বিলয়বিন্দু – শোভন সোম

বিলয়বিন্দু – শোভন সোম

রঘুকুলপতি বসুরায়চৌধুরী হালের উঠতি বাঙালী ব্যবসায়ী। বংশানুক্রমে তিনি আভিজাত্যের উত্তরাধিকারই পেয়েছিলেন, পেয়েছিলেন তদুপযোগী জমজমাট একটা নাম। কিন্তু তাঁর বাবার আমলে বিত্তের তলানিটুকুও অবশেষ ছিল না। রঘুকুলপতি করিতকর্মা মানুষ। নিজের উদ্যমেই তিনি ব্যবসার মজবুত ভিত গড়ে তুলেছেন। তাঁর ব্যবসার ওঠানামা নিয়ে শেয়ারমার্কেট আলোড়িত হয়। ঠাণ্ডা ঘরে বসে তাঁর সাম্রাজ্য সামলান ম্যানেজমেন্টে ডিগ্রিধারী ঝকঝকে একজিকিউটিভরা।

রিয়্যাল এস্টেট বা ঘরবাড়ির ব্যবসা ছোট ব্যবসা। ওতে ওঁর রুচি নেই। কিন্তু বাল্যবন্ধু চিত্তপ্রকাশকে দেনার দায় থেকে বাঁচাবার জন্য দক্ষিণ পার্ক স্ট্রীট অঞ্চলে তিনি চিত্তপ্রকাশের আধ বিঘে জমির ওপর সেকেলে তেতলা বাড়িটা বেশ দাম দিয়েই কিনে ফেলেছিলেন। এককালে এই অঞ্চলটা দিব্যি নিরিবিলিই ছিল আর সম্ভবত এই বাড়িটাই এখানকার সবচেয়ে উঁচু বাড়ি ছিল। ইদানীং রিয়্যাল এস্টেটের হিড়িকে চারদিকে জিরাফের মত গলা তোলা উঁচু উঁচু বাড়ির সারি এই বাড়িটাকে ঘিরে ফেলেছে।

রঘুকুলপতির ঠাকুরদার বাবা যখন আমহার্স্ট স্ট্রীটে চকমিলান বাড়িটা তুলেছিলেন তখন এই অঞ্চলটা ছিল দেশী আভিজাত্যের সাকিন মোকাম। রামমোহন, বিদ্যাসাগর থেকে এই সেদিনও এই অঞ্চলেই ছিলেন জগদীশ বোস, প্রফুল্লচন্দ্র রায় আর কত বড় বড় মাপের মানুষ। কিন্তু হালে আভিজাত্য ঠিকানা বদলে উত্তর দিক থেকে দক্ষিণমার্গী হয়েছে। ঠিকানাটাও আভিজাত্যের একটা লক্ষণ যা ঠিক জায়গায় না থাকলে অনেক কিছু এসে যায়। বন্ধুকে বাঁচাতে গিয়ে এই বাড়িটা কেনার পর রঘুকুলপতির মাথায় ঠিকানা পালটাবার চিন্তা হঠাৎ চাড়া দিয়ে ওঠে।

কিন্তু মানুষ যা চায় সব সময় তক্ষুনি তা হয় না। চিত্তপ্রকাশদের বাড়িটা একবারে খালি ছিল এক থুথ্থুরে বুড়ো যাঁর বয়সের গাছ পাথর নেই, সাতকুলে ওঁর কেউ আছে কি না তা-ও জানা নেই, এহেন একজন ভাড়াটে ওই বাড়িটার তেতলার পেছনের কোণের ফ্ল্যাটটাতে পাঁজর বেরোন বাড়ির ফাটলে গজানো জেদী অশ্বথ্থ গাছের মত শেকড় গেড়ে বসেছিলেন।

কন্ট্র্যাক্টর বা প্রমোটারের হাতে রঘুকুলপতি বাড়ি তোলার ভার দেন নি। দিয়েছেন নামজাদা আর্কিটেক্টের হাতে। কিন্তু আর্কিটেক্টের সাধ্য কি ওই ষাট সত্তর বছর ধরে এক পয়সাও ভাড়া না বাড়িয়ে পঁচিশ না তিরিশ টাকা ভাড়ায় এখনো গ্যাঁট হয়ে বসে থাকা ভাড়াটে তোলে! আবেদন নিবেদন করে, টাকার টোপ ফেলে, অন্য একটা ফ্ল্যাট দেবার কড়ারেও ওই বুড়োকে টলানো গেল না।

রঘুকুলপতি এমন একটা সামান্য ব্যাপারের জন্য কোন ঝুটঝামেলায় যেতে চান না। ওঁর সামান্য আঙুলের টুশকিতেই বুড়োটাকে তোলা যায়। ওঁর মুখ থেকে কথা খসতে না খসতে কাজ হাসিল করতে পারলে অনেকে ধন্য হয়। ওরা বলেছেও যে রঘুকুলপতি বললেই ওরা এখুনি বুড়োটাকে ঝুঁটি ধরে ঘর ছাড়া করবে।

রঘুকুলপতি ভেবেই পেলেন না যে, চালচুলোহীন একটা ভাড়াটে, যে কিনা ঠিকমত ভাড়াটাও দিতে পারে না সে কেন টাকার টোপ খায় না, নতুন ফ্ল্যাট বিনি পয়সায় দিলেও যেতে চায় না, অথচ এই ঝরঝরে ভুতুড়ে বাড়িটাতেই মরতে চায়!

একদিন গরমের বিকেলে রঘুকুলপতি বালিগঞ্জ থেকে লান্সডাউন রোড হয়ে ফিরছিলেন। অনেকদিন বাদে সেদিনও হঠাৎ সেকালের মত দক্ষিণের হাওয়া হঠাৎ বইল। রাস্তার দু পাশের ফুলন্ত জারুল গাছগুলো হঠাৎ চঞ্চল হয়ে উঠল। রঘুকুলপতির মনটাও হঠাৎ চনমন করতে লাগল। তিনি ড্রাইভারকে গাড়ি ঘোরাতে বললেন।

মালিককে আচমকা আসতে দেখে হাতের খৈনি ফেলে দরোয়ান হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এল। ড্রাইভার নেমে গাড়ির দরজা খুলতেই রঘুকুলপতি গাড়িবারান্দার মুখোমুখি সিঁড়িতে পা দিলেন। গোটা বাড়িটায় জরা ধরেছে। সিঁড়িতে কস্মিনকালে ঝাঁট পড়ে না। সেকেলে সৌখিন বাড়ির গাড়ি বারান্দায় পঙ্খের বাহারি নকশা ঝুলের পুরু চাদরে একেবারে গায়েব। চারপাশে বোঁটকা গন্ধ। পকেট থেকে রুমাল বার করে রঘুকুলপতি নাকে চাপা দিলেন।

সিঁড়িতে আলো নেই। কাঠের রেলিঙ নড়বড় করছে। সাবেক বাড়ির এক-একটা তলা একেলে বাড়ির দোতলার সমান উঁচু। তেতলা উঠতে ওঁর হাঁপ ধরল। রঘুকুলপতি কলিংবেল টিপেছিলেন, কিন্তু ঘন্টা বাজল না। ঘণ্টা না বাজলেও দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন এক থুথ্থুরে বুড়ো। নিদন্ত মুখে একগাল হেসে দু হাতে দুটো কপাট মেলে ধরে তিনি বললেন, পায়ের শব্দেই টের পেয়েছি যিনি আসছেন তিনি সামান্য লোক নন। কি সৌভাগ্য আমার, আসুন, আসুন। আমিই কালোশশী দস্তিদার। ওই বেল বাজবে না। বিল মেটাতে পারি নি। বিজলির লাইন কেটে দিয়েছে।

হাঁপাতে হাঁপাতে বিরক্তির স্বরে রঘুকুলপতি বললেন, বসতে আসিনি। একটা কথা বলতে এসেছি।

কালোশশী বললেন, একটা কেন, একশটা কথা বলবেন। কিন্তু আপনি হাঁপাচ্ছেন যে, একটু জিরিয়ে নিয়ে বলবেন। দাঁড়ান, একটা মোমবাতি জ্বালাই।

দেরাজ হাতড়ে দেশলাই বার করে কালোশশী একটা মোমবাতি জ্বাললেন। একটা উটকো ভাড়াটের সঙ্গে বৃথা গল্প করতে রঘুকুলপতি আসেন নি। ঘরে ঢুকে তিনি বললেন, দেখুন মিস্টার—

—দস্তিদার, কালোশশী দস্তিদার।

—হ্যাঁ, মিস্টার দস্তিদার। আপনি তো জানেনই যে, এখানে আমি একটা বাড়ি তুলতে চাই—

—হ্যাঁ জানি। আপনার লোক আমার কাছে এসেছিল। আপনি আমাকে উঠে গেলে টাকা দেবেন, ফ্ল্যাট চাইলে ফ্ল্যাট দেবেন। আপনি সদাশয় ভদ্রলোক। আমি আর কদিনই বা বাঁচব। এই বাড়িতে ঢের দিন আছি। এর প্রত্যেকটা ইট আমার হাড়েমজ্জায় একেবারে গেঁথে গেছে। আমি এখানেই মরতে চাই। কটা দিনের জন্যে আমাকে দয়া করে বেঘর করবেন না, দোহাই আপনার।

রঘুকুলপতি আর কথা বাড়ালেন না।

পরদিনও তিনি টালিগঞ্জ থেকে আশুতোষ মুখুজ্যে রোড ধরে ফিরছিলেন। সেদিনও বিকেলে তেমনি চনমনে হাওয়ায় বেগনি জারুলে ছাওয়া ডালগুলো হঠাৎ চঞ্চল হয়ে উঠেছিল। আকাশের নীল শামিয়ানায় টুকরো টাকরা ভাসন্ত মেঘ অস্তরশ্মির যাদুতে আশ্চর্য রঙিন মায়া বিছিয়েছিল। ড্রাইভারকে তিনি গাড়ি ঘোরাতে বললেন।

আগের দিনের মত কালোশশী দরজার দুটো কপাট দু হাতে খুলে একগাল নিদন্ত হাসি হেসে বললেন, আসুন আসুন। দু মাসের ভাড়া আজ জোগাড় করেছি। কালই গিয়ে দিয়ে আসতুম। বসুন। আপনি যখন এসেই গেছেন, ভাড়াটা দিয়ে দিই।

এহেন প্রস্তাবে বিরক্ত হলেও রঘুকুলপতি না হেসে পারলেন না। বললেন, আপনার রেস্ত আমার বিলক্ষণ জানা। ছুঁচো মেরে আমি হাত গন্ধ করি না। বরং আমিই আপনাকে বেশ কিছু টাকা দিচ্ছি। আপনি ফ্ল্যাটটা ছেড়ে দিন।

মোমবাতির আলোতেও রঘুকুলপতি দেখতে পেলেন যে, বৃদ্ধের মুখ কঠিন হয়ে উঠল। তিনি বললেন, দেখুন, আমি খেটে খাই। কারো দয়াদাক্ষিণ্যে শেষ কটা দিন বাঁচতে চাই না।

—খেটে খান? এ বয়সেও? কি করেন আপনি?

—ছবি আঁকি, ছবি বেচে খাই।

—ছবি আঁকেন! তাতে চলে!

—চলে যায়। আমি ভিয়েনা অ্যাকাডেমিতে ছবি আঁকা শিখেছিলাম। তখন ইয়োরোপে ছবি আঁকা শিখতে যাবার খুব হিড়িক ছিল। জানেন বোধহয়, হিটলারও ভিয়েনা অ্যাকাডেমির ছাত্র ছিলেন!

রঘুকুলপতি ব্যবসা বোঝেন, ছবিটবি বোঝেন না। মুখ্যমন্ত্রীর ডাকা অকশনে গিয়ে তাঁকেও বেশ ক’লাখ টাকা দিয়ে একটা ছবি কিনতে হয়েছিল। ব্যবসায়ীদের এমনি করতেই হয়। ওই ছবিটার মাথামুণ্ডু তিনি বোঝেন নি। তাঁর ধারণায় ছবি বাউণ্ডুলেরা আঁকে। ছবি এঁকে কিস্সু হয় না।

রঘুকুলপতি তবু কৌতূহলী হলেন, বললেন, ইয়োরোপ থেকে আর কিছু শিখে এলেন না, ছবি আঁকা শিখতে গিয়েছিলেন!

—হ্যাঁ। পোরট্রেট, ল্যান্ডস্কেপ এইসব শিখেছি। মডার্ন আর্টের হাওয়া যতই উঠুক, লোকে এখনো তেমন ছবিই চায় যা কিনা দেখে বোঝা যায়। আঁকাবেন নাকি? আপনার পোরট্রেট! ছবি আঁকিয়ে টাকা দেবেন, সেটা দয়া দেখানো হবে না।

রঘুকুলপতি ঈষৎ প্রলুব্ধ হলেন। এঁকে দিয়ে বাবা মা ঠাকুমা ঠাকুরদার ছবি আঁকিয়ে নিলে মন্দ হয় না। চাই কি, তাঁর স্ত্রী কাঞ্চনকুন্তলার ছবিও আঁকিয়ে নেওয়া যেতে পারে।

তিনি কিছু বলবার আগেই কালোশশী বললেন, পাশের ঘরেই ছবি আঁকি। আসুন, দেখবেন, এখন একটা ছবি আঁকছি।

মোমবাতি হাতে নিয়ে কালোশশী পাশের ঘরের দিকে এগোতে মন্ত্রচালিতের মত রঘুকুলপতি তাঁকে অনুসরণ করলেন।

সারা ঘর জুড়ে ডাঁই করা ওলটানো ক্যানভাস, এটা সেটা জিনিসপত্রের রাশ। ইজেলে কাপড় ঢাকা একটা ক্যানভাস। কাপড়টা তুলে ধরে কালোশশী বললেন, এখন এটাই আঁকছি। জায়গাটা চেনা-চেনা ঠেকছে কি? পুরোন ফোটোগ্রাফ দেখে এঁকেছি।

রঘুকুলপতি দেখলেন ক্যানভাসে আঁকা রয়েছে একটা হলের মধ্যে একটা মিটিঙের ছবি। হলের ভেতরটা একটু চেনা চেনা ঠেকলেও তিনি ঠিক চিনতে পারলেন না।

—কি করেই বা চিনবেন! সেই মাদান থিয়েটার কি আছে! ওটা এখন এলিট সিনেমা। ভাবতে পারেন, ওই হলে, রবীন্দ্রনাথ বক্তৃতা দিয়েছেন, ওঁর নৃত্যনাট্য ওখানে হয়েছে। উনিশ শ পঞ্চাশেও ওই হলে মহালয়ার সকালে রবীন্দ্রসংগীতের আসর বসেছিল।

রঘুকুলপতির মাথার চুল থেকে পা অবধি একটা অলৌকিক বিদ্যুৎ শিহরণ খেলে গেল। হঠাৎ তিনি দেখতে পেলেন যে, তিনি মাদান থিয়েটারে ওপচানো ভিড়ের একজন হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। মঞ্চে স্থূলকায় এক ভদ্রলোক এসরাজ বাজিয়ে দলবল নিয়ে গান ধরেছেন, দেশ দেশ নন্দিত করি মন্দ্রিত তব ভেরি। গানের গমকে সারা ঘর গমগম করছে। ঘরভর্তি মানুষ নিস্তব্ধ হয়ে ওই গান শুনছে। গান শেষ হতেই, আরে ও কে, ওই গাঢ় রঙের জোব্বা, গাঢ় রঙের টুপি পরা দেবপ্রতিম যিনি উঠে দাঁড়ালেন, তিনি কে! তিনি রবীন্দ্রনাথ না! আরে, এ কী করে হয়! কী করে রঘুকুলপতি সময়ের উলটো ধারায় অতগুলো বছর উজিয়ে এলেন! তিনি কি স্বপ্ন দেখছেন!

রবীন্দ্রনাথ উঠে দাঁড়িয়ে অলৌকিক কণ্ঠে বললেন, আজ সরকারী দণ্ডনীতিতে আমাদের কণ্ঠ অবরুদ্ধ। দেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে দেশের কথা বলবার অধিকারও দেশের কর্তারা আজ অপহরণ করেছেন। এই কর্তার ইচ্ছায় কর্মে—

সভা শেষ হলে রঘুকুলপতি ভিড় ঠেলে রবীন্দ্রনাথের দিকে এগিয়ে গেলেন। পকেট থেকে ছোট্ট নোটবই আর কলম বার করে তিনি রবীন্দ্রনাথের সামনে অটোগ্রাফের জন্য মেলে ধরলেন। রবীন্দ্রনাথ সেই নোটবই আর কলম হাতে নিয়ে তাঁর অনবদ্য শৈলীতে লিখলেন শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

রবীন্দ্রনাথের পেছন পেছন তিনিও হল থেকে বেরিয়ে আসতেই দেখতে পেলেন যে তিনি ইজেলে রাখা ছবিটার সামনেই দাঁড়িয়ে আছেন। ঘরে মোমবাতি জ্বলছে আর তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কালোশশীর মুখে মোমবাতির আলোর কাঁপুনিতে ভৌতিক আলোছায়া খেলছে।

রঘুকুলপতির হাতে ধরা নোটবই আর কলম আর নোটবইয়ের খোলা পাতায় রবীন্দ্রনাথের অটোগ্রাফ। একটু আগেই রবীন্দ্রনাথ ওই অটোগ্রাফ দিয়েছেন। অটোগ্রাফের নিচে লেখা ছাব্বিশে শ্রাবণ তেরোশ চব্বিশ। গোটা ব্যাপারটা অলীকদর্শন বা হালুসিনেশন হতে পারে। পি সি সরকারও তো গোটা ট্রেন ভ্যানিশ করে দেন। কিন্তু এই জ্বলজ্বলে অটোগ্রাফটা তো মেকি নয়! এটা কি করে হল। কালোশশী তন্ত্রটন্ত্র করেন নাকি, যাকে বলে ব্ল্যাক ম্যাজিক!

কালোশশী ওঁর বিমূঢ় অবস্থা দেখে হেসে বললেন, যা দেখেছেন তাতে এক চিলতে যাদু নেই। সব সত্যি, দেয়ার আর মোর থিংস ইন হেভেন অ্যান্ড আর্থ দ্যান আর ড্রিমট্ অফ ইন ইয়োর ফিলোজফি। কথাটা আমার নয়, শেক্সপিয়রের। এইমাত্র আপনি উনিশ শ সতেরর এগার অগস্টে দেওয়া রবীন্দ্রনাথের স্পিচ শুনে এলেন। এভিডেন্স তো আপনার হাতেই রয়েছে।

গোটা ব্যাপারটাই ভেলকিবাজি হলেও রঘুকুলপতি ধাঁধায় পড়লেন রবীন্দ্রনাথের সইটাকে নিয়ে। ওটা তো ধাঁধা নয়। তিনি রবীন্দ্রনাথের কাছের মানুষ বাণী চন্দ, প্রশান্তিদেব ঘোষ, বীরেনকৃষ্ণ দেববর্মা, সমুদ্রজয় ঘোষের সঙ্গে দেখা করলেন এবং ওঁরা প্রত্যেকে একবাক্যে বললেন ওটা সত্যিই। পূজনীয় গুরুদেবের স্বাক্ষর।

একবার প্লেনে দীর্ঘপথ যেতে যেতে কি একটা পত্রিকায় রঘুকুলপতি প্যারাসাইকোলজির কথা পড়েছিলেন। গোটা ব্যাপারটাই ওঁর বুজরুকি মনে হয়েছিল। দুঁদে ব্যবসায়ী রঘুকুলপতি জীবনে এই প্রথম সত্যিকার একটা সমস্যায় পড়লেন। জীবনে তিনি হারতে শেখেন নি। কোন এক সেকেলে বুড়ো কালোশশী, আহা রে কি বাহারে নাম, তাঁকে ভেলকি দেখাবে আর তিনি ঠকবেন, তা হবে না।

রইল পড়ে কালোশশীকে উচ্ছেদের চিন্তা, বাড়ি তোলা তো দূরস্থান, তিনি আর্কিটেক্ট কোম্পানীকে বলে দিলেন কিছুদিন বাড়ি তোলার কাজ মুলতুবি রাখতে। আগে তিনি এই সমস্যার সমাধান করবেন, তারপর বাড়িটাড়ি হবে’খন।

রঘুকুলপতি বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন। বিজ্ঞানে বুজরুকির জায়গা নেই। কেমিস্ট্রি আছে, আলকামি নেই; ফিজিক্স আছে, মেটাফিজিক্স নেই। কিন্তু ওঁর যে অভিজ্ঞতা হল সেটা এমনই অবিশ্বাস্য যে কাউকেই বলা যাবে না। কাঞ্চনকুন্তলাকেও না। কাঞ্চন তো কথায় কথায় বলে, যত বুড়ো হচ্ছ তত তোমার ভীমরতি ধরছে। সারাদিন খালি ঠাণ্ডি ঘরে বসে থাকবে। দিন দিন ভুঁড়ি বাড়ছে। কাল সক্কালবেলা থেকে জগিং করবে। বুঝলে!

এসব কথা কাঞ্চনকে বললে এখুনি সাইকিয়াট্রিস্ট ডক্টর বীরেন গাঙ্গুলির সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করবে। ডক্টর গাঙ্গুলিও বলবেন যে রঘুকুলপতি হ্যালুসিনেট করছেন। ছবিতে কেউ আবার ঢোকে নাকি! ছবিতে কেবল ঢোকাই নয়, ঢুকে রবীন্দ্রনাথের সই নিয়ে আসার ব্যাপার কখনো ঘটা সম্ভব!

রঘুকুলপতি মরিয়া হয়ে উঠলেন। এই রহস্য ওঁকে জানতেই হবে। ওসব ম্যাজিক-ফ্যাজিক তিনি বার করে দেবেন।

একগাল নিদন্ত হাসি হেসে কালোশশী বললেন, আমি জানতাম আপনি আসবেন।

ওঁর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে রঘুকুলপতি বললেন, থামুন মশাই, থামুন। বুঝেছি, আপনি ব্ল্যাক ম্যাজিক করেন, কিন্তু ম্যাজিকও তো হাত সাফাই ছাড়া কিছু না। আর যা দেখালেন সেটা মেস্মেরিজম্ও তো হতে পারে। রবীন্দ্রনাথের সইটাও দিব্যি রপ্ত করেছেন দেখছি। এই সব করে লোক ঠকান নাকি!

কালোশশীর মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। তিনি বললেন, বিজ্ঞান কি পৃথিবীর সব রহস্য জানতে পেরেছে! বিজ্ঞান কি থেমে গেছে! আজ যেটা আল্-কিমিয়া কাল সেটা কেমিস্ট্রি। মানুষ কি কোনদিন ভেবেছিল যে সে চাঁদে পা ফেলবে! চন্দ্রগ্রহণ, সূর্যগ্রহণের মত বিজ্ঞানকে মানুষ একদিন গল্পগুজব দিয়ে দেখে নি? মানুষ এখনো বোঝে নি বলেই কি টাইম ট্রাভেল বুজরুকি!

রঘুকুলপতি এ ধরনের বক্তৃতা ঢের শুনেছেন। কাঞ্চনের সময় কাটে না। ও এক গুরুদেবকে ধরেছে। একদিন বাধ্য হয়ে রঘুকুলপতি গিয়েছিলেন কাঞ্চনের গুরুদেবকে দেখতে। উনিও এ সব বক্তৃতা দিয়েছিলেন সেদিন। বিরক্ত হয়ে রঘুকুলপতি আর ওখানে যান নি। কাঞ্চনকে তিনি বলেছেন, দেখ কাঞ্চু, ধন্মোটম্মো নিয়ে তুমিই থাকো, ও আমার কম্মো নয়। রঘুকুলপতি বিরক্তির স্বরে বললেন, হ্যাঁ, মেসমেরিজম্ হিপনোটিজম্ হ্যালুসিনেশন সবই মেনে নিলাম, কিন্তু এতসব করলেন কি করে!

কালোশশী বললেন, আপনি নিজেই বোধ হয় জানেন না যে সেদিন আপনি যা দেখেছিলেন ওসব হাজারে একজনও দেখতে পায় না; কোটিতে হয়তো এক আধজন দেখে। আসলে দেখাটা তো কেবল চোখ দিয়ে দেখা নয়। দেখাটা একটা মুহূর্তকালের ব্যাপারও না, আর নিছক একটা মেকানিজমও না। আপনি দেখতে পান না বলেই কি একটা বিশেষ জিনিসের অস্তিত্ব নেই! মৌমাছি আলট্রা-ভায়োলেট রে দেখে। কই আপনি দেখেন! শোনেন আপনি আলট্রাসোনিক সাউন্ড! শোনেন না। কিন্তু তা বলে এগুলির অস্তিত্ব আপনি নস্যাৎ করে দেবেন! বাহ রে।

অন্য কেউ ওঁর মুখের ওপর তর্জনী নেড়ে এভাবে কথা বললে রঘুকুলপতি দরোয়ান ডেকে ঘাড় ধরে বের করে দিতেন। কিন্তু কালোশশীর এই ভূতুড়ে স্টুডিয়ো, ওঁর মুখে মোমের আলোর কাঁপা কাঁপা রহস্যময় আলোছায়ার নাচ আর সন্ধের আবছা আঁধারে জানালা গলে আসা হাওয়ায় এমন কিছু ছিল যে রঘুকুলপতির মুখে একটাও কথা সরল না।

কালোশশী বলতে লাগলেন, না বুঝে অবিশ্বাস করে বসাটাই মানুষের ধর্ম। মানুষ ভাবে, সে যা জানে তার বাইরে কিছছু নেই। তাই যা সে জানে না সেটাকেই সে ফুঁ দিয়ে ওড়াতে চায়। হ্যাঁ, কাজের কথায় আসুন। আমাকে দিয়ে পোরর্ট্রেট আঁকাবেন।

রঘুকুলপতি বললেন, সে আঁকানো যাবে’খন। আসলে ব্যাপারটা কি করে হল, সেটা বলুন তো!

—তাহলে তো একটা ছোটখাটো বক্তৃতা দিতে হয়। আপনার সে সময় হবে!

—তা না হয় হবে।

—তাহলে এক কাপ চা খান। আমি চা নিয়ে আসি।

—চা থাক। আপনাকেই তো বানাতে হবে। ছেড়ে দিন।

—তাহলে শুনুন। আপনাদের বিজ্ঞানই তো বলে যে পদার্থ অক্ষয়, তার লয় নেই কিন্তু রূপান্তরণ ক্ষমতা আছে। রবীন্দ্রনাথ লেখেন নি, ফুরায় যা তা ফুরায় শুধু চোখে, অন্ধকারের পেরিয়ে দুয়ার যায় চলে আলোকে। শোনেন নি, শেষ নাহি যে শেষ কথা কে বলবে! ব্যাপারটা বুঝেছিলেন উপনিষদের সূক্তপ্রণেতারা, গ্রিক দার্শনিকেরা। প্লেটোর টাইমিয়াস্ থেকেই ইউক্লিড লিখেছিলেন ইলিমেন্টস্। পিথাগোরিয়ানদের সলিড্স থেকেই কেপ্লার তাঁর মহাবিশ্বতত্ত্বের অনেক হদিশ পেয়েছিলেন। কিন্তু আপনারা প্লেটোর কথা শুনবেন না, শুনবেন ইউক্লিডের কথা, কেপ্লারের কথা।

—ভণিতা কবার দরকার নেই। প্রশ্নটা বিশ্বাস অবিশ্বাসের নয়। প্রশ্নটা হল ঘটনার সত্যতা নিয়ে।

—তাহলে আসল কথায় আসি। আপনি ভ্যানিশিং পয়েন্টের কথা নিশ্চয়ই শুনেছেন যাকে বাংলায় বলে বিলয়বিন্দু। বাঙালীরা অবশ্য বিলয়বিন্দু বলে না। বলে ভ্যানিশিং পয়েন্ট। এক নাছোড় অধ্যাপক কি যেন একটা বইতে, হাঁ মনে পড়ছে চিত্রভাবন নামের বইতে, শব্দটার এই বাংলাই করেছেন।

—হ্যাঁ, আর্কিটেকচারাল ড্রইংয়ে ভ্যানিশিং পয়েন্ট ব্যবহার করা হয়।

—তবে শবব্যবচ্ছেদের মতই এই ভ্যানিশিং পয়েন্টের তত্ত্বও প্রথম তৈরি আর ব্যাখ্যা করেছিলেন রনেসাঁসের ব্রুনেলেশচি আর আল্বের্তি। ওঁরা বলেছিলেন কস্তুজিয়ো লেজিত্তিমা। কাগজ বা পটের সমতল ক্ষেত্রে গভীরতা বা দূরত্বের ধারণা তুলে ধরতে পার্স্পেক্টিভের দরকার হয়। পার্স্পেক্টিভের রহস্য হচ্ছে ভ্যানিশিং পয়েন্ট। পার্স্পেক্টিভ সেন্স্ না থাকলে হুবহুর ধারণা দিয়ে ছবি আঁকা যায় না। রোমানরা নাকি এমনই ফল আঁকতেন যাতে এসে পাখিতে ঠোকরাত, তাঁদের আঁকা ফুলে নাকি মৌমাছি এসে বসত। অবশ্য ও-সব অতিরঞ্জন। তখন অতিরঞ্জন ছিল প্রশংসারই নামান্তর। ধান ভানতে শিবের গীত থাক্।

রেললাইনের মধ্যিখানে দাঁড়িয়েছেন কখনো!

—হ্যাঁ।

—কি দেখেছেন? দুটো সমান্তরাল রেললাইন দূরে একটা বিন্দুতে মিলিয়ে যায়নি! কিন্তু আসলে কি তা যায়! যায় না। কিন্তু আমরা মিলিয়ে যেতে দেখি। ওই বিন্দুটাই হচ্ছে ভ্যানিশিং পয়েন্ট। ওই ভ্যানিশিং পয়েন্ট আছে বলেই আমরা স্পেইসের দূরত্ব ধরতে পারি। একটা জিনিস যতটা দূরে রয়েছে ওটাকে ধরবার জন্যে অতটুকুই হাত বাড়াই। ভাবুন তো যদি পার্স্পেক্টিভ না থাকত তাহলে কি ধুন্ধুমার কাণ্ডটা ঘটত? কতটা পা ফেললে সিঁড়ি দিয়ে নামা যাবে, ঢিল কতটা ছুঁড়লে কাঁচা আম পাড়া যাবে আর ক্লে পিজিয়ন কতটা দূরে আছে, সেটা তাহলে আমরা বুঝতেই পারতাম না। সেটা হত টপ্সিভারভি্। এই যে পার্স্পেক্টিভ আমরা দেখি সেটাকেই অবলম্বন করে ছবির সমতলীয় পটে গভীরতার হুবহু প্রতিফলন শিল্পীরা এনে দেখালেন। এটা মিথ্যে নয়, মায়া নয়। যদি তা মিথ্যে হত, মায়া হত, তাহলে পুরো আর্কিটেকচারাল ম্পেইসের ব্যাপারটাই হত মিথ্যে। সেই স্পেইস্টাকেই টাইমে পরিবর্তিত করায় আপনি উনিশ শ সতেরর ছবিতে ঢুকে যেতে পেরেছিলেন। আমি ভেল্কি দেখাই নি, ম্যাজিকও না। কেবল কী করে স্পেইস্টা টাইম হতে পারে, সেটাই আপনাকে দেখালাম।

রঘুকুলপতি শিউরে উঠলেন, তাজ্জব কাণ্ড মশাই! আপনি তো একজন জিনিয়াস।

কালোশশী বললেন, লেওনার্দো দা ভিঞ্চি তো ছবির সূত্রেই বিজ্ঞানের সব আশ্চর্য তত্ব ধরতে পেরেছিলেন। এই যেমন ভূকেন্দ্রের অবস্থান, কি করে গাছের বয়স আর ফসিলের বয়স জানা যায়, এমন কি অপটিক্সের গূঢ় তত্ত্বও তিনি ছবি আঁকতে আঁকতেই জেনেছিলেন। মশাই, ছবি জিনিসটা কেবল ছবিই নয়।

রঘুকুলপতি বললেন, তাহলে কি এভাবে কেবল পিছনে যাওয়াই সম্ভব! ভবিষ্যৎ দেখা যায় না?

কালোশশী হাসলেন, সেটা কী করে হয়। যা ঘটে গেছে, তার একটা সত্যতা ছিল আর যা ঘটে নি তার মধ্যে কাজ করছে সম্ভাব্যতা। সত্যতা আর সম্ভাব্যতা কী এক? কত তারাই তো মরে গেছে কিন্তু মরে যাবার পরেও কি করে ওই সব তারার আলো আলোকবর্ষ অতিক্রম করে দেখা দেয় বলুন তো? যার মৃত্যু ঘটেছে সে তো আলোকতরঙ্গের যাত্রা শেষ না হওয়া পর্যন্ত মরে না। যদি কোন অত্যন্ত দূরে আলোকবর্ষের নক্ষত্র থেকে বিশাল দুরবিনে পৃথিবীকে দেখা সম্ভব হয় তাহলে কি ডাইনোসরসদের দেখা যাবে না! যাবে। বাস্তবে যা ঘটে গেছে, তা আলোকতরঙ্গে থেকে যায়। ছবিতে আমরা আলোছায়া দিয়ে আলোকতরঙ্গকেই কি ধরি না! সেই সত্যকেই আপনি দেখেছিলেন। তা স্বপ্ন নয়, মায়া নয়, মতিভ্রমও নয়। আমাদের প্রাচীন কবিরা তা জানতেন।

রঘুকুলপতি বললেন, তাহলে আপনি অতীতে গিয়ে টাকাকড়ি এনে নিজের ভাগ্য ফেরান না কেন?

আর সে সাহস নেই। ইচ্ছেও নেই। যাক্ গে ওসব। যদি আপনার অন্য কোন মনোবাঞ্ছা থাকে, বলবেন, এঁকে রাখব। প্লেনে করে তো কত জায়গায় যান। ছবিতে ঢুকে না হয় কালভ্রমণ করবেন। তবে দোহাই, যে কদিন বাঁচি, উচ্ছেদ করবেন না। এ বয়সে আর কোন্ চুলোয় যাব!

রঘুকুলপতি সময়ে পিছিয়ে গিয়ে সেজানের আঁকা এমন একটা স্টিললাইফ নিয়ে এলেন যেটি নাকি খোয়া গিয়েছিল। অন্তত বইতে তা লেখে। সথ-বি-র ক্যাটালগে রঘুকুলপতি দেখেছেন, সেজানের একটা ছবির দাম এখন অন্তত ছ কোটি ডলার। শিল্পী ঐতিহাসিক ভুবন হোম জানালেন, এ ছবির দাম ডলার দিয়ে মাপা যায় না। এ ছবি অবিলম্বে ইন্সিওর করে ব্যাঙ্কের ভল্টে রাখা উচিত। রঘুকুলপতি সে সাহস পেলেন না। ব্যাঙ্কের ভল্টে রাখতে গেলে ওটার ইতিহাস, কি করে পেলেন, সব জানাতে হবে।

এভাবেই রঘুকুলপতি আনলেন মহেঞ্জোদাড়োর চিত্রিত একটা পাত্র, অজন্তার শিল্পীদের আঁকা ছবির একটা ছব্বা, একটা খাঁটি সোনার আকবরি মোহর যা পুরাতত্ত্বের আইন মোতাবেক অ্যান্টিক ও জাতীয় সম্পত্তি।

হেলহেডের বাংলা ব্যাকরণের প্রথম সংস্করণের একটি অক্ষত কপির জন্য জাতীয় গ্রন্থাগার দু লাখ টাকা দিতে চাইল। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের গাওয়া গানটির ঝকঝকে রেকর্ডটির জন্য এক সংগ্রাহক পাঁচ হাজার টাকা কবুল করলেন। ওঅরেন্ হেস্টিংসের নস্যির কৌটোর জন্য সথ-বি দিতে চাইল তিরিশ হাজার পাউন্ড। বলাবাহুল্য রঘুকুলপতি এর একটাও হাতছাড়া করলেন না।

তাঁকে নেশায় পেয়ে বসল। চুলোয় গেল ভাড়াটে উচ্ছেদ, বাড়ি তোলার তাগিদ, অভিজাতপাড়ায় ঠিকানা বদল। এমন কি ব্যবসা দেখাশোনায়ও তিনি শিথিলতা দেখাতে লাগলেন। ইতিহাস আর পুরাতত্ত্বের মোটা মোটা বই তিনি পড়তে শুরু করলেন। তিনি এক আশ্চর্য অনাস্বাদিত জগতে ঢুকে গেলেন।

স্বামীর এই পরিবর্তন কাঞ্চনকুন্তলার দৃষ্টি এড়ালো না। যতই গুরু-গুরু করুন আর সৎসঙ্গ করুন, ব্যাপারটা তাঁর ঠিকই চোখে পড়ল। কি কি সব জিনিস যে রঘুকুলপতি কোথ্থেকে আনেন আর সেইসব ছাইপাঁশ যক্ষের ধনের মত আগলে রাখেন, সেটা তাঁর বুদ্ধিতে কুলোল না।

স্বামীকে জিগ্যেস করে যে সদুত্তর পাবেন না, সেটা তিনি বিলক্ষণ জানতেন। এবং পেলেনও না। এই বয়সে চিত্তবৈকল্য ঘটবে তেমন কথাও কাঞ্চনকুন্তলা ভাবেন না। তবু তিনি হাল ছাড়লেন না। বললেন, চল, কদিন একটু বাইরে ঘুরে আসি।

রঘুকুলপতি বললেন, বেড়াতে যাব! ক্ষেপেছ! তুমি যাবে তো যাও, সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।

—না, বলছিলাম, মানে বেড়িয়ে এলে তোমারও ভাল লাগবে।

—আমি দিব্যি আছি। ও তোমাকে ভাবতে হবে না।

কাঞ্চনকুন্তলার সন্দেহ তবু গেল না। তিনি স্বামীর গতিবিধির হদিশের জন্য বেসরকারী গোয়েন্দা লাগালেন। না, রঘুকুলপতির কোন চিত্তচাঞ্চল্য ঘটেনি, কোন ডাকিনী যোগিনীও এর পেছনে নেই। রঘুকুলপতি একেবারে ধোয়া তুলসীপাতা। তবে প্রায়ই বিকেলে তিনি ঘণ্টাখানেকের জন্য ওই নতুন কেনা পোড়ো বাড়িটায় যান। না, নেশাটেশাও করেন না। আর যার কাছে যান সেই আদ্যিকালের বুড়োটা ছবিটবি আঁকে। ওই লোকটাও কালেভদ্রে বাড়ি থেকে বেরোয়। ওরও সাতকুলে কেউ নেই। কিন্তু কেন যে ওই সাতবুড়োর এক বুড়ো চালচুলোহীন ছন্নছাড়া মানুষটার কাছে তিনি যান সেটা কাঞ্চকুন্তলাকে খুঁজে বার করতেই হবে। আপাতত রঘুকুলপতিকে এ বিষয়ে কিছু বলা ঠিক নয়। তিনি নিজেই যাবেন একদিন।

—আজ একটা আশ্চর্য ছবি দেখাব, কালোশশী হাসলেন, এমন অভিজ্ঞতা আপনার হয়নি, জীবনে হবেও না।

—রিয়্যালি! আচ্ছা, যে কেউ কি এভাবে ছবিতে ঢুকে যেতে পারে! এই যেমন আমি মুহূর্তের মধ্যেই ঢুকে পড়ি—

—কথামৃততে পড়েন নি, যার দৃষ্টি আছে, সে-ই দেখতে পায়। চোখ থাকলেই হয় না। অধিকাংশ মানুষের দেখা হল অন্ধের হস্তীদর্শন। আমরা তো দেখার মত করে সব কিছু দেখি না।

—না, তা দেখি না।

—ঠিক তাই। একজন লোক একঘন্টা পথেঘাটে ঘুরে আসার পর ওকে প্রশ্ন করুন কি দেখলেন, দেখবেন সে প্রায় কিছুই দেখে নি। কটা সিঁড়ি সে উঠে এল, সেটাও সে বলতে পারে না। আবার কেউ কেউ আছে যারা চোখ আর মন দুই দিয়েই দেখে। ওরা ঠিক ঠিক দেখতে পায়। আপনি ব্যবসায়ী মানুষ, হাড়েমজ্জায় খতিয়ে দেখা আপনার স্বভাব। হুবির ভ্যানিশিং পয়েন্টে অভিনিবেশ করে ছবিতে আপনি যেভাবে ঢোকেন, সেটা আপনার দেখতে জানার জন্যেই সম্ভব হয়েছে। এ হল অর্জুনের মাছের চোখ। অর্জুন দেখতে জানতেন বলেই ঘুরন্ত মাছের প্রতিবিম্ব দেখে লক্ষ্যভেদ করতে পেরেছিলেন।

রঘুকুলপতি শুনে পুলকিত হলেন। তারিফ শুনলে কে না খুশি হয়।

কালোশশী বললেন, আসলে ভ্যানিশিং পয়েন্টে কিছুই মিলিয়ে যায় না। ওখান থেকেই স্পেইসের মাপ আমরা করি। রেললাইনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে যেখানে ভ্যানিশিং পয়েন্ট দেখতে পাচ্ছেন সেখানে পৌঁছে পেছন ফিরে আবার আপনি আগে যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন ঠিক সেখানেই ভ্যানিশিং পয়েন্ট দেখতে পাবেন। ভ্যানিশিং পয়েন্ট আসলে শেষ নয়, ওখান থেকেই আবার নতুন স্পেইসের শুরু।

ইজেলে রাখা ক্যানভাসের ওপর থেকে ঢাকনাটা সরিয়ে দিতেই রঘুকুলপতি দেখতে পেলেন চিত্রার্পিত এক উজ্জ্বল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ জাহাজের সুসজ্জিত কেবিনে বসে আছেন। চেহারাটা ওঁর খুব চেনাচেনা ঠেকল। আরে, ইনি সিন্ধুমাধব মল্লিক না। সেই বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক আর ওঁর দাদুর বন্ধু। ইনি না দাদুর সঙ্গে বউবাজারে এক স্কুলে পড়েছেন। রঘুকুলপতি দাদুর ফুটবল খেলার বন্ধুদের গ্রুপ ফোটোগ্রাফে এঁকেও তো দেখেছেন! ইনি এখানে কি করছেন!

ভাবতে ভাবতে ওঁর কানে মৃদু থেকে গভীর সমুদ্রের গরগর আওয়াজ ধ্বনিত হতে লাগল। চোখে মুখে নোনা জলের ছিটে লাগল। পায়ের নিচে কার্পেট মোড়া পাটাতন দুলতে লাগল। রঘুকুলপতির সারা গায়ে ভয়ে কাঁটা দিল।

ওঁকে দেখে ছবির মানুষটি এক অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকালেন। কিছু একটা বলবার জন্য ওঁর ঠোঁট দুটো কেঁপে উঠলেও শব্দ সরল না। রঘুকুলপতি কোথায় এসেছেন ভেবেই পেলেন না। কেবিনের দরজা খুলে বাইরে আসতেই নিকষ অন্ধকারে ক্রুদ্ধ জলের গর্জনে ওঁর কানে তালা লাগল। পেছনে স্বয়ংক্রিয় দরজা আপনিই বন্ধ হয়ে গেল। চোখে কিছুই দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু জলের ঝাপটায় তিনি ভিজে গেলেন। টালমাটাল পাটাতনে দাঁড়ানো দায়। আন্দাজে হাত বাড়িয়ে তিনি রেলিং ধরে ধরে এগোতে লাগলেন। তীব্র ঠাণ্ডায় ওঁর হাত পা জমে আসছে। রেলিং ধরে ধরে এগিয়ে তিনি খোলা ডেকে পৌঁছালেন। সেখানে দেখতে পেলেন, শিশু ও মহিলাদের লাইফবোটে করে নামিয়ে দেওয়া হচ্ছে। মাথার উপর ঝুলন্ত আলোর বিচ্ছুরণে সব মিলিয়ে একটা ভৌতিক পরিবেশ তৈরি হয়েছে। অসংখ্য সুবেশ সুপুরুষ যাত্রী আর নাবিক কোন্ এক প্রত্যাসন্ন মুহূর্তের অপেক্ষায় নির্বাক দাঁড়িয়ে আছে। একদিকে ব্যান্ডে বেজে চলেছে একটানা সংগীত। সেই সংগীতের বিদায়ের সুর ছাপিয়ে একটানা বেজে চলেছে পাগলা ঘন্টি।

বিমূঢ় রঘুকুলপতির হঠাৎ মনে পড়ল তিনি দাদুর কাছে শুনেছিলেন যে দাদুর হাফ প্যান্টের বন্ধু সিন্ধুমাধব টাইটানিকের যাত্রী ছিলেন। টাইটানিক ডুবতে তাঁরও সলিলসমাধি হয়।

আতঙ্কে শীতে হাত পা শরীর হিম হয়ে এলেও রঘুকুলপতি বুদ্ধি হারালেন না। তিনি বুঝতে পারলেন, কালোশশী ওঁকে টাইটানিকে ঢুকিয়ে দিয়েছেন। লোকটা কি পাগল! না কি এটা তিনি ইচ্ছে করেই করেছেন! কেন রঘুকুলপতি মরতে ওঁর ফাঁদে পা দিয়েছিলেন!

কিন্তু ওঁকে টাইটানিক থেকে বেরোতেই হবে। বেরোবার একমাত্র উপায়, যে জায়গায় যে ভ্যানিশিং পয়েন্টে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে তিনি ছবিতে ঢুকেছেন ঠিক সেই জায়গায় ফিরে যাওয়া। এ ছাড়া আর কোন পথ নেই। রেলিং ধরে ধরে আবার তিনি কেবিনের দিকে ফিরে গেলেন।

কিন্তু কোন্ কেবিন, কত নম্বর কেবিন থেকে তিনি বেরিয়েছেন সেটা তো ওঁর মনে নেই!

জাহাজ ধীরে ধীরে ডুবছে। নিচে কলকল করে কালো জলের স্তর বাড়ছে। টালমাটাল জাহাজের প্যাসেজে কেবিনের পর কেবিনের দরজায় উন্মাদ রঘুকুলপতির করাঘাত কেউ শুনতেও পেল না। কেউ জানল না কখন পাটাতনে হাত বাড়িয়ে একটা ঢেউ ওঁকে সমুদ্রের নিস্তল গভীরে ঠেলে পাঠালে।

কাঞ্চনকুন্তলা দেখলেন গাড়িবারান্দায় ওঁর স্বামীর গাড়িটাই দাঁড়িয়ে আছে। ড্রাইভার নেই। বুঝলেন, আজ রঘুকুলপতি নিজেই গাড়ি চালিয়ে এসেছেন। দরোয়ান বলল, মালিক ঘন্টা দেড়েক আগে ওপরে গেছেন, এখনো নামেন নি।

মাকড়শার জাল, চামচিকের ঝাপটা আর আবর্জনার স্তূপ ভেদ করে সিঁড়িতে গোটা চারেক হুমড়ি খেয়ে কাঞ্চনকুন্তলা ওপরে পৌঁছলেন। সামনে দরজা হাট করে খোলা। কাঞ্চনকুন্তলা কলিংবেল টিপলেন। বেল বাজল না। তবে মোমবাতি হাতে এক মান্ধাতা বুড়ো বেরিয়ে এসে বললেন, কাকে চাই।

কাঞ্চনকুন্তলা হাঁপাচ্ছিলেন। হাঁপাতে হাঁপাতে জিগ্যেস করলেন, ওর স্বামী এসেছেন কি না, কোথায় তিনি।

—এসেছিলেন বটে তবে তিনি তো চলে গেছেন।

বিস্মিত কাঞ্চনকুন্তলা বললেন, চলে গেছেন! কোথায়? গাড়িটা তো নিচেই রয়েছে।

—কোথায় গেছেন তা আমি কি করে বলব। উনি তো নিজেই চলে গেলেন।

—কি করে বলবেন মানে! গাড়ি ফেলে যাবেন কোথায়? কোথায় ওকে লুকিয়ে রেখেছেন?

—আমি লুকিয়ে রাখব! হা, হা, হা, হাসালেন আপনি। নিজেই চলতে ফিরতে পারি না আর ওই পাঁচমণি লাশটাকে আমি গুম করব! ডাকুন পুলিশ, তল্লাশি নিন।

দুটো মাত্র ঘর। এক চিলতে রান্নাঘর। একটা বাথরুম কাম টয়লেট। বেরোবার সিঁড়ি আর দরজা একটাই। এক মিনিটেই সরেজমিন দেখা হয়ে যায়। কাঞ্চনকুন্তলা কোথাও রঘুকুলপতিকে দেখতে পেলেন না। কিন্তু পাশের ঘরটায় ইজেলে রাখা একটা ছবিতে বসে থাকা একজন মানুষকে দেখে মোমের আলোতেও কাঞ্চনকুন্তলা চমকে উঠেছিলেন, এতই জীবন্ত ছবিটা।

সংশয়ের দোলায় পড়লেন কাঞ্চনকুন্তলা। দরোয়ান বলেছে, রঘুকুলপতি এখনো বেরোননি। তাহলে তিনি গেলেন কোথায় আর কোন্ পথেই বা গেলেন!

উন্মাদ কালোশশী এই ভেবে আশ্বস্ত হলেন যে রঘুকুলপতি আর কোনদিনই ওঁকে উঠে যাবার তাগিদ দিতে আসবেন না। এই বাড়িটাতেই তিনি মরবেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *