বিয়ের রাত
আচ্ছা মশাই, আত্মবিশ্বাস জিনিসটা আসলে কীরকম বস্তু তা বলতে পারেন? বলা কঠিন। তবে যতদূর মনে হয় লোহার রডের মতো একটা শক্ত জিনিস মেরুদণ্ডের ভিতর দিয়ে ঠেলে মাথা অবধি ওঠে। তাতে হয় কী, ঘাড়—গর্দান সব সোজা থাকে, মাথাটাও সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে না। আমাদের পটলবাবুকে তো দেখছি, সবসময়ে যেন খাড়া হয়ে আছেন।
তাই হবে। ওই রডটা আমার নেই।
বেশিরভাগ লোকেরই থাকে না। রেয়ার জিনিস হলেই সাপ্লাই কম হয়। খুঁজে দেখেছি আমারও নেই।
দু—জনেরই দুটো দীর্ঘশ্বাস পড়ল।
আত্মবিশ্বাস জিনিসটা খুব কাজের জিনিস, কী বলেন?
খুব। তবে না হলেও যে চলে না তা নয়। এই ধরুন ফ্রিজ। থাকলে খুব ভালো, বাসি স্যাঁতা সব জমিয়ে রাখা যায়, তিন—চারদিন রান্না না চাপালেও চলে। চমৎকার কাজের জিনিস। কিন্তু ধরুন, যাদের নেই তাদেরও কী চলে না?
তা অবিশ্যি ঠিক।
আপনার যা যা নেই তার একটা লিস্টি তৈরি করে ফেলুন। ধরুন, আত্মবিশ্বাস নেই, সাহস নেই, বিবেক নেই, বিবেচনাশক্তি নেই, বুদ্ধি নেই, মেধা নেই, জেদ নেই, উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই, সততা নেই, চরিত্র নেই, ব্যক্তিত্ব নেই, স্মার্টনেস নেই, অনুভূতি নেই, কল্পনাশক্তি নেই ইত্যাদি ইত্যাদি। নেই—এর একটা লিস্ট থাকলে কী কী আছে তার একটা হদিশ বেরিয়ে আসবে। ডেবিট ক্রেডিটের মতোই। তাতে হবে কী, অল্পস্বল্প যা আছে তাই দিয়েই কাজ চালিয়ে নেওয়ার একটা সুলুকসন্ধান করতে সুবিধে হবে।
ঠিকই বলেছেন। তবে নেই—এর লিস্টিটা বড্ড বড়ো হয়ে যাবে মনে হচ্ছে।
বেশিরভাগ লোকেরই তাই। নেই—এর লিস্টি আমারও খুব বড়ো। এতবড়ো যে তাই দিয়ে ঘড়ির লেজ বানানো যায়। আচ্ছা, কীসের গন্ধ আসছে বলুন তো!
দিব্যি খুশবু।
ওঃ, এ গন্ধটা! দাঁড়ান বলছি! এ হল বিরিয়ানির গন্ধ। জাফরান পড়েছে, আর খোয়া ক্ষীর। আর ক্যাওড়ার জলও।
বাঃ, আপনার নাক তো খুব শার্প।
হ্যাঁ, আমি বড্ড গন্ধ পাই।
বাঃ, তা হলে ওটা আছে—র লিস্টিতে ধরবেন। তা আর কী কী আইটেম আছে আজ, জানেন?
খুব জানি। পয়লা পাতে রাধাবল্লভী, বেগুনভাজা, ছোলার ডাল, ফিশ ফ্রাই। তারপর বিরিয়ানি, কষা মাংস। শেষ পাতে চাটনি, আইসক্রিম, সন্দেশ আর রসগোল্লা। পাঁপড়ভাজাও আছে।
নেমন্তন্ন বাড়ির খাওয়া সবই প্রায় একরকম রয়ে যাচ্ছে। একটা অন্যটার কার্বন কপি। কী বলেন?
যে আজ্ঞে।
তো মশাই, এই বিয়েবাড়ির মেনু আপনি জানলেন কী করে? আপনি কি কন্যাপক্ষের কোনো কর্মকর্তা?
না। পাড়ায় থাকি। বীরেশবাবু একটু স্নেহ করেন।
অ। তাই তাঁর মেয়ের বিয়েতে খাটছেন বুঝি?
আজকাল আর বিয়েবাড়ির খাটনি কোথায়? সব তো ডেকোরেটর, ক্যাটারার এরাই করে দেয়। ক্যাটারারের সঙ্গে আমার একটু ভাবসাব আছে, আমিই ঠিক করে দিয়েছিলাম।
তাই বলুন।
একশো কুড়ি টাকা করে প্লেট।
একশো কুড়ি! সে তো সস্তা মশাই। গেল হপ্তায় সত্যেনবাবুর ছেলের বিয়ে খেয়ে এলুম, শুনলুম দুশো টাকা করে প্লেট।
দুশো! ও বাবা, দুশো টাকা তো বিরাট ব্যাপার!
আপনার আমার কাছে বিরাট, সত্যেনবাবুর কাছে তো আর নয়। সত্যেনবাবুরা নমস্য ব্যক্তি। আপনার আর আমার যেমন নেই—এর লিস্টিটা অনেক লম্বা, সত্যেনবাবুদের তেমনি আছে—র লিস্টিটা বেজায় বড়ো। তবে কিনা এমন অনেক লোক আছে যাদের কাছে সত্যেনবাবুও নস্যি।
খুব ঠিক কথা। আরও—র কোনো শেষ নেই।
এই তো বুঝেছেন। লোককে কোনো কথা বোঝাতে পারলে আমি বড়ো খুশি হই। ভারি তৃপ্তি পাই। মুশকিল কি জানেন, আজকাল বেশিরভাগ লোককেই কোনো কথাই যেন বুঝিয়ে উঠতে পারি না। তখন সন্দেহ হয় আমি হিব্রু ভাষায় কথা বলছি না তো! এটা বেশিরভাগ কোথায় হয় জানেন? বাড়িতে। নিজের বাড়ির লোকেরা, এই আমার বউ, ছেলে, মেয়ে— এদের সঙ্গে কথা বলতে গেলেই ভয়ংকর ল্যাংগুয়েজ প্রবলেম হয় মশাই।
কেন, আপনার স্ত্রী কি মাদ্রাজি না জার্মান?
নৈকষ্যি বাঙালি মশাই। কোলাঘাটে বাপের বাড়ি। না না, ভাষাগত সমস্যা ঠিক ওরকম নয়। আসল কথা, তারা আমার বক্তব্য বুঝতে চায় না। কিংবা বলতে পারেন গ্রহণ করে না। আমি হয়তো খুব মোলায়েম করে বললুম, ওগো, বাড়িওয়ালার সঙ্গে ঝগড়া করার দরকার নেই। জলে বাস করে কুমিরের সঙ্গে বিবাদ কি ভালো? সঙ্গে সঙ্গে আমার বউ খেপে উঠে বলল, ঝগড়া করব না মানে? একশোবার করব। অন্যায়ের প্রতিবাদ না করে করেই তো দেশটার আজ এই অবস্থা! তোমার মতো মেনিমুখোদের দিয়ে সংসার চলে না— ইত্যাদি। যা বোঝার বুঝে নিন।
বুঝেছি।
তারপর ধরুন, হয়তো অফিস থেকে ফিরে এসে দেখলুম আমার ডায়েরির মধ্যে কে যেন একটা চিরুনি গুঁজে রেখেছে। চিরুনির তেলে ডায়েরির পাতায় জলছাপ। পুরুষসিংহ নই জানি, তবু হয়তো সামান্য একটু হেঁকে কথাটা বলতে গেছি, সঙ্গে সঙ্গে প্রথমে বউ ফুঁসে উঠল, আমি নাকি মেজাজ হারিয়ে চেঁচামেচি করেছি। বউয়ের সঙ্গে মেয়েও এসে গলা মেলাল। তাদের ধারণা, এরকম চেঁচামেচি নাকি নারী নির্যাতন ছাড়া কিছু নয়। যুগ যুগ ধরে নারীরা পুরুষদের হাতে যে কীভাবে নিরন্তর নির্যাতিতা হয়ে আসছে তা নাকি নির্যাতনকারী পুরুষেরা নির্যাতনে অভ্যস্ত বলে বুঝতেও পারে না।
একটা দীর্ঘশ্বাসের শব্দ হল, খুবই খারাপ অবস্থা তো!
খুব। আচ্ছা, এই ছত্তিশগড়, ঝাড়খণ্ড, গোর্খাল্যান্ড হচ্ছে, আপনি কি জানেন আলাদা নারী রাজ্য বা নারীল্যান্ড নিয়ে কোনো দাবিদাওয়া উঠেছে কিংবা আন্দোলন হচ্ছে কি না?
না তো। আমি শুনিনি।
উঠছে না কেন বলুন তো!
মনে হয় নারীল্যান্ডে চাকরবাকরের অভাব দেখা দিতে পারে বলেই দাবি উঠছে না।
বাঃ, বেশ বলেছেন মশাই। অতি ঠিক কথা।
নারীল্যান্ড হলে ফাইফরমাশ করার জন্য পুরুষ জুটবে কোত্থেকে? তাই তো কথাটা আমার মাথায় আসেনি। এটা কিন্তু আপনার আছে—র লিস্টিতে যায়। বুঝলেন?
বুঝেছি।
তা ফার্স্ট ব্যাচের ডাক কখন পড়বে বলতে পারেন?
মোটে সাতটা বাজে। আরও আধঘণ্টা বা থ্রি কোয়ার্টার ধরে রাখুন।
আমি তো সেই দমদম পার্কে ফিরব, তাই বলছিলাম। তা লগ্ন ক—টায় জানেন নাকি?
খুব জানি। রাত বারোটা বিয়াল্লিশ মিনিট।
ও বাবা!
ভয় পাবেন না, লগ্ন দেরিতে বলে ব্যাচ দেরিতে বসবে না। দমদম পার্কে ফেরার সবচেয়ে ভালো রুট হল এখান থেকে বাস বা ট্যাক্সিতে গিয়ে রাসবিহারীর মোড় থেকে পাতালরেল ধরা।
সেটাই তো প্ল্যান মশাই। আর ব্যস্ত হচ্ছি সেই কারণেই। পাতাল রেল তো বোধহয় সাড়ে ন—টায় বন্ধ হয়ে যায়।
তার মধ্যেই পারবেন। এখন থেকে রাসবিহারীর মোড় তো হাঁটা পথ। বাসে পাঁচ—সাত মিনিট, ট্যাক্সিতে মিনিট তিনেক। কিংবা আরও কমও হতে পারে।
বলছিলাম কী তাড়াহুড়ো করলে খাবারের স্বাদ—সোয়াদ তেমন পাওয়া যায় না।
বিরিয়ানি গন্ধটা বেশ ভালোই ছেড়েছে মশাই।
হ্যাঁ, কারিগর খুবই ভালো।
বীরেশবাবু তা হলে বেশ খরচা করেই মেয়ের বিয়ে দিচ্ছেন, কী বলেন?
হ্যাঁ, খরচ তো আছেই।
তা পাত্রটি কেমন পেলেন? ইঞ্জিনিয়ার না কী যেন শুনেছিলাম।
আমারও শোনা কথা। কিন্তু কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার।
বেশ গালভরা কথা। কিন্তু কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার ব্যাপারটা কী তা কি আমাকে একটু বুঝিয়ে বলতে পারেন? তারা কি কম্পিউটার বানায় না মেরামত করে?
আসল ব্যাপারটা কী?
আপনিও যে তিমিরে আমিও সে তিমিরে।
বীরেশবাবু বলছিলেন আমেরিকা না কোথা থেকে যেন ঘুরে এসেছে। তা আজকাল ওই এক দেশে হয়েছে। সবাই শুনি ল্যাজ তুলে সেখানে দৌড়াচ্ছে। আগে বিলেতের কদর ছিল, এখন তো সেটা বোষ্টমঘাটার মতো এলেবেলে জায়গা হয়ে গেছে।
কিছুদিন সবুর করুন, আমেরিকাও তাই হয়ে যাবে।
তাই হোক মশাই, তাই হোক। এই আমরা যারা আমেরিকা—টিকা যাইনি তাদের ভারি আত্মগ্লানি হচ্ছে। বাড়িতেও সবাই ঠেস দিয়ে কথা কয় কিনা।
বাড়ির লোকদের নিয়ে আপনার একটু প্রবলেম আছে, তাই না?
সবারই আছে মশাই, সবারই আছে। আমি পেট—পাতলা মানুষ বলে কবুল করে ফেলি, অন্যেরা চেপেচুপে রাখতে পারে। আপনার তো বয়স কম, বুঝবেন না। বলি, বিয়ে—টিয়ে করেছেন?
আজ্ঞে না।
আগে করুন, তারপর বুঝবেন। বাইরে আপনি যতবড়ো কেওকেটা মানুষই হন না কেন, বাড়ির লোকের কাছে পাপোশের বেশি সম্মান আশা করবেন না।
কিন্তু আপনি তো সেই বাড়িতেই ফিরে যাওয়ার জন্য ভারি ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন দেখছি।
এটাই তো জীবনের ট্র্যাজেডি। কতবার সন্ন্যাসী—বিবাগী হওয়ার কথা ভেবেছি, পেরে উঠিনি। সুইসাইড করব বলে মনস্থির করেও রণে ভঙ্গ দিতে হয়েছে।
কেন জানেন?
কেন বলুন তো।
তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে বটে, মুখনাড়াও দেয়, আবার শরীর—টরীর খারাপ হলে বা বিপাকে পড়লে হামলে এসে আগলায়ও তো! সংসার এক রঙ্গ মশাই।
সেরকমই শোনা যায় বটে।
এতক্ষণ ধরে কথা কইছি কিন্তু আপনার সঙ্গে ভালো পরিচয়ও হয়নি। তা আপনি কি বীরেশবাবুর আত্মীয়—টাত্মীয় নাকি?
না, না, এই কাছেই থাকি, চেনাজানা আছে আর কী?
আমার নাম দিবাকর দত্ত, সরকারি ঠিকাদার। বীরেশবাবুর এ বাড়িটা আমিই করে দিয়েছিলাম।
আপনি সরকারি ঠিকাদার! তা হলে তো বড়োলোক মানুষ আপনি!
আরে না। ঠিকাদারদের আজকাল আর বেশি মার্জিন থাকে না। একে ওকে তাকে দক্ষিণা দিতে দিতেই সব উজাড় হয়ে যায়। পেমেন্ট পেতেও নাভিশ্বাস।
শুনতেই ভালো।
গাড়ি—টাড়ি নেই?
তা থাকবে না কেন? কিন্তু কলকাতার যা হাল হয়েছে গাড়ি নিয়ে পারতপক্ষে বেরোয় কোন আহাম্মক!
ঠিকই বলেছেন।
তা আপনার নামটি কী?
সুজিত।
বামুন না কায়েত?
কায়েত।
তা কী করা হয়—টয়?
এই টুকটাক হাতের কাজ।
চাকরি করেন না?
ওই সামান্য একটা।
বয়স তো বোধহয় সাতাশ—আঠাশ।
আঠাশ।
তা এই বয়সে আপনার আত্মবিশ্বাসের অভাব হচ্ছে কেন?
ব্যাপারটা হঠাৎ আজ সকালেই ধরা পড়ল কিনা। সকালে ঘুম থেকে উঠেই মনে হল, আমার যেন আত্মবিশ্বাসটা নেই।
তার মানে কি আগে ছিল, এখন নেই?
আগে ছিল কি না ঠিক মনে করতে পারছি না। তবে এখন নেই, এটা বেশ বুঝতে পারছি। কেমন একটু নার্ভাস লাগছে।
হ্যাঁ, আপনি যে বেশ নার্ভাস তা বুঝতে পারছি, নইলে আলটপকা এসে আমাকে জিজ্ঞেস করতেন না যে, আত্মবিশ্বাস জিনিসটা কীরকম। কিন্তু হঠাৎ নার্ভাসই বা লাগছে কেন?
বলা মুশকিল। মাঝে মাঝে জীবনে এক—একটা দিন আসে যখন কোনো একটা সত্য উদঘাটিত হয়ে যায়।
বাঃ, বেশ বলেছেন। ওরকম আমারও হয়। এই তো বছরটাক আগে পাঞ্জাব মেল থেকে হাওড়া স্টেশনে নামছি, দরজার কাছটায় উঠন্ত কুলি আর নামন্ত যাত্রীদের মধ্যে খুব ঠেলাঠেলি। হাতের অ্যাটাচিকেসটা সামলাতে পারছি না। প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ানো একটা বেশ মিষ্টি দেখতে ছেলে হঠাৎ ভিড়ের মাথার উপর দিয়ে হাত বাড়িয়ে বলল, দিন না, অ্যাটাচিকেসটা আমার হাতে দিন। তারপর নামুন। এসব লোকেরা বোধহয় খানিকটা হিপনোটিজমও জানে। কে জানে কেন ছেলেটাকে আমার বেশি চেনা—চেনাও ঠেকল,তাই দিব্যি অ্যাটাচিকেসটা দিয়ে দিলাম। নেমে একগাল মাছি। কোথায় সেই ছোকরা, আর কোথায় বা অ্যাটাচি। তা সেদিন আমি বুঝলাম যতই লোক চরিয়ে খাই না কেন, আমি একটি গাড়ল।
আপনাকে কিন্তু গাড়ল বলে মনে হয় না। যদিও এ জায়গাটায় তেমন আলো নেই, তবু মনে হচ্ছে আপনি বেশ বুদ্ধিমান লোক।
কথাটা যে খুব ভুল বলেছেন তা নয়। আমি বুদ্ধিমানও বটে, আবার গাড়লও বটে। কোনো কোনো ব্যাপারে বুদ্ধিমান, কোনো কোনো ব্যাপারে গাড়ল। সব মানুষই এরকম। নিউটন বড়ো আর ছোটো বেড়ালের জন্যে কক্ষে দুটো দরজা করেছিলেন, মনে আছে তো?
হ্যাঁ, মনে আছে।
আমরা আসলে আমাদের বুদ্ধিটাকে সর্বত্র প্রয়োগ করি না। এক বিষয়ে বুদ্ধির খেল দেখিয়ে বাহবা কুড়োচ্ছি, অন্য বিষয়ে আকাট। বোকার মতো কাজ করে ছিছিক্কার পাচ্ছি। এই ধরুন ঠিকাদারির কাজে আমাকে বোকা বানাতে পারে এমন লোক কমই পাবেন, আবার সেই আমিই যে কী করে বাজার থেকে বুড়ো ঢ্যাঁড়শ বা পাকা পটল নিয়ে আসছি সেটা আমার কাছেও রহস্য। কাজেই আমি বুদ্ধিমানও বটে, বোকাও বটে। কিন্তু আপনার কথাটাই শোনা হল না। আপনি যেন কেন আজ নার্ভাস বোধ করছেন।
ওই যে বললাম, আজ সকালে উঠেই আমার মনে হচ্ছে আমার আত্মবিশ্বাস বলে কিছু নেই।
ঘাবড়াচ্ছেন কেন? যখন বিয়ে করবেন তখন থেকে টের পাবেন আপনার আরও অনেক কিছুই নেই। বউ এসে আপনার এমন অ্যাসেসমেন্ট করতে শুরু করবে যে আপনি নিজেই অবাক হয়ে যাবেন।
ওরে বাবা!
ভয় পেলে চলবে কেন? এটাই তো দুনিয়ার দস্তুর।
বিয়ে না করলে কেমন হয়?
ব্যাচেলার থাকবেন? তা হলে তো আরও চিত্তির। ব্যাচেলারকে সবাই এক্সপ্লয়েট করে। আত্মীয়স্বজন থেকে বন্ধুবান্ধব কেউ ছাড়বে না। তা ছাড়া ব্যাচেলাররা একটু বায়ুগ্রস্তও হয়ে পড়ে কিনা। প্রথম ব্যাচরা বসল কি না একটু খেয়াল রাখবেন। সাড়ে সাতটা বাজতে চলল কিন্তু।
না না, সাতটা সতেরো। ফার্স্ট ব্যাচ বসার আগেই আমি আপনাকে জানিয়ে দেব।
আপনি কি বিয়েবাড়ির ম্যানেজমেন্টে আছেন নাকি?
না, ঠিক ম্যাজেনমেন্টে আছি বলা যায় না। তবে দেখাশোনা করছি আর কী।
বিয়েতে দেনা—পাওনা কীরকম হচ্ছে জানেন?
তেমন কিছু শুনিনি।
নগদ আছে নাকি?
যতদূর জানি, না।
অবশ্য নগদের প্রশ্ন ওঠে না। শুনেছি নাকি মেয়েটি পছন্দ করে বিয়ে করছে।
লাভ ম্যারেজ নাকি মশাই?
তা ওরকমই বোধহয় কিছু।
সে কী! আপনি পাড়ার ছেলে হয়ে এসব জানেন না!
একটা দীর্ঘশ্বাসের শব্দ হল।
দীর্ঘশ্বাস ফেললেন নাকি?
ঠিক ফেললাম না। বেরিয়ে গেল।
বীরেশবাবুর মেয়ে রিয়া বেশ সুন্দরী, তাই না?
আজ্ঞে।
কীরকম সুন্দরী বলে আপনার মনে হয়?
খুব।
সুজিতবাবু, একটা কথা জিজ্ঞেস করব?
করুন না।
বাই এনি চান্স, রিয়ার প্রতি আপনার কোনো দুর্বলতা নেই তো!
এ কথা কেন মনে হল আপনার?
আত্মবিশ্বাসের অভাবের কথা বলছিলেন তো, তার ওপর দীর্ঘশ্বাস!
দুর্বলতাই তো মানুষকে খায়। আপনি খুবই বুদ্ধিমান।
তা হলে ঠিক ধরেছি?
ঠিকই ধরেছেন।
আত্মবিশ্বাসের অভাবের ফলেই এগোতে পারেননি তো!
সেটাও একটা ফ্যাক্টর বটে।
ভেঙে পড়বেন না মশাই। আপনার এখনও বয়স পড়ে আছে। কত কী ঘটতে পারে। বীরেশ মিত্রের মতো বড়োলোকের মেয়েকে প্রেমের প্যাঁচে ফেলে বিয়েতে গেঁথে তুলতে পারলেও হয়তো পরে পস্তাতেন। বড়োলোকের আদুরে মেয়ের বায়নাক্কা সামলানো তো সোজা কথা নয়।
সে তো বটেই।
তা হলে খারাপটা কী হয়েছে বলুন। ভালোই তো হয়েছে।
আপনি যেভাবে ধরছেন সেভাবে ধরলে বলতে হয় ভালোই হয়েছে।
আরে মশাই, সবসময়ে জীবনের উজ্জ্বল দিকগুলির কথাই তো আমাদের ভাবা উচিত, তাই না? আচ্ছা, আপনার চাকরিটা কীরকম?
সামান্যই।
সরকারি না বেসরকারি?
বেসরকারি।
ওই তো মুশকিল। বেসরকারির ফার্মগুলি বড্ড এক্সপ্লয়েড করে।
আজ্ঞে হ্যাঁ।
জব সিকিউরিটিও তেমন থাকে না।
যথার্থই বলেছেন।
মাইনে—টাইনে কেমন দেয়?
মোটামুটি দেয়, আমার চলে যায়।
খাটুনি কেমন?
খুব। মোষের মতো খাটতে হয়। দৌড়ঝাঁপও আছে।
ওই তো বেসরকারি ফার্মে চাকরির মুশকিল। আপনি তো বললেন হাতের কাজ জানেন।
আজ্ঞে যৎসামান্য।
ভালো করে শিখলে হাতের কাজ জানা লোকের অবশ্য চাকরির অভাব হয় না।
তা আপনার হাতের কাজটা কী ধরনের?
এই একটু কম্পিউটার নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতাম। তাই একটু—আধটু শিখেছি।
আজকাল তো কম্পিউটারের যুগ। লেগে থাকুন, হবে।
লেগেই তো আছি।
কোন কোম্পানিতে আছেন?
ইনফো টেকনো।
ইনফো টেকনো? না! নামটা শুনেছি বলে মনে হয় না।
শোনার মতো নয়। মোটে দু—বছর হল খুলেছে।
এবার একটু অ্যালার্ট হবেন মশাই। সাড়ে সাতটা বাজে কিন্তু।
হ্যাঁ, ওটা আমার খেয়াল আছে। এখন আপনি ধীরে ধীরে রওনা হতে পারেন, তবে গিয়ে সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়াতে হবে। পাঁচ মিনিট পর ডাকবে।
তা হলে উঠি?
হ্যাঁ, আসুন।
আপনার পুরো নামটা কী যেন!
সুজিত বসু।
সুজিত বসু! নামটা চেনা চেনা লাগছে কেন বলুন তো!
চেনা লাগবার কথা তো নয়। আমি বিখ্যাত লোক নই।
তা হলেও কেমন যেন চেনা ঠেকছে। আচ্ছা ইয়ে বীরেশবাবুর জামাইয়ের নামটা কী বলুন তো!
সুজিত বসু!
তাই তো সেইজন্যই চেনা ঠেকছিল। আপনার নামও তা হলে সুজিত বসু! তা কী করে হয়?
আর একটা একটা দীর্ঘশ্বাস।
হয়। হয়ে যায়।
তার মানে কি আপনি বলতে চান রিয়ার সঙ্গে একজন সুজিত বসুর বিয়ে হচ্ছে যিনি আপনি নন?
আর একটা দীর্ঘশ্বাস।
সেরকম হলেই বোধহয় খুশি হওয়া যেত। কিন্তু লোকটা আমিই।
অ্যাঁ?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
খুব ভালো লাগলো গল্পটা।