ট থেকে ঘরের দেয়াল আর ছাদের নীচের তলায় চিত্রশিল্প এমনি করে ছড়িয়ে গেছে।

এর তুলনায় আমরা কোথায়? আমাদের দেশের সেরা শিল্পীদের চিত্র প্রদর্শনীতেই বা ক’জন লোক আসে? ক’জন বা তাদের সমঝদার? দু’চারজন এলেও ক’জন তাদের চিত্র পয়সা দিয়ে কেনে। নিজের ঘরে টাঙিয়ে রেখে চিত্তের পরিচর্যা করে? রুচির পরিচয় দেয়? শিল্পীর মন থেকে সৃষ্টি স্বতঃউৎসারিত হয়ে দেশের সাধারণ মানুষের মনে বাসা না বাধতে পারলে শিল্প কোথা থেকে প্রাণরস সংগ্রহ করবে। কি করে বাঁচবে?

ইংলণ্ডের সাধারণ মানুষ শুধু চিত্র শিল্পেরই সমঝদার আর ভক্ত? তাতো নয়। অপেরা, রেভূ সিনেমা, থিয়েটার, ব্যালে, প্যান্টোমাইম প্রভৃতি অবসর-বিনোদন ও চিত্তরঞ্জনের যে প্রভূত আয়োজন দেখি, তাতে এক রকম সব মানুষই ভেঙে পড়ে। কিন্তু কণ্ঠসংগীত ও যন্ত্রসংগীত, বিশেষ করে দ্বিতীয়টি সাধারণ মানুষেরও যে এত প্রিয় হতে পারে, তা এ দেশে না এলে বিশ্বাস করতে পারতাম না। এলবার্ট হলে কি রয়্যাল ফেষ্টিভ্যাল হল-এ কোনো অর্কেষ্ট্রা থাকলে অগ্রিম টিকিট না করলে সিট পাওয়াই মুস্কিল। অনেক সময় ব্যর্থ মনোরথ হয়ে ফিরে আসতে হয়। বেটোফেন কি মোজার্ট এর Symphony যে কি আকর্ষণীয় তা কি করে বোঝাবো? কবির বলেন, “From harmony to heavenly har mony this Universal frame began’; আমার মনে হয় এ কথার মধ্যে যদি কিছু সত্য থাকে, তাহলে তার উল্টোটাও অর্থাৎ ‘From harmony to harmony this world will Come to its end’ এ কথাও সত্য হতে বাধ্য। তার কারণ এ Symphony গুলোতে সুরের যে ইন্দ্রজাল রচনা করা হয়েছে আর এর আরোহ ও অবরোহে যে শক্তি নিহিত আছে, তাই মানুষকে স্বর্গে নিয়ে যাওয়ার আর তার মন হরণ করবার জন্য যথেষ্ট। সুর যখন চড়াই-এ উঠে, তখন ধাপে ধাপে শ্রোতার মনও শূন্য হতে মহাশূন্যে উঠে যায়। আর সুর যখন নীচে নামতে নামতে সূক্ষ্মতর হতে হতে কাঁপতে কাঁপতে একেবারে বিলীয়মান হয়ে আসে, তখন মনে হয় যেন সমস্ত চেতনা স্তব্ধ হয়ে আসছে। ‘সমগ্র শ্রুতিকে আচ্ছন্ন করে কি আশ্চর্য সংগীত আর নিঃশব্দতার ঐক্যজাল, তার পেছনে কি কঠিন সৃষ্টি কৌশল এবং আত্মবিলীনতার শক্তি।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *