বিম্ববতী

                রূপকথা
   সযত্নে সাজিল রানী, বাঁধিল কবরী,
   নবঘনস্নিগ্ধবর্ণ নব নীলাম্বরী 
   পরিল অনেক সাধে। তার পরে ধীরে 
   গুপ্ত আবরণ খুলি আনিল বাহিরে 
   মায়াময় কনকদর্পণ। মন্ত্র পড়ি 
   শুধাইল তারে— কহ মোরে সত্য করি 
   সর্বশ্রেষ্ঠ রূপসী কে ধরায় বিরাজে। 
   ফুটিয়া উঠিল ধীরে মুকুরের মাঝে 
   মধুমাখা হাসি-আঁকা একখানি মুখ,
   দেখিয়া বিদারি গেল মহিষীর বুক— 
   রাজকন্যা বিম্ববতী সতিনের মেয়ে,
   ধরাতলে রূপসী সে সবাকার চেয়ে। 
 
   তার পরদিন রানী প্রবালের হার 
   পরিল গলায়। খুলি দিল কেশভার 
   আজানুচুম্বিত। গোলাপি অঞ্চলখানি,
   লজ্জার আভাস-সম, বক্ষে দিল টানি। 
   সুবর্ণমুকুর রাখি কোলের উপরে 
   শুধাইল মন্ত্র পড়ি— কহ সত্য করে 
   ধরামাঝে সব চেয়ে কে আজি রূপসী। 
   দর্পণে উঠিল ফুটে সেই মুখশশী। 
   কাঁপিয়া কহিল রানী, অগ্নিসম জ্বালা— 
   পরালেম তারে আমি বিষফুলমালা,
   তবু মরিল না জ্বলে সতিনের মেয়ে,
   ধরাতলে রূপসী সে সকলের চেয়ে! 
 
   তার পরদিনে— আবার রুধিল দ্বার 
   শয়নমন্দিরে। পরিল মুক্তার হার,
   ভালে সিন্দূরের টিপ, নয়নে কাজল,
   রক্তাম্বর পট্টবাস, সোনার আঁচল। 
   শুধাইল দর্পণেরে— কহ সত্য করি 
   ধরাতলে সব চেয়ে কে আজি সুন্দরী। 
   উজ্জ্বল কনকপটে ফুটিয়া উঠিল 
   সেই হাসিমাখা মুখ। হিংসায় লুটিল 
   রানী শয্যার উপরে। কহিল কাঁদিয়া— 
   বনে পাঠালেম তারে কঠিন বাঁধিয়া,
   এখনো সে মরিল না সতিনের মেয়ে,
   ধরাতলে রূপসী সে সবাকার চেয়ে! 
 
   তার পরদিনে— আবার সাজিল সুখে 
   নব অলংকারে; বিরচিল হাসিমুখে 
   কবরী নূতন ছাঁদে বাঁকাইয়া গ্রীবা,
   পরিল যতন করি নবরৌদ্রবিভা 
   নব পীতবাস। দর্পণ সম্মুখে ধরে 
   শুধাইল মন্ত্র পড়ি— সত্য কহ মোরে 
   ধরামাঝে সব চেয়ে কে আজি রূপসী। 
   সেই হাসি সেই মুখ উঠিল বিকশি 
   মোহন মুকুরে। রানী কহিল জ্বলিয়া— 
   বিষফল খাওয়ালেম তাহারে ছলিয়া,
   তবুও সে মরিল না সতিনের মেয়ে,
   ধরাতলে রূপসী সে সকলের চেয়ে! 
 
   তার পরদিনে রানী কনক রতনে 
   খচিত করিল তনু অনেক যতনে। 
   দর্পণেরে শুধাইল বহু দর্পভরে— 
   সর্বশ্রেষ্ঠ রূপ কার বল্‌ সত্য করে। 
   দুইটি সুন্দর মুখ দেখা দিল হাসি— 
   রাজপুত্র রাজকন্যা দোঁহে পাশাপাশি 
   বিবাহের বেশে। অঙ্গে অঙ্গে শিরা যত 
   রানীরে দংশিল যেন বৃশ্চিকের মতো। 
   চীৎকারি কহিল রানী কর হানি বুকে 
   মরিতে দেখেছি তারে আপন সম্মুখে 
   কার প্রেমে বাঁচিল সে সতিনের মেয়ে,
   ধরাতলে রূপসী সে সকলের চেয়ে! 
 
   ঘষিতে লাগিল রানী কনকমুকুর 
   বালু দিয়ে— প্রতিবিম্ব না হইল দূর। 
   মসী লেপি দিল তবু ছবি ঢাকিল না। 
   অগ্নি দিল তবুও তো গলিল না সোনা। 
   আছাড়ি ফেলিল ভূমে প্রাণপণ বলে,
   ভাঙিল না সে মায়া-দর্পণ। ভূমিতলে 
   চকিতে পড়িল রানী, টুটি গেল প্রাণ— 
   সর্বাঙ্গে হীরকমণি অগ্নির সমান 
   লাগিল জ্বলিতে। ভূমে পড়ি তারি পাশে 
   কনকদর্পণে দুটি হাসিমুখ হাসে। 
   বিম্ববতী, মহিষীর সতিনের মেয়ে 
   ধরাতলে রূপসী সে সকলের চেয়ে। 
Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *