বিলুপ্ত বিশ্ব

বিলুপ্ত বিশ্ব

‘ইলেকট্রিকের বিলটা আজও জমা করলে না?’ প্রশ্নটা পিছন থেকে ধেয়ে আসতেই সুমিতের বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল৷ আবার একটা ঝামেলা লাগল বলে৷ এমনিতে ঝামেলাটা নতুন কিছু নয়৷ এ বাড়ির নির্জীব ইটগুলো পর্যন্ত সিমেন্টের চাদরের আড়াল থেকে জেনে গিয়েছে, বাড়ির বাসিন্দারা রাতদিন ছোটো-বড়ো-মাঝারি নানারকম কারণে বা নিতান্তই অকারণে একে-অপরের ওপর চিৎকার করে৷ কয়েকবার ঝগড়ার শব্দ এতটাই সপ্তমে উঠেছে, যে পাশের বাড়ি থেকে লোক ছুটে এসেছে, তিরস্কারের সুরে বলেছে, ‘এ কী মশাই! রবিবার দুপুরে পাড়ার লোক একটু শুতে পারবে না? অ্যাঁ? ক-টা দিন আপনারা একটু ছুটি কাটিয়ে আসুন তো দেখি৷’

স্ত্রী আশেপাশে না-থাকলে সুমিত তৎক্ষণাৎ জবাব দিয়েছে, ‘বুঝলেন দাদা, সংসার থেকে ছুটি নিতে না পারলে কিছুতেই শান্তি আসবে না৷’ উপদেষ্টা ভদ্রলোকও বিজয়ীর হাসি হেসে বলেছেন, ‘তিনবছরেই এই! আমাদের দেখুন, আজ ছাব্বিশ বছর হতে চলল বিবাহিত, হু হু…’

তেমন কিছু আজও যে হতে চলেছে সেটা একরকম আঁচ করতে পেরেছে সুমিত, সামাল দেওয়ার জন্য পিছন না ঘুরেই বলল, ‘আজ তো ইয়ে… ওই বন্ধ৷’

‘কী বন্ধ?’ প্রশ্নকারিণী এত সহজে ছেড়ে দেওয়ার পাত্রী নন৷

‘ইলেকট্রিক অফিস৷’

‘কেন? আজ কী? আমার গঙ্গাযাত্রা?’

‘খারাপ ছাড়া ভালো কথা মুখে আসে না তোমার?’ সুমিত এতক্ষণে পিছন ঘুরল, প্রতি-আক্রমণের একটা সুযোগ পাওয়া গেছে৷ ছাড়তে দেওয়া যায় না৷ অপরপক্ষ প্রতিহত করল, ‘বাজার যাওয়ার আগে অন্তত আঠেরোবার বলেছিলাম জমা করতে, সেটাও ভুলেছে, কোনওদিন কার সঙ্গে বিয়ে করেছে তা-ও ভুলে যাবে, যত্তসব!’

মোক্ষম জবাবটা দিতে গিয়েও দিল না সুমিত৷ এইসব ঘরোয়া অশান্তিতে নষ্ট করার মতো সময় নেই তার৷ বড়ো একটা দায়িত্ব এসে পড়েছে তার কাঁধে, সেটা সামলাতেই হিমশিম খাচ্ছে৷ এমনকি সেই কারণেই দিনকয়েক হল কিছুই মনে রাখতে পারছে না৷

ব্যাপারটা তেমন বড়ো কিছু না-একটা প্লট৷ তাও আবার সায়েন্স ফিকশনের, শর্ত শুধু একটাই৷ নতুন ধরনের গল্প হতে হবে৷ অর্থাৎ, এমন একটা প্লট যেটা আগে কেউ পড়েনি৷ আর সেখানেই হয়ছে সমস্যা, নতুন প্লট কোথায় পাওয়া যায়? সায়েন্স ফিকশনের কথা ভাবলেই আগে কয়েকটা গতে বাঁধা শব্দ মাথায় আসে, মহাকাশযান, মঙ্গলগ্রহ, এলিয়েন, এপোক্যালিপ্স ইত্যাদি৷ এইসব নিয়ে খেলা করতে করতে নয়-নয় করে একটা গল্প তৈরি হয়েই যায়৷ এতকাল সে তা-ই করে এসেছে৷ সেগুলো এদিক-ওদিক ছাপা হয়ে বাজারে বেশ খানিকটা নামও হয়েছে৷ তাতেই মাসখানেক আগে ‘আশ্চর্য তারা’ ম্যাগাজিনের সম্পাদক একরকম জোর করেই ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছেন গুরুদায়িত্ব৷ এমন একটা সায়েন্স ফিকশন লিখতে হবে যেটা আগে কেউ লেখেনি, এদেশেই হোক কী বিদেশে৷

মহা সমস্যা৷ এই একমাসে লাইব্রেরি তন্নতন্ন করে সায়েন্স ফিকশন চষে ফেলেছে সুমিত৷ Arthur C Clarkes– Ray Bradbury– Orson Scott Card থেকে শুরু করে আমাদের শঙ্কু পর্যন্ত প্রায় মুখস্থ করে ফেলেছে, কিন্তু কোনও লাভ হয়নি, উলটে ব্যাপারটা আরও গুলিয়ে গিয়েছে৷ এখন যা-ই লিখতে যায়, মনে হয় অমুক বইতে তো এটা আগেই লেখা হয়ে গিয়েছে৷ ব্যস! ক্যানসেল৷

একমাসে এক লাইনও লেখা হয়নি৷ মনে মনে সে বুঝতে পারছে শেষ পর্যন্ত সম্পাদকের কাছেই হার স্বীকার করতে হবে, তা-ও কয়েকদিনের শেষ চেষ্টা৷ ভেবে কূল পাচ্ছে না সুমিত৷ তার ওপরে এসে জুটেছে এই রাতদিনের চিৎকার৷ রান্নাঘরের ভিতর থেকে চিৎকার ভেসে আসছে, ‘সংসারে মন নেই যখন, তো বিয়েটা করেছিলে কেন বাপু? তাও যদি জানতাম ভালো কিছু লিখছে, সুচিত্রা ভটচাজ, আশাপূর্ণা দেবীরা কি লিখতেন না? নাকি তাঁদের লেখার দাম নেই? তা নয়, যত ভূত-প্রেত, খুন, অনাসৃষ্টি!’

‘ওই লিখছি বলে দু-বেলা মাছ পড়ছে পেটে, আজকাল ওইসব ইনিয়ে-বিনিয়ে যারা লেখে, তাদের থেকে বাজারে বেগুনওয়ালা বেশি রোজগার করে, সে খবর রাখো?’

‘থাক, তোমার ওই লেখার বড়াই আর কোরো না, আমার বড়োমেসো নাটক লিখতেন, জানো? মারা যাওয়ার দু-দিন আগে সে নাটক পড়ে উৎপল দত্ত নাকি জড়িয়ে ধরেছিলেন মেসোকে৷’

‘উৎপল দত্ত শুনেছি হার্ট ফেলিওর হয়ে মারা গেছিলেন৷’ কথাটা বলে চুপ করে গেল সুমিত৷ ওপাশ থেকে উত্তর আসতে একটু সময় লাগবে, তার মধ্যে প্লটটা ভাবার একটু সময় পাওয়া যাবে৷ এইসব ক্যাচালের মধ্যেই মহাকাশ নিয়ে কিছু একটা ভেবেছে সে৷

ধরা যাক, এমন একটা গ্রহ মানুষ আবিষ্কার করল, যেটা একদম পৃথিবীর মতোই৷ জল আছে, আকাশে মেঘ আছে, এমনকি শ্বাস নেওয়ার মতো বায়ুমণ্ডলও আছে৷ কিন্তু তাতে কোনও প্রাণী নেই৷ সব কিছু যেন ফাঁকা৷ মনে হয়, বহুকাল আগে এখানে একটা সভ্যতা ছিল, এখন তার সমস্ত নিদর্শন ধ্বংস হয়ে গিয়েছে৷

পরে গিয়ে দেখা যাবে যে আসলে ওটা পৃথিবীই, সভ্যতাটা মানুষের, কিন্তু ভবিষ্যতের, গ্রহটা এক্সপ্লোর করতে গিয়ে মানুষ জানতে পারবে সেখানে মাটির নীচে বাস করে পাহাড়ের সমান উঁচু কিছু অদ্ভুত জীব৷ অর্থাৎ, মানুষের সভ্যতাকে ধ্বংস করে ভবিষ্যৎ পৃথিবীর দখল করেছে তারা৷ একালের মানুষকে তাদের নজর বাঁচিয়ে পাড়ি দিতে হবে তাদের গ্রহে, জানতে হবে কীভাবে হারানো যায় তাদের৷

এতদূরই ভেবেছে সুমিত, অবশ্য কিছু জায়গা এখনও অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে৷ যাকে বলে প্লট হোলস৷ যাই হোক এই মুহূর্তে তার মনে হল খিদে পেয়েছে৷ ঠিক খিদে নয়, কেমন যেন একটা খিদে খিদে ভাব৷

ধীরে সুস্থে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেল সে৷ তেলের উপর তেজপাতার চিড়বিড় আওয়াজ আসছে, একর্জস্ট ফ্যানের একটানা শব্দ৷ রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে দেখল নবনীতা একমনে সবজি কাটছে, ঝিঙ্গে, শসা ইত্যাদি গোল গোল সবজির শরীর ভেদ করে ছুরিটা টেবিল স্পর্শ করছে৷ টকটক করে আওয়াজ হচ্ছে, সুমিত একটু ভিতরে ঢুকে এসে বলল, ‘বাঃ, ছুরিতে বেশ হাত চলে তো৷ তালিম নেওয়া আছে?’

‘কীসের তালিম?’ নবনীতা মুখ তুলল না৷

‘একটু বড়ো ধরনের ঝামেলা হলে শসার জায়গায় আমার পিতৃদত্ত মাথাটা থাকবে, আর কী…’

‘তোমাকে মেরে আমার লাভ?’

‘কেন? স্বামীর অবর্তমানে তার স্থাবর-অস্থাবর সমস্ত সম্পত্তির মালিকানা৷’ কথাগুলো বলে একফালি কাটা শসা মুখে দিল সুমিত৷

‘এঃ, স্থাবর-অস্থাবর না হাতি, একখানা এঁদো পানাপুকুর ছাড়া তো কিছু নেই, যদি তার ধারে একটা বাগানবাড়ি বানাতে তাও একটা কথা ছিল৷’

‘ও, কী করতে বাগানবাড়িতে?’ সুমিত টমেটো তুলে নিল৷

এবার মুখ তুলে ঘুরে তাকাল নবনীতা, টেবিলে কোমর ভর দিয়ে উপরের দিকে তাকিয়ে ভেবে ভেবে বলতে লাগল৷

‘সাজাতাম খুব যত্ন করে৷ জানো? সামনে ছোটো একটা বাগান করতাম, আর পুকুরটা পরিষ্কার করিয়ে তাতে মাছ চাষ করতাম, ছাদে একটা ছোটোখাটো ঝরনা থাকত, নীচ থেকে পাম্পে করে জল গিয়ে সারাদিন জল পড়ত ওখান থেকে, রাত হলে বাইরেটায় আলো জ্বলত, ওই যে শেড দেওয়া আলো হয় না, হালকা হ্যারিকেনের মতো, চারপাশ ফাঁকা বলে খোলা হাওয়া…’

‘ইশ, এই টমেটোটা পচা… দেখে কাটো না নাকি?’

‘অ্যাঁ? কী বললে?’ সুমিতের কথাগুলো ভালো করে খেয়াল করেনি নবনীতা৷ সুমিত থুঃ থুঃ করে মুখ থেকে টমেটো ফেলতে ফেলতে বলল,

‘ছাদে ঝরনার গল্প শোনাতে শোনাতে পচা টমেটো খাওয়াচ্ছ? ছিঃ ছিঃ, মুখটাই কেমন বিশ্রী হয়ে গেল, দেখি কী রান্না করেছ?’

চুপড়ি চাপা দিয়ে কয়েকটা ভাজা বেগুন রাখা ছিল, সেগুলোতে নুন মাখিয়ে মুখে দিল সুমিত, খেতে খেতে মনে হল নবনীতা এখনও কী যেন ভাবছে, তাকে বেগুনের তেল মাখা হাতে একটা ঠেলা দিয়ে বলল, ‘আচ্ছা নব, একটা কথা বল দেখি…’

‘কী কথা?’

‘তোমার কিছু হতে ইচ্ছা করে না?’

প্রশ্নটা ভালো করে বুঝল না নবনীতা, বলল, ‘আবার হবটা কী? তোমার মতো একটা লোককে বিয়ে করে এমনি গোল্লায় গেলাম তার উপর আবার হব! সর দেখি রান্নার সময় এরকম এটা সেটা ধরে টানাটানি করবে না৷’

‘না, মানে অনেক মেয়ের ধরো নাচের শখ থাকে, সিনেমায় অভিনয়ের শখ থাকে৷’

‘আমি ওসব নাচ-ফাচ জানি না৷’ নবনীতা আবার সবজিতে মন দিল৷

‘গান জানো তো?’

‘এখন আর জানি না, কলেজে পড়ার সময় গলা ভালো ছিল, তখন হলে একটা কথা ছিল৷’

‘সারাদিন চিল চিৎকারে বাড়ি মাথায় না-করলে সে গলা এখনও খুলত৷’

‘খুলে? তোমার লেখক হয়ে কোন স্বর্গলাভটা হয়েছে? ক-টা লোক চেনে তোমাকে? আমাদের বাঙালি বাড়িতে সব ছেলেমেয়েই কেউ গান গায়, কেউ নাচে, কেউ কবিতা লেখে, তাদের সবারই কিছু করে দেখানোর ইচ্ছা থাকে, কিন্তু হয় আসলে লাখে একজন৷ ওই একজনের গল্পটা কাগজে ছাপে, বইতে লেখে তাই সহজ মনে হয়, বাকিদের গল্পগুলো কেউ শোনে না৷’

সুমিত ভেবে দেখল কথাটা মিথ্যে নয়, বাড়ির পাশের মাছওয়ালাটাও তাকে তেমন একটা চেনে না৷ চেনার খুব একটা যে কারণ আছে তাও নয়৷ কিন্তু জীবন তো এখানেই শেষ নয়, হার না মেনে দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করে যাওয়াটা এখনও বাকি৷

নবনীতার দিকে আর একবার ভালো করে তাকাল সুমিত৷ সে আজকের নতুন পরিচিতা নয়, সেই স্কুল জীবন থেকে একসঙ্গে৷ সুমিতের একসময় বাসনা ছিল ক্রিকেটার হওয়ার৷ সে দুপুর রোদে স্কুল পালিয়ে মাঠে ক্রিকেট খেলত, ছোট্ট নবনীতা তখন বাবার সাইকেলে চেপে আঁকার স্কুলে যেত৷ ফিরেই টিউশন, সকালে ঘুম থেকে উঠেই হারমোনিয়াম নিয়ে বসা, ওদের বাড়ির একতলায় একটা স্টেশনারি দোকান ছিল, সেখান থেকে সকালে দুধ আনতে যেত সুমিত৷ তখন মাঝে মাঝে সেই গান কানে আসত৷ বিরক্তিকর একঘেয়ে সা রে গা মা— এই হল গান শেখা? ফুঃ…

সুমিত মনে মনে ভাবত এর থেকে সে নিজে ভালো গান গায়৷ দোকান থেকে ফেরার পথে মনে মনে ভুল সুরে গুনগুন করত, ‘কাভি আনা তু মেরি গলি৷’

এই না শেখার বাঁধনহারা ঊচ্ছ্বাসে কেমন একটা মুক্তির স্বাদ আছে৷ পরে অবশ্য নবনীতা বুঝিয়েছিল বাঁধা নিয়মের মাঝে না-শিখলে গলায় সুর আসে না৷ রং মেশাতে না জানলে ছবি আঁকা যায় না৷ মানুষের গোটা জীবনটাই রং মেশানোর খেলা৷ সমস্যা হল কোন রং মিশবে সেটা মানুষের হাতে নেই, শুধু ছবি আঁকাটাই একমাত্র সম্বল৷

কলেজ জীবন শেষ হতেই আগেকার লাল-নীল-সবুজ-হলুদ, লুডোর রংগুলো হারিয়ে যেতে লাগল৷ ধেয়ে এল একঝাঁক খয়েরি, বাদামি আর কালো৷ এর মাঝে কোনও একদিন চেপে ধরে জোরজার করতে গান শুনিয়েছিল নবনীতা, ‘কে বসিলে আজি হৃদয়াসনে…’ শুনে মুগ্ধ হয়ে সুমিত বলেছিল, ‘এই গলা নিয়েও তুমি এখানে পড়ে আছ!’

‘তো যাব কোথায়?’

‘সে আমি কী জানি, এভাবে প্রতিভা নষ্ট করবে?’

কী যেন ভেবে নবনীতা বলেছিল, ‘আরও অনেক শেখা বাকি, হুট করে কোথাও গিয়ে পড়লেই চলবে?’

‘সে যা-ই হোক, মোট কথা তোমার জায়গা এখানে নয়৷’

তারপর নানা ঝড়-ঝাপটার মাঝে একটানা গান শেখা হয়নি নবনীতার৷ মাসদুয়েক শিখে ছেড়ে দিয়েছে, ফাঁকা পেলে আবার শুরু করেছে৷ গানের সঙ্গে সঙ্গে আগেকার সেই মেয়েটাও যেন হারিয়ে গিয়েছে একটু একটু করে৷ এইমুহূর্তে তার দিকে তাকিয়ে সুমিতের মনে হল, যার সঙ্গে স্কুলজীবন থেকে প্রেম ছিল সেই মেয়েটার সঙ্গে তার বিয়ে হয়নি৷ যার সঙ্গে হয়েছে, সে সংসার বোঝে, বড়ো বাড়ি বোঝে, বাড়ির ছাদে ঝরনা বোঝে, এ এক সময়ের অভিশাপ৷ অতীত হারিয়ে ফেলার অব্যক্ত যন্ত্রণা৷

‘তুমি কত পালটে গেছ নব৷’

কথাটায় খুব একটা পাত্তা দিল না নবনীতা, মাথা না তুলেই বলল, ‘তা-ই?’

‘তা-ই নয়?’

‘কী জানি৷’

একটু চুপ করে থেকে সুমিত জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা তুমি গান গাইবে একটা?’

‘পারি না৷’

উত্তরটা আগে থেকেই জানত সুমিত৷ মনের ভাবনাটাকে একবার যাচাই করে নিল শুধু৷

বছরচারেক আগেও নবনীতার গলার কাছে একটা গোল পোড়া দাগ ছিল৷ বিয়ের ঠিক আগেই কোনও ডাক্তারের কাছে গিয়ে কীসব ট্রিটমেন্ট করে তুলে এসেছিল সেটা৷ ইদানীং সেই দাগটার জন্য মন কেমন করে সুমিতের৷

সে ধীর পায়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এল৷ এসব ভাবনা ভেবে আর কাজ নেই, তার চেয়ে ভালো গল্পটার প্লট রেডি করা৷ কী যেন ভেবেছিল, ও হ্যাঁ, পৃথিবীর মতোই একটা গ্রহ, যেটায় কোনও সভ্যতা নেই৷

হঠাৎ মনে পড়ল আর্থার সি ক্লার্কও এরকমই একটা কিছু নিয়ে লিখে গিয়েছেন— রঁদেভু উইথ রামা৷ সেখানে অবশ্য গ্রহ ছিল না৷ একটা স্পেসশিপ, যেটা নাকি সমুদ্রের মতো বড় আর খালি৷ না, নতুন কিছু ভেবে বের করতেই হবে৷ মহাকাশ নিয়েই ভাবতে হবে কিছু, তার জন্য একবার ন্যাশনাল লাইব্রেরি যাওয়া দরকার৷ একটা নতুন প্লট মাথায় আসছে বটে…

খানিক ভেবেচিন্তে সে খাতা কলম তুলে নিল৷ বেশ কিছুদূর লিখেও ফেলেছিল, এমন সময় হঠাৎ টেলিফোনটা বেজে উঠল৷ এই হয়েছে এক সমস্যা, ল্যান্ডফোন৷ অর্থাৎ না ধরলে ফোনটা কে করেছিল বোঝার উপায় নেই, আবার ধরলে লেখার খেই হারিয়ে যাবে৷ সুমিত লেখা থেকে মুখ তুলে একবার হাঁক দিল, ‘গেলে কোথায়? ফোনটা ধরো না৷’

‘নিজে তো ও-ঘরেই আছ, ধরতে কী হয়?’ ঝাঁঝালো উত্তর ভেসে এল৷

বিরক্ত হয়ে সুমিত নিজেই উঠে পড়ল৷ ফোনটা ধরতেই ওপাশ থেকে ‘আশ্চর্য তারা’র সম্পাদক সুকান্ত চক্রবর্তীর গলা ভেসে এল, ‘কিছু এগোল কাজ তোমার?’

‘ওই খানিকটা, একটা প্লট ভেবেছি৷’

‘কী প্লট শোনাও দেখি৷’

প্লটটা সুমিতের নিজের কাছেও ততটা পরিষ্কার নয়, সে মনে মনে একটু গুছিয়ে নিয়ে বলল, ‘এখনও সেরকম ভাবে ব্লুপ্রিন্ট হয়নি, আসল ব্যাপারটা হল একটা সত্যি ঘটনা নিয়ে…’

‘সত্যি ঘটনা? বেসড অন আ ট্রু স্টোরি? বাঃ, এইসব জমে ভালো, অরিজিনাল তো?’

‘একদম, ব্যাপারটা নিয়ে এর আগে কেউ মাথা ঘামায়নি৷’

‘হুম, দিচ্ছ কবের মধ্যে?’

‘দু-একদিনের মধ্যে হয়ে যাবে আশা করি৷’

‘বেশ তাহলে লিখে ফ্যালো, আমি রবিবার হানা দিচ্ছি তোমার ওখানে৷’

ফোনটা রেখে আবার টেবিলে ফিরে এল সুমিত৷ মাথাটা খানিক গরম হয়েছে তার৷ কাছে থাকা সত্ত্বেও উঠে এসে ফোনটা ধরেনি নবনীতা, সে গলা তুলে বলল, ‘সবকিছুর একটা লিমিট রাখতে হয়, লিখতে বসেছি এখন জোর করে ঝগড়াটা না বাঁধালেই নয়?’

‘তুমি লিখতে বসেছ আর আমি কি ফুর্তি করছিলাম?’ নবনীতার বিরক্ত গলায় শ্লেষ ঝরে পড়ে৷

‘তা-বলে ফোনটা একবার এসে ধরা যায় না?’

‘রান্নাটা করে দিও, আমি বসে থাকব ফোনের ধারে, হাঁ করে৷’

‘ধুস শালা,’ পেনটা টেবিলের উপর আছড়ে ফেলে সুমিত উঠে পড়ল৷ গল্পটার শেষের দিকটা কিছুতেই মাথায় আসছে না৷ কীভাবে ওই পর্বতসমান প্রাণীগুলো ধ্বংস করেছে মানব সভ্যতা? কীভাবে যুদ্ধ করতে হবে তাদের সঙ্গে? শেষে কে জিতবে? মানুষ না ভিনগ্রহী দৈত্যরা? সায়েন্স ফিকশন লেখা বেশ কঠিন কাজ, কোনওভাবে মিলিয়ে দিলেই হল না, রীতিমতো যুক্তি দিয়ে ধাপে ধাপে এগোতে হয়৷ তবে এ ঘরে বসে লেখালিখি করতে গেলে যুক্তি-বুদ্ধি সব মাথায় ওঠে৷

জামাটা গায়ে গলাতে যাবে, এমন সময় আঁচলে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে ঘরে ঢুকল নবনীতা, তাকে দেখে একটু থমকে গিয়ে বলল, ‘তুমি আবার বেরচ্ছ নাকি?’

‘অগত্যা? এখানে আর যা-ই হোক লেখালিখির পরিবেশ নেই৷’

‘তো যাও যেখানে খুশি, এককাঁড়ি ভাত যে রান্না করলাম গিলবে কে?’ সুমিত উত্তর দিল না৷ এই মুহূর্তে ঝগড়াঝাঁটি করতে একদম ভালো লাগছে না তার৷

‘তিনটের আগে যেন ফেরা হয়৷’ নবনীতা খেঁকিয়ে ওঠে৷

‘পারব না৷’ আর না দাঁড়িয়ে দরজা খুলে সিঁড়িতে পা রাখে সুমিত৷

ন্যাশনাল লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে আর তেমন কোনও কাজ ছিল না৷ গল্প যতটা ভেবেছিল লেখা প্রায় শেষ৷ এখন শুধু ক্ল্যাইম্যাক্সটা বাকি৷ অর্থাৎ শুধু খুঁজে বের করতে হবে কী করে হারানো যায় এলিয়েনদের৷ সেটা যতক্ষণ না মাথায় আসছে ততক্ষণ আর কিছু লেখার নেই৷

এখনই বাড়ি ফিরতে ইচ্ছা হল না সুমিতের, গেলেই তো আবার সেই কথা কাটাকাটি, মনটা খিচড়ে যাবে, তার থেকে সন্ধে অবধি কোথাও চুপচাপ বসে থাকতে পারলে গল্পের শেষটা হয়তো মাথায় এসে যেত৷

খানিকটা হাঁটতেই একটা খোলামেলা পার্ক চোখে পড়ল৷ মনটা খুশি হয়ে উঠল সুমিতের, এমনটাই সে খুঁজছিল৷ বেশ অনেকটা আকাশ দেখা যায়৷ কিছু বাচ্চা ছেলেমেয়ে পার্কের চারপাশ জুড়ে দৌড়ে বেড়াচ্ছে, মাঝখানে দু-একটা বেঞ্চ পাতা আছে, বয়স্ক লোকজন লাঠি হাতে বসে আছে সেখানে৷ সেগুলো একটাও ফাঁকা নেই দেখে সুমিত একটু হতাশ হল৷

নিরিবিলিতে বসে ভাবনা-চিন্তা করলে প্লট আসার সম্ভাবনা বেশি, যাই হোক, একটা পরিষ্কার দেখে বেঞ্চ খুঁজে নিল সে৷

বেঞ্চটার একপ্রান্তে একটা বুড়ো লোক চোখ বুজে বসে আছে, শরীরটা স্থির৷ এমনকি বুকটাও ওঠা-নামা করছে না৷ বুড়ো মরে টরে গেছে নাকি? কেমন যেন ভয় লাগল সুমিতের৷ যাই হোক, সে কিছু বলল না৷ চুপ করে বসে ভাবতে লাগল৷

মন কিন্তু পড়ে থাকল সেদিকেই৷ এই এক সমস্যা— অন্য কোনও ভাবনা মনে থাকলে কিছুতেই গল্পের প্লট ভাবা যায় না৷ অর্থাৎ ভাবনাটা মন থেকে তাড়াতেই হবে৷ সুমিত একবার গলাখাঁকারি দিল৷ আশ্চর্য! এতক্ষণে এক ইঞ্চিও নড়েনি শরীরটা৷ কেমন যেন টেনশন হল তার, বুড়োটার দিকে একটু সরে এসে নীচু গলায় ডাকল, ‘মশাই শুনছেন?’

এইবার বুড়োর হাতের লাঠি নড়ল, তারপর মুখটাও, ভেজা চোখদুটো ধীরে ধীরে খুলে গেল, বুড়োদের চোখ অবশ্য ভেজাই থাকে সারাক্ষণ, ‘কী?’

গলাটার মধ্যে কেমন যেন একটা গাম্ভীর্য আছে, সুমিত একটু ইতস্তত করল, বলা তো যায় না, যে আপনি বেঁচে আছেন কি না দেখার জন্য ডাকলাম৷ লোকটার বয়স অন্তত আশি পেরিয়ে গেছে৷ গলার চামড়া ঝুলে পড়েছে, গায়ে খয়েরি রঙের মোটা শাল৷

‘বলছিলাম, দেশলাই আছে আপনার কাছে?’ বোকাবোকা প্রশ্নটা ধাঁ করে বেরিয়ে গেল মুখ থেকে৷ উত্তরটা একরকম মনে মনে ধরেই নিয়েছিল সুমিত, তাই কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে শালের ভিতর হাত ঢুকিয়ে বুড়োটা দেশলাই বের করে দিতেই সে চমকে গেল, হাতে নিতে নিতে বলল, ‘এই বয়সেও সিগারেট খান আপনি? ভারী অন্যায়৷’

বুড়োটা একবার রক্তচক্ষে সুমিতের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ন্যায়-অন্যায় বাতলে দেওয়ার তুমি কে হে?’

‘না আমি কেউ না, তবে লোকে বলে একটা সিগারেট খেলে নাকি একঘণ্টা আয়ু কমে যায়৷’ সুমিত হাসল৷

‘তো আমার আয়ু কত ছিল? দেড়শো বছর? আর আমার অত আয়ু-ফায়ু দরকার নেই হে ছোকরা, কোনওরকমে ভব-নদী পার হলে বাঁচি৷’

‘কেন বলুন তো?’ সুমিত সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল৷

‘তুমি অত জেনে কী করবে?’

মনে হল, কিছু যেন গোপন করছে লোকটা৷ বুড়োটাকে কিন্তু বেশ লেগেছে সুমিতের৷ মানে টিপিকাল বুড়োবুড়ো হাবভাব নয়৷ বরঞ্চ কথাবার্তায় ছেলেমানুষি মস্তানি আছে৷

‘তোমাকে তো আগে দেখিনি এখানে, করটা কী?’ বুড়ো জিজ্ঞেস করল৷

‘এই সামান্য লেখালিখি করি৷’

‘লেখালিখি,’ বলে খ্যাঁকখ্যাঁক করে বিশ্রীরকম হেসে উঠল লোকটা, ভারী অস্বস্তি হল সুমিতের৷ হাসি থামতে বুড়ো বলল, ‘যাও যাও, ফুটে যাও দেখি এখান থেকে, এসব লেখক-টেখক সহ্য হয় না একদম৷’

সুমিত অপমানিতই বোধ করত৷ কিন্তু লোকটার কথার মধ্যে কোথায় যেন একটা চাপা বেদনার ছাপ ছিল৷ সে গলা স্বাভাবিক রেখেই জিজ্ঞেস করল,

‘কেন? লেখকরা কোন পাকা ধানে মই দিল আপনার?’

লোকটা শীর্ণ হাতেই থাইয়ের উপরে চাপড় মারল, ‘লেখকরা দেবে কেন? আমি নিজেই দিইচি৷ আচ্ছা আমাকে দেখে সবার আগে কী মনে হয়েছিল তোমার?’

‘ইয়ে, অসহায় বৃদ্ধ পার্কের বেঞ্চে৷’

‘একটা খ্যাচামার্কা বিটকেল বুড়ো৷’

‘আপনি অন্তর্যামী দেখছি৷’

‘হু,’ বুড়ো নড়ে চড়ে বসে, ‘অথচ আমার চোখেও স্বপ্ন ছিল, বুঝলে? বিয়ের পর-পর ওই লেখালিখির শখ চড়েছিল মাথায়৷ ভেবেছিলাম কলম পিষেই দেশ জুড়ে ঢি-ঢি ফেলে দেব৷ আমাকে ঘিরে লোকজন সারাক্ষণ হল্লাগুল্লা করবে, আর আজ আমার চারপাশে কী দেখছ?’

সুমিত এতক্ষণে বুঝতে পারে ব্যাপারটা৷ লোকটা অসফল লেখক৷ লিখে বিশেষ সুবিধা করতে পারেনি৷ মনে মনে বেশ মজাই লাগে তার৷

‘তা বিকেলবেলা পার্কে বসে নিজেকেই শাপশাপান্ত করেন?’ বাঁকা হেসে জিজ্ঞেস করল সুমিত৷

বুড়ো কিন্তু এবার চুপ করে গেল৷ আবার আগের মতো মাথা পিছন দিকে করে ধ্যানে মগ্ন হল৷ সুমিত চুপচাপ বসে থাকল কিছুক্ষণ, গোটা পার্ক জুড়ে অল্পবয়সি ছেলেমেয়ে আর বুড়োবুড়িদের ভিড়৷ মাঝবয়সীরাই শুধু অনুপস্থিত৷ আকাশের দিকে চেয়ে থাকল সুমিত৷ মহাবিশ্বের শেষ নেই৷ গ্রহ-নক্ষত্র, সৌরজগৎ, ছায়াপথ, সব কিছুর মাঝে মানুষের অস্তিত্ব এত নগণ্য, এত গুরুত্বহীন৷ মাঝে মাঝে কেমন যেন ভয় লাগে সুমিতের৷ শৈশব, কৈশোর, যৌবন থেকে ধীরে ধীরে বার্ধক্য তারপর মৃত্যু, কী এসে যায় তাতে মহাবিশ্বের, তার অসীম ব্যাপ্তিতে মানুষ একটা ধুলোর থেকেও বেশি গুরুত্বহীন৷

সন্ধে হয়ে আসছে, আর বসে থাকতে ভালো লাগল না সুমিতের৷ সে উঠে পড়তে যাচ্ছিল, এমন সময় বুড়োটা মৃতদেহে যেন আবার প্রাণ সঞ্চার হল, ‘শোন হে ছোকরা…’

সুমিত দাঁড়িয়ে পড়ল৷

‘তোমাকে এসব কথা বলে কোনও লাভ নেই, তোমার বোঝার বয়স হয়নি, তুমি লেখক মানুষ, একসময় আমিও তাই ছিলাম, কেমন যেন মায়া হচ্ছে তোমার ওপর, তাই বলছি…’

‘বলুন…’

লোকটা হাতের একটা আঙুল সুমিতের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘এই যে আংটিটা দেখচ… এটা আমার স্ত্রী আমাকে দিয়েছিল৷’

আংটিটা সবুজ রঙের, কী পাথর তা সুমিত জানে না৷ চারপাশে সোনালি রঙে বেড় দেওয়া৷

‘তুমি যে জায়গাটায় বসে আছ, সেখানে সে বসত একসময়, আর এখানে আমি, ঠিক এইখানে? কিন্তু…’

একটু থেমে দম নেন বৃদ্ধ৷ আবার বলতে থাকেন, ‘কিন্তু বহু বছর হল সে আর বসছে না, বেঁচে থাকতে তার যে তেমন গুরুত্ব ফুরুত্ব আছে কিছুই মনে হয়নি৷ ওই যে বললাম, আমার ইচ্ছা ছিল সারাক্ষণ আশপাশে পাঠককুল হল্লাগুল্লা করবে৷ তার মাঝখানেই বুঝি একটা মানুষ হারিয়ে গিয়েছিল৷ আর আজ দেখো, আমি পড়ে আছি তোমাদের মাঝখানে, তোমাদের সঙ্গে আমার কী বলো তো? না তো, তোমাদের আমি চিনি, না আমার তোমাদের ভালো-ফালো লাগে, লিভিং ফসিল বোঝো? সেই হয়ে টিকে আছি কোনওমতে, তাই বলছিলাম ওইসব আয়ু-ফায়ু আমার কোনও কাজে লাগে না৷ তোমারও লাগবে না একসময়, দেখে নিও৷ যেখানে যাচ্ছিলে যাও এখন, আর ওই সিগারেটের প্যাকেটটা রেখে যাও দেখি, বেশি তো নেই৷’

বাড়ির সামনে এসেই সকালের চিন্তাগুলো আবার মনে পড়ল সুমিতের৷ রাস্তা দিয়ে আসার সময় লোকটার কথাগুলোই বাজছিল মনে মনে৷ লোকটা কি অভিশাপ দিল ওকে? ও নিজেও একদিন লড়তে লড়তে হেরে গিয়ে ব্যর্থ লেখক হয়ে হারিয়ে যাবে?

ঘরের দরজার সামনে আসতে নতুন করে বিস্বাদ হয়ে উঠল মনটা৷ ভিতরে ঢুকলেই আবার শুরু হবে সেই একই কচকচানি৷ অথচ না ঢুকেও উপায় নেই৷ বাইরে থেকে দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে এল৷ একতলায় আলো জ্বলছে না৷ অর্থাৎ নবনীতা দোতলায় আছে৷ সুমিত জামাকাপড় ছেড়ে নিল, ব্যাগ থেকে খাতাকলম বের করে রাখল টেবিলের ওপরে৷ লেখাগুলোর উপর আর একবার চোখ বুলিয়ে নিল৷ কেমন যেন খাপছাড়া হয়ে আটকে আছে গল্পটা৷ এলিয়েনরা কোন গ্রহের? কীভাবে পৃথিবীতে এসে পৌঁছাবে তারা৷ দোতলায় রান্নাঘরে এসে দেখল সেখানেও নেই নবনীতা৷ তাহলে গেল কোথায়? ছাদে গিয়েছে নাকি?

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মুখে-চোখে জল দিল সুমিত৷ সঙ্গে সঙ্গে একটা অদ্ভুত ব্যাপার চোখে পড়তে থমকে গেল সে৷ বেসিনের ঠিক ওপরেই একটা আংটি রাখা আছে, কার আংটি? এখানে এল কী করে? তার থেকেও আশ্চর্যের হল আংটিটা সে একটু আগেই দেখেছে৷ পার্কের সেই বুড়ো লোকটার হাতে৷ সেই সবুজ পাথর, সেই সোনার বেড় দেওয়া৷ অবশ্য একইরকম ডিজাইন দুটো আংটির হতেই পারে, কিন্তু এতটা কাকতালীয়! লোকটাকে ভালো করে মনে করার চেষ্টা করল সুমিত, কেমন যেন চেনা-চেনা লাগছিল না তাকে? কী যেন বলেছিল? সে-ও একসময় লেখালিখি করত, তবে কী…

নাঃ, সারাদিন গল্পের প্লট ভাবতে ভাবতে মাথাটাই এইসব গাঁজাখুরি চিন্তায় ভরে গিয়েছে৷ ভাবনাটা মাথা থেকে সরানোর চেষ্টা করল সুমিত৷ নবনীতাই বা গেল কোথায়? কথাটা মাথায় আসতেই একটা অজানা আশঙ্কা গ্রাস করল তাকে৷ কী যেন বলেছিল লোকটা? কতদিন আগে স্ত্রী মারা গেছে তার? সে মনে করতে পারল না, কথাটার সেরকম কোনও গুরুত্ব নেই, তাও মনে হল, মনে করা একান্ত দরকার, জোর গলায় একবার ডাক দিল সে, ‘নব…’

দু’বার ডাকার পরে ছাদের দিক থেকে সাড়া পাওয়া গেল, ‘ওপরে আছি আমি৷ চলে এস৷’

অর্থাৎ সে ছাদে৷ সুমিত একদৌড়ে ওপরে চলে এল৷

ঠান্ডা ঠান্ডা মিহি হাওয়া বইছে ছাদের উপর দিয়ে৷ আকাশে আধ-খাওয়া বিস্কুটের মতো চাঁদ উঠেছে৷ একদিকের মেঝেতে শতরঞ্চি পেতে শুয়ে আছে নবনীতা, তার পাশে গিয়ে বসে পড়ল সুমিত৷ পকেট থেকে আংটিটা বের করে তার মুখের সামনে ধরে বলল, ‘এটা এল কোত্থেকে?’

সেদিকে আড়চোখে তাকিয়ে সে বলল, ‘মনে নেই? আমিই দিয়েছিলাম৷’

‘বাজে কথা, আমার তো মনে নেই৷’ সুমিত বেশ জোরের সঙ্গে বলল কথাগুলো৷

‘সোনাটা নতুন বসানো তা-ই চিনতে পারছ না৷’

‘ব্যর্থ লেখক’ কথাটা বারবার বাজতে লাগল সুমিতের কানে৷ শক্ত হাতের মুঠোয় গলা টিপে মারতে চাইল আংটিটাকে, অন্ধকারে তার ক্লান্ত শরীরটা কয়েকবারের জন্য কেঁপে উঠল, কিছুক্ষণ দু-জনেই চুপ৷ একটু পরে আংটিটাকে পাশে রেখে শতরঞ্চির ওপরেই শুয়ে পড়ল সুমিত৷

আকাশ জুড়ে উজ্জ্বল গ্রহ-নক্ষত্রের মেলা বসেছে, আজকের রাতটা কেমন যেন অদ্ভুত, মনে হয় ভালো করে তাকালে গোটা আকাশের গায়ে ধূমকেতু, উল্কা আর তারাভাঙা ধুলোগুলোকেও দেখা যাবে৷ সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সুমিত বলল, ‘আমার খুব ভয় করে, জানো?’

‘কীসের ভয়?’ অন্যদিকে তাকিয়েই জিজ্ঞেস করল নবনীতা৷

‘এই আকাশের, এত গ্রহ-নক্ষত্রের, অন্তহীন, প্রাণহীন, বিরাট৷’ তার গলাটা উদাস শোনাল৷

‘তাতে ভয়ের কী আছে?’ অবাক হল নবনীতা৷

‘তুমি ঠিক বুঝবে না, ধরো আমার লেখাগুলো, কী আর করতে পারব জীবনে? ক-টা ম্যাগাজিন-ট্যাগাজিনে বেরোবে, দু-একটা লোক পড়বে৷ বড়োজোর একটু নাম যশ হবে৷ কিন্তু এই মহাবিশ্বটা কত বড়ো বলো? আমার সব চিহ্ন মুছে যাওয়ার পরেও সময় কতদিন ধরে নিজের নিয়মে বয়ে যাবে বলো তো, আমাকে কেউ মনে রাখবে না৷’

এইবারে সুমিতের দিকে ফিরে শুল নবনীতা, তার মাথায় একটা হাত রেখে বলল, ‘সে তো কাউকেই সবাই চিরকাল মনে রাখবে না, তোমার একার দুঃখ তো নয়৷’

মুখ দিয়ে একটা আওয়াজ করে সুমিত, ‘ধুর, তুমি একটা গাড়ল৷ একার দুঃখ নয় ভেবে কারও দুঃখ কমে যায়?’ কপাল থেকে চোখে নেমে এল নবনীতার হাত, চোখটা ভিজে৷

সে শতরঞ্চি থেকে মাথা তুলে ভালো করে তাকাল তার মুখের দিকে, ‘আরে! কাঁদছ যে!’

‘বিশ্বাস করো নব… লোকে ভাবে মৃত্যু সব থেকে বেশি অন্ধকার, পুড়ে ছাই হয়ে-যাওয়া সব থেকে বেশি কষ্টের৷ আমার বরাবর মনে হয় সব থেকে বেশি কষ্টের হল সময়ের কাছে হেরে যাওয়া৷ সময়ের জলের ধারায় নিজের নাম মুছে যেতে দেখা,’ নবনীতার দিকে চায় সুমিত, ধরা গলায় জিজ্ঞেস করে, ‘আচ্ছা, এই যে ধরো, একদিন আমরা সবাই মরে যাব, আমাদের নাম-যশ সব হারিয়ে যাবে, এত বড়ো আকাশের দিকে তাকালে তোমার ভয় লাগে না?’

‘লাগে, কিন্তু হারিয়ে যাওয়ার নয়৷’

‘তাহলে?’

মুখ ফিরিয়ে নেয় নবনীতা৷ মাটির উপরে নখ ঘষতে ঘষতে বলে, ‘তোমার দিকে তাকালে ভয় লাগে৷ কোনওদিন তুমি না থাকলে আমাকে যদি বেঁচে থাকতে হয়, সেই ভয়৷’

শেষ কথাগুলো বলতে গিয়ে গলা বুজে এসেছে নবনীতার৷ হাতটাকে ভাঁজ করে চোখের ওপর রাখল সে৷ বুকটা কয়েকবার কেঁপে উঠল, সেখানে হাত রাখল নবনীতা, ধীরে ধীরে বলল, ‘আচ্ছা, কাল বলছিলে না, আমি পালটে গেছি?’

‘গেছো, আমি বুঝতে পারি৷’

‘জানি, এটাও জানি যে তুমিও পালটে গেছো, কিন্তু একটা মজার কথা কী জানো?’

‘কী?’ সুমিত ভেজা গলায় প্রশ্ন করে৷

‘প্রত্যেকটা পালটে যাওয়া আমি, প্রত্যেকটা পালটে যাওয়া তোমাকে ভালোবেসেছি, কীরকম কাকতালীয় ব্যাপার না? কাউকে ভালোবাসলে এই কাকতালীয় ব্যাপারটা ঘটে৷’

সুমিতের বুকের উপর মাথা রাখে নবনীতা, কীসের যেন আবেশে চোখ দুটো বন্ধ হয়ে আসে, দু-জনেরই৷ হঠাৎ কী যেন ভেবে সুমিত চমকে ওঠে, বলে, ‘এই দাঁড়াও, দাঁড়াও, কী যেন বললে, বদলে যাওয়া আমি, বদলে যাওয়া তুমি… অর্থাৎ আমরা নিজের বদলটা দেখতে পাই না… উফফ… প্লট, পেয়ে গেছি, জবরদস্ত ক্ল্যাইম্যাক্স৷’

‘ব্যাঙ! কীসের ক্লাইম্যাক্স?’ নবনীতা বিরক্ত হয়ে ওঠে৷

‘আমার গল্পের৷ মানে ওই দৈত্যগুলো এলিয়েন নয়, ওরা মানুষ, বদলে যাওয়া মানুষ, ভবিষ্যতের মানুষ৷ ছাড়ো, ছাড়ো লিখতে হবে এক্ষুনি, ভুলে যাব নইলে৷’

সুমিত উঠতে যায়, নবনীতা হাতের এক ধাক্কায় শুইয়ে দেয় তাকে৷ তারপর তার মুখের ঠিক ওপরে মুখ নিয়ে এসে বলে, ‘কী দেখতে পাচ্ছ? মহাকাশ? স্পেসশিপ? এলিয়েন?’

নবনীতার ভরাট মুখটা তার দৃষ্টি আগলে রয়েছে, দীর্ঘ সাহিত্যজীবনে এই প্রথম সুমিত বুঝতে পারে ‘চোখ’ আর ‘আঁখি’ শব্দ দুটোর মধ্যে বিস্তর ফারাক আছে৷ তার গালের ওপর দুটো নরম হাত নেমে এল, গরম নিঃশ্বাস পড়ছে নাকের ওপরে৷

আর সেই রুপোলি চোখের কোলে অন্তহীন মহাবিশ্ব একটু একটু করে মিলিয়ে যাচ্ছে…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *