বিরাট ধোঁকা – কালীকিঙ্কর কর্মকার
‘ওমেগা ইন্ডাস্ট্রিজ’-এর অফিস ডালহৌসী স্কোয়ার অঞ্চলে। সেখানকার ম্যানেজার পুলক পুরকায়স্থ আমার বড়সাহেব। আমাদের কোম্পানির ভারতবর্ষের সর্বত্র শাখা ছড়িয়ে আছে এবং আমার মত বহু কর্মচারীও। কাজের মধ্যে আমাদের শুধু খাওয়া-দাওয়া-ঘুমান আর বড়সাহেবের ছোটখাটো নির্দেশ পালন করা। সেই নির্দেশ মত ঠিকভাবে কাজ হাসিল করার ওপর নির্ভর করছে আমাদের দেশের নিরাপত্তা। আমি এক গুপ্তচর সংস্থার সদস্য।
সেদিন পুলকবাবু আমাকে ডেকে পাঠালেন তাঁর অফিসে। সাধারণত ফোনেই তিনি যা বলার বলে থাকেন। সুতরাং এটা অসাধারণ কিছু একটা হবে জেনেই গেলাম।
‘এস গড়াই, এস।’ তিনি আমাকে অভ্যর্থনা জানালেন।
আমার নাম গোবর্ধন গড়াই।
তাঁর সামনের চেয়ারটায় বসলাম। তিনি সিগারেটের প্যাকেটটা আমার দিকে এগিয়ে দিলেন। আমি সিগারেট ধরালাম।
‘তুমি নিশ্চয় জান যে, আগামী সপ্তাহে কলকাতায় একটা বিজ্ঞান সম্মেলন শুরু হবে?’ বিনা ভূমিকায় তিনি বললেন।
‘সে খবর শুনেছি।’
‘কিন্তু এটা হয়তো জান না যে, সম্মেলন চলাকালীন কোন একদিন একজন বিদেশী সদস্য আমাদের বৈজ্ঞানিকদের সঙ্গে কিছু গোপন পরামর্শ করবেন!’
‘না।’
পুলকবাবু চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লেন।
‘হ্যাঁ, সেই কথাই হয়েছে। কিন্তু কবে, তা তিনি জানাতে রাজী হননি!’
‘কেন?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম।
‘কোন কারণ তিনি বলেননি।’
আলমারি খুলে সাহেব আমার দিকে একটা প্যাকেট বাড়িয়ে দিলেন। আর একটা সিগারেট কেস এবং লাইটার। আমি সেগুলো নিলাম।
‘ওই প্যাকেটের মধ্যে সমস্ত ডেলিগেটদের ছবি আছে।’ সাহেব বলে চললেন, ‘ওর মধ্যে প্রফেসর পল ভোল্টাস আমাদের লোক। ওঁর নিরাপত্তার ভার তোমার ওপর দিলাম। ভদ্রলোক ফ্রান্সের একজন বিশিষ্ট ‘মিসাইল’ ইঞ্জিনিয়ার। ওঁর সঙ্গে আমাদের পরামর্শ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ!’
‘বুঝতে পারছি স্যার।’
‘সিগারেট কেসটার মধ্যে বিশেষভাবে তৈরি একটা টেপ-রেকর্ডার আছে। মোট পনের ঘণ্টা চলবে এবং লাইটারটা একটা ক্যামেরাও বটে। সেলফ্ অ্যাডজাস্টিং ক্যামেরা, চব্বিশটা ছবি তুলতে পারে। তাছাড়া তোমার নিজস্ব প্রতিরক্ষার জন্য যা যা প্রয়োজন, তা সবই তোমার আছে আশা করি।’
‘হ্যাঁ স্যার, আছে।’
‘বেশ, কনফারেন্সে যাতায়াতে যাতে অসুবিধা না হয়, তার জন্য ওই প্যাকেটের মধ্যে একটা প্রেস কার্ড আছে। এখন থেকে তুমি চিত্ত চ্যাটার্জি, স্টেটসম্যানের বিশেষ সংবাদদাতা।’
‘ধন্যবাদ।’ বলে আমি উঠে পড়লাম।
‘প্রফেসর ভোল্টাস পরশুদিন বেলা ন’টায় দমদমে নামবেন। এয়ার ইণ্ডিয়ার ফ্লাইটে।’
জনবহুল ডালহৌসী স্কোয়ারে নেমে এলাম। একটা ট্যাক্সির অপেক্ষায় কিছুক্ষণ ছোটাছুটি করলাম। কুড়ি মিনিট পরে পেলাম। ঠিকানাটা দিয়ে আরাম করে বসলাম। গুপ্তচরবৃত্তি বেশ রোমাঞ্চকর। যখন এম-এস-সি পাশ করলাম, তখন স্বপ্নেও কোনদিন ভাবতে পারিনি যে আমি এই কাজ করব। ইচ্ছে ছিল একটা পি-এইচ-ডি নেবার। কিন্তু হঠাৎ একদিন একটা বিজ্ঞাপনের উত্তরে গিয়ে হাজির হলাম পুলকবাবুর সামনে। তারপর এই সংস্থায় চাকরি পেলাম। ট্রেনিং নিলাম মেদিনীপুরের ট্রেনিং স্কুলে এবং একদিন গুরুদেবের আশীর্বাদ আর উপদেশ নিয়ে ফিরলাম পুলকবাবুর কাছে—সরকার অনুমোদিত হত্যাকারীর অন্যতম। সরকার থেকে মাস গেলে মাইনে মন্দ আসে না।
কেউ কি বিশ্বাস করবে যে, আমার তিনটে দাঁত খুলে সেখানে বসান হয়েছে দুটি মারাত্মক রকমের ‘রিমোট কন্ট্রোলড্’ বোমা এবং এক সায়ানাইডের বড়ি। কেউ কি মানবে যে আমার ঘড়ির সঙ্গে বোমা দুটির ফায়ারিং বাটন্! তাছাড়া আমার দেহের একস্থানে অস্ত্রোপচার করে গেঁথে দেওয়া হয়েছে একটি বিশেষ ধরণের ট্রান্সমিটার যেটি দেহের সামান্য উত্তাপে চালু থাকে। যদি কখনও আমি বেপাত্তা হয়ে যাই, তবে আমার সমিতি আমাকে ঠিক খুঁজে বার করবে—জীবিত অথবা মৃত, যে অবস্থায় থাকি না কেন! এটা কি অবিশ্বাস্য নয় যে, আমার সঙ্গে সবসময় একজোড়া চাকু থাকে—ইস্পাতের তৈরি, ন’ ইঞ্চি লম্বা, পাতলা চকচকে দুটো চাকু যাদের নাম ‘রাম’ আর ‘শ্যাম’। তাছাড়া ছোট্ট ছ-ঘড়া জার্মান অটোমেটিকটাও আমার সর্বক্ষণের সঙ্গী!
এদের জন্যই আজও আমি টিকে আছি। আপনারাও আছেন।
ট্যাক্সিটা একসময় গন্তব্যস্থলে পৌঁছে গেল। ড্রাইভারটাকে অপেক্ষা করতে বলে আমি আমার ঘরে গেলাম। জিনিসপত্র গুছিয়ে বিল চুকিয়ে পুনরায় ট্যাক্সিতে এসে বসলাম। উত্তর কলকাতার একটা হোটেলে এলাম। দোতলায় বড় রাস্তার ওপরে একটা ঘর খালি ছিল। সেটা পেলাম। প্রেস কার্ডটা দেখিয়ে একটা টেম্পোরারি টেলিফোনের কানেকশান চাইলাম। ম্যানেজার প্রথমে অক্ষমতা প্রকাশ করল, কিন্তু একটা কুড়ি টাকার নোট আঙুলের ফাঁকে দেখতে পেয়ে রাজী হল। টাকায় কি না হয়!
ঘরে এসে কফি চেয়ে পাঠালাম।
তারপর ছবিগুলো নিয়ে বসলাম। বিভিন্ন দেশের ডেলিগেট—বিদঘুটে সব নাম। দেখতেও তদনুরূপ। কিন্তু এক একজন এক একটি রত্ন। এদের একজন পল ভোল্টাস—আমাকে তার নিরাপত্তার ভার দেওয়া হয়েছে। কেন? আমাকে কেন? আমার ডাক পড়ে কাউকে হত্যা করার দরকার হলে, কোন জিনিস উদ্ধার করার প্রয়োজন হলে। এ সমস্ত ফালতু কাজ তো যে কাউকে দিয়ে হতে পারত। আমাকে কেন?
দুটো দিন নির্বিঘ্নে কেটে গেল। আজকে তাঁর আসবার কথা। এখন সাতটা বাজে।
হঠাৎ টেলিফোনটা রিং করল।
‘হ্যালো।’ আমি বললাম।
‘মিস্টার চ্যাটার্জি?’ ওদিক থেকে একটি মেয়ের গলা।
‘হ্যাঁ।’
‘মিস্টার চিত্ত চ্যাটার্জি? স্টেটসম্যানের বিশেষ সংবাদদাতা?’
‘হ্যাঁ।’
‘বাঁচা গেল!’ একটা স্বস্তির নিশ্বাস কানে এল।
‘কিন্তু আপনি? আপনি কে?’ আমি জানতে চাইলাম।
‘অত ঢং করছ কেন?’ অভিমানের স্বর, ‘আপনি, আপনি। ন্যাকামো কিসের? চিরকাল তো ‘তুই-তোকারি’ করে গেলে।’
আমি চুপ থাকলাম। এ আবার কি ঝামেলা!
‘শোন চিত্তদা, আমি তোমার হোটেলের কাউন্টার থেকে বলছি, বুঝতে পারছ?’
‘হ্যাঁ, বুঝলাম।’
‘মা তোমাকে ডেকে পাঠিয়েছে, এক্ষুণি!’
‘কিন্তু’, আমি আমতা আমতা করি, ‘আমায় একটা জরুরী কাজে এক্ষুণি বেরোতে হবে।’
‘ওসব জানি না। তুমি নেমে আসবে, নাকি আমাকে ওপরে উঠতে হবে?’
রাজী না হয়ে উপায় নেই।
‘বেশ, আমিই যাচ্ছি।’ অগত্যা বললাম, ‘কিন্তু আটটার মধ্যে ছেড়ে দিতে হবে।’
‘সে দেখা যাবে।’ ওধারে টেলিফোন নামিয়ে রাখল।
প্যাণ্টের পকেটে অটোমেটিকটা চালান করলাম। বুশ শার্টের বুক পকেটে সিগারেট কেসটা। ঠোঁটে সিগারেট ঝুলিয়ে লাইটটারটা হাতে রাখলাম। প্রেসকার্ড, পেন, পেন্সিল আর নোটবইটা নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলাম। সিঁড়ির মুখেই মেয়েটি দাঁড়িয়ে ছিল। পনের-ষোলোর বেশি নয়, স্কার্ট-ব্লাউজ পরা, চুলগুলো বিনুনি করে পিঠে দোলান। মিষ্টি মুখ। আমাকে প্রণাম করতে এল।
ওকে ধরে ফেললাম। এ ধরণের পরিস্থিতির জন্য একদম প্রস্তুত ছিলাম না।
‘আরে করিস কি? করিস কি?’
‘চিনতে পেরেছ তাহলে?’ মেয়েটা বলল।
‘সাংঘাতিক বড় হয়ে গেছিস দেখছি।’ যা হোক কিছু একটা বললাম।
‘ছ’ মাসের মধ্যে। কিশোরীর গলায় বিস্ময়।
‘তাই তো দেখছি।—নে, তাড়াতাড়ি চল, আমাকে আবার কাজে যেতে হবে।’
আমি হাঁটতে লাগলাম। মেয়েটা পিছু পিছু আসছিল। এবার পাশাপাশি। রাস্তার ওপর একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল। ড্রাইভারটা হাত বাড়িয়ে দরজাটা খুলল। আমি সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করলাম।
‘জান চিত্তদা, বাপী না অন্য গাড়িটা বেচে দিয়েছে!’
‘কেন?’ দরজাটা বন্ধ করে জিজ্ঞেস করলাম।
‘জানি না।’ মেয়েটা আমার কোল ঘেঁষে বসেছিল, ‘আচ্ছা, তুমি নেপালে কদ্দিন ছিলে?’
‘বেশ কিছুদিন।’ বলে আমি সিগারেটটা বাইরে ফেলে দিলাম।
‘তোমার কি হয়েছে, বল তো?’
‘কেন? কিছু না!’
‘আগে তো শুধু নিজের কথাই বলতে—জানিস গীতা, রাজস্থানে এই দেখেছি, ওই কিনেছি, তাই খেয়েছি ; দিল্লীতে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছি, বম্বেতে অশোককুমারকে গালি দিয়েছি! হঠাৎ তোমার কি হল?’
‘গীতা, কেন বিরক্ত করছিস—একটু চিন্তা করতে দে না!’
‘বাব্বাঃ, কি রাগই না হয়েছে !’ মেয়েটা জানলার দিকে সরে গেল, দাঁড়াও না, দিদিকে সব বলে দেব।’
পাইকপাড়ার টালা পার্কের সামনে একটা বাড়িতে গাড়িটা থামল। মেয়েটা দৌড়ে ভেতরে চলে গেল। আমিও বেরোলাম। বসবার ঘরে ঢুকলাম।
‘এস, চিত্ত এস।’ বলে একটি লোক আমার দিকে এগিয়ে এল, ‘ওই চেয়ারটাতে গিয়ে লক্ষ্মী ছেলের মত চুপচাপ বসে বল, কি সেই জরুরী কাজ!’
পেছনে তাকালাম। দরজাতে ড্রাইভারটা দাঁড়িয়ে আছে।
অগত্যা কি আর করি, গিয়ে বসলাম চেয়ারে।
‘বেশ’, লোকটা আমার সামনে এল, ‘এবার বল।’
‘কি বলব?’
‘জরুরী কাজটা কি?’
‘সে তো দেশশুদ্ধ লোক জানে!’ আমি বিস্মিত হয়ে বললাম।
‘ওসব দিয়ে লোকের চোখে ধুলো দিতে পার, আমার চোখে না।’
‘মানেটা ঠিক বুঝতে পারছি না!’
‘ন্যাকামো রাখো!’ লোকটা গর্জে উঠল।
‘বললাম তো!’
এই যদি তোমার অ্যাটিচ্যুড হয়, তবে অন্য রাস্তা ধরতে হবে।’ বলে লোকটা একটু দূরে দাঁড়িয়ে পড়ল। ‘তুমি ছিলে নেপালে। হঠাৎ তোমাকে এখানে কেন আনা হল?’
‘সম্মেলনটা কাভার করার জন্য!’ আমি আশ্চর্য হয়ে বললাম, ‘অন্তত আমাকে তো তাই বলেছেন আমার চীফ এডিটার।’
‘কেন? আর কি লোক ছিল না?’
‘সেটা তিনিই বলতে পারবেন!’
‘তুমিও বলবে!’ দাঁতে দাঁত চেপে সে বলল।
‘জানলে নিশ্চয় বলব।’
‘তুমি জান না?’
‘না।’
‘বেশ।’ বলে সে ড্রাইভারটাকে ডাকল, ‘জগা, একে তিনতলার ঘরে নিয়ে যা। আমি আসছি।’
জগা এগিয়ে এল। আমার পকেটে হাত দিয়ে অটোমেটিকটা ধরল।
‘তোমার কাছে অস্ত্রও আছে দেখছি!’ লোকটা বলল।
‘নেপালে থাকতে কিনেছি।’ আমি কৈফিয়ৎ দিলাম।
‘আর কিছু আছে নাকি?’
‘খুঁজে দেখতে পার।’
জগা একবার আমার সারা গায়ে হাত বুলিয়ে দেখল। পায়ের মোজার দিকে এগোলও না। হয়তো ধারণাই করতে পারেনি যে ওখানে কিছু থাকতে পারে! মনে মনে হাসলাম। ভাল, কিন্তু সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে। ন’টার সময় সেই প্রফেসর আসবেন। তাঁর নিরাপত্তার ভার আমার ওপর ন্যস্ত কিন্তু আমি বন্দী! ছাড়া পেতে হবে—এখন পৌনে আটটা বাজে।
তিনতলার ঘর। ঘরে মাত্র দুখানা চেয়ার। একটা মাটির সঙ্গে লাগানো, ওটাতে আমাকে বসিয়ে জগা আমাকে সেটার সঙ্গে বেঁধে দিল। তারপর অন্য চেয়ারটা নিয়ে সে গিয়ে ঘরের অন্যদিকে বসল। জলতেষ্টা পেয়েছিল।
‘জগা!’ আমি ডাকলাম, ‘একটু জল দিতে পার?’
‘হুকুম নেই।’ জগা বলল।
আবার ওকে ডাকলাম। জগা সে ডাক গ্রাহ্য করল না।
হঠাৎ দরজা খুলে লোকটা ঘরে ঢুকল।
‘এখনও সময় আছে, বলো কেন তুমি এখানে?’
‘আমার যা বলবার, তা বলে দিয়েছি।’
‘আসল কথাটা বাদে।’ সে মনে করিয়ে দিল।
‘এর বেশি আমি জানি না।’
‘বেশ।’ বলে সে এগিয়ে এল আমার সামনে, ‘জানো, এ ঘরে কি হয়? তুমি যে চেয়ারে বসে আছ, সেই চেয়ারের মধ্যে দিয়ে কারেন্ট পাশ করানো যায়!’
‘ওঃ!’ আমি অবাক হলাম।
‘ভয় নেই’, সে বলল, ‘তোমাকে অত তাড়াতাড়ি মারব না। প্রথমে তোমাকে প্রশ্ন করব। তুমি উত্তর দেবে। না দিলে তোমার ওপর অত্যাচার করব। অজ্ঞান হয়ে গেলে, জ্ঞান ফেরা পর্যন্ত অপেক্ষা করব। তারপর আবার শুরু করব। যতক্ষণ না সঠিক খবর পাই!’
আমি কোন উত্তর দিলাম না।
লোকটা সামনের দেওয়ালে লাগানো একটা সুইচ অন করল। এতক্ষণ খেয়াল করিনি যে হাতের ওপর দুটো লাইট রয়েছে। হাই-পাওয়ার সার্চলাইট গোছের। আমার মুখের ওপর ফোকাস করা। আমার চোখ ধাঁধিয়ে গেল। সামনে শুধু অন্ধকার। আমি ঘামতে লাগলাম। হঠাৎ খুব জোরে কানের কাছে আওয়াজ হতে লাগল। যেন ড্রাম বাজছে। আওয়াজ সমানে বেড়েই যাচ্ছে।
লাইট দুটো নিভে গেল।
‘তোমার নাম চিত্ত চ্যাটার্জি? প্রশ্ন হল।
আমি নিরুত্তর।
আবার লাইট দুটো জ্বালল। চোখ খুলতে পারছি না। আওয়াজ আর আলো। আমি যেন পাগল হয়ে যাচ্ছি। আবার প্রশ্ন হল। এবারো কিছু বললাম না। অন্য কথা চিন্তা করতে হবে। সে কোন কথা? গীতার কথা? গীতা মেয়েটি কে? এত নিখুঁত অভিনয়! ভবিষ্যৎ আছে। সিনেমার কথা মনে পড়ল। বাংলা বই, হিন্দী বই, ইংরাজি বই। গল্পের বই। মনে পড়ল কলেজ লাইফের কথা। আমার বান্ধবীর কথা। কি যেন নাম ছিল?
হঠাৎ বুকের মধ্যে জ্বলতে লাগল। অসম্ভব জলতেষ্টা পেয়েছে। গলা শুকিয়ে গেছে। জিভ নড়াতে পারছি না। চোখের সামনে দেখলাম ফ্রিজ, বরফ, বিয়ার বোতল, ডাব! আর পারলাম না।
‘জল!’ কোন রকমে বললাম।
‘নিশ্চয় পাবে।’ কানে ভেসে এল, ‘এখানে কেন এসেছ?’
‘সম্মেলনটা কাভার করতে।’
‘সে তো যে কেউ করতে পারত, তুমি কেন?’
‘জানি না।’
‘চীফ এডিটার কে?’
‘সুধাংশু দাশগুপ্ত।’
‘স্টেটসম্যানের?’
‘হ্যাঁ।’
‘বিবাহিত?’
‘হ্যাঁ।’
‘বাচ্চা-কাচ্চা?’
‘তিনটি।’
‘ছেলে?’
‘একটি।’
‘কত বয়স?’
‘ছ’ বছর।
‘আলাপ আছে?’
‘আছে।’
‘কি নাম?’
‘সঞ্জয়।’
‘পদবী?’
‘দাশগুপ্ত।’
‘ভোল্টাস নয়?’
‘ভোল্টাস!’
‘হ্যাঁ!’
‘সে কে?’
‘চেনো না?’
‘নাম শুনিনি।’
‘পল ভোল্টাস?’
‘ফ্রান্সের লোক?’
‘জানি না।’
‘প্রোফেসর পল ভোল্টাস!’
‘সঞ্জয় দাশগুপ্ত।’
‘মিসাইল ইঞ্জিনীয়ার!’
‘কোন মেশিন?’
‘মিসাইল!’
‘কি?’
‘নাম শোননি—মিসাইল?’
‘শুনেছি।’
‘তবে?’
‘কে, চিনি না।’
‘লাইট দুটো নিভে গেল। আওয়াজটা থেমে গেল। কানের মধ্যে কি রকম একটা ‘পোঁ-ও-ও’ শব্দ হচ্ছিল। যাক, প্রাথমিক বিপর্যয় তো কাটল। কে এক গ্লাস জল এগিয়ে দিল। কি আরাম! আঃ!
হঠাৎ ঘরের মধ্যে আরও একজন এল। উত্তেজিত ভাবে কথা বলতে বলতে সে আমার দিকে এগিয়ে এল।
‘দিস ইজ নট চিত্ত!’ তার বিস্মিত কণ্ঠস্বর।
‘নট চিত্ত!’ সেই লোকটির গলা।
‘না।’
‘তবে এ কে? কেন চিত্ত চ্যাটার্জির নাম নিয়েছে?’
‘জিজ্ঞেস করা যাক।’ অন্যজন বলল।
ওরা আমার চোখে মুখে জলের ঝাপটা দিল। জগা বাঁধন খুলে দিল। আমি টলতে টলতে উঠে দাঁড়ালাম। তারপর ওদের সঙ্গে দোতলায় নেমে এলাম। বিরাট একখানা ঘর। কার্পেট বিছানো। নরম গদী-আঁটা সোফা সেট। বুক কেসে বই। এক কোণে রেডিওগ্রাম। ফুলদানিতে ফুল। আলমারিতে কিউরিও! একজন আমার দিকে একটা গ্লাস বাড়িয়ে দিল। হুইস্কি! খেয়েই যেন শক্তি ফিরে পেলাম।
‘এবার বল’, নতুন লোকটি জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কে?’
‘চিত্ত চ্যাটার্জি।’
‘মিথ্যা কথা বলো না।’ ভর্ৎসনার স্বর।
‘আমি সত্যি বলছি।’
‘এইটা দেখ।’ বলে সে আমার দিকে একটা ছবি এগিয়ে দিল। দেখলাম। শ্মশানে একটি মৃতদেহ। আশেপাশে কয়েকজন দাঁড়িয়ে।
‘ওই হল চিত্ত। চারদিন আগে তাকে মৃত অবস্থায় তার ঘরে পাওয়া গেছল।’
‘কি বলতে চাও তুমি?’ আমি ক্ষেপে গেলাম।
লোকটা আরেকটা জিনিস এগিয়ে দিল।
‘এইটা তার প্রেস কার্ড। সঙ্গে তার ফটো আছে, মিলিয়ে নাও।’ সে শান্তভাবে বলল।
সেটাকে দেখলাম। মাথার মধ্যে সব কিছু যেন জট পাকিয়ে যাচ্ছে। তার মানে, আমি যখন তার পরিচয় নিই, তখন সে মৃত! আমার বস্ নিশ্চয় ব্যাপারটা জানত। অস্বাভাবিক মৃত্যু। এবার আমাকে গল্প ফাঁদতে হবে। মিথ্যার আশ্রয় নিতে হবে। এরা কারা? এদের সম্বন্ধে আমি কি জানি? কি চায় এরা? পল ভোল্টাসের নাম নিয়েছিল—সুতরাং সেই লাইনটাই ধরা যাক।
‘এবার বল!’ আবার তার প্রশ্ন, ‘তুমি কে? কি চাও?’
আমি ধীরে সুস্থে একটা সিগারেট ধরালাম।
‘বেশ, যতটুকু তোমাদের জানা দরকার, ততটুকুই বলছি। তার বেশি জানতে চেও না, বলব না।’
‘দেখা যাবে।’
‘এখানে যে কনফারেন্স হবে সেখানকার একটি লোককে সরানোর জন্য আমি এসেছি। নেপালে ছিলাম। সেখানে চিত্তর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। এবং একটা ছদ্মবেশের প্রয়োজন ছিল আর আমাদের দুজনের চেহারার যথেষ্ট মিল ছিল বলে চিত্তকে হত্যা করে ওর নামেই চালিয়ে যাচ্ছিলাম। আমার সঙ্গে আরও দুজন লোক আছে। যেভাবেই হোক একাজ হাসিল করতে হবে।’
‘চমৎকার! কিন্তু প্রমাণ কই?’
‘নেই।’
‘তোমার কথা মানতে হবে?’
‘আর কি করবে বল!’ আমি একটু হাসলাম।
‘আর যদি তোমার ওপর আবার অত্যাচার করি?’
‘নতুন কিছু জানতে পারবে বলে মনে হয় না!’
‘তোমাকে মেরে ফেললে?’
‘আরও দুজন আছে। কাজ ঠিকই হয়ে যাবে।’
‘লোকটি কে?’
‘নাম জানি না।’
‘তবে?’
‘সময়মতো সে নির্দেশ আসবে।’
‘পল ভোল্টাস?’
‘হতে পারে।’
লোক দুটি কিছুক্ষণ চিন্তা করল। তারপর জগাকে পাহারায় রেখে ওরা বেরিয়ে গেল। আমি উঠে বুককেসের দিকে গেলাম। জগা আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর পকেট থেকে একটা বিড়ি বের করল। কাচের ওপর ওর ছায়া দেখলাম। পা-টা চুলকোতে চুলকোতে মোজার ফাঁক থেকে ‘রাম’কে বের করলাম। বিড়িটা দাঁতে চেপে জগা দেশলাই জ্বালালো। কাচের মধ্যে দেখে নিশানা ঠিক করে পায়ের পাশ দিয়ে সাঁ করে চাকুটা ছুঁড়লাম। জলের মধ্যে তাকিয়ে অর্জুন যেমন লক্ষ্যভেদ করেছিল! ছটফট করে গোঙাতে গোঙাতে বুকের পাশটা দু’হাতে চেপে ধরে জগা মাটিতে পড়ে গেল। ওর দেহটা টেনে পাশের ঘরটার মধ্যে রেখে ওর পাজামার পকেট থেকে আমার অস্ত্রটি উদ্ধার করে। আবার এসে সোফাটায় বসলাম।
অন্য লোক দুটিও এল।
‘জগা!’ একজন ডাকল।
‘হঠাৎ একটা হেঁচকি তুলে মারা গেছে!’ আমি অটোমেটিকটা দেখিয়ে বললাম, ‘এবার আমার পালা⋯আরে তোমরা বসো। আরাম করে বস, কিন্তু গড়বড় করো না। আমি একটুতেই নার্ভাস হয়ে পড়ি!’
ওরা আমার সামনে এসে বসল। কিন্তু কোন কথা বলল না।
‘তোমাদের একজনকে হলেই আমার চলবে।’ অটোমেটিকটা তাক করে বললাম, ‘অন্যজন অপ্রয়োজনীয়! বলো কাকে নেব?’
দুজনের চোখে এবার আতঙ্ক দেখলাম। একটু হাসলাম। উপভোগ করছিলাম পরিস্থিতিটা।
‘তোমরা বোধ হয় আমাকে বিশ্বাস করছ না,’ আমি উঠে দাঁড়ালাম, ‘গীতাকে ডাকো!—গীতা বোধ হয় তোমার মেয়ে?’
কারও গলায় আওয়াজ নেই।
‘ডাকো!’ আমি হুঙ্কার ছাড়লাম।
‘গীতা!’ প্রথম জন ডাকল।
‘আবার ডাকো!’ বলে অন্যজনের দিকে অস্ত্রটা তাক করলাম, ‘তোমার প্রয়োজন নেই।’
ট্রিগারটা টিপলাম। লোকটা যেন একটু আশ্চর্য ভাবে উঠে বসতে গিয়ে পড়ে গেল।
মেয়েটা এই সময় দৌড়ে ঘরে ঢুকল। আমাকে দেখতে পায়নি।
‘বাপী, ডাকছিলে?’ সে জানতে চায়।
‘চুপচাপ ওই দেয়ালটার সামনে দাঁড়িয়ে থাকো⋯’ আমি হুকুম দিলাম।
‘কিন্তু—’
‘যাও!’ আমার কঠিন স্বর।
মেয়েটা গেল।
‘এবার!’ লোকটাকে বললাম, ‘তোমার গল্প বলল, আমি শুনি—তোমার নামটাই এখনও জানা হয়নি। সেখান থেকেই শুরু করা যাক। তোমার নাম কি?’
‘সমীর—’ লোকটা ভীত কণ্ঠে বলল, ‘সমীর দাশ’।
‘চিত্তর সঙ্গে তোমার সম্পর্ক কি?’
‘কিছু না। তাকে আমি কোনদিন দেখিওনি!’
‘তবে আমাকে এখানে কেন এনেছ?’
‘তোমার কাছ থেকে কিছু খবর পাব বলে।’
‘কি খবর?’
‘কনফারেন্স সম্বন্ধে!’
‘সে আমি জানি, তাড়াতাড়ি বল। আমি অধৈর্য হয়ে পড়ছি।’ বলে অটোমেটিকটা গীতার দিকে ঘুরোলাম, ‘গীতা তোমার নিজের মেয়ে?’
‘হ্যাঁ।’
‘ভাল—বল।’
‘কনফারেন্স চলাকালীন একটা আলাদা ভাবে পরামর্শ হওয়ার কথা ছিল—বেসরকারী পরামর্শ পল ভোল্টাসের সঙ্গে। সেটা টেপ করার জন্যে আমাদের লোকেরা চিত্তকে বলেছিল। কিন্তু ও রাজী হয়নি। তাই যখন জানতে পারলাম যে ও আবার কলকাতায় ফিরে এসেছে, তখন ভাবলাম সে হয়তো ওর মত বদলেছে।’
‘আচ্ছা, এই ব্যাপার—তা রেকর্ডিংটা কার দরকার?’
‘আমাদের বস-এর।’
‘কে সে?’
‘প্রতাপনারায়ণ।’
‘প্রতাপনারায়ণ? প্রমাণ আছে?’
‘না, আমার কথাই প্রমাণ!’
আমি ওর সামনে এসে দাঁড়ালাম।
‘যদি মিথ্যা বলে থাকো, তাহলে আমি আবার ফিরে আসব। আমার হাত থেকে মুক্তি নেই!’ আমি শাসালাম।
‘আমাকে বিশ্বাস কর।’
‘আপাতত করলাম, কিন্তু মনে রেখো গীতার ওপর নজর রইল। যদি কোন কারণে আমাকে ফিরে আসতে হয়, তাহলে তোমার ওই ষোড়শী কন্যা রেহাই পাবে না!—নাও, ওঠো।’
গীতা ভয়ে দেওয়ালের সঙ্গে লেপটে গেল।
‘কোথায় নিয়ে যাচ্ছ আমাকে?’ সমীর জানতে চাইল।
‘টেলিফোন আছে এখানে?’
‘আছে।’
‘প্রতাপনারায়ণকে ফোন করে বল আমি যাচ্ছি।’
‘ওঁর বাড়িতে ফোন করার নিষেধ আছে।’
‘সে আমি জানি না—যা বলার, যে কোন অজুহাত দেওয়ার দাও। কিন্তু প্রতাপনারায়ণকে বল চিত্ত সেই রেকর্ডিং এনে দেবে, কিন্তু তার এক্ষুণি টাকার প্রয়োজন—দেড় লাখ টাকা ক্যাশ। দশ টাকা পাঁচ টাকায় মিলিয়ে। কানে গেছে?
সঞ্জীব টেলিফোন তুলল।
মনে মনে চিন্তা করতে লাগলাম। প্রতাপনারায়ণ। নামকরা ব্যবসায়ী এম-এল-এ’র জন্যে দাঁড়াচ্ছে। প্রায়ই কাগজে তার ছবি বেরোয়। বড় বড় অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করতে হয়। মন্ত্রীদের সঙ্গে যথেষ্ট হৃদ্যতা। দুটো সিনেমার মালিক। একটা স্কুলের প্রেসিডেন্ট। এও কি সম্ভব!
‘⋯আমি জানি না’, সমীর ফোনে বলছিল, ‘এই তার ডিমাণ্ড! ও হয়তো শিগগিরই আপনার ওখানে পৌঁছবে⋯হ্যাঁ⋯তাহলে আমি কি করব এবার⋯আচ্ছা⋯’
‘আমার কথা মনে থাকে যেন।’ বলে আমি বেরিয়ে এলাম।
স্টেজ তৈরি। শিগগিরই পর্দা উঠবে। অভিনয় শুরু হবে।
প্রতাপনারায়ণের বাড়ি পৌঁছলাম।
ভি-আই-পি রোডের ওপর বড় তিনতলা বাড়ি। সামনে বিরাট লন। একটা ফোয়ারা। গেটে দরোয়ান। আমি সোজা গাড়ি চালিয়ে গেটের সামনে এসে বিরক্তিভরে হর্ন বাজালাম। দরোয়ানটা ছুটে এল।
‘কিসকো মাঙ্গতা?’
‘সাহেব আছেন?’ আমি জানতে চাইলাম। কঠিন স্বরে। সিগারেট কেস থেকে একটা সিগারেট বের করে ধরালাম। টেপ রেকর্ডার অন।
‘আছেন⋯কিন্তু আপনি⋯’ দরোয়ানটা আমতা আমতা করতে লাগল। ‘তাকে বল চিত্ত চ্যাটার্জি তার সঙ্গে⋯’
‘চিত্ত চ্যাটার্জি!’
‘হ্যাঁ। মনে হয় আমার নাম শুনেছ!’
‘যাইয়ে সাব।’ দরোয়ানটা সসম্ভ্রমে গেটটা খুলে দিয়ে সেলাম ঠুকল।
মাথাটা ওর দিকে ঈষৎ হেলিয়ে গাড়ি চালিয়ে দিলাম ভেতরে।
গাড়িবারান্দা থেকে দৌড়ে হলঘরে প্রবেশ করলাম। যেন এ-বাড়ির কর্তা আমিই এরকম একটা ভাব। একজন চাকর গোছের কেউ কিছু একটা বলতে এসেও সঙ্কোচ বোধ করল।
‘কাকে চাই?’ হঠাৎ পেছন থেকে প্রশ্ন এল।
‘তুমি বোধ হয় প্রতাপনারায়ণের সেক্রেটারি?’ আমার পাল্টা প্রশ্ন।
এরকম সহজ সম্বোধনে একটু বিব্রত হয়ে পড়ে সে। বলল, ‘হ্যাঁ।’
‘নাম কি?’
‘বিপ্লব। কিন্তু⋯’
‘শোন বিপ্লব, প্রতাপনারায়ণকে গিয়ে বল যে চিত্ত এসেছে।’
‘চিত্ত চ্যাটার্জি!’
‘তুমিও আমাকে চেনো তাহলে!’
‘প্রতাপনারায়ণবাবু বলেছেন আপনি আসামাত্রই তাঁর ঘরে সোজা চলে যেতে।’
‘বেশ, তা কোন ঘর?’
‘দোতলায়। আমি আপনার সঙ্গে আসছি।’ বলে সে এগোতে থাকে।
‘থাক।’ আমি সিঁড়ির দিকে পা বাড়ালাম।
দোতলায় সামনেই একটা ঘরে ভেলভেটের পর্দা ঝুলছে। বোধ হয় প্রতাপনারায়ণের ঘর হবে। ভেতরে প্রবেশ করলাম।
‘প্রতাপনারায়ণ!’ ওর নাম ধরে ডাকলাম।
‘কে?’
‘আমি চিত্ত—চ্যাটার্জি—স্টেটসম্যানের বিশেষ সংবাদদাতা।’
‘এস, এপাশে।’
আওয়াজ অনুসরণ করে এগিয়ে গেলাম। ভেবেছিলাম ও হয়তো একাই থাকবে, কিন্তু চমকে উঠলাম। সঙ্গে আমার বস পুলকবাবুও বসে।
‘ইনি হচ্ছেন পুলক পুরকায়স্থ’, প্রতাপনারায়ণ আমাদের পরিচয় করিয়ে দিল, ‘আর এ হচ্ছে চিত্ত, অ্যাদ্দিন স্টেটসম্যানের সঙ্গে যুক্ত ছিল, এখন আমি একে আনিয়েছি।’
‘ভাঙিয়ে আনিয়েছেন মনে হচ্ছে।’ পুলকবাবু শান্ত ভাবে বললেন।
‘হ্যাঁ। আমাদের নতুন যে ফ্যাক্টরি খুলছি পুণাতে, তার লেবার অফিসার।’
‘বেশ, বেশ’, পুলকবাবু যেন খুশি হলেন, ‘তাহলে আমাদের দেখাসাক্ষাৎ হবে—কি বল হে ছোকরা!’
আমি একটু হাসলাম।
প্রতাপনারায়ণ সিগারেট এগিয়ে দিল। আমি একটা নিলাম। তারপর আমার লাইটারটা বের করলাম। সিগারেট ধরালাম। পুলকবাবুও আর দু-চারটে কথা বলে উঠে পড়লেন। প্রতাপনারায়ণ দরজাটা বন্ধ করে আমার সামনে এসে দাঁড়াল।
‘তুমিই তাহলে চিত্ত?’
‘বকবক করে সময় নষ্ট করো না—সমীরের ফোন পেয়েছ নিশ্চয়?’
‘হ্যাঁ, কিন্তু তার কথা বিশ্বাস করতে পারছি না।’
‘কি বিশ্বাস হচ্ছে না।’
‘তুমি নাকি সব জানো?’
আমি হাসলাম।
‘সমীর বাড়িয়ে বলেছে। সব কি আর জানা যায়?’
‘বেশ, যা জেনেছ, তাই বল।’
‘প্রতাপনারায়ণ!’ আমি উঠে পড়লাম, ‘এখন ন’টা বাজতে দশ। আর দশ মিনিটে ভোল্টাস আসছে। আমাকে এয়ারপোর্টে যেতে হবে। ফালতু সময় আমার নেই। তোমার খবর দরকার, আমার টাকার!’
‘কিন্তু দেড় লাখ যে অনেক টাকা!’
‘জানি। তুমি যা চাচ্ছো, তাও এমন কিছু ছোট না।’
‘অত টাকা দেওয়া অসম্ভব!’
‘তাহলে আমি আসি।’ বলে আমি বাইরে যেতে উদ্যত হই।
‘তুমি বুঝছ না চিত্ত—’ প্রতাপনারায়ণের স্বর বদলে যায়, ‘তোমার শর্তে রাজী হলেও পাঁচ-দশ টাকায় মিলিয়ে দেড় লাখ করতে সময় লাগে।’
‘সে মাথাব্যথা তোমার!’
‘চিত্ত, আমায় একটু সময় দাও।’ তার গলায় যেন মিনতি।
আমি থমকে দাঁড়ালাম। একটু আশ্চর্যও হলাম।
‘তবে কি করতে হবে?’
‘তোমাকে এখন দশ হাজার দিচ্ছি—পাঁচ-দশ মিলিয়ে। বাকিটার জন্যে চেক।’
‘সরি প্রতাপনারায়ণ।’ আমি দৃঢ় ভাবে বললাম, ‘অন্ততঃ এক লাখ টাকা ক্যাশ চাইই।’
‘দ্যাট টেক্স্ টাইম।’
‘তুমি ম্যাক্সিমাম কত এখন হাতে হাতে দিতে পারবে?’
‘হাজার পনেরো হবে।’
‘বেশ, আনো।ֺ’
‘বাকিটা?’
‘তিনটে চেক লেখো—দুটো পঞ্চাশ হাজারের আর একটা পঁয়ত্রিশ হাজারের। অনিমেষ অধিকারীর নামে, গোবর্ধন গড়াইয়ের নামে আর পরিতোষ লাহার নামে।’
‘এরা কারা?’
‘তা দিয়ে তোমার কোন প্রয়োজন নেই।’ আমি ধমক দিলাম।
খসখস করে লেখার আওয়াজ হল। চেক তিনটে আমার দিকে বাড়িয়ে দিল। তারপর ড্রয়ার খুলে একটা প্যাকেট বের করল। কাগজে মোড়া। একটা কোণ ছিঁড়ে দেখলাম—কারেন্সি নোট!’
‘আচ্ছা, এবার তোমার নির্দেশটা রিপিট করছি।’ আমি বললাম, ‘ভুল হলে শুধরে দিও।’
প্রতাপনারায়ণ কিছু বলল না। শুধু মাথাটা নাড়ল।
‘পল ভোল্টাস আজ ন’টার সময় দমদমে নামছেন। ফ্রান্সের ‘মিসাইল’ ইঞ্জিনীয়ার প্রোফেসার পল ভোল্টাস। বিজ্ঞান সম্মেলনে যোগ দেওয়ার জন্যে তাঁর সঙ্গে একটা গোপন পরামর্শ হবার কথা হচ্ছে। সেই পরামর্শের টেপ রেকর্ডিং তোমার দরকার। তারপর পল ভোল্টাসকে হত্যা করতে হবে—ঠিক?’
‘হ্যাঁ, এই আমি চাই।’
‘তার জন্যে তুমি আমাকে দেড় লাখ টাকা দিয়েছ?’
‘হ্যাঁ।’
‘বেশ—তুমি রেকর্ডিংও পাবে এবং পল ভোল্টাসকেও হত্যা করা হবে। আমি এবার উঠি। সময় নেই।’
যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিমানবন্দরে পৌঁছে গেলাম। প্লেনটা ততক্ষণে নেমে গেছে এবং আস্তে আস্তে রান-ওয়ে দিয়ে এগিয়ে আসছে। একসময় সেটা থামল। লোকজন নামতে আরম্ভ করল। আমি দূরবীন লাগিয়ে খুঁজতে লাগলাম। প্রফেসর পল ভোল্টাসকে। কিন্তু তিনি নামলেন না। আমি অনেকক্ষণ ধরে চিন্তা করলাম এবং হঠাৎই সব যেন জলের মত স্বচ্ছ হয়ে গেল।
পল ভোল্টাস আসবেন না!
আজ নয়, কাল নয়, কোনদিন নয়। কারণ ওই নামের কেউ নেই। মনে মনে আমার বসের তারিফ করে পারলাম না। একটি মাত্র লোককে ধরার জন্য এত বড় একটা চক্রান্ত—এত বড় ধোঁকা!
যখন ‘ওমেগা ইণ্ডাষ্ট্রিজ’য়ের অফিসে এসে পৌঁছলাম তখনও দশটা বাজতে কিছু বাকি ছিল। বসকে পেলাম। সিগারেট কেস, চেক তিনটে, কারেন্সি নোটের প্যাকেট আর লাইটারটা তাঁকে ফেরৎ দিলাম।
‘কিন্তু স্যার’, তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ব্যাপারটা যদিও বা আঁচ করতে পারলাম—এবার প্রতাপনারায়ণের কি হবে?’
‘কিচ্ছু না, যেমন আছে তেমন থাকবে।’
‘তাহলে এত আয়োজনের কি দরকার ছিল?’
‘কারণ এখন চিত্ত চ্যাটার্জির নাম শুনলেই ও গুটিয়ে যাবে!’
‘কি রকম?’
এই টেপের একটা রেকর্ডিং, ওই চেকের ফোটোস্ট্যাট কপি, আর যে ছবিগুলো তুলেছ সেগুলোর একখানা করে কপি ওকে পাঠিয়ে দেওয়া হবে।—ওকে বহুদিন থেকে সন্দেহ করছিলাম। তাই এই সম্মেলনটার অজুহাতে ওকে এবার আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলতে পারলাম।’
‘যদি আমাকে আগে বলতেন, তাহলে আরও ছবি তুলে আনতাম!’
‘তোমার বুদ্ধি আছে বলেই তোমাকে আমাদের সমিতিতে নিয়েছি। এটুকু বিশ্বাস আমার আছে যে, দরকারী ছবিই তুমি তুলেছ।’
এর উত্তরে আমি আর কিছু বলতে পারলাম না।
বলার কিই বা থাকতে পারে।