বিলেতে সাড়ে সাতশ দিন – ১

এক

১৮ই সেপ্টেম্বর। ১৯৫০ সাল।

পাখীর মতো ডানা মেলে দিয়ে জীবনের প্রথম আজ নিজের দেশের আকাশে উড়ছি। নিজের দেশের শ্যামশোভা এমন করে দেখার সুযোগ হয়নি কোনদিনও। নীচে ফসলের মাঠ আর তরুলতার সবুজ। ওপারে নীল শূন্য আকাশ। সাদা-কালো রঙ-বেরঙের মেঘমালার ছোঁয়া লাগছে শরীরে ও মনে। ওপর থেকে মাঠঘাট দেখে মনে হচ্ছে কে যেন পাশার ছক পেতে রেখেছে। মানুষ ও মানুষের ঘরবাড়ীগুলো দেখে গালিভারের লিলিপুটের কথা মনে পড়ছে। অনন্তকাল-স্রোতের মধ্যে বুদ্বুদের মতো মানুষের জীবন–অবিরত ফুটছে ও ঝরছে। দুনিয়ার খেলাঘরে কয়টি মুহূর্ত কাটিয়ে দেবার জন্যে তার কত আয়োজন–আর নিজের শক্তির পরিচয়ে কি তার আনন্দ! কিন্তু ওপর থেকে এমন নির্লিপ্তভাবে দেখলে মানুষের ক্ষুদ্রতার কথা আশ্চর্যভাবে মনে পড়ে যায়। কি অদ্ভুত ছোট ছোট দেখাচ্ছে সব কিছু। ঘরবাড়ী লাগছে শিশুদের খেলাঘরের মতো। বাস-ট্যাক্সী ট্রেনগুলোকে মনে হচ্ছে যেন তাদের খেলনা। পদ্মাকে মনে হচ্ছে যেন খেয়ালী মেয়ের হাত থেকে খসে পড়া এক টুকরো রূপালী ফিতী।

কিন্তু শোভা দেখলাম পূর্ব বাংলার মাটির আর আকাশের। সবুজে সবুজ আর নীলিমায় নীল সারা পূর্ব বাংলা। আদিকাল থেকেই প্রকৃতির যে বৈশিষ্ট্যের জন্যে বাংলা দেশের খ্যাতি, র‍্যাডক্লিফ রোয়েদাদ মতে পূর্ব বাংলার সবটাতেই পাই তার ছাপ। মেঘের এমন সমারোহ, আকাশের বুকে মেঘরাজ্যের এমন খেলা, মুহর্মুহু মেঘমালার এত বিচিত্র রূপবদল, ধীরভাবে মুগ্ধ দৃষ্টিতে না দেখলে তার সৌন্দর্য উপলব্ধি করা যায় না। সাদা, কালো, অসিমানি, ফিরোজা, সবুজ, নীল, ধূপছায়া, বেগুনি, লালচে ও লাল, ফিকে ও গাঢ় কত রঙের মেঘের কি সুন্দর কৌতুক লীলা। দেখে দেখে চোখ জুড়িয়ে গেলো। নিজের দেশকে এমনভাবে দেখবো একথা কোনদিন ভাবিনি। মনে পড়ছে ইবনে বতুতার ভ্রমণ বৃত্তান্ত। আজ থেকে দু’শ বছর আগে তিনিও দেখেছিলেন পূর্ব বাংলার এ সবুজ রূপ অনাস্বাদিতপূর্ব পিপাসা নিয়ে। মরুদেশের মানুষ তিনি। পূর্ব বাংলার স্নিগ্ধ সবুজরূপ সে দিন তাঁর চোখে মায়ার পরশ বুলিয়েছিলো! পূর্ব বাংলায় প্রবেশ করে পৃথিবী তার কটিদেশে সবুজ মেখলা জড়িয়েছে। তার সেই সবুজ স্রস্ত বসনাঞ্চল বার্মা-মালয় হয়ে লুটিয়ে পড়েছে। ইন্দোনেশিয়ার দিকে। সবুজের সবটুকু গাঢ়তা অকৃপণভাবে উপচে পড়েছে পূর্ব বাংলায়। সিলেট এবং চাটগাঁ থেকে আরম্ভ করে ঢাকার রমনা হয়ে আকাশের পথে উত্তর-পশ্চিমে যতই বিচরণ করা যায়, প্রকৃতির সবুজের প্রবাহ ততই কমে আসতে থাকে। পশ্চিম বাংলার বর্ধমান বিভাগে প্রবেশ করলেই দেখা যায় সবুজ ফিকে হয়ে পেছনে সরে পড়েছে।

কলকাতাও ছাড়লাম। উড়ছি ভারতের উপর দিয়ে। তখতে সোলায়মানে ব’সে ভারতবর্ষ পরিক্রমণ করছি। ‘নদ-নদী-নগরী বাহিয়া’ উড়ে যাচ্ছে সোলায়মানের হাওয়াই সিংহাসন। মানুষ আর প্রকৃতির গড় নিদর্শনগুলো একে একে আমাদের চোখের সামনে থেকে দ্রুত অপসৃত হয়ে যাচ্ছে। এলাম নয়াদিল্লী। ওপর থেকে ছবির মতো লাগছে। দিল্লীর পালাম বিমান বন্দর ছাড়লাম। করাচীর দিকে উড়ে চলেছি। রাত্রি তখন গোটা দশেক হবে। কারাচী বিমান বন্দরের আলো চোখে পড়লো। প্রাচ্যে প্রবেশ করার রাজতোরণ এই করাচী। বিমান বন্দরটি প্রকাণ্ড। তেজগাঁ থেকে লণ্ডন পর্যন্ত যতগুলো বিমানবন্দর রয়েছে, একমাত্র আমষ্টার্ডম ছাড়া অন্যান্যগুলোর তুলনায় করাচীর বিরাটত্ব ও গাম্ভীর্য লক্ষ্য করার মতো। প্রাচ্যের তোরণ হিসেবে আর দুনিয়ার সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্রের বিমান বন্দর হিসেবে করাচী তার বৈশিষ্ট্য রক্ষা করেছে। নিজের দেশ পাকিস্তানের তদানীন্তন রাজধানী করাচী দেখে নিলাম। করাচীর প্রধান যে জিনিস পূর্ব পাকিস্তানীদের চোখে পড়ে, তা তার প্রচুর চওড়া পথ আর উটের গাড়ী। কদাকার প্রাণী উটের প্রয়োজন ও উপযোগিতার শুরু ভারতের যুক্তপ্রদেশ থেকে। উটকে বলা হয় ‘মরুজাহাজ’। শুকনো মাটির দেশ আর মরুভূমিতে উটের মতো উপকারী প্রাণী খুব কমই আছে। পানি-কাদার দেশ আমাদের পূর্ব পাকিস্তান। গরু-মোষই আমাদের যানবাহনোপযোগী প্রধান জন্তু। বাংলাদেশ থেকে বেরিয়ে বিহার পেরিয়ে যতই উত্তর-পশ্চিমে এগুনো যায় উটের প্রয়োজনীয়তার কথা ততই মনে পড়ে। করাচীতে দেখলাম উট বোঝা বয়, গাড়ী টানে, লাঙ্গলও বয়, তাছাড়া মানুষের খাদ্যের একটা মোটা উপকরণও বটে।

করাচীতে চোখে পড়লো সেখানকার ফল। পথে পথে ফলের দোকান। ফলও অত্যন্ত সস্তা। যেখানে যা নেই, কথা আছে, সেখানে তার কদর বেশী। পশ্চিম পাকিস্তানে আনারস আর পানি নেই। পশ্চিম পাকিস্তানের আমীর লোকদের জন্যে অনেক সময়ে তাই হওয়াই জাহাজে আসে পূর্ব পাকিস্তান থেকে আনারস আর পান। আমাদের এগুলো প্রচুর, তাই এসবের প্রয়োজন বুঝলেও কদর আমরা তেমন বুঝি না। আঙুর, বেদানা, সেব ইত্যাদির জন্যে আমরা জিভের পানি ফেলি। আমাদের ওখানে এ সবের যা সের দর তাতে মধ্যবিত্তরা এ সব ফল খাওয়া বিলাস বলে মনে করে। আঙুর, বেদানা ও সেবের কথা মনে হ’লে ইচ্ছে করে রোগী হয়ে থাকতে। বেলুচিস্তান, সিন্ধু ও কাশ্মীরে এ সব ফল প্রচুর পরিমাণে জন্যে। তাই করাচীতে এগুলোরই প্রাচুর্য।

১৯শে সেপ্টেম্বর। করাচীর ঈদগাহ ময়দানে গেলাম। নীল স্বচ্ছ আকাশ, চারিদিকে ধূ ধূ করছে শুকনো রোদ। জাতির পিতা কায়েদে আযমকে দেখলাম অনন্ত বিশ্রাম-রত। জীবনে বিশ্রাম নেবার সুযোগ তার ঘটেনি। জাতিকে গড়তে গিয়ে তিলে তিলে নিজের জীবন ক্ষয় করে পাকিস্তানী জাতির চলার পথ তৈরী করে দিয়ে তবেই তার শোবার সময় এলো। যেখানে তার মাজার সে জায়গাটি বেশ উঁচু এবং খুব চওড়া। চারিদিকের মাটি ও কাকর পাথরের মত শক্ত। তারই ওপরে রচনা করা হচ্ছে কায়েদের স্মৃতিসৌধ। জীবনে তার জাতিকে উঁচু করে গড়ে তোলার জন্য তিনি তাঁর মাথা যেমন কারও কাছে নীচু করেন নি, তেমনি তার হাতে গড়া জাতি মৃত্যুতেও তাঁকে উঁচু করে তুলে ধরবার জন্যে উঁচু জায়গাতেই তাকে শুইয়ে রাখার ব্যবস্থা করেছে। মানীর মান খোদা কিভাবে রক্ষা করেন, তার অপূর্ব সমন্বয় দেখলাম কায়েদে আযমের মাজারে। বহুদূর থেকে স্পষ্ট দেখা যায়, ঐ ওখানে শুয়ে থেকে হযরত ওমরের মতো, খালেদের মতো তার জাতিকে এগিয়ে যাবার কি অপূর্ব প্রেরণা তিনি যোগাচ্ছেন। কবরের শিরানায় পাথর ফলকে কোরানের আয়াত লেখা রয়েছে। তার বাম দিকে মেয়েদের ও ডানদিকে পুরুষদের যিয়ারতের ব্যবস্থা। দুপাশেই কোরান শরীফ রয়েছে। ইচ্ছা করলেই যে কেউ সেখানে কোরান তেলাওয়াত করে তার রূহের মাগফেরাতের জন্যে বখশে দিতে পারে। কায়েদে আযমের সৌভাগ্যে মন ভরে উঠলো। তার জন্যে শুধু পাকিস্তানেই নয়, সারা মুসলিম জাহানে যতো কোরান-খতম হয়েছে, ইসলামের শুরু থেকে আজ অবধি কারুর একার জন্যে এতোবার কোরান খতম হয়েছে কি-না সন্দেহ। মাজারের দক্ষিণ-পশ্চিম ঘিরে যে স্মৃতিসৌধ গড়ে উঠবে, তার চিহ্ন আকা হয়েছে দেখলাম। করাচীর প্রান্তভাগে এই ঈদগাহ ময়দান। দূর সমুদ্র থেকে হু হু করে বাতাস বয়ে এসে কায়েদে আযমের মাজার চুমে যাচ্ছে।

আরব সাগরের কূলে-করাচীর সুবিখ্যাত ক্লিফটন বীচ। নগরবাসীদের সমুদ্রস্নানের ও যুগল মিলনের এমন উপযুক্ত জায়গা সারা পাকিস্তানে আর দ্বিতীয়টি নেই। করাচীর এক ধনী পারসীর টাকায় গড়ে উঠেছে এই বীচটি। বলতে গেলে একেবারে সমুদ্র থেকে একটু একটু করে বেঁধে তোলা হয়েছে এই বীচের রাজপথ। ট্যাক্সি নিয়ে কি পায় হেঁটে পাড় থেকে সামনে যাতে পানির ধার পর্যন্ত নেমে যাওয়া যায় তার সুন্দর ব্যবস্থা আছে। পাথর বাঁধানো পথ পাড়ের ওপর থেকে নীচে নেমে গেছে। পথের ওপরেই রোদ থেকে বাচবার আশ্রয় বিশ্রাম শিবির। আর মাঝে মাঝে রচা সুন্দর কৃত্রিম অথচ মনোহর তরুলতা ও ফলের বাগান। মরুভূমির বালির উপর কচি ঘাসের চোখ জুড়ানো সবুজ ছোঁয়া। পায়ে হেঁটে পথ বেয়ে নেমে গেলাম একেবারে পানির ধারে। জোয়ার ভাটায় বালির বহুল আমদানীতে পথ মাঝে মাঝে বন্ধ হয়ে যায়; সেজন্যে বালি সরিয়ে দেবার যথারীতি ব্যবস্থাও দেখলাম। ক্লিফটন বীচ থেকে অনতিদুরেই দেখা যায় আরব সাগরের বুক ভেদ করে স্ফিংসের মতো পাহাড় উঁচু হয়ে উঠেছে। তার চারপাশে এসে দিগন্ত জোড়া অথৈ পানির কলেজ্জিাস ও অনন্ত গর্জন আছাড় খেয়ে ভেঙে পড়ছে, তবু সেই পর্বত চূড়া উন্নত মহিমায় আজও দাঁড়িয়ে রয়েছে। দেখলাম অভিসারকামী যুগলের দল। সাগরের অনন্ত মত্ততার আভাসে দুরন্ত প্রাণ বন্যায় তারাও তরঙ্গিত হচ্ছে। দু’হাত তুলে তাদের আশীর্বাদ করলাম। মনে মনে বললাম, আমার দেশের এ অনন্ত যৌবন অক্ষয় হোক। যে দেশের যুবকেরা এমনি করে জীবন উপভোগ করতে পারে তারাই হাসতে হাসতে দেশের জন্যে প্রাণও দিতে পারে। যুবতীরা দেয় প্রেরণা; যুবকেরা দেয় প্রাণ। যে দেশে অক্ষয় যৌবনের দুর্বার অভিযান আধুনিক জগতে সে দেশের উন্নতিই অবশ্যম্ভাবী; ইউরোপ তার সাক্ষ্য।

***

ভাবতে ভাবতে শূন্য আকাশের বুকে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না। উড়ন্ত বিমান হঠাৎ ‘বাম্প’ করলো। তবু রক্ষা। আকাশ থেকে মাটিতে নামবার ব্যবস্থা হচ্ছে। ভোর ছ’টা। বাগদাদে নামলাম। রাত্রির অন্ধকারে আর জড়িমাজড়িত মনের ভাবে আমি বেঁচেছিলাম কি না জানিনা। কখন আফগানিস্তান ও ইরান পার হয়ে এসেছি টের পাইনি।

মুসলিম-সভ্যতার গৌরব নিকেতন খলিফা হারুনর রশীদের দেশ ইরাকের রাজধানী এই বাগদাদ। মধ্যপ্রাচ্যের শ্রেষ্ঠ ফল খুরমা ও খেজুর দেখলাম। মধ্য এশিয়া সম্পর্কে আমাদের দেশে যে ধারণাঁ তা মোটেই মধুর নয়। মধ্যযুগীয় মনোবৃত্তি মধ্য এশিয়ার মুসলিম দেশগুলোতে আজও যে নেই তা নয়। তবু এরা এগুচ্ছে বর্তমান যুগের বিজ্ঞান-শাসিত সভ্য ইউরোপকে অনুসরণ করে। মানুষের প্রকৃতিতে দেশের মাটির ছাপ থাকে সুস্পষ্ট। বাগদাদ বিমানঘাঁটি দেখলাম। বড়ো নোংরা লাগলো। সেই থুথু। সেই চেঁচামেচি। বাংলা দেশের স্টীমার কি রেল স্টেশনের মতো মনে হলো। অন্যান্য বিমানঘাটির মতো বাগদাদ বিমান ঘাটি শহর থেকে তেমন দূরে নয়। বিমান ঘাঁটির পাশ দিয়ে রাস্তা শহরের দিকে চলে গেছে। দু’পাশ দিয়ে মাঝে মাঝে গাছপালা। আমাদের দেশের মতো এত সবুজ নয়, সরসও নয়। একটা রুক্ষতার ছাপ প্রকৃতির যুতটুকু চোখে পড়ল তাতে আর মানুষগুলোর চেহারায় স্পষ্ট দেখতে পেলাম। ভাঙা আরবীতে এখানকার দু’চার জনের সঙ্গে কথা বললাম। পাকিস্তান থেকে আসছি শুনে খুব খুশী হলো ওরা। পাকিস্তানের বাইরে মুসলিম দেশগুলোতে পাকিস্তানের জন্যে দরদ দেখে বুক ভরে উঠলো। একটি প্রৌঢ় ভদ্রলোককে দেখলাম। আরবী সাহিত্যের বিস্মৃতপ্রায় রহস্যময় চরিত্র বদিউজ্জামান হামদানী 1 আবুল ফাহল এস্কান্দরী’র কথা মনে হলো। আমরা কৈশোর জীবনের পরিচিত সেই চরিত্রকে বাগদাদে এসে এমন অপ্রত্যাশিতভাবে দেখবো একথা ঘুণাক্ষরেও কোনদিন ভাবিনি। আমার কাছে সে হলো হঠাৎ আবির্ভুত। জোব্বাজোব্বি পরিহিত ভদ্রলোক অনর্গল আরবীতে কি বকছে। বক্তৃতা শুনবার জন্যে কাছে গেলাম। আমাদের মতো নতুন মুখ দেখে আরবী বুঝবো না মনে করে ফারসী ভাষা বলতে লাগলো। দুই-ই হলো আমাদের কাছে সমান দুর্বোধ্য। অঙ্গভঙ্গী থেকে যতটুকু বুঝলাম তাতে মনে হলো বেচারা ভুগছে কোনো অসুখে। যে কারণেই হোক তার অর্থের প্রয়োজন। আমার কল্পনা আর বাস্তবের এস্কান্দারীর মধ্যে তফাৎ দেখে মনটা ভারী হয়ে উঠলো। এমন সময়ে কালো পোশাক পরিহিত দৈর্ঘপ্রস্থে সমান টানা বাগদাদী পুলিশের হ’লো অতর্কিত আবির্ভাব। বেচারাকে চেঁচানোর আর সুযোগ দিল না। দিল বিমানঘাঁটির বাইরে বের করে। আমাদের দিকে চেয়ে ওর অতি বড়ো আশা বোধ হয় শূন্যে মিলিয়ে গেল।

বাগদাদ ছাড়লাম। জেগে-উঠা ভোরের আলোয় বিমানের সব শুদ্ধ পঞ্চাশ জন লোক আকাশ-বিহার করছি, এবারেই তা প্রথম বুঝলাম। নানা দেশের নানা রকমের নরনারী মূল থেকে উৎপাটিত হয়ে আকাশের বুকে এমন সখ্যবন্ধনে আবদ্ধ হবো তা কি কখনও ভেবেছিলাম? আশে-পাশে যে মুখগুলো দেখছি সবই যেন সুন্দর মনে হচ্ছে। আমাদের পাশের সিটে দেখলাম একটি যুগলকে। পরিচয়ে জানতে পারলাম তারা আসছে শ্যামদেশ থেকে। একজন সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানীর অধ্যাপক, আর একজন তারই বান্ধবী। বয়সে দু’জনেই তরুণ। তার সঙ্গিনীর নাম জিজ্ঞাসা করলাম। মেয়েটি ইংরেজী ভালো বুঝে না, কিন্তু যুতটুকু বুঝলো তাতেই অত্যন্ত মিষ্টি করে তার নামটি উচ্চারণ করলো ‘pa-নি’। ‘প’ এর পরের আকারের দীর্ঘতা তার বলার ভঙ্গী থেকে অত্যন্ত মধুর হয়ে বাজলো আমার কানে। বর্মী, মালয়ান, শ্যামদেশী, জাপানী আর চৈনিক মেয়েদের মুখের গড়ন কিছুটা চেপ্টা। আমাদের দেশের সৌন্দর্য-বিচারে অভ্যস্ত আমাদের চোখ এদের কোনদিনই ভালো চোখে গ্রহণ করেনি। কিন্তু এ মেয়েটির চেহারায় স্নিগ্ধ সারল্যের ছোঁয়া স্পষ্ট অনুভব করলাম। মাধুর্যের উপকরণ যে দুনিয়ার সব দেশেই আছে, একে দেখে বার বার সে কথাই মনে হচ্ছিল।

একটি সুন্দর কচি মেয়েকে দেখলাম। তার পাশের সিটে ছিল ষাটের অধিক বয়স্ক এক বুড়ো। দু’জনের চেহারায় কোন সামঞ্জস্য নেই। তবু তাকে বুড়োরই মেয়ে ঠাওরালাম। পরে জিজ্ঞাসা করে জানলাম, বুড়ো আর কেউ নয়। সে বাগদাদের এক শ্রেষ্ঠীর মেয়ে। বিলেতে যাচ্ছে পড়তে। বয়স তার বছর এগার হবে। নাম লায়লা। তার কচি মুখের ওপর জ্যোত্সা-নম্র রূপের স্নিগ্ধ চমক মন ভরে দেবার মতো। বাগদাদের মুসলমান ঘরের ঐ ছোট্ট কচি মেয়েটি কি অপূর্ব মনোবল নিয়ে একা চলেছে বিলেতে! ঐ বয়সের আমাদের দেশে ছোট্ট ছেলেমেয়ের কথা না-ই বললাম। প্রৌঢ় আমাদেরকে নিয়েই একা চলার সমস্যায় আমরা কেমন উদ্বিগ্ন হয়ে উঠি তা ভেবে কিছুটা যে লজ্জা না পেলাম তা নয়। এয়ার হোস্টেস প্রতি দুঘণ্টা অন্তর খাওয়াচ্ছেন। এটা সেটা হরদম খেয়ে মনে হচ্ছে যেন খাওয়ার ওপরেই আছি। আমরা মদ খাইনা দেখে বুড়োটির বিস্ময়ের শেষ নেই। খোঁজ নিয়ে বুঝলাম সেও মুসলমান। জীবনের কোন বন্ধন নেই তার। বয়স ভাটার টানে গড়াচ্ছে, পয়সা আছে প্রচুর। বয়সে বুড়ো হলেও তাই মন বুড়ো হয়নি। সে প্যারিস যাচ্ছে, জীবন। উপভোগ করতে। বাগদাদের এ বুঝি আর এক রূপ।।

আমরা উড়ছি সিরিয়ার মরুভূমির উপর দিয়ে। এর যেন আর শেষ নেই। যেদিকে তাকাই শুধু ধু ধু প্রান্তর। বালির তরঙ্গের পর তরঙ্গ, তার ছোঁয়ায় রোদ শুকিয়ে গিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলছে। যতই চলছি মনে হচ্ছে মহাপিপাসার রঙ্গভূমি পড়ে পড়ে ধুকছে। পৃথিবীর অবয়ব যে কতো আশ্চর্য উপাদানে গড়া এমন করে পৃথিবী পরিক্রমণ না করলে তা বোঝা যায় না।

বেলা তখন দশটা। কায়রের ফারুক এয়ারপোর্টে নামলাম। ইরাক, সিরিয়া, মিশর এই তিনটি দেশের বুকের উপর দিয়ে উড়ে মধ্য এশিয়া সংক্রান্ত ছেলেবেলার ভূগোলের জ্ঞান ঝালিয়ে নেবার সুযোগ হলো। দেশগুলো যে শুকনো, আমাদের দেশের মত এমন ভিজা নয়, বীজ ফেললেই এমন সোনার ফসল ফলে না, তা বেশ বুঝতে পারলাম। এখন বুঝি যুগে যুগে এ জন্যেই ভারত বিশেষ করে বাংলাদেশকে বলা হয়েছে ঐশ্বর্যের লীলাভূমি। মধ্য এশিয়ার শুকনো দেশগুলোর সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের তুলনা করলে এর সত্যতা ভালো করে উপলব্ধি করা যায়। দিগন্ত জোড়া মরুভূমির মধ্যে ফারুক এয়ারপোর্ট। ইসরাইলের সঙ্গে মিশর যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল। তার বিমান বন্দরের চারিদিকে অসংখ্য বিমান ডানা-ভাঙ্গা অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখলাম। শুকনো ঠনঠনে কাকরের মতো মাটি। উপরে উড়ছে মিশরের আলহেলালী ঝাণ্ডা। মিশরের মাটিতে পা দিয়ে অজ্ঞাত আত্মীয়তার সুরের আভাস পেলাম। বাগদাদের মতো এখানকার মানুষগুলোকে তেমন। শুকনো মনে হলো না। এদের কথা আরবী শুনতে ভাল লাগলো। কথ্য আর লেখ্য ভাষায় তফাৎ যে কতোখানি, আমরা যারা বিদেশী ভাষায় লেখ্যরূপ শিখি তার কথ্যরূপ না শুনলে তা যথাযথ বুঝতে পারি না। আমাদের জ্ঞান ক্লাসিকাল আরবীতে- তা অপরিবর্তনীয়; বর্তমান কালে আরবী ভাষা পরিবর্তনের স্রোতে কোথায় ভেসে এসেছে, মিশরে এসে তার টের পেলাম। মনে হচ্ছে যেন ফারসী ভাষা শুনছি। মা আর মাতৃভাষা প্রত্যেকেরই অতি আপনার, সে জন্যেই মিষ্টি। বিদেশী হওয়া সত্ত্বেও তুমদুনিক সংযোগের জন্যে এদের ভাষার মিষ্টতা আমার হৃদয় স্পর্শ করলো।

***

মধ্য এশিয়া ছেড়ে যাচ্ছি। ভূমধ্যসাগরের উপরে আমরা উড়ছি- তিরিশ হাজার ফিট উঁচু দিয়ে। নীচ থেকে বহু উপর দিয়ে পাখী উড়তে দেখে কতোদিন কতো কথাই তো মনে করেছি, আজ আকাশের বুকে এমন ভাবে উড়তে গিয়ে সুদে আসলে তার সব শোধ করে নিচ্ছি। পৃথিবীর অগণিত বৈচিত্র প্রতিভাত হচ্ছে আমার চোখে। সবটা মিলিয়ে কিসের যেন মোহ জাগছে।

ছেড়ে গেলাম ক্রীট। ছাড়লাম আদ্রিয়তিক সাগর। সামনে দেখা যাচ্ছে আল্পস পর্বতমালা। অষ্ট্রিয়া, ইটালী, সুইজারল্যাণ্ড, ফ্রান্স ও জার্মানীর প্রান্তদেশ জুড়ে পড়ে আছে ইউরোপের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলানিকেতন আল্পস পর্বতমালা। আমাদের বিমান ক্রমেই উঠে যাচ্ছে উঁচুতে আরও উঁচুতে। মনে হচ্ছে নমরুদী সিংহাসন মাংস-লুব্ধ শকুনির সাহায্যে খোদার খোদকারী ধূলিসাৎ করবার জন্যে অভিযানে বেরিয়েছে। তাই সে যেন আর নীচুতে নামতে চায় না। ভাবছি রক্ষা পেলে হয়। আল্পসের মেঘমালার সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে আমরা এগুচ্ছি। আর কিছু দেখা যায় না। মেঘরাজ্যে হারিয়ে গেলাম। ভয়ে আতঙ্কে প্রাণ শিউরে উঠছে। মনে হচ্ছে এ দুর্জয় প্রকৃতির অপরিসীম রহস্যের মধ্যে তলিয়ে গেলাম। এখান থেকে বেরুনোর আর কোন আশা নেই। জীবনের বৃন্তটুকু হতে প্রকৃতির গভীর অন্ধকারে খসে যাচ্ছি। পিছনে পড়ে রইলো জীবনের সুখ দুঃখের স্মৃতি। আর কোনদিন। সেখানে ফিরবার অবসর হবে না। কি গভীর মেঘান্ধকারে এতগুলো প্রাণী মরণের অভিসারে চলেছি ভাবতে পারছি না। সকলের মুখেই গভীর আতঙ্কের ছাপ। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকে যাচ্ছে। হঠাৎ তারি আলোর ঝলকানিতে অমানিশার চেয়েও থমথমে গাঢ় কালো মেঘের রূপ চোখে এসে ধাক্কা দিচ্ছে। কি ভীষণ সুন্দর! কি মৌন মহিমা তার! অনন্ত-জোড়া কালো মেঘ পাহাড়ের গায়ে গায়ে কি জমাটবাধা ভীষণতা ধারণ করছে। ভয়ঙ্কর সৌন্দর্যের অতলে ডুবে গেলাম। ক্ষণে ক্ষণে মনে হচ্ছে এর হাত থেকে মুক্তি পাবো কি?

বহুক্ষণ কেটে গেলো। চোখ মেলে চাইতেই দেখি এবারে সঘন সাদা মেঘমালার প্রণয়াভিসার। এক একটি মেঘপিণ্ড কি সতেজ, সুডৌল, সুঠাম! পরস্পরের কণ্ঠলগ্ন হয়ে মানুষের লোকালয় থেকে বহু দূরে জীবনের মৌন আকুতি বিবশ আলিঙ্গনে নিবেদন করে চলেছে। তাদের আনন্দের জ্যোতি বিচ্ছুরিত হয়ে দিগদিগন্ত উদ্ভাসিত উল্লাসিত করে তুলেছে। তুষার ধবল বরফের রাজ্য। একটার পর একটা। একের গায়ে আর একটা। সে কত! যতদূর চোখ যায় দেখা যায় শুধু বিরাট বরফের পর্বতখণ্ড। মনে হচ্ছে “ন তত্র চন্দ্রোভাতি ন সূর্য তারকা।” আলোর গায়ে আলো ঠিকরে পড়ছে। বজ্রের আলোর চেয়ে সাদা। মৃত্যুর অনুভূতির চেয়ে হিম স্নিগ্ধ। বরফ-হিম-আলোর হাসি যেন থৈ থৈ করছে। বহু নীচে পড়ে রয়েছে আল্পস। মাথায় দুর্গম প্রকৃতির দুর্ভেদ্য রহস্য। তারই ওপর দিয়ে ভেসে চলেছি আমরা। পাশাপাশি কালো ও আলোর একি সমারোহ! নির্বাক বিস্ময়ে চোখ মেলে চাইছি! দেখে দেখে জীবনের অনুভূতি যেন স্তব্ধ হয়ে আসছে। এ দৃশ্য সত্যি দুর্লভ। ইউরোপের পথে বেরিয়ে এ জীবনে প্রকৃতির যে মনোরম শোভা দেখে নিলাম তার কোনো মূল্যই দেওয়া যায় না। সৌন্দর্য-পাগল মানুষেরা এর অতটুকু ছোঁয়া পাওয়ার জন্যে কেন যে জীবন দান করতেও কণ্ঠিত হয় না আজ তা বুঝি!

পূর্ব-পাকিস্তান ছাড়ার পর মেঘের শোভা আর চোখে পড়েনি। আল্পসে এসে মেঘরাজ্যের ভিতরে পড়ে প্রাণ হারাতে বসে দেখলাম মেঘের অনুপম কান্তি। তার নিরুপম ভীষণতা। তার জমাট বাঁধা নিরাভরণ রূপ। সে কী আশ্চর্য সুন্দর!

কায়রো থেকে দীর্ঘ সাত ঘণ্টা আকাশ বিহার করলাম। আকাশের বুকে মহাশূন্যতায় এক নাগাড়ে সাত ঘণ্টা ঝুলবো এ কি কোনদিন ভেবেছিলাম! সুদূর পশ্চিম দিগন্তে দেখতে পাচ্ছি ইটালীর নীল স্বচ্ছ আকাশ; সামনে জার্মানী। মিউনিকে আসা গেলো। মাটির মানুষ মাটিতে পা দিতে পারবো এ আশায় মন উদ্বেলিত হয়ে উঠেছে। মিউনিকের আকাশ ও মাটিতে সবুজের সুস্পষ্ট শোভা দেখা যাচ্ছে। চোখে লাগছে অনেকটা পূর্ব বাংলার নেশা। গোধূলি লগ্নে ইউরোপের মাটিতে পা দিতে হালকা সবুজের সঙ্গে মিউনিকেই প্রথম বারের জন্য চোখের মালা বদল হ’লো। মিউনিক অনেকটা আমাদের রমনার প্রান্তদেশের মতো। সেই বিস্তীর্ণ মাঠ। মাঝে মাঝে সেই রকম ঘরবাড়ী। পার্থক্যের মধ্যে, যেন বরফ না জমে সে জন্যে ছাদগুলো তৈরী হয়েছে আমাদের টিনের দোচালার মতো।

মানুষগুলো দেখে মনে হলোনা যুদ্ধের যাতা এদের বুক পিষে দিয়ে গেছে। স্বাস্থ্য দেখলাম অটুট। প্রাণে তেমনি চাঞ্চল্য। দুর্বার যৌবনের স্থায়ী স্বাক্ষর আজও বহন করছে। এরা। অনন্ত যৌবনের পূজারী জার্মানী। যুগে যুগে নিঃক্ষত্রিয় হয়েও পুনঃ পুনঃ যৌবনের চর্চা করে। তাই মরেও এরা আবার বেঁচে উঠে। মিউনিকের নরনারী দেখে মনে হলোনা এদের সেই তেজ, সেই যৌবন যুদ্ধে হেরে কোনো রকমে স্তিমিত হয়েছে।

আমষ্টার্ডামে যখন পৌঁছলাম রাত্রি তখন দশটা। হল্যাণ্ডের তুলনায় তার রাজধানীর বিমান বন্দরটি খুব জাঁকালো বলে মনে হলো। আজও বাইরে বেরোলেই বুঝা যায়। পাসপোর্ট নামক জীবন-পত্রটি কত মূল্যবান। জীবন ওতে বন্দী হয়ে থাকে। ও হারালে বেশ কিছুদিনের জন্য জীবন হারাবারও স্বাদ পাওয়া যায়। কেন বুঝলাম না, জীবনের সেই ছাড়পত্র নিয়ে এরা বেশ কড়াকড়ি করলো। মুক্তি পেলাম, কিন্তু দুর্যোগের জন্য সময় মতো লণ্ডনের পথে রওয়ানা হওয়া গেলো না। শুনতে পাচ্ছি এখানকার আকাশেও আমাদের দেশের আষাঢ়ের মেঘমন্দ্র রব। ভয়ঙ্কর নয়, মিষ্টি। বেশ এক ঝলক বৃষ্টি হয়ে গেলো। মুষলধারে কিংবা প্রবল নয়; মৃদু। নতুন দেশে নতুন অভিজ্ঞতা হচ্ছে। এই সুযোগে বিমান। কোম্পানী লণ্ডন যাত্রীদের এখানেই খাইয়ে নিলেন। খাবার ঘরে গিয়ে দেখি বিরাট আয়োজন। মিউনিকও এখানকার আসবাব ও উপকরণে হার মেনে গেলো। ঘরে ঢুকতেই চোখে পড়লো আমাদের আগের দেখা সেই শ্যামদেশী যুগলের অসহায় তরুণীটিকে। সেবারে সঙ্গে ছিল তার বন্ধু, ভাঙা ইংরেজীতে কোনো রকমে জবাব দেওয়া তাই সহজ হয়েছিলো। এবারে বন্ধুহীন প্রবাসে বেচারী কোনো জবাব দিতে পারলো না। দিল একটি স্মিত স্নিগ্ধ হাসি। সহায়হীন অবস্থায় ওকে বড়ো ভালো দেখাচ্ছিল। লাগছিল অনেকটা ভীরু হরিণ-শিশুর মতো। পথের বন্ধু পথ শেষ হবার সঙ্গেই কোথায় গেলো হারিয়ে। শুধু জেগে রইলো প্রভাতী তারার মতো আজো তার স্মিত হাসিটি!

***

রাত্রি তখন গোটা দুই। ইংলণ্ডের আকাশে এসে পৌঁছলাম। দূরে দেখতে পাচ্ছি। আলোর মালা। অথৈ আলোর সমুদ্রে সাঁতার কাটছে সারা লণ্ডন। সারি সারি কত বিচিত্র আলোর তরঙ্গ; তরঙ্গের দোলায় দোল খেয়ে ঝলমল করছে লণ্ডন। নিদ্রিতা সুন্দরী লণ্ডনের শিথিল রূপ এমন করে চোখে পড়বে তা ছিল আমার আশার অতীত। ওপর থেকেও বহু বিচিত্র আলোর সারির অন্ত পাচ্ছিনে। মনে হচ্ছে পৃথিবী মন্থন করে ইংরেজ লণ্ডনকে মায়াস্বর্গের রূপ দিয়ে সাজিয়ে রেখেছে। গভীর নিশীথে দীর্ঘক্ষণ ধরে লণ্ডনের যৌবন জোয়ারের লাবণ্য দূর আকাশ থেকে ধীরে ধীরে হৃদয়ে গেঁথে নিলাম। বিমান থেকে নেমে লণ্ডনের মাটিতে পা দিতেই সংশয়ানন্দের শরীর শিউরে উঠলো। শহরে প্রবেশ করলাম। মুগ্ধ বিবশ চোখ দুপাশে মেলে ধরে এগুতে লাগলাম। যার জন্যে জীবনের এতগুলো দিনকে সযত্নে গুছিয়ে তুলেছি, গভীর রাতে তার স্তব্ধ মধুর রূপ দেখেও তার মুখের আবরণ সম্পূর্ণ অপসারণ করবার সাহস হলো না।

দুই

ইংলণ্ড শীতের দেশ। এখানে ঋতুর হেরফের যে হয় না তা নয়। গ্রীষ্মকাল এখানকার ক্ষণস্থায়ী। তাই এখানকার লোকেরা গরমের জন্যে সূতী কাপড় তৈরী করে না, দেখতে দেখতে মাস দুই সময় কেটে যায়। শীতকালের চিরাচরিত গরম কাপড় পরেই এরা। গরমকাল কাটায়। বছরের আর বাকী সময় সবই ঠাণ্ডায় ঘেরা থাকে। আমরা গরম দেশের লোক। শীত যে কি এবং কতটা ভয়াবহ তা মোটেই বুঝি না। তবু অগ্রহায়ণ, পৌষ এবং মাঘ মাষের শীত সম্বন্ধে আমাদের দেশে নানা গালগল্প, ছড়া ও প্রবাদ সৃষ্টি হয়েছে। ভারতচন্দ্রের একটা লাইন ‘বাঘের বিক্রম-সম মাঘের শিশির’ আমাদের দেশের শীতের প্রচণ্ডতা কিছুটা ফুটিয়ে তোলে। গ্রাম্য ছড়ায় ছেলেবেলা থেকে শুনে আসছি ‘মাঘমাসের জাড়ে, মোষের শিং নড়ে’। পানি-কাদার প্রাণী বেচারা মোষ গরমের সময় রোদে বাতাসে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে, শীত তার কাম্য হলেও মাঘ মাসে আমাদের দেশে সেও শীতে কাঁপতে থাকে। এখানে এসে দেখছি আমাদের দেশের পৌষ-মাঘ মাষের শীত নিতান্ত গরমের মাস দুই বাদ দিয়ে সব সময়েই থাকে। দেশে থাকতে এখানকার শীতের কথা বন্ধু-বান্ধবদের কাছে যে না শুনেছি তা নয়। ভাবতাম ও একটা কথার কথা। যেমন শীত আছে তেমন শীত নিবারণের ব্যবস্থাও আছে। কিন্তু এখানকার শীতের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যে পরিচয় হ’লো তা যে কি ভয়াবহ সে কথাই লিখছি।

১৯৫০ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ২১ তারিখের রাত্রে এখানে এসে পৌঁছি। তখনও গাছপালায় বেশ পাতা ছিল। সবুজের সঙ্গে চোখের কিছুটা ভাব বিনিময় হলো। সঙ্গে যে সব গরম কাপড় ছিল সেগুলোতে চললো কিছুদিন। বন্ধুরা এখানকার শীতোপযোগী কাপড় চোপড় তাড়াতাড়ি কিনে দিলেন। অক্টোবরটা কোন রকমে গেলো। নভেম্বর শুরু হতে না হতে হু হু করে বাতাস বইতে আরম্ভ করলো। এক এক দিন মনে হতো বাতাস নয় যেন ঝড়। পথে বেরুলে ঠাণ্ডা বাতাস তীরের ফলার মতো একেবারে হাড়ে গিয়ে বিধে। সে কি তীব্র। ঠাণ্ডা। হ’লেও এখানকার ছেলেমেয়েদের তাতেই কি আনন্দ। মনে হতো বিদেশী আমরা-আমাদেরকে যেন উড়িয়ে নিয়ে যেতে চায়। এর ওপরে আবার সারাদিন আকাশের মুখ ভার। দিনের পর দিন সূর্যের আলোর কোন দেখা নেই। এক নাগাড়ে দিন পনের কেটে গেলো। আকশের অবস্থা একই রকম। রাত্রির বেলা পথ, ঘরবাড়ী ও দোকানের আলোতে তবু লণ্ডন শহরের সে ধোয়াটে ভাব ততটা চোখে পড়ে না। কোনো রকমে বিদ্যুতের আলোতে পথ ডিঙিয়ে ঘরে ঢুকতে পারলে দিন-রাত্রির ভেদ ঘুচে যায়। মুস্কিল হয় দিনের বেলায়। পরিচ্ছন্ন আকাশের দেশের লোক আমি। আলো আঁধারের তফাৎ ‘আর দিন-রাত্রির পরিষ্কার সীমারেখা দেখে দেখে এত বছরের অভ্যস্ত চোখ দিনের বেলায় পথে বেরিয়ে দেশের সেই স্বচ্ছ নীল আকাশ আর সাদা রোদ দেখবার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে; কিন্তু আকাশের সেই আবছা অবস্থা আর কাটে না-রোদের দেখা মেলা তো দূরের কথা। এর ওপর আবার গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। সে যে কি বিশ্রী, ভুক্তভোগীরাই জানে। এ দেশের লোকের ওটাও গা-সওয়া হয়ে গেছে। ওতেই ওরা বের হয়, ওতেই ওরা ছোটে। দৈনন্দিন জীবনের কোনো কাজই পড়ে থাকে না। জীবন ওদের ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে বাঁধা। আবহাওয়ার উপর নির্ভর করে এরা চলে না। আবহাওয়া যেমনই হোক ওদের জীবনের গতির সঙ্গে ভালোমন্দ সকল অবস্থায় ওকে ওদের দাস হয়ে চলতে হয়।

বাংলা দেশে মাঘ মাসের তীব্রতর শীতে তাপমাত্রা নামে বড়ো জোর পঞ্চাশ না হয় পয়তাল্লিশ ডিগ্রি। উত্তর ভারত কি পশ্চিম পাকিস্তানের লোকেরা তবু কিছু শীত দেখেছে। সে সব জায়গায় তাপ বহু নীচে নেমে যায়। কিন্তু বাংলা দেশের সর্বত্র এর নীচে নামে না। মনে আছে একবার মাঘ মাসে কৃষ্ণনগরে ক’দিনের জন্য টেম্পারেচার ৪৪° ডিগ্রি হয়ে। গিয়েছিল। তাতে সারারাত্রি লেপতোষকের মধ্যেও শরীর গরম হতো না। বিছানার ভিতর যেখানকার পা সেখান থেকে এক আধটু নাড়লে চাড়লে মনে হতো পায়ে যেন হঠাৎ কে পানি ঢেলে দিয়েছে! সকালে দেখতাম শিশিরের সঙ্গে তুষার জমে আছে। আর একবার জুন কি জুলাই মাসে দার্জিলিং-এ ছিলাম। টাইগার হিল থেকে সূর্যোদয়ের দৃশ্য দেখে ফেরার সময় ঘুমের নিকটবর্তী এক ডেইরী ফার্ম দেখতে গিয়েছিলাম। সেখানে মাটির নীচের ছোট্ট একটা ঘরের টেম্পারেচার ফ্রিজিং পয়েন্টের নীচে বারো ডিগ্রি করে রাখা হয়েছিল। সে ঘরে দুধ পেস্টোরাইজ করে রাখা হতো এবং ওখান থেকে দার্জিলিং-এর সর্বত্র সেই দুধ চালান করা হতো। সে ঘরে ঢুকেছিলাম। মিনিট খানেক যেতে না যেতেই দেখলাম ঠাণ্ডায় আমার কোমর পর্যন্ত জুমে আসছে, তাই দ্রুত লাফিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে হয়েছিলো।

ডিসেম্বর মাসে সারা ইংলণ্ডে এমনি ধরনের শীত গেলো। টেম্পারেচার বত্রিশ ডিগ্রী ফা: হলে তার নাম হয় ফ্রিজিং পয়েন্ট। এবারে ডিসেম্বর মাস ধরে ইংলণ্ডের সর্বত্র টেম্পারেচার ফ্রিজিং পয়েন্টের বারো চৌদ্দ ডিগ্রি নীচে নেমে রইলো। ষোল, আঠারো, বিশঊর্ধ্বতম তাপের মান ছিল এই। লেকের পানি জমে গিয়েছিলো। আকাশের দিকে চাইতে পারতাম না। মনে হতো সূর্য, সেও শীতের ভয়ে কোথায় গা ঢাকা দিয়েছে। শীতের প্রচণ্ডতায় রোদহারা আবছা ধূসর আকাশ কেমন এক রকম ধূ ধূ করতো। ঠাণ্ডায় সমস্ত আকশের বুক চড় চড় করে ফেটে পড়ায় সেখান থেকে অনবরত ঝরতো তুষারকণিকা। যখন তুষার বৃষ্টি হতো তখন অবশ্য খুব ভালো লাগতো। আমরা আমাদের দেশে বৃষ্টিই দেখেছি, কিন্তু এখানে এসে দেখলাম বরফের বৃষ্টি। আমাদের দেশে যেমন শিলা পড়ে এ তেমন নয়। মনে হচ্ছে এদেশের লোকগুলোর সঙ্গে কৌতুক করার জন্য কে যেন মহাশূন্যে বসে থেকে দেশ। জুড়ে পাউডার ছড়াচ্ছে। ভারী সুন্দর সে দৃশ্য! ঘণ্টা দু’তিন ধরে এক সঙ্গে এমন তুষার বৃষ্টি হয়ে বাড়ীঘর, গাছপালা, পথঘাট সব কিছু সাদা ধবধব করতে থাকে। সব চেয়ে ভালো লাগে গাছগুলো। একটিতেও পাতা থাকে না। প্রচণ্ড শীতে সব পাতা খসে নেড়া হয়ে যায়। নেড়া ডালপালায় তুষারকণা বেধে বেধে সেগুলোকে যখন সাদা করে তোলে তখন মনে হয় তারা যেন মাথায় বরফ ধরে দাঁড়িয়ে আছে।

এখানকার বাড়ীঘরগুলোর ছাদও আমাদের দোচালার মত! যাতে বরফ জমতে না পারে সে জন্যেই অমন করে তৈরী করা হয়েছে। তবু বরফ বৃষ্টির পরে বাড়ীগুলো যখন সাদা হয়ে ওঠে তখন সূর্যের আলোতে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। হিম শীতল সাদা আলোতে বেঁচে থাকার অনুভূতিও যেন ধীরে ধীরে ঠাণ্ডা হয়ে আসতে চায়।

এ তুষার বৃষ্টির আবার প্রকার ভেদ আছে! ঝড়ের সঙ্গে তুষার বৃষ্টি হতে থাকে তখন আর তুষারের কণিকায় হয় না। ও রকম ঝড়ের নাম হলো ব্লিজার্ড আর তার সঙ্গে আমাদের দেশের শিলার মতো ভাঙা টুকরোর মতো যে বৃষ্টি হতে থাকে তাকে বলে গ্লিট। শ্লিট হলো বরফের টুকরো। ব্লিজার্ড এবং শ্লিট যে কি ভীষণ, ওর মধ্যে পড়লে অবশ্য তার ভীষণতা উপলব্ধি করা যায়। প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করেও এখানকার লোক বেঁচে আছে। এরা প্রকৃতির দুর্যোগের ভীষণতাও উপভোগ করে। খাস বাংলাদেশের মানুষ আমি শীতেই হলাম সাপের মত আড়ষ্ট। এর ভীষণতা চোখেই দেখলাম, এবারের মতো আর উপলব্ধি করতে পারলাম

এ শীতের মধ্যে বাইরে বেরুনোর জন্য সব আয়োজন করে রেখেছিলাম। কোমর থেকে পা পর্যন্ত উলের আণ্ডার ওয়্যার। তার ওপরে গরম প্যান্ট। শরীরে দেশী গেঞ্জীর মতই উলের ভেষ্ট, তার উপরে সার্ট, তার উপরে উলের সোয়েটার। তার ওপরে সব চেয়ে গরম হ্যারিস টুইডের কোট এবং গলার স্কার্ফ। তার উপরে লম্বা ওভারকোট, হাতে গ্লাভস। আধ কি এক সাইজ বড়ো জুতা কিনে ভেড়ার নোমওয়ালা সুখতলার ওপরে দু’সেট করে গরম মোজা পরা পা দু’খানিকে সযত্নে প্রবেশ করিয়ে দিয়ে এহেন অবস্থায়ও যখন বাইরে বেরোই তখনও কিছুক্ষণ বাইরে চলার পর মনে হয়, দাস্তানার ভেতর থেকে হাতের আঙ্গুলগুলো ঠাণ্ডায় ফেটে যেতে চাচ্ছে। পায়ের আঙ্গুলগুলোর রক্ত চলাচলও বুঝি বন্ধ হয়ে এলো। কোন দুটো আছে কি নেই কিছু বোঝা যায় না। নাকটা স্পর্শ করলে ওটা যে আমারই তা ঠাওর করতে পারি না। কি রকম একটা ঠাণ্ডা অনুভূতি মাথা থেকে পা পর্যন্ত একেবারে জমিয়ে দিয়ে যায়। তবু চলতে হয়, ছুটতে হয়, দৌড়তে হয়। এ দ্রুত চলার মধ্যে শরীরের রক্ত চলাচল করে। শীতকালে এখানকার নর-নারী, ছেলে-বুড়ো প্রায় ছুটেই চলে। কেন যে ছুটে চলে তা এখন ভালই বুঝি।

এ কারণেই এখানকার মানুষের জীবন আমাদের দেশের মতো আলস্যের বেড়া দিয়ে ঘেরা নয়। রাস্তা দিয়ে এজন্যেই এরা হেলে দুলে ধীরে মন্থর গতিতে চলে না। রাস্তায় দাঁড়িয়ে বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে দু-দণ্ড আলাপ করে না। নিতান্ত আপনার লোকের মতো ছেলেমেয়ে থেকে আরম্ভ করে কি চাকুরি করি; কত মাইনে পাই এ সব খোঁজ করার সুযোগ পায় না। দেশের মাটি ও প্রকৃতি প্রত্যেক দেশের মানুষের ওপর এমনি অদ্ভুত ছায়া ফেলে। প্রকৃতিই মানুষের জীবনকে পার্থক্যের বেড়া দিয়ে তৈরী করে তোলে। এরা তাই পথে বেড়িয়ে ছোটে, ঘরে গিয়ে হয় কাজ করে, না হয় নেয় শারীরিক ও মানসিক বিশ্রাম। বাইরে যেমন শীতের এই উগ্রতা, ঘরের ভেতরে বিশেষভাবে অফিস আদালতে, স্কুল কলেজে, দোকানপাটে, সাধারণ বাড়ীঘরে তেমনি শীত থেকে বাঁচার জন্যে আগুনের বন্দোবস্ত। হয় বিদ্যুতের সাহায্যে সেন্ট্রাল হিটিং করে সমগ্র ঘরটিকেই গা সওয়া গরম করে রাখার, না হয় সাধারণ বিদ্যুৎ কি গ্যাসের আগুনের বন্দোবস্ত এখানকার প্রতি ঘরেই রয়েছে। আমাদের দেশে গরমের সময় বাইরে থেকে এসে যেমন আমরা পাখা হাতে নিই এখানে তেমন বাইরে থেকে এসে এরা নেয় আগুনের গোড়ায় আশ্রয়। আগে এদের সেন্ট্রাল হিটিং অথবা বিদ্যুৎ সাহায্যে আগুন পোওয়াবার ব্যবস্থা ছিল না। ছিল ঘরের মধ্যে দেওয়ালের সঙ্গে কয়লা জ্বালানোর ব্যবস্থা। সে জায়গাটুকুকে বলা হতো ফায়ার প্লেস। ফায়ার প্লেসের আগুনে ধোয়া হয় বলে দেওয়ালের ভেতর দিয়ে ধোঁয়া বের হওয়ার পথও আগেকার তৈরী অধিকাংশ ঘরেই রয়ে গেছে। ছোটদের ইংরেজী বই-এ মাঝে মাঝে যে চিলেকোঠার ছবি দেখতে পাওয়া যায় সেটাই ধোঁয়া নির্গমের পথ।

দিনের বেলা তো কাটে লাইব্রেরীতে না হয় স্কুলে। সেগুলো সেন্ট্রাল হিটেড। যতোক্ষণ ওখানে থাকি ততক্ষণ শীত কি বুঝি না। ওখান থেকে বেরোবার আগে শীতের সঙ্গে যুদ্ধ করবার কথা আবার ভেবে নিতে হয়। আটঘাট বেঁধে পথে বেরিয়ে হয় টিউব রেলওয়ে দিয়ে না হয় বাস ধরে ফিরি। স্কুল থেকে যখন বেরোই তখন এখানে গভীর রাত। আমাদের দেশেই শীতকালে পাঁচটা সাড়ে পাঁচটায় সন্ধ্যা হয়, এখানে যে আরও আগে সাঁঝ লাগবে তা সহজেই বুঝতে পারি। এখানে তিনটা সাড়ে তিনটায় সূর্য ডুবে যায়। সুতরাং রাত্রের অনেকটা এরা কাজে লাগায়। বাতি জ্বালিয়ে স্কুলে ক্লাশ বসেছে। অফিসে কাজ চলেছে। দোকানে সওদাপাট হচ্ছে। লাইব্রেরীতে ছেলেমেয়েরা পড়ছে।

শীত যে নির্মম ওর সঙ্গে মুখোমুখি সাক্ষাৎ হয় ঘুমোবার সময়ে। শীত থেকে বাঁচবার জন্য মানুষ নেয় বিছানায় আশ্রয়। এখানে তার জন্যে প্রচুর আয়োজনও করে রাখা হয়েছে। গদি আঁটা বিছানা। একবার ওর মধ্যে পড়লে মনে হয় বিছানায় ডুবে গেলাম। এহেন আরামের বিছানাও একেবারে হিম হয়ে থাকে। সারাদিনের আপিসী কাপড় চোপড়ের উষ্ণ সুখস্পর্শ থেকে শরীরকে এই প্রথম বারের মতো বিচ্ছিন্ন করে বরফ দেওয়া এক কলস পানি শরীরে ঢেলে দিয়ে গেলো। এতে বড়ো শত্রুও কি মানুষের আর কেউ আছে? এ থেকে বাঁচবার জন্যে বার বার ব্যাগে গরম পানি পুরে বিছানার অন্ততঃ কিছুটা শরীরের সঙ্গে মিতালি পাতানোর উপযোগী করে নিই। কিন্তু সমস্ত বিছানার তুলনায় সে আর কতটুকু! ও খোদা! বিছানায় যাবার কথা মনে হলে বুকের ভিতরটা ঢপ ঢপ করে উঠে।

***

এখানকার শীত যে কতো ভীষণ এবং সে জন্যই আমাদের কাছে কতো হিংস্র হতে পারে এ সম্পর্কে অনেক ইংরেজের সঙ্গে আলাপ করেছি। তারা বলেছে, এবারের মতো শীত নাকি গত কয়েক বছরে পড়েনি। অনেক বুড়ো বুড়ি এমনকি ছোটরাও নাকি শীতের প্রকোপে মারা পড়েছে। আমার মতো শীত-ভীতু লোক কি করে এই শীত থেকে উদ্ধার। পেলাম সেটা আমার নিজের কাছেই একটা বিস্ময়।

ফরাসী সম্রাট নেপোলিয়ান মস্কো জয় করার জন্যে রাশিয়া আক্রমণ করেছিলেন। ইউরোপ মহাদেশে সবচেয়ে বেশী শীত পড়ে রাশিয়ায়। যুদ্ধ যেমনই হোক না কেন, রাশিয়ানরা শত্রুপক্ষকে কোন রকমে ঠেকিয়ে যদি শীত পর্যন্ত টেনে নিয়ে যেতে পারে তা হলে তাদের দেশের শীতই শত্রুপক্ষের জন্যে মারাত্মক অস্ত্র হয়ে ওঠে। রাশিয়ার সাইবেরিয়ার সমতল ভূমি থেকে তুষার-হিম হাড় ভেদ করা বাতাস প্রবল বেগে বইতে থাকে। উপর থেকে পড়তে থাকে বরফের টুকরো-বৃষ্টির মতো। কুয়াশায় চারদিক হয়ে যায় অন্ধকার। এদেশী যারা তারা তো অভ্যস্ত বলে কোন রকমে সহ্য ক’রে যায় কিন্তু বিদেশীদের পক্ষে শীতের এ প্রকোপ হয়ে ওঠে এ যুগের এটম বোমার মতো মারাত্মক। যুদ্ধের সেনাপতির ইংরেজী উপাধি জেনেরাল। রুশরা তাদের দেশী শীতের আলঙ্কারিক নাম রেখেছে জেনেরাল উইণ্টার’। জেনেরাল উইণ্টারকে কোনো শত্রুর পক্ষে হারানো বড় শক্ত। নেপোলিয়ান মস্কোর জেনেরাল উইণ্টারের কাছে হার মেনে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে আসেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে হিটলারকেও নাজেহাল হতে হয় মস্কোর এই নিদারুণ সেনাপতি জেনেরাল উইন্টারের কাছে।

গ্রীনল্যাণ্ড, থাইল্যাণ্ড প্রভৃতি অঞ্চল বছরের অধিকাংশ সময়েই বরফে ঢাকা থাকে। এ সব অঞ্চলে মানুষের বাস খুব অল্প। কিন্তু যারা থাকে তারা বরফের উপরে ঘর বেঁধে বাস করে। মানুষ প্রকৃতিকে কি ভাবে জয় করেছে তাই ভাবি। ফিনল্যাণ্ডের একটি ছেলের সঙ্গে এক রেস্তোরাঁয় বসে ওদের দেশের শীতের সম্বন্ধে আলাপ করছিলাম। বরফের ওপর দিয়ে কি ভাবে ওরা শ্ৰেজগাড়ী চালায়, স্কেটিং করে, বরফ দিয়ে কিভাবে গেণ্ডুয়া খেলে তার গল্প শুনে তাক লেগে যায়; প্রকৃতিকে মানুষ যে কি ভাবে দাসে পরিণত করেছে তার ছবি দেখে আশ্চর্য হতে হয়। ওদের দেশের শীত ও বরফের কথা শুনে আমাদের দেশের সাধারণ লোকের বিশ্বাস না হবারই কথা। ওরাও আমাদের রৌদ্রের তাপ ও গরমের কথা শুনে কি ভাবে বিস্মিত হয় তা বলছি। ছেলেটি তেমন লেখাপড়া জানে না। বয়স আঠারো কি বিশ বছর হবে। তার বোন লণ্ডনে রেস্তোরাঁ চালায়। বোনের সংসারে দিনাতিপাত করছে, অবশ্য বিনাখরচে নয়–তার রেস্তোরাঁয় খেটে। সে আমাকে বললে, তোমাদের দেশের রান্নার জন্যে নাকি আগুনের দরকার হয় না, পাত্রের রান্নার জিনিসপত্র রেখে সেটা বাইরে রোদে রেখে দিলেই নাকি সিদ্ধ হয়ে আসে? অজানা জিনিসের গায়ে আমরা এ ভাবেই কল্পনার রং চাড়াহ, এ কথা ভেবে আমি মনে মনে না হেসে পারলাম না।

যে দেশের প্রাকৃতিক আবহাওয়া যেমন সে দেশের মানুষও তেমনি হয় কর্মঠ না হয় অলস। আমাদের দেশ গরম বলে মানুষগুলোর কি দশা দেখি? তেমন হাড়ভাঙ্গা খাটুনি তাদের পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না। যতটুকু খাটে পান্তাভাত খেয়ে তারও চেয়ে বেশী জিরিয়ে নিতে চায়। ইংলণ্ড একে তো সমুদ্রের মধ্যে ছোট্ট একটুখানি দ্বীপ তাতে বছরের ন’মাসই শীতার্ত। সুতরাং এখানকার নরনারীকে বেঁচে থাকার জন্যে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করতে হয়। প্রকৃতিই ওদের শ্রমের মূল্য শিখিয়েছে। প্রকৃতি এদের বিরূপ বলে হাত পা ছেড়ে এরা ঘরের কোণে বসে থাকে না। আনন্দের সময় এরা পরিপূর্ণ আনন্দ ভোগ করে কিন্তু কাজের সময় বোরো শুধু কাজ। শীতকালে রাস্তাপথে গাদাখানিক কাপড়ের বোঝার মধ্যে নিজেদের দেহটাকে কোনোরকমে লুকিয়ে যখন নরনারীদের ছুটতে দেখতাম তখন এদের পোশাক আবৃত দেহের সৌন্দর্য কি স্বাস্থ্য কিছু চোখে পড়ত না। মুখ দেখতাম বটে, তাতে শ্রীর চিহ্ন তেমন স্পষ্ট হয়ে ভেসে উঠতো না। বরফ-হিম ঠাণ্ডা পানিতে হাত দিলে হাত যেমন জমে যায়, সারা শীতকালময় প্রকৃতি থেকে ইংলণ্ডের ক্ষুদ্রতম প্রাণীটাও তেমনি নিজেকে গুটিয়ে নেয়।

তার বড় নিদর্শন দেখি এখানকার গাছপালায়। শীতকালে আমাদের দেশের তরুলতা থেকেও পাতা ঝরে কিন্তু সারাদেশ তাই বলে একেবারে নিপ্রত্র হয় না। এখানে দেশময় অসংখ্য গাছ মাথা মুড়িয়ে শুকনো দাঁড়িয়ে আছে। কোথাও একটু পাতা কি কুঁড়ি পর্যন্ত দেখা যায় না। নেড়া মাথার এমন সমারোহ যদি কেউ কোথাও দেখতে চায় তাহলে একবার তাকে আসতে হবে ইংলণ্ডে। ডিসেম্বর, জানুয়ারী ও ফেব্রুয়ারী ধরে যখন তুষার বৃষ্টি হতো তখন গাছের নেড়া ডালপালার বরফকণা জমে কি সুন্দর সাদা হয়ে থাকতো; শীতে মরলে কি হবে, তারও যে একটা সৌন্দর্য আছে তা অস্বীকার করবার উপায় নেই। মৃত্যু-হিম ঠাণ্ডার মধ্যে বরফ ছুঁড়ে খেলার দৃশ্য উপভোগ করতাম আর প্রকৃতির সেই তুষার-শুভ্র স্নিগ্ধতায় মন ভরে আসততা। এদেশের লোকের যে তাতে কি আনন্দ, তা দেখে দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে যেতাম।

তিন

আজ ১লা এপ্রিল। রবিবার। এ দিনটি এ দেশের লঘু হাসি-পরিহাসের দিন। দুনিয়াতে ইংরেজ জাত যেমন চুপ থাকতে জানে, তেমনি হাসতেও জানে। পথে, ঘাটে, স্কুল-কলেজে, অফিস-আদালতে, দোকানপাটে কিংবা টিউব বাস-ট্রেনে যেখানেই দেখিনা কেন এরা আপন মনে যে যার কাজ করে যাচ্ছে। মনে হয় বিনা প্রয়োজনে এদের কথা বেরোয় না, নিতান্ত জরুরী কথাটা ছাড়া অকারণ বেশী কথা ইচ্ছা করলেও বলতে পারে না।

প্রায় সাত মাস হলো এখানে এসেছি। সাত মাসে দিন গুণে দিন কুড়ির বেশী সূর্যের আলো দেখেছি বলে মনে হয় না। সকাল বেলায় যদিও সূর্য ওঠে, কিছুক্ষণ যেতে না যেতেই বাতাসের বেগ প্রবল হয়, ঠাণ্ডার প্রকোপ বাড়তে থাকে। আকাশে টুকরো টুকরো মেঘ ভেসে বেড়াতে বেড়াতে জমাট বাঁধে। আকাশ আঁধার হয়ে আসে; ধোয়ায় কুয়াশায় আর মেঘের অন্ধকারে সারা লণ্ডন দিনের বেলাটায় ধোয়াটে অন্ধকার হয়ে যায়। আমি যে পরিষ্কার সূর্যের দেশের লোক, আমার দেশে সকালে সূর্য উঠে, সারাদিন প্রখর কিরণ ছড়িয়ে সন্ধ্যাবেলায় পশ্চিম দিগন্তে অস্ত যায়-পরিষ্কার আলোকিত দিনে মন যে সেখানে প্রফুল্ল থাকে, এই সাত মাস ইংলণ্ডে বাস করে সে কথা ভুলেই যেতে বসেছি।

এই মেঘ, এই ধোঁয়া, এই বৃষ্টি, এই বাতাস, এই কনকনে হাড় ভেদকরা শীত–সবই এদেশের মানুষের গা-সওয়া হয়ে গেছে। তাই দিনের বেলাকার গোড়ার দিকে হঠাৎ যখন এরা সূর্যের মুখ দেখে, স্নিগ্ধ রোদে চারিদিক যখন ঝলমল করে ওঠে, তখন এদের চোখে মুখে আনন্দের জ্যোতি উপচে পড়ে। পরিচিতে পরিচিতে তো কথাই নেই-অপরিচিতও অপরিচিতকে পথ চলতে গিয়ে মনের আনন্দের ভাগ দেওয়া নেওয়ার জন্য ডেকে বলে-কেমন সুন্দর দিনটা, না? ‘হাউ লাভলী’। তার অনুগামী কি সহগামী তার আনন্দ ভাগ করে ভোগ করবার জন্যে ঠিক তেমনি ভাষায় সাড়া দেয়। কিন্তু আলাপ এদেশের বেশী জমে না। ওয়েদারই এদের আলাপের পুঁজি। সুতরাং পুঁজি ফুরুলে চুপ করে যায়।

এরা যেমন চুপ করে থাকতে, আপনার মধ্যে ডুব মেরে থাকতে ভালোবাসে তেমনি সামান্য কিছু একটা অবলম্বন পেলে প্রাণ খুলে হাসতেও জানে। যে হাসতে জানে, দেখা যায় সে বাঁচতেও জানে। হাসির লহরীতে সব ধুয়ে মুছে যায়। ইংরেজের জাতীয় চরিত্র বড়ভো পাক-খাওয়া, কূটবুদ্ধির জন্যে এদের নাম আছে। আর ডিপ্লোমেসীর জোরেই এদের। মত একটা সংখ্যালঘু জাতও এতকাল ধরে দুনিয়াতে প্রভুত্ব করে এলো। কিন্তু এখানে এসে দেখছি ইংরেজ বড়ো কষ্টসহিষ্ণু জাতও। চারিদিকের সাগরের মধ্যে অবস্থিত ইংলণ্ড একটি দ্বীপবিশেষ। জায়গায় জায়গায় পাহাড়ের মতো উঁচু আর তার পরেই সমতল ভূমির মতো নীচু।

এদের দেশে খাদ্যশস্য বড়ো বেশী ফলে না, যা ফলে তাতে এদের কুলোয় না, তাই বিদেশের দিকে সব কিছুর জন্যেই এদের চেয়ে থাকতে হয়। কিছুদিন থেকে দেখছি গোশত একেবারে উধাও হয়ে গেছে। আরজেনটিনা, অস্ট্রেলিয়া থেকে এরা মাংস আমদানী করে। আমাদের মতো টাটকা মাংস এরা খেতে পায় না কি? বিদেশ থেকে তিন চার মাস আগের হালাল (জবাই) করা গরু, ভেড়া, শুয়োর, খরগোস জাহাজ বোঝাই করে এদেশে আসে। এরা অতি আদরে সেগুলো দোকানে দোকানে ঝুলিয়ে রাখে। আর মাথাপিছু র‍্যাশনে সামান্য একটু যা পায় তাই নিয়ে অতি আনন্দে খায়। দুধ ও দুধজাত জিনিস আসে নিউজিল্যাণ্ড থেকে। ভিন্ন দেশের জিনিসপত্র না হলে এদের আদৌ চলে না। তাই বলে কি এরা এদের দেশকে কম ভালবাসে? কত কবি যে এদের আপন দেশের প্রশংসায় মুখর হলেন তা বলে শেষ করা যায় না। এদের দেশ সত্যি ভারি সুন্দর। পৃথিবীর সেরা বৃহত্তম নগরী তাও এদেরই দেশ। বৃহত্তম নগরী লণ্ডন আর অসংখ্য সুন্দর সাজানো ছোট গ্রাম আর উঁচুনীচু দিগন্তবিস্তৃত মাঠ নিয়ে সাগরের মাঝখানে গড়ে উঠেছে ইংলণ্ড দ্বীপ। শেক্সপীয়ার তার দেশকে তাই বলেছেন-A precious gem set in the silver sea রূপালী সমুদ্রের মাঝখানে যেন অমূল্য মণির মতো বসানো রয়েছে এই দেশ ইংলণ্ড।

এদের প্রকৃতির এই রুদ্র-কঠোরতার কথা যত ভাবি ততই মনে হয় এ জাতটা বড্ডো কষ্ট সহিষ্ণু আর তেমনি সংগ্রামশীল। রুদ্র প্রকৃতি ও পরিবেশের সংগে সংগ্রাম করে এদেরকে বাঁচতে হয়। তাই মনে হয় কাজের চাপে এরা যেমন অকারণ কথা বলে দু’দণ্ড সময় নষ্ট করার সুযোগ পায় না, আলাপ জমানোটা এরা যেমন ভুলেই গেছে, তেমনি কাজের বোঝা হাল্কা করে নেবার জন্যে এরা মুখ খুলে হাসতেও শিখেছে। হাসতে পরো যে কতো বড়ো কলা তা বোঝা যায় এদের দৈনন্দিন ব্যবহারের খুঁটিনাটিতে। এদের আমোদ-প্রমোদ, খেলাধূলায়, সিনেমা-থিয়েটারে, প্যান্টোমাইম কি ব্যালেতে যতো না দেখি গম্ভীর ভাবে জীবনকে গড়ে তোলার তাগিদ, তার বেশী দেখা যায় হাসির মারপ্যাঁচ। ঘর ভরা লোক কথায় কথায় হেসে যাচ্ছে। কোন গোলমাল নেই-হৈ চৈ নেই। বিরাট জনতার প্রাণখোলা হাসির হররায় সমস্তটা ঘর যেনো গমগম করছে। দোকানপাটে যাও-বিশেষ করে ছেলেপুলেদের বিভাগে গেলে দেখা যাবে ছেলেমেয়েদের হাসানোর জন্য কত রকমের খেলনার আয়োজন করে রাখা হয়েছে। এমনভাবে এ্যালিস ইনদি ওয়াণ্ডার ল্যাণ্ড, হামটি ডামটি, পিটার পাণ্ড, হিফটি টিফটি প্রভৃতির গল্প বা ছড়াকে আকার দিয়ে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। দোকানে ঢুকলেই মনে হয় যেন আপনা থেকে কাতুকুতু লাগছে। হাসির আবহাওয়াটাই ছোঁয়াচে।

এই জাতেরই তো পয়লা এপ্রিল। এদের আমোদের দিন। লোককে ঠকিয়ে এমন কি কষ্ট দিয়েও কিভাবে নির্দোষ আমোদ পাওয়া যায় পয়লা এপ্রিল তার প্রতীক। এজন্যে এরা এদিনটাকে বলে ‘অল ফুলস ডে’-বোকা বানাবার দিন। ঠাট্টা করে যাতে আমোদ উপভোগ করা যায় সে জন্য একটা দিন এরা আলাদা করে রেখেছে। তাদের জাতীয় চরিত্রে সহজ আনন্দ পাবার আয়োজনের কথা ভাবলে এটাকে তেমন খাপছাড়া বলে মনে হয় না। এ দিনে নানা ভঙ্গীতে এরা রসিকতা করে। যেমন-বন্ধু বন্ধুকে খেতে ডেকে খাওয়ার টেবিলে। শুধু হয়তো সুন্দর করে থালাই সাজিয়ে রাখলো। কোন বন্ধুকে হয়তো একটা নির্দিষ্ট জায়গায় নির্দিষ্ট সময়ে দেখা করতে বলে হয়রান করা হলো। কাউকে সম্মান করে বসাতে গিয়ে পিছন দিক থেকে তাকে না দেখিয়ে চেয়ার টেনে নেওয়া হলো। এ ধরনের আরো কত কি! এসব দেখে শুনে মনে হয় এরা শুধু হালকা আমোদপ্রিয়ই নয়, রহস্যপ্রিয়ও বটে। এদের আমোদে বুদ্ধির খেলা আছে। শাণিত বুদ্ধির দীপ্তি নিয়ে এদের সঙ্গে তেমনি ভাবে মিশতে পারলে এরা কম খুশী হয় না।

নভেম্বর কি ডিসেম্বর মাসের মতো এখন তিনটা সাড়ে তিনটায় সন্ধ্যা হয় না। সূর্য থাক বা না থাক, সাড়ে সাতটা পর্যন্ত দিনের রেশ থাকে। এমন সময়ে সূর্যের একফালি আলো যখন ঘরে এসে পড়ে তখন আর ঘরে থাকতে ইচ্ছে করে না। মনে হয় বাইরে বেরিয়ে পথে ঘুরে এই সন্ধ্যা বেলাটা সূর্যের আলোতে আমার দেশের ছোঁয়া নিয়ে আসি। কিন্তু পথে বেরুলেই কি লণ্ডনের কোন কুল পাওয়া যাবে? যত বছর এখানে থাকবো, তার প্রতিটি দিন লন্ডনের একটা করে পথ যদি ঘুরে আসি, তবু এর শেষ হবে না, এর পথঘাটও সব চেনা যাবে না। বৃটিশ সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় সেরা শহর ছিল কলকাতা। এমন গোটা কয়েক কলকাতা লণ্ডনের পেটে হজম হয়ে যাবে। আকাশ পথে উড়ে লণ্ডন আসার সময় কোনো এক দেশে পাহাড়-পর্বত মরুভূমি কি মহাসাগর যখন যেটা চোখে পড়ছিল মনে হচ্ছিল তার শেষ নেই। লণ্ডনে এসে সে কথাই বার বার মনে পড়েছে। লণ্ডন যেন প্রাসাদের একটা মহাসমুদ্র। কোথায় যে এর আরম্ভ আর কোথায় যে এর শেষ ম্যাপে দেখা গেলেও লণ্ডনের আমরণ অধিবাসীরাও তা ঠিক করে বলতে পারে না জানেও না। অন্ধকারে হাতড়ে চলার জন্যে মানুষ যেমন দু’একটা আন্দাজ করা চিহ্ন ঠিক করে রাখে আমিও তেমনি মোটামুটি দু’একটা জায়গা মনে মনে ঠিক করে রেখে আর বাকিটা চিনতে পারবো না বলেই এক রকম নিশ্চিত হয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছি। এতে আমার লজ্জার কোন বালাই নেই। খাস লণ্ডনবাসীদেরও ত ঐ দশী।

লণ্ডনের বিরাটত্বই মনকে ঘাবড়ে দেয়। পথে বেরোলে মনে হয় যেন নিজকে হারিয়ে ফেলছি। ফুটপাথে অগণিত জনতার ভিড় আর পথ দিয়ে পিঁপড়ের সারির মতো যানবাহন-সেই কোচ, ট্রাক, টিউব-বাস-ট্যাক্সী। তবু ভাগ্য ভালো-যানবাহনের ধাক্কায় জনস্রোত চাপা পড়ে না। তাদের পথ সুনির্দিষ্ট। শৃঙখলা প্রশংসাতীত ভাবে সুন্দর। একটা পথের কিছু দূর যেতে না যেতেই জুতা যেনো ডান বামের পথে কেটে পড়তে পারে তার সুবন্দোবস্ত আছে। মোড় ঘুরবার সময় তো বটেই, তার আগেই গাড়ীগুলো চলতে চলতে পথের মাঝে প্রয়োজন মতো যেনো হঠাৎ দাঁড়িয়ে যায় আর স্তব্ধ গতি গাড়ীর সামনে দিয়ে অপেক্ষমান জনতা যেনো মোড় ঘুরে যায়, সেজন্য রাস্তার মাঝে মাঝে যেমন ষ্ট্যাণ্ড থেকে প্রতি দু’মিনিট অন্তর লাল হলুদ ও সবুজবাতি জ্বলে উঠছে, তেমনি পথের বুকে খাজ-কাটা জায়গা দিয়েই যেন তারা একপথ ডিঙ্গিয়ে আর একপথে যেতে পারে তার সুন্দর নিদর্শনও আছে।।

লালবাতি জ্বলে উঠলে গাড়ীগুলোকে সেখানে অবশ্যিই দাঁড়াতে হয়। সবুজ বাতি জ্বললে তারা চলার নির্দেশ পায়। লাল ও সবুজের মধ্যে রং বদলানোর জন্য হলুদবাতি ক্ষণিকের জন্যে জ্বলে। এদের শৃঙখলা যেমন পথে পথে, তেমনি বাড়ীঘরে আর সবার ওপরে পথচারী মানুষের মধ্যে। ছককাটা স্কোয়ারের মধ্যে বাড়ীঘর আর তার চারপাশ দিয়ে রাস্তা। সবই ছবির মতন। এক রকমের পথ। পথের ধারে এক রকমেরই বাড়ী-দালানের পর দালান একই সঙ্গে এটেনসনের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে। লণ্ডন অতি প্রাচীন শহর। পুরানো ইতিহাসের বয়সের চিহ্ন গায়ে মেখে আর ফ্যাক্টরীর ধোঁয়ায় লণ্ডনের বাড়ীঘরগুলোর রং কালো হয়ে গেছে।

শীতের দেশ। এ কারণে এদের বাড়ীঘরগুলোতে বারান্দা নেই, ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে খোলা হাওয়া উপভোগ করে আমাদের দেশের মতো ঘুমে ঢলে পড়বার কোনো অয়োজনও নেই। ঘরের কোনো সৌন্দর্য আছে কি না বাইরে থেকে বুঝবার উপায় নেই। আয়োজন ও সাজসজ্জা সবই ঘরের ভেতরে। এদের রুচি কতো মার্জিত এবং শীত থেকে বাঁচবার জন্যে এদের দরিদ্রতম মানুষও প্রয়োজনের তাড়নায় কিভাবে যে ঘর সাজায় তা এখানে এসে না দেখলে বিশ্বাসই করা যায় না। ঘরের ভেতরের দেওয়ালগুলো সুন্দর মসৃণ ওয়াল পেপার দিয়ে মোড়া। মেঝেতে অবস্থা ও রুচিভেদে দামি কার্পেট পাতা।

ঘরের জানালাগুলো কাঁচের। সে কাঁচও পুরু এবং খুব বড়ো। শীতের ভয়ে জানলা কালেভদ্রে খোলা হয়। খুললেও মানুষ যখন ঘরে না থাকে তখনই জানালা খোলা হয়। অক্সিজেন নেবার জন্যে। কাঁচের জানালার সঙ্গে রুচিমতো পর্দা দেখা যাবে সব বাড়ীতেই ঝুলছে।

লণ্ডনের বাড়ী-ঘরের সব চাইতে বড়ো বৈশিষ্ট্য হলো তার মাটির নীচেকার ঘর। লণ্ডনের প্রতি বিন্দু মাটিকে এখানকার লোকেরা কাজে লাগিয়েছে। সব কিছুতেই মাপজোখ করা পরিকল্পনার ছাপ দেখা যায়।

সমস্ত লণ্ডন শহরের মাটির নীচে আছে আর একটি জগৎ। সে জগৎ তার টিউবরেলের জগৎ। সেটা যেমন তার মায়াপুরী তেমনি লণ্ডনের অধিকাংশ বাড়ীর নীচে আছে দু’এক তলা ঘর। মাটির নীচে ঘর নেই এমন বাড়ী তো আজও চোখে পড়লো না। এ জন্যেই মাটির সঙ্গে লাগানো তলাটিকে এরা ফাষ্ট ফ্লোর বলে না-বলে গ্রাউন্ড ফ্লোর। আমাদের যেটা দোতলা সেটা এদের ভাষায় ফাষ্ট ফ্লোর। মাটির নীচে বেজমেন্টে কম পক্ষে একটা তুলা এদের থাকেই। ল্যাণ্ডলেডীরা সাধারণতঃ বেজমেন্টে বাস করে। বেজমেন্টের ঘর থেকে যেমন সিঁড়ি বেয়ে ওপরের ঘর গুলোয় আসা যায়, তেমনি বাড়ীর বাইরেও বের হওয়া যায়। বাইরে জগতের সঙ্গে বাড়ীওয়ালাদের দৈনিক জীবনের কারবার হয় এ পথে। আমাদের দেশের লোক হঠাৎ এসে যদি বেজমেন্টের ঘরেরই প্রথম সাক্ষাৎ পায় তা হম্বলে তার মনে প্রশ্ন জাগবে মাটির নীচে মানুষ কি করে জীবন কাটায়। এতদিন পরেও আমি মাঝে মাঝে বিস্মিত হই, মুক্ত বাতাস থেকে এ জাতটি নিজেদেরকে কি ভাবে আড়াল কম্বরে রেখেছে। হলোই না হয় শীতের দেশ।

এদের বাড়ীঘর রাস্তাঘাট তৈরীর মধ্যে যেমন একটা পরিণত পরিকল্পনার ছাপ আছে, তেমনি সময় মতো মুক্ত হাওয়া খেয়ে আসার জন্যও শহরের মাঝে মাঝে এরা পার্ক তৈরী করে রেখেছে। পার্কগুলো শহরের প্রাসাদ সমুদ্রের মধ্যে ছোট ছোট সবুজ সুন্দর দ্বীপের মতো। বদ্ধঘর ও কর্মশালা থেকে বেরিয়ে সারাটা ইংরেজ জাত এই পার্কগুলোতে প্রাণ ভরে মুক্তি ও আনন্দের স্বাদ গ্রহণ করে। এজন্যেই শহরের মহল্লার মাঝে মাঝে এমনি ভাবে এত পার্ক লণ্ডনের বুকের মাঝে সবুজের মোহ ছড়িয়ে নগরবাসীদের হাতছানি দিচ্ছে।

লণ্ডন শহরকে নানা অংশে ভাগ করা হয়েছে। এক একটা অংশকে বোরো বলা হয়। আমাদের যেমন মিউনিসিপ্যালিটি এখানে তেমনি বোরো। প্রত্যেকটি বোরোতেই অনেক পার্ক আছে। পার্কে দেখা যায় নানা রকমের গাছ, ফুলের বাগান, আর সবুজ ঘাস। এ সবের পেছনে প্রচুর খরচ করতে হয়। পার্কের কোন অংশ যেন কেউ নষ্ট না করে কিংবা ঘাসের ওপর দিয়ে যেন না হাঁটে সে জন্যে আইনের সাবধানবাণী ছাপানো রয়েছে। লণ্ডনের সব চেয়ে বড় পার্ক হাইডপার্ক, আর সেন্ট জেমস্ পার্ক। এগুলো এত বড়ো যে, এদের মাঝখানে এসে পৌঁছলে কর্মমুখর কোলাহল রত লণ্ডন শহরের আওয়াজও কানে এসে পৌঁছয় না। পাকিগুলোর বাইরে কাজের চাপে সারা লণ্ডন গতিরে ভেঙে পড়েছে অথচ এদের ভেতরে বিরাজ করছে অনাবিল শান্তি। বাঁধনের মাঝে মুক্তি পাবার অনুরূপ আয়োজন বটে।

শীতে সারা লণ্ডনের গাছপালা নেড়া হয়ে গিয়েছিল। পাতা নেই অথচ ডালপালা মাথায় করে গাছগুলো দাঁড়িয়ে আছে, এ যেমন দেখতে ইচ্ছে করে না, তেমনি অদ্ভুত লাগে। বসন্তকালে এ সব নেড়া গাছে পাতা বেরিয়ে সবুজে সবুজে নাকি কোলাকুলি করবে। হয়তো বা হতেও পারে। তার প্রস্তুতি চলছে এখন থেকে। সেই প্রতীক্ষায় আমি চেয়ে থাকলাম।

চার

বিলেতে এসে দেখলাম এখানকার বড়োদিন; আর দেখলাম পুরাতন বছরকে বিদায় দিয়ে নতুন বছরকে বরণ করে নেবার উত্সব। বড়োদিন অর্থাৎ ‘Christmas Day –আমাদের হযরত ঈসা (আঃ)-র জন্মদিন ২৪শে ডিসেম্বর গত হয়ে রাত্রি ১২ টার সময়, তার মানে যে মুহর্তে ২৫শে ডিসেম্বরের শুভ সূচনা ঠিক সে সময়ে। মানুষের উপকার করতে এসে তিনি ক্রশবিদ্ধ হয়ে জীবন দান করে গেছেন। তাই বিশেষ করে খৃষ্টান জগৎ আজও তাকে স্মরণ করে আসছে। তিনি মানুষের মঙ্গল করতে দুনিয়াতে এসেছিলেন, তাই তার অনুবর্তীরা তাঁর জন্মদিনে উৎসব করে, প্রার্থনা করে তাঁকে স্মরণ করে।

বড়োদিনের বেশ ক’দিন আগে ও পরে ইংরেজ ছেলেমেয়েরা পথে পথে গান গেয়ে বেড়ায়। এ গানকে ইংরেজীতে বলে ‘Carol’। এতে পুরুষদের চেয়ে মেয়ে ও শিশুদের উৎসাহ বেশী। মেয়েদের কণ্ঠনিঃসৃত এ গানের সুর ভারী অদ্ভুত। ওদের গানের সুর মোহ জাগায়। সকল দেশের নারীকণ্ঠের কাকলীই কি এক? আমাদের দেশে গ্রাম অঞ্চলে বিয়ের কনের হলুদ মাখা উপলক্ষে কনের বাড়ীতে মেয়েরা দল বেঁধে গান গায়। আর ধান ভানার সময়ে তাদের পাদপদ্ম যখন টেকির পিঠে পড়ে সে সময়ে ঢেঁকির উঠানামার তালে তালে তাদের গলার চিকন সুন্দর তানলয়ও ওঠানামা করে। আত্মীয়হীন প্রবাসে ‘Community Carol’ এর বিচিত্র সুর শুনতে শুনতে মনে পড়ে যায় আমাদের দেশের মেয়েদের সমবেত কণ্ঠের সেই গানের কথা।

২৪শে তারিখে প্রত্যেক অঞ্চলের স্থান বিশেষে এতো হাসি আর এতে গান সবই আনন্দের সাগর-সঙ্গমে মিলে যায়। লণ্ডনের সে রকম স্থান ট্রাফালগার স্কোয়ার। ২৪শে তারিখে সন্ধ্যার পর থেকেই ট্রাফালগার স্কোয়ারে নেলসনের কলামের নীচে এসে অগণিত ছেলেমেয়ে ও স্ত্রী পুরুষ যীশুর উদ্দেশ্যে গান গায় আর আমোদ করে। একটা গোটা জাত যীশুর নামে কিভাবে সহজ আনন্দে ভেসে যায়, ২৪শে ডিসেম্বরের রাত্রে ইংরেজ নরনারীর এই উদ্দাম নাচ গান না দেখলে বুঝা যায় না। এদের এই হাসি, এই গান, আনন্দের বন্যা, একি ধর্মের জন্যে? ধর্মের স্রষ্টা আত্মদান ক’রে পৃথিবীতে এক একটা বিরাট জাতির সৃষ্টি করে গেছেন। সে জাতি তাঁর জন্মদিন স্মরণ করে নিজের বেঁচে থাকার আনন্দ ঘোষণা করছে জাতীয় জীবনের উৎসব লহরীর ভেতর দিয়ে। মনে হচ্ছে ইংরেজ জাত ধর্মকে উৎসবে পরিণত করেছে। ইংরেজ নরনারীর সমবেত ক্যারলের সুর শীতার্ত ট্রাফালগার স্কোয়ারের বুক ভেদ করে সমগ্র ইংলণ্ডে ছড়িয়ে পড়েছে। শব্দ শুনলাম, স্বরও শুনলাম। সবটা বুঝলাম না। গানের কলির ধুয়াটুকু বারে বারে কানের কাছে ফিরে ফিরে এলো– “Oh, Come, let us adore Him, Christ the Lord!”

বড়োদিন এদের উৎসবের দিন। আমাদের ঈদের দিনের মতো আনন্দের দিন। এ দিনটিতে হোটেল, রেস্তোরাঁ প্রায়ই বন্ধ তাকে। আর এ দিনেই বাড়ীতে বাড়ীতে খানার আয়োজন হয়। সতর্ক না হলে বা এদেশের নিয়মকানুন জানা না থাকলে এ দিনটিতে খাবার উৎসবানন্দের মধ্যেও খাবারের দোকানপাট বন্ধ থাকে বলে শেষটায় উপোস করে কাটাতে হয়। লণ্ডনে নবাগতদের প্রথম ক্রিসমাস যদি কারও উপোসে কাটে তাতে বিস্মিত হবার কিছু নেই।

এদিনের ভোজ উপলক্ষে বাড়ীর ভেতরটা নানা রঙিন কাগজের কারুকাজে সাজানো, হয়। আসল বা নকল এটা “ক্রিসমাস ট্রি বাড়ীতে দিন কতকের জন্যে ঘর সাজানোর উদ্দেশ্যে আনা হয়। ঘরের ভেতরের ছাদে ও আশে-পাশে ঝুলে মিসিলটো গাছের লতা। এ লতা যেমন শোভা বাড়ায় তেমনি মধুরেণ সমাপয়েতের ইঙ্গিত বহন করে। মিসিলুটো লতা নিয়ে নরনারীর কৌতুকানন্দ ওদের এ উৎসবের অঙ্গীভূত ‘fun’। হিন্দুরা যেমন পূজোমণ্ডপে কলস ও কলাগাছ পুঁতে মন্ত্রের সাহায্যে উদ্দিষ্ট দেবদেবীর আবাহন করে, তেমনি এদের ঐ “ক্রিসমাস ট্রি’ মঙ্গলের স্মরণ চিহ্ন। তাছাড়া এ গাছটির ডালপালায় ও ঝোপেঝাড়ে গৃহকর্তার দিক থেকে বাড়ীর ছেলেপুলে ও অতিথি অভ্যাগতদের জন্যে কাগজের আবরণে নানা উপহার টাঙানো থাকে। আহার শেষে এ উপহারও বাটা হয়। বড়োদিন থেকে বারো দিনের দিন অর্থাৎ ৬ই জানুয়ারীতে এ গাছটি বাড়ী থেকে সরিয়ে ফেলতে হয়। নইলে প্রচলিত বিশ্বাস মতে বাড়ীর হয় অমঙ্গল।

পোলাও কোরমা আর সেমাই-এর আয়োজন ছাড়া আমাদের যেমন ঈদ হয় না, তেমনি বড়োদিনে এদের ভোজের প্রধান অঙ্গ রোষ্ট টার্কি, ক্রিসমাস পুডিং আর ক্রিস কেক। টার্কি ছাড়া বড়োদিনের ভোজ এদের জমে না। নিতান্ত গরীবের ঘরেও টার্কি চাই। দিনের বেলায় দুপুরেই এদের ‘Christmas Dinner হয়। সে ডিনারে ছেলেমেয়ে ও নিমন্ত্রিত অতিথি সহ খোদ গৃহকর্তা আর গৃহকত্রী সকলেই এক টেবিলে বসে খায়। শুধু খাওয়াই নয়, খেতে বসেও সকলেই যেন বিমল আনন্দ পেতে পারে তার জন্যে নানারকমের রঙিন কাগজের মধ্যে সযত্নে বাধা উপহার লুকানো থাকে-টেবিলের প্রত্যেকের জন্যই। কেউ জানে না কার ভাগ্যে কি আছে। পাশাপাশি বা সামনাসামনি খেতে বসে দু’জনে কাগজের পুরিয়া টানাটানি করলো। দ্রাম করে ফুটে উঠলো সেটি, আর তার ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো ছোট্ট একটা চিরুণী, কি কুকুর, কি হরিণের বাচ্চা, কি বোতাম, কি এমন ধরনের সাত-পাঁচ আরও কত কি। এতেও কিছু হাসির খোরাক আছে। পেটের খোরাকের সঙ্গে মনেরও তো খোরাক কিছু চাই।

মনের খোরাককে কেন্দ্র করেই এরা নিতান্ত ব্যক্তিগত কিংবা সাধারণভাবে ‘ক্রিসমাস পার্টি করে। ক্রিসমাস ডিনারটি হয় ২৫তারিখে, কিন্তু পার্টি’ ২৫শে ডিসেম্বরের আগে যে কোনও দিনে। ব্যক্তিগত ঘরবাড়ীতে তো হয়ই, তার ওপরে হয় স্কুল কলেজে, হোষ্টেলে ও ক্লাবগুলোতে। এতে থাকে বডান্সের, পানাহারের এবং নানা রকম খেলার আয়োজন। আমরা ‘কনট হল’ ব’লে লণ্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক আন্তর্জাতিক হোষ্টেলে থাকতাম। এ হলটিতে এবং ‘friends centre’-এ বড়োদিন উপলক্ষে অনেকগুলো পার্টি দেখলাম। সব পার্টিই মোটামুটি এক ধরনের।

কুনটু হলের পাটির কথা বলছি। সাতই ডিসেম্বর রাত্রে এ পাটির দিন ধার্য হলো। এ হলে থাকতো নানা জাতের আশি জন ছেলে। আশিজন ছেলের আশিটি সঙ্গিনী চাই- এ উদ্দেশ্যে ইউনিভার্সিটি মেয়েদের বিভিন্ন হোষ্টেল থেকে আশিটি মেয়েকে নেমন্তন্ন করে আনা হলো। মদ এলো তিন পিপা, সঙ্গে এলো নানা রকমের কেক ও খাবার। কোন ছেলে কোন্ মেয়েটির পার্টনার হবে তা ঠিক করা হলো এক এক জোড়া নাম ঠিক করে দিয়ে। যেমন ‘জ্যাক’ আর ‘জি’ল; ‘প্রিন্স আলীখান’ আর ‘রীটা’; চার্লি’ আর ‘ক্লেয়াররুম এবং এ ধরনের আরও। উৎসবের রাত্রে নির্ধারিত সময়ে ছেলেরা নাম বদল করে তাদের নতুন নামের টিকেট বুকে এঁটে ঘরের মধ্যেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। অতিথিরা একে একে আসছে আর প্রত্যেকের হাতেই তাদের নিজ নিজ নকল নাম দেওয়া হচ্ছে। প্রথম আমোদ হলো পার্টনার খোঁজাখুজি নিয়ে। মনে পড়ছে একটি তুকী ছেলে, ওরহান জিহনী’র কথা। সেক্রেটারীর সঙ্গে ছিল তার খুব ভাব। তাকে বলে কয়ে সে বুকে আঁটলো প্রিন্স আলীখান-এর নাম। বেচারী ভেবেছিল, যে রীটা হবে, সে যে সুন্দরী হবে তা অবধারিত। কিন্তু লটারী মতে ৬ ফিট উঁচু বকের মতো সরু গলার কিম্ভূতকিমাকার নকল রীটাকে দেখে বেচারা ‘জিহ্‌নী’র উৎসাহ এমন ভাবেই উবে গেলো যে, ক্ষোভে, অভিমানে সে তার কল নামটি ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ছেলেদের মধ্যেই গা ঢাকা দিলো। আর রীটা! তার পার্টনারকে খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়ে বেচারী একাই রইলো দাঁড়িয়ে।

পার্টিতে খাওয়া-দাওয়া হলো। তারপর শুরু হলো নানা রকম খেলা। কয়েকটি জুড়ি মিলে অনেকগুলো ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে গেলো। এক একটি দলের প্রত্যেকেই নিজের হাত থেকে অপরের হাতে একটা বল দ্রুত পাস করে দিতে লাগলো। ওধারে বাজছে গীটার। মাঝে মাঝে বাজনা থেমে যাচ্ছে। এ বাজনা থামার সময় দলের যার হাতে বলটা থাকবে তাকে দল থেকে বের হয়ে এসে দলের আর সকলকে হাসানোর জন্যে একটা কিছু করতে হবে। আমাদের দলে আর্জেনটিনার বাগুক বলে একটা ছেলে ছিলো। বলটা তার হাতে পড়তে না পড়তে হঠাৎ বাজনা থেমে গেলো। সে তখন দল থেকে বেরিয়ে এসে ‘God save our gracious King’ উল্টো করে গাওয়া শুরু করলো–’King gracious our save God’. হাসির একটি রোল পড়ে গেল।

আর একটি খেলার উল্লেখ করতে হয়। ঘরের মধ্যে আগে পরে প্রত্যেকের পার্টনার নিয়ে একটা লাইনে কুড়ি জন করে চারটি লাইন করে দাঁড়ালো। চার লাইনের জন্যে চারটি ছোট ছোট কাল আনা হলো। যে দল সবার আগে লাইনের প্রথম জনের কাছ থেকে কমলাটি হাতে না ছুঁয়ে মুখ থেকে মুখে নিয়ে শেষের জনের কাছে পৌঁছে দিতে পারবে, সে দল হবে ফা। এ খেলার মধ্যে যেমন আছে উৎসাহ ও উদ্দীপনা, তেমনি শালীনতা বজায় রেখে ছেলেমেয়েদের দু’তরফ থেকেই যৌবনাবেগ প্রকাশের একটা ব্যর্থ ব্যাকুলতা।

২৪শে ডিসেম্বর এদের মূল উৎসবের দিন। এই একটি দিনের জন্যে গত তিন মাস ধরে সারা লণ্ডনে প্রস্তুতির পালা দেখলাম। মনে হচ্ছে এরা উৎসব করতে জানে আর উৎসবের আনন্দ উপভোগ করার অধিকার এদেরই আছে। পৃথিবীর অধিকাংশ জায়গার ওপরে যে জাত এতোদিন ধরে রাজত্ব করেছে এবং এখনও করছে, সে ইংরেজ জাতের বিরাটত্রে কিছু কিছু পরিচয় পাচ্ছি। এদের জাতীয় উৎসবের মধ্যেও শ্রেষ্ঠত্বের, গাম্ভীর্যের ও লঘু পরিহাসরসিকতার ছাপ রয়ে গেছে। উৎসবের ঠিক দিনটিতে দূর থেকে হলেও যাতে বন্ধুবান্ধব ও শুভাকাক্সক্ষীদের স্মরণ করা যায় তার জন্যে ক্রিসমাস কার্ড পাঠানোর রেওয়াজ এখানে আছে। এক পেনি থেকে এক পাউণ্ড দামের কার্ডও দেখলাম। সে কার্ডে কতো রকম কবিতা লেখা আর কতোভাবে তা সাজানো। যে যেমন কার্ড কিনতে চায় ঠিক তেমনটিই সে পাবে এবং আপন প্রিয়জনকে তেমন কার্ডই এ শুভদিনের স্মরণে দিতে পারবে। আমরা নিতান্ত বাঙালী, খেতে পরতে পারলেই আমরা খুশী, উৎসবের দিনে মনের অতিরিক্ত খুশী সঞ্চারের আয়োজনের দিকে আমাদের ততো নজরই বা কোথায়? তাই এদের ক্রিসমাস কার্ডের ব্যাপারটা প্রথমে তেমন ভাবতে পারিনি। ২৪/২৫শে ডিসেম্বর যতই ঘনিয়ে আসতে লাগলো, ততোই দেখতে পেলাম পোষ্ট অফিসের লোকদের আর বিরাম নেই। কার্ড সংক্রান্ত ব্যাপারে কতো লোকের যে সপ্তাহ খানিকের চাকুরী হলো তা কানে শুনলাম এবং চোখেও দেখলাম। পোষ্ট অফিসগুলো লণ্ডন শহরের অনেকগুলো ব্যক্তিগত গাড়ীই কার্ড বিলির জন্যে ভাড়া করে নিলো। রবিবারে লণ্ডনে কোনো ডাক বিলি হয় না, কিন্তু ক্রিসমাসের কার্ড রবিবারেও বিলি হ’লো। পরের দিন বি, বি, সি’র ঘোষণা থেকে জানা গেলো এবারের বড়োদিনে সমগ্র ইংলণ্ডে ৫৬০ মিলিয়ন অর্থাৎ ছাপ্পান্ন কোটি কার্ড বিলি হয়েছে। শুনে তো অবাক হয়ে গেলাম। অবাক হবার কথাই বটে। ইংলণ্ডের লোকসংখ্যা পাঁচ কোটির মতো, আর কার্ড বিলি হলো ছাপ্পান্ন কোটি; প্রত্যেকটি লোকই গড়ে এগারটা। থেকে বারোটা কার্ড পেয়েছে ধরা যেতে পারে। বিস্মিত হচ্চি এই ভেবে যে, এতে মনের আনন্দের খোরাক ত মিটেছেই তার ওপরে কতো ভাবে কতো লোকের আয়ের পথ খুলে গেছে। কার্ড যারা তৈরী করেছে, যারা কার্ডে লিখেছে এদের আয়টাও কম হয়নি। আর সবার ওপরে আছে গভর্ণমেন্টের রাজস্ব বা আয়ের প্রশ্ন। এক একটা কার্ড পাঠাতে বড়োজোর এক কি দু’পেনি খরচ লাগে, যে পাঠায় তার গায়ে লাগে না, কিন্তু এক দুই করে এই ছাপ্পান্ন কোটি কার্ডে সরকারের ঘরে কত রাজস্ব এলো হিসেব করলে বেশ একটা মোটা অঙ্ক হয়ে যাচ্ছে। আমাদের দেশে সরকার রাজস্ব বৃদ্ধির জন্যে খাম পোষ্টকার্ডের দাম বাড়িয়ে চলেছেন, তার ফল হয় এই যে, নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া কেউ লেখে না। জাতীয় জীবনের আনন্দের আয়োজনও গভর্ণমেন্টের আয় কি ভাবে বাড়িয়ে দেয় ইংলণ্ড তার বড়ো দৃষ্টান্ত।

এরা উৎসবে কিভাবে খরচ করে তার একটা নমুনা দিই। বড়দিন উপলক্ষে ইংলণ্ডের ব্যাঙ্কগুলো থেকে টাকা উঠানো হয়েছে উক্ত সপ্তাহের হিসেব মতো ৭৮ মিলিয়ন পাউণ্ড, আমাদের দেশী হিসেবে মোটামুটি আটাত্তর কোটি টাকা। এ ছাড়া ব্যাঙ্ক থেকে না উঠিয়ে ব্যক্তিগত ব্যয়ও আছে। আমাদের পূর্ব পাকিস্তানের সমগ্র প্রদেশের এক বছরের রাজস্বখাতে আয় যেখানে প্রায় ৩৩/৩৪ কোটি টাকা, সেখানে এক সপ্তাহেই ইংলণ্ডের উৎসবের বেসরকারী খরচ আনুমানিক দশ কোটি টাকা। এদের টাকা আছে বোঝা গেলো আর এরা খরচ করতে জানে।

যে জাত সাধারণভাবে তার শিশু সন্তানের দিকে এতো লক্ষ্য রাখে, উৎসবের আনন্দের ভাগ তারাও যেন পায় এ কথা কি সে জাত ভুলতে পারে? এক কথায় বলতে গেলে উৎসব তো শিশুদেরই। তাদের আনন্দেই তো পিতামাতার আনন্দ। এখানে পৃথিবীর সব মানুষ এবং সব জাতের লোকই বোধ হয় সমান। ইংরেজ পিতামাতা তাদের শিশুদের আনন্দ দেবার জন্যে এ বিষয়ে আর একটু এগিয়েছে। শান্তাক্লজ বলে এদের বড়োদিনের একজন পুরোহিত ছিলেন। হাতেম তাই’র মতো তিনি ছিলেন দাতা। ছেলেমেয়েদের তিনি খুব ভালোবাসতেন। তাদের প্রয়োজন মতো তাদের নানা উপহার দিয়ে বেড়াতেন। সে বহুকাল আগের কথা তিনি তো গুজরে গেলেন, কিন্তু খৃষ্টান জগতের ছেলেমেয়েরা তাকে ভুললো না। এখনও তারা মনে করে শান্তাক্লজ সব খৃষ্টান সন্তানের Father Christmas; তাই তিনি প্রত্যেক বাড়ীতে বাড়ীতে ছেলেমেয়েদের বড়দিনের উপহার দিয়ে বেড়ান। ইংলণ্ড শীতের দেশ। প্রত্যেক ঘরেই দেয়ালের সঙ্গে শীত নিবারণের জন্য আগুন জ্বালবার জায়গা আছে। আগেই বলেছি, ইংরেজিতে সেটাকে বলে Fire place। আর ফায়ার প্লেসের উপরে কানেস্তারাকে বলে Mantelpiece। ছেলেমেয়েরা কি উপহার চায় তা একটা কাগজে লিখে তারা মোজায় কিংবা টুপিতে রেখে কানেস্তারায় ঝুলিয়ে রাখে। শিশুদের মা বাবারা যে বুদ্ধিমান লোক তা বেশ বোঝা যায়। ছেলেমেয়েদের অর্ডার মোতাবেক জিনিস এনে ছেলেমেয়েরা ঘুমিয়ে গেলে গভীর রাতে তাদের অজ্ঞাতে ঐ টুপি মোজা বা অন্য কোনও জিনিসে ঘরের কোথাও ঝুলিয়ে রাখে। ঘুম থেকে উঠে ২৫শে তারিখ সকালে শিশুরা সে উপহার পেয়ে কি যে খুশী হয়! নতুন কাপড় বা বই পাওয়ার আনন্দ থেকে তা কোন অংশে কম নয়। এখানকার শিশুদের আনন্দের একটা বাড়তি কারণ, তারা মনে মনে বিশ্বাস করে তাদের ফরমাইসের কাগজটা ম্যানটেলপিসের ফাঁক দিয়ে চিলেকোঠার ভেতর দিয়ে ফাদার ক্রিসমাসের কাছে পৌচেছে আর ফাদার ক্রিসমাস তাদের জন্যে উপহার রেখে গেছেন।

ছেলেমেয়েদের ভোলানোর জন্যে দোকানে দোকানে সাদা লম্বা দাড়ি লাগিয়ে, আর ঝোলা আলখাল্লা ও লালটুপি পরে এক একজন লোক নকল শান্তাক্লজ সাজে। ছেলেমেয়েরা তার কাছে গিয়ে অত্যন্ত সস্তায় তাদের খেলার জিনিস কেনে। ছোট ছেলেমেয়েদের সরল বিশ্বাস এই বিশ্বাসের বলেই ওরা বুঝি অতটা নির্মল আনন্দ পায়।

এ সম্পর্কে এখানকার সাপ্তাহিক “The New StatesITIal and Nation” পত্রিকায় একটি গল্প পড়লাম। কচি বাচ্চাদের মনে শান্তাক্লজের ব্যাপারটা কত সহজ ভাবে রেখাপাত করে তার সুন্দর ইংগিত আছে গল্পটির মধ্যে। আমেরিকা থেকে একটি পরিবার বড়োদিনে লণ্ডনে বেড়াতে এসেছে। পরিবার বলতে মা, বাবা এবং দুটি কচি বাচ্চা। আমেরিকার লোকেরাও খৃষ্টান। তারাও বড়োদিনে শিশু জগতের শান্তাক্লজে বিশ্বাস করে। তাদের ছেলেমেয়েদের মনও সেইভাবে তৈরী। পরিবারটি লণ্ডনের একটি হোটেলে বাস করছে। ২৩শে ডিসেম্বর এলো। বাচ্চা দুটো মা বাবাকে প্রশ্ন করছে, আমরা তো বাড়ী থেকে অনেক দূরে এসে গেছি, শত্তিা কেমন করে এখানে আসবে বাবা? ওর উপহার তাহলে এবার আমরা আর পাবো না’। মা বাবা তাদের যথারীতি বোঝালেন। ২৫শে ডিসেম্বর ভোরে উঠে বাচ্চারা দেখলো, ম্যান্টেলপিসের ওপরে তাদের ফাদার ক্রিসমাস শান্তাক্লজের উপহার। কি খুশীই যে হলো তারা! এত সহজে শিশুমনে বিশ্বাস জন্মে বলে বিশ্বাস করেও তারা আনন্দ পায়। তাইতো ইংরেজ কবি গ্রে একদিন শিশুদের লক্ষ্য করে বলেছিলেন, ‘where igno rance is bliss it is folly to be wise’। শিশুদের একটু বুদ্ধি হ’লে ফাদার ক্রিসমাস শান্তাক্লজের পৌরোহিত্য ও উপহার দেবার কথা ওরাই যে কিভাবে হেসে উড়িয়ে দিতে চায় এ কবিতাংশটুকুতে তার মনোজ্ঞ পরিচয় পাওয়া যাবে

My daddy’s dressing up as Father Christmas
With presents for the stocking and the tree.
I know he is, beause he is. always Santa Claus.
And it used to take me in, when I was three.
I did believe in fairies and in Santa.
But definitely stopped when I was four:
It is n’t that I won’t, but simply that I don’t
Any more.

***

When mummies shop to make merry Christmas
It’s up to kiddies all to play the game
I would not be the one to spoil the parents’ fun,
and my little baby sister says the same.
The parents think we still believe in fairies
But we have heard and seen an awful lot
They think that games and holly and things will make us
jolly, well, we are not.

***

When daddy’s dressing up as Father Christmas.
When grown-up are enjoying Christmas fun
It makes the Children glad to think that mum and dad
Have not the least idea what’s going on—
We want to be good democratic kiddies
My baby sister loves the common cause
But sometimes, she and I consess we wonder why
Grown-ups can still believe in Santa Claus.

শিশুদের জন্যে যেমন বড়োদের জন্যেও তেমনি শান্তা বড়োদিনের উৎসবে আনন্দ যোগায়। ফাদার ক্রিসমাস ইংরেজ জাতের এ উৎসবে হাল্কা কৌতুকের অংশ বিশেষ। তাই দেখা যায় বড়োদিনের শুরু থেকে নতুন বছরের প্রথম মুহূর্ত পর্যন্ত বহু লোক জুব্বা-জুব্বি পরে লম্বা গোঁফ লাগিয়ে নকল শান্তাক্লজ সেজেছে। ২৩/২৪শে ডিসেম্বরের রাত্রে লণ্ডনের ছবির দোকানগুলো থেকে ভিন্ন ভিন্ন দল একজনকে নকল শান্তা সাজিয়ে ট্রাফালগার স্কোয়ার, পিকাডিলি সারকাস প্রভৃতি জায়গায় ঘুরে বেড়ায়। দেখলাম, এদিনের আনন্দ স্থায়ী করে রাখবার জন্যে নকল শান্তার সঙ্গে প্রিয়জনকে সঙ্গে নিয়ে বহুলোকই ছবি তুলছে। এতে আনন্দ ও অর্থার্জনের পথ খুলে গেছে। ইংরেজ জাত হিসেবীও কম নয়। আনন্দের মধ্যেও তারা ব্যবসায়ের আয়োজন করে রাখে।

“ক্রিসমাস ইভ” উপলক্ষে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর থেকে বন্ধুত্বের নিদর্শন হিসেবে নরওয়ে প্রতি বছর লণ্ডনকে একটা প্রকাণ্ড ‘ক্রিসমাসট্রি’ উপহার দিয়ে আসছে। লণ্ডনবাসীরা এটাকে পেতে ট্রাফালগার স্কোয়ারে, আর ওর পাতার ফাঁকে ফাঁকে রঙ-বেরঙয়ের আলো দিয়ে ওটাকে অপরূপ মনোহর ক’রে তোলে। পাশে পানির ফোয়ারাগুলো থেকে পানি হাত পঞ্চাশেক উঁচুতে উঠে ঝরণাধারার মতো আবার নীচুতে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। এ ফোয়ারা ও ক্রিসমাসট্রির চারপাশে ক্রিসমাস ও নতুন বছর উপলক্ষে ইংরেজ নরনারী ছেলেবুড়ো সকলেই আনন্দোন্মত্ত হয়ে নৃত্য করে। আর এর ছবি টেলিভিশনে দেখে সারা ইংলণ্ডের লোক।।

ক্রিসমাসে দেশটা সত্যিই মেতে উঠে। তার প্রতি ধমনীতে রক্তের তেজ ও উত্তেজনা সহজেই লক্ষ্য করা যায়। সিনেমা, সারকাস, থিয়েটার, প্যান্টোমাইম (কথা না বলে। অঙ্গভঙ্গীর সাহায্যে গল্প ইত্যাদি কৌতুকাভিনয়), ব্যালে (নাচের সাহায্যে অভিনয়) কত কিসের যে হাট বসে তা বলে শেষ করা যায় না। প্রতিটির মধ্যেই বড়ো ও বুড়োদের জন্যে তো আছেই শিশুদের জন্যেও বিশেষ বন্দোবস্ত রয়েছে। প্যান্টোমাইম গুলোতেই শিশুরা বেশী আনন্দ পায়। কাজেই সেখানে তারাই ভিড় করে বেশী। বড়োদিনে একটা সারকাস দেখলাম- বাট্রামমিলস্ সারকাস। এরকম সারকাস ছোটবেলায় আমাদের দেশে ঢাকা ও রাজশাহীতে দেখেছি। কিন্তু আশ্চর্য ঠেলো এদের অত্যদ্ভুত-স্বাভাবিকত্ব। ৬০/৭০ হাত উঁচুতে লোহার একটি রডের উপরে স্ত্রী-পুরুষে মিলে অবাধে এবং অত্যন্ত সহজে এরা হাতে ব্যালেন্সের খেলা দেখাচ্ছে। অপূর্ব সাধনা! সারকাসের মধ্যেও পাশেই শিশুজগতের আনন্দের আয়োজন ‘fun fair’ বা ‘মজার মেলা।’ আমাদের দেশে এ ধরনের মেলায় নাগরদোলা দেখেছি। কিন্তু এ নাগরদোলা যে কত উঁচু না দেখলে ধারণা করা যায় না। ছেলে বুড়ো সকলেই দু’তিন পেনি দিয়ে নাগরদোলায় বসছে। কল টিপলেই আনন্দ পিপাসুরা সমান ব্যালান্সে উপরে উঠছে, নীচে নামছে।।

নিজের পয়সায় মোটরকার, রেলগাড়ী, উড়োজাহাজ কিনবার ক্ষমতা ক’জনেরই বা থাকে। মজার মেলায় তিন থেকে ছ’ পেনিতে নির্দিষ্ট একটা সীমার লাইনের মধ্যে শিশুরা, দিব্যি এ আনন্দ উপভোগ করছে। সবই যন্ত্র ও পয়সার কারবার। পয়সা দাও আর কলটি টেপো তাহলে মাটি থেকে কত উপরে যে উঠা যাবে তা খোদাই জানেন। পক্ষিরাজ ঘোড়ায় চড়ে রূপকথার রাজপুত্রেরা সাত সাগর পাড়ি দেয়। মজার মেলায় এসে পয়সা থাকলেই সে নায়ক হবার স্বাদ পাওয়া যায়। সুতরাং কি আনন্দ! কলের ঘোড়া (কাঠের যদিও বা) রেস খেলছে। কলের কুকুর দৌড়াচ্ছে। কাঠের পুতুল (এখানকার হাস্যকৌতুকের পরিভাষায়- হামটিডামটি, পাত্তা ইত্যাদি) ওরাও বাজি জিতে দিচ্ছে। তাতে খাবার জিনিস-নানাজাতীয় চকলেটও পাওয়া যায়। এই মজার মেলায় আমি এবং সাজ্জাদ সাহেব (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগের অধ্যক্ষ) এক জায়গায় গিয়ে ছ’ পেনি দিয়ে একটা বোর্ডের মাঝখানে কতকগুলো ঘর লক্ষ্য করে ছোট ছোট তীর ছুঁড়লাম। চল্লিশের বেশী পয়েন্ট হলো না। একটা চাবি রাখবার আংটি উপহার পেলাম। আর এক জায়গায় একটা বড়ো টাইমপিস লক্ষ্য করে কতকগুলো কাঠের গোল রিং ছুঁড়লাম। ঘড়িটা সাজানো ছিল। ছোট্ট একটা চৌকোণো উঁচু কাঠের ওপর। রিংটা ঘড়িটার ভেতর দিয়ে এসে কোথাও না ঠেকে মেঝের উপরে পড়লে আমাদের জয় হতো। কিন্তু এমন কায়দায় তা সাজানো যে, ঘড়িটার ভেতরে গিয়ে পড়লেই নীচের কাঠের কোনো এক কোণায় বেধে উপরে আটকে যেতে লাগলো-কিছুতেই নীচে নামলো না। এক শিলিং-এ আটবার ছুঁড়ে শিলিংটা হারলাম। একটা অভিজ্ঞতা হলো। কিছুক্ষণ ঘুরে আবার সেখানে এলাম; কে এক ভদ্রলোক ঘড়িটা জিতে গেছে। ঘড়িওয়ালাকে এবারে একটু বিমর্ষ দেখলাম।

২৬শে ডিসেম্বর ‘Boxing Day’। এ নামটি বিদেশীদের বড্ডো ভুল বুঝাবার সুযোগ দেয়। মনে হতে পারে এ দিনটিকে ইংরেজরা বুঝি ‘Boxing’ খেলার জন্য ঠিক করে রেখেছে। কিন্তু তা নয়। বড়োদিনে ইংলণ্ডকে উৎসব মুখর করে তোলবার জন্য পিওন, দুধওয়ালা প্রভৃতি মানুষেরা কম পরিশ্রম করে না। প্রত্যেক বাড়ীর উৎসবে পরোক্ষভাবে এরাও সহায়তা করে। দেশ বিদেশ থেকে প্রতি বাড়ীতেই প্রত্যেকের মনোরঞ্জনের জন্যে কত ক্রিসমাস কার্ডও যে পিওনেরা বয়ে নিয়ে আসে সে কথা স্মরণ করে এদেরকে কিছু কিছু বখশিশ দেবার ব্যবস্থা করা হয়েছে। বাক্সে ফেলা হোক বা না হোক এ উদ্দেশ্যে প্রায় প্রত্যেক বাড়ীতেই কিছু কিছু পয়সা জমা করা হয়। যার যা দেবার সে তা দেয় কোনো থালা কিংবা বাক্সে। পিওনেরা আসে প্রত্যেক বাড়ীতে বাড়ীতে এ দিনে দাবীর পাওনা আদায় করতে নয়, প্রত্যেকের আনন্দের ভাগে সহায়তা করছে বলে তাদের সকৃতজ্ঞ দান গ্রহণ করতে।

এক দুই করে ২৫শে ডিসেম্বর থেকে এলো ৩১ ডিসেম্বর। ৩১ ডিসেম্বর ইংরেজ জাতের নাচের দিন। নাচ আর নাচ। নেচে নেচে হেসে খেলে এরা পুরানো বছরকে বিদায় দেবে। যেদিকে দেখি ইংরেজ নরনারীর মুখে শুধু হাসি। এদের ব্যক্তিগত জীবনে যে কারও দুঃখ নেই এমনতো হতে পারে না। ব্যথা, বেদনা, আঘাত, নৈরাশ্য মানব জীবনে সাধারণ কথা। আশা পূর্ণ হ’লে মানুষ হাসে, আনন্দ করে, গান গায়, তার প্রকাশ করে আত্মীয় বন্ধু নিয়ে খেয়ে দেয়ে। দুঃখ মানুষের একার। বিফলতা আসে মানুষের একক জীবনে। সে বেদনায় মুষড়ে পড়ে একা একা, তাতে বেদনার আনন্দ পাওয়া যায়। কিন্তু তাতে মুখ ভার ক’রে থেকে সকলকে জানতে দিয়ে কি লাভ? ইংরেজ জাত মনে হয় তা ভালই বোঝে। এরা তাই ব্যক্তিগত দুঃখ ঢেকে রেখে, জাতীয় জীবনে আনন্দের তরঙ্গ তুলতে জানে।

দেখলাম ৩১শে ডিসেম্বর রাত্রিতে সারা লণ্ডন নাচছে। পথে ঘাটে চলতে চলতে নাচ। দু’চারজন একত্রিত হলেই নাচ। পিকাডিলি সারকাস, ট্রাফালগার স্কোয়ার প্রভৃতি ঐতিহাসিক স্মৃতি জড়ানো জায়গাগুলোতে পুরানো বছর বিদায় দিয়ে নতুন বছরের বরণোৎসবের নব নব আয়োজন করা হয়েছে। এ উৎসব দেখবার জন্যে বেরোলাম। ঠাণ্ডায় আমরা জমে যাচ্ছি। ভাগ্য ভালো, দিন দুই তুষার বৃষ্টি হয়নি। দেখলাম অগণিত লোক জমায়েত হয়েছে-সব বয়সের, সব শ্রেণীর এবং পৃথিবীর অধিকাংশ জাতের। রাত্রি ৯টা থেকে এখানে সেখানে দুটো একটা দলের নাচ শুরু হলো। বারোটার কিছু আগে দেখি হাজার হাজার নরনারী জড়াজড়ি করে, নাচে, ঢলাঢলি করে আর গায়। এ বছর তো ভালই কাটলো, দুনিয়াব্যাপী সমরায়োজনের হুমকীর মধ্যে আজ থেকে যে বছরের শুরু হলো সকলেরই অন্তিম ইচ্ছা যেন সেটাও ভালো কাটে! তাই নরনারী যে যাকে ধরে বলছে, Happy New Year!

এ নাচ, এ গান, এ হাসি, এ উল্লাস, সবই এ জাতের বেঁচে থাকার আনন্দঘন প্রকাশ। জীবনে যে সুদীর্ঘ ৩৬৫ দিন উপভোগ করা গেল, সে জীর্ণ পুরাতন বছরকে ধরে রাখা যাবে, তার ক্লান্তি ও অবসাদের মধ্যে পড়ে থেকে লাভও নেই। তাকে হেসে খেলেই বিদায় দাও। আবার যে আসছে সমান আদরে তার অভিষেক করো। জীবনের প্রতি এ অদ্ভুত দৃষ্টিভংগী থেকেই মনে হয় ইংরেজ জাতি বর্ষ-বিদায় ও বর্ষবরণের এ আনন্দোৎসব পালন করে আসছে।

পার্লামেন্ট হাউসের উপরের বিগবেন ঘড়িতে ঢন্ টন্ করে এক দুই করে বাজল রাত বারোটা। বি, বি, সি থেকে বিগবেনের এ আওয়াজ দুনিয়াতে প্রচারিত হলো। অসংখ্য নরনারীর সঙ্গে ১৯৫০ সালের বিদায়ের আর্তনাদ আমরা শুনতে পেলাম। মনে হলো মহাকাল তার কুহেলীঘন একটা অন্ধকার আস্তরণ মেলে দিয়ে একটি বছরকে আপন বুকের ভেতরে সযত্নে গুটিয়ে নিলো। আনন্দময় মুহূর্তের ভেতর দিয়ে জন্ম হলো ১৯৫১ সালের। এ বছরে জগতের বুকে কে জানে কি ইতিহাস রচিত হবে!

বিলেতে এসে দেখছি এখানকার স্ত্রী-পুরুষ, ছেলেমেয়ে সকলেই তাদের বিয়ের দিন ও জন্মদিন সম্বন্ধে অত্যন্ত সজাগ। বর্তমানের মধ্যে বাস করতে গিয়ে অতীতের সেই হারানো দিনটিকে এরা স্মরণ করে বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয় স্বজনদের নিয়ে আমোদ আহ্লাদে একটা দিন কি একটা রাত্রি কাটাতে চায়। আমাদের দেশে এ রকম উৎসব করে বিয়ে কি জন্মদিনের গৌরব জাহির করার তেমন রেওয়াজ নেই। করতে চাইলেও অনেকের আবার পয়সা থাকে না। দারিদ্র্যই আমাদের দেশের অধিকাংশ লোকের কাল হয়েছে। আবার যাদের পয়সা আছে তাদের এ-সবের দিকে খেয়াল নেই। জীবনকে সুন্দর করে গুছোবার, কিংবা আনন্দ উপভোগ করবার জন্য যে দৃষ্টিভঙ্গীর প্রয়োজন আমাদের দেশের অধিকাংশ ধনী ও শিক্ষিত লোকেরও তার অভাব রয়েছে; ফলে আমাদের দেশের লোকের জীবন হয়েছে গতানুগতিক। রান্না-বান্না, খাওয়া-দাওয়া আর ঘুমোনো ছাড়া আর কিছু ভাবতেই পারে না আমাদের দেশের নরনারী। জীবনকে এরা উপলব্ধি করে, রচনাও করতে জানে; নিজের সীমাবদ্ধ বিত্তের মধ্যেও এরা চলতে জানে আর ওরই মধ্যে অতীত জীবনের মধুর সুন্দর ক্ষণটি স্মরণ করে বর্তমানকে সাজাতে জানে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *