বিয়ের ফুল

বিয়ের ফুল

রামতনু সাত-সাত জায়গায় মেয়ে দেখিয়া ফিরিল; কিন্তু পছন্দ আর হইল না। সবগুলিই জবুথবু হইয়া সামনে আসিয়া বসে; হাজার চেষ্টা করিলেও ভাল করিয়া দেখা হয় না, সেইজন্য হাজার সুন্দর হইলেও মনে কেমন একটু খুঁত থাকিয়া যায়। সন্দেহ হয়, আচ্ছা, এ যে চোখটা কোনমতেই বড় করিয়া চাহিল না, নিশ্চয়ই কোনও দোষ আছে; ওর যে খোঁপার এত ধুম, ওইখানেই গলদ নাই তো? ইত্যাদি।

নাহক এই সাত ঘাটের জল খাইয়া রামতনু বুঝিল, কন্যামননের এ প্রশস্ত উপায় নহে। একটা প্রশস্ত উপায় মনে মনে ঠাওরাইবার চেষ্টা করিতেছিল, এমন সময় বউদির মুখে একদিন শুনিল, তাঁহার সম্পর্কে এক পিসির কন্যা সম্প্রতি প্রবেশিকা পরীক্ষায় কৃতিত্বের সহিত পাস দিয়া জলপানি পাইয়াছে। রামতনু বেচারা এতদিন বেশির ভাগ পাড়াগাঁয়ে পুঁটী- খেদী’দেরই সন্ধান করিয়া ফিরিতেছিল, সুতরাং এখন খবর পাইয়া এই সুশিক্ষিতা যুবতী- রত্নটির জন্য তাহার হৃদয় একেবারে পিপাসিত হইয়া উঠিল।

‘দেখা নাই, বুঝা নাই, এইরূপ হইল কি করিয়া’—ইত্যাকার সন্দেহ যদি কাহারও মনে উদয় হয় তো কৈফিয়ত এই মাত্র দেওয়া যায় যে, প্রেম সব সময় চোখে দেখার তোয়াক্কা রাখে না—হৃদয় মরুভূমে’ আপনার খেয়ালমতই গজাইয়া উঠে। তাই, বউদিদি সংবাদটি দিতে একটু অশোভন হইলেও রামতনু প্রথমেই জিজ্ঞাসা করিয়া বসিল, “কত বয়স তাঁর, দেখতে কেমন?”

বউদিদি ইহাতে তাচ্ছিল্যের সহিত মুখটা ঘুরাইয়া বলিলেন, “পোড়া কপাল, তোমার বুঝি অমনই নোলায় জল এল? পুরুষের সঙ্গে টেক্কা দিয়ে পাস করে, সে মেয়ের আবার বিয়ে! গলায় দড়ি জোটে না? কোন্ দিন বা কাছা-কোঁচা এঁটে পুরুষের সঙ্গে আপিসে বেরুবে!”

রামতনু বেজায় অপ্রতিভ হইয়া পড়িল। বুঝিল, কথাগুলা বড় অসাময়িক হইয়া পড়িয়াছে। বয়স এবং চেহারার সহিত পাস দিবার বিশেষ সম্বন্ধ সে নিজেই তেমন খুঁজিয়া পাইল না। কথাগুলা তাহার মনের আকস্মিক উন্মাদনার খবরই বাহিরে প্রকাশ করিয়া দিয়াছে। সামলাইবার চেষ্টা করিয়া বলিল, “না গো না, সে কথা নয়, কত বয়সে পাস দিয়েছে—তোমার গিয়ে, ষোল বছরের কমে—অর্থাৎ কিনা—”

বউদিদি হাসিয়া ফেলিলেন।

রামতনু মুখ-চোখ রাঙা করিয়া আরও দুই তিন বার ‘অর্থাৎ কিনা’ ‘অর্থাৎ কিনা’ করিয়া তখনও বউদিদিকে হাসিতে দেখিয়া হঠাৎ চটিয়া উঠিল; বলিল, “না বৌদি, সব সময় ইয়ারকি ভাল লাগে না।”

পূর্বের মতই সূতীক্ষ্ণ হাস্যসহকারে বউদিদি উত্তর করিলেন, “বিশেষ ক’রে মনের অবস্থা যে-সময় খারাপ, না? আহা, শুধু পাস-করা শুনেই বেচারীর এই দশা, যখন শুনবে চোদ্দ বছর বয়স, দেখতে পটের ছবিটির মতন, তার ওপর আবার পদ্য লিখতে পারে, তখন বোধ হয় মুচ্ছো যাবে।”

মূৰ্চ্ছা যাইবার লক্ষণ রামতনুর তখনই প্রকাশ পাইতেছিল—রাগের চোটে; কোনরকমে আত্মসংবরণ করিয়া ঘর হইতে সক্রোধে বাহির হইয়া গেল।

এই ঘটনাটির পর ছোকরা হঠাৎ বড় নির্জনতাপ্রিয় হইয়া উঠিল। বৈকালে দেখা গেল, সে মাঠে একলা ঘুরিয়া বেড়াইতেছে এবং সন্ধ্যার সময় তাহাকে বড় একটা দেখাই গেল না। রাত্রে ডালের সহিত দুধ মাখিয়া এবং মাঝে মাঝে আলুর শাঁস বাদ দিয়া খোসা খাইয়া সে আহার শেষ করিল এবং তাহার পর বিছানায় আশ্রয় লইল। রাত একটার সময়ও সে জাগিয়া মশারির চালে কল্পনার রঙিন ছবি আঁকিতেছে।

.

তাহার পরদিন কিন্তু মেঘ কাটিয়া গেল, এবং রামতনুকে বেশ প্রফুল্ল দেখা গেল। স্পষ্টই বুঝিতে পারা গেল যে, সে রাতারাতি একটা মতলব আঁটিয়া ফেলিয়াছে। সে স্থির করিল, প্রজাপতির সহিত এ পর্যন্ত সাত-সাতটা বাজি হারিলেও আর এক হাত খেলিয়া দেখিবে। এবার আর পরের কথায় নাচিয়া চট করিয়া কন্যা দেখিতে ছুটিয়া তিক্ত মুখে ফিরিয়া আসা নয়। পূর্বরাগের পালাটা দস্তুরমত শেষ করিয়া অন্য কথা। তবে দেরি আর কোনমতেই করা চলে না। সে মনশ্চক্ষে দেখিতে পাইল, এই বিদুষী তরুণীটির জন্য যুবকমহলে একটা চাঞ্চল্য পড়িয়া গিয়াছে; এবং স্বয়ম্বর-সভার প্রত্যেক প্রার্থীর মতন যদিও সে নিজেকেই সর্বাপেক্ষা বাঞ্ছনীয় মনে করিল, তথাপি ভাবিল, না, দেরি করাটা নিরাপদ নয়। অভাবের মাথায় চাই কি অবাঞ্ছনীয়ের গলায়ই বরমাল্য পড়িয়া যাইতে পারে।

সকালবেলা একটু এদিক ওদিক করিয়া কাটাইল; তারপর হঠাৎ বউদিদির নিকট একটা পুরানো টেলিগ্রাম লইয়া গিয়া বিরক্তভাবে বলিল, “এই নাও, যা মন করেছিলুম তাই; আমায় আর থাকতে দিলে না।”

টেলিগ্রাম দেখিয়া বউদিদির মুখটা শুকাইয়া গিয়াছিল। তিনি জিজ্ঞাসু নেত্রে চাহিয়া রহিলেন।

রামতনু বলিল, “ভয় পাবার কিছুই নেই; তবে আমার কালই যেতে হবে।”

“কাল? এই বললে, বারো দিন দেরি আছে!”

“আমি বললেই তো আর হচ্ছে না, বিশ্বাস না হয় টেলিগ্রামটা পড়িয়ে নাও কাউকে দিয়ে।”—বলিয়া পাছে সত্যই কাহাকেও দিয়া পড়াইয়া লওয়া হয়, এই ভয়ে সেটা সঙ্গে সঙ্গে পকেটে পুরিল এবং হঠাৎ অধিকতর বিরক্তভাবে সেটাকে বাহির করিয়া টুকরা টুকরা করিয়া ছিঁড়িয়া বলিল, “আরে রামঃ এমন কলেজেও মানুষে পড়ে!”

এ সব ব্যাপারে অনভিজ্ঞা বউদিদি সান্ত্বনা দিয়া বলিলেন, “তা ভাই, কি করবে বল; কামাই করাটা কি ভাল হবে? তোমার দাদা শুনে আবার চটবেন। কিন্তু এমন কেন হ’ল বল তো?”

রামতনু পূর্বের মতই রাগতভাবেই বলিল, “কে জানে? শুনেছিলাম, লাটসাহেব নাকি কলেজ দেখতে আসবে, তাই হবে বা।”

বউদিদি রাগিয়া বলিল, “মুখে আগুন লাটসাহেবের, সে আর মরবার সময় পেল না! ঘরের ছেলে দুদিন ঘরে এসে বসবে, তাতেও সোয়াস্তি নেই।”

যেন অকস্মাৎ মনে পড়িয়া গেল—এই ভাবে রামতনু বলিল, “চুলোয় যাক; হ্যাঁ, তোমার কোন কাজ-টাজ আছে নাকি? তা হলে বল। তাই ব’লে আমি কিন্তু তোমার সেই পিসের বাড়িতে যেতে পারব না, সে আগে থাকতেই ব’লে রাখছি।”

এই সরলহৃদয়া রমণী ভাবিলেন কালকের ঠাট্টায় দেবর তাঁহার রাগ করিয়াছে। সেইজন্য সেইখানি যাওয়াইবার জন্য বেশি জিদ করিয়া বসিলেন। ঠিকানা দিলেন মাথার দিব্য দিলেন, এবং যাহাতে হাঁটিয়া যাইতে না হয় তাহার জন্য ভাড়াও কবুল করিলেন। রামতনুর ঠিকানাটা লওয়াই উদ্দেশ্য ছিল; সেটি মনে মনে মুখস্থ করিয়া লইল। বাহিরে কিন্তু খুব মাথা নাড়িয়া বউদিকে বলিল, “সে হতেই পারে না, আমি সেখানে যেতেই পারব না : তুমি আমায় তা হ’লে চেন নি।”

পরদিবসই যাওয়া ঠিক হইল। দাদা তাহার বাড়িতে ছিলেন না। রামতনু ভাবিল, স্ত্রীর মুখে তিনি যখন এই উদ্ভট কথাটা শুনিবেন তখনই নিশ্চয়ই ভাবিবেন, রামতনু ভ্রাতৃজায়ার সহিত খুব একচোট ঠাট্টা করিয়া গিয়াছে; ততদিনে সে একটা সুসঙ্গত কারণ খুঁজিয়া বাহির করিয়া ফেলিবে।

মা বধূমাতার মুখে শুনিলেন। অঞ্চলে চোখ মুছিয়া বলিলেন, “রামুর আমার পড়াশুনার ঝোঁকটা চিরকালই এই রকম। আহা, ও কি বাঁচবে আমাদের পোড়া অদৃষ্টে? সবই ভাল বাছার, তবে ওই কেমন বিয়ের ফুল আর ফুটছে না!”

.

যাহা হউক, কোর্টশিপ করিবার উদ্দেশ্যে সুটকেস, বিছানা, স্টিল-ট্রাঙ্ক, টিফিন- কেরিয়ার ইত্যাদি গাদাখানেক লটবহর সমেত রামতনু কলিকাতা অভিমুখে যাত্রা করিল। হাওড়ায় পঁহুছিল সন্ধ্যার ঘণ্টা দেড়েক পূর্বে। মনটা তাহার উৎসাহে পূৰ্ণ হইয়া উঠিল। এইবার সে সেই বাঞ্ছিতার নিকট পঁহুছিল, যাহাকে আজ তিন দিন ধরিয়া কল্পনা ও স্বপ্নের মাঝে পরিপূর্ণ করিয়া ফেলিয়াছে। পুলটি পার হইলেই তাহার ওই তীর্থরূপা নগরী! ওঃ, কাল এতক্ষণ!—ভাবিতেও অসহ্য সুখ!

অন্যমনস্কভাবে মালকোঁচা আঁটিয়া ভারনিপীড়িত কুলিটাকে একটা ধমক দিল; এবং নিজেই বিছানার পুঁটলিটা হাতে ঝুলাইয়া লইল। নিকটে একটা ছোঁড়া একটা ফিটনের দ্বার খুলিয়া অন্য দিকে মুখ ফিরাইয়া দাঁড়াইয়া ছিল। ভারটা নেহাত অসহ্য বোধ হওয়ায় রামতনু না বলিয়া সেটা দ্বারপথে সেই ফিটনের মধ্যে চালাইয়া দিয়া অগ্রগামী দূরবর্তী কুলিটাকে ডাক দিল, “ওরে বেটা, এদিকে—এখানে।”

ছোঁড়াটা ব্যাপার দেখিয়া হতভম্ব হইয়া গিয়াছিল। এক্ষণে আবার কুলিটাকে গাড়ির দিকে আসিতে দেখিয়া অগ্নিশর্মা হইয়া চিৎকার করিয়া উঠিল, “এটা মালগাড়ি আছে নাকি বাবু—যেতো পারছো চাপাচ্ছো? আমার আয়েসী বিলেতী ঘোড়া; বাজে মাল টানতে পারবে না।” তাহার পর রামতনুর সহিত অন্য লোক নাই দেখিয়া বলিল, “আলবৎ, আদমি যেতো পারবে এসো তাতে ‘না’ বোলবার ছেলে নয়।”—বলিয়া ঘোড়াটার চর্মসার জঙ্ঘায় একটা চাপড় দিয়া বলিল, “কি রে বেটা, না?”

রামতনু কথাটা প্রমাণের জন্য একবার ‘আয়েসী বিলিতী’ ঘোড়াটার পানে চাহিল, দেখিল, সে বেচারী দীন নয়নে মোটগুলার দিকে চাহিয়া আছে। তাহার সুস্পষ্ট মোটা মোটা পঞ্জরের বেড়ার মধ্যে শিরাবহুল স্থূল পেটটি দেখিলেই বোধ হয় সে তাহারই ভারে এত কাহিল যে, অন্য ভার বহিবার আর তাহার সামর্থ্য নাই। তবে বেঁধে মার সয় ভাল’– ভাবটা যেন অনেকটা এই রকম গোছের।

কিন্তু অনুকম্পার এ অবসর নহে; বরং দুই পয়সা ভাড়া বেশি দেওয়া যাইতে পারে, সেই বালকের কথায় অনাদর দর্শাইয়া রামতনু বোঝাগুলি কুলির মাথা হইতে নামাইতেছিল, এমন সময় এক সাহেব-আরোহীর সহিত গাড়োয়ান স্বয়ং আসিয়া দেখা দিল। সুখের বিষয় কোন বচসা হইল না; কারণ এই নবৈশ্বর্যগর্বিত গাড়োয়ানটার সহিত আর বাক্যবৃদ্ধি নিরাপদ নহে জানিয়া রামতনু স্বহস্তেই বোঝাটি গাড়ি হইতে নামাইয়া লইল।

ফিটন চলিয়া গেল। চালকের পাশে আসিয়া সেই ছোঁড়াটা একবার রামতনুর পানে চাহিয়া হাসিতে হাসিতে গাড়োয়ানটাকে কি একটা বলিল। কথাটা শুনিতে না পাইলেও রামতনু অপমানের আঘাতে বড় নিরুৎসাহ হইয়া পড়িল। তাহার বাঞ্ছিতার ছবিটি মনে এতই সজীব হইয়া পড়িয়াছিল যে, তাহার মনে হইল, যেন তাহার সম্মুখেই তাহাকে এই লাঞ্ছনা ভোগ করিতে হইতেছে।

কিন্তু নিরুৎসাহ হইলে কাজ চলে না। এদিকে সব গাড়িই প্রায় ভর্তি হইয়া আসিতেছে। রামতনু কুলিটাকে বলিল, “নে, ওঠা। ও বেটা বড় বেঁচে গেল আজ আমার হাত থেকে।”

কুলিটা খপ করিয়া একটু নিচু হইয়া হাতজোড় করিয়া বলিল, “না বাবু, আমায় চুকিয়ে দিন; আপনি বোড়ো ফ্যাসাদে লোক আছেন।”

গাড়োয়ানটার মত কুলিটারও অদৃষ্ট সুপ্রসন্ন ছিল বলিতে হইবে। তাই অদূরে কয়েকজন ব্যর্থমনোরথ গাড়োয়ানকে সেই অভিমুখে হুড়াহুড়ি করিয়া আসিতে দেখা গেল এবং তাহাদের মধ্যে একজন বিশেষ ক্ষিপ্রতার সহিত আগুয়ান হইয়া মালগুলিতে হাত রাখিয়া সঙ্গীগণকে শাসাইয়া দিল, “বাস করো, মেরা সওয়ারি হ্যায়।” এবং সঙ্গে সঙ্গে তাহার সহকারী বালককে ডাক দিল, “এ ইসমাইল, আরে চল্ শা—”

তাহাকে লইয়াই এত কাড়াকাড়ি পড়িয়া গিয়াছে দেখিয়া রামতনু আবার বেশ সপ্রতিভ হইয়া উঠিল এবং গাড়ি আসিলে গদিতে একটা চাপ দিয়া বসিয়া বলিল, “হাঁকাও।”

ঘোড়ার পিঠে চাবুক কষিয়া গাড়োয়ান জিজ্ঞাসা করিল, “কোথায় যেতে হোবে বাবু?”

রামতনু একেবারে আকাশ হইতে পড়িল। তাই তো, কোথায় যাইতে হইবে? সর্বনাশ! এ কথাটা যে রামতনু নিজেই জানে না। কলেজের হস্টেলে যে তালা আঁটা—এ কথা তো সে একেবারও ভাবে নাই। কি বিভ্রাট! এখন উপায়? এদিকে সন্ধ্যা আগতপ্রায়, আর সঙ্গে এই এতাগুলা অতিকায় মোট। এই তিন দিন পড়াশুনা ছাড়িয়া এত যে ছাইভস্ম চিন্তা করিল, তাহার মধ্যে এই এত বড় চিন্তাটা কি মনে একবারও স্থান দিতে নাই?

কবিরা বলেন, প্রেম অন্ধ। তা যখন হইয়াছিল, তখন তো অন্ধ করিয়াছিল, কিন্তু এখন নেশা কাটিয়া গেলেও রামতনু চক্ষে কিছু দেখিতে পাইল না। শরীর তাহার এলাইয়া পড়িল। গদিতে ঠেস দিয়া সে আকাশ-পাতাল ভাবিতে লাগিল; কিন্তু আকাশ-পাতালের মাঝখানে যে আপাতত কোথায় গিয়া দাঁড়াইবে, তাহা স্থির করিয়া উঠিতে পারিল না।

১৪ নম্বর বিপ্রদাস লেনের কথা একবার মনে হইল। কিন্তু সেখানে তো এ অবস্থায় গিয়া খোঁটা গাড়া চলে না। চলে না তো, কিন্তু উপায়? কলেজ খুলিবার তো এখনও পুরো দশ দিন বাকি; এই দশ দিন কি গাড়িতে ঘুরিয়া বেড়াইবে? তাহাতেও সে নয় রাজী; কিন্তু গাড়ির মালিক যে নামিয়া আসিয়া এখনই একটা মীমাংসা করিয়া লইবার জন্য উৎকট রকম পীড়াপীড়ি লাগাইয়া দিবে, দশ মিনিটও যাইতে দিবে না।

গাড়িটা স্টেশন ছাড়াইয়া বাহিরে আসিল। ইহার মধ্যে গাড়োয়ান আরও দুই-তিন বার মাথা ঝুঁকাইয়া জিজ্ঞাসা করিয়াছিল, “কোথায় যেতে হোবে?” কিন্তু কোন উত্তর না পাওয়ায় গাড়ি থামাইয়া নামিয়া আসিয়া রুক্ষভাবে জিজ্ঞাসা করিল, “এ বাবু, আপনি ও একটা মাল আছেন নাকি? কোথা বোলেন না যে? না, আমরা জ্যোৎখি আছি যে, বাড়ি চিনে লেবো?” ঘর্মাক্ত কলেবর রামতনু সোজা হইয়া বসিয়া ধীরভাবে বলিল, “দাঁড়া না বাবা, ততক্ষণ তুই চল্ না সামনে, বলছি।”

একটা অজানা বিপদের আশঙ্কায় ভীত হইয়া গাড়োয়ান বলিল, “কি মোজার কথা আছে! আপনি লামুন, আমি এ রকম সওয়ারী চাহে না।” পরে ইসমাইলকে বলিল, “উতার লে বক্সা।”

বিপদ যখন এতই আসন্ন হইয়া পড়িল, রামতনুর চট করিয়া একটা হোটেলের কথা মনে পড়িয়া গেল। সে বলিল, “আঃ, চল্ না রে ২৫/৭ নম্বর মেছোবাজারে; আমার এই নম্বরটাই মনে পড়ছিল না।”

.

অপরাহুকাল। ‘নবদ্বীপ আশ্রম’-এর একটি কক্ষে রামতনু গালে হাত দিয়া গাঢ় চিন্তায় আচ্ছন্ন।

আকাশে মেঘ থমথম করিতেছে। অপরাহ্ণের তাবৎ চিহ্নগুলাই লোপ পাইয়াছে। রামতনুর মনটা বড় বিষণ্ন। আজ সকালে এক পশলা বৃষ্টি হইয়া গিয়াছিল বলিয়া প্রিয়ার উদ্দেশে যাওয়া হয় নাই; আর এখনও এই দশা। কাজটাও এমন ধরনের নয় যে একটা গাড়ি ভাড়া করিয়া যাওয়া চলে। যাক, যখন উপায় নেই, তখন আর কি হইবে?

পশ্চিমে হাওয়ায় মেঘগুলা পূর্বপ্রান্তে জড় হইতেছিল। রামতনু শখ করিয়া ভাবিতেছিল, তাহার মানসপ্রতিমাও ওই দিকটাই আলো করিয়া আছে। পুরাকালে এই মেঘ বিরহী যক্ষের সংবাদ যেমন তাহার প্রেয়সীর নিকট বহন করিয়া লইয়া যাইত, তেমন করিয়াই পূর্বদিকে ১৪ নম্বর বিপ্রদাস লেনে তাহার প্রিয়ার পদতলে ঢলিয়া পড়িতেছে। আহা, তাহার বিরহেও এত সুখ!

রামতনুর কিন্তু মনে পড়িল, তাহার সহিত যখন একবারও দেখা হয় নাই, তখন এই মনগড়া বিরহ নিষ্ফল। প্রথমে কিরূপে দেখা-সাক্ষাৎ করা উচিত সেইটিই ভাবিবার কথা। বাস্তবিক, আমি অমুকের দেওর বলিয়া উঠিলে চলিবে না তো। না হয় পাঁচমিনিট ধরিয়া বারান্দায় দাঁড়াইয়া পরিচয়ই দিল। তাহার পর যদি জিজ্ঞাসা করে, “কি কাজ বাপু এখানে?” সাত-পাঁচ ভাবিয়া রামতনু স্থির করিল, পরিচয়টা যেন হঠাৎ হইয়া গেল—এইরূপ হইলেই ঠিক।

মিনিট কয়েক চিন্তার পর রামতনুর মাথায় একটা জমকালো মতলবের উদয় হইল। সেটা সংক্ষেপিত এই—

সে এখনই বাহির হইয়া বিপ্রদাস লেনটা চিনিয়া লইবে। তাহার পর যতক্ষণ না বৃষ্টি নামে, এদিক ওদিক একটু পায়চারি করিবে; এবং বৃষ্টি নামিবামাত্রই গলিতে ঢুকিয়া পড়িবে ও চৌদ্দ নম্বর বাড়ির নিকট গিয়া আর যেন পারিল না—এই ভাবে তাহার বারান্দায় উঠিয়া পড়িবে। ইহাতে চাই কি শ্রীমুখে ‘আহা’ এবং শ্রীহস্তপ্রদত্ত একটি শুষ্ক বস্ত্রেরও আশা করা যাইতে পারে। তাহা ছাড়া পরিচয়াদির সময়ও পাইবে অনেক

তাহা হইলে আর দেরি করা চলে না। রামতনু তাড়াতাড়ি জুতা জামা পরিয়া বাহির হইয়া পড়িল। চারিদিকে মেঘের আড়ম্বর দেখিয়া একবার মনে হইল ছাতাটা লইয়া যায়; কিন্তু ভাবিল, তাহা হইলে ভাল জমিবে না।

ছোট বড় কতকগুলি গলি অতিক্রম করিয়া রামতনু কর্নওয়ালিস স্ট্রিটে আসিয়া পড়িল। রাস্তার দুই দিকে বিপ্রদাস লেন খুঁজিতে খুঁজিতে সে উত্তর দিকে চলিল। মাঝে মাঝে আকাশের দিকে চাহিয়া তাহার মনটা বড় দমিয়া যাইতেছিল। বৃষ্টি আরম্ভ হইল বলিয়া আর দেরি নাই। তাহা হইলেই তো সর্বনাশ! আশঙ্কা-দুর্বল মনে রামতনুর একটা সংশয় উদয় হইল, বউদিদি যদি ভুল বলিয়া থাকেন! কিংবা তাহার পোড়া বরাতে যাহা বেশি সম্ভব— ইঁহারা যদি বাসা বদলাইয়া থাকেন!

বিপন্নভাবে রামতনু এক বৃদ্ধ দোকানীকে বলিল, “ওগো কর্তা, আমি বিপ্রদাস লেনে যাব।”

বৃদ্ধ কি একটা নেশার ঝোঁকে ঝিমাইতেছিল। মাথা না তুলিয়াই ঘাড়টা একটু হেলাইয়া বলিল, “স্বচ্ছন্দে।’

বৃষ্টি নামিল। এখানে আর বৃথা কালক্ষেপ করা যায় না। দোকানীকে বিড়বিড় করিয়া কি একটা গালি দিয়া রামতনু এক রকম ছুটিতেই আরম্ভ করিল। বৃষ্টির জলে তাহার উৎসাহ স্যাতস্যাতে হইয়া আসিতেছিল! স্থির করিল, আর একজনকে জিজ্ঞাসা করিবে; যদি সন্ধান না পায় তো আজ এই পর্যন্ত।

এইরূপ মনস্থ করিয়া রামতনু একজন পথিককে প্রশ্ন করিল। সামনেই একটা গলি ছিল, তিনি দেখাইয়া দিয়া বলিলেন, “এই গলি দিয়ে একটু বেরিয়ে যান, সামনেই বিপ্রদাস লেন।”

রামতনু হাতে স্বর্গ পাইল, কিন্তু মাথার স্বর্গ তাহাকে তীক্ষ্ণ বারিধারায় বিব্রত করিয়া তুলিতেছিল, আর সেই তীক্ষ্ণতা অতিশয় অসহ্য হইয়া উঠিল, যখন রামতনু বিপ্রদাস লেনে প্রবেশ করিয়া দেখিল, ডাইনে বাড়ির নম্বর ১১১ এবং বামে ১১২।

তাহার মানে এটা গলির শেষ দিক এবং গলিটাও মস্ত বড়। দুঃখ করিয়া আর কি হইবে? দক্ষিণ দিকের বাড়িগুলার উপর মাঝে মাঝে নজর ফেলিয়া মাথা নীচু করিয়া সে দৌড়াইতে লাগিল। তাই কি ছাই বাড়িগুলাই ছোট? যাহা হউক, এই বড় বড় বাড়িগুলার নম্বর ক্রমে ক্রমে কমিয়া আসিতে লাগিল, এবং রামতনুরও নষ্ট উৎসাহ ফিরিয়া আসিতে লাগিল। অবশেষে একবার মাথা উঁচাইয়া রামতনু দেখিল—২১।

তাহার পরে মুখে হাসি দেখা দিল, এবং সে আর মাথাও নীচু করিল না। চোখে জলের ঝাপটা লাগিতেছিল। আসন্ন সুখের কথা ভাবিয়া এ সামান্য অসুবিধাকে উপেক্ষা করিয়া বাড়ির নম্বরগুলিতে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখিয়া রামতনু লম্বা লম্বা পা ফেলিয়া শৌখিন চালে দৌড়াইতে লাগিল। মুখে একটু হাসিও টানিয়া আনিল—যেন ব্যাপারটা সে বড়ই উপভোগ করিতেছে।

ক্রমে ১৮, ১৭, ১৬ নম্বর বাড়ি পার হইয়া গেল। এইবার ১৫, তাহার পর এই ১৪। রামতনু টপ করিয়া উঠিয়া পড়িল। দিব্য বারান্দাওয়ালা বাড়ি।

গলা হইতে চাদরটা নামাইয়া নিংড়াইতে নিংড়াইতে রামতনু বলিল, “কি বৃষ্টি!” এবং একবার চারিদিকটা চাহিয়া দেখিল।

বারান্দার এক কোণে একটা পশ্চিমী চাকর গুনগুন করিয়া গান করিতেছিল—

“কলকতিয়াকে লোগনিকে নহি পতিয়ইহ
সমর্ হু সমর্ হু সখি বাট ঘাট যেইহ।”

অর্থাৎ হে সখি, কলিকাতার লোককে প্রত্যয় নাই, অতএব পথঘাট চলিবে খুব সামলাইয়া। সুতরাং এবংবিধ অবিশ্বাস্য একজন কলিকাতাবাসীকে পথঘাট ছাড়িয়া একেবারে তাহার প্রভুর গৃহে আসিয়া উঠিতে দেখিয়া রুক্ষভাবে সে বলিল, “এ মাশা, কিনারে চলিয়ে দাঁড়ান; দালানকে মাঝখানে জল পরসে।”

রামতনুর এতক্ষণ অন্য রকম অভ্যর্থনা পাইবার কথা। কিন্তু তাহার কোন চিহ্ন না পাইয়া সে দালানের মাঝখানেই দাঁড়াইয়া রহিল। এক্ষণেই পরিচয়মাত্রে তাহার কদর দেখিয়া এ বেটার কিরূপ ভ্যাবাচাকা লাগিয়া যাইবে, তাহা ভাবিয়া রামতনু বেশ একটু কৌতুক অনুভব করিতেছিল। কিন্তু আর একটু দাঁড়াইয়া চঞ্চলভাবে ইতস্তত দৃষ্টিক্ষেপ করিয়া দেখিল, দুয়ারে শিকল আঁটা। এতক্ষণ সে শুধু কাঁপিতেছিল, এইবার দাঁতে দাঁত লাগিতে শুরু হইল। কি কুগ্রহ, মিছামিছি সন্ধ্যার সময় এই বৃষ্টিস্নান! আরে মার্ ঝাড়ু এই কোর্টশিপের মাথায়! ইহার চেয়ে চার ক্রোশ গরুর গাড়ি চড়িয়া মেয়ে দেখিতে যাওয়া শতগুণে শ্রেয়।

হঠাৎ পরিচয়ের আশা ছাড়িয়া কাপড় নিংড়াইয়া মাথা মুছিতে মুছিতে রামতনু চাকরটাকে প্রশ্ন করিল, “তোর মনিবরা কোথায়?”

চাকরটা লোকটার চালচলন দেখিয়া সন্দিগ্ধ মনে ইতস্ততঃ করিয়া বলিল, “তাতে তোমার কি জরুরি আছে? এই পাঁচ মিনিটমে এসে পড়বে।”—বলিয়া একবার আড়চোখে নিজন রাস্তা ও রুদ্ধ গৃহগুলোর উপর নজর ফিরাইয়া লইল।

বেচারা মনিবের সত্বর প্রত্যাবর্তনের সম্ভাবনা জানাইয়া এই অজ্ঞাতকুলশীল কলিকাতাবাসীটিকে তাড়াইবে ভাবিয়াছিল, কিন্তু ইহাতে তাহাকে বরং প্রফুল্ল হইতে দেখিয়া বেজায় অস্বস্তি অনুভব করিল এবং রামতনুর উপর হইতে চোখ না সরাইয়া একটু রাস্তার দিকে সরিয়া বসিল।

রামতনু সেটা বিশেষ লক্ষ্য করিল না। নেহাত চুপ করিয়া না থাকিয়া একটু কথাবার্তা কহিবার জন্য বলিল,”তুই বুঝি চাকর?”

উত্তর হইল, “হুঁ, লেকিন হামার বড়া ভাই পুলিসে কাম করে।” রামতনু বড় ভাইয়ের পরিচয়ের প্রয়োজন তেমন বুঝিতে পারিল না, ভাবিল, ওদের বুদ্ধিই এই রকম।

অনেকক্ষণ নীরবে কাটিল। রামতনু মুঠায় চাপিয়া চাপিয়া জল বাহির করিয়া রকের মাঝেই ফেলিতে লাগিল। চাকরটা অসহিষ্ণুভাবেই বলিয়া উঠিল, “এ মাশা, কিনারে দাঁড়ান না, কিস মাফিক লোক আপনি?”

রামতনু একটু চটিল; ভাবিল, আচ্ছা বেয়াদব তো! কিন্তু মনে হইল, আহা, চেনে না; ও বেচারার আর দোষ কি? তাই এই অজ্ঞানজনিত ঔদ্ধত্যকে ক্ষমা করিয়া বলিল, “কই, মনিব যে তোর আসে না?”

চাকরটা তাহার দিকে ফিরিলও না, তাচ্ছিল্যের সহিত চুপ করিয়া রহিল। রামতনু ভিতরে ভিতরে জ্বলিয়া যাইতেছিল; কিন্তু ভাবিয়া দেখিল, চটিয়া ফল নাই। তাই কঠোর সংযমের সহিত বলিল, “তা যদি দেরিই থাকে তো একটা শুকনো কাপড় নিয়ে আয় দিকিনি।”

চাকরটা বিজ্ঞভাবে মাথা নাড়িয়া ব্যঙ্গস্বরে বলিল, “আর গোরাম গোরাম একপেয়ালা চা ভি আনিয়ে দি? বোড়ো ভিজিয়ে গেলেন—”

রামতনু তখন আরও চটিয়া গেল, কিন্তু আরও নরম সুরে চিবাইয়া চিবাইয়া বলিল, “দেখ, ঢের বাংলা বুলি হয়েছে, চালাকি রাখ। আমার চাকর হলে এতক্ষণে আস্ত থাকতিস নি। তোর মনিব এলে টের পাবি, আমি কে। তবে নেহাত দেরি হ’লে আমি যদি চ’লেই যাই তো এই কার্ড রইল। নে একখানা কাপড় নিয়ে আয় দিকিন লক্ষ্মীছেলের মতন।”

রামতনু পূর্ব হইতেই কার্ড সংগ্রহ করিয়া রাখিয়াছিল। ভিজা একখানা কার্ড বাহির করিয়া তাহার নাম ও ঠিকানা লিখিয়া চাকরটার হাতে দিয়া বলিল, “নে রাখ; আর এই ঠিকানায় ভিজে কাপড়গুলোও কাল দিয়ে আসবি।”

চাকরটা গম্ভীরভাবে কার্ডটা দুই খণ্ড করিয়া ফেলিয়া দিল এবং দাঁড়িয়া উঠিয়া হুঁশিয়ারির সহিত গলা উঁচাইয়া বলিল, “হামার নাম রামটহলবা আসে, হামায় ঠকিয়ে কাপড় লিতে আসে তুম?”

রামতনু আর নিজেকে সামলাইতে পারিল না, কারণ মানবের ধৈর্য এবং শীত সহ্য করিবার ক্ষমতা—উভয়েরই একটা সীমা আছে। একে তো শুষ্ক কাপড় পাইল না, তাহার উপর চক্ষের সম্মুখে তাহার কার্ডের এই লাঞ্ছনা হওয়াতে সে একেবারে ক্ষিপ্ত হইয়া উঠিল। ঘুষি বাগাইয়া সামনে আগাইয়া গেল এবং দাঁতে দাঁত পিষিয়া বলিল, “আমি ঠগ, জোচ্চোর? বেটা, যত বড় মুখ নয়, তত বড় কথা?”

হুঁশিয়ার হইলেই যে সাহসী হইতে হইবে–এমন কোন কথা শাস্ত্রে লেখে না। আবার সম্প্রতি শহরে কয়েকটা ডাকাতি হইয়া গিয়াছিল। রামতনুর উদ্যত ঘুষির নিম্ন হইতে তড়িতের ন্যায় সরিয়া গিয়া মাঝরাস্তায় বৃষ্টি মাথায় করিয়া রামটহলবা আর্তস্বরে ডাকিয়া উঠিল, “খুন ভইল, দৌড় হো, ডাকু পড়ল বা।”

রামতনু প্রমাদ গণিল। মুহূর্তের মধ্যে নামিয়া পড়িয়া প্রেম ভুলিয়া প্রাণপণে ছুটিল। সামনেই একটা গলি দেখিতে পাইয়া তাহার মধ্যে ঢুকিয়া পড়িল এবং এ গলি সে গলি করিয়া একেবারে হেদোর সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল। হাঁপাইতে লাগিল, যেন বুকের পাঁজরা কয়টা ছিটকাইয়া বাহির হইয়া যাইবে।

কিন্তু তখনও তাহার স্বস্তি নাই। সামনে দিয়া মন্থর গতিতে একটা ঘোড়ার গাড়ি যাইতেছিল। একবার চারিদিক চাহিয়া গাড়োয়ানকে সে জিজ্ঞাসা করিল, “মেছোবাজার যাবি?”

রামতনুর বস্ত্রের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া গাড়োয়ান বলিল, “না বাবু, গদি ভিজে যাবে।”

“আমি দাঁড়িয়ে যাবো বাবা, গদি ভিজলে তুই দাম পাবি।”

“ডবল ভাড়া লিব বাবু, দেখছেন না কি রকম বাদল আছে?”

“বাদল না হ’লে আর এইটুকুর জন্যে গাড়ি করি? তা ডবল ডবলই সই। কত হবে?”

“দেড় টাকা দিবেন বাবু; আপনি ভদ্রলোক বড় কষ্টে পড়েছেন, কি আর বোলব?”

নিরুপায়ভাবে গাড়িতে চড়িতে চড়িতে রামতনু বলিল, “চার আনার ডবল কি দেড় টাকা হয় বাপু? তা চল্, তোর ধর্ম তোতেই আছে, একটু জোরে হাঁকাস।”

গাড়ি চড়িবার মিনিট দুয়েকের মধ্যে বৃষ্টিটা হঠাৎ ধরিয়া গেল। বিধিরও এই কঠোর বিদ্রূপ দেখিয়া রামতনুর মনে হইল, গাড়ির দেওয়ালে মাথা ঠুকিয়া মরে।

নামিয়া একটা দোকান হইতে পাঁচ গ্রেন কুইনাইন কিনিয়া লইয়া হোটেলে ঢুকিল। তাহার পর ট্রাঙ্ক খুলিয়া গাড়োয়ানের জন্য দেড় টাকা বাহির করিয়া লইল। তখন কেবল একটি এক টাকার নোট ও বিকশিতদন্ত বিদ্রূপের মত একটি টাকা ট্রাঙ্কের মাঝখানে পড়িয়া রহিল।

পর দিবস বেলা আন্দাজ চারিটার সময় রামতনু বিছানার উপর অলসভাবে শুইয়া জানালার মধ্য দিয়া আকাশপানে চাহিয়া ছিল। মেঘ ছিল না বলিলেও মিথ্যা বলা হয় না, তবুও ঘরপোড়া গরু যেমন সিঁদুরে মেঘে ডরায়, সেইরূপ যা দুই-এক খণ্ড মেঘ এদিক- ওদিক করিয়া বেড়াইতেছিল, তাহা দেখিয়া রামতনুর যথেষ্ট আতঙ্ক উপস্থিত হইয়াছিল এবং আশু বিবাহের আশা দিয়াও তাহাকে শ্যামবাজারে পাঠাইতে পারা যাইত না। সে ভাবিতেছিল, মেঘের নামগন্ধ না মুছিয়া গেলে সে আর পাদমপি নড়িতেছে না। এমন পয়সাও নাই যে, গাড়ি করিয়া যাইবে। আর যাইলেও যে তাহাকে কেন্দ্র করিয়া মস্ত বড় ভিড় দাঁড়াইয়া যাইবে না, তাহারই বা নিশ্চয়তা কি? বেটা উজবুক চাকরটা সব কাঁচাইয়া দিল।

মেসে একটা লোক খবরের কাগজ দিত, সে দেখা দিল। তাহাকে নিজের ঘরে ডাকিয়া রামতনু কাগজটা লইল। হাতে কোনও কাজ নাই, একটা কাগজের দামও বেশি নয়, রামতনু জিজ্ঞাসা করিল, “কোনও বাংলা কাগজ রাখিস?”

লোকটা সোৎসাহে একখানা ‘নায়ক’ বাহির করিয়া বলিল, “এই নিন বাবু, এ রকম গালাগাল পাঁচকড়িবাবু অনেক দিন দেন নি; প্রাণ খুলে লাট সায়েবকে নিয়েছেন একচোট।”

রামতনু হাসিয়া কাগজখানা লইল, তাহাকে দাম চুকাইয়া দিল এবং বুকে বালিশটা চাপিয়া কাগজটা বিছানায় মেলিয়া পড়িতে লাগিল।

পড়িবে কি? প্রথমেই বড় বড় অক্ষরে ছাপা হেডিংগুলায় নজর পড়ায় তাহার আক্কেল গুড়ুম হইয়া গেল—”দিনে ডাকাতি! মাঝ শহরে ভীষণ কাণ্ড!!” নিম্নবর্তী দুইটি অনতিক্ষুদ্র প্যারাগ্রাফে লেখা আছে—”গতকল্য বেলা আন্দাজ ৪। ঘটিকার সময় ১৪নং বিপ্রদাস লেন শ্রীযুক্ত বাবু সারদাপ্রসাদ দত্তের ভবনে একটি লোমহর্ষণ ডাকাতির উপক্রম হইয়া গিয়াছে। মুষলধারায় অশ্রান্ত বৃষ্টি হইতেছিল বলিয়া গলিতে লোক চলাচল বন্ধ ছিল এবং আশেপাশে বাড়িগুলিরও দুয়ার-জানালা প্রায় সব রুদ্ধ ছিল। সারদাবাবু সপরিবারে কালীঘাট দেবীদর্শনে গিয়াছিলেন। বাড়িতে ছিল মাত্র একটি পশ্চিমা চাকর! এই সময় সুযোগ বুঝিয়া একটি ভদ্রবেশী যুবা ভিজিতে ভিজিতে আসিয়া বারান্দায় উঠে এবং প্রথমে সোজা কথায় একখানি শুষ্ক বস্ত্ৰ চাহিয়া আলাপ জমাইবার চেষ্টা করে এবং তাহাতেও কৃতকার্য না হইয়া একখানি কার্ড হাতে দিয়া বলে যে, সে তাহার প্রভুর আত্মীয়। চাকরটা ইহাতে ক্রুদ্ধ হইয়া কার্ডটা ছিঁড়িয়া ফেলে এবং তাহাকে অর্ধচন্দ্রদানে নিষ্ক্রান্ত করিবার প্রয়াস করে। ইহাতে দুর্বৃত্ত জামার মধ্য হইতে একখানা ভোজালি বাহির করিয়া তাহাকে আক্রমণ করে। তখন ভৃত্যটা রাস্তায় পড়িয়া চিৎকার করিয়া লোক জড়ো করে। ইত্যবসরে ভদ্রবেশধারী গুণ্ডাটি চম্পট দেয়, এবং ঠিক এইসময় গলির বাহিরে সদর রাস্তা দিয়া একটি মোটরকে ঊর্ধ্বশ্বাসে বৃষ্টির মধ্য দিয়া ছুটিয়া যাইতে দেখা যায়। পুলিসের তদন্ত চলিতেছে।

“দ্বিখণ্ডিত কার্ডের অর্ধেকটা মাত্র পাওয়া গিয়াছে। সেটার লেখাটুকুও নাকি জল পড়িয়া এমনই অস্পষ্ট হইয়া গিয়াছে যে, কিছুই নিরূপিত হয় না। আমাদের লালপাগড়ি ভায়ারা বোধ করি ভাবিতেছেন, লেখাটা পড়া গেলে ব্যাপারটার একটা কিনারা হয়। এমন না হইলে আর বুদ্ধি! আমরা বলি, তত মাথা না ঘামাইয়া, বিজ্ঞাপন দিয়া ঠিকানাটা ডাকাতের নিকট হইতে আনাইয়া লওয়া হউক না।”

রামতনুর সর্বাঙ্গে কাঁটা দিয়া উঠিল। কি সর্বনাশ! সে একজন ফেরারী আসামী! তাহাকে লইয়া শহরময় হৈ-চৈ পড়িয়া গিয়াছে! ঘামে তাহার বুকের বালিশ ভিজিয়া গেল এবং তাহার মনে হইতে লাগিল, যেন মাথার মধ্যে একটা গুবরে পোকা ঢুকিয়া ভোঁ ভোঁ করিয়া চক্র দিতেছে। ক্রমে পারিপার্শ্বিক জিনিসগুলার ধারণা যেন তাহার এলোমেলো হইয়া আসিতে লাগিল।

মিনিট পাঁচেক পরে সে অতি কষ্টে নিজেকে একটু সামলাইয়া লইল। বাহিরে গিয়া বেশ করিয়া মাথাটা ধুইয়া ফেলিল। লোকটা সাধারণত দেব-দেবী মানিত না, কিন্তু হঠাৎ তাহার তেত্রিশ কোটির উপরই দৃঢ় বিশ্বাস জন্মিয়া গেল, এবং যাঁহারা বিশিষ্ট, তাঁহাদের মধ্যে যিনি যাহা পছন্দ করেন, তাঁহার জন্য সেই দ্রব্য প্রচুর পরিমাণে মানত করিয়া বসিল। আবার ভিতরে আসিয়া কাগজটা আর একবার পড়িয়া তাড়াতাড়ি ভাঁজ করিয়া ফেলিল। তাহাতেও তাহার মন যেন মানিল না। খবরটা শহরের অনেকে পড়িয়াছে এবং পড়িতেছে, কিন্তু তাহার ভীতি এই কাগজখানিতে এমন সংবদ্ধ হইয়া পড়িল যে, সে যেন ইহা লোকচক্ষুর অন্তরালে রাখিলেই বাঁচে। তাহার ঘরে এই খবরটা তাহার কেনা এই কাগজে কেহ পড়িলে যেন তাহার গ্রেপ্তার না হইয়াই যায় না।

রামতনু এদিক-ওদিক দেখিয়া ভাঁজ-করা কাগজখানা বিছানার নীচে একেবারে মাঝখানে গুঁজিয়া দিল। জানালা দিয়া কাগজখানা রাস্তায় ফেলিয়া দেওয়াও তাহার নিরাপদ বোধ হইল না।

তাহার পর মাথায় হাত দিয়া ভাবিতে লাগিল, এখন পুলিসের হাত হইতে বাঁচিবার উপায় কি? মাতৃবাক্য ঠেলিয়া একেবারে অশ্লেষা-মঘা মাথায় করিয়া আসিয়া কি অঘটনটাই ঘটিল! যাহাকে উদ্দেশ্য করিয়া আসা, তাহার মুখ তো এখনও দেখা গেল না; ভবিষ্যতে যদি দেখা হয় তো পুলিস পরিবৃত হইয়া—কল্পনাতেও প্রেমের নেশা ছুটিয়া গায়ে কাঁটা দিয়া উঠে। সে মুখ দেখাইবার বদলে এখন ভগবান যদি তাহার নিজের মুখ লুকাইবার একটু সুযোগ করিয়া দেন তো হাঁপ ছাড়িয়া বাঁচে। ধর, শেষ পর্যন্ত জেলে না হয় নাই যাইতে হইল, কিন্তু এই কুটুম্ব-সাক্ষাৎ লইয়া কি কেলেঙ্কারিই না হইবে! শেষে বাড়ি পর্যন্ত টান ধরিবে, তাহার প্রবঞ্চনা করিয়া চলিয়া আসার কথাও জাহির হইয়া পড়িবে এবং সে আসার উদ্দেশ্যও কাহারও অবিদিত থাকিবে না। হা ঈশ্বর, স্বপ্নে দেখাইয়াছিলে মধুর মিলন, আর বাস্তবে দাঁড় করাইলে কাঠগড়ায় দাঁড়াইয়া ডাকাতির দায়ের এজাহার! তবে আর ভক্ত-বৎসল তোমায় বলে কেন মিছামিছি?

নীচে ঠাকুরের সঙ্গে যেন একটি ভদ্রলোকের কথাবার্তার আওয়াজ শোনা গেল; তাহার পর সিঁড়িতে পায়ের শব্দ—রামতনু উৎকর্ণ হইয়া রহিল। শব্দটা যেন তাহারই ঘরের দিকে আসিতেছে; বিবশাঙ্গ রামতনু দরজার দিকে অপলক নেত্রে চাহিয়া রহিল।

ভদ্রলোকটি দরজার সামনে আসিয়া রামতনুকে নমস্কার করিলেন, তার পর ভিতরে প্রবেশ করিয়া বিনা বাক্যব্যয়ে চেয়ারখানায় বসিয়া বলিলেন, “মশায়—”

রামতনু ঠিক এতক্ষণে সাহস সঞ্চয় করিয়া বলিল, “মশায়—”

দুইজনের কথা একসঙ্গে বাহির হওয়ায় দুইজনেই একটু থতমত খাইয়া গেল। সামলাইয়া রামতনু কি বলিতে যাইতেছিল, তাহার আগেই ভদ্রলোকটি বলিলেন, “এখানে রাম—এই রাম—অর্থাৎ রাম-তারণ বলে কেউ থাকেন?”

রামতনু বুঝিল, এ সাক্ষাৎ ডিটেকটিভ, আর রক্ষা নাই। ঢোক গিলিয়া জড়িত স্বরে বলিল, “আজ্ঞে, কই, না।”

“থাকেন না? তাই তো—আচ্ছা, ধরুন, রামের সঙ্গে কিছু যোগ ক’রে—যেমন ধরুন—রাম—রাম—”

রামতনুর বক্ষে সজোরে ঢিপঢিপ করিয়া আওয়াজ হইতেছিল। সে ব্যস্তভাবে বলিল, “না না মশায়, ও-রকম নাম—রামায়ণ থেকে কোন নামই এ বাড়িতে নেই। আপনি বোধ হয় ভুল ঠিকানায় এসেছেন।”

লোকটি রামতনুর দিকে একটু অপ্রতিভভাবে চাহিলেন ও বলিলেন, “মশায় মাফ করবেন, আপনাকে বোধ হয় বিরক্ত করছি; আপনি অসুস্থও বোধ হচ্ছে, কিন্তু একটু হাঙ্গামায় পড়া গেছে।”—বলিয়া পকেটে হাত দিলেন এবং কোণাকোণি ছিন্ন একটা কার্ড বাহির করিয়া পড়িয়া বলিলেন, “আজ্ঞে না, ঠিকানা ঠিক এই, এই দেখুন না।”

রামতনু কার্ড দেখিবে কি, সব আঁধার দেখিতেছিল। এ সেই তাহারই কার্ড— রামটহলের হাতে ছেঁড়া। সে মন্ত্রমুগ্ধের মত কার্ডটার দিকে চাহিয়া রহিল, তাহার আর বাক্যস্ফূর্তি হইল না।

হঠাৎ লোকটি বলিলেন, “আচ্ছা, আপনি এখানে আছেন কদিন? সবাইকে চেনেন?”

রামতনুর নেশার মত ভাবটা ছাঁত করিয়া কাটিয়া গেল; সে মুখ তুলিয়া পাগলের মত ফ্যালফ্যাল করিয়া চাহিয়া রহিল।

লোকটিও ব্যাপারটা আন্দাজ করিতে পারিলেন না। নিজেকে সামলাইয়া বলিলেন, “না, আপনি রেস্ট নিন, আপনাকে জ্বালাতন ক’রে বড় অন্যায় করছি। আমি বোধ হয় ভুল ঘরে ঢুকেছি; কিন্তু অন্য ঘরগুলোও বন্ধ। তা আমি এই বইটা নিয়ে বসি। অন্যান্য ভদ্রলোকেরা এলে খোঁজ নোব।” তাহার পর তিনি চিন্তিতভাবে নিজের মনে মনেই বলিলেন, “কিংবা হতেও পারে নিজেই বোধ হয় ভুল বুঝেছি।”—বলিয়া বইখানার পাতা উল্টাইতে লগিলেন।

বলে কি? বসিয়া থাকিবে! রামতনুর মাথায় বাজ পড়িল। বিপদে বুদ্ধিবৃত্তিকে একটু গুছাইয়া লইয়া বলিল, “আজ্ঞে, ব’সে থেকে তো কোন ফল নেই; আমি এ মেসের সব্বাইকেই জানি। আজ চার বছর একটানা এখানে রয়েছি। আপনি মিছামিছি সময় নষ্ট করছেন।”

ভদ্রলোক উত্তর দিলেন না, শুধু চক্ষু কুঞ্চিত করিয়া বইয়ের এক জায়গায় কি যেন পড়িবার চেষ্টা করিতে লাগিলেন। তাহার পর সন্ধিগ্ধভাবে রামতনুর মুখের দিকে খানিকক্ষণ চাহিয়া হো হো করিয়া হাসিয়া উঠিলেন। বলিলেন, “তা থাকুন মশায় চার বছর, কিন্তু দু- মিনিটে আমি যা টের পেয়েছি, আপনি চার বছরে কেন পান নি, তা জানি না। অর্থাৎ রামতনু ব’লে এখানে কেউ আছেন, সম্ভবত এই মেসেই থাকেন, আর সম্ভবত আমার সামনেই ব’সে আছেন। দেখুন তো, এই বইখানা বোধ হয় আপনার।”—বলিয়া রামতনুর যেখানে নামটা লেখা ছিল, সেইখানটা টিপিয়া ধরিয়া তাহার সম্মুখে বইটা বাড়াইয়া ধরিলেন।

রামতনুর মুখটা ছাইয়ের মত ফ্যাকাশে হইয়া গেল। লোকটির হাতটা চাপিয়া ধরিয়া নিতান্ত মিনতির স্বরে কহিল, “মশায়, বাঁচান, কিছু দোষ নেই আমার, জেল থেকে-

“কিছু দোষ নেই, নিতান্ত বলা যায় না; কারণ মিছিমিছি আত্ম-গোপন করতে গিয়ে আমায় যা ভাবিয়েছেন, তাতে একটু দোষ হয়েছে বই কি। তবে তার জন্যে জেলে যেতে হবে না, এ গ্যারান্টি আমি দিতে পারি। তারপরে, ব্যাপারটা একটু খুলে বলুন তো।”

রামতনু ব্যাপারটা খুলিয়া বলিল না বটে, তবে কিছু কিছু বলিল; অর্থাৎ সারদাবাবুর সহিত তাহাদের কুটুম্বিতা কি প্রকারের আর সেই কুটুম্বিতাসূত্রে আলাপ করিবার প্রয়াসে ব্যাপারটা কিরূপ অহেতুকভাবে ঘোরালো হইয়া দাঁড়াইয়াছে—ইত্যাদি, ইত্যাদি। বেশির ভাগ গোপনই করিল—যেমন আসিবার মুখ্য উদ্দেশ্য কি, আসিল কত বাধাবিপত্তির মাঝে, আরও অনেক কথা।

ভদ্রলোকটির নাম অমিয়বাবু। তিনি বলিলেন, “হ্যাঁ, আমিও অনেক্টা এই ধরনের একটা হবে তা আন্দাজ করেছিলাম। চাকরটা যখন একটা কার্ডের টুকরো দেখিয়ে বললে, আবার আমায় কার্ড দিয়ে ভোলাতে এসেছিল, তখনই আমার মনে একটু খটকা লাগে; ভাবলুম, বাংলা দেশে ডাকাতির যুগটা এখনও সম্পূর্ণ যায়নি বটে, তবে চিঠিপত্র দিয়ে ডাকাতির যুগটা আর নেই। লুঠ করতে এসে ঠিকানা রেখে যাবে, এমন ডাকাতকে অতি- সাহসী অথবা অতি-বোকা বলতে হবে, তা এই সভ্যযুগে এই দুরকমের কোনটাই সম্ভব নয়।

“পুলিসরা কার্ডের খানিকটা পেয়ে বাকিটা খুঁজতে লাগল। দৈবক্রমে সেটা জলকাদা মাখা হয়ে আমার জুতোর পাশেই প’ড়ে ছিল, আমি জুতোর তলায় সেটা চেপে ধরলাম, এবং সুবিধেমত উঠিয়ে পকেটে পুরলাম। কার্ডের এই আধখানা নিয়ে আমি দুটো সিদ্ধান্ত খাড়া করলাম—প্রথমত, যদি খারাপ মতলবে কেউ এসে থাকে তো এটার কোন মূল্যই নেই; সে প্রকৃতপক্ষেই চাকরটার কাছে নিজের আত্মীয়তা প্রমাণ করতে গিয়েছিল একটা যা- তা ঠিকানা দিয়ে। আর যদি কোন জানিত লোক দেখা করতে এসে থাকে, তবে এটার যথেষ্টই দাম আছে। আমার নিজের আন্দাজ কাউকেও আর জানালাম না, ভাবলাম, একবার চুপিচুপি দেখা যাবে।

“ঠিকানাটা বুঝতে ততটা বেগ পেতে হয় নি; তবে নামটা সমস্ত পাওয়া গেল না। এই দেখুন না, আন্দাজে ‘রাম’-গোছের একটা কথা দাঁড় করানো যায়, বাস্, তার পরে ছেঁড়া। পুলিসের হাতে যেটুকু আছে, তাতে নামের যেটুকু ছিল—একেবারে জলকাদায় মুছে গেছে, নীচে খালি ‘লেন’ আর তার নীচে ‘ক্যালকাটা’ পড়া যায়।

“কিন্ত পুরো নামের অভাবটুকুই ব্যাপারটাকে খানিকটা রহস্য দিয়ে একটু জমাট ক’রে তোলে, আমার ডিটেক্‌টিভগিরি করার লোভটা বাড়িয়ে দেয়। একটু না থাকলে তো ব্যাপারটা এক রকম বৈচিত্র্যহীনই বলতে হয়।

“যা হোক, শেষে কিন্তু আপনি বড় দমিয়ে দিয়েছিলেন। আর আপনার এই বইখানি আমায় সাহায্য না করলে আমায় বড় অপ্রস্তুত হয়ে বাসায় ফিরতে হ’ত। আচ্ছা, আপনি কিন্তু এতটা বেগ দিলেন কেন? সত্যিই ডাকাতি করতে গিয়েছিলেন নাকি? তা হ’লে গেরস্থের কাছে ঠিকানা দিয়ে আসতে পারলেন, আর বাবার কাছে আত্মপরিচয় দেবার সময় সব সাহস লোপ পেল!”

ভদ্রলোকটি চেয়ারে হেলান দিয়া খুব হাসিতে লাগিলেন; রামতনু ক্ষীণভাবে তাহাতে একটু যোগ দিল। তাহার পর বিছানার ভিতর হইতে ‘নায়ক’খানা বাহির করিয়া বলিল, “পড়ুন এইখানা, তা হলেই শ্রাদ্ধ কতদূর গড়িয়েছে বুঝতে পারবেন! মশায়, মানুষ সাধু কি অসাধু, তা আর আজকাল তার নিজের কাজের ওপর নির্ভর করে না, নির্ভর করে এই সব খবরের কাগজগুলোর মতামতের ওপর।”

অমিয়বাবু উচ্চহাস্যে মধ্যে মধ্যে বিবরণটুকু পড়িয়া কাগজটা রাখিয়া দিলেন, বলিলেন, “বাহাদুরি তবে আমারই বেশি, একটা মস্তবড় ব্যাপারের কিনারা ক’রে ফেলেছি। কিন্তু আসল কথাটা যে চাপা পড়ে যাচ্ছে। নিন জামা-টামা পরে, ব্যাপারটা না জুড়তে পরিচয় হলেই ভাল, তাঁদের একেবারে অভিভূত ক’রে ফেলা যাবে। নিন, আমি ততক্ষণ একটা সিগারেট ধরাই।”

ভয়টা যখন সম্পূর্ণ তিরোহিত হইল, রামতনুর মনে আবার পূর্বের ভাবটা আত্মপ্ৰতিষ্ঠা লাভ করিয়া লইল। অমিয়বাবু তাহাকে বিপন্মুক্ত করিয়াছেন বটে, কিন্তু বিশেষ করিয়া তিনি তাহার বাঞ্ছিতার আত্মীয় বলিয়া সে সহজেই তাঁহার প্রতি আকৃষ্ট হইয়া পড়িল এবং তাঁহার আতিথ্যের জন্য ব্যস্ত হইয়া উঠিল। অমিয়বাবু যখন সিগারেট ধরাইতেছিলেন, রামতনু প্রচ্ছন্নভাবে একটা টাকা বাহির করিয়া নীচে নামিয়া গেল এবং ঠাকুরকে বাছা বাছা খাবার, এক বাক্স কাঁচি মার্কা সিগারেট ও পানের ফরমাশ দিয়া উপরে উঠিয়া আসিল। তাহার মনে হইতেছিল, হ্যাঁ, শেষ পর্যন্ত বিয়ের ফুলটা ফুটল তা হ’লে, ভগবান মুখ তুলে চাইলেন, ওঃ চাইতেই হবে, অধ্যবসায় ব’লে একটা জিনিস আছে তো! আর তিনিই শুধু আছেন ওসব দেবতা-টেবতা কিছু নয়।

ঘরে আসিয়া প্রফুল্লভাবে অমিয়বাবুকে বলিল, “তা নয় টাটকা-টাটকিই দেখাশোনা করা গেল; কিন্তু আগে থাকতে বাড়িতে কে কে আছেন জানা থাকলে পরিচয়ের বিশেষ সুবিধে হয়। অর্থাৎ নূতন পরিচয়ের আড়ষ্ট ভাবটা অনেকটা কেটে যায়। বিশেষ ক’রে আপনাকে ভাগ্যক্রমে পেয়ে আমি এ সুযোগটুকু ছাড়তে রাজী নই।”

রামতনু পূর্বে অবশ্য অনেকটা শুনিয়াছিল কিন্তু যাহাকে উদ্দেশ্য করিয়া আসা, তাহার সম্বন্ধে আলোচনার জন্য তাহার তৃষিত মনটা বড়ই ব্যগ্র হইয়া উঠিল—বিশেষ করিয়া তাহারই এই আত্মীয়ের সহিত।

অমিয়বাবু বলিলেন, “হ্যাঁ সে কথা মন্দ কি! তবে মেলা লোকের মধ্যে গিয়ে আপনাকে হাঁপিয়ে পড়তে হবে না—বাড়িতে ওঁদের আছেন মাত্র কর্তা স্বয়ং, আর এই গিয়ে একটি মেয়ে, মা আর একটি ছেলে, সে নেহাত ছেলেমানুষ ইস্কুলের নীচু ক্লাসে পড়ে।”

নিজের অন্তনির্দিষ্ট পথে আলোচনাটিকে লইয়া যাইবার জন্য রামতনু বলিল, “হ্যাঁ লেখাপড়ার কথায় মনে প’ড়ে গেল, সারদাবাবুর মেয়েটি তো খুব উচ্চশিক্ষিতা।”

“উচ্চশিক্ষিতা এখনও বলা যায় না, ম্যাট্রিকটা পাস করেছেন মাত্র; তবে হ্যাঁ, আরও পড়েন সবারই এই রকম ইচ্ছে।”—কথাগুলা অমিয়বাবু ঘাড়টা একটু নামাইয়া মৃদু হাসিয়া বলিলেন।

রামতনু বলিল, “যাই হোক, আমাদের মধ্যে এটুকুও বড় একটা পাওয়া যায় না, আলাপ ক’রে তৃপ্তি পাওয়া যাবে। তার ওপর আপনার সঙ্গে পরিচয়টা আগে থাকতেই হয়ে রইল। আপনার সঙ্গে ওঁদের খুব ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ ব’লে বোধ হচ্ছে যেন।”

অমিয়বাবু পূর্ববৎ হাসিয়া বলিলেন, “সম্বন্ধ কিছুই ছিল না, তবে কয়েক দিন থেকে হয়ে দাঁড়িয়েছে বটে, আর সেটা একটু ঘনিষ্ঠ বলতে হবে বইকি।”

রামতনু বিশেষ কিছু না বুঝিয়া, শুধু বাক্যের কৌশলটুকু লক্ষ্য করিয়া হাসিয়া বলিল, “কি রকম?”

“অর্থাৎ—ওর নাম কি—ওঁর সেই মেয়ের সঙ্গে সম্প্রতি আমার বিবাহ হয়েছে।” বলিয়া পূর্বের মত লজ্জিতভাবে হাসিতে হাসিতে অমিয়বাবু নির্বাপিত সিগারেটটা আবার ধরাইবার উদ্যোগ করিতে লাগিলেন; এবং ঠিক সেই সময়ে দরজার আড়াল হইতে উড়ে ঠাকুরটা বিজ্ঞের মত মুচকি হাসিয়া ইশারা করিয়া জানাইল, আতিথ্যের আয়োজন সব হাজির।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *