বিলিতি বিয়ার-পাব
বিয়ার-পাব মানে বিয়ার পানশালা। পাবলিক হাউস সংক্ষিপ্ত হয়ে হয়েছে পাব, ইংরেজিতে লেখা হয় pub।
পাব একান্তই বিলিতি ব্যাপার, ইংল্যান্ড দেশীয় কিংবা আরও গুটিয়ে এনে বলা যায় লন্ডন নগরীয়। মার্কিন দেশে ক্কচিৎ-কদাচিৎ দুয়েকটা বিয়ার-পাব দেখা যে যায় না তা নয় তবে সেগুলো প্রধান পানশালা নয়। আমাদের দেশে, কাছাকাছির মধ্যে ব্যাঙ্কক, হংকং, সিঙ্গাপুর ইত্যাদি মহানগরেও দুয়েকটা ইতস্তত বিয়ার-পাব দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু লন্ডনের বিয়ার-পাবের চরিত্র সেগুলোর মধ্যে নেই।
আগে এই কলকাতা শহরের পাড়ায় পাড়ায় এবং মফস্বল শহরেও চায়ের স্টল ছিল। দক্ষিণ কলকাতায় সুতৃপ্তি, বনফুল, বিজলি গ্রিল ইত্যাদি চরিত্রবান সব রেস্তোরাঁ ছিল। সেগুলোর চেহারা, মালিক, খদ্দের, আড্ডার প্রকৃতি সবই বিশিষ্ট ছিল। একটা ঘরোয়া প্রকৃতি ছিল ওই দোকানগুলোর, একটা স্থানীয় চেহারা। স্বতন্ত্র চরিত্র।
দুঃখের বিষয় আমাদের যৌবনকালে এবং তারও বহু আগের পিতৃ-পিতৃব্যদের আমল থেকে এই যে বিশিষ্ট চায়ের দোকানগুলো ছিল এগুলো আজকাল আর নেই বললেই চলে। সবই প্রায় উঠে গেছে।
ব্রিটিশ পাব কিন্তু এখনও আছে, সেই রমরমা নেই, বহাল তবিয়তে না হলেও আছে। একেক পাড়া বা এলাকায় একটি কি দুটি নির্দিষ্ট পাব। তাদের খদ্দেররা বহু বহুকালের পুরনো। তাদের রুচি, মর্জি সবই পাব মালিকের নখদর্পণে, তাদের ব্যক্তিগত জীবন, সুখ-দুঃখ সবই পাব মালিক জানে। পাব হল কিছুটা ক্লাব, কিছুটা আড্ডা, কিছুটা বৈঠকখানা—পুরো ইংরেজিয়ানা, এর কোনও বিকল্প নেই। যেমন বিকল্প ছিল না আমাদের সুতৃপ্তি রেস্তোরাঁর কিংবা বসন্ত কেবিনের।
সে যা হোক, সম্প্রতি বিয়ার-পাবের কথা উঠেছে অন্য এক অকল্পনীয় দিক থেকে।
গ্রেট ট্রেন রবারির কথা মনে আছে? ও রকম দুঃসাহসিক ট্রেন ডাকাতি এর আগে আর হয়নি।
প্রায় চল্লিশ বছর আগের কথা। উনিশশো তেষট্টি সালের এক রাতে গ্লাসগো থেকে লন্ডন যাচ্ছিল নাইট মেল ট্রেন। সেই ট্রেনে ডাকাতি হল সরকারি টাকা পঁচিশ লক্ষ পাউন্ড। এখন বোঝা যাবে না, কিন্তু আজকের হিসেব অনুযায়ী এ ছিল বিরাট টাকার অঙ্ক।
এই ট্রেন ডাকাতি নিয়ে অত্যন্ত জনপ্রিয় সব সিনেমা হয়েছিল, লন্ডনে ও হলিউডে। আমাদের বলিউডেও অনেক পরে এই জাতীয় একটা ছবি হয়েছিল।
এই ট্রেন ডাকাতির পান্ডা, যাকে নায়ক করে এই সিনেমাগুলো করা হয়েছিল, সেই রনি বিগস ছিলেন যে কোনও কলকাতাইয়ার মতোই লন্ডনিয়া। ধীরে সুস্থে পাড়ার পাবের শীতল অভ্যন্তরে প্রাচীন অগ্নিকুণ্ডের উষ্ণতায় সফেন বিয়ার মগে চুমুক দিতে দিতে এই ব্যক্তি ডাকাতির ছক কষেছিলেন।
সে ছক ব্যর্থ হয়নি। ডাকাতির বিপুল অর্থ করতলগত করে তিনি দক্ষিণ আমেরিকায় চলে যান, সেখানে ব্রাজিল দেশে বসবাস করেন রনি বিগস। কারণ সেখানে তিনি নিরাপদ, ব্রিটিশ সরকারের কোনও আবেদন বা নির্দেশের কোনও পাত্তা দেওয়া হয় না ব্রাজিলে।
রাজার হালে ব্রাজিলে জীবনযাপন করেছেন শ্রীযুক্ত রনি বিগস। কিন্তু এখন তিনি ক্লান্ত।
ব্রিটিশ প্রশাসন হাজার চেষ্টা করেও যাকে ধরতে পারেনি, যার কেশ স্পর্শ করতে পারেনি সেই রনি বিগস বলছেন, লন্ডনে ফিরে যেতে চাই।
সংবাদপত্রের লোকেরা জানতে চেয়েছে, ‘ব্রাজিলে তো চমৎকার আছেন। আবার লন্ডনে ফিরে কী করবেন? সেখানে আপনি যাওয়া মাত্র আপনাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে।’
শ্রীযুক্ত বিগস বলেছেন, ‘তা যাই হোক, আমি লন্ডন ফিরতে চাই।’ শুধু একবার, মৃত্যুর আগে শুধু শেষবার লন্ডনে তাঁর প্রিয়তম পাবে বসে এক গেলাস বিয়ার—এই তাঁর শেষ বাসনা।
শেষ সংবাদ এই যে তিনি লন্ডনে ফিরে গেছেন এবং পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন। পুলিশ তাঁকে শেষ পর্যন্ত বিয়ার-পাবে যেতে দেবে কি না, এখনই বলা কঠিন।