বিরহিণী

বিরহিণী

আজ সকাল থেকেই ক্লাসরুমের ভিতরে একটা রণক্ষেত্র শুরু হয়ছে৷ বাঁকাটেরা সরু মুখওয়ালা ভয়ংকর কতগুলো রেখা গিয়ে বিঁধছে কারও মাথায় কারও বুকে কারও চোখে, তাদের কোনওটা সাইন কোনওটা কস কোনওটা আবার এক বিদঘুটে চেহারার ইকুয়েশন৷ ব্ল্যাকবোর্ডের সামনে উদ্যত চক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন উপেন ঘোষ৷ এই লিখছেন এই মুছছেন, স্ট্রেটলাইনকে কেটেকুটে বের করে আনছেন অ্যাকিউট অ্যাঙ্গেল, তাকেও ভেঙে ফেলছেন ভেক্টরে৷ উপরের ফোরস নীচের ফোরস, সেখানেও থেমে থাকছেন না৷ x আর y অ্যাক্সিসেই সীমাবদ্ধ না থেকে প্রায় জোর করে ব্ল্যাকবোর্ড থেকে বের করে আনছেন z অ্যাক্সিসকে৷ প্রথম দশ মিনিট আমিও বোঝার চেষ্টা করেছিলাম, তারপর আর মনকে ব্যস্ত করিনি৷ ব্লাকবোর্ডে আছাড় খেতে খেতে চকটা মাঝে মধ্যেই ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ করছে৷ এদিকে আমার অবস্থাও ওই চকটার মতোই৷ পাশে হারু খাতা বাগিয়ে বসেছিল৷ বুঝলাম বোর্ড দেখে খানিকক্ষণ সে কপি করার চেষ্টা করেছিল৷ তারপর হাল ছেড়ে দিয়েছে৷ আমার দিকে ফিরে বলল, ‘মালটা আজ খেপে গেছে৷’

‘কেসটা কী বলত?’ আমি নীচু গলায় জিজ্ঞেস করলাম৷ ‘কী জানি৷’ বলে সে ভুরু কুচকে একদৃষ্টে সামনে তাকিয়ে থাকল৷ আমার বিরক্তি লাগল৷ জানলার বাইরের পৃথিবীটা যেন ক্লান্ত দুপুরের রোদ মেখে ঘুমিয়ে আছে৷ রাস্তাঘাট ফাঁকা৷ চারপাশের বাড়িগুলো যেন খাঁ খাঁ করছে৷ রাস্তার ধার ঘেঁষে লম্বা লম্বা গাছের সবুজ পাতায় ঝকঝকে রোদ ঝিমিয়ে রয়ছে৷ সল্টলেকের রাস্তাঘাট এমনিতেই শুনশান, এই নির্জন দুপুরে ফুটপাথে দু-একটা ঘুমন্ত কুকুর ছাড়া জনপ্রাণী চোখে পড়ে না৷ হঠাৎ একটা ব্যাপার আমার চোখে পড়ল৷ আমাদের ক্লাসরুমের জানলা দিয়ে রাস্তার ওপারের একটা অ্যাপার্টমেন্টের খানিকটা অংশ দেখা যায়৷ সেখানে চোখ পড়তে দেখলাম—ফ্ল্যাটের বারান্দায় একটা মেয়ে এসে দাঁড়িয়েছে৷ মুখটা যদিও অন্যদিকে ফিরিয়ে আছে, তবু বোঝা যায় বয়সে আমাদের মতোই হবে৷ বোধহয় ওই ফ্ল্যাটটাতেই থাকে৷ আমি সেদিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম৷ বারান্দার রেলিঙের উপর একটা কফির কাপ রাখা আছে৷ সেটাকে হাতে তুলে মাঝে মাঝে ঠোঁটে ঠেকাচ্ছে৷ তারপর আবার সেটা রেলিঙের উপর রেখে কী যেন ভাবছে৷ পিঠ বেয়ে খয়েরি চুলের ঢল নেমেছে৷ আমি সেদিকে বেশ কিছুক্ষণ একমনে তাকিয়েছিলাম৷ উপেনবাবুর গলাটা যেন বহুদূর থেকে ভেসে আসছে৷ এমনসময় পেটে খোঁচা লাগল৷ জানলা থেকে মুখ ফিরিয়ে বুঝতে পারলাম, আঙুলটা হারুর৷ মুখে কিছু বলল না সে৷ শুধু ভুরুটা তুলে আমাকে সামনের দিকে দেখিয়ে দিল৷ আমি সেদিকে তাকিয়ে দেখলাম উপেন ঘোষ আমার দিকে বিস্ফারিত নেত্রে তাকিয়ে আছে! এর আগে কী হয়েছে আমি কিছুই জানি না৷ একবার ঢোঁক গিলে বললাম, ‘হ্যাঁ… হ্যাঁ স্যার!’

‘আমি কী পড়াচ্ছিলাম?’

‘কেন, ভেক্টর স্যার৷’

‘হুউ, বাইরে ওরকম হাঁ করে তাকিয়ে ছিলে কেন?’

আমি আড়চোখে ক্লাসে বাকিদের দিকে তাকালাম৷ আমি যে কেন তাকিয়েছিলাম সেটা আর কেউ দেখেছে কি না জানি না৷ এবারে কিন্তু সবার চোখ জানলা দিয়ে বাইরে চলে গেল৷ আমি দুরু দুরু বুকে সেদিকে তাকিয়ে দেখলাম, বারান্দা ফাঁকা৷ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম, উপেনবাবু আবার বোর্ডের দিকে ফিরে বললেন, ‘অত প্রকৃতি বিলাসী হলে চলবে? বসো, বসো৷’

আমি ধীরে ধীরে বসে পড়লাম৷ এবং বসতেই আবার হারুর আঙুলের খোঁচা৷ আমি তার দিকে ফিরে দেখলাম তার চোখদুটো ব্লাকবোর্ডের উপর স্থির৷ সেদিকে তাকিয়েই যেন বিড়বিড় করে কিছু বোঝার চেষ্টা করছে এমন ভাবে বলল, ‘জানলার বাইরে কী দেখছিলি শালা?’

‘ওই একটা পাখি৷’ আমি আমতা আমতা করলাম, ‘গাছটায় বসে ছিল৷’ ‘পাখিই বটে৷ তবে গাছে নয়, ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছিল, শা…ল্লা৷’

হারুর ভালো নাম হরনাথ সোম৷ আমরা এমনিতে ছাত্র হিসেবে খারাপ না, কিন্তু অল্প বয়সে নানা দিকে মাথা দিতে গিয়ে কোনওটাই ঠিকমতো হত না৷ বিশেষ করে ইলেভেনে ওঠার পর থেকে পড়াশোনার জগৎটাকে বড্ড বেশি ম্যাড়ম্যাড়ে লাগে৷ সকাল থেকে চিবিয়ে যাওয়া চিউইংগামের মতো৷ গালভারী সাবজেক্টের বইগুলোর এমন খোদার খাসির মতো চেহারা যে ওগুলো পড়ে নয়, কাগজের দরে বিক্রি করে ভালো আমদানি হয়৷ আরও বড়ো তঞ্চকতা বই-এর আইসক্রিম, চকোলেটের ছবিওয়ালা কভারগুলো৷ দেখলে মনে হয় যেন রান্না শেখার বই৷ হারু অবশ্য মাথা খাটিয়ে এর একটা সমাধান বের করেছে৷ মোটা বইগুলোকে ব্লেড দিয়ে লম্বালম্বি কেটে মোট আটটা খণ্ডে ভেঙে নিয়েছে, তাতে পড়তেও সুবিধা, টুকতেও৷ তবে মাঝখানের কয়েকটা আলগা পাতা সেই ক্ষুদ্র বন্ধনের মোহ কাটিয়ে বিবাগী হয়ছে৷ ফিজিক্সের কোনও শক্ত প্রশ্নের উত্তর জানা না থাকলে সেই উত্তর যে ওই কটা পাতাতেই লেখা ছিল সন্দেহ করে সে হতাশ হয়ে পড়ে৷ যাই হোক মোটকথা বইখাতাকে আমরা একরকম এড়িয়েই চলি৷ তা বলে স্কুলে আসতে খারাপ লাগে না৷ ছুটি হবার পর বেশ কিছুক্ষণ মাঠে ক্রিকেট খেলি৷ তারপর আলো কমে এলে, আমাদের নীল ইউনিফর্ম ধুলোয় ধূসর হয়ে গেলে সারাদিনের ক্লান্তি গায়ে মেখে বাড়ি ফিরি৷

আজও ছুটির পর মাঠে খেলছিলাম৷ আমি উইকেটকিপার, সাধারণত বল আমি করি না; পারি না তা কিন্তু নয়৷ আসলে উইকেটকিপার আর ব্যাটসম্যানের জায়গাটা বাদ দিয়ে মাঠের বাকি অংশটাকে দুপুরের গনগনে রোদ তাতিয়ে রাখে৷ সে রোদে দৌড়াদৌড়ি করে মাথা গরম করার ইচ্ছা আমার হয় না৷ যাই হোক আজ দাড়ি ব্যাট করছিল, আমি যথারীতি উইকেটের পিছনে৷ ওপাশ থেকে বল করতে আসছে গুলি৷ ম্যাচ টানটান উত্তেজনার মুহূর্তে, এমন সময় কভার থেকে হারু হাঁ হাঁ করে উঠল৷ দাড়ি থতমত খেয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কী হল রে?’

হারু উত্তর না দিয়ে আমার কাছে এগিয়ে এসে বলল, ‘ব্যাটটা নে৷’

আমি তার কথার মানে বুঝতে পারলাম না, জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেন? দাড়ি তো ব্যাট করছে৷’

‘দাড়ি ব্যাট করে কী করে নেবে? উপরে দেখ৷ পাখি৷’

আমি পিছন ফিরে উপরে তাকিয়ে দেখলাম সেই ব্যালকনিটায় আবার সেই মেয়েটা এসে দাঁড়িয়েছে৷ আগে সে একটা সবুজ রঙের গাউন পরে ছিল এখন একটা পার্পল শার্ট পরে আছে৷ আনমনা হয়ে তাকিয়ে আছে মাঠের দিকে৷ এবার কিন্তু আমি আর বোকার মতো দাঁড়িয়ে থাকলাম না৷ তড়িঘড়ি গিয়ে হারুর হাত থেকে ব্যাটটা নিয়ে বীরদর্পে দাঁড়ালাম উইকেটের সামনে৷ দাড়িও প্রতিবাদ করল না৷ মেয়েটা তো আর সারাবিকেল ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে থাকবে না৷ হারু নীচু গলায় গুলিকে নির্দেশ দিল, ‘ওরে লোলা দে, লোলা৷’ পিছন থেকে দাড়ির নির্দেশ ভেসে এল, ‘ব্যাটটা বাঁহাতে ধর ছাগল, নাহলে চোখে পড়বে না৷’

আমি সেই অনুযায়ী স্টান্ট নিলাম৷ কিছু একটা করে দেখাতেই হবে৷ এর থেকে ভালো সুযোগ আর পাব না৷ চোখ বুজে মনে মনে দু-বার ভগবানের নাম করলাম৷ ওপাশ থেকে গুলির আলতো বল ভেসে এল, মনে হল আমার চারপাশের ধুলোঢাকা মাঠ মুছে গিয়ে একটা আস্ত স্টেডিয়াম তৈরি হয়ছে৷ শেষ বলে ছয় মেরে ম্যাচ জেতাতে হবে আমাকে৷ বল ধীর গতিতে সামনে আসতে ঠিক করলাম গিলক্রিস্টের মতো কভার ড্রাইভ মারব, বলটা দেখে নিয়ে চোখ বুজে চালালাম ব্যাট৷ কিন্তু একী! ব্যাটে বলের কোনও অনুভুতি পেলাম না৷ বরঞ্চ পিছন থেকে টক করে একটা আওয়াজ আসতে বুঝলাম বল গিয়ে লেগেছে ইটের উইকেটে৷ আমার বুকের ভিতর সমস্ত আশা ওই ইটগুলোর মতোই ভেঙে গড়িয়ে পড়ল৷ পিছন থেকে দাড়ির ভর্ৎসনা কানে এল, ‘তুই মর৷’

হঠাৎ আমাদের কানে তালা লাগিয়ে দিয়ে হারু চিৎকার করে উঠল, ‘সেঞ্চুরি, গুপ্ত সেঞ্চুরি করেছে!’

আমি পিছনে তাকিয়ে দেখলাম বল উইকেটে গিয়ে লাগলেও উইকেট ভাঙেনি৷ উপরে তাকাতেই আমার বুকের মধ্যে গরম তরলের ফোঁটা পড়তে লাগল৷ হারুর উন্মত্ত চিৎকারে মেয়েটাও তাকিয়েছে আমার দিকে৷ চোখ সরিয়ে নিলাম৷ চারপাশে তখন হাততালির ঢেউ৷ আমি ধীরে সুস্থে হাতের ব্যাটটা তুলে চারপাশে দেখালাম৷ হাততালি দিতে দিতে হারু আমার দিকে এগিয়ে এসে বলল, ‘আউটটা দেখেনি, চাপ নিস না৷’

আমি বোকার মতো হাসলাম৷

দিন কয়েক গেল কিন্তু এর বেশি কিছু এগোয় না৷ বেশিরভাগ দিন মেয়েটা বিকেলে বেরোয় না, দুপুরে কখনও কখনও বারান্দায় এসে দাঁড়ায়৷ সে না থাকলে আমি ব্যালকনিটাই ভালো করে লক্ষ করি৷ বেশি বড়ো নয়৷ আড়াআড়ি দেড় মিটারের মতো হবে৷ দরজার ঠিক পাশেই একটা পুরোনো সাইকেল রাখা আছে৷ রেলিঙের একপাশে একটা ফাঁকা টব৷ উপরে সিমেন্টের ছাউনি, শুধু রেলিংটার উপর রোদ এসে পড়ে৷ ফিজিক্স কেমিস্ট্রি বায়োলজির ফাঁক গলে মনটা ওখানে পড়ে থাকে৷ ছুটি হওয়ার বেল বাজলেই জানি না কেন মনটা খারাপ হয়ে যায়৷ ইলেকট্রিক বেলের আওয়াজটা নির্মম তানপুরার সুরের মতো বাজতে থাকে৷

আমাদের স্কুলটা দোতলা৷ তবে অনেকটা জায়গা জুড়ে ছড়িয়ে৷ চারপাশ ঘিরে উঁচু লালচে পাঁচিল৷ সেটা শেষ হতেই পিচের চওড়া রাস্তা৷ পাঁচিলের একপাশে একফালি হাঁটার মতো জায়গা৷ তার ধার জুড়ে ছোটো ছোটো গাছের সারি৷ গাছের ফাঁক দিয়ে বিল্ডিংয়ের কাচের জানলা দেখা যায়৷ ছুটির পর ঝাঁকে ঝাঁকে স্টুডেন্ট বাইরে বেরিয়ে এলে স্কাই-ব্লু স্কুলড্রেস, সবুজ গাছ, লাল পাঁচিল আর স্বচ্ছ জানলার রং মিলে এক বর্ণময় জলছবি তৈরি করে৷ স্কুলের ঠিক সামনেই একটা মোটাসোটা চেহারার বিহারী লোক নীল রঙের ঠেলাগাড়ি নিয়ে নানারকম জিনিস বিক্রি করে৷ আমি আর হারু তার কাছ থেকে আমড়া কিনছিলাম৷ হারু হঠাৎ কী ভেবে বলল, ‘তোর কাছে কিছু মালকড়ি হবে?’

আমি আমড়ার প্যাকেট হাতে নিয়ে বললাম, ‘মালকড়ি? কী হবে?’

‘ফিনাইল কিনব৷’

‘ফিনাইল কিনবি! তারপর?’

‘কাজ আছে৷ তোর শালা অত খবরে কী দরকার, হবে কি না বল৷’

হারু দিনকতক হল কেমন যেন রহস্যময় হয়ে পড়েছে৷ ফিনাইল দিয়ে ঘরদোর পরিষ্কার করা ছাড়া আর কী কাজ হয় কে জানে৷ সে কাজ করার ছেলে তো হারু নয়৷ আমি আমড়ার প্যাকেট তার হাতে দিয়ে হাঁটতে লাগলাম, সে কী যেন ভেবে বলল, ‘আমার মাথায় একটা আইডিয়া আছে৷ ধর যদি সেলসম্যান সেজে ফিনাইল বেচতে যাই, কেমন হবে?’

আমি খানিকটা আঁচ করতে পারলাম, সন্দেহের দৃষ্টিতে বললাম, ‘আমাদের পড়াশোনার যা হাল এমনিতেই তাই করতে হবে৷ কোথায় যাবি বেচতে?’

‘পাখির বাসায়৷’ বলে সে মুচকি হাসল৷

ফিনাইল জোগাড় হল বটে, তবে সেটা আমরা বেচতে যাব সেলসম্যান হিসেবে নয়, কে জানে, মেয়েটা যদি আমাদের চিনে থাকে তাহলে মিথ্যেটা ধরা পড়ে যাবে৷ ফিনাইল হাতে বাড়িটার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে আমার কেমন যেন ভয় লাগল৷ কোনওরকমে সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে এলাম৷ হারু বেশ যত্ন করে ফিনাইলের লেবেল তুলে দিয়েছে, সেগুলো আমার হাত থেকে নিয়ে একটা ক্লিপবোর্ডে লাগানো কাগজ আর কলম আমার হাতে ধরিয়ে দিল৷ বাইরের দরজায় নেমপ্লেট নেই দেখে হতাশ হলাম৷ দরজায় টোকা দিলাম৷ টোকার খটখট আওয়াজটা যেন আমার হৃদস্পন্দনের সঙ্গে কোথায় মিলে গেল৷ পেপারে কী লিখব নিজেই জানি না, জিজ্ঞেস করলাম, ‘যদি ফিনাইল না কিনতে চায়?’

এমন সময় ভিতর থেকে হেঁড়ে গলায় প্রশ্ন এল, ‘কে?’

গলাটা শুনেই আমি সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাচ্ছিলাম, হারু থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘ইয়ে… একটু দরকার ছিল, দরজাটা খুলবেন?’

কয়েক সেকেন্ড পরে ভিতর থেকে কেউ দরজাটা খুলল, আমি ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে দেখলাম একটা দশাসই চেহারার লোক দরজা আগলে ভ্রুকুটি করে দাঁড়িয়ে আছে৷ হারু একগাল হেসে বলল, ‘আমরা আসছি আকাঙ্ক্ষা স্পেশাল চাইল্ড অরগানাইজেশন থেকে৷’

‘হ্যাঁ, কী বলুন৷’ লোকটা যেন এবার একটু নরম হল৷

‘আসলে আমাদের অরগানাইজেশনের বাচ্চারা এই ফিনাইলগুলো বানিয়েছে, আপনি ফিনাইল ইউজ করেন তো?’

‘না না, আমি ওসব ব্যবহার করি না৷’

আমি ইতিমধ্যে কয়েকবার উঁকি মেরে নিয়েছি৷ জিজ্ঞেস করলাম, ‘ইয়ে… আপনার ফ্যামিলিতেও কেউ করে না?’ সঙ্গে সঙ্গে গোড়ালির কাছে বুটের লাথি খেলাম, হারু বলল, ‘এটা কিন্তু ব্যবহার করে দেখতে পারেন৷ একদম বাড়িতে তৈরি৷’

লোকটা একটা ফিনাইলের বোতল হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে বলল, ‘আকাঙ্ক্ষা… কী বললে যেন?’

‘চাইড… চাইল্ড…’ হারু তোতলাতে লাগল৷

আমার এতক্ষণে জিভ শুকোতে শুরু করেছে৷ হারু বোতলের লেবেলটা তুলেছে বটে কিন্তু ছিপির গায়ে এখনও ব্র্যান্ডের নামটা খেয়াল করলেই বোঝা যায়৷

‘তোমাদের এই অরগানাইজেশনটা কোথায়?’ লোকটার গলায় সন্দেহের আভাস৷

‘কাঁকুড়গাছি৷’ তৎক্ষণাৎ উত্তর৷

‘ওহ, না নেব না৷ তিনতলায় দেখুন৷’

‘এক গ্লাস জল হবে?’ হারু কিন্তু দমবার পাত্র নয়৷

‘হ্যাঁ নিশ্চয়ই, দাঁড়ান৷’

লোকটা ভিতরে ঢুকে যেতে আমরা আবার ভিতরটা হুমড়ি খেয়ে দেখে নিলাম৷ নাহ, কেউ নেই৷ এমনকি দেওয়ালে একটা ছবিও নেই, বললাম, ‘ধুর, আমাদের লাকটাই খারাপ৷’

‘আমাদের নয়, তোর৷’ হারু বলল৷

‘হুম… কী আর করবি, অন্য কিছু ভাবতে হবে৷’

****

অন্য কিছু আর ভাবা হয়নি৷ সিলেবাসের বিষম বোঝা পিঠের উপর এসে পড়তে আর দম ফেলার সুযোগ পেতাম না৷ প্রথম শীতের শুকনো ডালপালায় নতুন পাতা এল, ধীরে ধীরে বর্ষাকাল এসে পড়ল৷ ক্লাসরুমের জানলাগুলো বেশিরভাগ সময় বন্ধই থাকে৷ কাচ বেয়ে বৃষ্টির জলের ধারা নামে৷ বাইরের সবুজ গাছপালার একটা আভাস পাওয়া যায়৷ বটানির জটিল মূলের শাখাপ্রশাখার ফাঁক গলে আমার মন চলে যায় জানলার ওপাশে অদৃশ্য বারান্দাটায়৷ হয়তো সেখানে কেউ এসে দাঁড়িয়েছে৷ বৃষ্টির ছাঁটে ভিজছে তার গোটা মুখ৷ দু-হাতের মুঠোয় ভরে জলের ফোঁটাগুলোকে আদর করছে সে৷ ক্লাসরুমের ভিতরের বাতাস গুমোট হয়ে ওঠে৷ বাইরে ঝিরঝিরে বৃষ্টির আওয়াজ যেন কিশোরী মেয়ের নূপুরের মতোই বেজে যায়৷

বর্ষাকাল বলে ছুটির পরে খেলাটা হয় বটে, তবে মাঠে নয় স্কুলের সামনে বড়ো পিচের রাস্তাটার উপরে৷ এত বড়ো রাস্তা অথচ সারাদুপুরে পাঁচটা কি ছ-টার বেশি গাড়ি পার হয় না৷ আজ আমরা খেলতে যাইনি৷ মাঠের এককোণে বসে দু-জনে সিগারেট খাচ্ছিলাম৷ একটু আগেই মাঠের এককোণ দিয়ে একটা লোক ইডলি নিয়ে পার হচ্ছিল৷ তাকে থামিয়ে ইডলি খেয়েছি৷ এখানে যে বিক্রি হবে লোকটাও ভাবতে পারেনি৷ হারু প্যাকেটে সিগারেট রাখে না৷ একটা খবরের কাগজের ঠোঙায় হরেক কিসিমের সিগারেট থাকে, মানে যখন যেমন অবস্থা যায় সেই অনুযায়ী জমতে থাকে৷ বৃষ্টির আমেজে সে কার্পণ্য করল না৷ একটা ইন্সিগ্নিয়া ধরিয়ে বলল, ‘ধুস শালা, আর ভালো লাগে না৷’

‘আমারও৷’ ভালো না লাগার কারণ কী তা আমার জানতে ইচ্ছা করল না৷ ভালো লাগে না এটাই জরুরি৷

সে গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে বলল, ‘এই বেকার মাঠে বসে সিগারেট টানছি, কী আর হল লাইফে?’ বলে সে জ্বলন্ত সিগারেটে আর একটা টান দিল৷ একটু দূরে একটা নীচু গর্তের ভিতর জল জমেছিল, আমি একটা ঢিলকে সেখানে ছুঁড়ে ফেলার চেষ্টা করছিলাম, বললাম, ‘দাড়ির কী খবর রে?’

‘কী আর৷ মেয়েবাজি করছে৷’

মাঠের একধার জুড়ে তখন একটা শান্ত থমথমে ভাব৷ ঝিরঝিরে বৃষ্টির ফোঁটা একটু একটু করে বড়ো হচ্ছে৷ বোধহয় ঝাঁপিয়ে নামবে৷ দূরে লম্বা গাছের ফাঁক দিয়ে ঘোলাটে আকাশটা দেখা যাচ্ছে৷ তার গা জুড়ে দশাসই লাল রঙের ব্রিজ৷ মাঠের একপাশে একটা সিমেন্টের ভাঙাচোরা স্লিপ আছে৷ অন্য সময় স্কুলের বাচ্চাকাচ্চারা তার উপর লাফালাফি করে, এখন ফাঁকা৷ চারপাশে কেউ নেই৷ বৃষ্টির ফোঁটা এবার বেশ জোরে জোরে পড়ছে৷ হারু মুখটা ব্যাজার করে বলল, ‘এখনই নামতে হল, নির্জনে বসে একটু ধূমপান করার উপায় নেই৷’

আমি তার পিঠে একটা চাপড় মেরে বললাম, ‘চ বে, উঠি৷ জামাকাপড় ভিজলে আবার বাড়িতে খ্যাচখ্যাচ করবে৷’

হারু উঠে দাঁড়াতে যাচ্ছিল, হঠাৎ কী একটা দেখে থেমে গেল, তারপর গা জালানো বাঁকা হাসিটা হেসে বলল, ‘তুই দৌড়া৷ জামাকাপড় আজ ভিজল বলে৷’

‘কেন?’

হারু উত্তর দিল না, চোখের ইশারায় আমাকে মাঠের উলটো দিকে স্লিপটা দেখিয়ে আবার বসে পড়ল৷ আমি সেদিকে তাকাতেই আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেল৷ ব্যালকনির সেই মেয়েটা৷ স্লিপের ঠিক নীচে দাঁড়িয়ে৷ বুঝলাম কোথা থেকে হয়তো ফিরছিল, মাঠ পার হওয়ার সময় বৃষ্টি নামায় কোনওরকমে স্লিপের নীচটায় আশ্রয় নিয়েছে৷

হারু বলল, ‘আহা রে৷ বেচারির কাছে ছাতা নেই৷’

‘হু, তাই তো মনে হচ্ছে৷’

‘তোর কাছেও তো নেই৷’

‘হাঁ, তো?’

‘এই বৃষ্টিতে জামা ভিজিয়ে কেন বাড়িতে ঝাড় খাবি, স্লিপের তলায় দাঁড়ালে তাও খানিকটা বাঁচবে৷’

আমি স্লিপের দিকে পা বাড়ালাম৷ ততক্ষণে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নেমেছে৷ গাছের তলা থেকে এগোতেই আমার জামাকাপড় ভিজে গেল৷ মাঠের উপর দিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে আমার নেভিব্লু প্যান্টের নীচের দিকটা ছিটকে আসা কাদায় ঢেকে গেল৷ খুব শীত করছে৷ জলের উপর পা পড়ে ছপছপ আওয়াজ হচ্ছে৷ বৃষ্টির অশ্রান্ত ধারাকে আমি সারা শরীরে মাখতে লাগলাম৷ ষোলোটা বছর তপ্ত রোদে হাঁটার পর সেই যেন আমার জীবনের প্রথম বৃষ্টি৷ কাচের জানলা ভেঙে ভিজে ঘাসের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে কর্দমাক্ত জীবনের প্রথম অধ্যায়৷ ঠান্ডা জলের স্রোত আমার কান গলা বুক বেয়ে নামতে লাগল৷ আমি দ্রুত পা চালিয়ে স্লিপের কাছে পৌঁছে গেলাম৷ মেয়েটা এখনও দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু তাকে আমি ভালো করে দেখতে পেলাম না৷ বৃষ্টির জলে ভিজে আমার চশমাটা অকেজো হয়েছে, সব ঝাপসা দেখছি, সেটা খুললেও একই অবস্থা৷ স্লিপের তলাটায় আলো কম, মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে আছে কি না বুঝতে পারলাম না৷ তবে আমি ভিজতে ভিজতে এখানে এসে দাঁড়ানোয় হয়তো অবাক হয়ছে৷ আমি ঝাপসা চোখে তাকে একঝলক ভালো করে দেখার চেষ্টা করলাম৷ লম্বা চুলের উপরের দিকটা ভিজে আছে, কপাল বেয়ে জলের ধারা নেমেছে৷ ফরসা মুখের কোল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে গলায়, সদ্যস্নাত ঠোঁটদুটো ঠান্ডায় কেঁপে কেঁপে উঠছে৷ হাতদুটো বুকের কাছে জড়ো করে নীচের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে৷ আমি একটু দূরে দাঁড়ালাম৷ কী করব বুঝতে পারছি না৷ হারু থাকলে নিশ্চয়ই একটা আইডিয়া দিতে পারত, নির্বাক নিস্পন্দ কয়েকটা মুহূর্ত কেটে গেল৷ শুধু ঝমঝমে বৃষ্টির আওয়াজ, আমার বুকের কাছটায় কী যেন একটা আটকে আছে৷ আমার স্কাই-ব্লু শার্টটা বুকের উপর লেপটে আছে৷ এর মধ্যে মেয়েটা দু-বার মুখ তুলে আকাশ দেখার চেষ্টা করেছে৷ বৃষ্টিটা কি কমে আসছে? এবার আমার কিছু বলা উচিত৷ কিন্তু কী বলব বুঝতে পারলাম না৷ হঠাৎ মেয়েটা পিছন ফিরে একবার আমার দিকে তাকাল৷ একঝলক, হয়তো ইচ্ছাকৃত নয়, দুটো ভেজা কালো চোখের দৃষ্টি যেন ঠান্ডা হাওয়ার মতো বয়ে গেল আমার শরীর জুড়ে৷ কোথা থেকে একটা অচেনা গন্ধ আসছে৷ সেটা ভিজেমাটির না পারফিউমের বুঝতে পারলাম না৷ আমি চেষ্টা করলে হয়তো কিছু বলতে পারতাম কিন্তু সেই একঝলক শূন্যচোখের চাহনি আমার সমস্ত সাহস আর মনের জোরকে অসাড় করে দিয়ে গেল৷ বাকি সময়টা আমি কাঠের মতো দাঁড়িয়ে রইলাম৷ বৃষ্টিটা ধরে আসতে মেয়েটা ধীরে ধীরে স্লিপের তলা থেকে বেরিয়ে গেল৷ আমি একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকলাম তার হেঁটে যাওয়া পথের দিকে, সে চলে যাওয়ার মিনিট খানেক পড়ে হারু দাঁত বের করতে করতে এসে দাঁড়াল, ‘কী রে৷ বললি কথা?’

‘হ্যাঁ৷ বললাম তো৷’ আমি তার কাঁধে হাত রাখলাম৷

‘কী বললি?’

‘নাম জিজ্ঞেস করলাম৷’

‘আরিসশলা,… ঠিক রাস্তায় যাচ্ছিস৷ কী নাম?’

‘বিরহিণী৷’

সেদিন সে নামটা কেন মনে এসেছিল জানি না, আজ ভাবলে বুঝি আমার কিশোর মনে সেই অচেনা মেয়েটির স্থান সেই নামেই জায়গা করে নিয়েছিল৷ যেন এক অমোঘ রহস্য তার৷ তাকে স্বপ্নের আড়াল থেকে বাস্তবে টেনে আনলেই মিলিয়ে যাবে সে৷ এক অন্তহীন বিরহে মুখ ফিরিয়ে থাকে চিরকাল৷ দেখা দিতে চায় না৷ জেগে থাকে শুধু কিছু খণ্ড মুহূর্তের জলছবি হয়ে৷ আমার ফেলে আসা স্কুল, সল্টলেকের রাস্তা, জানলার ভেজা কাচ, ধুলোয় ঢাকা মাঠ, নীল স্কুলড্রেস আর প্রথম বৃষ্টির ফোঁটায় কোথাও লুকিয়ে আছে সে, আজও, তাকে ভোলা যায় না৷ সে আমার কৈশোরের ফেলে আসা বিকেলের মুঠোয় ধরা একখণ্ড আলোর মতো৷ নেই, কোনওদিন ছিল না, তবু সে চিরন্তনী৷

ছয় বছর কেটে গেছে৷ হারুর সঙ্গে আর যোগাযোগ নেই৷ সে কোথায় আছে তাই জানি না ঠিকমতো৷ স্কুল পেরিয়ে কলেজও প্রায় শেষ হতে চলল৷ আমার কৈশোরের মুখটা আর নিজেও চিনতে পারি না৷ কলেজ থেকে ফিরছিলাম একদিন, লেকটাউনে যাওয়ার ছিল, অন্য রাস্তা দিয়েও যাওয়া যেত, ভাবলাম স্কুলের রাস্তা দিয়েই ফিরব৷ হাঁটতে হাঁটতে মাঠের উপর পৌঁছে গেলাম৷ স্কুল বিল্ডিংটা অনেক পালটে গেছে৷ আরও ঝকঝকে হয়েছে চারপাশটা৷ মাঠটাও যেন একটা ছোটোখাটো চিলড্রেনস পার্ক, একধারে সেই লাল স্লিপটা আর নেই৷ মাঠ পেরিয়ে আমি স্কুলের সামনে এসে দাঁড়ালাম৷ উপরে তাকিয়ে ক্লাসরুমগুলো দেখার চেষ্টা করলাম৷ সঙ্গে সঙ্গে চোখ গিয়ে পড়ল উলটোদিকের ব্যালকনিটায়৷ রেলিঙের উপর টবটায় নতুন চারাগাছ গজিয়েছে৷ সাইকেলটা আর নেই৷ শূন্য বারান্দাটা প্রতীক্ষায় খাঁ-খাঁ করছে, ওই স্কুলের জানলার ফাঁক দিয়ে দুটো ক্লান্তিহীন চোখ অধীরে অপেক্ষা করছে ওই ব্যালকনিটার দিকে তাকিয়ে, কে জানে কখন দরজা খুলে বেরিয়ে আসবে সে, একমনে কী ভাববে আকাশের দিকে তাকিয়ে, তার বিরহিণী৷ বিকেল হয় আসছে৷ আমি দ্রুত পা চালালাম৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *