বিলিতি ভূতচতুর্দশী

বিলিতি ভূতচতুর্দশী

পঞ্চাশ একর হাতার মধ্যে বিশাল বাড়ি ‘হোয়াইট-গেটস’। গোটা চার-পাঁচ চাকর-দাসীর কথা বাদ দিলে সে বাড়িতে সারা ক্লেবার্ন একা। সন্তান কোনোদিন হয়নি, স্বামী জিম ক্লেবার্ন, এই অল্পদিন আগেই দেহরক্ষা করেছেন।

এ-বাড়িতে সারা একা বটে, কিন্তু তাই বলে আপনজন যে তাঁর কেউ কোথাও নেই, তা মোটেই নয়। ক্লেবার্নদের এক গোষ্ঠী আছে বোস্টনে, নিউইয়র্কে হেপবার্গদেরও জমজমাট সংসার, ওটাই বাপের বাড়ি সারার। জিম মারা যেতে দুই জায়গা থেকেই জোর অনুরোধ এসেছিল, ‘সারা, তুমি সেই তেপান্তর মাঠে কদাচ একা থেকো না বাপু, চলে এসো আমাদের কাছে। একটা ফ্ল্যাট দেখে দিচ্ছি, আরামসে থাকবে।’

তা সারা কর্ণপাতও করেননি সে-কথায়। বাপ-মা নেই, আছে ভাইয়েরা, তাদের বউয়েরা, তাদের ডজন ডজন ছেলেমেয়েরা। এদিকেও শ্বশুর-শাশুড়ি নেই, আছে ভাশুর-দেওরেরা, তাদের বউয়েরা, তাদেরও ডজন ডজন—

রক্ষে করো! ওই লোকারণ্যের ভিতর সারার দম আটকে আসবে তিনদিনের ভিতর। আজ ডিনার, কাল ব্রিজ পার্টি, পরশু পিকনিক। না-গেলে মন-কষাকষি হবে, গেলে আরও বেশি। সবাই দাবি করবে, ‘ডু অ্যাট রোম অ্যাজ রোম ডাজ’ যস্যার্থঃ— ‘যস্মিন দেশে যদাচার, কাছা খুলে নদীপার।’ রক্ষে করো! পাক্কা চল্লিশ বৎসর এই হোয়াইট গেটস ভবনে স্বামীর সঙ্গে একা একা কাটিয়েছেন সারা। আজ স্বামী নেই বলেই সারা চল্লিশ বছরের বাঁধন ছুরির এক পোঁচে কেটে ফেলে ফ্ল্যাটের আশ্রয় নেবেন বোস্টনে বা নিউইয়র্কে? হাসির কথা! এমন প্রস্তাব যারা করতে পারে, স্পষ্টতই সারা ক্লেবার্নকে চেনে না তারা।

ভয়ানক শক্ত মানুষ সারা, এক নম্বর স্বাধীনচেতা। মিশুক বা সামাজিক লোক যাকে বলে, তা মোটেই নয়। জিম বেঁচে থাকতে তবু বা আত্মীয়স্বজনদের কিছু কিঞ্চিৎ যাতায়াত ছিল এখানে, ইদানীং তা একদম বন্ধ। তাঁদের শেষ পদার্পণ ঘটেছিল জিমের অন্ত্যেষ্টি-উপলক্ষ্যে। তারপর আর না। সারা ডাকেননি কাউকে। একমাত্র ইবার্ট-ভাইকে ছাড়া।

ইবার্ট-ভাই হচ্ছেন ইবার্ট স্নোডেন, জিমের মাসতুতো ভাই এবং সারার মামাতো। বয়সে সারার চাইতে বছর কুড়ি কম, কুনোমিতে সারার চাইতেও এক কাঠি উপরে। সারা তবু সাহস করে স্বামীর ঘরে ঢুকেছিলেন, ইবার্ট একটা বউ ঘরে আনার মতো সাহস এখনও সঞ্চয় করে উঠতে পারেননি। ‘ওরে বাপ! বিয়ে করা তারই পোষায়, বেড়ালের মতো যার নয়টা প্রাণ। আমার প্রাণ একটাই মাত্র, সেটা আমি জ্ঞানোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে উৎসর্গ করে বসে আছি। কাকে? বউকে নয়, বইকে।’

সত্যিই, পড়াশুনো নিয়েই মশগুল হয়ে রয়েছেন ইবার্ট, জীবনের এই সবচেয়ে চটকদার চল্লিশটা বছর। যাতায়াতের জায়গা হল নিউইয়র্কের লাইব্রেরিগুলো, আর ক্বচিৎ কদাচিৎ ক্লেবার্নদের এই হোয়াইট গেটস। এখানে তিনি আসেন শুধু এই সাহসে যে, এ-বাড়ির ছয় মাইলের ভিতরে কোথাও ভদ্র গৃহস্থের বসতি নেই। প্রজাপতির এমন সাধ্য নাই যে তাঁকে পাকড়াবার জন্য এখানে ফাঁদ পেতে রাখবেন।

আত্মীয়দের ভিতরে একমাত্র ইবার্টকেই সহ্য করতে পারেন সারা, তাঁকেই হোয়াইট গেটসে ডেকে আনেন মাঝে মাঝে, ধরে রাখেন দুই-এক হপ্তার জন্য। মোটর বোঝাই করে বই নিয়ে আসেন ইবার্ট, সেগুলি পড়া শেষ না-হচ্ছে যতদিন, থাকবার অসুবিধে নেই তাঁর।

এবারে ইবার্ট এসে এক হপ্তা ছিলেন, চলে গেলেন সবে কাল। তা কালই চলে যাওয়াটা মন্দ হয়নি, আজ সকাল থেকেই আবহাওয়াটা পালটে গিয়েছে বিশ্রীরকম। কালও আকাশ ছিল নির্মল, আজ মেঘে মেঘে আচ্ছন্ন। দমকা হাওয়া বইছে, হাড়ে কাঁপুনি ধরিয়ে। অসময়ে বরফ পড়বে, তারই লক্ষণ। বৃষ্টি তো মাঝে মাঝে ঝরছেই এক এক পশলা।

সারা সকালটা ঘরেই বসে রইলেন সারা। লাঞ্চ পর্যন্ত। যখন যে ঘরেই বসছেন, আসন তাঁর জানালার ধারে। বসে বসে দেখছেন, বৃষ্টির ধারাগুলো ত্যারছাভাবে নেমে আসছে আকাশ থেকে, ঢালু পাহাড়ের গা বেয়ে ঘোড়সওয়ারেরা যেমন নামে শত্রু-সৈন্যকে আক্রমণ করবার সময়। বেশ লাগে দেখতে। গায়ে মাথায় ঠান্ডা লাগছে, তা সত্ত্বেও বসে বসে এই দৃশ্য দেখেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। ইবার্ট থাকলে সেও হয়তো পাশে বসে দেখত এই বর্ষা। নীরবেই বসে বসে উপভোগ করত একে। কারণ সারা জানেন, ছন্দের নাচুনির নীচেই যে-নাচ কাব্যরসিক ইবার্টের পছন্দ, তা হল উদার প্রান্তরে আলো-ছায়ার পটভূমিতে বর্ষার নৃত্য।

বিকালের দিকে আকাশের মেঘ যদিও কাটল না, বৃষ্টিটা কিন্তু থেমে গেল। সারা উঠে পড়লেন চেয়ার থেকে। বেড়াতে বেরুবেন। ঘনঘটা করে তুষার ঝঞ্ঝা শুরু না-হচ্ছে যতদিন, প্রাত্যহিক চার-পাঁচ মাইল হাঁটাহাঁটি কিছুতেই বন্ধ হওয়ার নয় সারার। প্রান্তরের বুক চিরে যে গাড়ির রাস্তা চলে গিয়েছে নরিংটন শহরে, বেরুবার সময় সেই রাস্তা ধরেই সারা সাধারণত বেরিয়ে থাকেন, ফেরার সময় ফেরেন শেকার-এর বনভূমির ভিতর দিয়ে। রাস্তা থেকে ঠিক এক মাইল দূরত্ব বজায় রেখে ওরই সমান্তরালে বরাবর ছড়িয়ে পড়ে আছে শেকার বন, গাছে গাছে বাদামি পাতা, ঝোপেঝাড়ে হলদে ফুল আর ঝরনায় ঝরনায় গোধূলি-আলোর ঝলমলানির দৌলতে এই হেমন্তে যাকে পরির দেশ বলে ভুল করে ভাবুক লোকেরা।

বনের সীমা পেরিয়ে খানিকটা মাঠ ভাঙতে হল আবার, তারপরে সারা এসে ঢুকলেন হোয়াইট গেটস-এর ছাতার ভিতরে। গেট থেকে কাঁকর বিছানা চওড়া পথ অনেকগুলো বাঁক খেয়ে খেয়ে অবশেষে থেমেছে গিয়ে বাড়ির সিঁড়িতে। একটা বাঁক ঘুরতেই সারা দেখলেন, তাঁর থেকে অল্প আগে ধীরে ধীরে বাড়ির দিকেই হেঁটে চলেছে এক অচেনা বুড়ি। চেহারা বা বেশবাস— কোনো দিক দিয়েই সে বুড়ি নজরে পড়বার মতো নয়। তবু যে সারার নজরে সে পড়ল, তার কারণ শুধু এই যে মাঠে বনে রাজপথে একটানা তিনঘণ্টা চক্কোর দেবার সময় একটিও মনুষ্যমূর্তি সারার চোখে পড়েনি, এমনই নির্জন পরিবেশ হোয়াইট গেটস-এর।

‘কোথায় যাবে গা তুমি?’— বুড়িকে জিজ্ঞাসা করলেন সারা।

‘ওই যে হোথা—’ আঙুল তুলে সারার বাড়িই দেখিয়ে দিল বুড়ি। ওর কথার সুরটায় যেন বিদেশি টান একটু ধরা পড়ল সারার কানে। এ অঞ্চলের লোকের কথার মতো নয় ঠিক।

‘ওখানে কার কাছে যাবে? কী দরকার?’— আবারও জানতে চাইলেন সারা।

‘এমনি, একটা মেয়ে কাজ করে ওখানে, তারই কাছে’— বলল বুড়ি কী দরকার তার কোনো জবাব নেই।

সারাও আর ঘাঁটালেন না ওকে। কাজ তাঁর বাড়িতে গোটা তিনেক মেয়েই তো করে, তাদেরই আরও আপনজন হতে পারে বুড়ি। কাজ কী তাঁর সে খবরে?

সারা জোর পায়ে হেঁটে চলেছেন সিঁড়ির দিকে। বুড়ি পিছনে পড়ে আছে। হেঁটে চলেছেন, হঠাৎ কেমন করে যেন পা হড়কে পড়ে গেলেন সারা। পড়ে গিয়েই আর উঠতে পারেন না। গোড়ালি বুঝি ভেঙেই গেল।

শক্তসমর্থ মানুষ সারা ক্লেবার্ন এই ষাট বছর বয়সেও। গায়ের জোর, গলার জোর, দুই-ই বিলক্ষণ বজায় রেখেছেন এখনও। চেঁচামেচি করে বাড়ি থেকে এনে ফেললেন দাস-দাসীদের। তারা জনাচারেক মিলে ওকে বাড়িতে এনে তুলল, চাকাওয়ালা চেয়ারে বসিয়ে। সেই চেয়ারে বসেই সারা টেলিফোন করলেন— নরিংটনে ডাক্তার সেলগ্রোভের কাছে।

বহুকালের ডাক্তার। এ-বাড়ির পারিবারিক চিকিৎসক। এসেই রসিকতা জুড়ে দিলেন, ‘বন্ধু ক্লেবার্নও স্বর্গে গেলেন, আমিও নরকস্থ হলাম। দারিদ্র্যের মতো নরক আর নেই, তা অবশ্য জানেন মিসেস ক্লেবার্ন। ক্লেবার্নের ছিল রক্তমাংসের দেহ, অসুখটা বিসুখটা হত মাঝে মাঝে, দু-চারপয়সা জুটত আমার বরাতে। আপনার তো ভদ্রে লোহার শরীর। ভেবেছিলাম, এ বাড়ির ডলারের কী রং, তা আর চর্মচক্ষুতে দেখব না কোনোদিন। তা ভগবান আছেন, বলি হয়েছে কী? পা ভেঙেছেন?’

বেদম এক চোট হেসে নিলেন সারা, ‘কারও অন্ন মেরে দেওয়া মহাপাপ, জানেন তা? সেই পাপেরই প্রায়শ্চিত্ত—’

পা পরীক্ষা করে বললেন, ‘কথা যদি দেন সে প্রাণান্তেও বিছানা থেকে উঠবেন না, তাহলে অমনি অমনি রেহাই দিয়ে যাই আজকের মতো। আর তা যদি না-দেন, এক্ষুনি গোড়ালিতে প্লাস্টার করব, উপরে হাঁটু, নীচে বুড়ো আঙুল পর্যন্ত। কী বলেন?’

প্লাস্টারে খুব ভয় সারার, কথা দিলেন যে নড়বেন না।

বললে কী হবে, ডাক্তার তবু অমনি অমনি রেহাই দিলেন না, প্লাস্টার না করুন, ব্যান্ডেজ একটা বাঁধলেন। ওষুধ দিলেন, কিন্তু ভরসা দিলেন না। ‘এক্স-রে না-করে কিছু বলা যাবে না। যেরকম ফুলে উঠেছে, পরশুর আগে আর করা যাবে না এক্স-রে। পরশু সকালে দশটায় আমি আসছি—’

উঠে যাবার মুখে তিনি কিন্তু থমকে দাঁড়ালেন একবার, ‘বলেন তো একটা নার্স পাঠিয়ে দিই গিয়ে। সেবা করার দরকার কিছু হবে না এক্ষুনি, কিন্তু একটা লোক কাছে থাকলে কথাবার্তায় সময় কাটত ভালো। ঘুম ভালো না-হতে পারে হয়তো। সেইজন্যই বলছি নার্সের কথা—’

‘নার্স কী হবে?’ কথাটা উড়িয়েই দিলেন সারা, ‘আমার ঝিয়েরা সব পুরোনো লোক, আমার শাশুড়ির আমল থেকে এ-বাড়িতে আছে, কথাবার্তা ওরা কি কইতে পারবে না দরকার হলে?’

‘তা পারবে।’— বললেন ডাক্তার, ‘আপনার ভৃত্যভাগ্য ভালো।’

সারা এ-বিষয়ে একমত ডাক্তারের সঙ্গে। তিনটি দাসী— অ্যাগনেস, মেরি, এসথার। এখানে ওদের চাকরির বয়স যথাক্রমে বাইশ, তেরো এবং এগারো বছর। এযুগে এমন ব্যাপার হোয়াইট গেটস ছাড়া অন্য কোনো বাড়িতে কেউ দেখাতে পারবে না। কথায় কথায় এখন নোটিশ দিচ্ছে ঝি-চাকরেরা। চাকরি যেন তারা নিজের প্রয়োজনে করে না, করে স্রেফ পরোপকারের জন্য মনিবদের উপরে দয়াপরবশ হয়ে। এ বাড়ির ভৃত্যেরা যে অন্যরকম, সারা সেজন্য তারিফ করেন নিজের ব্যক্তিত্বকে। মনে মনে ধারণা আছে তাঁর, মনিব তিনি ভালো। নিজে ভালো হলে জগৎ ভালো হয়, এ আর না-জানে কে।

যাহোক, ডাক্তার তো গেলেন।

ব্যথাটা ক্রমেই বাড়ছে পায়ে। শুয়ে শুয়েই ডিনার খেতে হল সারাকে। চেষ্টা করলে অবশ্য উঠে গিয়ে বসতে পারতেন ডিনার টেবিলে, কিন্তু তা গেলেন না। ডাক্তারকে যে কথা দিয়েছেন, বিছানা ছেড়ে উঠবেন না বলে!

রাত্রে যাতে মনিবনীর কোনো কষ্ট না-হয়, তার সব ব্যবস্থাই করছে অ্যাগনেস। হাতের নাগালে টিপয়, তাতে লেমনেড। একটা ছোটো টেবিল টেনে এনে টিপয়ের পাশে রেখেছে, তার উপরে খাবারের ট্রে একখানা, স্যান্ডউইচে বোঝাই সে ট্রে।

সারা বিস্মিত, বিরক্ত। ‘স্যান্ডউইচ কী হবে? আমি খাই নাকি রাত্রে? কোনোদিন খেয়েছি নাকি? আজ পা ভেঙেছে বলে কি পেটেও আগুন জ্বলেছে?’

‘না, তা নয়।’— অ্যাগনেস দরদে গলে পড়ছে, ‘তবে বলা তো যায় না, যদিই পেয়ে যায় খিদে—’

‘কক্ষনো পাবে না।’— অ্যাগনেসের আদিখ্যেতায় সারা বিরক্ত হয়ে উঠছেন, রেগে যাচ্ছেন, ‘নিয়ে যাও, স্যান্ডউইচ—’

রাগ দেখে অ্যাগনেস ট্রেসুদ্ধ টেবিল সরিয়ে নিয়ে গেল বটে, কিন্তু রেখেও যে দিল পাশের ঘরেই, শুয়ে শুয়েও তা টের পেলেন সারা। তবে ও নিয়ে আর চেঁচামেচিও করলেন না কিছু, পায়ের ব্যথার দরুন কথা কইতেও তাঁর ইচ্ছে হচ্ছে না।

অ্যাগনেস চলে গেল রাত্রির মতো। সারা ঘুমোবার চেষ্টা করতে লাগলেন।

না, ঘুম পাচ্ছে না। অন্তত অন্যদিনের মতো হচ্ছে না। রোজ এক ঘুমে রাত শেষ হয়ে যায় সারার, আর আজ দেখ না! মিনিটে মিনিটে চটে যাচ্ছে ঘুম। ব্যথার জন্যই যে শুধু, তাও তো নয়! কী যেন একটা অস্বস্তি। শুধু দেহে নয়, মনেও। কে যেন কোথায় ভারি একটা অন্যায় কাজ করছে কিছু, এমনই একটা অস্পষ্ট ধারণা। এক্ষুনি উঠে গিয়ে তাদের ধমকে দেওয়া দরকার— এমনই একটা অবচেতন ঝোঁক। ভারি অস্বস্তি। পায়ের ব্যথার কথা মনে থাকছে না এই অস্বস্তির দরুন এক এক সময়, আবার অন্য সময়ে ওরই দরুন ব্যথাটা হয়ে উঠেছে দ্বিগুণ কষ্টদায়ক।

ঘড়ির সবগুলো বাজনা শুনে যাচ্ছেন সারা, একটার পরে একটা। টং টং টং! কোয়ার্টারের বাজনা, হাফ-ওয়ারের বাজনা, তিন কোয়ার্টারের বাজনা, সবশেষে বাজনা পুরো ঘণ্টার। বারোটা, একটা, দুটো—

পৌনে আটটা বাজল অবশেষে। সকাল হয়েছে, পর্দার ফাঁকে ফাঁকে বাইরের আলো এসে উঁকি দিচ্ছে লাজুক শিশুর মতো। এইবার অ্যাগনেস আসবে। আটটা বাজলেই। রোজই আসে। আটটার অষ্টম টং যেই বেজে ওঠে ঘড়িতে, দরজাও খুলে যায় খুট করে পাশের ঘরে। ও-ঘরটা এই শয়নকক্ষেরই অংশ বলতে গেলে, ওই ঘরের ভিতর দিয়েই এ ঘরে আনাগোনার পথ।

বাজছে আটটা। শেষ হয়ে গেল বাজনা। এইবার খুলছে দরজা খুট করে। কই, না তো! খুলছে তো না! ছোট্ট সে আওয়াজটুকু হচ্ছে না তো খুট করে। এ হল কী? অ্যাগনেসের কি ঘুম ভাঙেনি? কেন ভাঙবে না? এতকাল ভেঙে গেল, আজই ভাঙবে না? যেদিন পা ভাঙল মনিবনীর, সেই দিনই? যেদিন অ্যাগনেসের প্রত্যাশায় ঘণ্টার পরে ঘণ্টা, মিনিটের পরে মিনিট গুনছেন মনিবনী, সেই দিনই? তাজ্জব!

শুধু তাজ্জব? হাজারো বার তাজ্জব। এখনও অ্যাগনেসের দেখা নেই, সওয়া আটটা বেজে গেল এদিকে। ধৈর্য আর রইল না। খাটের ছত্রি থেকেই ঘণ্টার দড়ি ঝুলছে, হাত তুলে তাতে টান দিলেন সারা। অ্যাগনেসের ঘরে ঘণ্টা বেজে উঠেছে এতক্ষণে, হতচ্ছাড়ির ঘুম এবারে আর না-ভেঙে যাবে কোথায়? ধড়মড়িয়ে উঠে এক্ষুনি ছুটে আসবে হন্তদন্ত হয়ে। অ্যায়সা বকুনি দিতে হবে একখানা—

কই? কেউ তো আসছে না হন্তদন্ত হয়ে? ঘণ্টাটা বেজেছে তো? কে বলবে তা? ও-মাথা পর্যন্ত তারটা ঠিক ঠিক বজায় আছে তো? না থাকবার কথা নয়, কিন্তু আজ যে সবই কেমন-কেমন হয়ে যাচ্ছে!

সাড়ে আটটা। কিছু একটা ঘটেছেই ওদিকে। অসুখ করল অ্যাগনেসের? করেও যদি থাকে, অ্যাগনেসের পাশের ঘরেই থাকে মেরি। সেও কি ঘণ্টার বাজনা শুনতে পাবে না? নাঃ, গুরুতর কিছু ঘটেছে। এই এতক্ষণে প্রথম মনে হল সারার, ডাক্তারের কথামতো কাল যদি একটা নার্স নিতেন তিনি, ভালোই হত তাতে। সে তো সারার কাছেই থাকত! অনায়াসে তাকে নীচে পাঠানো যেত সেখানকার হালচাল দেখে আসবার জন্য।

হয়নি নার্স নেওয়া। তার ফলে, অ্যাগনেসকে যদি ডাকতে হয়, স্বয়ং সারাকেই নীচে নামতে হবে। ডাক্তারকে কথা দেওয়া আছে, প্রাণান্তেও সারা শয্যা ছেড়ে উঠবেন না। কিন্তু এ-ব্যাপার যে সারার একান্ত প্রাণান্ত নয়! নীচের সবাইয়ের প্রাণ রাতারাতি অন্ত হয়ে গেল কিনা, কে বলবে? তেপান্তরের মাঠের ভিতর এই একখানি বাড়ি হোয়াইট গেটস, রাত্রি বেলা কোনো খুনে ঘাতক এসে যদি পাঁচটা ঝি-চাকরের গলা কেটে রেখে গিয়ে থাকে?

কেন কাটবে?

এ-প্রশ্ন মোটে প্রশ্নই নয়। আজকাল গলা-কাটা একটা শখের ব্যাপারে দাঁড়িয়েছে। হামেশাই এমন উন্মাদের কাহিনি কাগজে পড়া যায়, যারা বিনা কারণে, বিনা স্বার্থে, বিনা উদ্দেশ্যে খুনের পরে খুন করে যায় স্রেফ সময় কাটাবার জন্য। তেমন উন্মাদ কাল রাতে কেউ হোয়াইট গেটস-এ এসে পড়েইনি যে, কে তা জোর করে বলতে পারে?

খোঁজ নেওয়া একান্ত দরকার। বেল বাজিয়ে সাড়া পাওয়া যায়নি, এবারে টেলিফোন করে দেখা যাক। তাতেও যদি কাজ না-হয়, অগত্যা নেমে যেতেই হবে, উপায় নেই।

টেলিফোনে রান্নাঘর পাওয়া যাবে, একটা লাইন আছে ওখানে। কোনোরকমে ফোন ধরতে পারা দরকার এখন। তাহলেই বোধ হয় রহস্যের কিনারা হয়।

বেল ঝুলছিল খাটের কোণে, শুয়ে শুয়েই তা হাতে পাওয়া গিয়েছিল। ফোন পেতে হলে কিন্তু পাশের ঘরে যেতে হবে। কষ্ট? তার আর করা যাচ্ছে কী? নিরুপায় যখন।

অতিকষ্টে উঠে, এক পায়ে ভর করে দেয়াল ধরে ধরে, প্রায় পাঁচ মিনিট কাল যমযন্ত্রণা ভোগ করে অবশেষে সারা টেলিফোনের কাছে পৌঁছুতে পারলেন। যোগাযোগ করতে চাইলেন রান্নাঘরের সঙ্গে। কাকস্য পরিবেদনা! সাড়া নেই। ফোনের দশাও বেল-এর মতো।

ফোনটা ঠিক আছে তো? সারা ডায়াল করলেন এক্সচেঞ্জ। সাড়া নেই তবু। লাইন কাটা। খুনি ডাকাত যারা এসেছিস, ফোনের লাইন আগেভাগে কেটে দিয়েছে তারা। বেল-এর বেলায়ও অবশ্যই তাই। আটঘাট বেঁধে কাজ করেছে ওরা। সোজা লোক নয়।

সারা এখন করেন কী? কী করেন তিনি? কেমন করে খবরটা নেন যে নীচের অবস্থা কী? যদি খুনোখুনিই হয়ে থাকে, বাইরের দুনিয়ার সঙ্গেই বা যোগাযোগ করেন কেমন করে? এমন অনেক বাড়ি আছে, যেখানে দুধ, মাংস, রুটি, খবরের কাগজ জোগান দেওয়ার জন্য শহর থেকে লোক আসে রোজ। হোয়াইট গেটস-এ সে ব্যবস্থা নেই। রোজ সকালে খানসামা প্রাইস চলে যায় সাইকেল চেপে, নরিংটন থেকে নিয়ে আসে সব জিনিস। আজ কেউ যাবে না, যদি প্রাইস খুন হয়ে থাকে।

উঠলেন আবার সারা। একটা লাঠি ঝুলছে দেয়ালে। তাঁর স্বর্গীয় স্বামীর লাঠি। পেড়ে নিলেন ওটা। ভর দিয়ে হাঁটা যাবে। দেরাজে রিভলভার আছে স্বামীর। সেটাও বার করলেন। খুলে দেখলেন টোটা আছে কিনা। যত রকমের সম্ভব, তৈরি হয়ে নিলেন নীচে নামবার আগে।

এক-একটা ধাপ নামছেন সিঁড়ির, পায়ের ভিতর তপ্ত শূল যেন কেউ বিঁধিয়ে দিচ্ছে। তবু— তবু নেমে চলেছেন সারা, এক হাত দেয়াল ধরেছে, আর এক হাত লাঠি। রিভলভার? সেটা কোমরে গোঁজা।

একতলার প্রথম ঘরই অ্যাগনেসের। ঘরে ঢুকলেন সারা। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, লাশ পড়ে নেই, ঘরে রক্তের ঢেউ খেলছে না, খুনোখুনি যে হয়েছে, এমন চিহ্ন কিছু নেই। অধিকন্তু, বিছানা দেখে একথা মনে হয় না যে, তাতে রাত্রে কেউ শয়ন করেছিল।

পাশের ঘর মেরির, সে ঘরেরও ওই একই দশা।

রান্নাঘরটা অনেক দূরে। ভাঁড়ার ঘর, বারান্দা, চাকর-দাসীদের আরও তিনখানা ঘর— সব পেরিয়ে। অতখানি হেঁটে যাওয়া কি সম্ভব হবে সারার পক্ষে? ভাঙা পা নিয়ে? দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শক্তি আর সাহস সঞ্চার করার চেষ্টায় আছেন সারা, হঠাৎ একটা আওয়াজ কানে এল। অনেকের গলায় মিলিত আওয়াজ। ব্যাপার কী? খুনিরা কি এখনও বাড়ির ভিতরই রয়ে গেছে? ডাকের মাথায় অন্য লোক নেই, কর্ত্রী ভাঙা পা নিয়ে উপরে পড়ে আছেন শয্যাগত, এই সাহসে খুনিগুলো কি দিনের বেলাতেও আড্ডা দিচ্ছে এখানে?

আড্ডা? নিশ্চয়? আওয়াজটা গানের। তাও আবার বিদেশি কোনো ভাষার গান সেটা। কী অদ্ভুত সুর তার। কী বিটকেল গলাই বা গায়কদের। শুধু গায়কও নয়, আছে গায়িকাও। অভাবনীয়! দুর্বোধ্য!

ভয়ের চেয়ে এখন উত্তেজনা বেশি সারার মনে। পায়ের ব্যথার কথা আর তাঁর খেয়ালেই আসছে না। দেয়াল ধরে ধরে তিনি এগিয়ে চললেন রান্নাঘরের দিকে। গানটার আওয়াজ সেখান থেকেই আসছে, মনে হয়।

সারা দোরগোড়ায় গিয়ে দাঁড়িয়েছেন রান্নাঘরের। ডান হাতে রিভলভার, বাঁ-হাতে দরজা নিঃশব্দে ফাঁক করলেন একটু। আর সঙ্গেসঙ্গে তিনি যেন পাথরে মূর্তিতে পরিণত হয়ে গেলেন।

ঘরময় নীল আলো জ্বলছে মিটিমিটি। একটা পচা গন্ধ ভকভক করছে। কয়েকটা শূকর পড়ে আছে গলা কাটা। একটা গামলা রক্তে ভরতি। তার চারদিকে গোল হয়ে বসে ও দাঁড়িয়ে মানুষ গোটাকতক আর ছায়ামূর্তি আরও গোটাকতক।

মানুষগুলিকে চিনলেন সারা— তাঁরই লোকজন সব! অ্যাগনেস, মেরি, প্রাইস প্রভৃতি। ছায়ামূর্তিদের ভিতরেও একজনকে চিনলেন— সে কাল সন্ধ্যার সেই বুড়ি, যার সঙ্গে দেখা হওয়ার পরেই পা ভেঙেছিল সারার! কাল তাকে জ্যান্ত মানুষ মনে হয়েছিল, আজ সহজেই বোঝা যাচ্ছে পেতনি বলে। একদম স্বচ্ছ তাদের গায়ের ভিতর দিয়ে দৃষ্টি চলে যাচ্ছে পিছনের দেয়াল পর্যন্ত।

ছায়া ও কায়া— সবাই মিলে গান গাইছে সেই ভূতুড়ে ভাষায়, আর গামলা থেকে বাটি বাটি রক্ত তুলে ঢেলে দিচ্ছে গলায়। তারপর গানের সঙ্গে শুরু হল নাচ অশ্লীল, উদ্দাম, তাথৈ নৃত্য। কয়েক মুহূর্ত তা চোখে দেখার পরই সারার মনে হল, তাঁরও অন্তরতম অন্তরে একটা পিশাচী নড়ে-চড়ে জেগে উঠছে যেন। ভয় পেয়ে তিনি বুকের উপর ক্রশ আঁকতে গেলেন, হাতে যে রিভলভার রয়েছে, তা ভুলেই গিয়েছিলেন তিনি। রিভলভারটা সশব্দে মেঝেতে পড়ে গেল, আর সঙ্গেসঙ্গে তা থেকে বুলেট ছুটে বেরিয়ে বিদ্ধ করল সেই পেতনি বুড়িকে। সঙ্গেসঙ্গে একটা নারকীয় হুঙ্কারে গমগম করে উঠল বাড়িটা, আর বুড়ি পেতনিসমেত সবগুলো ছায়ামূর্তি চোখের পলকে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল।

রইল অ্যাগনেসেরা পাঁচজন শুধু। তারা যেন গভীর ঘুম থেকে জেগে উঠে ফ্যালফ্যাল করে চাইছে চারিদিকে। কিছুই যেন বুঝতে পারছে না, সারাকে পর্যন্ত তারা চিনতে পারছে না যেন।

সারা কীভাবে যে উপরে উঠে এলেন, তা তাঁর হুঁশ ছিল না কিছু।

হুঁশ হল নিজের ঘরে ঢুকবার পর। তারপরই তিনি প্রার্থনায় বসলেন।

সারাদিন মেঝেতে বসে ভগবানকে ডাকলেন সারা, এই প্রেতসংস্পর্শ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য।

অবাক কাণ্ড, প্রার্থনা সেরে বিকাল নাগাদ তিনি উঠে দাঁড়ালেন যখন, ভাঙা পা জোড়া লেগে গিয়েছে তাঁর, তাতে আর লেশমাত্র ব্যথা নেই। খিদে বেশ হয়েছিল। ছোটো টেবিলটার উপরে স্যান্ডউইচের ট্রে তখনও রয়েছে, সেই স্যান্ডউইচ দিয়েই জঠরজ্বালার নিবৃত্তি হল সারার। আগে থাকতে এই খাবার গুছিয়ে রেখে যাওয়াতেই প্রমাণ হল যে রাত্রে যা-কিছু হয়েছে, তা অতর্কিতে হঠাৎ হয়নি, অ্যাগনেসেরা আগে থাকতে সবই জানত।

রাত্রি এল আবার নিঝুম নিস্তব্ধ পুরী। সারার খুবই ভয় করছে আবার। বিছানায় কম্বল মুড়ি দিয়ে ভগবান স্মরণ করছেন, ‘রক্ষা করো! রক্ষা করো প্রভু!’

ভয় সত্ত্বেও শেষ রাতে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন সারা, ঘুম যখন ভাঙল, অ্যাগনেস তখন ঢুকে পড়েছে ঘরে। ঘড়িতে ওই আটটা বাজছে, বেজে শেষ হয়নি এখনও। ঠিক আটটাতেই তো ও আসে রোজ!

‘সুপ্রভাত মাদাম।’ মোলায়েম সুরে বলছে অ্যাগনেস, ‘পায়ের ব্যথা কি একটু কম মনে হয়? কাল যা বলে গেলেন ডাক্তার— নড়া-চড়া না-করবার কথা, আশা করি আপনাকে উঠতে হয়নি একবারও?’

‘ডাক্তার কাল বলে গেলেন, না পরশু?’ মাদামের কথা তীক্ষ্ন ও তিক্ত।

‘পরশু? সে কী কথা মাদাম? ডাক্তার তো কাল সন্ধ্যায়—’ অ্যাগনেস এমনভাবে মনিবনীর পানে চাইছে, যেন সে পাগল ঠাউরেছে তাঁকে।

‘কাল সন্ধ্যায়?’ ব্যঙ্গের সুরে কথা কইছেন সারা, ‘কাল সারাদিন কী কষ্টেই যে কেটেছে আমার!’ হঠাৎ তিনি নিজেকে সংযত করে নিলেন, শুধু বললেন, ‘কাল কী পরশু, তা ডাক্তার এলে তাঁর কাছেই শুনতে পাবে—’

‘ডাক্তার তো আসতে পারবেন না আজ।’ মৃদুকণ্ঠে জবাব দিল অ্যাগনেস, ‘একটু আগেই তিনি ফোন করেছিলেন—’

‘ফোন? ফোন কি আবার চালু হয়েছে নাকি? কাল তো ফোনও ছিল না। বেলও বাজেনি—’

‘আপনার, মানে অপরাধ যদি না নেন তো বলি, সবই আপনার ভুল মাদাম! ফোনও চালু, বেলও চালু, রাত্রে দুঃস্বপ্ন দেখেছেন— আর কী!’

এবার একেবারে গুম হয়ে গেলেন সারা। উঠে বসলেন, উঠে দাঁড়ালেন।

‘আ হা হা, উঠবেন না মাদাম, উঠবেন না দয়া করে! ডাক্তার যা বলে গিয়েছেন—’

‘তা বটে, ডাক্তার যখন নিষেধ করেছেন, উঠবই না।’ একেবারে সুশীলা বালিকার মতো দাসীর কথা শিরোধার্য করে বিছানায় আবার বসে পড়লেন সারা। ‘তুমি যাও, প্রাতরাশ নিয়ে এসো এখানেই। খিদে পেয়েছে—’

‘তা আনছি, কিন্তু উঠবেন না মাদাম, তোহাই আপনার—’

অ্যাগনেস বেরিয়ে গেল, আর সঙ্গে সঙ্গেই সারা উঠে গিয়ে বসলেন ফোনের কাছে। সত্যিই তো ফোন চালু হয়েছে আবার! ডাক্তারকে ডাকামাত্র সাড়া পাওয়া গেল।

‘সুপ্রভাত, আপনি ফোন করেছিলেন নাকি?’ বললেন সারা।

‘আমি? সে কী?’ ডাক্তার আকাশ থেকে পড়লেন যেন, ‘বরং আপনার ওখান থেকেই আপনার দাসী ফোন করল এই বলে যে, আপনি ভালো আছেন, আজ আর আমার আসার দরকার নেই।’

‘ব-টে!’ দেখুন ডাক্তার, একটা দারুণ গোলমাল হয়েছে। আমি সাক্ষাতে বলব সব। আজ বা কাল আমি দেখা করছি আপনার ওখানে গিয়ে। ভালো কথা, আপনি বলুন তো, আমাকে আপনি দেখতে এসেছিলেন কাল সন্ধ্যায়? না, পরশু?’

‘এ সব কী প্রশ্ন, এ্যাঁ?’ ডাক্তার ককিয়ে উঠলেন, ‘ভেঙেছে পা, তাতে মাথা গোলমাল হবে কেন? আমি পরশু গিয়েছিলাম। কাল নয়, পরশু।’

‘ধন্যবাদ।’ বলে ফোন ছেড়ে দিলেন সারা। তারপর আবার ডায়াল করলেন, এবার নিউইয়র্কে ইবার্ট ভাইকে।

ইবার্টকে যা বললেন, তার ফলে ইবার্ট বিকাল নাগাদ সশরীরে এসে পড়লেন দু-খানা ট্রাক আর একখানা গাড়ি নিয়ে। পাঁচটি চাকর-দাসীর তো চক্ষুস্থির! তাদের তিন মাসের মাইনে আগাম দিয়ে চাকরি থেকে ছাড়িয়ে দেওয়া হল সঙ্গেসঙ্গে।

খুব বেশি দরকারি জিনিসগুলো ট্রাকে চাপিয়ে দিয়ে সারা গাড়িতে উঠে বসলেন ইবার্টের পাশে। স্বামীর ভিটের মায়া তাঁকে কাটাতে হল প্রাণের মায়ায়। তিনি নিউইয়র্কে ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েই বাস করবেন। হোয়াইট গেটস বিক্রি হবে।

ইবার্ট ব্যাপারখানা শুনলেন ও বুঝলেন। সারাকে যা বললেন, তা হল এই, সেদিন তারিখ ছিল ১ নভেম্বর, ‘অল সোলস ডে’। সব প্রেতাত্মা সেদিন পৃথিবীতে চলে আসে স্বর্গ বা নরক থেকে। স্বর্গ থেকে যারা আসে, তারা মানুষের ভালোর চেষ্টা করে নানাভাবে। আর নারকীরা করে পৃথিবীর মাটিতে নারকীয় মজলিশ। সে মজলিশের নাম কোভেন। এই কোভেনে যোগ দেওয়ার জন্য তারা জ্যান্ত মানুষকেও প্রলুব্ধ করে বিভিন্ন উপায়ে। বলা বাহুল্য সে-প্রলোভনে যারা মজে, পরিণামে নরকবাসই ঘটে তাদের ভাগ্যে।

ওই বুড়িটা ছিল নরকের প্রেত। অ্যাগনেসদের সমুখে নরকের দরজা খুলে দেবার জন্যই তার আবির্ভাব ঘটেছিল হোয়াইট গেটস-এ। আর তার সঙ্গে চোখাচোখি হওয়ার ফলে সঙ্গে সঙ্গেই পড়ে গিয়ে পা ভেঙেছিলেন সারা ক্লেবার্ন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *