3 of 3

বিরুদ্ধ স্রোত

ঢাকার সন্ত্রাসী হামলা নিয়ে ভারতের কিছু মিডিয়া আমার মতামত জানতে চেয়েছিল। ওদের জন্য লিখেছি, বলেছি। কথা প্রসঙ্গে ইসলাম এসেছে। আসাটা খুব স্বাভাবিক। আমি যথারীতি আমার মত প্রকাশ করেছি। এতে ক্ষুব্ধ কংগ্রেসের বড় বড় নেতা। গোলাম নবী আজাদ রাজ্যসভায় সেদিন বললেন, আমি নাকি মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিচ্ছি। কাশ্মীর নিয়ে বলছিলেন, হঠাৎ আমাকে নিয়ে কেন পড়লেন কে জানে। আমি কি কাশ্মীর সমস্যার জন্য দায়ী? বোধহয় তাই বলতে চাইছিলেন যে, দায়ী। কাশ্মীরের প্রেস ফ্রিডম দাবি করছেন আবার দিল্লির প্রেস ফ্রিডমের নিন্দে করছেন। এ নিয়ে রাজনীতির কোনও দলের কোনও নেতাই মুখ খুললেন না। আমি কিন্তু ইসলাম নিয়ে কোনও মিথ্যে কথা বলিনি। ইসলামকে গালাগালি করিনি। বলেছি, মেয়েদের সমানাধিকার দরকার, অন্যান্য ধর্মের কানুন প্রথা অনেক পাল্টেছে। মুসলমানের শত্রু ছাড়া আর কেউ বলবে না, ইসলামি আইনের কোনও বদল -পরিবর্তন চাই না।

কংগ্রেসের আরও একজন বড় নেতা সালমান খুরশিদ দেখলাম টুইট করছেন, আমি নাকি পুরো জাতিকেই ধ্বংস করে দিয়েছি। এত বড় ক্ষমতা আমার? এত বড় ভারতকে ধ্বংস করে দেওয়ার? ছ’মাস আগে আইন বিষয়ক একটি বইয়ের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আমি ছিলাম, ওখানে সালমান খুরশিদ গিয়েছিলেন। তাঁর সঙ্গে কেউ আমার পরিচয় করিয়ে দেয়নি। কিন্তু মঞ্চ থেকে দর্শকের আসনে বসা আমাকে দেখে উনি তাঁর ভাষণের শুরুতে বললেন যে আমার উপস্থিতি নাকি অনুষ্ঠানের মর্যাদা বাড়িয়েছে, তাঁর ভাষণ শুনে আমার মনে হয়েছিল তিনি খুব শিক্ষিত, সচেতন, বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদী একজন মানুষ। তিনি যে সময়ে বদলে যেতে পারেন, একটুও তো মনে হয়নি। এই মানুষটাই এখন আমার সম্পর্কে কী ভীষণ বাজে বকছেন।

গোলাম নবী কটাক্ষ করছিলেন, ইসলাম নিয়ে লিখে এমন অন্যায় করেছি যে আমাকে আমার দেশের সরকার দেশ থেকে বের করে দিয়েছে। বলতে চাইছেন, আমি যে নির্বাসন দণ্ড ভোগ করছি, দোষটা আমার, দোষটা আমার দেশের সরকারের নয়। যে লেখে তার দোষ, লেখককে যে বের করে তার নয়? আমি শুধু চেয়ে চেয়ে দেখলাম, মুসলমান সমাজের রিফরমেশনের কথা বলাতেই কী ভীষণ রাগ করতে পারেন ভারতের বাঘা বাঘা নেতা! এঁরাই কি মুসলমান সমাজের পিছিয়ে থাকার জন্য দায়ী? এঁরা পলিটিক্স করবেন বলেই কি মুসলমানদের আফিম খাইয়ে অন্ধকারে রেখে দিচ্ছেন? আলোকিত হতে দিতে এত আপত্তি কেন? এঁরা নিজেরা আধুনিক জীবনযাপন করেন। কিন্তু জাকির নায়েককে ফিরিয়ে আনতে চান। জাকির নায়েক জনগণকে চমত্কার আফিম খাওয়াতে পারেন বলেই কি ফিরিয়ে আনতে চান?

কয়েকজন ভারতীয় পরিচিত নারী-পুরুষকে জিজ্ঞেস করেছি যে শিক্ষিত মুসলমান রাজনৈতিক নেতারা তো আধুনিক মানুষ, ওঁরা কেন মুসলিম সমাজের কোনও বিবর্তন চান না?

পরিচিতরা যা উত্তর দিল, তা বলছি—

১. ইসলামে এমন কোনো বাধা আছে বলে আমি মনে করি না, যার জোরে মুসলিম সমাজের সংস্কারকে আটকে বা স্তব্ধ করে রাখা যায়। তবু মুসলিম সমাজের সংস্কার তেমন হচ্ছে না তার প্রধান কারণ হলো রাজনৈতিক নেতানেত্রীদের নির্লজ্জ নেতিবাচক ভূমিকা। তাঁরা তাঁদের সন্তানদের মানুষ করেন আধুনিক শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক পরিবেশ ও পরিমণ্ডলে। কিন্তু তাঁরাই আবার মুসলিম সমাজকে আটকে রাখতে চায় মধ্যযুগীয় সংস্কৃতিতে। এসব করেন ভোটে জিতে ক্ষমতা হাসিল করার জন্যে। আর মূলতঃ তাদের জন্যে মুসলিম সমাজ পিছিয়ে পড়ে রয়েছে সংস্কারের অভাবে।

২. কেউ কি কারো অধিকার ছাড়তে চায়! এত বছর ধরে দাবিয়ে রেখেছে, তুমি তাদের বাড়া ভাতে ছাই দিতে চাইছ, তোমাকে শত্রু বলবে না তো কি মিত্র বলবে? হিন্দু ধর্মের অত্যাচার, অনাচারগুলোকে দূর করার জন্য রামমোহন, বিদ্যাসাগরকে কম গালাগাল, অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে?

৩. গোলাম নবী আজাদ, সালমান খুরশিদ প্রথমে মুসলিম তারপর ভারতীয়। আধুনিক পোশাক পরলে, আধুনিক জীবনযাপন করলেও একজন জঙ্গি মুসলিমের সাথে এদের তফাত একটাই, এরা বিধর্মীকে নিজে হত্যা করে না কিন্তু জঙ্গিদের সবরকম সাহায্য করে বিধর্মীকে হত্যা করার জন্যে।

৪. এটা রাজনীতি, ক্ষমতায় টিকে থাকার ঋণাত্মক সংগ্রাম।

৫. এঁরা পলিটিক্স করবেন বলেই মুসলমানদের আফিম খাইয়ে অন্ধকারে রেখে দিচ্ছেন।

৬. ভারতের মুসলমান ইস্যু হচ্ছে রাজনৈতিক। কংগ্রেসের রাজনীতিতে মুসলমান ইস্যু খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পৃথিবীর সব দেশেই সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায় হচ্ছে কিছুটা প্রগ্রেসিভ রাজনৈতিক দলের রাজনৈতিক ঘুঁটি। এটাই বর্তমানের রাজনৈতিক মানবাধিকার ইস্যু। কংগ্রেস তার রাজনৈতিক প্রয়োজনে আপনার ধর্ম বিরোধিতাকে রাজনৈতিক ইস্যু বানাবে। এসব তথাকথিত রাজনৈতিক দলগুলো এটা বুঝতে চায় না পৃথিবীর সব রকম মানবাধিকার ইস্যুতে সব ধর্মই বিরাট বাধা।

৭. ভারতে সব কিছুই তো ভোটমুখী, নেতারা তো চায় না সমাজ বদলে যাক।

৮. এরা কূপমণ্ডূক, এরা ইসলামের শত্রু, এরা ভারতেরও শত্রু।

৯. ভারতের পলিটিক্স এর ট্রাম কার্ড হলো ইসলাম।

১০. “মুসলমান সমাজের রিফরমেশনের কথা বলাতেই কী ভীষণ রাগ করতে পারেন ভারতের বাঘা বাঘা নেতা! এঁরাই কি মুসলমান সমাজের পিছিয়ে থাকার জন্য দায়ী?”— হ্যাঁ। এরাই দায়ী। এরা হলেন রাজনৈতিক মৌলবি…

১১. এটাই পলিটিশিয়ান আর লেখকদের মধ্যে পার্থক্য দিদি। তোমরা সমাজের মঙ্গলের জন্য কলমযুদ্ধ চালিয়ে যাও আর ওরা নিজেদের স্বার্থে মানুষদের আফিমখোর বানিয়ে রাখে।

১২. ভারতের ডান বাম প্রায় সব রাজনৈতিক দলের নেতারাই ভোটের রাজনীতির নামে মুখে মুসলিম তোষণের যে সহজ পথটি ধরেছেন তাকে মুসলিম ধর্মীয় নেতারাও বাহবা দিচ্ছেন। আর এতেই মুসলিম ধর্মের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হচ্ছে।

১৩. ইসলামের বিরুদ্ধে মুখ খুললে তো ইসলাম ধর্মকে আঁকড়ে থাকা লোকদের বুকে ব্যথা হবেই। ঠিক সেরকম হিন্দু ধর্ম কিংবা অন্য ধর্মের বিরুদ্ধে মুখ খুললে সেই ধর্মকে আঁকড়ে থাকা লোকেরা চ্যাঁচামেচি করে। এ আর এমন কি! তারপর, তুমি যাদের কথা বলছো এরা তো আবার রাজনীতিক। এরা তো এসব নিয়ে রাজনীতি করবেই। ধর্মান্ধদের নাচানো তো রাজনীতিকদের কাজ-ই। তুমি ওসব নিয়ে চিন্তা করো না দিদি। এঁদের যা বলার আছে, তা বলতে দাও; আর তোমার যা বলার তুমি বলতে থাকো। বুদ্ধিমানেরা ঠিক বুঝতে পারবে, কার বলাটা সঠিক আর কারটা বেঠিক।

চিরকাল মানুষের মঙ্গল চাইলাম, চিরকাল মানুষ ভুল বুঝলো। সমাজের ভালো চাইলাম, সমাজপতিরা গালি দিল। নারীর সমানাধিকার চাইলাম, নারীবিদ্বেষীরা কুৎসা রটালো। এভাবেই বেঁচে আছি।

মনে আছে তিয়ানানমান স্কোয়ারের কামান-লোকটির কথা?            মাঝে মাঝে নিজেকে সেই লোকটির মতো মনে হয়। জানি ওই লোকটির মতো হওয়ার ক্ষমতা পৃথিবীতে প্রায় কারওরই নেই। আমারও নেই। তারপরও কিছু কিছু সময় মনে হয় আমার অবস্থা বোধহয় ওরকমই। কতকাল যে যুদ্ধ করছি। এখনও দাঁড়িয়ে আছি বিরুদ্ধ স্রোতে।

সোর্স : বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২৮ জুলাই, ২০১৬

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *