বিমলবাবু এবং আবার চাঁদুবাবু
আমার যে সব জঙ্গলের সঙ্গীদের কথা আগে লিখেছিলাম তাঁদের মধ্যে, আগেই লিখেছি, অনেকেই আজ নেই। এ বি কাকু (ইস্ট ইন্ডিয়া আর্মস—এর অনন্ত বিশ্বাস) আগের লেখাতেও ছিলেন। কিন্তু মাস তিনেক আগে হঠাৎ হার্ট—অ্যাটাকে চলে গেলেন।
কটকের চাঁদুবাবু (বাখরাবাদের সমরেন্দ্র দে) এবং অঙ্গুলের সিমলিপাড়ার বিমলবাবু (বিমলচন্দ্র ঘোষ) দুজনেই খুবই অসুস্থ। চাঁদুবাবু মোটর সাইকেল থেকে পথে পড়ে গিয়ে মাথাতে চোট লেগে অনেকদিন হাসপাতালে ছিলেন। সম্প্রতি বাড়িতে ফিরেছেন। বিমলবাবু সেরিব্রাল স্ট্রোক হয়েছিল। উনিও বেশ কিছুদিন কটকের হাসপাতালে থেকে অঙ্গুলে ফিরেছেন নিজের বাড়িতে, অল্প ক’দিন হল।
গত মাসের গোড়াতে পুরীতে গিয়েছিলাম স্ত্রী—কন্যাকে নিয়ে। তখন একটি গাড়ি নিয়ে চাঁদুবাবুকে দেখতে গেছিলাম কটকে। তাও অনেক ঘুরপাক খেয়ে। চাঁদুবাবুদের বাখরাবাদ কাঠজুরি নদীর পাশে কিন্তু স্মৃতিভ্রংশ হয়ে চলে গেছিলাম মহানদীর ধারে।
দেখা হল। আগের থেকে অনেক ভাল আছেন। তবে নড়বড়ে হয়ে গেছেন। বিমলবাবুকে কিছুতেই ধরতে পারলাম না। গত সপ্তাহে উনি ফোন করে আমাকে বললেন যে, যে সময়ে ওঁর খোঁজ করেছিলাম তখন উনি কটকের হাসপাতালে ছিলেন। যাই হোক, শুনে আশ্বস্ত হলাম যে মোটামুটি সুস্থ হয়ে ফিরেছেন। তবে চাঁদুবাবু এবং বিমলবাবু কেউই পুরো সুস্থ হননি।
আমরা যে—বয়সে, যে সময় কাটিয়েছি ওড়িশার বিভিন্ন প্রান্তের বনে পাহাড়ে সে আর ফিরে আসবে না। সেই সব স্মৃতি কিছু লেখা আছে আনন্দর ‘বনজ্যোৎস্নায়, সবুজ অন্ধকারে’র প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ডে। আবার অনেক কিছু লেখা নেইও।
বিমলবাবু একজন ছোট্টখাট্টো রোগা—পটকা কালো—কালো মানুষ। চাঁদুবাবুর চেহারা আফ্রিকার কালো সিংহের মতো। পঞ্চাশ ইঞ্চি বুকের ছাতি। দুটি পাকানো ছুঁচল গোঁফ এবং দুটি মরকতমণির মতো লাল বড় বড় চোখ। মুখে সব সময়েই একটি দুষ্টু হাসি। দেখে মনে হয় সব সময়েই নেশা করে আছেন। অথচ নেশা তিনি করতেন ক্বচিৎ—কদাচিৎ। ওই বয়সে আমরা কেউই নেশা করতাম না। আমিও জীবনে প্রথমবার বিয়ার খেয়েছি ত্রিশ বছর বয়সে।
চাঁদুবাবুর পরনে জলপাই সবুজ শিকারির পোশাক, কোমরে চামড়ার চওড়া বেল্ট, পায়ে শিকারের বুট, চামড়ার অথবা কাপড়ের, আর পিঠে স্প্রিং—এ ঝোলানো ১২ বোরের দোনলা বন্দুক, ত্রিশ ইঞ্চি ব্যারেলের।
বিমলবাবুর পরনে জিনসের রঙিন সস্তা প্যান্ট, গ্রীষ্মে এবং শীতেও সুতির হাফ—শার্ট। শীতে তার ওপরে একটি বাড়িতে বোনা হাফ—হাতা সোয়েটার। পায়ে চামড়ার সস্তা চটি এবং হাতে বাঁশের একটি ছোট লাঠি, আর্মির অফিসারেরা যেমন সাইজের চামড়া—মোড়া বেটন নিয়ে চলেন। চালিয়াতি বলতে, রোদ থেকে বাঁচার জন্যে চশমার ওপরে একটি রঙিন কাচ, যা খুলে রাখা যেত। ওই পোশাকে এবং পাদুকাতে বিমলবাবু করাতিদের সঙ্গে হরিণের মতো ক্ষিপ্রতাতে মাইলের পর মাইল উঁচু—নিচু পাহাড়ি পথে সকাল—বিকেল যাতায়াত করতেন। যে সব বনে রাইফেল হাতে দিনের বেলাতে যেতেও আমার মতো শহুরে শিকারি ও বনপ্রেমীর গা—ছমছম করত, যে—সব পথে দিনের বেলাতেও প্রাচীন নানা মহীরুহর পাতার চাঁদোয়া ভেদ করে সূর্যের আলো পড়ত না, সেই সব বনে হাতি, গাউর, বুনো মোষ, বড় বাঘ, চিতা, বুনো কুকুর, নীলগাই, শম্বর, শুয়োর, ভালুক, মৃগ, নানা জাতের বড় বড় এবং অতি ছোট সাপ গিসগিস করত। সেই পথে বিমলবাবু দেড় হাত সমান বাঁশের লাঠিটি নিয়ে অবলীলায় ঘুরে বেড়াতেন দিনে এবং তেমন প্রয়োজনে রাতেও। কাজের তদারকি করতে। বড়ই গরিব, গেরুয়া ধুতি—পরিহিত, নগ্নগাত্র করাতিদের প্রতি এক গভীর সমব্যথা ছিল বিমলবাবুর।
পৌষের শেষ। বাঘ্বমুন্ডা বাংলোর চওড়া বারান্দাতে ডেক চেয়ারে বসে আছি আমি। সকাল থেকে বিকেল চারটে অবধি হাঁকা হয়েছে বাঘের জন্যে। দুর্গা এবং নারাণের কাছে খবর ছিল বাঘের। কিন্তু বাঘ বেরোয়নি। হাঁকার সময়ে আমরা মাটিতেই বসেছিলাম বড় গাছেদের আড়ালে, আলাদা আলাদা। একদল হাতি বেরিয়েছিল, দুটি অতিকায় গাউরও। ওড়িয়া ভাষাতে গাউর বা ভারতীয় বাইসনকে বলে গল্ব। আর বেরিয়েছিল বন—শুয়োরের একটি বিরাট দল। তাতে প্রকাণ্ড বড় দু—তিনটি শুয়োর ছিল। প্রায় পনেরো—কুড়ি ইঞ্চি বাঁকানো দাঁত। শুয়োরকে ওড়িয়াতে বলে ‘বারা’। সবচেয়ে বড় শুয়োরটিকে আমার ৪৫০/৪০০ ডাবল ব্যারেল রাইফেল দিয়ে গুলি করি ঘাড়ের কাছে। সঙ্গে সঙ্গে পড়ে গিয়ে চরকিবাজির মতো মাটি ছিটোতে ছিটোতে স্বল্পক্ষণ ঘুরে সে থিতু হয়। দুর্গাদের কী আনন্দ! ভারতের সব বন—পাহাড়েই জংলি মানুষের শুয়োরের মাংস আর দেশি মদ লাগে। এই সব অঞ্চলে মহুয়া ও হাঁড়িয়া ছাড়াও নানারকম ফুল ও ফল দিয়ে নানারকম মদ তৈরি হয়। যেমন, পানমৌরী।
আমি বাংলোতে ফিরে এসেছি বিমলবাবু ও চাঁদুবাবুর সঙ্গে। ফুটুদাদা ছিলেন না। তিনি এ বি কাকুর সঙ্গে আমার নতুন অ্যাম্বাসাডর নিয়ে অঙ্গুলে গেছেন, ফরেস্ট অফিসে ডি এফ ও—র সঙ্গে দেখা করে শিকারের পারমিট রিনিউ করতে। অঙ্গুলের দোকান থেকে পোড়পিঠা (ছানা পোড়া) এবং পাঁঠার মাংস নিয়ে আসবেন। তাঁদেরও ফিরে আসার সময় হয়েছে। রাত নামলেই বাঘ্বমুণ্ডা হাতিদের রাজত্ব হয়ে যায়। বনের গভীরে বাংলোর পূর্ব—দক্ষিণে হাতিগির্জা পাহাড় আছে। এখানের হাতিরা ক্রিশ্চান কি না বলতে পারব না তবে এ কথা জানা ছিল যে বাঘ্বমুণ্ডার হাতিদের আড্ডা এই হাতিগির্জা পাহাড়ে। রাত নামলে ওরা মস্ত বড় বড় দলে ভাগ হয়ে চলে যায় পুরুনাকোটের দিকে। যেখানে বিস্তীর্ণ ধানখেতে পৌষের সোনালি ধান পেকে আছে। ছোট ছোট মাচা বেঁধে তার ওপরে কাঁথা অথবা কম্বল আর তেলচিটে ছোট বালিশে মাথা দিয়ে শোবে যদি সুযোগ হয়। অন্য সময়ে পায়খানা করার মতো বসে পেছনে মাটির সরাতে কাঠকয়লার আগুন রেখে বসে থাকবে সারারাত পুরুনাকোট গ্রামের লোকেরা। আর হাতিরা এক ক্যানেস্তারা বাজাবে, শিঙে ফুঁকবে, ঘণ্টা বাজাবে। ওরা ওদের কর্তব্য করবে। কেউ কেউ আছাড়ি পটকা ফোটাবে আর তাতে বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে হাতিরা রাতারাতি তাদের অনেক কষ্টের ফসল নিঃশেষ করে দেবে।
যারা বলশালী তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অন্যের সুখসুবিধা সম্বন্ধে অন্ধ হয়। ন্যায়—অন্যায় বোধও তাদের থাকে না। দুর্বলকে এবং যারা প্রতিবাদী তাদের শারীরিক অথবা আর্থিক অথবা অন্য শক্তি দিয়ে পিষে দেওয়াটাই তাদের একমাত্র আনন্দ। হাতিই হোক কী হস্তিসদৃশ কিছু কিছু হস্তিমূর্খ মানুষই হোক, তারা একই জাতের।
ওড়িশার অঙ্গুল ফরেস্ট ডিভিশনের বাঘ্বমুণ্ডা, পুরুনাকোট, টুম্বকা, লবঙ্গী, টিকিয়াপাড়া ইত্যাদি সমস্ত বনই আজ ‘সাতকোশীয়া গণ্ড’। তার দু’পাশেই অগণ্য মাথা উঁচু পাহাড় আর আদিম বনভূমি ছিল যে সময়ের কথা বলছি, প্রায় অর্ধশতাব্দী আগের সেই সময়ে। আর সেখানে বন্যপ্রাণীও ছিল প্রচুর। মহানদীতে কুমির ও ঘড়িয়াল ছিল অনেক আর ছিল বিরাট বিরাট লাল আঁশের মহাশোল মাছ। সেই মাছেদের নাকে নোলক থাকত আর স্বাদ যা ছিল তা বলার নয়। আসামের ব্রহ্মপুত্রর মহাশোলও বিরাট বিরাট হয়, লালরঙা। তবে তাদের নাকে নোলক থাকে না। কেন? তা বলতে পারব না। আমরা সাতকোশীয়া গণ্ডার দু’পারের যে জঙ্গলেই থাকি না কেন, বিশেষ করে সঙ্গে বাবা থাকলে, জিপ পাঠিয়ে টিকরপাড়া থেকে সেই মাছ কিনে আনা হতই।
টিকরপাড়াতে ঘাটের ডান দিকে ঘাসিয়ানীদের বস্তি ছিল। তাদের জীবিকা সম্ভবত ছিল মাছ ধরা। ঘোর সন্ধে নামলে তাদের মেয়েরা সাজুগুজু করে মুখে নিম বা কনৌজের তেল মেখে কাজল পরে চুলে লাল—নীল রিবন বেঁধে ঘাটের পাশে দাঁড়িয়ে থাকত। তারা ছিল সব দেহপসারিণী। চব্বিশ—পঁচিশ বছর বয়সে ঔৎসুক্য ছিল প্রবল কিন্তু ভয়ও ছিল সমান। তা ছাড়া বাবা ও তাঁদের বন্ধুবান্ধবরাও সঙ্গে থাকতেন অনেক সময়েই। এ বি কাকু ও ফুটুদাদারা আমার বন্ধু হলেও বয়সে বড় তো ছিলেনই। এবং ছিলেন অত্যন্তই রক্ষণশীল এবং বেশ ভিতুও।
ওই ঘাটে এক গরমের রাতে আমরা জিপ লাগিয়ে গাছতলাতে আছি। চাঁদুবাবু জিপের বনেটের ওপরে শুয়ে একটু বেশি হাওয়া খাওয়ার চেষ্টা করছেন, আমরা জিপের মধ্যেই আধশোয়া হয়ে আছি। টিকরপাড়ার ঘাটে পৌঁছতে পৌঁছতে সন্ধে হয়ে গেছিল—খেয়া নৌকো চলাচলও বন্ধ। বাস, ট্রাক, গাড়ি, জিপ সব খেয়াতেই নদী পেরোত। নদীর ওপারে দশপাল্লা, বৌধ, উঁচু পাহাড়ের ওপর ফুলবনী। আমরা যাব দশপাল্লার পথে, টাকরাতে। ওই নামের একটি সুন্দর নদীর পারের গ্রামে। সেখানে একবেলা বিশ্রাম করে চড়ব খুব উঁচু পাহাড় বিরিগড়ে, যেখানে ফুটুদাদাদের নতুন জঙ্গল। বিরিগড় খন্দমাল—এ; যেখানে আদিবাসী খন্দদের বাস। যাদের পূর্বপুরুষরা মেঘে করে এসে উঁচু পাহাড়ে নেমে বসতি স্থাপন করেছিল। তাদের রূপকথা তাই—ই বলে। যাঁরা আমার উপন্যাস ‘পারিধী’ এবং ‘লবঙ্গীর জঙ্গলে’ পড়েছেন তাঁরা এসব জায়গার ও মানুষদের কথা জানাবেন। ‘পারিধী’ একটি খন্দ শব্দ। মানে, মৃগয়া। বইটি দে’জ থেকে প্রকাশিত হওয়ার পরে অনেকেই বলতেন অশিক্ষিত বুদ্ধদেব গুহ ‘পরিধি’ শব্দের বানান জানেন না।
আমি যে নিপাট অশিক্ষিত সে বিষয়ে আমার নিজের কোনওই সন্দেহ নেই তবে আমি পণ্ডিত বৈয়াকরণ কোনওদিনই হতে চাইনি। সামান্য লেখকই হতে চেয়েছিলাম।
বলছিলাম এক কথা আর এসে গেলাম অন্য কথাতে।
মাহিন্দ্রর জিপ, খোলামেলা, জিপের ত্রিপলের ছাদও নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। সকলেই গরমে হাঁসফাঁস করছি, ঘুম কারওই আসছে না, এমন সময়ে একটা খোঁড়া লোক আস্তে আস্তে চাঁদুবাবুর কাছে এসে বলল, ‘বাবু! এ বাবু!
বিরক্ত হয়ে চাঁদুবাবু বললেন, কন? কহুছি কন?
বড্ড বড্ড মাই শম্বর মারিবে? আপ্পানমানে সব শিকারি আসিলানি।
চাঁদুবাবু তড়াক করে উঠে বসে তার দিকে বন্দুক বাগিয়ে বললেন, ষড়া, বেধূয়াত মৃতস্মে মারি পকাইবি।
সে কথা শুনে খোঁড়া মানুষটি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে দৌড়ে ঘাসিয়ানী বস্তির দিকে চলে গেল।
ওড়িয়াতে ফেমিনিন জেন্ডার বোঝাতে বলে ‘মাই’। মাই শম্বর, মাই মৃগ এরকম। তবে লোকটা আসল শম্বরের বার্তা নিয়ে আসেনি— ‘বড্ড বড্ড মাই শম্বর’ বলতে সে অন্য কিছু বুঝিয়েছিল?
আবার ফিরে যাই বাঘ্বমুণ্ডাতে। একতলা বাংলো। বাইরে চওড়া বারান্দা। আমি ডেকচেয়ারে বসে আছি পাতলে (পা তুলে বসার হাতল) পা তুলে। মাইল ছ—সাত হাঁটা হয়েছে হাঁকাতে। বেলা পড়ে গেছে। পশ্চিমের আকাশে সূর্য একটি লাল অগ্নিগোলক হয়ে বনের দিগন্তের ওপরে ফানুসের মতো ঝুলে আছে। আর দুটি ছোটকি ধনেশ (Lesser Indian Hornbill) নিস্তরঙ্গ পাখায় গ্লাইডিং করে ভাসতে ভাসতে পশ্চিমে চলে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, তারা সোজা গিয়ে সূর্যর মধ্যে সেঁধিয়ে যাবে।
এমন সময়ে লোকজনের গলা শোনা গেল। অতিকায় বারোটাকে বাঁশের সঙ্গে বেঁধে নিয়ে এসেছিল অনেকে মিলে। আমাকে দেখিয়ে ওরা বাংলোর পেছনে নিয়ে গেল একটি মস্ত মিটকুনিয়া গাছের তলাতে কাটাকুটি করবে বলে।
চাঁদুবাবু ঘরের ভেতরে গিয়ে শুয়ে পড়েছিলেন। দুর্গা মহান্তি এসে শুধোল, কন হেল্বা চাঁদুবাবু?
দেখিলানি? মো গোড়াটা ফুলি গল্বা।
হউ! টিক্কে লুম্ব আর গরম পানি দেইকি—সেঁক দেইলে ঠিক হই যীবু। এত্বে চিন্তার কন অচ্ছি?
চাঁদুবাবু বললেন, বারার দাঁত দুটো আমাকে আর লালাবাবুকে দিবি। মেরে দিস না।
আমি বারান্দা থেকেই বললাম, দাঁত দিয়ে কী করবেন?
চাবির রিং। ফার্স্টক্লাস চাবির রিং হবে। মোটা দিকটার মধ্যে দিয়ে ফুটো করে সরু পেতলের বা রুপোর চেন লাগিয়ে দেবে।
কে এসব করবে?
কে আবার? কলকাতার কার্থবার্টসন হার্পার। ওদের দিয়ে শুয়োরের চামড়াটাও ট্যান করিয়ে নেবেন।
শুয়োরের চামড়া ট্যান করা যায় নাকি? এ পর্যন্ত কত শুয়োর মেরেছি আসামে, বিহারে, ওড়িশাতে, পশ্চিমবঙ্গের নানা জায়গায় কোনও চামড়াই তো ট্যান করাইনি।
ছোটখাটো চামড়া ট্যান করিয়ে কী লাভ! এতবড় বারা তো দেখা যায় না সচরাচর। বড় বাঘও একে সমীহ করে চলত নিশ্চয়ই।
তারপর দুর্গা বলল, শুয়োরের মাংস খাবেন তো আপনারা?
নিশ্চয়ই খাব। স্বয়ং রামচন্দ্র বন্যবরাহ খেতেন। তা ছাড়া শুয়োরের চর্বির মতো নদনদে সুখ আর বেশি কি আছে!
আমাদের করা রান্নাই খাবেন? না নিজেদের জন্যে আলাদা রান্না করবেন?
দুর্গা বলল।
বললাম, চাঁদুবাবু, কখনও শুয়োরের ভিন্ডালু খেয়েছেন?
না। সেটা কী জিনিস?
তবে আজকে খাওয়াব আপনাকে।
চাঁদুবাবু দুর্গাকে বললেন, শুয়োর তোরা পরে রাঁধবি। আগে নারাণকে বল তো দুর্গা, আমাদের আদা দিয়ে দু কাপ চা বানিয়ে দেবে। আর বাথরুমে গরম জল দিতে বলবি। চা খেয়ে উঠে চান করব দুজনেই।
হ্যাঁ। চান করে উঠে তারপর ভিন্ডালু রাঁধব।
আমি বললাম।
সন্ধে নামলেই এই বাংলোর হাতাতেই মৃগ অর্থাৎ চিতল হরিণের ঝাঁক চলে আসবে চৌকিদারের লাগানো ফসল খেতে। তখন দুর্গা পাঁচ ব্যাটারির টর্চ হাতে করে বারান্দাতে নেচে নেচে বলবে, ‘ঠিয়া হইছে, ঠিয়া হইছে, মারন্তু।’ মানে, দাঁড়িয়ে আছে, দাঁড়িয়ে আছে, তাড়াতাড়ি মারুন লালাবাবু।
অমন করে ঘরে বসে অতিথি প্রাণী মারতে প্রাণ সরে না আমার। চাঁদুবাবুরও নয়। শিকার এক ধরনের স্পোর্ট। ঘুমন্ত বাঘ, বাংলোর হাতাতে ফসল খেতে আসা হরিণ মারাটা স্পোর্টসম্যানের কাজ নয়। শিকার শব্দটিই আজকাল ন্যক্কারজনক বলে গণ্য কিন্তু সমস্ত বড় বড় কনসার্ভেটররাই এক সময়ে শিকার করতেন। জিম করবেট, সালিম আলি, অ্যানন ও বব রাইট (বেলিন্ডা রাইটের মা ও বাবা)। বব ও অ্যান রাইট প্রতি শীতে আমাদের মক্কেল মুকুন্দলাল বিশ্বাস ও তাঁর ছেলে মোহন বিশ্বাসের অতিথি হয়ে পালামৌতে শিকারে যেতেন। অনেক সময়ে আমরা পাশাপাশি বাংলোতে থেকেও শিকার করেছি। অ্যান অনেক সময়ে তার এক অ্যাংলো ইন্ডিয়ান বন্ধু জন—এর সঙ্গেও আসতেন, কেস কেস জিন আর হুইস্কি নিয়ে। আমরা যে সময়ে পারমিট নিয়ে আইন মান্য করে শিকার করেছি তখন জানোয়ার ছিল প্রচুর এবং শিকার সত্যিই স্পোর্ট ছিল। আজকের ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা অগণ্য আর্ম—চেয়ার এন জি ও আইদের মতো না হলেও বন এবং সবরকম বন্যপ্রাণীদের প্রতি দরদ আমাদেরও কম ছিল না। চোরাশিকারিদের সঙ্গে সেই সময়েও আমাদের টক্কর দিতে হত। বিভিন্ন রাজ্যের জঙ্গলে অনেককে ধরে আমরা বনবিভাগের আমলাদের হাতে তুলেও দিয়েছি।
দুর্গা মহান্তি যেহেতু বনের ঠিকাদারের মুঙ্গরি ছিল, গাছ বিশারদ ছিল সে। গাছই ছিল তার ধ্যানজ্ঞান, গাছই স্বপ্ন। একবার টুল্বকার জঙ্গলে এ বি কাকুর ভাইপো জয়ন্ত বিশ্বাস একটি প্রকাণ্ড গাউরকে গুলি করে। আমরা টুল্বকা থেকে পুরুনাকোটে ফুটুদাদের যে বাড়ি ছিল সেখানে ফিরে আসছিলাম একটি শর্ট—কাট পথ দিয়ে। আসতে আসতে পথে সন্ধে নামল। জয়ন্ত যখন গুলি করল গাউরটিকে তখন সবে সন্ধে নেমেছে। জিপের হেডলাইটের আলোতে গুলি করেছিল সে। সেই আহত গাউরের ভবলীলা সাঙ্গ করতে আমি আর চাঁদুবাবু জিপ থেকে নেমে তার দিকে এগোলাম। ততক্ষণে সে গুলি খেয়ে জঙ্গলের গভীরে চলে গেছে। দুর্গাও চলল আমাদের সঙ্গে হাতে একটি পাঁচ ব্যাটারির টর্চ নিয়ে।
এগিয়ে গিয়ে দেখি পাহাড়ের মতো গাউরটির কাঁধে জয়ন্তর পয়েন্ট থ্রি—সেভেন্টি ফাইভ রাইফেলের গুলি লেগেছে। আর ফোয়ারার মতো রক্ত ঝরছে ঝরঝর শব্দ করে। গাউর আমাদের দেশে হাতির পরেই সবচেয়ে বড় জানোয়ার। তার এক টুঁ—তে জিপ গড়িয়ে পড়ে পথপাশের খাদে। এই পুরুনাকোটেই আমি একটি রোগ বাইসন মেরেছিলাম প্রথমবার এ অঞ্চলে শিকারে এসে। সে, দুটি ফরেস্ট গার্ডকে মোটা সেগুন গাছের গুঁড়ির সঙ্গে চেপে ধরে শিং দিয়ে থেঁতলে দিয়েছিল। গাউর এমনিতেই ভীতিপ্রদ। তার ওপরে এ তো আহত গাউর। অন্ধকার হয়ে গেছে আর আমরা পায়ে হেঁটে গভীর জঙ্গলের মধ্যে আহত গাউরের মোকাবিলায় গিয়েছি। গাউর হাতিরই মতো দলের জানোয়ার। একা থাকলে বুঝতে হয় সে একরা বা রোগ (Rogue) যাই হোক, আমি যখন ফিসফিস করে দুর্গাকে বলছি আমার রাইফেলের নলের ওপরে আলো ফেলতে, যাতে ব্যারেলের ফ্রন্ট সাইট ও বিয়ার সাইট দেখে নির্ভুল নিশানায় গুলি করতে পারি, সে হঠাৎই তার টর্চের আলো বাঁ পাশের একটি প্রকাণ্ড বড় সেগুন গাছের ডালে ফেলে ভীষণ উত্তেজিত হয়ে গলা চড়িয়ে বলল বাবু। বাবু! সে গাছুটা দেখিলে।
রাগে, মনে হচ্ছিল তাকেই গুলি করি। যে—কোনও মুহূর্তে গাউরের শিংয়ে আমরা মণ্ড হয়ে যেতে পারি আর সেই অকুস্থলে এবং অসময়ে তার এই গাছপ্রীতি একেবারেই অসহ্য ঠেকেছিল। তার নিজের অবশ্য কোনও ধারণাই ছিল না আমরা কী বিপজ্জনক অবস্থাতে আছি। আমি শক্ত হাতে ওর হাত ধরে, বাঁ হাতে ওর টর্চের আলো ঘুরিয়ে আমার রাইফেলের ব্যারেলের ওপরে ফেলে গাউরের গলাতে গুলি করলাম। চাঁদুবাবুও তাঁর শটগান দিয়ে গুলি করলেন তার মাথাতে নির্ভুল নিশানাতে। রাতের বেলাতেও শটগানের মাছির ওপরে সামান্য আলো পড়লেই নিশানা নেওয়া যায়—অথচ রাইফেলের বিয়ার সাইট ও ফ্রন্ট সাইটে আলো না পড়লে নিশানাই করা যায় না। যাই হোক, কপালজোরে আমাদের দুজনের গুলিই জায়গামতো লাগাতে সেই বিশাল গাউর আন্ডারগ্রোথের ওপরে হুড়মুড়িয়ে পড়ল পাহাড়ের মতো।
এই সরলপ্রাণ মহামতি দুর্গা মহান্তির বাড়ি ছিল পুরুনাকোট থেকে লবঙ্গী যাওয়ার পথে পাহাড়ের মাঝবরাবর পম্পাশর নামের একটি ছোট্ট গ্রামে। সেখানে তার স্ত্রী আর দশ বছরের মেয়ে থাকত একা। ছুটিছাটায়, রজর সময়ে, রথের সময়ে, দুর্গাপুজোতে দুর্গা বাড়ি আসত। ওই নিবিড় বনের মধ্যে একটি যুবতী তার কিশোরী কন্যাকে নিয়ে এক হাতে চাষাবাদ করে হরিণের সঙ্গে, শজারুর সঙ্গে, শুয়োরের সঙ্গে এবং মাঝে মধ্যে আগন্তুক চিতা ও ভালুকের সঙ্গে, অগণ্য বিষধর ও নির্বিষ সাপেদের রাজত্বে নিরস্ত্র অবস্থাতে কী নিদারুণ জীবন সংগ্রামে নিয়োজিত থাকত যে ভাবলেই আমার হৃৎকম্প হত। তার স্ত্রী আর কন্যা যখন বনবাসে থাকত তখন দুর্গা মহান্তি তার বাবুদের কাঠের হিসেব রাখত। কোন কাঠ, কত কিউবিক ফিট, লরি করে কটকের কাঠপট্টিতে চালান যেত প্রতিদিন তার হিসেব রাখত ট্রানজিস্টারে কটক স্টেশন শুনতে শুনতে, ক্যাম্পের সামনে ধুনি জ্বালিয়ে।
আসলে বনবাস আমাদের কাছে যেমন ভয়ের ওদের কাছে ততটা ছিল না। বনের মধ্যেই ওদের জন্ম গ্রাম্য ধাইমার হাতে, বনের মধ্যেই রোগে অথবা গাছ চাপা পড়ে অথবা বন্য জন্তুর আক্রমণে ওদের মৃত্যু। এই নিয়তিতেই ওরা অভ্যস্ত ছিল।
এ এক আলাদা জগৎ। এই দারিদ্র এবং সাহসের বেশি তুলনা জানা নেই আমার। এ জগতের সঙ্গে আমাদের মধ্যে স্বল্পজনেরই পরিচয় থাকাতে এ জগৎ সম্বন্ধে আমাদের বিস্ময়ের অবধি নেই।
ওড়িয়া ভাষাতে বন কেটে যে আবাদ হয় তাকে বলে ‘তৈলা’। বিমলবাবু যে লাল মাটির পথটি পুরুনাকোট থেকে গভীর বাঁশবন এবং অন্যান্য বনের মধ্যে দিয়ে চলে গেছিল টিকরপাড়ার দিকে, সেই পথের ডানদিকে একটি বেশ বড় পাহাড়ি নালাকে পাশে পাশে নিয়ে। বেশ কয়েক ‘শুঁট’ জায়গা বনবিভাগ থেকে বন্দোবস্ত করে নিয়ে চাষাবাদ করতেন। নালাটির নাম ছিল বোষ্টম নালা।
একবার শীতে শিকারে গিয়ে আমরা পুরুনাকোটে নতুন পি ডব্লু ডি বাংলোতে উঠেছি। ফুটুদাদের বাড়িটি অব্যবহারে ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে জরাজীর্ণ হয়ে গেছিল এবং সেখানে মাত্র একটি ঘর ও একটি বারান্দা ছিল। রান্নাঘর ও পায়খানা ছিল বনের মধ্যে। জলের উৎস ছিল একটি মস্তবড় ঘোড়ানিমের নিচে পাতকুয়ো। তখন আমরা আর আগের মতো কষ্ট করতে পারি না—তাই। বাংলোতেই উঠেছি। বাংলোর পেছনে বয়ে—যাওয়া বোষ্টম নালার ঝরঝরানি শব্দ শোনা যায়। ওই নালাটিই বাঁক নিয়ে বয়ে গেছে বাঘ্বমুণ্ডার পাশ দিয়ে হাতিগির্জা পাহাড়ের দিকে। হাতিগির্জা এবং বাঘ্বমুণ্ডার হাতিরা ওই পথ বেয়েই রাত নামলে পুরুনাকোটের ধান খেতে আসে।
একদিন বিষণ্ণবদনে বিমলবাবু বললেন, কয়েক বছর পরে রিটায়ার করব। তাই ভেবেছিলাম তৈলাতে কিছু চাষাবাদ করতে পারলে সুবিধা হবে।
আমি বললাম, তা তো বিলক্ষণই হবে। তাছাড়া, আপনার ছেলেরা তো ইতিমধ্যেই কাঠের কারবারে নেমে পড়েছে।
বিমলবাবু বললেন, ওরা তো এখনও তেমন পাকা হয়নি। ব্যবসা করতে অনেক বুদ্ধি লাগে লালাবাবু। সময় লাগবে বুদ্ধি পাকতে ততদিনে যাদের বুদ্ধি ইতিমধ্যেই পেকেছে তারা ওদের পাকা ধানে মই দিয়ে দেবে। তারপরই বললেন, একটা উপকার যদি আপনি আর চাঁদুবাবু করতেন আমার।
চাঁদুবাবু বললেন, ওদিকের জঙ্গলে তো শুধুই হাতি আর গল্ব।
তা তো আছেই তবে জঙ্গলে তো কোনও জানোয়ারই বাঁধা থাকে না। এক এলাকাতে অন্যে ঢুকে পড়ে।
তারপর বললেন, বিকেল বিকেল আসবেন। খিচুড়ি আর ডিমভাজা রাঁধতে বলব শত্রুঘ্নকে। রাম—এর বোতলও আনানো আছে। রাম নাম করে খিচুড়ি খেয়ে মাচায় উঠে বারা নিধন করবেন। ব্যাটারা আসতে আসতে রাত দশটা—এগারোটা করে।
বিমলবাবু তৈলার দিকে। সেই দিনই বেলা পড়লে রওয়ানা হলাম আমি আর চাঁদুবাবু। আমরা যাচ্ছি বলে চাঁদুবাবু পুরুনাকোটের তৈলাতেই আছেন। ওঁর অঙ্গুল শহরের সিমলিপাড়ার বাড়িতে রাত—বিরেতে বিভিন্ন জঙ্গল থেকে গিয়ে কতবার যে গরম বিছানাতে লেপের তলাতে আশ্রয় পেয়েছি তার লেখাজোখা নেই। বিমলবাবুর স্ত্রীর হাতের রান্না চমৎকার ছিল। আর সকালের ব্রেকফাস্টে তিনি একটা চিঁড়েভাজা করে দিতেন আমাদের তার কোনও জবাব নেই। আজও মুখে লেগে আছে সেই স্বাদ। নারকোল কুচি, বাদামভাজা আরও কত কী পড়ত তার মধ্যে।
বউদি কয়েক বছর হল গত হয়েছেন।
তৈলাতে প্রায় পৌঁছেই গেছি হঠাৎ চাঁদুবাবু আমার হাত ধরে আমাকে আটকালেন। আমি লাল ধুলোর পথে দাঁড়িয়ে পড়লাম। পথের দু’ধারে বাঁশের ঝাড়। শীতের রুখু হাওয়াতে বাঁশবনে কটকটি আওয়াজ উঠছে। বেশ শীত শীত করছে। রাতে ভালো শীত পড়বে। এই পথের দু’পাশে অগণ্য লজ্জাবতীর ঝাড়। মনে পড়ে গেল ছেলেবেলাতে রংপুরে ডিমলার বাড়ির সামনের পাঠশালাতে পড়তে যাওয়ার সময়ে লজ্জাবতী লতাতে হাত ছুঁইয়ে দেখতাম তারা কেমন লজ্জাতে লাজিত হয়ে গেল।
চাঁদুবাবু এবং আমার দুজনের হাতেই আমাদের আগ্নেয়াস্ত্র ছিল। কিন্তু তার তলব করলেন না চাঁদুবাবু। বাঁশের একটা কঞ্চি ভেঙে নিয়ে পথের ঠিক মাঝখানে গিয়ে দাঁড়ালেন। দেখলাম, পথের মধ্যে একটি শুকনো খড় পড়ে আছে। চাঁদুবাবু সেই খড়টিকে কঞ্চি দিয়ে সরালেন। আর সরাতেই সেই খড়টি ইঞ্চি দুয়েক চওড়া হয়ে গিয়ে সোজা উঠে দাঁড়াল। তখন বুঝলাম যে সেটি একটি সাপ।
কঞ্চিটা দিয়ে চাঁদুবাবু তাকে মারতে চাইলেন। সে কোমরে আঘাত পেয়ে অনেকখানি উঁচু হয়ে ফণা তুলে ধরল।
অবাক হয়ে তাকিয়েছিলাম আমি।
সাপটি কোমর—ভাঙা অবস্থাতেই শরীরটাকে টেনে টেনে পথের ডানদিকের লজ্জাবতী লতার জঙ্গলে ঢুকে গেল।
চাঁদুবাবু বললেন, চলুন, এগনো যাক।
চাঁদুবাবুকে বললাম, ওটা কী সাপ?
—এ মহা বিষধর সাপ। এর নাম কাল্বখুন্টা। মানে, কান খুশকি।
—লাউডগা এবং আরও অন্যান্য সরু সাপ দেখেছি, কিন্তু এই কাল্বখুন্টা সাপের খবর তো জানতাম না। আর এত সরু! সত্যিই মনে হয়, একগাছা খড় পড়ে আছে।
—বিচিত্র এ পৃথিবীর কতটুকু জানি আমরা লালাবাবু।
বিমলবাবুর তৈলাতে দুটি ঘর। বাঁশের চাটাই ঘেরা, ওপরে খড়। একটিতে শোয়ার বন্দোবস্ত। একটি শাল কাঠের তক্তপোশ। তার ওপরে একটি তেলচিটে শতরঞ্চি আর ছোট ওয়াড়হীন বালিশ পাতা। পাশের ঘরে রান্না হয়, বীজ ও ফসল থাকে, যখন ফসল ওঠে। কুলিরা, যারা খেতে কাজ করে এবং যাদের বাড়ি দূরে, তারাও থাকে। অন্যরা কাজ সেরে হাতে কুপি নিয়ে এই গহন বনের মধ্যে দু—তিন ক্রোশ হেঁটে বাড়ি ফিরে গিয়ে রান্নাবাড়ি করে খায়। তৈলার একেবারে লাগোয়া বলে শীতে ঘর একেবারে ঠান্ডা এবং স্যাঁতসেঁতে হয়ে থাকে।
বিমলবাবুর রাঁধুনি—কাম—ম্যানেজার ভরত খিচুড়িটা জম্পেশ করে বেঁধেছিল, মধ্যে নানারকম সেদ্ধ দিয়ে। শিম, ফুলকপি, আলু, মুরগির ডিম (এ অঞ্চলে হাঁসের ডিম পাওয়া যায় না) এ সব দিয়ে। সঙ্গে তৈলাতেই (জ্বাল—দেওয়া গাওয়া ঘি, আর শুকনো লঙ্কা ভাজা। গরুর থাকার জায়গা তৈলাতে নেই। তাছাড়া, রাতে থাকলে তার প্রাণ যাওয়ার সম্ভাবনাও আছে। একজন মুনিষের বাড়িতে থাকে গরু। তাকে সকালবেলা দু ক্রোশ হাটিয়ে নিয়ে আসে—। সামনে দুধ দোয়ায় গরু—ছাগল—বউ—বাচ্চচা সকলকে নিয়ে একটিই ঘরে সেই মুনিষ, নাম, এন্ডু, শীতের রাত কাটায় ঘরের মেঝেতে আগুন জ্বেলে। তার শীতবস্ত্র কিছু নেই। মেঝের আগুনের দিকে বুক দিয়ে শোয় প্রথম রাতে আর বুকের চামড়া যখন প্রায় জ্বলে যায় তখন পিঠ দিয়ে শোয় মাঝরাতে। ফলে চৈত—বোশেখ মাসে তাদের বুক—পিঠের চামড়া পুড়ে কুঁকড়ে গিয়ে উঠে যায় সাপের খোলসের মতো। একটি বড় গামছা কেনে বছরের প্রথমে এরা সকলেই দুর্গা, ভীম, শত্রুঘ্ন এবং এন্ডুও। তাকে দুখানা করে আধখানা গায়ে দেয় আর আধখানা পরে। তাদের বউয়েরা দুটি তাঁতের শাড়ি হাট থেকে কেনে, সে—ই এক বছরের বরাদ্দ। বছরে মাত্র দুটি শাড়িই বরাদ্দ। চান করে অধিকাংশ দিনই নগ্ন হয়ে। অথবা শাড়ি পরেই। চানের পর সেই শাড়ি কেচে দিয়ে অন্য শাড়িটা পরে। পরদিন আবারও ওই নিয়ম।
রাম খেয়ে গা গরম করে তারপর খিচুড়ি খেয়ে (খিচুড়ির সঙ্গে লাউ আর কুমড়ো ভাজা আর শুকনো লঙ্কা ভাজাও ছিল) আমরা আমার রাইফেল এবং চাঁদুবাবুর বন্দুক নিয়ে গিয়ে মাচায় উঠলাম। আমাদের জন্যে আগেই বাঁশের মই বানানো ছিল যাতে মাচাতে উঠতে অসুবিধে না হয়। কৃষ্ণা চতুর্থী বা পঞ্চমী হবে। ততক্ষণে চাঁদ উঠেছে। আকাশভরা তারা।
আজকাল বনের মধ্যে বা সমুদ্র বা হ্রদের ওপরের আকাশে যেমন নানা স্যাটেলাইট দেখা যায়, তখনকার দিনে তা দেখা যেত না। এই হারে স্যাটেলাইট বাড়তে থাকলে মহাবিশ্বের মহাকাশের চেহারাটাই হয়তো ভবিষ্যতে বদলে যাবে। কোনওদিন হয়তো আকাশেও ট্রাফিক জ্যাম হবে আর দুর্গা, নারাণ, ভরত, শত্রুঘ্নরা তাদের শীর্ণ স্ত্রী ও গলার সবুজরঙা শিরা বের করা সন্তানদের নিয়ে, খালি পেটে, খালি গায়ে, বিজ্ঞানের এই আশ্চর্যজনক অগ্রগতি মুগ্ধ ও ভীত নয়নে দেখবে।
মাচায় আমাদের তুলে দিয়ে এন্ডু বিমলবাবুর সঙ্গে চলে গেল। আমাদের গায়ে যথেষ্ট গরম জামা, মাথাতে টুপি, কোলের ওপরে বাংলো থেকে আনা ভাঁজ—করা কম্বল।
রাত আটটার মধ্যে তৈলার সব শব্দ মরে গেল। সামান্য দূর দিয়ে বয়ে যাওয়া বড় বড় শিলাখণ্ড ছড়ানো বোষ্টমনালা দিয়ে জল বয়ে যাওয়ার শব্দ ক্রমশ জোর হতে লাগল। শীতের বনের শিশির—ভেজা যে নিজস্ব গন্ধ আছে তা ধীরে ধীরে চারিয়ে যাচ্ছে। গভীর জঙ্গলের মধ্যে শীতার্ত অন্ধকার রাতে থম মেরে থাকে। বসন্ত বা গ্রীষ্মবনের রাতের মতো তা সুগন্ধি হাওয়াতে টাল—মাটাল হয় না। মহুয়া আর করৌন্ধের গন্ধ ছুটোছুটি করে হাওয়ার হাত ধরে প্রস্তরখণ্ড এবং মাটির ওপর শুকনো পাতাকে ঝরনার মতো ঝরঝরানি তুলে দৌড় করিয়ে বয়ে যায় না।
একটি কোটিয়া হরিণ (বার্কিং ডিয়ার) টিকিয়াপাড়ার রাস্তার দিক থেকে ঘাউ ঘাউ করে ডেকে উঠল। বনের শান্তি খান খান করে দিয়ে অ্যালসেশিয়ান অথবা জার্মান বা অস্ট্রিয়ান শেফার্ড ডগসদের মধ্যে ডাকে বলেই এদের নাম বার্কিং ডিয়ার।
তারপরই সব চুপচাপ। রাত আরও গভীর হলে টুপটাপ করে বড় গাছের পাতা থেকে নিচের আন্ডারগ্রোথের ওপর শিশির ঝরে পড়ার শব্দ শোনা যাবে। কিছুক্ষণ পর টুল্বকাতে যাওয়ার শর্টকাট পথের (যে পথের পাশে জয়ন্ত সম্ভবত গাউরকে গুলি করেছিল) দিক থেকে একটা লেপার্ডের করাত—চেরা শব্দের মতো শব্দ ভেসে এল। তারপর আবার সব চুপচাপ। রাত নটা নাগাদ একটা হুতুমপ্যাঁচা বোষ্টমনালার ওপরের গভীর জঙ্গল থেকে দুরগুম—দুরগুম করে ভারি আওয়াজ করে ডেকে উঠল। যাঁরা এই আওয়াজ না শুনেছেন তাঁরা প্রথমবার অতর্কিতে শুনলে আঁতকে উঠবেন ভয়ে।
প্যাঁচার ডাক থামার পরই মাচার ডানদিকে মড়মড় শব্দ শোনা গেল। চেয়ে দেখি, তৈলার বাঁশের বেড়া ভেঙে একদল ছোটবড় হাতি তৈলাতে ঢুকছে। মনে হল, ঢুকছে, কিন্তু ঢুকল না। তারা সম্ভবত খাওয়ার উপযুক্ত কিছু দেখতে না পেয়ে অন্যত্র চলে গেল। বিমলবাবু ধান লাগাননি, আলু, বেগুন, টম্যাটো, নানারকম শাক, ধনেপাতা, পুদিনাপাতা এবং সর্ষে লাগিয়েছিলেন। কচু ও ওল লাগিয়েছিলেন প্রচুর, যে কারণে শুয়োর ও শজারুর অত লোভ ছিল তৈলার ওপরে।
আধঘণ্টা পরে গাউরের একটি দলও হাতিদেরই মতো বেড়ার কাছে এসেও ফিরে গেল। হাতি বা গাউর কারও সঙ্গেই আমাদের কোনও ঝগড়া ছিল না। কিন্তু রাত সাড়ে এগারোটা বাজল, যাদের জন্যে আমাদের প্রতীক্ষা তারা এল না, সম্ভবত আসবে না সেই রাতে। শুয়োর বা শজারু শিকার করার জন্যে ওই ঠান্ডাতে সারারাত বসে থাকার মতো উৎসাহ ছিল না আমাদের। শজারুকে ওড়িয়া ভাষাতে বলে ঝিংক্ক। খুব বড় বড় ঝিংক্ক আছে বড় বন বারারই মতো এ অঞ্চলে। ভাবছি, নেমে গিয়ে বাংলোতে ফিরে প্রচণ্ড শীতের রাতে কম্বলের তলাতে সেঁধিয়ে গিয়ে শয়নে পদ্মনাভ হই। এমন সময়ে পুরুনাকোট গ্রাম থেকে কী এক গুঞ্জরন ভেসে এল ওই শীতার্ত সিক্ত রাতে।
ওড়িয়া আমি বুঝতে ও মোটামুটি বলতে পারি, ওড়িশার নানা জঙ্গলে বহু বছর ধরে এসে এসে শিখেছি। তবে আমাদেরও যেমন বাঁকুড়া বা মুর্শিদাবাদ বা দক্ষিণবঙ্গের ভাষা আলাদা ওড়িয়ারও অনেক ডায়ালেক্ট আছে, কটকি, সম্বলপুরিয়া এই সব। আমার যা ওড়িয়া জ্ঞান তা গভীর রাতের দূরাগত কথোপকথন বোঝার মতো যথেষ্ট ছিল না। তাই চাঁদুবাবুকে জিজ্ঞেস করলাম, কী হল চাঁদুবাবু? চাঁদুবাবু বললেন, একটি মেয়ে সন্তান প্রসব করল। তার ঘর এবং আশপাশের ঘরের মেয়েরা এবং কিছু পুরুষও তাইনিয়ে আলোচনা করছে। খুব ফর্সা দেখতে ছেলে হয়েছে।
ও।
আমি বললাম।
তারপর দুজনেই আবার চুপচাপ। শুয়োর আর শজারু এমনকী দু—চারটে ধেড়ে খরগোশও হয়তো আসবে না। এদিকের জঙ্গলে খরগোশ বিশেষ দেখিনি যদিও। মাচা থেকে নেমে আসতে ইচ্ছে করছিল কিন্তু বিমলবাবুর কথা ভেবে বিবেক দংশন করছিল। তিনি তৈলাতে সেই শালকাঠের তক্তপোশে তাঁর গায়ের মোটা আলোয়ানটি গায়ে দিয়ে নিদ্রা গেছেন নিশ্চয়ই ততক্ষণ। ঘুমনোর ক্ষমতা তাঁর অসীম, প্রায় রানা প্রতাপ বা শিবাজিরই মতো, তাঁরা যেমন ঘোড়ার পিঠেও ঘুমোতে পারতেন, বিমলবাবুও যত্রতত্র ঘুমিয়ে পড়তে পারেন সময়ের একটুও অপব্যবহার না করে। ওই গভীর জঙ্গলে হাতি, গাউর, বাঘ, ভালুক, শুয়োর, অগণ্য সাপের মধ্যে অবলীলাতে এমন নিরস্ত্র অবস্থাতে এই হালকা—পলকা ,কতলা ছ্যাঁচাবেড়া আর খড়ের চালের ঘরে রাত কাটানোর কথা ভাবতেও পারা যায় না। অস্ত্র বলতে ওই লাঠিখানি, বাঁশের এবং দেড় হাতি।
তিনি তো কমান্ডার কিন্তু সৈন্য বলতে তো ওই অর্ধনগ্ন নিরস্ত্র একাধিক খিতমদগার। গোলাগুলি বলতে কিছু আছাড়ি পটকা আছে শিকেতে বাঁধা একটি হাঁড়িতে, যার মুখ বন্ধ করা থাকে ড্যাম্প লাগার ভয়ে।
দুজনে নির্বাক ‘নট—নড়ন—চড়ন’ বসে আছি। একবার আস্তে করে মাথা তুলে আকাশের তারা দেখছি। কৃষ্ণপক্ষ হলেও চাঁদ এখন উঠেছে। শিশিরে সপসপে ভেজা বন পাহাড় চাঁদের সামান্য আলোতেও রূপসী হয়ে উঠেছে। একজোড়া কপার স্মিথ ডাকছে, একটা বোষ্টমনালার এ পাশ থেকে আর অন্যটা ও পাশ থেকে। গভীর রাতে এদের ডাক অনেক জোর শোনায় এবং বলা বাহুল্য মোহাবিষ্ট করে। বোষ্টমনালার ঝরঝরানি শব্দও রাতের নিস্তব্ধতাতে আরও জোর হয়েছে। তৈলার বাঁদিকে টিকর পাড়া—পুরুনাকোটি রাস্তা। যদিও সেই গেরুয়া মাটির রাস্তা পেরিয়েও আগন্তুকরা আসতে পারে তবে তৈলার ডানদিক থেকে তাদের আসার সম্ভাবনাই বেশি।
আধঘণ্টাটাক সময় গেছে পুরুনাকোট গ্রামের সেই নবজাতকের আবির্ভাবের পরে। এবার একক নারী কন্ঠের এক তীব্র আর্তনাদ ভেসে এল। আর্তনাদের কোনও ভাষার ব্যবধান থাকে না। আর্তনাদ, তা যে ভাষাতেই হোক না কেন, আর্তনাদ বলে সহজেই বোঝা যায়। আর্তনাদের পরেই বিলাপ। তারপরে অনেক নারী—পুরুষের কন্ঠস্বর যোগ হল।
আমি চাঁদুবাবুর ডান কানের মধ্যে মুখ নিয়ে বললাম, কী হল? চাঁদুবাবু বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। তারপর বললেন, কী হবে শুনি।
আমি অধৈর্য হয়ে বললাম, বলুনই না।
চাঁদুবাবু বললেন, যে ছেলেটি একটু আগে জন্মাল, তার মাথার ঘিলু ছুঁচোতে খেয়ে গেল।
আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। এই আমার ভালবাসার ভারতবর্ষ। এত এত হেলিকপ্টার—বাহিত দুগ্ধ—ফেননিভ খদ্দর পরিহিত নেতারা, এত পাঁচ শালা, দশ শালা পরিকল্পনা, তার এই পরিণতি।
আমি যে ঘটনার কথা বললাম তা পঞ্চাশ বছর আগের। আশা করি, শুধু ওড়িশাতেই নয়, ভারতের সর্বত্রই আজ এই গ্রামীণ এবং বন—পাহাড়ের গরিবস্য গরিব মানুষদের আস্থার উন্নতি হয়েছে, শুধু আর্থিক অবস্থারই নয়, তাদের সামাজিক অবস্থারও।
ফিলিপিনসের টুপামারো চরমপন্থীরা বিশ্বাস করে, তাদের ম্যানিফেস্টোতে লেখে: ‘If the Countru dose not belong to everyone, it will belong to no one.’ সে কথা সে রাতে মনে পড়ে গেল। আরও পড়ল টি এস এলিয়টের কবিতা :
‘Time present and time past
Are both perhaps present in time future
And time future contained it time past.’
চাঁদুবাবু বললেন, কী হল? চুপ মেরে গেলেন কেন?
বললাম, কিছু না।
আমিও যেমন চাঁদুবাবুর সব কথা বুঝি না, চাঁদুবাবুও আমার সব কথা বুঝবেন না। হয়তো বিমলবাবুও বুঝবেন না। ওঁদের সরল বনময় জগৎ আর আমার কালিমাময় শহুরে জগতে অনেকই যে তফাত।
গত মাসে পুরী থেকে কটকে গিয়ে চাঁদুবাবুর সঙ্গে দেখা যে করে আসতে পারলাম সে জন্যে ভাল লাগছে। বিমলবাবুর সঙ্গে দেখা হলেও ভাল লাগত। মনে পড়ে গেল, নাজিম সাহেব যখন খুবই অসুস্থ তখন খবর পেয়ে রাঁচি থেকে গাড়ি ভাড়া করে হাজারিবাগে গেছিলাম। সেই প্রথম জেনানা মহলে ঢোকা। এত বছরের দোস্তি কিন্তু কোনওদিনও বাড়ির দোতলাতে উঠিনি। লম্বা বারান্দা দিয়ে গিয়ে পৌঁছলাম—দু’পাশের ঘরের সব জানলা—দরজা বন্ধ। পর্দা খুব কঠোর। নাজিম সাহেবের ছেলে তাঁর ঘরে নিয়ে গেল। নাজিম সাহেব খুব কষ্ট করে দাঁড়িয়ে উঠে কেঁদে বললেন, আমাকে একবার জড়িয়ে ধরুন লালাবাবু। আমি জড়িয়ে ধরে বলেছিলাম, তাড়াতাড়ি ভাল হয়ে উঠুন, আমরা আবার কোসমাতে যাব, আপনার রান্না করা খিচুড়ি আর আলুকা ভাজাও খাব, সারারাত বন্দুক কাঁধে ‘পালসা’ শিকার করব পায়ে হেঁটে।
কথাগুলো যখন বলছিলাম তখন আমি যেমন জানতাম যে কথাগুলো মিথ্যা, নাজিম সাহেবও জানতেন। অনেক সময়েই আমাদের সকলকেই কথার কথা বলতে হয়, সে কথা ফালতু, তা ভাল করে জেনেও। ‘সবকিছুরই একটা কোথাও করতে হয়রে শেষ, গান থামিলে তাইত কানে থাকে গানের রেশ জীবন আস্তে যায় চলি তার রঙটি থাকে লেগে প্রিয়জনের মনের কোণে শরৎসন্ধ্যা মেঘে।’
তিলাইয়া ড্যাম তখন সবে তৈরি হয়েছে। বিংশ শতাব্দীর চল্লিশের দশকের কথা বলছি। ওই দশকের শেষের দিকে আমাদের ফার্ম—এর মক্কেল হলেন রামকুমার আগরওয়ালা। ওঁরা আগরওয়ালা হলেও মাড়োয়ারি ছিলেন না। উত্তরপ্রদেশীয় ছিলেন। রামগোপাল, রামমনোহর, রামকুমার এবং বদ্রীপ্রসাদ। চার ভাই। অতি সামান্য অবস্থা থেকে নিজের অসাধারণ পরিশ্রম ও দূরদৃষ্টিতে অনেক বড় বড় শিল্পের মালিক হয়েছিলেন, যেমন ক্রিশ্চান মাইকা, গ্যাঞ্জেস ইঙ্ক, ওড়িশা ম্যাঙ্গানিজ এবং আরও অনেক শিল্পের। কোডারমা রেল স্টেশনের (হাওড়া থেকে গেলে) বাঁদিকে ছিল ঝুমরি তিলাইয়া, যা থেকে তিলাইয়া ড্যাম, আর ডানদিকে কয়েক মাইল গেলেই ডোমচাঁচ ও শিবসাগর। ডোমচাঁচেই ক্রিশ্চিয়ান মাইকা কোম্পানির কারখানা ছিল। সাহেবদের কাছ থেকে রামকুমারবাবুরা সবে কিনেছিলেন। কোম্পানির অভ্রখনি ছিল রজৌলির গভীর জঙ্গলাবৃত ‘ঘাটে’। খলকতুম্বি নামের একটি খাদান ছিল পৃথিবীর গভীরতম অভ্রখাদান। অভ্রখাদান সেখানে অনেকই ছিল। রাজঘুড়িয়াদের, সামন্তদের এবং আরও অন্যদের। অগণ্য শ্রমিক নিযুক্ত ছিল সেই সব খাদানে। ডোমচাঁচের কারখানাতে অভ্রর চাঁই ছুরি দিয়ে কেটে অতি পাতলা সব অভ্রর ছিলকা বের করত সার সার বসা কামিনরা। কুলি—কামিনদের স্বার্থ দেখার জন্যে একজন লেবার ওয়েলফেয়ার অফিসার ছিলেন সেখানে—সরকারি আমলা, তাঁর নাম ছিল বিজাপুকার— মারাঠি। তাঁরও খুব শিকারের শখ ছিল। সেই সূত্রে বাবার সঙ্গে আলাপ। বিজাপুকার সাহেবের হাত খুব ভাল ছিল। তবে তাঁর রাইফেল ছিল না, দোনলা শটগান দিয়ে মারতেন। ওখানে ভাল গুলি পাওয়া যেত না তাই বাবার গুলির চামড়ার থলে থেকে তিনি আকছার গুলি চুরি করতেন। অ্যালকা ম্যাক্স—এর পৌনে তিন ইঞ্চি বল এবং এল জি ই বেশি নিতেন। তাঁর ড্রাইভারের নাম ছিল যুগলপ্রসাদ। সে এক বিচিত্র পুরুষ ছিল। মস্ত বড় বড় পাকানো গোঁফ ছিল। ছ ফিটের ওপর লম্বা। জবাফুলের মতো লাল দুটি চোখ নিয়মিত প্রচুর পরিমাণে মহুয়া সেবনের ফল। বাবার সময় ছিল না মোটে। তাই সপ্তাহান্তে শিকারে গিয়ে পারমিট নিয়ে বাংলো বুক করে হাঁকোয়া করে মাচায় বসে শিকার করার উপায় ছিল না তাঁর। তা ছাড়া তাঁর দর্শন ছিল অন্যরকম। বলতেন, এত টাকাপয়সা খরচ করে শিকারে আসা—যে কোনও জানোয়ারই চেহারা দেখাবে ওকে সম্মিলিত প্রচেষ্টাতে ধরাশায়ী করতেই হবে। অতএব জিপ বা ওয়েপন ক্যারিয়ারে যতজন সশস্ত্র শিকারি থাকতেন সকলেই একসঙ্গে গুলি চালাতেন বন্দুক, রাইফেল যার হাতে যা থাকত তাই দিয়ে। এ নিয়ে পরে বাবার সঙ্গে আমার মতভেদ হত—তখন আমি ক্লাস নাইন টেন—এ পড়ি—বাবার সঙ্গে তর্ক করার সাহস ছিল না। কিন্তু পরে হাজারিবাগে, ওড়িশাতে এবং অন্যত্র ওইরকম শিকারের পক্ষপাতী আমি একেবারেই ছিলাম না। মাদী শম্বরও মারা হত বাবার কমান্ডে, বাছ—বিচার ছিল না। অত পয়সা খরচ করে শিকারে আসা, কলকাতাতে ফিরে বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়পরিজন সকলকে ‘শিকার’ খাওয়াতে না পারলে কী লাভ? ছেলেমানুষ আমি মৃত হরিণীর কোমল যৌনাঙ্গ দেখে রোমাঞ্চিত হতাম। শরীরে শিরশিরানি উঠত।
যুগলপ্রসাদ নানা জঙ্গলের গল্প বলত। চাতরা, কাটকামচারি, ইটখোরি, পিতিজ, ঢোঁড়াখোলা, চম্পারণ, দানুয়া ভুলুয়া ইত্যাদি জায়গার কথা তার মুখেই প্রথম শুনি। পরবর্তী জীবনে গোপাল ও নাজিম সাহেবের সঙ্গে সেইসব জায়গাতে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল।
শীত, গ্রীষ্ম সব ঋতুতেই যুগলের একইরকম পোশাক ছিল গায়ে একটি ওয়াটার প্রুফ, পায়ে গামবুট। সদ্য একাধিক বোতল মহুয়া পান করে সে স্টিয়ারিংয়ে বসত। অনেক সময়েই অন্য ড্রাইভার গাড়ি চালাত এবং সে স্পট লাইট হাতে জিপের পেছনে দাঁড়াত।
ক্রিশ্চান মাইকার গেস্ট হাউস ছিল পাঁচ নম্বর বাংলো। ত্রিশ—চল্লিশ বিঘা শাল জঙ্গলের মধ্যে ছিল সেই বাংলো। বিরাট বিরাট সব বেডরুম, মধ্যে ডাইনিং রুম, প্রকাণ্ড অ্যাটাচড বাথরুম বাথটাব ও শাওয়ার সমেত। বাবুর্চিখানাতে একজন মুসলমান বাবুর্চি আর একজন হিন্দু কুক এবং তাদের ওপরে ছিল গ্র্যাজুয়েট একজন ক্রিশ্চান স্টুয়ার্ড। একটি জিপ ও একটি ওয়েপন ক্যারিয়ার এবং একটি শেভ্রলে ও একটি ব্যুইক গাড়ি ছিল আমাদের ব্যবহারের জন্যে। বিকেলে দুজন সহিস দুটি ঘোড়াতে; চেহারা খুব বড় ছিল না ছোটরা যাতে চড়তে পারে সে জন্যই বোধহয়।
জঙ্গল সম্বন্ধে জ্ঞান ছিল যুগলের দুর্দান্ত। সব জানোয়ারের রাহান—সাহান ছিল তার নখদর্পণে। কোথায় কোন গ্রামের কুলমি খেয়ে শম্বর বা চিতল হরিণ কলাই ডাল খেতে আসবে, শীতের মধ্যরাতের কোথায় গেলে বাঘ বা লেপার্ডের দেখা মিলবে, কোথায় প্রকাণ্ড ভালুকের গুহা সবই তার জানা ছিল।
একরাতে এক খোয়াইভরা মস্ত টাঁড়ে একদল ‘ঘোড়ফরাস’ তাড়া করার স্মৃতি আজীবন মনে থাকবে। বিহার—ঝাড়খণ্ডে নীলগাই (নাজিম সাহেবের ভাষাতে ‘বুলু—বুল’, ইংরেজি ব্লু—ব্লু) এর নাম ছিল ঘোড়ফরাস। জিপের সামনের কাচ শোয়ানো, হুড খোলা, বাবা বসেছেন পেছনের বাঁদিকের সিটে, আমি ডানদিকে, সামনে বিজাপুকার সাহেব। খুব জোরে জিপ চালাচ্ছে হোসেন ড্রাইভার। যুগল পেছনে দাঁড়িয়ে স্পট লাইট নিয়ে।
জিপ অকুস্থলে পৌঁছতেই নীলগাইয়ের দল তিরের বেগে দৌড় লাগাল। দলে মাদী—মদ্দা মিলিয়ে প্রায় ত্রিশটি ছিল। আমাদের দেশে অধিকাংশ জায়গাতেই যেহেতু নামের পেছনে ‘গাই’ আছে হিন্দু চাষিরা এবং অধিকাংশ শিকারিও নীলগাই মারেন না। উত্তরপ্রদেশে তো নীলগাই ও ময়ূর কেউই মারে না—তখনও ময়ূরকে ন্যাশনাল বার্ড ডিক্লেয়ার করা হয়নি। তবে আমরা সর্বভুক ছিলাম। তা ছাড়া, না খেলেও, নীলগাইদের চামড়া দিয়ে ভাল জুতো বানিয়ে দিত কার্থবার্টসন হার্পার। তবে মুসলমান শিকারিরা অবশ্যই মারতেন এবং খেতেন তো বটেই।
নীলগাইয়ের দল প্রাণপণে দৌড়চ্ছে ক্ষুরে ক্ষুরে ধুলো উড়িয়ে এবং জিপও ছুটছে তাদের পিছু পিছু। জায়গাটা, গোপালের ভাষায় ‘বিশ্বটাঁড়’, মাঝে মাঝে কিছু পুটুস বা ল্যানটানার ঝোপ এবং পলাশের চারাগাছ। জিপ জোরে চললেও খুব সাবধানে যেতে হচ্ছে কারণ মাঝে মাঝেই খোয়াই। একটা সময় এল যখন নীলগাইয়েরা প্রায় রাইফেলের রেঞ্জের মধ্যে চলে এল—বাবা অতি—উত্তেজনাতে জিপের বাঁদিকের সিট থেকে পা দুখানি বাইরে ঝুলিয়ে রাইফেলটি কোলের ওপরে রেখে ‘প্রস্তুত’ হয়ে রইলেন। জিপ থামলেই নেমে পড়ে গুলি করবেন বলে। এমন সময়ে হঠাৎ সামনে আবিষ্কৃত হল এক মস্ত খোয়াই—তাড়াতাড়ি প্রায় দশ ফিট গভীর ফাটল। গাড্ডায় পড়লে জিপ তো ভাঙতই, সকলের প্রাণও যেত তাই ড্রাইভার একেবারে একটি সমকৌণিক বাঁক নিল স্টিয়ারিং পুরোপুরি ডানদিকে ঘুরিয়ে আর তার ফলবশত প্রস্তুত হয়ে থাকা আমার একমাত্র বাবা মাটিতে পড়ে গেলেন রাইফেল—ধরা অবস্থাতেই।
যুগলের প্যান্টে জোর চিমটি কেটে আমি চিৎকার করে বললাম, ‘পিতাজি গিড় গ্যয়া’। যুগল বাঁহাত দিয়ে আমার মাথাতে এক উড়চাঁটি মেরে বলল, গিড়নে দো, ঘোড়ফরাস ভাগ রহা হ্যায়। মুহূর্তের মধ্যে জিপের চাকাতে ওড়া ধুলোর আড়ালে গভীর অন্ধকারে আমার পিতাজি অন্তর্হিত হয়ে গেলেন।
জিপ ওই খোয়াইয়েরই জন্য ঘোড়ফরাসদের কাছে আর পৌঁছতে পারল না। উত্তেজনা শমিত হলে বিজাপুরার সাহেব বললেন, অব ঘোড়ফরাসকি ঝুঁন্ড তো ভাগই গ্যয়া, অব চলো গুহাসাবকো ঢুঁড়া যায়। জিপ ঘোরানো হল ঘোড়ফরাস শিকারের মায়া ত্যাগ করে। জিপ একটু এগোতেই দেখি আমার দীর্ঘদেহী একমাত্র বাবা হেঁটে আসছেন। পাঁচটা নয়, দশটা নয় আমার একটি মাত্র বাবা। পরমুহূর্তেই অবাক হয়ে লক্ষ করলাম যে বাবার দু হাতে দুটি রাইফেল। ছিল একটি, হয়ে গেছে দুটি। এ কী পি সরকারের ম্যাজিক!
বাবা কাছে আসার পর রহস্যের উন্মোচল হল। জিপ অতর্কিতে বিনা নোটিসে ডানদিকে রাইট অ্যাঙ্গেলে ঘুরে যাওয়ায় বাবা রাইফেলসুদ্ধ মাটিতে পড়ে যান এবং তাঁর ভারী শরীরের চাপে রাইফেলটি ভেঙে দুটুকরো হয়ে যায়। বাঁহাতে ব্যারেল আর ডানহাতে বাট ধরে বাবা নতমস্তকে হেঁটে আসছেন আলোর বৃত্তের মধ্যে। সে এক অভাবনীয় দৃশ্য। পাঁচটি নয় দশটি নয় একটি মাত্র বাবার ওই দুরবস্থা দেখে আমার চোখে জল এল। রাইফেলটি ছিল একটি উইনচেস্টার ফোর ইন ফাইভ আন্ডারলিভার। আমেরিকান। প্রতিবার গুলি করার পর চেম্বারের নিচের হাতল ধরে ঘটা—ঘং শব্দ করে রাইফেল রি—লোড করতে হত—সুব্রত অনেক বছর পরে ওইরকম রাইফেল দিয়েই হাজারিবাগের সীতাগড় পাহাড়ের মানুষখেকো বাঘকে গুলি করেছিল।
আমার ‘জঙ্গল মহল’ বইয়ে ‘পীতাজি গিড় গ্যয়া’ শীর্ষক এই উপাখ্যানটি আছে।
একবার শেষরাতে রজৌলির ঘাটের অন্যপ্রান্তে সিঙ্গারের উপত্যকাতে (যে উপত্যকা পেরিয়ে গিয়ে নওয়াদা, পাওয়াপুরি, রাজগির, নালন্দা ইত্যাদি জায়গা।) একটি দেড়মনি শুয়োর এবং একমনি শজারু শিকার করে আমরা ফিরে আসছি যখন, প্রায় ডোমচাঁচের পাঁচ নম্বর বাংলোতে পৌঁছে গেছি, তখন বাংলোর উল্টোদিকের খোয়াই ভরা শালবনের মধ্যে পাশাপাশি তিন—চার জোড়া লাল চোখ জ্বলে উঠল। দু চোখের দূরত্ব ও উচ্চচতা দেখে বোঝা গেল যে হয় বাঘ নয় লেপার্ড।
তখন আমি কলেজে সবে ভর্তি হয়েছি। এন সি সি করি, আল রবার্ট ক্যাডেট ট্রফি—ইন্টারন্যাশনাল ট্রফিতে কমপিট করেছি এবং ন্যাশনাল রাইফেল শুটিং কম্পিটিশনে যাওয়ার জন্যে নির্বাচিতও হয়েছি। এন সি সি—র ইনস্ট্রাক্টরেরা ফোর্ট উইলিয়ামের রেঞ্জে আমার রাইফেল ছোড়ার ভূয়সী প্রশংসা করেন। বাবার সে খবর জানা ছিল। বাবা বলেন, মার।
কমিউনিটি শুটিং নয়, সোলো পারফরমেন্স। গুলি করতেই এক জোড়া চোখ অপসৃত হল। তার অপসরণের ভঙ্গিতেই বোঝা গেল যে গুলি লেগেছে। অন্য চোখগুলিও আর দেখা গেল না। মনে হল সবকটি চোখই একটি খোয়াইয়ের ধারে ছিল। আমি রাইফেল হাতে নেমে যেতে চাইলাম। নতুন রাইফেল, অস্ট্রিয়াতে তৈরি, পৃথিবী খ্যাত ম্যানলিকার অ্যান্ড শুনার কোম্পানির, বাবা অস্ট্রিয়া থেকে ইমপোর্ট করিয়ে আমাকে উপহার দিয়েছিলেন। কিছুদিন আগে ইংল্যান্ডের বিশ্ববিখ্যাত ডব্লু ডব্লু গ্রিনার কোম্পানির দোনলা বন্দুকও বত্রিশ ইঞ্চি লম্বা ব্যারেল, ডাবল ইজেক্টর ডাবল চোকসুদ্ধ, ইমপোর্ট করিয়ে আমাকে দিয়েছিলেন।
নামতে চাইলে কী হবে, বাবা এবং যুগল দুজনেই আটকে দিলেন। বললেন, বেশি বাহাদুরি করতে হবে না। বললেন, আহত লেপার্ড এবং একটি নয় একাধিক লেপার্ড আছে। কাল ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে আসা যাবে কী ব্যাপার বা অনুসন্ধান করতে। বিজাপুরার সাহেব ছিলেন না, বাবার দুজন বন্ধু ছিলেন। একজন শিকারি তবে তাঁর শিকারের উৎসাহ যতখানি ছিল অভিজ্ঞতা ততখানি ছিল না। অন্যজন দর্শক। এবং বলতে ভুলে গেছি আমার ছোটকাকুও ছিলেন সঙ্গে। তিনিও বন্দুকধারী।
সে রাতে যুগল পাঁচ নম্বর বাংলোতেই রয়ে গেল। পুবের আকাশ লাল হওয়ার আগেই আমরা রওয়ানা হলাম অকুস্থলের দিকে। জায়গাটা বাংলোর প্রায় উল্টোদিকে এবং সিকি মাইল মতো হবে। পুরো এলাকাটাই শালের জঙ্গল ছোট ছোট টিলা এবং খোয়াই ভর্তি। নানা পাখি ও জানোয়ারে ঠাসা। তিতির, বটের এবং মুরগির লেখাজোখা নেই।
যে জায়গাতে গুলি করেছিলাম, যুগলের আন্দাজে সেখানে গিয়ে পৌঁছলাম। রাতের বেলা আলোতে বনের যা চেহারা দিনের বেলা তা পুরো বদলে যায়। রাতের বন রহস্যে মোড়া থাকে, ভয়াবহ, আর আলো ফুটলে সব প্রাঞ্জল। ভয় থাকে না কোনও।
যুগল যে জায়গাতে নিয়ে গেল সেখানে লেপার্ডের অনেক পায়ের দাগ দেখা গেল বটে। রক্তের চিহ্নও দেখা গেল। গুরুতর আহত হলে যেমন রক্ত বেরোবার কথা তেমন বেরোয়নি। তখন ঠিক হল অত্যন্ত গভীর এবং লম্বালম্বি যে বড় খোয়াইটি চলে গেছে বাংলোর দিক থেকে জঙ্গলের গভীরে তাতে নেমে অনুসন্ধান করতে হবে। সেই খোয়াইটি প্রায় দু মানুষ গভীর এবং যা সোজা বলে মনে হয়েছিল তা আসলে সোজা নয়, বেশ আঁকবাঁক আছে। বর্ষার সময়ে জোর বৃষ্টির পরে এই খোয়াইই নদীর চেহারা নেয়।
যুগলের জন্যে বাবা বাংলো থেকে একটি বন্দুক নিয়ে এসেছিলেন। যুগল সেটি নিয়ে খোয়াইতে নেমে পড়ল। এক বা একাধিক লেপার্ডের খোঁজে। আমি রাইফেল হাতে খোয়াইয়ের ডানদিকের পাড় ধরে এগোব ঠিক হল আর বাবা বাঁদিকের পাড় ধরে। সশস্ত্র ছোটকাকু, আর বাবার সেই সশস্ত্র বন্ধু বাঁদিকেই রইলেন, বাবার সঙ্গে সঙ্গে এগোবেন তাঁরা। আর নিরস্ত্র যিনি, তিনি উত্তর কলকাতার স্থায়ী বাসিন্দা, তিনি গাছে চড়তে না জানায় আরও অনেকক্ষণ ঘুমিয়ে, কিন্তু তিনি ‘রাফিং’ করবেন এবং আমাদের লেপার্ড শিকার অথবা লেপার্ডদের আমাদের শিকার করা দেখবেনই। যাই হোক, তিনি আমাদের মরাল সাপোর্টার হিসেবে র্যাম্পার্টে চড়া ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগানের সাপোর্টারদের মতো বসে রইলেন। অধীর আগ্রহে কলকাতাতে ফিরে লুঙি পরে রকে বসে জমিয়ে বন্ধুদের তাঁর অভিজ্ঞতার গল্প বলবেন বলে।
আমাদের চলা শুরু হল। তীক্ষ্নদৃষ্টিতে নালার গভীরে চোখ ফেলে রাইফেল রেডি পজিশনে ধরে এগোতে লাগলাম। খোয়াইয়ের ওদিকে বাবাদের শোভাযাত্রাও এগোতে লাগল—আর খোয়াইয়ের মধ্যে সামনে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বন্দুক বগলে করে অন্য কোনও গ্রহের মানুষের মতো যুগল ওয়াটারপ্রুফের টুপি মাথায় ওয়াটারপ্রুফ গায়ে এবং ডাকব্যাক—এর গামবুট পরে এগোতে লাগল।
কিছুটা এগোনোর পরেই দেখা গেল সামনে খোয়াইটা ডানদিকে একটি সমকৌণিক বাঁক নিয়েছে। ওপরে শালের চারাগাছের জঙ্গল ছিল। মাঝে মাঝে পুটুসের ঝাড়ও ছিল। তাই সামনে সাবধানী নজর রেখে চলতে সময় লাগছিল। খোয়াইটা যেখানে বাঁক নিয়েছে সেখানে আমাদের থেকে পনেরো—কুড়ি গজ সামনে খোয়াইয়ের গভীর থেকে বন্দুকের আওয়াজ হল। দৌড়ে খোয়াইয়ের কানায় পৌঁছে দেখি একটি লেপার্ড তির বেগে পেছন দিকে, মানে বাংলোর দিকে দৌড়চ্ছে। তাকে দেখে পুরোপুরি অক্ষত মনে হল। কাল রাতে—করা আমার গুলি অথবা আজ সকালে—করা যুগলের গুলি তার কেশাগ্রস্পর্শ করেছে বলে মনে হল না। আমি যাকে গুলি করেছিলাম এ মোটেই সে নয় কারণ যেখানেই লাগুক আমার গুলি কাল নিশ্চয়ই কোথাও লেগে থাকবে।
ওই দুর্বিপাকে খবরের কাগজের ভাষায় যাকে বলে ‘কিংকর্তব্যবিমূঢ়’ তাই হয়ে অসম্ভব ‘প্রত্যুৎপন্নমতিত্বর’ সঙ্গে আমি দৌড়ে খোয়াইয়ে নেমে লেপার্ড কোথায় গেল তার খোঁজে লেগে পড়লাম। দেখলাম একটি মাঝারি মাপের লেপার্ড দৌড়ে একটি নালা বেয়ে ডানদিকে উঠে যাচ্ছে। তার পেছনটুকুই দেখতে পেলাম। আমার আগে যুগল ছিল। সেও দৌড়ে ডানদিকের পাড়ে উঠবার চেষ্টা করছিল কিন্তু গামবুট পরে থাকায় পা পিছলে পড়ে গেল।
কী হয়েছিল? জিজ্ঞেস করলাম আমি, ওপরে উঠতে উঠতেই।
সে বলল বাঁকটা ঘুরেই দেখি বাঘ বসে আছে আমার দিকে পেছন ফিরে। প্রায় তার লেজে পা দিয়েছিলাম। নিশানা—টিশানা না নিয়ে গদ্দাম করে ডানদিকের ব্যারেল দেগে দিলাম আর সঙ্গে সঙ্গে বাঘ পেলাভল্ট দিয়ে আমার মাথার ওপর দিয়ে আমাকে ডিঙিয়ে উল্টোদিকে চলে গেল। আমিও সঙ্গে সঙ্গে তার পেছনে দৌড়লাম।
খোয়াইয়ের পুরো বুকময় নানা জানোয়ারের নতুন ও পুরনো হাড় পড়েছিল। বোঝা গেল এটিই পুরো পরিবারের আস্তানা। দৌড়ে ডানদিকে উঠতেই দেখি বাঘ ডানদিকের জঙ্গলের দিকে চলে যাচ্ছে। ছোটকাকু গুলি করলেন এল জি দিয়ে। এল জি—র ছররাগুলো ঝরঝর করে শ্রাবণের বৃষ্টির ফোঁটার মতো শালগাছের চারাদের ওপরে পড়ল। বাবার সশস্ত্র অনুজ বন্ধু বাঘের দিকে বন্দুক তাক করে থাকলেন কিন্তু গুলি করলেন না, হয়তো ঠিক করেছিলেন যে বাঘ ঘাড়ে চড়লে তবেই আত্মরক্ষার্থে তাকে গুলি করবেন। কী মনে করে বাঘ মুখ ফিরিয়ে আমার আর যুগলের দিকে ফিরে এল। বাবার অবস্থান ঠিক কোথায় ছিল আজ আর মনে নেই। ভারী শরীরের তিনি হয়তো তখনও অনেক পেছনে ছিলেন। যুগল শিকারি নয়, সে আমাদের পথপ্রদর্শনকারী —আমরা থাকতে সে আর গুলি করল না—বাঘের লেজে গুলি করেই শান্ত হল। লেপার্ড দ্রুত দৌড়ে এসে কারোকে আক্রমণ টাক্রমণ না করে আমার সামনের একটি নালা বেয়ে আবার খোয়াইয়ের ভেতরে নেমে যেতে লাগল। তখন চলমান তার ঘাড় লক্ষ্য করে আমি গুলি করলাম রাইফেল দিয়ে। গুলিটা তার ঘাড়েই লাগল এবং সঙ্গে সঙ্গে সে মুখ থুবড়ে পড়ে গিয়ে কিছুক্ষণ থরথর করে কেঁপে তারপর নিশ্চল হল। কাঁপুনিটা তার শরীরের গতিজাড্যর জন্যে।
সেই আমার প্রথম লেপার্ড শিকার। তার আগে আসামে চিতার জন্যে তামাহাটের কাছের বাগডোরা গ্রামে পাঁঠা বেঁধে রতু জেঠুর সঙ্গে (পিসেমশাইয়ের পড়শি নামকরা শিকারি রতু বিশ্বাস) মাচাতে বসেছিলাম। কিন্তু রতু জেঠু ঘুমাচ্ছিলেন। আমাকে বলেছিলেন বাঘ এলে চিমটি কাটবি। চিমটি যখন কাটলাম তখন রতু জেঠু দূর শালা, দূর শালা বলে হাততালি দিয়ে বাঘকে তাড়িয়ে দিলেন। বললেন, শালা শিয়াল। আমি পরিষ্কার দেখলাম লেপার্ড। তখন আমি ক্লাস নাইনে পড়ি। প্রথম লেপার্ড শিকারের সুযোগ অমনভাবে হাতছাড়া হওয়াতে বড়ই মনমরা হয়েছিলাম।
যাই হোক, সেই লেপার্ড নিয়ে অনেক আদিখ্যেতা হল, টিলার ওপরে ফোটোও তুললেন বাবার বন্ধু। অন্য বন্ধু যিনি টিলায় বসে গ্রান্ড স্ট্যান্ড ভিউ পাচ্ছিলেন, তিনি যুগলের বন্দুক চেয়ে নিয়ে বাঘের সঙ্গে ছবি তুললেন।
তারপরে খেয়াল হল গত রাতে যে লেপার্ডকে আমি গুলি করলাম সেই আহত লেপার্ড কোথায় গেল? তখন চিরুনি তল্লাশি শুরু হল। আহত জানোয়ারকে ভবলীলা সাঙ্গ না করে ছেড়ে দিয়ে আসাটা আন—স্পোর্টসম্যানশিপের চূড়ান্ত। প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট পুরো এলাকাতে সকলে মিলে তল্লাশি চালানোর পরে যুগল অস্পষ্ট রক্তের দাগ দেখে আবিষ্কার করল যে একটি মাঝারি পাহাড়ের গুহার মধ্যে বাঘটি শুয়ে আছে। আমার রাতের গুলি তার কপালে না লেগে লেগেছিল তার হাঁটুতে। সে মানুষ হলে এবং আজকের দিন হলে পিয়ারলেস হাসপাতালের ডাঃ চ্যাটার্জির কাছে নিয়ে যেত সকলে মিলে। তিনি লেপার্ড না হলেও অনেক বাঘা—মানুষের হাঁটুর চিকিৎসাতে সিদ্ধহস্ত, কিন্তু সে যেহেতু বাঘ এবং প্রায় চলচ্ছক্তিহীন, যুগল বাবাকে প্রায় ঠেলেঠুলে (বাবাও মেদাধিক্যের কারণে চলচ্ছক্তিহীন না হলেও ফিট নন) পাহাড়ে চড়িয়ে গুহার অন্য মুখ দিয়ে লেপার্ড দর্শন করানো হল। বেটা আহত করেছিল, পিতৃদেব সেই ফুটো দিয়ে তাঁর হেভি রাইফেলের নল সেঁধিয়ে দিয়ে লেপার্ডের মাথাতে মেরে তার পঞ্চত্বপ্রাপ্তি ঘটালেন। এক সকালে দু—দুটি লেপার্ড শিকার হল।
আমাদের এক মক্কেল এবং সুন্দরবনের সম্রাট, বাবার বন্ধুও, শ্রীগোপেন্দ্রকৃষ্ণ বাগচী একবার আসামের ‘যমদুয়ারে’ (ভুটানের সীমান্তে) আমাদের সঙ্গে শিকারে গিয়ে ফেরার সময়ে বলেছিলেন, এবারে বেশ খাওয়া—দাওয়া যাত্রা—গান শোনা হল, জঙ্গলটি ভারি সুন্দর, এখানে একবার শিকারে আসতে হবে, বুঝলেন লালাবাবু।