বিমলবাবুর একদিন
১৪ই আষাঢ় বিমলবাবু হঠাৎই ঘুম থেকে উঠে দেখতে পেলেন তিনি একটি বিছানা বালিশহীন কাঠের খাটের মধ্যে শুয়ে আছেন। ঘুম জড়ান চোখেও অবশ্য বুঝতে অসুবিধা হল না সেটা বাবার আমলের সেই আসল মেহগিনি খাটটা। চোখ মেলে চারদিক দেখলেন তিনি। দেওয়ালে ক্যালেন্ডারে কাগজটা হাওয়া। শুধু ফিনফিনে রডটা ঝুলছে সুতোহীন অবিশ্বাস্যভাবে। টেবিলটা নেই। শুধু ওর ওপরের বইগুলি কভারহীন ভাবে আশ্চর্য ভঙ্গিমায় শূন্যে ভাসমান। টিভিটার পিকচার টিউব দেখা যাচ্ছে খালি। আলমারি হাওয়া শুধু জামাকাপড়গুলি শূন্যে ভাসছে। টিউবের আলো আছে, টিউব নেই। হাওয়া আছে, ফ্যান নেই।
#
বিমলবাবু অকৃতদার। সুতরাং তিনি ভয় পেলেন না। উঠে বাথরুমে গেলেন। অদৃশ্য কলের জলে মুখ ধুয়ে বাইরের ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালেন। আজ হল কি?
বিমলবাবু দেখলেন তার সন্তোষপুরের জমজমাট পাড়া ছেড়ে তিনি একটা খাখা মরুভূমির মত জায়গায় দাঁড়িয়ে। তবে বালি নয়, মনে হচ্ছে বালির রঙের একটা চকচকে হলদে চাদর কেউ সামনে পেতে দিয়েছে। আকাশ দেখা যাচ্ছে না। মাথার উপরে কতগুলি আলোর রশ্মি বাড়ছে, কমছে। এই অস্বস্তিকর পরিবেশে বিমলবাবু বুঝলেন না কি করবেন। এমনিতে বিমলবাবু লোকটি একটু কমই চমকান। বিস্মিত হবার ক্ষমতাও কম। কলেজ লাইফে তিনি চুটিয়ে প্রেম করতেন। তারপর একদিন হঠাৎ করে একদিন জানতে পারলেন তার প্রেমিকা সুমনা তার মতোই আরও একটি ছেলের সাথে প্রেম করছিল এবং বিয়ে টিয়ে করে পগারপার হয়ে গেছে। সেই সময়টায় তিনি এতটাই বিস্মিত হয়েছিলেন কিভাবে একটি মেয়ে এত মুন্সিয়ানার সাথে ডুয়াল সিম ব্যবহার করতে পারে যে তার গোটাজীবনের বিস্মিত হবার কোটাটাই পূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। সেই সময়টাই তিনি বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত নেন। বর্তমানে কেষ্টপুরের পিসিমা তার ননদের মেয়ের জন্য ফোন করে রোজই ঘ্যানঘ্যান করেন। বিমলবাবু সুকৌশলে কাটিয়ে দেন।
নিজের মত দশটা পাঁচটা অফিস করেন। বাড়ি ফিরে খবর টবর দেখে হোম ডেলিভারির খাবার খেয়ে চুপচাপ ঘুমিয়ে পড়েন। কোন নেশা নেই, কোন দোষ নেই, শুধু মাঝে মাঝে মাঝরাতে ঘুম থেকে উঠে বসে থাকেন। মনটা বড় হুহু করে। বড় একা লাগে। তারপর জলটল খেয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়েন।
#
এহেন বিমলবাবু ১৪ই আষাঢ় ঘুম থেকে উঠে চারদিকের পৃথিবীর পরিবর্তন দেখে বিস্মিত হলেন না। তবে একটু দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হলেন। “অফিসটা বোধহয় আজ আর যাওয়া হল না”। ভাবলেন তিনি। কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকার পর বালির রঙের হলুদ চাদরের ওপর হাঁটতে শুরু করলেন বিমলবাবু।
#
তার একটু খিদে খিদে পাচ্ছিল। তিনি ভাবছিলেন একটু লুচি আলুরদম হলে মন্দ হত না। ভাবার সাথে সাথেই তিনি দেখতে পেলেন একটু দূরে চাদরের ওপর ধপধপে সাদা লুচি আর আলুরদম। প্লেটের কোণে আবার একটা জলভরা তালশ্বাসও উঁকি মারছে। বিমলবাবু এগিয়ে যেতেই দেখলেন প্লেটের খাবার হাওয়া। শুধু প্লেটের ওপর কিছু ময়দা, চারটে আলু, আর কিছু চিনি পড়ে আছে। তারপরে সেগুলিও অদৃশ্য হয়ে গেল। মরীচিকা নাকি? ভাবলেন একবার। তার পেটটা ভরা ভরা লাগছিল। মনটা খুশি হয়ে উঠল বিমল বাবুর। ভরা পেটে থাকলে আর কোন চিন্তা থাকে না। যত চিন্তা তো এই খিদে নিয়েই। তার ফুর্তি হল খুব। তিনি দুবার লাফিয়ে নিলেন চাদরের ওপরে। চারদিক তাকিয়ে একটু গড়িয়েও নিলেন।
#
বিমলবাবুর মনে হল আজ ভারত পাকিস্তানের ক্রিকেট ম্যাচ ছিল। খেলাটা দেখতে ইচ্ছে করছিল তার। ভাবতে না ভাবতেই একটা বিরাট স্ক্রিন উদয় হল সামনে। তিনি দেখতে পাচ্ছিলেন টস হচ্ছে। কিন্তু আরেকটু মনোযোগ দিতেই দেখলেন স্ক্রিন উধাও। দপ করে অখণ্ড ভারতের মানচিত্র উদয় হয়ে আবার উবে গেল।
#
বিমলবাবু বুদ্ধিমান লোক। তিনি বুঝতে পারলেন এখানে যা চাওয়া যায়, তাই পাওয়া যায় অন্তত কিছু সময়ের জন্য। তিনি হলদে চাদরের উপর দাঁড়িয়ে চিন্তা করলে লাগলেন কি চাওয়া যায়? সেই ছোটবেলার ঠাকুমার আমসত্ত্বের আচার? শীতকালে কাঁচা কুলের টক ঝাল মাখা? নাকি প্রথম কৈশোরের সেই লাল সাইকেল যেটা ও পাড়ার হরিপদ রোজ চালিয়ে যেত আর তিনি জুল জুল করে চেয়ে দেখতেন? অখিলেশের দামী মোবাইলটাই বা মন্দ কি?
বিমলবাবু এই বাতানুকুল পরিবেশেও ঘামতে লাগলেন। তিনি ঠিক করতে পারলেন না কি চাইবেন। কিছুই ঠিক করতে না পেরে অবশেষে একে একে সবই চাইতে লাগলেন। কোনবার মুখ টক, কোনবার মিষ্টি, কখনও দেখলেন একটা লাল সাইকেল, পরক্ষনেই কিছু লোহালক্কড় আর লাল রঙ, কখনও একটা ক্যামেরা মোবাইল আর তার পরেই কিছু ধাতু।
#
বিমলবাবু একটু ক্লান্ত হলেন। বসলেন হলুদ চাদরের উপরে। হঠাৎ তার মন মাঝরাতের মত হুহু করে উঠল। বুকটা টনটন করে উঠল।
তার সুমনাকে দেখতে ইচ্ছা করল। সেই সুমনা। যে তার সাথে দুবছর প্রেমের নাটক করে ফিলজফি অনার্সের অমিতাভকে বিয়ে করেছিল। তারপর কত বিনিদ্র রজনী কাটিয়েছিলেন তিনি। কতবার তার মনে হয়েছে এই সুমনা ছাড়া তিনি পাগল হয়ে যাবেন। এখনও মাঝরাতে উঠে বসে থাকেন। সেই সুমনাকে একবার দেখার বড় ইচ্ছা হল তার।
ভাবতেই চোখের সামনে ভেসে উঠল একজন স্থুলকায়া মহিলা। গর্ভবতী মহিলার মত ভুঁড়ি। মুখটা পান খেয়ে লাল। এই সেই সুমনা? বিমলবাবুর মুখটা এবার নিজে থেকেই তেতো হয়ে গেল। তবু ভাল করে দেখার জন্য সামনে যেতেই দেখতে পেলেন দপ করে সুমনা উবে গিয়ে একটা কঙ্কালে পরিণত হল। তারপর কিছু লাল, সবুজ, হলুদ বাস্প হয়ে উবে গেল।
#
তিনি আবার বসলেন। ক্লান্ত অবসন্ন লাগছিল বড়। ঘুমিয়েই পড়লেন শেষতক।
#
১৫ই আষাঢ় ঘুম থেকে উঠে বিমলবাবু দেখতে পেলেন তিনি সেই একই খাটে শুয়ে আছেন, সেই একই বিছানা, সেই কোলবালিশ, টি ভি সেই টি ভির জায়গাতেই আছে। বিমলবাবু এবারও বিস্মিত হলেন না। তবে উঠে তিনি একটা ফোন করলেন। কেস্টপুরের পিসিমাকে জানিয়ে দিলেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তার বিয়ের ব্যবস্থা করতে। একা থাকা তার আর পোষাচ্ছে না।
#
মনে মনে বললেন, সবই যখন কঙ্কাল আর কিছু লাল সবুজ হলদে ধোঁয়া তখন আর জীবনভর দেবদাস থাকার মানে কি?
#
শোনা যায়, এক মেয়ে আর গিন্নি নিয়ে বিমলবাবু এখন সুখেই সংসার করছেন।