বিলাসখানি

বিলাসখানি

জাপানের ডঃ হানেদা সােমাটুমাে বক্তৃতা দিতে উঠলেন। বাইরে তখন বরফ পড়ছে। নিউইয়র্কের সেন্ট্রালি হিটেড এই কনফারেন্স হলে হর্স সু গ্যালারির একদম সামনের সারিতে বসে রাশিয়ার ডঃ পেশকভ, তার ডানদিকে ফ্রান্সের ডঃ মারিও দাঁতাে। তিনি চোখের চশমা খুলে ডান চোখের ওপর মােটা দ্রু একবার চুলকে নিলেন। তারপর এক গ্লাস জল খেয়ে কানে হেডফোন লাগালেন। সঙ্গে সঙ্গে ডঃ হানেদা সােমাটুমাের জাপানি বক্তৃতা ফরাসি হয়ে ডঃ মারিও দাঁতাের কানে গলগল করে ঢুকতে লাগল।

ডঃ দাঁতাের ঠিক পিছনের গ্যালারিতে বসেছেন ব্রাজিলের ডঃ ফিয়েদেল মারকেজ। তার কানেও একই জাপানি বক্তৃতা স্প্যানিশ হয়ে ঢুকে যাচ্ছিল। এমনই একটি ইন্টারন্যাশনাল কংগ্রেস যেখানে উঠতে বসতে ডক্টরেট। সেই একই জাপানি বক্তৃতা বাংলাদেশের ডঃ রিয়াজ আহমেদ পরিষ্কার বাংলায় শুনতে পাচ্ছেন। বাংলাদেশ হবার পর থেকে ইংরেজি, ফরাসি, স্প্যানিশ, রুশ ভাষার সঙ্গে সঙ্গে বাংলা ভাষাও এখন আন্তর্জাতিক। যেকোনও আন্তর্জাতিক কংগ্রেস, কনফারেন্স, সেমিনারে ওই সব ভাষার পাশাপাশি যেকোনও ভাষার বক্তৃতা, ভাষণ, রিপাের্ট পলকে বাংলায় করে ফেলার ব্যবস্থা থাকে।

ডঃ রিয়াজ আহমেদ ফরিদপুর জেলা স্কুল থেকে পাশ করে ঢাকার জগন্নাথ কলেজের অনার্স গ্র্যাজুয়েট। জিওলজিতে। তার পর ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে এম এস সি। পি এইচ ডি কালিফোর্নিয়ার বার্কলে ক্যামপাস থেকে। ডঃ রিয়াজ আহমেদের কানে ডঃ হানেদা সােমাটুমাের জাপানি বক্তৃতার বাংলা তর্জমা করকর করে ঢুকে যাচ্ছে। অনেকটা এরকম—

জাপানে আমরা গােরু শুয়ােরের খাবার জোগাড় করিতে ইন্দোনেশিয়ার নিকট হইতে সুমাত্রা দ্বীপের প্রধান নদীর অববাহিকায় সমগ্র উপত্যকারই পঞ্চাশ বছরের জন্য ইজারা লইয়াছি। সেখানে ভুট্টা ফলাইয়া জাহাজে করিয়া তাহা জাপানে লইয়া আসি। সেই ভুট্টা খাইয়া আমাদের গােরু শুয়াের বড়াে হয়। বড়াে হইলে আমরা জাপানিরা তাহাদের খাইয়া বাঁচিয়া থাকি।

বাংলাদেশের ডঃ রিয়াজ আহমেদ জাপানি থেকে বাংলায় তর্জমার বহর দেখে ভেতরে ভেতরে তাে হেসেই অস্থির। কিন্তু ইন্টারন্যাশনাল কপার কংগ্রেস বলে কথা! যাকে বলে আন্তর্জাতিক তা সম্মেলন। হাসি গিলে তিনি শুনতে লাগলেন।

আমাদের লােহা নাই। ভারত হইতে লােহা আনিয়া ইস্পাত বানাইতে হয়। সেই জন্য আমরা ভারতের বইলাডিলা খনিতে নিজেদের উদ্যোগে রেললাইন, বন্দর—সবই বসাইয়াছি। তেমনি আমাদের তামা নাই। কিন্তু তামার অভাবে আমাদের বয়লারগুলি তাে বসিয়া থাকিতে পারে না। তামা নাই বলিয়া আমাদের টোকিও মেট্রো তাে অচল হইয়া পড়িয়া থাকিতে পারে না। তাই আফ্রিকার কঙ্গো নদীর অববাহিকায় আমরাই নতুন নতুন খনি খুঁজিয়া বাহির করিয়া দিতেছি।

ডঃ রিয়াজ আহমেদ তার নিজের কান থেকে হেডফোন নামিয়ে নিয়ে ডঃ হানেদা সােমাটুমাের মুখে তাকালেন। কোনও জাপানির মুখ দেখে বােঝার উপায় নেই—মনে কী আছে। ইন্দোনেশিয়ার মাঠে ভুট্টা চাষ। ভারতের খনি থেকে লােহা। কঙ্গো নদীর উপত্যকায় তামা খুঁজে বের করা। এটা না হলে জাপানি।।

হেডফোন ছাড়াই জাপানি তামা এক্সপার্টের ঠোট নাড়া দেখতে দেখতে ডঃ রিয়াজ আহমেদের ঘুম এসে গেল। বাইরে এখন শেষ ডিসেম্বরের এই দুপুরে অন্ধকার হয়ে আসা আকাশ থেকে নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কোয়ার, গ্রিনউইচ ভিলেজ, সেন্ট্রাল পার্কের মাথায় বিস্কুটের টিনের কাগজের ফালির মতােই বরফের চোকলা পড়ছে তাে পড়ছেই। ভিজে রাস্তায় রাস্তায় কোটের ওপর রেনকোট চাপানাে মানুষজনের ছােটাছুটি। সেন্ট্রালি হিটেড কনফারেন্স হলের ভেতরটা রীতিমতাে আরামের। ঘুমের ভেতর ডঃ রিয়াজ আহমেদের নাক ডাকতে শুরু করেছিল প্রায়।

ঠিক এমন সময় তামা নিয়ে চোস্ত ইংরেজিতে কিছু ধারালাে ধারালাে শব্দ খচাখচ ডঃ রিয়াজ আহমেদের কানে এসে ঢুকতে লাগল। তিনি চোখ চেয়ে দেখেন—আর কেউ নয়—তাঁরই খুব চেনা-জানা একজন পােডিয়ামে দাঁড়িয়ে। তার মুখ দিয়ে তামার কথা জলের মতাে ইংরেজিতে বেরিয়ে আসছে। ডঃ রিয়াজ আহমেদের মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল—আরে ! নীলুদা যে—। তিনি হেডফোনটা নিজের মাথায় চেপে বসিয়ে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে ডঃ নীলমাধব সেনের ইংরেজি বক্তৃতা বাংলা হয়ে ডঃ রিয়াজ আহমেদের কানে ঢুকতে লাগল।

আমাদের মগজ বিশাল এক স্মৃতিভাণ্ডার। এই পৃথিবীও তার নিজেরই স্মৃতিভাণ্ডার। তবে সেই স্মৃতি এক জমাট ভাণ্ডার। পৃথিবী একসময় তারকা হইতে বিচ্যুত জলন্ত গলন্ত ধাতুপিণ্ড ছিল। যতই সে জুড়াইয়া আসিয়াছে ততই সে জমাট হইয়াছে। সেই সব গলন্ত ধাতুগুলি এখন সব জমাট ধাতু। সেখানে লােহা, তামা, দস্তা, নিকেল সব একাকার হইয়া আছে। পৃথিবীর কেন্দ্রে যতই আমরা যাইব ততই দেখিব—সে এখনও জ্বলন্ত-গলন্ত। সেখানে পৃথিবীর কেন্দ্রে তার স্মৃতি এখনও জাগ্রত। যেমন কি না আমাদের মগজ। তাহা কখনও জমাট বাঁধে না।

ডঃ নীলমাধব সেনের শেষের কথাটি স্টোনচিপের একটি ধারালাে টুকরাে হয়ে ডঃ রিয়াজ আহমেদের মাথার ভেতরে নরম থলথলে ঘিলুতে গিয়ে বিধে গেল। মগজ কখনও জমাট বাঁধে না। রিয়াজের ইচ্ছা হল, নীলুদার কথার শেষে সে আর কয়েকটি লাইন জুড়ে দেয়—

মগজ তামা নহে। মগজ দস্তা নহে। পৃথিবীর পিঠে আমাদের ভার রাখিতে তাহার একদা জাগ্রত স্মৃতি লােহা, তামাকে জুড়াইয়া গিয়া জমাট, শক্ত হইতে হয়। তাহাই পৃথিবীর স্মৃতি।

কলকাতায় নিজের ফ্ল্যাটে নীলুদাই একবার কথায় কথায় তাকে বলেছিলেন, মানুষের মগজ তার অভিজ্ঞতার সাজানাে পাঠাগার। বুঝলে রিয়াজ—সেই সাজানাে লাইব্রেরি থেকে আমরা দরকারমতাে অভিজ্ঞতার এক-একখানি বই বের করে নিই। বের করে দেখে নিয়ে নতুন কাজে বা অভিজ্ঞতায় নামি।

সাধারণ কথা এমন করে বলেন মানুষটি যা কিনা মনে গিয়ে বিঁধে যায়। ডঃ নীলমাধব সেন পােডিয়ামে দাঁড়িয়ে ঝরঝরে ইংরেজিতে আরও কী বলে যাচ্ছেন। ডঃ রিয়াজ আহমেদের সামনে ফরাসি প্রতিনিধি ডঃ মারিও দাঁতাে ঝুঁকে পড়ে নীলুদাকে শুনছেন।

ডঃ নীলমাধব সেনের বক্তৃতায় বার বার দুটি নদীর নাম আসছে। কঙ্গো। রংপাে। কঙ্গো আফ্রিকায়। রংপাে সিকিমে। ওখানেই পাহাড়ের নীচে ইন্ডিয়ার তামার সব চেয়ে বড়াে রিজার্ভ। নীলুদা সরকারি খনি বিভাগের হয়ে ওখানেই প্রথম প্রসপেক্ৰটিং করেছিলেন। চাকরির একেবারে গােড়ার দিকে। সে রিপাের্ট রিয়াজ লাইব্রেরি থেকে নিয়ে পড়েছেন। বছর দশেক আগে সার্ক এক্সচেঞ্জ প্রােগ্রামে ঢাকা থেকে তিনি কলকাতায় এলে ডঃ নীলমাধব সেন তাঁকে নিজের ফ্ল্যাটে খাবার নেমন্তন্ন করে নিয়ে গিয়েছিলেন। চমৎকার পণ্ডিত মানুষ। একেবারে উঁচু থাকের সরকারি অফিসার। মিসেস সেন যেমন সুন্দর রাঁধেন—তেমনি সুন্দর গান করেন।

ডঃ নীলমাধব সেনের মুখের কথা হঠাৎ আটকে গেল। আন্তর্জাতিক তামা কংগ্রেসের নানান দেশের প্রতিনিধিরা নীলমাধবের মুখের দিকে একদম মুখিয়ে তাকিয়ে আছেন। সবাই খুব মন দিয়ে শুনছেন। ডঃ রিয়াজ আহমেদ মনে মনে বললেন, এ সব কংগ্রেসে টাইপ করা কাগজ দেখেই পড়া উচিত। অবশ্য নীলমাধবের মতাে মানুষেরা এক্সটেমপােয়ই বলে থাকেন। সারা কংগ্রেস নিশূপ। প্রায় মিনিটখানেক পরে নীলমাধবের মুখ থেকে বার বার কয়েকটি কথা বােমার মতাে ছুটে বেরিয়ে এল। টিটিকাকা লেকস ফোর্টিন থাউজান্ড ফিটস অ্যাবভ দ্য সি লেভেল ইন দি আন্ডিজ মাউনটেইনস অব পেরু

কথাগুলাে কোথায় যেন নীলমাধবের স্মৃতির ভেতর শক্ত বাঁধে আটকে গিয়েছিল। কথাগুলাে বেরিয়ে যেতেই নীলমাধব একদম চুপ। রিয়াজ দেখলেন—পােডিয়ামে দাঁড়ানাে মানুষটির চোখদুটি পলক না ফেলে স্থির হয়ে গেছে। তামা নিয়ে যারাই কাজ করেছেন—তারা সবাই জানেন—পেরুর আন্ডিজ পর্বতমালার প্রায় মাথায় মাথায় বিশাল টিটিকাকা হ্রদ। সেখানেই পাহাড়ের ভেতর পৃথিবীর তামার বড়াে রিজার্ভ। এর পর নীলুদা নিশ্চয় ব্রাজিলের তামার রিজার্ভের কথায় আসবেন। কংগ্রেসে সবাই তাই আশা করছেন। কিন্তু ডঃ নীলমাধব একদম চুপ। আবার তার ভেতরের কথাগুলাে ভেতরেই কোনাে শক্ত বাঁধে আটকে গেছে। বেরােতে পারছে না।

কী ব্যাপার? শুধু ডঃ রিয়াজ নন—অনেকেই জানেন, তামার ব্যাপারে ডঃ নীলমাধব পেরু, ব্রাজিল ছাড়াও সাউথ আমেরিকার আরও কয়েকটি দেশে গিয়েছেন—ঘুরেছেন। সরকারই পাঠিয়েছে তাকে। এ ব্যাপারে তার পেপার্সও পড়েছেন রিয়াজ। পড়তে হয়েছে তাঁকে। কেননা, এশিয়ার প্রায় দেশেই তামা নেই। তামা ছাড়া বয়লার অচল। তামা ছাড়া কেল হয় না। ডিফেন্সে কামানের গােলায়—কার্তুজে তামা চাই-ই চাই।

রুশবিজ্ঞানী ডঃ পেশকভ নিশ্ৰুপ নীলমাধবের মুখে তাকিয়ে উশখুশ করে উঠলেন। সারাটা হলঘরে কোনও শব্দ নেই। এ অস্বস্তি যেন ডঃ রিয়াজের নিজের। অথচ নীলুদা তাে ইন্ডিয়ার ডেলিগেট। রিয়াজ বাংলাদেশের। বহু বছর পরে এবার নিউইয়র্কে বরফ পড়ছে। তার ভেতরেই রাস্তায় রাস্তায় মানুষের বড়ােদিনের ভিড়—আনন্দ। দু-একটা ট্রলি বাসও সেজেছে। কংগ্রেস হলে ঢােকার মুখে একজন গাঁট্টাগোট্টা নিগ্রো ব্যাঞ্জো বাজিয়ে গাইছে। যে যা পারে তার সামনে ফেলে রাখা বিরাট একটা সামুদ্রিক ঝিনুকে ফেলে দিয়ে যাচ্ছে।

হঠাৎ ডঃ নীলমাধব সেন পােডিয়াম থেকে নেমে পড়লেন। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই ডঃ নীলমাধব হনহন করে কনফারেন্স হল থেকে বেরিয়ে | গেলেন। তাঁর সামনে কাচের দরজা আপনাআপনি খুলে গেল। বেরিয়ে যেতেই কাচের দরজা আপনাআপনি বন্ধ হয়ে গেল।

ডঃ রিয়াজ আহমেদ ছুটতে ছুটতে বেরিয়ে এলেন। বেরিয়েই ক্লোকরুমে টাঙানাে নিজের রেনকোটটি কোনও রকমে গায়ে চাপিয়ে রাস্তায় নামলেন। কোথায় ডঃ নীলমাধব !

চারদিকে শুধু মানুষের মাথা। বড়ােদিনের ফুর্তিতে এই বরফ-ভেজা রাস্তাতেও মানুষের কোনও কমতি নেই। ডিপার্টমেন্টাল স্টোরসের কাচের উইন্ডােগুলাে আলােয় আলাে। কোনও কোনও শাে-উইন্ডাের ভেতর প্রমাণ সাইজের সান্টাক্লজ হাসিমুখে বসে। অন্ধকার হয়ে আসা রাস্তায় এখন তিনি কোত্থেকে ড. নীলমাধবকে খুঁজে বের করবেন? কেন যে হঠাৎ বেরিয়ে পড়লেন নীলমাধব তা বুঝে উঠতে পারছেন না ডঃ রিয়াজ। কেনই-বা বলতে বলতে নীলুদা হঠাৎ অমন চুপ করে যাচ্ছিলেন ? আশ্চর্য! কেমন ভূতে পাওয়া মানুষের মতাে হলঘরের ডেলিগেটদের সামনে হনহন করে বেরিয়ে গেলেন। কিছুই মেলাতে পারছেন না রিয়াজ। তিনি আবার কনফারেন্স হলে ফিরে আসছিলেন।

হঠাৎ দেখেন—ডঃ নীলমাধব সেন প্রায় পঞ্চাশ ফুট দূরে রেনকোট গায়ে চাপিয়ে একটি লাইনে দাঁড়িয়ে। মাথায় টুপি। লাইনটা একটু একটু করে একটি দোকানঘরে ঢুকছে। কয়েকজনের পিছনে দাঁড়ানাে নীলমাধবও সেইমতাে এগােচ্ছেন।

ডঃ রিয়াজ আহমেদ ছুটতে ছুটতে এগিয়ে এলেন। কী ব্যাপার? ডঃ সেন? কোথায় যাচ্ছেন?

সবাই যেখানে যায়—বলে নীলমাধব রিয়াজের মুখে তাকালেন। টুপির কার্নিশের নীচে চোখদুটিতে কোনও পলক পড়ল না নীলমাধবের। যেন খানিক আগেও রিয়াজের সঙ্গে তার কথা হয়েছে।

আপনি এ লাইনে দাঁড়িয়ে কী করছেন? জেরক্স করাব।—বলে নীলমাধব তাঁর ডান হাতে ভঁজ করা একখানি কাগজ মেলে ধরলেন। রিয়াজের চোখের সামনে। একখানি দশ ডলারের নােট।

নােটটা হাতের মুঠোয় ফের ভাঁজ করে ডঃ নীলমাধব বললেন, হাতে পয়সা কমে এসেছে তাে। তাই দশ কপি এখনকার মতাে জেরক্স করিয়ে নিচ্ছি। পয়সা কমে গেলে আবার করিয়ে নেব।

ডঃ রিয়াজ রীতিমতাে অবাক। এ কোন নীলুদা কথা বলছেন? কথাগুলাে এলােমেলাে। ডলারের নােট জেরক্স করিয়ে চালাতে গেলে তাে জেল হবে শেষে। কিন্তু এটা তাে জেরক্স শপ নয়। এখানে দেখছি কমিউনিটি ওয়েলফেয়ার কুপন দেওয়া হচ্ছে। যাতে লম্বা ডিসকাউন্টে জিনিসপত্র কেনা যায় বড়দিনের সময়।

ডঃ নীলমাধব অস্থির হয়ে পড়লেন। তা হলে? এখন ডলার পাবাে কোথায় ?

হাসতে হাসতে রিয়াজ বললেন, সামনে বড়ােদিন। এখন তাে কোনও জেরক্স শপ খােলা পাবেন না। আসুন। আমার সঙ্গে আসুন।

বলেও ভেতরে ভেতরে ঘাবড়ে গেলেন রিয়াজ। নীলুদা কয়েক মিনিট আগে ইন্টারন্যাশনাল কপার কনফারেন্সে পেরুর টিটিকাকা হ্রদে ছিলেন। আন্ডিজ পর্বতমালার মাথায় মাথায়—সমুদ্র থেকে চোদ্দো হাজার ফুট উঁচুতে। আর এখন হাতে পয়সা কমে যাওয়ায় দশ ডলারের নােট জেরক্স করতে লাইন দিয়েছেন? কিছুই মেলাতে পারছেন না রিয়াজ। হল কী ডঃ সেনের ? একটা কাজের সঙ্গে মানুষটির আরেকটি কাজের তাে কোনও যােগ নেই। ফুল অব ইররেলিভ্যালেন্সি! বক্তৃতা দিতে দিতে বেরিয়ে আসা। মাথাটি ঠিক আছে তাে? মগজ? মানুষের নানান অভিজ্ঞতার সাজানাে পাঠাগার ? স্মৃতিভাণ্ডার। এই খানিক আগেই তাে নীলুদা এসব কথা বলছিলেন। ওই পাঠাগার থেকেই তাে এক-একখানি বই বের করে নিয়ে আমরা নতুন কাজে, অভিজ্ঞতায় নামি। ওখান থেকেই গাইডেন্স পাই। সেই মতাে কাজ করি।

নিউইয়র্কের ভিজে রাস্তায় সন্ধেবেলার আলােয়—তুষারে ডঃ রিয়াজ আহমেদের পাশাপাশি ডঃ নীলমাধব সেন হাঁটছেন। রিয়াজ দেখলেন, পাঁচ-ছ বছর আগে কলকাতায় শেষ দেখা হওয়ার পর ডঃ সেন অনেকটা পালটে গেছেন। সামনের দিকে ঝুঁকে হাঁটছেন। হাঁটার সময় হাত দুখানি কতটা দুলবে তা যেন বুঝতে পারছেন না।

রিটায়ার করেছেন তাে? | সে তাে তিন বছর আগে। তবে এখনও কনফারেন্স, কংগ্রেসে আমায় ডেকে পাঠায়—বাইরে হলে প্লেনের টিকিট হাতে ধরিয়ে দেয়। ডেলিগেশনে যাই।

রিয়াজ দেখলেন, এই তাে বেশ পরিষ্কার কথাবার্তা বলছেন নীলুদা। বেলা বউদি কেমন আছেন? বেলার শরীরটাই ভালাে নেই। গান গাইছেন বউদি? হা। বাড়িতেই তাে গানের তালিম দেয়। দশ-বারােটি স্টুডেন্ট। রিয়াজ অবাক। এই মানুষই একটু আগে দশ ডলারের নােট জেরক্স করবেন বলে লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন? এখন তাে দিব্যি নরমাল কথাবার্তা বলছেন!

সেবারে আমায় খুব যত্ন করে খাইয়েছিলেন বউদি।

একথায় হাসলেন ডঃ সেন। রিয়াজ দেখলেন নীলমাধব এই ক-বছরে সামান্য কুঁজো হয়ে গেছেন। কঁাধ আগের মতােই চওড়া। মুখের ভেতর চোখদুটি উজ্জ্বল। পা কিছু এলােমেলাে পড়ছে। কলকাতায় লেকরে এই মানুষটিই তাঁর সেলার খুলে সেবারে রিয়াজকে সিনজানাে ওয়াইন ঢেলে দিয়েছিলেন সুন্দর কাচের গ্লাসে।

নন্দার বিয়ে দিয়েছেন?

চার বছর হল। জামাই মেয়ে এসে মাঝেমাঝে থাকে। আমার তাে হাত কঁপে। সই মেলে না। জামাই আমাকে নিয়ে গিয়ে ব্যাঙ্ক থেকে পেনশন তুলে দেয়। কিন্তু আমার যে ডলার কমে যাচ্ছে রােজ। কী হবে?

সে দেখা যাবে। আপনি উঠেছেন কোথায় ? | হাডসন নদীর কাছাকাছি—অফ—অফবিট থিয়েটার হলগুলাের পাশ দিয়ে যেতে হয়। বড়াে একটা পুলিশ স্টেশন ডানহাতে—

জায়গার নাম বলুন। নয়তাে ফিরবেন কী করে?—বলে দাঁড়িয়ে পড়লেন ডঃ রিয়াজ। তাঁর একবার মনে হল, ডঃ সেন নরমাল। আর একবার মনে হল, এলােমেলাে। দূরে একটা চ্যাপেলের মাথার ক্রসে তুষার ফিতে চোকলা হয়ে ঝুলছে।

সেখান থেকেই তাে ট্যাক্সিতে এখানে এসেছি। তাইতাে? কিছুই মনে পড়ছে

যে। এখন কী হবে? | বাতাসে বরফের কুচি। তুষারে ঢেকে যাচ্ছিল রাস্তা। আর মােটরগাড়ির টায়ার তার ওপর দিয়ে গিয়ে গিয়ে রাস্তার কালাে গা বের করে দিচ্ছে। ডঃ রিয়াজ বুঝলেন, কিছু একটা গােলমাল হয়েছে। নয়তাে বিদেশে এমন অবস্থায় একজনকে তাঁর হােটেলে নিয়ে তােলা তাে বেশ কঠিন। এ অবস্থায় কলকাতার বাড়ি থেকে এতদূরে বিদেশে এলেনই বা কী করে? না, এখানে এসেই এসব সিমটম দেখা দিল মানুষটির ?

ডঃ সেনকে বাজিয়ে দেখার জন্যে রিয়াজ জানতে চাইলেন, বলুন তাে আমি কে?

তুমি তাে রিয়াজ। ঢাকার সেক্রেটারিয়েট থেকে আসতে মাঝে মাঝে। রিয়াজ মানে উদ্যান। ফারসি শব্দ। তুমিই বলেছিলে সেবারে—

এইতাে বেশ সাফ মাথা। তবে রিয়াজ দেখলেন, কথা মনে করে উঠতে ডঃ সেনের কিছুটা সময় লাগছে। কথা শুরুর আগে ভীষণ একটা চেষ্টা বন্ধ ঠোটে এসে ধাক্কা দিল। কিন্তু ঠোট খুলছে না। বেরিয়ে আসবে বলে যেসব কথা ভেতর থেকে ধাক্কা দিচ্ছে তাদের চাপে বােজানাে ঠোট বরং খানিক উঁচু হয়ে উঠল। চোখের মণি ঠেলে উঠল। কেবল একটা উঃ! উঃ! শব্দ করেই ঠোট ফেটে কথাগুলাে বেরিয়ে পড়ল শেষে।

সন্ধের কাগজে বড়াে বড়াে হেডলাইন। স্মরণকালে এমন তুষার কখনাে পড়েনি নিউইয়র্কে। সেই কোন ঊননব্বই বছর আগে একবার এমন পড়েছিল। রাস্তায় দাঁড়িয়ে কাগজ দেখতে দেখতে ডঃ রিয়াজ চেঁচিয়ে উঠলেন, ট্যাক্সি ! আট সিলিন্ডারের কালাে লিংকন এসে নিঃশব্দে দাঁড়াল। ভেতরে উঠে রিয়াজ বললেন, অফ-অফবিট থিয়েটারস অন দি হাডসন।

নিগ্রো ট্যাক্সি ড্রাইভার মােটা ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকাল।

ডঃ রিয়াজ বললেন, নিয়ার দ্য পুলিশ স্টেশন।

গাড়ি সাঁ সাঁ করে ছুটে চলল। ভেতরে ডঃ নীলমাধব সেন বললেন, পেটে পােকা কিলবিল করছে—

কেন? কেন?

বাঃ! এও জানাে না? এখানে মাছগুলাে সব ইনজেকশন করা। আপেলেও তাই।

তাই নাকি? আমি ওসব ছুঁয়েও দেখি না। এই ঠান্ডায় তবে কী খেয়ে আছেন? স্রেফ দুধ আর পরিজ।

ডঃ রিয়াজ আর কথা বাড়ালেন না। নিউইয়র্কের আকাশ কালাে হয়ে গেছে। হাডসনের ওপর দিয়ে ব্রিজ পেরােবার সময় দূরে নীচের জল একসময় চোখে পড়ল। তাও রীতিমতাে কালাে। স্পিড কমিয়ে দিয়ে ড্রাইভারের চোখ পুলিশ স্টেশন খুঁজছে। ঠিক এই সময় ডঃ সেন নিজের কানের কাছে ডান হাতের মুঠো ফোনের মতাে এগিয়ে নিয়ে বলতে লাগলেন, হ্যালাে ! হ্যালাে !

পাছে ড্রাইভারের চোখ পড়ে—তাই রিয়াজ চাপা গলায় বললেন, কাকে ফোন করছেন?

ভিজিল্যান্সকে। কেউ যদি টেবিলে থাকে! সবাই অফিসে এসে সই করেই পায়চারি করতে উঠে যায়। হ্যালাে। হ্যালাে—তামার ক্লাসিফায়েড ডেস্কে কাউকে দিন আমাকে। খুব জরুরি। এখুনি চাই—

ডঃ সেন একটু থেমে গেলেন। যেন ফোনের ওপাশ থেকে কিছু বলা হাতের মুঠোই ফোনের রিসিভারের মতাে সরিয়ে রেখে নীলমাধব হাসি হাসি মুখে বললেন, জানতে চাইছে—আমি কে ফোন করছি? ভালাে !

ডঃ রিয়াজ ভীষণ ভয় পেয়ে গেলেন। এমন চেনা ভালাে মানুষকে এই দশায় নিউইয়র্কের অচেনা রাস্তায় ছেড়ে যান কী করে? বললেন, তা বলে দিন না—

তেমনি হাসি হাসি মুখে নীলমাধব বললেন, কী মুশকিল বলুন তাে! তাকে আপনি বলায় রিয়াজ আরও ঘাবড়ে গেলেন। তিনি প্রায় তেরিয়া হয়ে রাগে খিচড়ে গিয়ে নীলমাধবকে বললেন, এর ভেতর মুশকিলের কী আছে? বলে দিন—আপনি বলছেন

কিন্তু আমি কে? মানে আসলে আমি কে? সেটাই তাে বলতে হবে। ওপাশ থেকে জানতে চাইছে। নাহলে তাে ওরা ফোন নামিয়ে রেখে দেবে। কী মুশকিল বলুন তাে !

শুনতে শুনতে ডঃ রিয়াজের বুকের রক্ত হিম হয়ে গেল।

ট্যাক্সিটা থানার সামনে এসে সাইড করে দাঁড়াল। এবার নামতে হবে। এই মানুষকে সঙ্গে করে হেঁটে হেঁটে হােটেলটা খুঁজে বের করতে হবে। যদি নীলমাধব তাঁর হােটেল না চিনে উঠতে পারেন? তাহলে? তার ওপর এখন আবার জানতে চাইছেন, আমি কে?

ট্যাক্সির দরজা খুলে নামতেই ডঃ সেন অন্ধকার কালাে আকাশে একটা পুরনাে ধাঁচের পেল্লাই বাড়ির মাথা দেখিয়ে বললেন, ওই তাে টেন লাসাল—

লাসাল ? হা। ওই হােটেলেই উঠেছি। কাছাকাছি সব থিয়েটার বাড়ি। খুব বড় নয় কোনােটাই। ডঃ রিয়াজ একবার এসে এখানে একটা থিয়েটারে নাটক দেখেছিলেন। এক্সপেরিমেন্টাল নাটক। অফবিট সব নাটক। এক জায়গায় বাতিল সব মােটরগাড়ির পেল্লাই ঢিবি। তার ওপারেই অন্ধকারে হাডসন নদী। তার বুকে আলাে জ্বালিয়ে কিছু জাহাজ ভাসছে।

হাঁটতে হাঁটতে লাসাল স্ট্রিট। দশ নম্বর বাড়িটাই হােটেল। অন্তত একশাে বছরের পুরনাে তাে হবেই। মারবেলের বিরাট ঘােরানাে সিঁড়ি রিসেপশন থেকে বাঁক নিয়ে ওপরে উঠে গেছে। তাতে শ্বেতপাথরের উড়ন্ত ঈগল।

বােঝাই যায়—লিফট আসার আগেকার বাড়ি। তা দেড়শাে বছরেরও পুরনাে হতে পারে। ইলেকট্রিক আসার আগেকার। এই বিশাল রিসেপশনে একসময় বিরাট ঝাড়লণ্ঠন ঝুলত। চেনা বাড়ির মতােই ডঃ নীলমাধব সিধে গিয়ে লিফটের সামনে দাঁড়ালেন। তারপর ডঃ রিয়াজকে ডাকলেন, আসুন।

 রিয়াজ ভাবছিলেন, এমন মানুষকে হােটেলে একা ফেলে রাখা যায় কী করে ? দুদিনের কংগ্রেস। আজই প্রথম দিন। কাল হয়ে তবে শেষ। কেউ কেউ ক-দিন থেকে দেশে ফিরবেন। কেউ-বা পরশুই ফিরে যাবেন। ইন্ডিয়ান এমব্যাসিতে একটা খবর দিলে কেমন হয় ? নীলুদা যে এখন তাঁকে আপনি আপনি করছেন। ধ্যাড়ধ্যাড়ে লিফটে ষােলােতলায় উঠেই ঘর। সে-ঘর ঠিক চিনে বের করলেন নীলমাধব। রিসেপশন থেকে ঘরের চাবি আনতেও যে ভােলেননি নীলমাধব তা চোখে পড়ল ডঃ রিয়াজের। এই তাে বেশ। আবার পলকে যে কীরকম হয়ে যান ডঃ সেন—রীতিমতাে ভয় ধরিয়ে দেন।

 বাইরে থেকে ভেতরে এসে আরামই লাগছে। এসব পুরনাে কায়দার হােটেলবাড়ির বেসমেন্টে ফারনেস অয়েল পুড়িয়ে সারা বাড়ির ভেতরটা আরামদায়ক গরম করে রাখা হয়ে সর্বক্ষণ।

নিজের ঘরে ঢুকেই ডঃ সেন কপার মাইনিং নিয়ে কথা বলতে বলতে কপার সালফেটে এসে আটকে গেলেন। আর কথা বেরােয় না। রিয়াজের মুখে তাকিয়ে আছেন তাে আছেনই। চোখ বড়াে হয়ে উঠল। ঠোট ফট করে খুলে যাবে মনে হচ্ছে। ঠিক এই সময় ডঃ সেন হঠাৎ গায়ের শার্ট খুলে ফেলে বললেন, ভীষণ গরম লাগছে। তাই না রিয়াজ? রিয়াজ কোনও কথা বললেন না। নীলমাধব গায়ের শার্টটা খুলে বিছানায় ছুড়ে দিলেন। ঠান্ডা লেগে যাবে ড. সেন—

কপার মেল্টস অ্যাট—বলতে বলতে গায়ের গেঞ্জিটাও খুলে ফেললেন নীলমাধব। দামি সুটের ট্রাউজারের বাইরে ডঃ সেনের শরীরটা পাতের মতাে। কোথাও মেদ নেই। রিব বক্সের ডানদিকের বাঁদিকের—দু-দিকেই তিন নম্বর পাঁজর পাতলা মাংস ঠেলে উঠেছে। সাদা বুকের ঠিক মাঝখানটায় খানিকটা জায়গায় ঘন করে লােম। এখনাে পাকেনি। দুপাশের কঁাধের হাড় দুখানি হাতকে সমানভাবে ধরে আছে। কণ্ঠমণির ঠিক নীচেই ছােটো গর্তটি বয়সের চর্বিতে বুজে এসেছে। এবার যেন রিয়াজের মনে হল ডঃ সেন আজ দাড়ি কামাতে ভুলে গেছেন। সরকারি ডেলিগেশনের লােকজনকে চেনা ট্রাভেল এজেন্সিই হ্যান্ডেল করে থাকে। ডঃ সেনকে কলকাতার ফ্ল্যাট থেকে তুলে দমদমে পৌছে দিয়েছে। নিউইয়র্কে নামতেই ওদেরই ঠিক করা এজেন্সি আগাম হােটেল ঘর ঠিক করে রেখে ওকে এয়ারপাের্ট থেকে তুলে এনে এখানে পৌছে দিয়েছে। একদম রেজিস্ট্রি চিঠির মতাে। নয়তাে এমন মানুষ এতদূরে এসে ফিরে যাবেনই বা কী করে?

তামা কত ডিগ্রিতে গলে যায় ? তা আজ আর মনে নেই রিয়াজের। ঠান্ডা লাগার সঙ্গে কোনও ধাতুর গলে যাওয়ার যােগ কোথায় তা ধরতে পারলেন

ডঃ রিয়াজ।। বাইরে থেকে এসে ঘরে ঢুকলে ঘরের গরমটা বেশ আরামের। সেই আরামেই নীলমাধব গিয়ে হােটেল ঘরের কোণে রাখা রাইটিং ডেস্কের সামনে চেয়ার টেনে বসলেন। যেন এখুনি কলকাতায় চিঠি লিখতে বসবেন। ড্রয়ার থেকে প্যাড বের করলেন। প্যাডের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর শার্টটা গায়ে গলিয়ে নিলেন ফের।

 রিয়াজ মনে মনে বললেন, এই ভালাে। আচমকা ঠান্ডা লেগে যাওয়ার ভয় থাকল না। এবার মানে মানে উঠতে যাবেন রিয়াজ—কেননা, এখনই নীলমাধবকে তার বেশ স্বাভাবিক লাগছে—এমন অবস্থায় ফেলে যেতে বিবেকে কিছু ফোটে

 কিন্তু ঠিক তখনই নীলমাধব চেঁচিয়ে উঠলেন, আশ্চর্য! গায়ে শার্ট রয়েছে, —অথচ গেঞ্জি নেই। গায়ের শার্ট না খুলেই গেঞ্জি খুললাম কী করে?

আপনি তাে একটু আগে রিয়াজ কথা শেষ করতে পারলেন না। চোখদুটো ঠিকরে বেরিয়ে আসছে নীলমাধবের। মুখ হাঁ হয়ে আছে। কপালে মাথার চুল আছড়ে পড়ল। ফের চিৎকার করে উঠলেন, গেঞ্জি খুললাম কী করে? কী করে? তবু ড. রিয়াজ একবার শেষ চেষ্টা করলেন। আপনি তাে নিজেই একটু আগে—

নীলমাধব আরও জোরে চেঁচিয়ে উঠলেন। আগে শার্ট না খুলেই গায়ের গেঞ্জি খুললাম কী করে? ও বাবা গাে! এ যে ভয়ঙ্কর ব্যাপার—শার্ট রয়েছে গায়ে—অথচ গেঞ্জি খুলে ফেলেছি। উঃ বাবাঃ! কী ভয়ঙ্কর ব্যাপার—কী করে হল ? | কোনও কুলকিনারা করতে না পেরে ডঃ নীলমাধব সেন ফের তাঁর ডান হাতখানি মুঠো করে ফোনের মতাে কানে লাগালেন। আর কনুইয়ে মুখ নামিয়ে চাপা গলায় বললেন, ভিজিল্যান্স? হ্যা। আমি বলছি ভিজিল্যান্স—কপারের ক্লাসিফায়েড ডেস্কে লাইনটা দিন একটু। খুব জরুরি। ভীষণ আরজেন্ট। লাইন ছাড়বেন না। আমার গায়ের শার্ট খুলিনি—অথচ গেঞ্জি খুলে ফেলেছি।

ডঃ রিয়াজের আর বসে থাকার সাহস হল না। বিশেষ করে তিনি যখন অন্য আরেক দেশের ডেলিগেট হয়ে এখানে এসেছেন—তখন তাঁরই সামনে ডঃ সেনের কিছু একটা হয়ে গেলে বিরাট এক ফ্যাসাদে জড়িয়ে পড়তে হবে।

রিয়াজ দরজা সামান্য ফাঁক করে বেরিয়ে এলেন। ভেতরে নীলমাধব তখন বলছেন, কী ভয়ঙ্কর ব্যাপার! শার্ট না খুলেই গেঞ্জি খুলে ফেলেছি। এ কী ভয়ঙ্কর! আমি কি আস্তে আস্তে | ডঃ রিয়াজ টেন লাসাল থেকে বেরিয়ে টিউব ধরলেন। কামরায় বিশেষ কোনও প্যাসেঞ্জার নেই। তাঁর পাশেই একটি বারাে তেরাে বছরের ছেলে খুব মন দিয়ে একখানি মােটা বই খুলে পড়ছে। কীসের বই? রিয়াজ উকি দিলেন। বড়াে বড়াে হরফে লেখা—এনসাইক্লোপিডিয়া অব গানস—ছাপা দুই

কলমের মাঝে মাঝেই নানারকমের কামানের ছবি।

 বুকের ভেতরটা ছাৎ করে উঠল রিয়াজের। একা অতবড় হােটেল বাড়িটার। ভেতর কী করছে মানুষটা। কাল সকালের সেশনে পৌঁছতে পারবেন তাে? এত রাস্তা পাড়ি দিয়ে শেষপর্যন্ত বাড়ি ফিরতে যদি না পারেন ডঃ সেন!

নিজেরই ভঁজ করা ডান হাতখানি যেন বা টেলিফোন—এই ভঙ্গিতে কান থেকে সরিয়ে হাত ফের টান টান করলেন নীলমাধব।

তারপর রাইটিং ডেস্কের ড্রয়ার থেকে প্যাড বের করে নীলমাধব লিখলেন—

গায়ের শার্ট না খুলে নীচের গেঞ্জি খুলে ফেলেছি। এটা কী করে সম্ভব হল? এ যে ভয়ঙ্কর কাণ্ড। আমি কিছুই ভেবে উঠতে পারছি না। মনে হচ্ছে—সামনেই কোনাে বড়াে সর্বনাশ আমার জন্যে ওত পেতে বসে আছে। একবার কঙ্গোর উজানে ওভেমাঙ্গোতে জঙ্গলের ভেতর কপার প্রসপেকটিং করার সময় সয়েল স্যাম্পেল নিতে নিতে চলেছি। দুপুরবেলা। সঙ্গে আরও তিনজন জিওলজিস্ট। একজোড়া জিরাফ অনেক উঁচু থেকে আমাদের দেখছে। ঠিক এই সময় এক আশ্চর্য গন্ধে সারা বন ভরে গেল।

লিখতে লিখতে নীলমাধব নাক দিয়ে হােটেলঘরের বাতাসের গন্ধ অঁকলেন। একবার মনে হল মাখন মাখানাে কড়কড়ে টোস্টের গন্ধ বাতাসে। আবার মনে হল—জিরে বাটা দিয়ে বেলা যে কচি পাঁঠার মাংস রাঁধে তারই গন্ধ বাতাসে। সেই অদৃশ্য গন্ধটাকে ডান হাত দিয়ে সরিয়ে দিলেন নীলমাধব। তারপর নিজের লেখার দিকে তাকিয়ে দেখলেন—কিছুই পড়তে পারছেন না। সাদা প্যাডের কাগজ থেকে আঁকাবাঁকা হরফগুলাে সিধে তার চোখে উঠে আসছে।

নীলমাধব বিড়বিড় করে নিজেকেই বললেন, আর বাকি কী থাকল? কীসের গন্ধে যে সারা বন ভরে গিয়েছিল—তা কিছুতেই আর মনে আসছে াঁর। মনের ভেতর হাতড়াতে গিয়ে এক একটা স্মৃতির বড়াে বড়াে গাছ, আগাছা, পুরু হয়ে শুকনাে পাতার চাপ—তার ভেতর দিয়ে হাতড়াতে গিয়ে ওটা টানতে আরেকটা বেরিয়ে আসে। কোথায় কঙ্গোর উজানে ওভেমাঙ্গো—আর কোথায় সামচিবাজার—রংপাে নদীর ওপর কাঠের পােল—পাহাড়ের কোলে শীতকাতুরে পাইথনের লম্বা হয়ে পড়ে থাকা। তার পাশেই তামার খনি। সেখানে তামা বের করেছিলেন নীলমাধব। টানা তিনবছর প্রসপেকটিং করে।

ড. নীলমাধব সেন এবার সত্যিই ভয় পেলেন। আমি কি পৃথিবীর মতােই জুড়িয়ে আসছি? আমার আদি বা স্মৃতি সবই পরতে পরতে কঠিন হয়ে জমে যাচ্ছে? মাথার ঘিলু নরম নরম বলেই না ইচ্ছেমতাে সাজানাে পাঠাগারের বই হিসেবে এক-একটা অভিজ্ঞতাকে—স্মৃতিকে টেনে এসে চোখের সামনে মেলে ধরতে পারি। তিনি মনে করার চেষ্টা করলেন শার্টটা একবার খুলে ফেলেছিলেন কি না? তারপর নীলমাধব লিখলেন—

এক হতে পারে—অন্যমনস্ক অবস্থায় শার্টটা খুলে গায়ের গেঞ্জিও খুলেছি। তারপর আবার শার্ট গায়ে দিয়েছি। তাই মনে হতে পারে গায়ের শার্ট না খুলেই গেঞ্জি খুলে ফেলেছি। এসব কি আমার এ জন্মের কথা? না, গতজন্মের কথা? কিছুই ঠিক করে উঠতে পারছেন না নীলমাধব। মনে করতে গিয়ে দুই চোখের ভেতর অন্ধকার ছুঁচলাে হয়ে ঢুকে গিয়ে মনে করার জায়গাগুলাে কালাে করে মুছে দেয়। তারপর সেই অন্ধকার কেটে গিয়ে একদম অন্য ছবি ভেসে ওঠে। তখনই নীলমাধবের সব গুলিয়ে যায়। সে বুঝতেই পারে —এখন সে কোথায় আছে—খানিক আগে কোথায় ছিল—কোথায় সে যেতে চলেছে। সে যেন কোনও জায়গারই নয়—অথচ সে সব জায়গাতেই আছে।

বেশি রাতে রুম সার্ভিসে এক ডােঙা দুধ—পেল্লাই এক চিনেমাটির পটে নামিয়ে দিয়ে সাহেব বেয়ারা কানাত উঁচু কারুকাজ করা প্লেট ট্রেতে রাখল। বেয়ারা চলে যেতে অনেকটা পরিজ দিয়ে তাতে দুধ ঢালতে গিয়ে ডঃ নীলমাধব সেন নিজেকেই বললেন, একা মাখবাে ? একা খাবাে?

গলা দিয়ে নামতে চায় না। কেমন যেন কঁাচা তঁাড়সের গন্ধ। এ ঘরে আরামের—রেস্ট নেবার—ঘুমিয়ে পড়ার অনন্ত আয়ােজন। আমার যেন কী মনে নেই। কী যেন খুব দরকারি একটা কথা একদম ভুলে বসে আছি। সেটা

কী কথা? কবেকার কথা? আজকের? না, বহুকালের?

খাওয়া হল না ডঃ সেনের। মনে পড়ল, ইঞ্জেকশন দেওয়া আপেল খেয়েছিলেন। তার পােকাগুলাে বিন বিন করে পেটের ভেতর বেড়ে উঠছে। একটু নড়লেই তারা পেটের ওদিককার দেওয়াল বেয়ে বুকের দিকে উঠে আসার চেষ্টা করে। নীলমাধব তাই কোনওদিকে কাত না হয়ে সােজা উঠে দাঁড়ালেন। পাছে তার ভেতরটা একদিকে ঢালু মতাে পেয়ে পােকাগুলাে উঠে আসে তাই এভাবে তাঁর উঠে দাঁড়ানাে। নইলে পােকাগুলাে তাে লাংসেও ঢুকে যেতে পারত।

পরদিন সকালের সেশনে নীলমাধব যখন ক্লোকরুমে তাঁর রেনকোট রেখে কনফারেন্স হলে ঢুকবেন—তখন ডঃ রিয়াজ দেখলেন, ডঃ সেনের হাতে একটি পাঁচ ব্যাটারির টর্চ ঝুলছে। নিশ্চয় দেশ থেকে যত্ন করে নিয়ে এসেছেন। যদি কাজে লাগে। কিন্তু এত বড়াে?

ডঃ রিয়াজ কাছে গিয়ে টর্চটা প্রায় কেড়ে নিয়ে বললেন, এখন তাে দরকার হচ্ছে না—এই আপনার রেনকোটের পকেটে রেখে দিলাম।

নীলমাধব ফ্যালফ্যাল করে তাকালেন। লাগবে না? লাগবে না। তেমন অন্ধকার তাে কোথাও নেই এখানে। চলুন। কলকাতার মতাে এখানে লােডশেডিং নেই। আজ ওপেনিং সেশন নয়। পেপার পড়বে মেকসিকো আর ফ্রান্স। নীলমাধব তাঁর জায়গায় বসতে দূর থেকে রিয়াজ লক্ষ করলেন, দাড়ি কামাতে গিয়ে ডঃ সেনের গালের দু-তিন জায়গা কেটে গেছে। কাল রাত থেকেই আতঙ্কে কেটেছে রিয়াজের। এই অবস্থায় মানুষটার কিছু না হয়ে যায়। যাক আস্ত আছেন। নিজেই সময়মতাে কনফারেন্সে এসেছেন। এজন্যে তিনি টেন লাসালের রিসেপশনকে মনে মনে ধন্যবাদ দিলেন। ওরা সব দেখে না দিলে—করে না দিলে এমন মানুষের এখানে এসে পৌছানাে কঠিন ছিল। দেখতে দেখতে লাঞ্চ ব্রেক এসে গেল। ডঃ রিয়াজ বললেন, চলুন নীলুদা—আপনার এয়ার টিকিটটা কনফার্ম করিয়ে নিয়ে আসি। কাছেই তাে প্যান-অ্যাম বিল্ডিং।

 আজ তুষার পড়া কমলেও বাতাস একদম হিম। বেলা দুটোয় সন্ধের আঁধার আঁধার ভাব। প্যান-অ্যাম অফিসে গিয়ে ডঃ রিয়াজ অবাক হলেন। আজই রাত নটায় জে এফ কে এয়ারপাের্ট থেকে প্লেন ছেড়ে যাবে। ফ্রাঙ্কফুর্ট, লন্ডন, তেহেরান হয়ে দিল্লি। সতেরাে-আঠেরাে ঘণ্টা পাড়ি দিয়ে দিল্লিতে পৌছবে। সেখানকার শেষরাতে। ঘণ্টা দু-তিন বসলেই দু-ঘন্টার ফ্লাইট ধরে ডঃ সেন একদম কলকাতায় পৌছে যাবেন। কলকাতায় তখন দিনের বেলা। দশটা সাড়ে দশটা।

এ সুযােগ হারালেন না ডঃ রিয়াজ। বললেন, হােটেলে চলুন। কনফারেন্সে যাবাে না?

 আপনার বলা তাে হয়ে গেছে। এখন শুধু খাজুরে আলাপ চলবে সন্ধে অব্দি। তার চেয়ে তাড়াতাড়ি হােটেলে ফিরে গােছগাছ করে নেওয়াই ভালাে। বেশি সময় নেই তাে হাতে।

কেন? বাঃ! আজই রাতে তাে আপনি নিউইয়র্ক ছেড়ে যাচ্ছেন। আজই? হা। টিকিট দেখেননি?

হু। রিসেপশনে বলেছিল বটে। ট্রাভেল এজেন্সির গাড়ি আসবে নাকি | বলতে বলতে ডঃ সেন দাঁড়িয়ে পড়ে কী মনে করার চেষ্টা করতে লাগলেন। মনের কথা ঠোটে উঠে আসছে। কিন্তু ঠোট ফাক হয়ে বেরােতে পারছে না। কতকগুলাে আওয়াজ মাথার ভেতর থেকে নেমে মুখের ভেতরে গুম গুম করে ফাটছে। অথচ ভাষা হয়ে বেরােতে পারছে না। নীলমাধবের চোখদুটো ঠিকরে উঠল। ডঃ রিয়াজ ভয় পেয়ে গেলেন। বললেন, আপনি কোথাও বসবেন? একটু জিরিয়ে নেবেন ?

নীলমাধব কোনও কথাই বলতে পারলেন না। রিয়াজ দেখলেন, একদম অজানা জায়গায় কী অদ্ভুত অবস্থায় নীলমাধব দাঁড়িয়ে। রাস্তায় লােকজন যে যাকে নিয়ে ব্যস্ত। ছ-ছ-টা লেন দিয়ে গাড়ির পর গাড়ির ছ-টা স্রোত। হরেক রকমের গাড়ি। লিংকন এইট, ফোর্ড, জার্মান বি এম ডবলু, টয়ােটা, ভলভাে।

হঠাৎ নীলমাধব চেঁচিয়ে বললেন, আবার সাচ্চার যুগ ফিরে আসছে—ফিরে আসছে সাচ্চার যুগ। কোনও ভয় নেই আর—বলেই দুই ঠোঁট একদম বন্ধ করে ফেললেন। চোখদুটো তাকিয়ে আছে রাস্তার ওপারে বুরবো হুইস্কির বিরাট এক হাের্ডিংয়ের দিকে।

ডঃ রিয়াজ ভয় পেয়েছেন। আবার তাঁর মায়াও হল। সুস্থ নন নীলমাধব। আবার পুরােপুরি পাগলও হয়ে যাননি। তামার কথা বলতে গিয়ে কালকের ওপেনিং সেশনে যা বলেছেন—তার ভেতরে জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, তুলনা সবই একজন পণ্ডিত, সুস্থ লােকের কথা। আবার এই যে কথা না বলতে পেরে ভেতরের কোনও একটা দরজা পেরােতে না পারার কষ্ট নীলমাধবের দুই চোখ বড়াে বড়াে করে তুলছে।

রিয়াজ নীলমাধবের হাত দুখানি ধরলেন। একটি ট্রলি বাস এই হিমেল বাতাসের ভেতর দিয়ে দিব্যি ফুরফুর করে উড়ে গেল।

নীলমাধব বিড়বিড় করে বললেন, আবার সাচ্চার যুগ ফিরে এল— রিয়াজ জানেন, পৃথিবী অনেকদিন হল আর সাচ্চা নেই। হিন্দি সিনেমায় ভিলেনকে হিরাে ধােলাই দেবার সময় বলে ওঠে—ঝুটি! ধােকেজ! মক্কার! প্রায় ঠিক তার উল্টো গলায় নীলমাধব আবারও বললেন, ফিরে এল সাচ্চার যুগ। আবার সামারকুল গেঞ্জি পাওয়া যাচ্ছে। সে ফিরে এল—

সামারকুল গেঞ্জি?

হা। সামারকুল গেঞ্জি। গায়ে দিলে ঘাম হবে না। রিয়াজ চুপ করে গেলেন। ডিসেম্বরের এই হিমেল বাতাসের ভেতর দাঁড়িয়ে একজন মানুষ বহুকাল আগে উঠে যাওয়া গরমকালের সামারকুল গেঞ্জির আবার ফিরে আসার কথা কখন এভাবে ঘােষণা করতে পারেন—তা খুঁজে বের করতে পারলেন না রিয়াজ।

চলুন হােটেলে যাই। রিয়াজের একথায় কোনও আপত্তি করলেন না নীলমাধব। বরং নিজের বাঁ-হাতখানি রিয়াজের কাঁধে রাখলেন—খুব নির্ভর করার মতাে করে। তারপর দুজনে হাঁটতে লাগলেন। ট্যাক্সি ধরা হবে। হাঁটার ফাঁকে ফাঁকে রিয়াজ টুকটাক কথা বলে দরকারি জিনিসগুলাে জেনে নিতে লাগলেন।

ভাগ্যিস এয়ার টিকিটখানা সঙ্গে রেখেছিলেন।নীলমাধব বললেন, পাসপাের্ট—টিকিট—সবসময় সঙ্গে সঙ্গে রাখি। ডান হাত দিয়ে কোটের ভেতর-পকেট থেকে বের করে দেখালেন নীলমাধব। তারপর এয়ার টিকিটখানি কোটের ভেতর-পকেটে পাঠিয়ে দিয়ে পাসপাের্ট খানি চামড়ার কেন্স থেকে বের করে রাস্তায় দাঁড়িয়ে পড়লেন।

কী হল? চলুন। রাস্তা আর দোকানপাটের আলােয় পাসপাের্টের ছবির সঙ্গে নিজেকে মেলাতে শুরু করলেন ডঃ সেন।

হচ্ছে কী? চলুন তাে।

ডঃ সেন বিড়বিড় করে বললেন, ও কে? আপনি। আপনারই ছবি। ঠিক বিশ্বাস হল না নীলমাধবের। আমি? ঠিক ঠিক আমিই তাে?

আপনি ছাড়া কে হবেন ! চলুন তাে ট্যাক্সিতে ওঠার সময়েও নিজেকে নিয়ে নীলমাধবের অবিশ্বাস পুরােপুরি কাটল না। তিনি সিটে বসেই স্পষ্ট গলায় বললেন, আমি যে আমি—সে আমি আমিই তাে?

পাছে ট্যাক্সির ভেতর বসে ফের কালকের মতাে নিজের ডান হাতকে ফোন বানিয়ে কথা বলতে শুরু করেন ডঃ সেন—তাই অন্যদিকে কথা ঘুরিয়ে দিতে রিয়াজ বললেন, আপনার কি শীত করছে?

শীত! আমার তাে গরম লাগছে— এই ঠান্ডায় গরম?

হা। সামারকুল গেঞ্জি তাে কেনা হয়নি। অথচ ক-দিন হল বাজারে এসে গেছে। ফের অনেকদিন পর সব আগের মতাে হয়ে যাচ্ছে। সাচ্চার যুগ ফিরে এল তাে।।

মনে মনে রিয়াজ বললেন, এই সব্বোনাশ! কথাবার্তা যে অন্যদিকে চলে যাচ্ছে। তিনি বললেন, কোন বাজারে সামারকুল গেঞ্জি দেখলেন?

 বাঃ। লেক মাকেটের উল্টোদিকে রঞ্জিৎ স্টোর্সে। কালীঘাটে গণেশ কাটরায়—

ঢাকার রিয়াজ কলকাতার এ-দুই জায়গাই চেনেন। তিনি দফায় দফায় অনেকবার কলকাতায় গেছেন। থেকেছেন। তাছাড়া ছেচল্লিশের দাঙ্গার সময় বেশ বালক বয়সে তিনি বাবা মায়ের সঙ্গে শিয়ালদহ বৈঠকখানা রােডে যে-বাড়িতে থাকতেন—তার আবছা স্মৃতি তাঁকে মনে করিয়ে দেয়—আমিও তাে আদিতে কলকাতারই। কিন্তু সামারকুল গেঞ্জি আমিও তাে অনেককাল দেখিনি। এই গেঞ্জি ফিরে এলেই কি পৃথিবী ফের সাচ্চা হয়ে যাবে?

ট্যাক্সিওয়ালা রাস্তা গুলিয়ে ফেলল। গলায় টাই লাগানাে সুটেড-বুটেড সওয়া ছ-ফুটি নিগ্রো ড্রাইভার ডবল হেমন্ত-গলায় জানতে চাইল, হুইচ ওয়ে—

ডঃ রিয়াজ বললেন, টেন লাসাল। নিয়ার গ্রিনউইচ পুলিশ স্টেশন | গাড়ি একটা ছবিঘরের সামনে দিয়ে যাবার সময় রিয়াজ দেখলেন—উডি অ্যালেনের ছবি। হাের্ডিংয়ে উঠতি তারকা—হেমিংওয়ের নাতনির ছবি। রাস্তায় তুষার পড়ে পড়ে চেনা জায়গাগুলাে অচেনা করে তুলেছে। এদিকটা লেট নাইনটিনথ সেঞ্চুরির ছবি মনে করিয়ে দিল রিয়াজকে। মার্ক টোয়েনের গপ্পে এমন রাস্তার কথা আছে। দুপাশে পুরনাে ধাঁচের পেল্লাই লম্বা সব বাড়ি। কোনও ঢাকপদ নেই। মােটা মতাে গ্যাসলাইন বেরিয়ে পড়েছে। শীতে বাড়ি গরম রাখতে বেসমেন্টে ফারনেস অয়েল পুড়িয়ে তাপ বাড়ানাের নানান কলকজা। এ তল্লাটে ক-দিন নাকি গারবেজ ধর্মঘট চলছে। তাই সব বাড়ির সামনে প্লাস্টিকের বড়াে বড়াে থলেয় করে ঘর গেরস্থালির আবর্জনা লাট করে রাখা। নিউইয়র্কের এদিকটা বােধহয় আগের মতােই রয়ে গেছে। কাছেই গ্রিনউইচ ভিলেজ। রাস্তার গায়ে ডাকবাক্সের মুখে খালি বিয়ারের বােতল কে গুঁজে রেখে গেছে কাল রাতে। মাটির নীচে এখনকার পাতাল রেলে নাকি অনেকে আজকাল টিকিটই কাটছে না। গেটের কাছে এসে লম্বা লম্বা ইয়াঙ্কি ছেলে-ছােকরা আর নিগ্রোরা হাইজাম্প দিয়ে গেট পেরিয়ে গিয়ে ট্রেনে ওঠে। তাই শুনেছেন রিয়াজ। এরকম জগতে নীলুদা কনফার্মড এয়ার টিকিট পকেটে নিয়েও কি ঠিক সময়ে ঠিক প্লেন ধরে উঠতে পারবেন?

জে এফ কে থেকে বুক পকেটে বাের্ডিং কার্ড গুঁজে ঠিক সময়ে ঠিক প্লেনে উঠলেন ডঃ নীলমাধব সেন। তাঁকে রওনা করিয়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন ডঃ রিয়াজ আহমেদ। নীলুদা যে গ্যাংওয়েতে উঠছেন—হাতে ব্যাগ—মাথায় কার্নিশ হ্যাট—চোখে চশমা—দুর থেকেও রিয়াজের মনে হচ্ছিল—মানুষটি আদৌ জানেন না তিনি কোথায় চলেছেন। কলকাতায় ? টোকিওতে? না, নরকে? সে ব্যাপারে কোনও ভ্রুক্ষেপই নেই। যেন বা লাইন দিয়ে কোনও বাসে উঠছেন। যে-বাস ঢাকার কমলাপুর থেকে কুমিল্লার সদরপট্টি যাবে। ভাবখানা এমনই।

শেষরাতে ভিড়ের সঙ্গে হাঁটি হাঁটি পা করে ডঃ নীলমাধব সেন পালামে নামলেন। তাঁর কাছে পালাম জে এফ কে-র মতােই সমান অচেনা। তিনি আলাে ফোটার অপেক্ষায় পাবলিকের সঙ্গে এক গদিমােড়া সােফায় বসে রইলেন।

আলাে বেশ ভালাে করে ফুটলে আরেকটা ভিড়ের পেছন পেছনে গিয়ে ডঃ নীলমাধব সেন আরেকটা ঢাউস প্লেনে ঢুকলেন। কোথাও আটকাল না। যেখানে যেমন দাঁড়িয়েছিলেন—সেখানে চাওয়া মাত্র কাগজপত্র তেমন তেমন দেখিয়ে তিনি বাের্ডিং কার্ড পেয়েছেন। জানলার পাশের সিটে বসে আকাশ থেকে যখন দেখলেন—নীচে মাটিতে একটা ফিতে প্লেনের সঙ্গে সঙ্গে চলেছে—তখন বহুকালের প্লেনে প্লেনে ঘােরা অভ্যেস থেকে ডঃ নীলমাধব তার নরম ঘিলুর ভেতরে সাজানাে পাঠাগারের অভিজ্ঞতার বইগুলাে ঘেটে পলকে বুঝলেন—নীচের ফিতেটা গঙ্গা। ওটা কলকাতা চলেছে। তিনিও কলকাতায় যাচ্ছেন। বেলা এগারােটায় এয়ারপাের্ট থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সিতে উঠলেন। ডানপাশে নন্দা বসল। বাঁপাশে নন্দার স্বামী অরিন্দম। নীলমাধব। জামাই বা মেয়ে কারও সঙ্গেই কথা বললেন না। নিউইয়র্কে গায়ে চাপানাে রেনকোট তেহেরানে খুলে ফেলেছিলেন। কলকাতায় নেমে ফুল সােয়েটারও খুললেন। যদিও ডিসেম্বর প্রায় শেষ—বাতাস ধারালাে—তবু নীলমাধব ওয়েস্টকোট খুলে হাতে নিলেন।

খেতে বসতে বসতে বেলা দেড়টা। টেবিলের দুই প্রান্তে বেলা আর নীলমাধব। একদম মুখােমুখি। তেমনি টেবিলের মাঝামাঝি দুই পাশে না আর অরিন্দম। ওরাও মুখােমুখি।

অনেকদিন পরে মুসুরির ডাল পেয়ে নীলমাধব ভাতে মেখে হাপুস হুপুস খেতে লাগলেন। টেবিলে বাকি তিনজন খাওয়া থামিয়ে দেখতে লাগলেন। সেদিকে কোনও খেয়াল নেই নীলমাধবের।

কাতলার মােটা গাদা দুখানি বেলা থালায় দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে নীলমাধব বললেন, ইলিশের এত মােটা গাদা—আই লাইক ভেরি মাচ।

 কাতলাকে ইলিশ বুলায় নন্দার খাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। সে চোখ তুলে। তার মায়ের মুখে তাকাল। সঙ্গে সঙ্গে বেলা বললেন, ওই শুরু হয়ে গেল।

ব্যাপারটা অত সহজে নিতে পারল না অরিন্দম। সে খাওয়া ফেলে উঠে গেল।

খেলে না?—বলে বেলা জামাইয়ের দিকে তাকালেন। নাঃ! পেট ভরে গেছে। বেলা দেখলেন, নীলমাধব বেশ গপ গপ করেই খাচ্ছেন। মনে মনে বলছেন, খাওয়া কী বেড়ে গেছে। থামানাে দরকার। কাছে এসে স্বামীকে বললেন, আর খেয়াে না। ওঠো ।

সেকথা নীলমাধবের কানে গেল না। নিজের বাবার খাওয়া দেখে নন্দার চোখে জল এসে যাচ্ছিল। অনেকদিন যেন বাবা কিছু খায়নি। নন্দা বলল, বাবা উঠে এসাে—

নীলমাধব মুখ তুলে মেয়ের মুখে তাকালেন একবার। ফের মুখ নামিয়ে খেতে লাগলেন।

অরিন্দম বাইরে বসার ঘরে গিয়ে সিগারেট ধরাল। তার শুকনাে গন্ধ শীতের বাতাসে। নন্দা হাত ধুয়ে এসে অরিন্দমকে বলল, তুমি কিছু না খেয়ে উঠে এলে কেন? | এমন ব্রিলিয়ান্ট মানুষের এরকম ডিজেনারেশন সামনে বসে দেখা যায়

নন্দা। নন্দার চোখে জল এসে গেছে। বাবা কোনােদিন রিল্যাক্স করেনি। করতে আমিও খুব ছােটোবেলায় বাবার সঙ্গে ফিল্ডে তাবুতে থেকেছি। মাঠে আকাশের নীচে সাদা ফোল্ডিং টেবিল পেতে লাঞ্চ সারতেন দুপুরবেলা—গাছের ছায়ায়—খেয়েই ফের হাঁটতে হাঁটতে খাড়াই চার কিলােমিটার ভেঙে সাইটে যেতেন। রক স্যাম্পেল হাতে যখন ফিরতেন—তখন আমি আর মা তাবুর সামনে বসে আছি। আকাশে চাঁদ উঠে এসেছে। কেটলিতে চায়ের জল ফোটার শব্দ—

 রিটায়ারের মুখে মুখে তােমার বাবা যেবার ফের ব্রাজিল যাবেন—এই তাে বছর চারেক আগে—যাবার আগে আমায় এক্সকুসিভলি ডাকলেন এক সন্ধ্যায়। এতবড়াে মানুষ—সেলার খুলে নিজের হাতে আমায় ড্রিঙ্কস ঢেলে দিয়ে বললেন, এই পৃথিবীর অভিজ্ঞতা পৃথিবী নিজেই।

 আমি কোথায় তখন?

তুমি বােধহয় তােমার স্কুলের কলিগদের সঙ্গে ওয়ালটেয়ারে। আমি বাইরে থেকে কলকাতায় তিনমাসের ট্রেনিংয়ে এসেছি। বান্টি তখনাে বেঁচে বান্টি বাবাকে বড়াে ভালােবাসত। উনি বাইরে ট্যুরে গেলে ওর খাটের নীচে শুয়ে থাকত শুনেছি।

হা। বাবা ওকে ভুটান থেকে এনেছিল। পাহাড়ি ব্রিড। গােড়ায় গােড়ায় কলকাতার গরমে ও ভীষণ কাবু হয়ে পড়ত। সারা গায়ে তাে ভীষণ লােম। বাবা বান্টির জন্যে দরজা জানলা আটকে ঘর ঠান্ডা করে রাখত।

সেদিন সন্ধ্যায় তােমার বাবা বলেছিলেন—কোন গলন্ত জ্বলন্ত মহাতারা থেকে ছিড়ে ছিটকে বেরিয়ে আসার সময় পৃথিবীও তাে গলন্ত-জ্বলন্ত ছিল। সবটা আজও জুড়িয়ে ওঠেনি। মাটি খুঁড়লে তামায়, লােহায়, সােনায়, দস্তায় পৃথিবীর সেই স্মৃতি জমাট, কঠিন শক্ত হয়ে আছে। আমাদের সারা মানুষ জীবনের জানাশােনা, জ্ঞান, আনন্দ—অভিজ্ঞতাও একদিন জুড়িয়ে জুড়িয়ে জমাট—নিরেট হয়ে আসবে অরিন্দম।

 ছােটোকাকা বাবার মাথাটা তার পলিক্লিনিকে স্ক্যান করিয়েছে। রিপাের্ট বলছে—বাবার অনেকগুলাে ব্রেইন সেল শুকিয়ে গেছে—আরও অনেক সেল নাকি শুকিয়ে আসছে।

 তােমার বাবা আজই আমেরিকা থেকে ফিরলেন। ভেবেছিলাম—কোথায় তার মুখ থেকে নিউইয়র্কের গল্প শুনব। তা নয়—তার মাথার ভেতরে যে-মােটরটা মানুষকে দিয়ে তার ইচ্ছের কাজ করায়—হাত নাড়ায়—কথা বলায়—রিঅ্যাকশন হয়—সেই মােটরটাই কাজ করছে না।

ঘরে শীতের দুপুর ভারি হয়ে এল। ডঃ নীলমাধব সেনের সঙ্গে সদ্য ফিরে আসা তাঁর এয়ারব্যাগের গায়ে দুনিয়ার কয়েকটা শহরের নাম লেখা স্টিকার ঘরের কোণের অন্ধকারে খুদে পতাকার মতাে বেরিয়ে। নিউইয়র্ক, লন্ডন, ফ্রাঙ্কফুর্ট, তেহেরান, নিউদিল্লি, ক্যালকাটা। নন্দার বুক কেঁপে উঠল। বাবা তাহলে ক-টা এয়ারপাের্টে প্লেন পাল্টেছে? এ অবস্থায় আস্তই বা ফিরে এল কী করে? মা যখন বলল, যাক ঘুরে আসুক—ঘুরলে—পুরনাে বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হলে যদি নরমাল হয়ে যায় ফের। তাই নীলমাধবকে পাঠানাে। তাও তার বাবাকে যেতে দিত না নন্দা। অমন ইনভিটেশন বছরে একটা দুটো এসেই থাকে। কিন্তু ট্রাভেল এজেন্সির এরােপ্লেন-জ্যাঠা যখন বলল, ভেবাে না নন্দা—আমরা তােমার বাবাকে এমনভাবেই প্যাক করে পাঠাব—সিধে নিউইয়র্কের কনফারেন্সে যাবেন—আর বেয়ারিং রেজিস্ট্রি চিঠির মতােই দমদমে ফিরে আসবেন। আমরা কোনােরকম চান্স নেব না। সব জায়গায় আমাদের ট্রান্সপাের্ট থাকবে।

পৃথিবীর অনেকগুলাে এয়ারপাের্টের স্টিকার দেখে না বুঝতে পারল, নিউইয়র্কে এজেন্সির লােক ডঃ নীলমাধবের নাগাল পায়নি। কিংবা প্লেন খারাপ হওয়ায় ইউরােপে পৌছবার পর নীলমাধবকে অন্য প্লেনে তুলে দেওয়া হয়। তারপরও নীলমাধব ফ্রাঙ্কফুর্ট-তেহেরানে প্লেন পাল্টিয়েছেন। কিংবা নেমে পড়ে মিস করে থাকবেন। কিংবা এসব কিছুই হয়নি। বাবার এয়ারব্যাগটা হারিয়ে গিয়ে নানান এয়ারপাের্ট হয়ে তবে কলকাতায় এসেছে। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি তাে এয়ারব্যাগ ফেরে না। আবার বাবাও তাে পথে নেমে প্লেন মিস করার দরুন এত তাড়াতাড়ি বদলি প্লেন পেতে পারেন না। তাহলে?

ঘরের কোণে ব্যাগটার পাশেই ধুলােমাখা ফটো স্ট্যান্ডে বান্টি লেজ গুটিয়ে বসে। পাছে নীলমাধবের চোখে পড়ে তাই সরিয়ে রাখা। নন্দা বলল, বছর পাঁচ-ছয় আগে—তােমার সঙ্গে তখনাে আমার পরিচয় হয়নি। এ পাড়ায় বেশ বয়স্ক এক ডাক্তার চেম্বারে বসে মাছি তাড়াত আর রাত হলে বাবার সঙ্গে গপ্পো করতে আসত। বাবা ফ্রিতে হুইস্কি খাওয়াত। সেইজন্যেই ডক্টর পালিতের আসা। বাবা কখনাে ব্লাডপ্রেসার—কখনাে সুগার—কখনাে কোলেস্টেরলের কথা বলত—আর ডক্টর পালিত ট্যাবলেট, ক্যাপসুল সব দিত। সেই ওষুধগুলাে খেয়েই এমন হল না তাে বাবার?

প্রেসক্রিপশন আছে? | না। ছােটোকাকাও দেখতে চেয়েছিল। ডাক্তারবাবু চুক চুক করে হুইস্কি খেত আর পকেট থেকে ওষুধ বের করে দিত।

বােধহয় ডক্টরস স্যাম্পেল নন্দা—কী ভয়ঙ্কর! যা ট্যাবলেট, ক্যাপসুল ফ্রি পেত—ফ্রিতে কয়েক পেগ গিলে তােমার বাবাকে গেলাত।

 হ্যা। বাবাও তক্ষুনি জল দিয়ে খেয়ে নিত।

তােমরা বারণ করতে না?

আমরা কি সব সময় সামনে থাকতাম। আমি তখন ইউনিভার্সিটির পর ফ্রেঞ্চ শিখতে যাই। মা নিজের গানের ক্লাস নিয়ে ব্যস্ত। কী একটা কেসে

এক রুগী মারা গেল। অমনি ডক্টর পালিত এ তল্লাট থেকে চম্পট—

লােকটা ডাক্তার ছিল কি আদৌ? আজকাল সবই হয় নন্দা— অত বয়স অব্দি কেউ ভান করতে পারে? ঠিক এইসময় লিভিংরুম থেকে সুরেলা গলা ভেসে এল। সঙ্গে সঙ্গে নন্দা মনে মনে বলল, বিলাসখানি! মায়ের গলা এখনাে কী ভালাে! দিব্যি ভৈরবী ঠাটে মা ধরেছে।

বেলা গাইছেন—মরা সইয়া বুলাওয়ে আধি রাত—

বাইরে থেকে ঠান্ডা হাওয়া যাতে ঢুকতে না পারে সেজন্যে কাচের জানলা সব কটা বন্ধ। লিভিংরুমটি বেশ বড়াে। একপাশে কিচেনের লাগােয়া বড়াে ডাইনিং টেবিল। পাশেই দেওয়ালে বিল্ট ইন সেলফ—তাতে কাচের শাটার। বাইরে থেকে দেখা যায়—ভেতরে নানা রকমের পানপাত্র। হয়তাে অনেকদিন বেরই করা হয়নি। কিংবা কালই ধুয়ে রাখা। বেলা সেন চেয়ারে হেলান দিয়ে ডাইনিং টেবিলে বসে। চোখ বােজা। তাঁর মাথার পেছনে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে। মেয়েটি দুই হাতে বেলার মুখে কী মাখাচ্ছে।

নন্দা বুঝল, ঘুরে ঘুরে বাড়ি বাড়ি রূপটানের কাজ করে বেড়ানাে সেই মেয়েটি এসে তার মায়ের মুখে মাস্ক লাগাচ্ছে। মেয়েটির স্বপ্ন, এভাবে বাড়ি বাড়ি ঘুরে রােজগারের পয়সা জমিয়ে সে একদিন বড়াে রাস্তায় একটি বিউটি পারলার খুলবে।

বেলা সেন ফের গেয়ে উঠলেন—মেরা সইয়া বুলাওয়ে আধি রাতে-এ-এ। কাচবন্ধ লিভিংরুমে ‘বুলাওয়ে আধি রাতে একদম গড়াগড়ি খেয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তেল তেল মােজাইকের ওপর দিয়ে। নন্দা লিভিংরুমে ঢুকল না। পর্দার ফাক দিয়ে দেখতে পেল—তার মা মুখে মাস্ক লাগিয়ে এক উদাসী বিষাদ মাখানাে গলায় গাইছে—বুলাওয়ে আধি রাতে-এ নদীয়া বৈরী ভয়ি-ই-ই নাওয়ে পুরানি… অরিন্দমও দাঁড়িয়ে পড়ে চুপ করে শুনছে। হঠাৎ নন্দা দেখতে পেল, তার বাবা লিভিংরুমের সেই তেল তেল মেঝেতে বসে পড়ে তার মায়েরই পার্স হাতড়াচ্ছে। চোখ বন্ধ বলে মা দেখতে পাচ্ছে না।

 টোরি দুপুর শেষে গায়। মা ভােরের ভৈরবী মাখিয়ে শীতের পড়তি দুপুরে গাইছে। চোখ বুজে। নন্দারও গানে তালিম তার মায়েরই হাতে।

নীলমাধবের হাতে কিছুকাল হল কোনাে পয়সাকড়ি দেওয়া হয় না। পয়সা পেলেই সে বেরিয়ে গিয়ে এটা সেটা কিনে খায়। চকোলেট। কাটলেট। ওমলেট।

সারা বাড়ির ভেতর তখন কয়েকটা কথা ভারী হয়ে ছিড়ে ছিড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ভীষণ উদাসী বিষাদে—বুলাওয়ে আধি রাতে নদীয়া-আ বৈরী নাওয়ে পুরানি। রূপটানের মেয়েটি গানের ভেতরেই চাপা গলায় বলল, গাইবেন না। মাস্ক ঘেটে গিয়ে মুখে রিংকিল পড়বে বেলা সেন চোখ বুজেই ধমকে উঠল, পড়ে পড়ুক। আমার ইচ্ছে আমি গাইব— | কিন্তু আর গাইতে পারলেন না বেলা সেন। চোখ খুলে যাওয়ায় তিনি নীলমাধবকে দেখতে পেলেন। পাজামা পাঞ্জাবি-পরা নীলমাধব মেঝেতে লেপটে বসে ফ্রিজের নীচে হাত পাঠিয়ে কী খুঁজছেন। পাশেই বুক খােলা পার্সটা পড়ে। নিশ্চয় কোনাে কয়েন গড়িয়ে ফ্রিজের নীচে চলে গেছে। খেতে খেতে উঠে যাওয়া অরিন্দমের মাখা ভাত সমেত প্লেটটা টেবিলে পড়ে। নন্দা দেখল—তার বাবার প্লেট পরিষ্কার একদম। কিছুই ফেলেনি বাবা। মা আর তার প্লেটেও ভাত পড়ে আছে। ঠিকে কাজের মেয়েটি বিকেল হলে এসে সব পরিষ্কার করবে।

বেলা নীলমাধবকে ডাকলেন—এই শােন। টেবিলে এসে বােস।

নীলমাধব এলেন না। মেঝেতে উপুড় হয়ে শুয়ে ফ্রিজের একদম নীচে ডান হাত পাঠিয়ে দিলেন। বেলার ভয় হল। যদি শক খায়। তিনি ফের গেয়ে উঠলেন—নাওয়ে পুরানি কেবট মাতােয়ারা-আ-আ। শুনে নাহি বাতে-এ-এ। শুনরে মালা হু তেরি-ই নইয়া লাগাদে পারে—এ পর্দার ওপাশে দাঁড়ানাে নন্দা—অরিন্দম দুজনই টের পেল গানের শেষটায় গলা বুজে আসছে। বেলা সেনের গলায় শীতের অন্ধকার মাখানাে। তবু তা মাতােয়ারা হয়ে সারা বাড়ি ঘুরে বেড়াচ্ছে। নন্দার পরিষ্কার মনে পড়ে—তার ছােটোবেলায় সে দেখেছে—তার মায়ের রেওয়াজের সঙ্গে বাবা বাঁয়া-তবলায় দিব্যি ঠেকা দিয়ে চলেছে। মাঝে মাঝে তবলার কালাে গােলটায় ট্যালকম পাউডার ঢালত বাবা। কোনাে কোনােদিন তার বাবার অফিসের জুনিয়র কলিগরা— বসন্ত রানাডে, অবিনাশ কাউর, রাহুল দীক্ষিত মাথা নেড়ে নন্দার মায়ের গানে কেয়াবাত দিত। গানের কোনাে একটা ফেরতা চরণ ভালাে লেগে গেলে ওরা বলত, ভাবিজি ফিন আউর এক দফে— শুনে নাহি বাতে-এ-এ ফিরিয়ে ফিরিয়ে গেয়েও বেলা নীলমাধবকে মেঝে থেকে তুলতে পারলেন না। সারা মুখে মাস্কের মিশেল মাখানাে। শুকিয়ে যেতে সময় দেওয়া দরকার। তারপর তুলে ফেলার পালা। শুকোনাে অব্দি কথা না বলে চুপ করে বসে থাকার কথা। গানের সুর বেলা সেনকে টোড়িতে নিয়ে যাচ্ছিল। মাস্ক শুকিয়ে উঠতে উঠতে দুই গাল টেনে ধরছে। অরিন্দম কিছু খেয়ে উঠে গেছে। নীলমাধব না বলে পার্স খুলতে বসে গড়ানাে কয়েনের খোঁজে ফ্রিজের নীচে ইলেকট্রিকের ছােবল না খায়। সব মিলিয়ে বেলা সেনের সহ্য করার সুতােটা পটাং করে ছিড়ে গেল। তিনি চিৎকারে ফেটে পড়লেন—

এই শুয়াের। উঠে আয় বলছি। আয়—একা আমাদের সবার জীবন অতিষ্ঠ করে তুললি—আর কথা বেরােল না বেলার গলায়। চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে এল।

নীলমাধব কিন্তু ফিরেও তাকালেন না।

রূপটানের মেয়েটি ভয় পেয়ে ব্যাগ গুছিয়ে চলে যেতে যেতে বলে গেল, ঠান্ডা জলের ঝাপটায় মুখটা ধুয়ে নেবেন কিন্তু

 বেলা সেন তার কোনাে জবাব দিলেন না। চোখ মুছে খুব মিষ্টিগলায় ডাকলেন—বান্টি, এই বান্টি !

ঘচ করে ঘুরে তাকালেন ডঃ নীলমাধব সেন। বেলা জানেন, নীলমাধব আর যা-ই ভুলে যান—মরে যাওয়া কুকুরের নামটা তিনি হারাননি—যদিও অনেকদিন হল—তাঁর সামনে থেকে বান্টির ছবি সরিয়ে ফেলা হয়েছে।

বেলা খুব নরম করে ডাকলেন, এখানে এসাে! এসাে-ও লক্ষ্মীটি। কাম হিয়ার

অবাক হয়ে নীলমাধব বেলার দিকে ঘুরে তাকালেন কিন্তু মেঝে থেকে উঠলেন না।

বেলা সেন মনে মনে বললেন, না-পাগল—না-অসুস্থ—এ যে কী তা বুঝি—

 রাগে দুঃখে কপাল কুঁচকে গিয়ে বেলার মুখে শুকিয়ে ওঠা মাস্কের খড়খড়ে মিশেলের খানিকটা সাদা সানমাইকা ঢাকা টেবিলে পড়ল। গুঁড়াে গুঁড়াে। তিনি মনটা মােলায়েম করে তােলার চেষ্টা করলেন। তারপর ফের ডাকলেন—এই বান্টি! আয়-আয়—এসাে—মেঝে থেকে নড়ে চড়ে বসে নীলমাধব উঠে দাঁড়ালেন। সিধে। লম্বা। মাথার কঁচাপাকা চুল কপালে এসে পড়ল। সাদা পাজামার একদিক মেঝের ধুলােয় কালাে মতাে—পাঞ্জাবির ডান হাতায় ফ্রিজের নীচের ঝুল। তিনি যেন কী করবেন বুঝতে পারছেন না। কোনদিকে যাবেন? এগােবেন? না, পিছােবেন? না, শুধু যেমন আছেন—তেমনি দাঁড়িয়ে থাকবেন। তার সামনে চেনা একজন কে বসে আছেন টেবিলে—যার সারামুখ কীসে ঢেকে গেছে। ঠিক চিনতে পারলেন না নীলমাধব।

বেলা সেনকে বহু কষ্টে শেষ পর্যন্ত বলতেই হল, আঃ। তু তু! আঃ !

মায়ের মুখে এই ডাক শুনে পাশের ঘরে নন্দা একটা শব্দ করে দুহাতে চোখ ঢেকে ফেলল।

ডঃ নীলমাধব সেন এবার বেশ হাসিমুখে হেলে দুলে বেলার উলটোদিকে টেবিলের এপারের চেয়ারটায় এসে বসলেন।

আমি কে? আঁ? আমি কে? আপনি। আপনি খুব সুন্দর। কে আপনি?

বেলা সেন মাস্কসুদ্ধ হাতের আঙুলে দুচোখ চেপে ধরে টেবিলে নিজের কপাল নিচু করে রাখলেন।

নীলমাধব আবারও বললেন, আপনি খুব সুন্দর। কে আপনি? আপনি কে? | রাগ আর দুঃখ একই সঙ্গে বেলার মাথার ভেতর দিয়ে ওপর দিকে ঠেলে উঠল। তিনি টেবিলে জোরে জোরে নিজের কপাল ঠুকতে লাগলেন। আর পারি না। তাের হাত থেকে কি আমার মুক্তি নেই?

সঙ্গে সঙ্গে নীলমাধব ফের বললেন, আপনি খুব সুন্দর। আপনি কে? কে আপনি?

পর্দার ওপারে ভেতর ঘরে নন্দা বলে উঠল, আর পারছি না। দমবন্ধ হয়ে আসছে। চলাে কোথাও ঘুরে আসি।

চলাে—

ওরা যখন দরজা খুলে বেরিয়ে গেল—বেলা ওদের দেখতে পেলেন না। তিনি তখন টেবিলে কপাল ঠেকিয়ে বসে আছেন। মুখময় শুকিয়ে যাওয়া মাস্ক। বেলার নােয়ানাে মাথার কাঁচাপাকা সিঁথির মুখােমুখি নীলমাধব বসে। তিনিও ওদের বেরিয়ে যাওয়া দেখতে পেলেন না।

নন্দা দেখল—তার বাবা বসে বসে বিড়বিড় করে কী বলে চলেছে।

নীলমাধব আরও কয়েকবার বললেন, আপনি খুব সুন্দর। আপনি কে? কে আপনি? | কোনাে সাড়া না পেয়ে তাঁর চোখ বুজে এল। অমনি তিনি দেখতে পেলেন—তাঁর দেখতে পাওয়া জগতের আকাশে চারদিক থেকে গাছপালার ঝুপসি ছায়া নেমে এসেছে। ছায়ার তলায় হাঁটতে হাঁটতে তিনি কয়েকটা মােটা গুড়ির গাছের বাকলে হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখলেন। দেখে বিড়বিড় করে বললেন—এর কোনাে ইতিহাস নেই। বিয়ন্ড মেমারি। প্রাগৈতিহাসিক। যতই তিনি হাঁটছেন—তার পায়ের নীচে শুকনাে পাতা মুচমুচ করে ভেঙে যাচ্ছে। ডান হাতেই বুক ভর্তি জল নিয়ে কঙ্গো বয়ে চলেছে। এই রিভারবেডের নীচেই পৃথিবীর রিচেস্ট কপার রিজার্ভ। একটা বিশাল কুমীর নীলমাধবকে আসতে দেখে সড়াৎ করে জলে নেমে গেল। ডাঙায় শুয়েছিল এতক্ষণ।

নীলমাধব বাঁদিকে তাকালেন। বড়াে ফ্রিজের মাথায় সদ্য সদ্য নিউইয়র্ক ফেরত পাঁচ ব্যাটারির টর্চটা তাঁর দিকে তাকিয়ে। ওটা ডান হাতে বাগিয়ে ধরলে তিনি বেশ কনফিডেন্স ফিরে পান। যেন-বা হাতে আর মনে আরাম হয়।

সঙ্গে সঙ্গে ডঃ নীলমাধব সেন টর্চটা বাগিয়ে ধরেই দেখতে পেলেন দরজা খােলা। সঙ্গে সঙ্গে তিনি সিঁড়ি দিয়ে রাস্তায় নেমে এলেন। উঃ! কী আনন্দ। রাস্তার মাথায় মাথায় দলা পাকানাে ধোঁয়ার সঙ্গে শীত। দূরে একটা লাইটপােস্টে আলাে জ্বালাবার জন্যে মই বেয়ে লােক। সব রাস্তাই তাঁর চেনা লাগছে। খানিক এগিয়ে নীলমাধবের মনে হল—সব কেমন অচেনা। দূরে একটা দোতলা বাড়ির দেওয়ালে খুব করে লাল লাগানাে। কাছে গিয়ে চিনলেন। আরে! এ তাে ডাকঘর।

ভেতরে দিনের বেলাতেই ডুম জ্বলছে। বাইরে হিম আকাশে কোনাে আলাে নেই আজ। কাউন্টারে গিয়ে নীলমাধব—খুপরির ভেতর হাত ঢােকালেন।

ছােকরা মতাে যে বসেছিল—সে চমকে উঠল, কী ব্যাপার?

আমার টাকা ? কীসের টাকা ?

বাঃ! আমার যে-টাকা জমা রয়েছে। সেদিন বললেন, মােটা টাকা—আগাম চিঠি দিয়ে যান—তুলে রাখব।

লােকটির গায়ে কলারওয়ালা সাদা ফুলশার্ট। সে অবাক হয়ে বলল,পাশ বই এনেছেন? | পাঞ্জাবির পকেটে হাত গলিয়ে নীলমাধব দেখলেন, কিছু নেই। আনতে ভুলে গেছি ।

বাঃ! পাশবই ছাড়া টাকা তুলতে এসেছেন। —এই করে আপনি আমায় প্রায়ই ঘােরাচ্ছেন! আমার টাকা আমি তুলতে পারব না?

লােকটি আরও অবাক হল। তারপর নীলমাধবের হাতে টর্চটা দেখে হেসে বলল, ভালাে করে দেখুন তাে! এই ডাকঘরে কি আপনি টাকা রেখেছিলেন?

একথায় নীলমাধব হকচকিয়ে গিয়ে ডাকঘরের ঝুল জমা সিলিঙে তাকাল। শেষে বলল, চিনতে পারছি না।

ভালাে করে মনে মনে মিলিয়ে দেখুন !

সঙ্গে সঙ্গে আর যারা কিউ দিয়ে দাঁড়িয়েছিল—তারা সবাই হাে হাে করে হেসে উঠল এক্সঙ্গে।

সেই হাসির ধাক্কায় বাইরে বেরিয়ে এসে ডঃ সেন ফুটপাথে দাঁড়ালেন। বাইরে থেকে ডাকঘরটা ভালাে করে দেখলেন। তাঁর মনে পড়ল, তিনি সত্যিই একটা ডাকঘরে প্রায়ই যেতেন তাঁর নিজের টাকা তুলতে। কাউন্টারে লােকটি তাকে শুধুই ঘােরাত। আজ টাকা নেই—কাল আসুন। আজ অ্যাপলিকেশন দিয়ে যান। পরশু তুলে রাখা হবে।

সেই পরশু আর কোনােদিন আসেনি। শেষবার তিনি যখন একা যান—তখন | লােকটি বলল, আপনার সই মিলছে না।

নীলমাধব বলেছিলেন, সতেরাে বছর আগে টাকা রেখেছি। সতেরাে বছরে সই বদলে গেছে। আমার টাকা আমি পাব না?

সই এফিডেভিট করে আনুন। এফিডেভিট ?

বুঝলেন না? বেশ—কোনাে গেজেটেড অফিসারকে দিয়ে সই অ্যাটেস্ট করে আনুন।

আমি নিজেই একজন গেজেটেড অফিসার। সিনিয়র ক্লাস ওয়ান গেজেটেড অফিসার।

 তাও টাকা তােলা যায়নি। এসব কথা ফুটপাথে দাঁড়িয়ে মনে পড়ায় নীলমাধবের একবার মনে হল—এ কি আমার জীবনের কথা? না, আমার গতজন্মের কথা? এমন যেন কোথায় একবার ঘটেছিল।

একটা ট্যাক্সি এসে দাঁড়াল। তার পেছনের কাচে স্টিকারে লেখা—সত্যেন্দ্র ছাতু।

কোনাে ঠিকানা নেই। তাহলে কোথায় পাওয়া যাবে? এত বিখ্যাত ছাতু যে কোনও ঠিকানাই লাগে না। আশ্চর্য! ফুটপাথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে নীলমাধব ছাতুর দোকান খুঁজতে লাগল।

একটা দোকানকে ছাতুর দোকান ভেবে এগিয়ে গিয়ে দেখল—সেটা আসলে গুড়ের দোকান। বাতাসাও পাওয়া যায়। সেই দোকানের গায়ে বড়াে পােস্টার সাঁটা। আলাে কম। তবু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়লেন নীলমাধব। বৈদ্যরাজ এ পি লােধ সর্বপ্রকার গুপ্তরােগ। দুরারােগ্য ব্যাধি। গ্যারান্টি সহকারে।

সারাইয়া থাকি। ধ্যাবড়া করে ছাপা এ পি লােধের ছবি দেখে চিনতে পারলেন নীলমাধব। একজন এ পি লােধ তার ডিপার্টমেন্ট থেকে লিয়েন নিয়ে ও এন জি সি-তে গিয়েছিল। তখন বােদরায় ধানখেতে অয়েল ড্রিলিং চলছে। কাছে চোখ নিয়ে গিয়ে ভালাে করে দেখলেন নীলমাধব। টর্চের ফোকাস মেরে। তারপর বিড়বিড় করে বললেন, ডাক্তার হয়ে তুমি মােটা হয়ে গেছ অংশুপ্রকাশ। চেনাই যায় না।

এবার হাঁটতে হাঁটতে নীলমাধব নানান রাস্তা আবিষ্কার করতে লাগলেন। সন্ধে হয়ে আসায় তাঁর সুবিধাও হল। একটু আবছা দেখলেই তিনি পাঁচ ব্যাটারির টর্চের ফোকাস মারেন। ছায়ার ভেতর বাড়ি, অটোর পাছা, ধর্মের যাঁড়—সবকিছু ফোকাসের গােল্লার ভেতর পড়ে ঝকঝক করে ওঠে।

এইভাবেই একটা সাইনবাের্ড চকচক করে উঠল।

আমরা জার্মান পদ্ধতিতে

তােতলামি সারাই

বহুদিনের পুরনাে তােতলামি।

ফোকাস মেরেও বাকিটা পড়তে পারলেন না নীলমাধব। নিশ্চয় গত বর্ষায় বাকিটা ধুয়ে গেছে। তবু হাতে টর্চ ঝুলিয়ে নীলমাধব দাঁড়িয়ে পড়লেন। যদি বাকিটা পড়া যায়।

ঠিক এই সময় কে খপ করে তাঁর হাত ধরল। নীলমাধব চমকে উঠলেন। একটা অজানা ভয়ে তিনি কুঁকড়ে গেলেন।

বাবা। একা একা তুমি এত দুরে চলে এসেছ? নন্দার পাশেই অরিন্দম। এ আপনি ঠিক কাজ করেননি। মা কোথায়? নীলমাধব কোনাে জবাব দিতে পারলেন না।

মা মানে বেলা সেন টেবিলে কপাল চেপে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। মাথায় কে হাত রাখতে চমকে তড়াক করে উঠে দাঁড়ালেন তিনি।

আবছা মতাে কে একজন দাঁড়িয়ে। মাথাটা কঁচাপাকা মনে হল। ভয় পেয়ে গেলেন বেলা সেন। তিনি মাথার পেছনে সুইচ টিপে দিলেন। অন্ধকার হয়ে আসা লিভিংরুম দপ করে জেগে উঠল।

কে? কে আপনি? আপনাকে তাে চিনি না।

লম্বা, কালাে, ছাই রঙ সুটপরা কঁচাপাকা মাথার লােকটি মিটিমিটি হেসে শান্ত গলায় বলল, হােয়াট হ্যাজ হ্যাপেনড টু ইউ ?

এমন ফ্রেন্ডলি ভরাট গলাতেও বেলা সেনের ভয় কাটল না। তিনি তখনাে দাঁড়িয়ে।

ইউ কানট রেকগনাইজ মি ভাবিজি!

কে? আই অ্যাম ইওর বসন্ত ও ! রানাড়ে— হােয়ার ইজ স্যার এন এম ?

কান্নায় ভেঙে পড়লেন বেলা সেন। চেয়ারে বসে পড়ে কোনও রকমে বলতে পারলেন, নীলমাধব ইজ নাে মাের—

চিৎকার করে উঠলেন বসন্ত রানাডে। হােয়াট হ্যাপেনড় টু হিম?

নিজের ভুল শুধরে নিয়ে বেলা সেন ফের বললেন, নীলমাধব ইজ নাে মাের নীলমাধব।

ওঃ। বলে উল্টোদিকের চেয়ারে বসন্ত ধপ করে বসে পড়লেন। ইউ ভারচুয়ালি স্কেয়ারড মি। হােয়ার ইজ হি? দি গ্রেট রিটায়ার্ড কপার ম্যান! হােয়ার হ্যাজ হি গান? ডিপার্টমেন্টমে উসনে হাম লােগােকা টিচার থা। বিশ সাল পহলে স্যার হাম য্যায়সে না-লায়েককো কপার কো অ্যায়সে লেসেন দিয়া কেয়া আজ তক ভুল না সাকে—বলতে বলতে বসন্ত জানাল, কেন সে নন্দার বিয়েতে আসতে পারেনি। শেষে হিসেব করে বলল, শেষবার সে এই ফ্ল্যাটে এসেছিল আট বছর আগে। মাঝেমধ্যে যা কথা হয়েছে তা টেলিফোনেই। ব্যাঙ্গালােরেই সেন্টার করে এই তেরাে বছর সে পশ্চিমঘাট পবর্তমালায় ক্যাম্প করে আছে রক ফসফেটের খোঁজে। বসন্তকে ভালাে করে দেখলেন বেলা। নাকের নীচে ভাজ পড়েছে মারাঠি জিওলজিস্টের। কপাল কিছু বড়াে হয়েছে। চুলে সাদা পাউডার ছড়ানাে।—ওভাবে

আমার দিকে তাকিয়াে না বসন্ত।

আই স্টিল লাভ ইউ বেলা। উহু। তুমি আমার গান ভালােবাসতে। মিথ্যে কথা বােলাে না। আমি তােমাকে ভালােবাসে

অনেকদিন পরে বেলা হেসে উঠলেন। সেই ভুল বাংলা ! এখন আর ভালােবাসার কথা বােলাে না। আমি বুড়ি হয়ে গেছি। ডান পায়ে হাঁটতে গেলে লাগে।

আমি আজ এখানে থাকবে বেলা—আগের মতাে—গেস্ট হাউসে উঠেছ নিশ্চয়ই—সেখানেই থাকবে। আগে দেখি— তােমাদের এন এম কোথায়? এই নন্দা ?

নন্দা ? হােয়ার ইজ শি? বহুত দিন হুয়ে উনকো নেহি দেখা—

নন্দা এখানে থাকে উইথ হার হাজব্যান্ড। ওরাই তােমাদের এন এম-কে দেখে। নইলে আমি একা পারব কী করে?

 হােয়াট হ্যাজ হ্যাপেনড টু স্যার—

হি ক্যান নট রিমেমবার—কিছুই মনে রাখতে পারে না—পারলেও সব সময় হি ক্যান নট স্পিক আউট | হােয়াই? ইনটেলেক্ট ওয়াইজ হি ওয়াজ অ্যাবভ এভরিবডি। হাম সব উনকা ফ্যাকাল্টিকা আভেরি হুঁ।

হি ইজ নট দি সেম নীলমাধব এনিমাের। ব্রেইন সেল আস্তে আস্তে শুকিয়ে যাচ্ছে। এই না?

 কোনাে জবাব পেলেন না বেলা সেন। এবার তাঁর কপালে ভাঁজ পড়ল। তুমি যে এলে দরজা খােলা ছিল ?

ইয়েস।

তড়াক করে উঠে দাঁড়ালেন বেলা। দেখলেন, ফ্রিজের ছাদে টর্চটা নেই। ছুটে ভেতরের ঘরে গেলেন। নাঃ! কেউ নেই।

লিভিংরুমে এসে বললেন, তাহলে ওরা ওদের বাবাকে নিয়ে হাঁটতে গেছে নিশ্চয়—চা খাবে? বিকেল হয়ে গেলে এক কাপ চা আমার চাই—

ননা। আমি বেরিয়ে দেখি স্যার আসছে কিনা। তুমি চা খাও। স্যার এলে একসঙ্গে খাব আমি।

আরে দাঁড়াও। কোথায় যাচ্ছ? পথ চিনবে না তুমি।। দিস ইজ ক্যালকাটা বেলা? আই নাে হার টু দি ডাস্ট! দাঁড়াও বসন্ত। কোথাও সেই কলকাতা আর নেই কিন্তু খােলা দরজা দিয়ে বসন্ত রানাড়ে বেরিয়ে গেল। চায়ের জল চাপিয়ে অনেকদিন পরে গ্যাসের সামনে বেলা সেনের দুই গাল একরকমের সুখ, স্মৃতি আনন্দ, লজ্জায় রীতিমতাে ফ্লাশ করল। অবশ্য তিনি নিজে তা দেখতে পেলেন । বসন্ত আগের মতােই ঠিক তেমনই মনােযােগী রয়ে গেছে। চা নিয়ে সবে টেবিলে বসেছেন বেলা—অমনি লােডশেডিং হয়ে গেল। সারা ফ্ল্যাটে একদম মাঝরাতের অন্ধকার। চায়ে এক চুমুক দিয়ে তিনি এমারজেন্সি লাইটটা খুঁজতে লাগলেন। পেলেন না। সব জিনিস এমন নাড়াচাড়া করে নীলমাধব। জায়গার জিনিস জায়গায় পাওয়া যাবে না।

পায়ে ব্যথা। সাবধানে পা ফেলে ফেলে টেবিলে ফিরে আসছিলেন বেলা। এমন সময় খােলা দরজা দিয়ে আলাে পড়ল। ওই ফিরল নীলমাধব। নীলমাধবের টর্চের ফোকাস নিশ্চয়।

ঘরে ঢুকতে ঢুকতে নন্দার গলা। তুমি তাে খেয়াল রাখবে মা-ভাগ্যিস আমাদের সঙ্গে রাস্তায় দেখা—নইলে বাবা তাে রাস্তা চিনে ফিরতেই পারত লােডশেডিংয়ের ভেতর পড়লে কী হত?

হারিয়ে যেত। আর কী হত? আমি আর পারছি না।

যাকে নিয়ে এত চিন্তা সেই নীলমাধব টর্চের ফোকাস মেরে এমারজেন্সি লাইটটা খুঁজে বের করলেন। কিন্তু অনেক টেপাটেপি করেও জ্বালাতে পারলেন না। বেলা জানেন—নীলমাধব অন্ধকার সহ্য করতে পারে না একদম। ভয় পায়। বললেন, জ্বলবে কী করে? তুমি তাে নেড়েচেড়ে আগেই নষ্ট করে রেখেছ!

অন্ধকার তাড়াতেই ডঃ নীলমাধব সেন ইনভার্টারের কাছে চলে গেলেন। টর্চের ফোকাস মেরে সেটা চালু করতে গেলেন। বেলা দেখলেন, তাকের ওপর জ্বালিয়ে রাখা টর্চের আলাের ভেতর নীলমাধবের মাথার চুল কপালে এসে পড়েছে। অনেক কসরত করেও নীলমাধব সেটা চালু করতে পারছে না।।

নন্দা বিরক্ত গলায় বলে উঠল, এ বাড়ির সব মেশিন খারাপ। সব অচল।

কথাটা খচ করে বেলার মাথায় লাগল। কেউ কারও মুখ দেখতে পাচ্ছে না। তাই তিনি বলে বসলেন, একটা মেশিনই শুধু চালু আছে!

কোনটা? এই আমি! নইলে বাড়ি অচল হয়ে যেত। মায়ের এই রসিকতায় নন্দা এখন কোনও চাপান উতাের করতে চায় না। সে বলল, একটু যে গান শুনব—রেডিয়ােটা ঘড়ঘড় করে। টিভি-র পিকচার টিউব নষ্ট। ক্যাসেট প্লেয়ারের হেডটায় ময়লা জমে টিবি

পরিষ্কার করলে পারিস।

সব কি বাড়িতে হয় মা? দোকানে নিয়ে যেতে হবে। কখন যাব? স্কুল। খাতা দেখা। রেকর্ড প্লেয়ারের পিন পাল্টানাে হয়নি কতদিন। কাল ও জামা ইস্ত্রি করতে গিয়ে দেখে শর্ট সার্কিট হয়ে আছে। আরেকটু হলেই শক খেত। আর বাথরুমে! ইমারশন হিটারটার কয়েলে জলের আয়রন লেগে পুরু হয়ে রাস্ট পড়েছে! ছাড়ানাে দরকার। সব। সব অচল হয়ে যাচ্ছে—

আমি একা কি এত পারি! | তােমায় দোষ দিচ্ছি না মা–বলে নন্দা ঘরের ভেতরে সাবধানে পা ফেলে ফেলে এগােল। সারা বাড়ির যন্ত্রপাতি বিকল। সবকিছুর ভেতর বাবা এমন হয়ে গিয়ে সব জট পাকিয়ে দিচ্ছে—

কোনাে কিছু করতে না পেরে টর্চ হাতে ডঃ নীলমাধব সেন লিভিংরুমের পশ্চিম দিকটার তিন ধাপ সিঁড়ি ভেঙে নিজের পড়াশুনাের ছােট্ট ঘরটায় ঢুকলেন। ফ্ল্যাট বানানাের সময় এই চিলতে জায়গাটা বেরিয়েছিল। পাঁচ ফুট বাই এগারাে ফুট। দেওয়াল জুড়ে বই। মেটাল। সয়েল। টপ লেয়ার। প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর ধরে জমিয়ে তােলা বইয়ের লাইব্রেরি। ছােটো টেবিল। টেবিল ল্যাম্প। পিঠের পেছনে দেয়াল কেটে বসানাে ঠান্ডা মেশিন। তার পাশ দিয়েও সব রেয়ার বইয়ের থাক। মানুষের জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, ইতিহাস ঠিকঠাক যাচাই বাছাইয়ের পর বইয়ে এসে ঠেকবে।

আন্দাজে নিজের চেয়ারে গিয়ে বসলেন। তারপর ঠান্ডা মেশিনের নব ঘােরালেন। তাও আন্দাজে। খেয়াল নেই—এখনও লােডশেডিং। হাত থেকে টর্চটা পড়ে গেল। অন্ধকারে হাতড়েও খুঁজে পেলেন না। নিশ্চয় গড়িয়ে গড়িয়ে বইয়ের শেষ তাকের নীচে গিয়ে সেঁধােল।।

ডঃ নীলমাধব সেন মেঝেতে বসে পড়ে ফের হাতড়াতে শুরু করলেন। যদি টর্চটা আঙুলের ডগায় ঠেকে।

নীচু করেছেন ঘাড়—ঠিক সেই সময় একটা শব্দ। কর—ক —

শব্দটার দিকে ডান কান এগিয়ে নিলেন নীলমাধব। তার মন বলল, বইয়ের ভেতর থেকে আওয়াজটা আসছে। ডান কান আরও কাছে এগিয়ে নিলেন তিনি। নাঃ! বই নয়। তাকের কাঠের ভেতর দিয়ে আওয়াজটা আসছে।

 উবু হয়ে কান প্রায় কাঠের তাকে লাগাতেই শব্দটা থেমে গেল। নীলমাধব নিশ্বাস বন্ধ করে একটু পিছিয়ে এলেন। অমনি ফের সেই কর—ক — কররর—। আবার। অবিরাম। কোনাে থামা নেই। ছােট্ট অন্ধকার চিলতে ঘরখানি এই শব্দে ভরে গেল একদম। ডঃ নীলমাধব সেন কী বলতে চাইলেন। কথা বেরােল না। ভেতরে বাধা পাচ্ছে। তিনি তখন মনে মনে বললেন, ঘুণপােকারা টের পায়। দেখতে পায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *