বিরাজবৌ – ০৪

চার

আরও ছয় মাস অতীত হইয়া গেল। হরিমতির বিবাহের পূর্বেই ছোটভাই বিযয়সম্পত্তি ভাগ করিয়া লইয়াছিল, নীলাম্বরের নিজের ভাগে যাহা পড়িয়াছিল তাহার কিয়দংশ সেই সময়েই বাঁধা দিয়া অর্থ সংগ্রহ করিতে হইয়াছিল—বলা বাহুল্য, পীতাম্বর এক কপর্দক দিয়াও সাহায্য করে নাই। অবশিষ্ট জমিজমা যাহা ছিল তাহাই একটির পর একটি বন্ধক দিয়া নীলাম্বর বিবাহের শর্ত পালন করিয়া ভগিনীপতির পড়ার খরচ যোগাইতে লাগিল এবং সংসার চালাইতে লাগিল। এইরূপে দিন দিন নিজেকে সে ক্রমাগত শক্ত করিয়া জড়াইয়া ফেলিতে লাগিল, কিন্তু মমতাবশে কোনমতেই পৈতৃক সম্পত্তি একেবারে বিক্রয় করিয়া ফেলিতে পারিল না। আজ বৈকালে ও-পাড়ার ভোলানাথ মুখুয্যে আসিয়া বাকী সুদের জন্য কয়েকটা কথা কড়া করিয়াই বলিয়া গিয়াছিল, আড়ালে দাঁড়াইয়া বিরাজ তাহা সমস্তই শুনিল এবং নীলাম্বর ঘরে আসিতেই, সে রান্নাঘর হইতে নি:শব্দে সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল। তাহার মুখের পানে চাহিয়াই নীলাম্বর মনে মনে প্রমাদ গণিল। ক্ষোভে অপমানে বিরাজের বুকের ভিতরটা হুহু করিয়া জ্বলিতেছিল। কিন্তু সে ভাব সংযত করিয়া হাত দিয়া খাট দেখাইয়া দিয়া প্রশান্ত-গম্ভীরকন্ঠে বলিল, ঐখানে ব’স।

নীলাম্বর শয্যার উপর বসিতেই সে নীচে পায়ের কাছে বসিয়া পড়িয়া বলিল, হয় আমাকে ঋণমুক্ত কর, না হয়, আজ তোমার পা ছুঁয়ে দিব্যি করব।

নীলাম্বর বুঝিল, সে সমস্ত শুনিয়াছে, তাই অত্যন্ত ভয় পাইয়া তৎক্ষণাৎ ঝুঁকিয়া পড়িয়া তাহার মুখে হাত চাপা দিয়া তাহাকে জোর করিয়া টানিয়া তুলিয়া পাশে বসাইয়া স্নিগ্ধকণ্ঠে বলিল, ছি বিরাজ, সামান্যতেই আত্মহারা হ’সনে।

বিরাজ মুখের উপর হইতে তাহার হাতটা সরাইয়া দিয়া বলিল, এতেও মানুষ আত্মহারা না হয়, কিসে হয় বল শুনি।

নীলাম্বর কি জবাব দিবে হঠাৎ খুঁজিয়া পাইল না, চুপ করিয়া বসিয়া রহিল।

বিরাজ বলিল, চুপ করে রইলে কেন? জবাব দাও।

নীলাম্বর মৃদুকন্ঠে বলিল, জবাব দেবার কিছুই নেই বিরাজ, কিন্তু—

বিরাজ বাধা দিয়া বলিয়া উঠিল, না, কিন্তুতে হবে না। আমার বাড়িতে দাঁড়িয়ে লোকে তোমাকে অপমান করে যাবে, কানে শুনে আমি সহ্য করে থাকব—এ ভরসা মনে ঠাঁই দিও না। হয় তার উপায় কর, না হয় আমি আত্মঘাতী হব।

নীলাম্বর ভয়ে ভয়ে কহিল, একদিনেই কি উপায় করব বিরাজ?

বেশ, দুদিন পরে কি উপায় করবে, তাই আমাকে বুঝিয়ে বল।

নীলাম্বর পুনরায় মৌন হইয়া রহিল।

বিরাজ বলিল, একটা অসম্ভব আশা করে নিজেকে ভুল বুঝিয়ো না—আমার সর্বনাশ ক’রো না! যত দিন যাবে ততই বেশী জড়িয়ে পড়বে, দোহাই তোমার, আমি ভিক্ষে চাইচি—তোমার দুটি পায়ে ধরছি, এই বেলা যা হয় একটা পথ কর।—বলিতে বলিতে তাহার অশ্রুভারে কণ্ঠ রুদ্ধ হইয়া আসিল। ভুলু মুখুয্যের কথাগুলো তাহার বুকের ভিতরে শূল হানিতে লাগিল।

নীলাম্বর হাত দিয়া তাহার চোখ মুছাইয়া দিয়া ধীরে ধীরে বলিল, অধীর হলে কি হবে বিরাজ? একটা বছর যদি ষোল আনা ফসল পাই, বার আনা বিষয় উদ্ধার করে নিতে পারব। কিন্তু বিক্রি করে ফেললে আর ত হবে না সেটা ভেবে দেখ!

বিরাজ আর্দ্রস্বরে বলিল, দেখচি; আসচে বছরেই যে ষোল আনা ফসল পাবে, তারই বা ঠিকানা কি? তার ওপর সুদ আছে, লোকের গঞ্জনা আছে। আমি সব দুঃখ সইতে পারি, কিন্তু তোমার অপমান ত সইতে পারিনে।
নীলাম্বর নিজে তাহা বেশ জানিত, তাই কথা কহিতে পারিল না।

বিরাজ পুনরায় কহিল, শুধু এই কি আমার সমস্ত দুঃখ? দিবারাত্রি ভেবে ভেবে তুমি আমার চোখের সামনে শুকিয়ে উঠচ, এমন সোনার মূর্তি কালি হয়ে যাচ্চে। আচ্ছা, আমার গাঁ ছুয়ে তুমিই বল, এও সহ্য করবার ক্ষমতা কি আমার আছে? আর কতদিন যোগীনের পড়ার খরচ যোগাতে হবে?

আরও একটা বছর। তা হলেই সে ডাক্তার হতে পারবে।

বিরাজ একমুহূর্ত স্থির থাকিয়া বলিল, পুঁটিকে মানুষ করেচি—সে আমার রাজরাণী হ’ক, কিন্তু সে হতে আমার এত দুঃখ ঘটবে জানলে, ছোটবেলায় তাকে নদীতে ভাসিয়ে দিতুম। এমন করে নিজের মাথায় বাজ হানতুম না। হা ভগবান! বড়লোক তারা, কোন কষ্ট, কোন অভাব নেই, তবুও জোঁকের মত আমার রক্ত শুষে নিতে তাদের এতটুকুও দয়া-মায়া হচ্চে না! —বলিয়া একটা সুগভীর নিশ্বাস ফেলিয়া স্তব্ধ হইয়া বসিয়া রহিল। বহুক্ষণ নিঃশব্দে কাটিবার পরে বিরাজ মুখ তুলিয়া আস্তে আস্তে বলিল, চারিদিকে অভাব, চারিদিকে আকাল, গরীব-দুঃখীরা ত এরই মধ্যে কেউ উপোস, কেউ একবেলা খেতে শুরু করেচে, এমন দুঃসময়েও আমরা পরের ছেলে মানুষ করব কেন? পুঁটির শ্বশুরের অভাব নেই, সে বড়লোক; সে যদি নিজের ছেলেকে না পড়াতে পারে, আমরা পড়াব কেন? যা হয়েচে তা হয়েচে, তুমি আর ধার করতে পাবে না।

নীলাম্বর অতিকষ্টে শুষ্কহাসি ওষ্ঠপ্রান্তে টানিয়া আনিয়া বলিল, সব বুঝি বিরাজ, কিন্তু শালগ্রাম সুমুখে রেখে শপথ করেচি যে! তার কি হবে?

বিরাজ তৎক্ষণাৎ জবাব দিল, কিচ্ছু হবে না। শালগ্রাম যদি সত্যিকারের দেবতা হন, তিনি আমার কষ্ট বুঝবেন। আর আমি ত তোমারই অর্ধেক, যদি কিছু এতে পাপ হয়, আমি আমার নিজের মাথায় নিয়ে জন্ম জন্ম নরকে ডুবে থাকব; তোমার কিছু ভয় নেই—তুমি আর ঋণ ক’রো না।

নীলাম্বর কাতরদৃষ্টিতে একটিবার মাত্র স্ত্রীর মুখের পানে চাহিয়া পরক্ষণেই নিরুপায়ের মত মাথা হেঁট করিয়া বসিয়া রহিল। ধর্মপ্রাণ স্বামীর অন্তরের নিদারুণ দুঃখের লেশমাত্রও তাহার অগোচর ছিল না। কিন্তু সে আর সহিতে পারিতেছিল না। যথার্থই স্বামী তাহার সর্বস্ব ছিল। সেই স্বামীর অহর্নিশি চিন্তাক্লিষ্ট শুষ্ক অবসন্ন মুখের পানে চাহিয়া তাহার বুক ফাটিতেছিল। এতক্ষণ কোনমতে সে কান্না চাপিয়া কথা কহিতেছিল, আর পারিল না। সবেগে স্বামীর বুকের মধ্যে মুখ লুকাইয়া ফুঁপাইয়া কাঁদিয়া উঠিল।

নীলাম্বর তাহার দক্ষিণ হস্ত বিরাজের মাথার উপরে রাখিয়া নির্বাক্‌ নিশ্চল হইয়া বসিয়া রহিল। বহুক্ষণ কান্নার পরে তাহার দুঃখের অসহ তীব্রতা মন্দীভূত হইয়া আসিলে সে তেমনই মুখ লুকাইয়া কাঁদিতে কাঁদিতে বলিল, ছেলেবেলা থেকে যতদূর আমার মনে পড়ে, কোনদিন তোমার মুখ শুক্‌নো দেখিনি, কোন দিন তোমার মুখ ভার করতে দেখিনি; এখন তোমার পানে চাইলেই আমার বুকের মধ্যে রাবণের চিতা জ্বলতে থাকে—তুমি নিজের পানে না চাও, আমার দিকে একবার চেয়ে দেখ! সত্যই কি শেষকালে আমাকে পথের ভিখারিণী করবে? সে কি তুমিই সইতে পারবে?

নীলাম্বর তথাপি উত্তর দিতে পারিল না, অন্যমনস্কের মত তাহার চুলগুলি লইয়া ধীরে ধীরে নাড়িতে লাগিল। এমনি সময়ে দ্বারের বাহিরে পুরানো ঝি সুন্দরী ডাকিয়া বলিল, বৌমা, উনুন জ্বেলে দেব কি?

বিরাজ ধড়মড় করিয়া উঠিয়া বসিয়া আঁচলে চোখ মুছিয়া বাহিরে আসিয়া দাঁড়াইল।
সুন্দরী পুনরায় কহিল, উনুন জ্বেলে দেব?

বিরাজ অস্পষ্টস্বরে বলিল, দে, তোদের জন্যে রাঁধতে হবে, আমি আর কিছু খাব না।

ঝি বড় গলায় নীলাম্বরকে শুনাইয়া বলিল, তুমি কি মা, তবে রাত্তিরে খাওয়া একেবারে ছেড়ে দিলে? না খেয়ে খেয়ে যে একেবারে আধখানি হয়ে গেলে!

বিরাজ তাহার হাত ধরিয়া টানিয়া রান্নাঘরের দিকে লইয়া গেল।

জ্বলন্ত উনুনের আলো বিরাজের মুখের উপর পড়িয়াছিল। অদূরে বসিয়া সুন্দরী হাঁ করিয়া সেই দিকে চাহিয়া ছিল। হঠাৎ বলিল, সত্যি কথা মা, তোমার মত রূপ আমি মানুষের কখন দেখিনি—এত রূপ রাজা-রাজড়ার ঘরেও নেই।

বিরাজ তাহার দিকে মুখ ফিরাইয়া ঈষৎ বিরক্তভাবে বলিল, তুই রাজারাজড়ার ঘরের খবর রাখিস?

সুন্দরীর বয়স পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ। রূপসী বলিয়া তাহারও এক সময় খ্যাতি ছিল, সে খ্যাতি আজিও সম্পূর্ণ লুপ্ত হয় নাই।

সে বলিত, কবে তাহার বিবাহ হইয়াছিল, কবে বিধবা হইয়াছিল, কিছুই মনে পড়ে না, কিন্তু সধবার সৌভাগ্য হইতে একেবারে বঞ্চিত হয় নাই। তাহাদের গ্রাম কৃষ্ণপুরে এ সুখ্যাতিও তাহার ছিল। এখন হাসিয়া বলিল, রাজারাজড়ার ঘরের খবর রাখি বৈ কি মা! না হলে সেদিন তাকে ঝাঁটাপেটা কত্তুম।

এবার বিরাজ রীতিমত রাগ করিল, বলিল, তুই যখন তখন ঐ কথাই বলিস কেন সুন্দরী? তাদের যা খুশি বলেচে, তাতে তুই বা ঝাঁটাপেটা করবি কেন? আর আমাকেই বা নাহ’ক শোনাবি কেন? উনি রাগী মানুষ, শুনলে কি বলবেন বল ত?

সুন্দরী অপ্রতিভ হইয়া বলিল, বাবু শুনবেন কেন মা? এও কি একটা কথার মত কথা!

কথার মত কথা নয়, সে কথা কি তুই আমাকে বুঝিয়ে বলবি? তা ছাড়া যা হয়ে বয়ে চুকে শেষ হয়ে গেছে, সে কথা তোলবার দরকারই বা কি?

সুন্দরী খপ করিয়া বলিল, কোথায় চুকেবুকে শেষ হয়েচে মা? কালও যে আমাকে ডাকিয়ে নিয়ে গিয়ে—

বিরাজ রাগিয়া উঠিল। বলিল, তুই গেলি কেন? তুই আমার কাছে চাকরি করবি, আর যে ডাকবে তার কাছে ছুটে যাবি? তুই নিজে না বললি সেদিন তাঁরা সব কলকাতায় চলে গেছেন?

সুন্দরী বলিল, সত্যি কথাই বলেছিলুম মা। মাস-দুই তাঁরা চলে গিয়েছিলেন, আবার দেখচি সব এসেচেন। আর যাবার কথা যদি বললে মা, পিয়াদা ডাকতে এলে, না বলি কি করে? তাঁরা এ মুল্লুকের জমিদার, আমরা দুঃখী প্রজা—হুকুম অমান্যি করি কি ভরসায়?

বিরাজ ক্ষণকাল চাহিয়া থাকিয়া কহিল, তাঁরা এ মুল্লুকের জমিদার নাকি?

সুন্দরী সহাস্যে বলিল, হাঁ মা, এ মহালটা তাঁরাই কিনেচেন—বাবু তাঁবু খাটিয়ে আছেন—তা সত্যি মা, রাজপুত্তুর ত রাজপুত্তুর! কিবা মুখ চোখের—

বিরাজ সহসা থামাইয়া দিয়া বলিল, থাম্ থাম্, চুপ কর্। ও-সব কথা তোকে জিজ্ঞেস করিনি—কি তোকে বললে, তাই বল।

সুন্দরী এবার মনে মনে বিরক্ত হইল। কিন্তু সে ভাব গোপন করিয়া ক্ষুব্ধস্বরে বলিল, কি কথা আর হবে মা, কেবল তোমারই কথা।

বিরাজ ‘হেঁ’ বলিয়া চুপ করিয়া রহিল।

এইবার কথাটা বুঝাইয়া বলি। বছর-দুই পুর্বে এই মহালটা কলিকাতার এক জমিদারের হস্তগত হয়; তাঁহার ছোটছেলে রাজেন্দ্রকুমার অতিশয় অসচ্চরিত্র এবং দুর্দান্ত। পিতা তাহাকে কাজকর্মে কতকটা শিক্ষিত ও সংযত করিতে এবং বিশেষ করিয়া কলিকাতা হইতে বহিষ্কৃত করিবার অভিপ্রায়েই কাছাকাছি কোন একটা মহালে প্রেরণ করিতে চাহেন। গত বৎসর সে এইখানে আসে।
রীতিমত কাছারি-বাটী না থাকায়, সে সপ্তগ্রামের পরপারে গ্রান্ড ট্র্যাঙ্ক রোডের ধারে একটা আমবাগানে তাঁবু ফেলিয়া বাস করিতেছিল। আসিয়া অবধি একটি দিনের জন্যও সে কাজকর্ম শিখিবার ধার দিয়া চলে না। পাখি শিকার করিতে ভালবাসিত, হুইস্কির ফ্লাস্ক পিঠে বাঁধিয়া বন্দুক ও চার-পাঁচটা কুকুর লইয়া সমস্ত দিন নদীর ধারে বনে বনে পাখি মারিয়া বেড়াইত। এই অবস্থায় মাস-ছয়েক পূর্বে একদিন সন্ধ্যার প্রাক্কালে গোধূলির স্বর্নাভামণ্ডিত সিক্তবসনা বিরাজের উপর তাহার চক্ষু পড়ে। বিরাজের এই ঘাটটি চারিদিকের বড় বড় গাছে আবৃত থাকায় কোন দিক হইতে দেখা যাইত না। বিরাজ নিঃশঙ্কচিত্তে গা ধুইয়া পূর্ণ-কলস তুলিয়া লইয়া উপর দিকে চক্ষু তুলিতেই এই অপরিচিত লোকটির সহিত চোখাচোখি হইয়া গেল। রাজেন্দ্র পাখির সন্ধান করিতে করিতে এদিকে আসিয়াছিল, অদূরস্থিত সমাধিস্তূপের উপর দাঁড়াইয়া সে বিরাজকে দেখিল। মানুষের এত রূপ হয়, সহসা এ কথাটা যেন সে বিশ্বাস করিতে পারিল না। কিন্তু, আর সে চোখ ফিরাইতেও পারিল না। অপলকদৃষ্টিতে চিত্রার্পিতের ন্যায় সেই অতুল্য অপরিসীম রূপরাশি বিভোর হইয়া দেখিতে লাগিল। বিরাজ আর্দ্রবসনে কোনমতে লজ্জা নিবারণ করিয়া দ্রুতপদে প্রস্থান করিল। রাজেন্দ্র স্তব্ধ হইয়া আরও কিছুক্ষণ দাঁড়াইয়া থাকিয়া ধীরে ধীরে চলিয়া গেল। ভাবিতে ভাবিতে গেল, কেমন করিয়া এমন সম্ভব হইলে। এই অরণ্যপরিবৃত, ভদ্রসমাজ-পরিত্যক্ত ক্ষুদ্র পাড়াগাঁয়ের মধ্যে এত রূপ কেমন করিয়া কি করিয়া আসিল! এই অদৃষ্টপূর্ব সৌন্দর্যময়ীর পরিচয় সে সন্ধান করিয়া সেই রাত্রেই জানিয়া লইল এবং তখন হইতেই এই একমাত্র চিন্তা ব্যতীত তাহার আর দ্বিতীয় চিন্তা রহিল না। ইহার পরে আরও দুইবার বিরাজের চোখে চোখে পড়িয়াছিল।

বিরাজ বাড়িতে আসিয়া সুন্দরীকে ডাকিয়া বলিল, যা’ ত সুন্দরী, ঘাটের ধারে কে একটা লোক পীরস্থানের ওপর দাঁড়িয়া আছে, মানা করে দি গে, যেন আর কোনদিন আমাদের বাগানে না ঢোকে।

সুন্দরী মানা করিতে আসিল, কিন্তু নিকটে আসিয়া হতবুদ্ধি হইয়া গিয়া বলিল, বাবু আপনি!

রাজেন্দ্র সুন্দরীর মুখের দিকে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিল, তুমি আমাকে চেন নাকি?

সুন্দরী বলিল, আজ্ঞে হাঁ বাবু, আপনাকে আর কে না চেনে?

আমি কোথায় থাকি, জান?

সুন্দরী কহিল, জানি।

রাজেন্দ্র বলিল, আজ একবার ওখানে আসতে পার?

সুন্দরী সলজ্জহাস্যে মুখ নীচু করিয়া আস্তে আস্তে জিজ্ঞাসা করিল, কেন বাবু?

দরকার আছে, একবার যেও, বলিয়া রাজেন্দ্র বন্দুক কাঁধে তুলিয়া লইয়া চলিয়া গেল।

ইহার পর অনেকবার সুন্দরী গোপনে ও নিভৃতে ওপারের জমিদারী কাছারিতে গিয়াছে, অনেক কথা বিরাজের সমক্ষে উত্থাপন করিতে সাহস করে নাই। সুন্দরী নির্বোধ ছিল না; সে বিরাজবৌকে চিনিত। বাহিরে হইতে এই বধূটিকে যতই মধুর এবং কোমল দেখাক না কেন, ভিতরের প্রকৃতি যে তাহার উগ্র এবং পাথরের মত কঠিন ছিল, সুন্দরী তাহা ঠিক জানিত। বিরাজের দেহে আরও একটা বস্তু ছিল, সে তাহার অপরিমেয় সাহস। তা সে মানুষ বলেই হোক, আর সাপখোপ, ভূতপ্রেতই হোক—ভয় কাহাকে বলে ইহা সে একেবারেই জানিত না। সুন্দরী কতকটা সে কারণেও এতদিন তাহার মুখ খুলিতে পারে নাই।

বিরাজ উনুনের কাষ্ঠটা ঠেলিয়া দিয়া ফিরিয়া চাহিয়া বলিল, আচ্ছা সুন্দরী, তুই ত অনেকবার সেখানে গিয়েছিস এসেছিস, অনেক কথাও কয়েচিস, কিন্তু আমাকে ত একটি কথাও বলিস নি?
সুন্দরী প্রথমটা কিছু হতবুদ্ধি হইয়া গেল, কিন্তু পরক্ষণেই সামলাইয়া লইয়া কহিল, কে তোমাকে বললে মা, আমি অনেক কথা কয়ে এসেচি?

বিরাজ বলিল, কেউ বলেনি, আমি নিজেই জানি। আমার কপালের পেছনে আরও দুটো চোখ-কান আছে। বলি, কাল ক’টাকা বকশিশ নিয়ে এলি? দশ টাকা?

সুন্দরী বিস্ময়ে অবাক হইয়া গেল। তাহার মুখের উপরে একটা পাণ্ডুর ছায়া পড়িল, উনুনের অস্পষ্ট আলোকেও বিরাজ তাহা দেখিল এবং সে যে কথা খুঁজিয়া পাইতেছে না তাহাও বুঝিল।

ঈষৎ হাসিয়া বলিল, সুন্দরী, তোর বুকের পাটা এত বড় হবে না যে, তুই আমার কাছে মুখ খুলবি; কিন্তু, কেন মিছে আনাগোনা করে, টাকা খেয়ে শেষে বড়লোকের কোপে পড়বি? কাল থেকে এ বাড়িতে আর ঢুকিস নে। তোর হাতের জল পায়ে ঢালতেও আমার ঘেন্না করে। এতদিন তোর সব কথা জানতুম না, দুদিন আগে তাও শুনেচি। কিন্তু যা, আঁচলে যে দশ টাকার নোট বাঁধা আছে, ফিরিয়ে দি গে, দিয়ে দুঃখী মানুষ দুঃখ-ধান্দা করে খে গে। নিজে বয়সকালে যা করেচিস, সে ত আর ফিরবে না, কিন্তু আর পাঁচজনের সর্বনাশ করতে যাসনে।

সুন্দরী কি একটা বলিতে চাহিল, কিন্তু তাহার জিভ মুখের মধ্যে আড়ষ্ট হইয়া রহিল।

বিরাজ তাহাও দেখিল। দেখিয়া বলিল, মিথ্যে কথা বলে আর কি হবে? এ-সব কথা আমি কাউকে বলব না। তোর আঁচলে বাঁধা নোট কোথা থেকে এল, সে কথা আমি আগে বুঝিনি, কিন্তু, এখন সব বুঝতে পাচ্ছি। যা, আজ থেকে তোকে আমি জবাব দিলুম—কাল আর আমার বাড়ি ঢুকিস নে।

এ কি কথা! নিদারুণ বিস্ময়ে সুন্দরী বাক্শূন্য হইয়া বসিয়া রহিল। এ বাটীতে তাহার কাজ গেল, এমন অসম্ভব কথা সে মনের মধ্যে ঠিকমত গ্রহণ করিতেও পারিল না। সে যে অনেক দিনের দাসী! সে বিরাজের বিবাহ দিয়াছে, হরিমতিকে মানুষ করিয়াছে, গৃহিণীর সহিত তীর্থদর্শন করিয়া আসিয়াছে—সেও যে এ বাটীর একজন। আজ তাহাকেই বিরাজবৌ বাটীতে প্রবেশ করিতে নিষেধ করিল! ক্ষোভ এবং অভিমান তাহার কণ্ঠ পর্যন্ত ঠেলিয়া উঠিল—একমুহূর্তে বড় রকমের জবাবদিহি, কত রকমের কথা তাহার জিহ্বাগ্রে পর্যন্ত ছুটিয়া আসিল, কিন্তু মুখ দিয়া শব্দ করিতে পারিল না—বিহ্বলের মত চাহিয়া রহিল।

বিরাজ মনে মনে সমস্ত বুঝিল, কিন্তু সেও কথা কহিল না। মুখ ফিরাইয়া দেখিল, হাঁড়ির জল কমিয়া গিয়াছে। অদূরে একটা পিত্তলের কলসীতে জল ছিল, ঘটি লইয়া তাহার কাছে আসিল; কিন্তু কি ভাবিয়া একমুহূর্ত স্থির হইয়া থাকিয়া ঘটিটা রাখিয়া দিয়া বলিল, না, তোর হাতের জল ছুঁলে ওঁর অকল্যাণ হবে—তুই ঐ হাত দিয়ে টাকা নিয়েচিস।

সুন্দরী এ তিরস্কারেও উত্তর দিতে পারিল না।

বিরাজ আর একটা প্রদীপ জ্বালিয়া কলসীটা তুলিয়া লইয়া এই রাত্রে সূচীভেদ্য অন্ধকার আমবাগানের ভিতর দিয়া একা নদীতে জল আনিতে চলিয়া গেল।

বিরাজ চলিয়া গেল, সুন্দরীর একবার মন হইল সেও পিছনে যায়, কিন্তু সেই অন্ধকারে সঙ্কীর্ণ বনপথ, চারিদিকের প্রাচীর, সপ্তগ্রামের জানা-অজানা সমাধিস্তূপ, ঐ পুরাতন বটবৃক্ষ—সমস্ত দৃশ্যটা তাহার মনের মধ্যে উদিত হইবামাত্র তাহার সর্বদেহ কণ্টকিত হইয়া চুল পর্যন্ত শিহরিয়া উঠিল। সে অস্ফুটস্বরে ‘মা গো’ বলিয়া স্তব্ধ হইয়া বসিয়া রহিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *