বিরাজবৌ – ১৮ (শেষ)

আঠার

কঠিন ব্যাধিপীড়িত কত নরনারী কত কামনায় এই দেবমন্দির ঘেরিয়া ইতস্ততঃ পড়িয়া আছে, তাহাদের মধ্যে আসিয়া বিরাজ অনেকদিনের পর একটু শান্তি অনুভব করিল। তাহাদের মত তাহারও ব্যাধি আছে, কামনা আছে, সে তাই লইয়া এখানে নীরবে পড়িয়া থাকিতে পাইবে, কাহারও দৃষ্টি আকর্ষণ করিবে না, কাহারও অর্থহীন কৌতূহল চরিতার্থ করিতে হইবে না মনে করিয়া এত দুঃখের মাঝেও আরাম পাইল। কিন্তু রোগ দ্রুত বাড়িয়া চলিতে লাগিল। মাঘের এই দুর্জয় শীতে ও অনাহারে ছয়দিন কাটিয়া গেল, কিন্তু আর কাটিবে বলিয়াও আশা হইল না, কেহ আসিবে বলিয়াও ভরসা রহিল না। ভরসা রহিল শুধু মৃত্যুর—সে তারই জন্য আর একবার নিজ়েকে প্রস্তুত করিতে লাগিল।

সেদিন আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হইয়াছিল, অপরাহ্ন না হইতেই আঁধার বোধ হইতে লাগিল। ও-বেলায় তাহার মুখ দিয়া অনেকখানি রক্ত উঠায় মৃতকল্প দেহটা যেন একেবারে নিঃশেষে ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছিল। সে মনে মনে বলিল, বুঝি, আজই সব সাঙ্গ হইবে এবং তখন হইতেই মন্দিরের পিছনে মুখ গুঁজিয়া পড়িয়া ছিল। দ্বিপ্রহরে ঠাকুরের পূজা হইয়া গেলে অন্যদিনের মত উঠিয়া বসিয়া নমস্কার করিতে পারিল না—মনে মনে করিল। এতদিন স্বামীর চরণে সে শুধু মিনতি জানাইয়াই আসিয়াছে। সে অবোধ নয়, যে কাজ করিয়া ফেলিয়াছে, তাহাতে এ জন্মের কোন দাবী রাখে নাই, শুধু পরজন্মের অধিকার না যায়, ইহাই চাহিয়াছে। না বুঝিয়া অপরাধ করার শাস্তি যেন এ জন্ম অতিক্রম করিয়া পরজন্ম পর্যন্ত ব্যাপ্ত না হইতে পায়, এই ভিক্ষাই মাগিয়াছে। কিন্তু বেলা অবসানের সঙ্গে সঙ্গে তাহার চিন্তার ধারা সহসা এক আশ্চর্য পথে ফিরিয়া গেল। ভিক্ষার ভাব রহিল না, বিদ্রোহের ভাব দেখা দিল। সমস্ত চিত্ত ভরিয়া এক অপূর্ব অভিমানের সুর অনির্বচনীয় মাধুর্যে বাজিয়া উঠিল। সে তাহাতেই মগ্ন হইয়া কেবলই বলিতে লাগিল, কেন তবে তুমি বলেছিলে!

অজ্ঞাতসারে কখন তাহার পঙ্গু বাঁ হাতখানি স্খলিত হইয়া পথের উপর পড়িয়াছিল, সে টের পায় নাই, সহসা তাহারই উপর একটা কঠিন ব্যথা পাইয়া সে অস্ফুটস্বরে কাতরোক্তি করিয়া উঠিল। এটা যাতায়াতের পথ। যে ব্যক্তি না দেখিয়া এই অবশ শীর্ণ হাতখানি মাড়াইয়া দিয়াছিল, সে অতিশয় লজ্জিত ও ব্যথিত হইয়া ফিরিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, আহা হা—কে গা, এমন করে পথের উপর শুয়ে আছ? বড় অন্যায় করেচি—বেশী লাগেনি ত?

চক্ষের পলকে বিরাজ মুখের কাপড় সরাইয়া চাহিয়া দেখিল, তার পর আর একটা অস্ফুট ধ্বনি করিয়া চুপ করিল। এই ব্যক্তি নীলাম্বর। সে একবার একটু ঝুঁকিয়া দেখিয়া সরিয়া গেল।

কিছুক্ষণে সূর্য অস্ত গেল। পশ্চিম দিগন্তে মেঘ ছিল না, চক্রবালবিচ্ছুরিত স্বর্ণাভা মন্দিরের চূড়ায়, গাছের আগায় ছড়াইয়া পড়িয়াছিল, নীলাম্বর দূরে দাঁড়াইয়া পুঁটিকে কহিল, ওই রোগা মেয়েমানুষটিকে বড় মাড়িয়ে দিয়েচি বোন, দেখ দেখি যদি কিছু দিতে পারিস—বোধ করি ভিক্ষুক।

পুঁটি চাহিয়া দেখিল, স্ত্রীলোকটি একদৃষ্টে তাহাদেরই দিকে চাহিয়া ধীরে ধীরে কাছে আসিয়া দাঁড়াইল। তাহার মুখের কিয়দংশ বস্ত্রাবৃত, তথাপি মনে হইল, এ মুখ যেন সে পূর্বে দেখিয়াছে। জিজ্ঞাসা করিল, হাঁ গা তোমার বাড়ি কোথায়?

সাতগাঁয়, বলিয়া স্ত্রীলোকটি হাসিল।

বিরাজের সবচেয়ে মধুর সামগ্রী ছিল তাহার মুখের হাসি; এ হাসি সমস্ত সংসারের মধ্যে কাহারও ভুল করিবার জো ছিল না। ওগো এ যে বৌদি, বলিয়া সেই মুহূর্তেই পুঁটি সেই জীর্ণশীর্ণ দেহের উপর উপুড় হইয়া পড়িয়া মুখে মুখ দিয়া কাঁদিয়া উঠিল।
নীলাম্বর দূরে দাঁড়াইয়া দেখিতেছিল, কথাবার্তা শুনিতে না পাইলেও সমস্ত বুঝিল। সে কাছে আসিয়া দাঁড়াইল। একবার তাহার আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করিল, তারপর শান্তকন্ঠে বলিল, এখানে কাঁদিসনে পুঁটি, ওঠ, বলিয়া ভগিনীকে সরাইয়া দিয়া স্ত্রীর শীর্ণদেহ ক্ষুদ্র শিশুটির মত বুকে তুলিয়া লইয়া দ্রুতপদে বাসার দিকে চলিয়া গেল।

চিকিৎসার জন্য, উত্তম স্বাস্থ্যকর স্থানে যাইবার জন্য বিরাজকে অনেক সাধ্য-সাধনা করা হইয়াছিল, কিন্তু কোনমতেই তাহাকে রাজী করান যায় নাই। আর ঘর ছাড়িয়া যাইতে সে কিছুতেই সম্মত হইল না।

নীলাম্বর পুঁটিকে আড়ালে ডাকিয়া বলিয়া দিল, আর কটা দিন বোন? যেখানে যেমন করে ও থাকতে চায়, দে। আর ওকে তোরা পীড়াপীড়ি করিস নে।

তারকেশ্বরে স্বামীর কোলে মাথা রাখিয়া সে প্রথম আবেদন জানাইয়াছিল, তাহাকে ঘরে লইয়া চল, তাহার নিজের শয্যার উপরে শোয়াইয়া দাও। ঘরের উপর, ঘরের প্রতি সামগ্রীটির উপর এবং স্বামীর উপর তাহার কি ভীষণ তৃষ্ণা , তাহা যে-কেহ চোখে দেখে সে-ই উপলব্ধি করিয়া কাঁদিয়া ফেলে। দিবারাত্রির অধিকাংশ সময়ই সে জ্বরে আচ্ছন্নের মত পড়িয়া থাকে , কিন্তু একটু সজাগ হইলেই ঘরের প্রতি বস্তুটি তন্ন তন্ন করিয়া চাহিয়া দেখে।

নীলাম্বর শয্যা ছাড়িয়া প্রায়ই কোথাও যায় না এবং প্রায়ই সজল চক্ষে প্রার্থনা করে, ভগবান, অনেক শাস্তি দিয়াছ, এইবার ক্ষমা কর। যে লোক পরলোকে যাত্রা করিয়াছে , তাহার ইহলোকের মোহ কাটাইয়া দাও।

গৃহত্যাগিনীর গৃহের উপর এই নিদারুণ আকর্ষণ দেখিয়া সে মনে মনে কন্টকিত হইয়া উঠিতে থাকে। দুই সপ্তাহ গত হইয়াছে। কাল হইতে তাহার বিকারের লক্ষণ প্রকাশ পাইয়াছিল। আজ সারাদিন ভুল বকিয়া কিছুক্ষণ পূর্বে ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল, সন্ধ্যার পর চোখ মেলিয়া চাহিল। পুঁটি কাঁদিয়া কাটিয়া পায়ের কাছে পড়িয়া ঘুমাইতেছে। ছোটবৌ শিয়রের কাছে বসিয়া আছে, তাহাকে দেখিয়া বলিল, ছোটবৌ না?

ছোটবৌ মুখের উপর ঝুঁকিয়া পড়িয়া বলিল, হাঁ দিদি, আমি মোহিনী।

পুঁটি কোথায়?

ছোটবৌ হাত দিয়া দেখাইয়া বলিল, তোমার পায়ের কাছে ঘুমাচ্চে।

উনি কৈ?

ও ঘরে আহ্নিক কচ্চেন।

তবে আমিও করি, বলিয়া সে চোখ বুজিয়া মনে মনে জপ করিতে লাগিল। অনেকক্ষণ পরে ডান হাত ললাটে স্পর্শ করিয়া নমস্কার করিল, তারপর ছোটবৌয়ের মুখের পানে ক্ষণকাল নিঃশব্দে চাহিয়া থাকিয়া আস্তে আস্তে বলিল, বোধ করি আজই চললুম বোন, কিন্তু আবার যেন দেখা হয়, আবার যেন তোকেই এমনি কাছে পাই।

বিরাজের সময় যে একেবারে শেষ হইয়া আসিয়াছিল, কাল হইতে তাহা সকলেই টের পাইয়াছিল, তাহার কথা শুনিয়া ছোটবৌ নিঃশব্দে কাঁদিতে লাগিল।

বিরাজের বেশ জ্ঞান হইয়াছে। সে কণ্ঠস্বর আরও নত করিয়া চুপি চুপি বলিল , ছোটবৌ , সুন্দরীকে একবার ডাকতে পারিস?

ছোটবৌ রুদ্ধস্বরে বলিল, আর তাকে কেন দিদি? সে আসবে না।

আসবে রে আসবে। একবার ডাকা—আমি তাকে মাপ করে আশীর্বাদ করে যাই। আর আমার কারও ওপর রাগ নেই, কারও ওপর কোন ক্ষোভ নেই। ভগবান আমাকে যখন ক্ষমা করেচেন , আমার স্বামীকে ফিরিয়ে দিয়েচেন, আমিও তখন সকলকে ক্ষমা করে যেতে চাই।
ছোটবৌ কাঁদিতে কাঁদিতে বলিল, এ আর ক্ষমা কি দিদি? বিনা অপরাধে এত দণ্ড দিয়েও তাঁর মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হ’ল না—তিনি তোমাকেও নিতে বসেচেন। একটা হাত নিলেন, চোখ নিলেন , তবুও যদি তোমাকে আমাদের কাছে ফেলে রেখে দিতেন—

বিরাজ হাসিয়া উঠিল। বলিল, কি করতিস আমাকে নিয়ে? পাড়ায় দুর্নাম রটেচে—আমার বেঁচে থাকায় আর ত লাভ নেই বোন।

ছোটবৌ গলায় জোর দিয়া বলিয়া উঠিল, আছে দিদি, তা ছাড়া ও ত মিথ্যে দুর্নাম—ওতে আমরা ভয় করিনে।

তোরা করিস নে, আমি করি। দুর্নাম মিথ্যে নয়, খুব সত্যি। আমার অপরাধ যতটুকুই হয়ে থাক ছোটবৌ, তার পরে আর হিঁদুর ঘরের মেয়ের বাঁচা চলে না। তোরা ভগবানের দয়া নেই বলচিস, কিন্তু—

তাহার কথাটা শেষ হইবার পূর্বেই পুঁটি উচ্ছ্বসিত কান্নার সুরে চেঁচাইয়া উঠিল, ওঃ ভারী দয়া ভগবানের!

এতক্ষণ সে চুপ করিয়া কাঁদিতেছিল আর শুনিতেছিল। আর সহ্য করিতে না পারিয়া অমন করিয়া উঠিল। কাঁদিয়া বলিল, তাঁর এতটুকু দয়া নেই, এতটুকু বিচার নেই। যারা আসল পাপী, তাদের কিছু হল না, আর আমাদের তিনি এমনই করে শাস্তি দিচ্চেন।

তাহার কান্নার দিকে চাহিয়া বিরাজ নিঃশব্দে হাসিতে লাগিল। কি মধুর, কি বুকভাঙ্গা হাসি! তারপরে কৃত্রিম ক্রোধের স্বরে বলিল, চুপ কর্‌ পোড়ারমুখী, চেঁচাস্‌ নে।

পুঁটি ছুটিয়া আসিয়া তাহার গলা জড়াইয়া ধরিয়া উচ্চৈঃস্বরে কাঁদিয়া উঠিল, তুমি ম’রো না বৌদি, আমরা কেউ সইতে পারব না। তুমি ওষুধ খাও—আর কোথাও চল—তোমার দুটি পায়ে পড়ি বৌদি, আর দুটো দিন বাঁচ।

তাহার কান্নার শব্দে আহ্নিক ফেলিয়া নীলাম্বর ত্রস্তপদে কাছে আসিয়া শুনিতে লাগিল, পুঁটির যা মুখে আসিল, সে তাই বলিয়া ক্রমাগত অনুনয় করিতে লাগিল। এইবার বিরাজের দুই চোখ বাহিয়া বড় বড় অশ্রুর ফোঁটা ঝরিয়া পড়িল। ছোটবৌ সযত্নে তাহা মুছাইয়া দিয়া পুঁটিকে টানিয়া লইতেই, সে তাহার বুকের মধ্যে মুখ লুকাইয়া সকলকে কাঁদাইয়া ফুলিয়া ফুলিয়া কাঁদিতে লাগিল। বহুক্ষণ পরে বিরাজ অবনত ভগ্নকন্ঠে বলিতে লাগিল, কাঁদিস নে পুঁটি, শোন্‌।

নীলাম্বর আড়ালে দাঁড়াইয়া শুনিতে লাগিল, বিরাজের চৈতন্য সম্পূর্ণ ফিরিয়া আসিয়াছে। তাহার যন্ত্রণার অবসান হইয়াছে তাহা সে বুঝিল। বিরাজ বলিতে লাগিল, না বুঝে তাঁর দোষ দিস না পুঁটি। কি সূক্ষ্ম বিচার, তবু যে কত দয়া, সে কথা আমার চেয়ে কেউ বেশী জানে না। মরাই আমার বাঁচা, সে কথা আমি গেলেই তোরা বুঝবি। আর বলচিস— একটা হাত আর একটা চোখ নিয়েচেন, সে ত দুদিন আগে পাছে যেতই। কিন্তু এইটুকু শাস্তি দিয়ে তিনি তোদের কোলে আমাকে ফিরিয়ে দিয়েচেন, সেটা কি করে ভুলবি পুঁটি?

ছাই ফিরিয়ে দিয়েচেন, বলিয়া পুঁটি কাঁদিতেই লাগিল।

ভগবানের দয়া বা সূক্ষ্মবিচারের একটা বর্ণও সে বিশ্বাস করিল না। বরং সমস্ত ব্যাপারটা তাহার কাছে গভীর অত্যাচার ও অবিচার বলিয়াই মনে হইতে লাগিল। খানিক পরে বিরাজ বলিল, পুঁটি, অনেকক্ষণ দেখিনি রে, তোর দাদাকে একবার ডাক্‌।
নীলাম্বর আড়ালেই ছিল, আসিতেই ছোটবৌ বিছানা ছাড়িয়া সরিয়া দাঁড়াইল। নীলাম্বর শিয়রে বসিয়া স্ত্রীর ডান হাতটা সাবধানে নিজের হাতে তুলিয়া লইয়া নাড়ী দেখিতে লাগিল। সত্যই বিরাজের আর কিছু ছিল না। সে যে জ্বরের উপর এত কথা বলিতেছে এবং ইহারই অবসানের সঙেগ খুব সম্ভব সমস্তই শেষ হইবে, তাহা সে পূর্বেই অনুমান করিয়াছিল, এখন তাহাই বুঝিল।

বিরাজ বলিল, বেশ হাত দেখ, বলিয়াই হাসিল।

সহসা সে মর্মান্তিক পরিহাস করিয়া ফেলিল। এই উপলক্ষ করিয়াই যে এত কাণ্ড ঘটিয়াছে, তাহা সকলেরই মনে পড়িয়া গেল। বেদনায় নীলাম্বরের মুখ বিবর্ণ হইয়া গিয়াছে, বিরাজও বোধ করি তাহা দেখিতে পাইল। সে তৎক্ষণাৎ অনুতপ্ত হইয়া বলিল, না, না, তা বলিনি—সত্যিই বলচি, আর কত দেরি? বলিয়া চেষ্টা করিয়া নিজের মাথা স্বামীর ক্রোড়ে তুলিয়া দিয়া বলিল, সকলের সুমুখে আর একবার তুমি বল, আমাকে মাপ করেচ?

নীলাম্বর রুদ্ধস্বরে ‘করেচি’ বলিয়া হাত দিয়া চোখ মুছিল।

বিরাজ ক্ষণকাল চোখ বুজিয়া থাকিয়া মৃদুকণ্ঠে বলিতে লাগিল, জ্ঞানে, অজ্ঞানে এতদিনের ঘরকন্নায় কতই না দোষ-ঘাট করেচি—ছোটবৌ, তুমিও শোন, পুঁটি তুইও শোন্‌ দিদি, তোমরা সব ভুলে আজ আমাকে বিদেয় দাও—আমি চল্লুম। বলিয়া সে হাত বাড়াইয়া স্বামীর পদতল খুঁজিতে লাগিল। নীলাম্বর মাথার বালিশটা এক পাশে সরাইয়া দিয়া উপরে পা তুলিতেই বিরাজ হাত দিয়া ক্রমাগত পায়ের ধূলা মাথায় দিতে দিতে বলিল, আমার সব দুঃখ এতদিনে সার্থক হল—আর কিছু বাকী নেই। দেহ আমার শুদ্ধ নিষ্পাপ—এইবার যাই, গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি গে। বলিয়া সে পাশ ফিরিয়া ক্রোড়ের মধ্যে মুখ গুঁজিয়া অস্ফুটস্বরে কহিল, এমনই করে আমাকে নিয়ে থাক, কোথাও যেও না, বলিয়া নীরব হইল। সে শ্রান্ত হইয়া পড়িয়াছিল।

সকলেই শুষ্কমুখে বসিয়া রহিল। রাত্রি বারোটার পর হইতে আবার সে ভুল বকিতে লাগিল। নদীতে ঝাঁপাইয়া পড়ার কথা—হাসপাতালের কথা—নিরুদ্দেশ পথের কথা—কিন্তু, সব কথার মধ্যে অত্যুগ্র একাগ্র পতিপ্রেম। মুহূর্তের ভ্রম কি করিয়া সে সতী-সাধ্বীকে দগ্ধ করিয়াছে শুধুই তাই।

এ কয়দিন তাহারই সুমুখে বসিয়া নীলাম্বরকে আহার করিতে হইত; সেদিন মাঝে মাঝে সে পুঁটিকে ডাকিয়া, ছোটবৌকে ডাকিয়া বকিতে লাগিল। তার পর, ভোরবেলায় সমস্ত ডাকাডাকি দমন করিয়া দীর্ঘশ্বাস উঠিল। আর সে চাহিল না, আর সে কথা কহিল না, স্বামীর দেহে মাথা রাখিয়া সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গেই দুঃখিনীর সমস্ত দুঃখের অবসান হইয়া গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *