বিভূতিবাবুর গল্প – বিনোদ ঘোষাল

বিভূতিবাবুর গল্প – বিনোদ ঘোষাল

ভয়ংকর সমস্যায় পড়েছেন বিভূতি গুঁই। কিছুতেই মাথায় আসছে না। কিছুতেই না। এই তিয়াত্তর বছর বয়সে শেষ পর্যন্ত কিনা মাত্র তিনশো চুয়াল্লিশে আটকে যাবেন! ওফ, ভাবলেই টাক বেয়ে টস টস করে ঘাম ঝরছে। সারাদিন কাগজ-কলম নিয়ে চাতক পাখির মতো হাঁ করে টেবিলের সামনে বসে আছেন, কিন্তু কিছুতেই মাথায় আসছে না।

একান্ত নিরুপায় হয়ে শেষপর্যন্ত ঠিক করলেন কোথাও একটা যেতে হবে। একেবারে জাতভুতুড়ে কোনো জায়গায়। সেখানে গিয়ে যদি…।

আসল ব্যাপারটি হল বিভূতি গুঁই একজন বিখ্যাত ভূতের গল্প লেখক। দীর্ঘ পঁচিশ বছর ধরে দেশি-বিদেশি ভাষায় আজ পর্যন্ত তার মোট তিনশো চুয়াল্লিশটা গল্প ছাপা হয়েছে। তার লেখা গল্পের বইয়ের সাংঘাতিক কাটতি। প্রকাশকরা তার গল্পের জন্য প্রায় সারাবছর লাইন দিয়ে থাকেন। আর পুজো সংখ্যায় তো কথাই নেই। স্রেফ তার একটা ভূতের গল্প থাকলে অনেক ওঁচা পত্রিকার শারদীয় সংখ্যাও ভূতের মতোই বাজার থেকে অদৃশ্য হয়ে যায়? ভূত সম্পর্কে বিভূতিবাবুর অগাধ জ্ঞান। শুধু গল্প নয়, ভূত বিষয়ক বহু তত্ত্ব, তথ্য এমনকি দু-একটি তথ্যচিত্রেও তার অবদান রয়েছে। ইচ্ছে ছিল এই বছর শারদীয় সংখ্যাগুলোর জন্য লেখা হয়ে যাবার পর ‘মনীষীদের জীবনী’র মতো ‘ভূতেদের জীবনী’ নাম দিয়ে একটি বই লিখবেন।

এমন লিখবেন যেন প্রথম পাতা থেকে শেষ অবধি পাঠকের গোটা গা সজারু হয়ে থাকবে। কিন্তু ভাগ্য যে এমন পালটি খাবে কে জানত। এত বছর পর আচমকা কোনো ভৌতিক কারণেই কোনো ভূতের গল্প তার মাথায় আসছে না। একটাও নয়। একটুও নয়। অথচ কমপক্ষে পনেরোজন প্রকাশক তাকে রোজ ফোন করছেন গল্পের কদ্দুর এগোল তার খোঁজ নিচ্ছেন। বিভূতিবাবু ঘোষণা করে দিয়েছেন তার শরীর খুবই খারাপ। চাকর শংকরকে নির্দেশ দিয়ে দিয়েছেন কোনো ফোন এলে যেন ওনাকে না-দেওয়া হয়। বিভূতিবাবু অকৃতদার। নিজের আপনজন বলতে ওই এক শংকর। বহুকাল ধরে সঙ্গে রয়েছে। বাবুকে খুবই ভালোবাসে। বিভূতিবাবুর এমন পাগল পাগল অবস্থা দেখে আর থাকতে না-পেরে একদিন জিজ্ঞেস করেই ফেলল ‘বাবু আপনার কী হয়েছে?’

গোপন কথাটা শংকরকে প্রথম দিকে বলতে না-চাইলেও শেষপর্যন্ত তুমুল কান্নায় ভেঙে পড়ে জানালেন সব কথা। সব শুনেটুনে শংকর পান খাওয়া ছোপ-দাঁত বার করে বাবুকে চমকে দিয়ে খুব হাসল। তারপর নিজের কাঁধে চাপানো সাত রাজ্যের ময়লা মাখা তেলের গন্ধওলা গামছাটা দিয়ে বাবুর চোখ-মুখ মুছিয়ে দিয়ে বলল, ‘এই কথা আগে বলবেন তো। চলে যান সিরসিরে। ক-টা ভূত চাই আপনার?’

বিভূতিবাবু হাঁ করে তাকালেন শংকরের দিকে।

শংকর আবার গোটা মুখে হাসি মাখিয়ে যা জানাল তা মোটামুটি এইরকম : শংকরদের গ্রামের পাশেই বিশাল মাঠ। সেই মাঠ পার হলে সিরসিরে গ্রাম। ওই গ্রামে নাকি সারাদিন চলে অদ্ভুত সব কাণ্ড। সবাই বলে ওই গ্রামে নাকি মানুষের থেকে ভূতের সংখ্যা বেশি। তবে মানুষদের কোনো ক্ষতি করে না তারা। আজ পর্যন্ত ঘাড় মটকানোর কোনো খবর নেই। অবশ্য দু-একটা বিচ্ছু ভূত যে নেই তা নয়, তবে তাদের শায়েস্তা করার জন্য আছে রাবণ ওঝা। তার পিটুনির ভয়ে পাজি ভূতগুলো তেমন কিছু সুবিধে করে উঠতে পারে না।

এমন খবরটি পেয়ে বিভূতিবাবু তড়াক করে লাফ দিয়ে উঠে শংকরের গালে সপাটে দুটো চুমু খেয়ে ফেললেন। তারপর নাচতে নাচতে বললেন ব্যাগ গুছোরে কাল ভোরেই দুজনে রওনা দেব।

বর্ধমান স্টেশনে নেমে পশ্চিমে পাকা আড়াই ঘন্টা বাসে। তারপর শংকরের গ্রামে পৌঁছে সেই বিশাল মাঠ পায়ে হেঁটে পার করে বিকেলের দিকে সিরসিরে পৌঁছোলেন বিভূতিবাবু আর শংকর। এতবড়ো মাঠ বিভূতিবাবু জীবনে দেখেননি। শেষই হতে চায় না। যেন সাহারা মরুভূমি। সিরসিরে পৌঁছোতেই ভেবেছিলেন নিশ্চয়ই তক্ষুনি কিছু একটা ভৌতিক কাণ্ড ঘটবে। কিন্তু কিছুই হল না। দিব্যি সমাজ, পরিবেশ গ্রামটায়। তবে সারাক্ষণ ধরে নানারকমের হাওয়া দেয়। কোনোটা পাতলা হাওয়া, কোনোটা বেশ ভারি। গায়ে ধাক্কা লাগে। কেমন সিরসির করে ওঠে গা। গ্রামের মোড়ল শ্রীভূতনাথ মণ্ডল নেহাতই ভালো মানুষ। শংকরের কাছে বিভূতিবাবুর পরিচয় পেয়ে উনিতো বেজায় খুশি। বললেন, ‘ভুতলে লিকবেন তো লিখুন না যতখুশি। ভূতেই তো ভর্তি আমাদের সিরসিরে।’

অনেক লোকজন বউ-বাচ্চা-বুড়ো বিভূতিবাবু আর শংকরকে ঘিরে দাঁড়িয়ে দেখছিল। মোড়লমশাই আঙুল তুলে বললেন, ‘এই যে লোকগুলোকে দেখতিছেন এদের মধ্যিই কতজনা তেনারা রইচেন কে জানে। মানুষের রূপ ধরি আপনেদের দেখতি এয়েচে হয়ত।’

কথাটা শুনে বিভূতিবাবুর আবার গা সিরসির করে উঠল। বলে কী লোকটা! দিনদুপুরেও ভূত …যাহ!

গ্রামের ধারে ছোট্ট একটা মাটির বাড়িতে বিভূতিবাবু আর শংকরের থাকার ব্যবস্থা করা হল। বাড়িটার সামনে নিকোনো চকচকে উঠোন। চারদিকে তালপাতার বেড়া দেওয়া। বিভূতিবাবুর খুব পছন্দ হল বাড়িটা। ভূতনাথ বাবু বললেন, ‘এই ঘরটা ছিল কালীবুড়ির। খুব ভালো মানুষ ছিল। তো বুড়ি মারা যাবার পরেও ঘরের মায়া ছাড়তি পারেনি। এখনো নিজের ঘরেই থাকে। কিন্তুক গাঁয়ে অতিথি এলি দিব্বি নিজের ঘর ছেড়ি দেই, তালগাছটায় থাকে তখন।’

বিভূতিবাবু বারদুয়েক ঢোক গিলে সামনের তালগাছটার দিকে তাকালেন। হাওয়াতে না-কীসে কে জানে তালগাছের মাথাটা দুলছে।

‘তবু কোনো অসুবিধা হলে জানাবেন। রাবণ ওঝাতো আছেই’ বলে নমস্কার জানিয়ে ভূতনাথবাবু চলে গেলেন।

বিভূতিবাবুর মাথায় এর মধ্যেই গোটা দু-খানা প্লট খুরপাক খেতে শুরু করেছিল। শংকর ঘরদোর গুছিয়ে বাবুকে ডাকতেই বিভূতিবাবু একলাফে কাগজ-কলম নিয়ে লিখতে বসে গেলেন। বেশ কিছুক্ষণ সাঁইসাঁই লেখার পরেই তাকে কলম থামাতে হল। আশেপাশে কারা যেন গুজগুজ ফুসফুস করছে। চারদিকে তাকালেন। কিছু নেই। অথচ পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে কারা যেন তার খুব কাছেই ফিসফাস করছে। বিভূতি গুঁই পোড়খাওয়া ভূতের গল্পলেখক। জীবনে বহু গল্পে তিনি এমন সিচুয়েশন লিখেছেন তাই খুব অল্পসময়ের মধ্যেই বুঝে ফেললেন ব্যাপারটা আসলে কী। তেনারা সব এসেছেন। বিভূতিবাবুকে নিয়েই গল্পগাছা করছে নিজেদের মধ্যে। যাকগে করুক। তাকে ডিসটার্ব না-করলেই হল। মনটাকে সাংঘাতিক শক্ত করে আবার লেখায় মন দিলেন তিনি। রাত্রি দশটা পর্যন্ত হ্যারিকেনের আলোতে পাক্কা পনেরো পাতা লিখে বেজায় ক্লান্ত হয়ে কলম বন্ধ করলেন বিভূতিবাবু। মনটা খুশিতে নাচছে। সাংঘাতিক ভালো হচ্ছে গল্পটা। কাল সকালের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে। এরপর আরো দুটো গল্পের প্লটও এসে গেছে মাথায়। এখানকার ভূতগুলো সম্পর্কেও খুবই ভালো ধারণা হল বিভূতিবাবুর। তারা শুধু বিভূতিবাবুকে দেখেশুনে ফিরে গেছে। কেউ তার কাজে এতটুকু ব্যাঘাত ঘটায়নি। রাত্রে মুরগির মাংস বানিয়েছিল শংকর। খাঁটি দেশি মুরগি। খেয়েদেয়ে উঠোনো এসে দাঁড়ালেন। বিশাল আকাশটায় ভর্তি তারা। ঠান্ডা-ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে। এক-একটা হাওয়ায় আবার সেই ফিসফিস শব্দ। বিভূতিবাবু বুঝেও গেলেন, তেনাদের কেউ কেউ হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে চলেছেন। উহ দারুণ জায়গা বটে। কেন যে এতদিন আসেননি। ভাগ্যিস আর কোনো ভূতের গল্পলেখক এখানের খবরটা পায়নি। নইলে … ভাবতে ভাবতে বাড়ির সামনের তালগাছটার মাথায় চোখ পড়তেই ছ্যাত করে উঠল বুক। সাদা কাপড় মুড়ি দেওয়া কে যেন তাল গাছটার মাথায় বসে রয়েছে। চোখ রগড়ে নিয়ে আবার ভালো করে তাকালেন বিভূতিবাবু,… হ্যাঁ সত্যিই তো… হঠাৎ মনে পড়ল মোড়ল মশাইয়ের বলা সেই কালীবুড়ির কথা। এই ঘরটাই তো কালীবুড়ির।

বিভূতিবাবু রয়েছেন বলে বুড়ি এখন নিজের ঘর ছেড়ে দিয়ে তালগাছে রয়েছে। নিমেষে ভয় উধাও হয়ে গিয়ে মনটা কালীবুড়ির জন্য শ্রদ্ধায় ভরে উঠল তার। দুম করে হাতজোড় করে দু-বার প্রণামও করে ফেললেন তালগাছের মাথাটাকে উদ্দেশ্য করে।

সকালে ঘুম থেকে উঠেই চক্ষু চড়কগাছ। একী কাণ্ড! গতকাল সারাসন্ধে ধরে যে গল্পটা লিখেছিলেন, আর একটু মাত্র বাকি ছিল, একরাত্তিরেই গল্পটা পুরো পালটে গেছে। বিভূতিবাবুর লেখার সঙ্গে কোনো মিল নেই। কী বিচ্ছিরি হয়েছে গল্পটা। কোনো মাথামুণ্ডু নেই। কোথাও কোথাও আবার শব্দ-অক্ষরগুলো পর্যন্ত উলটে-পালটে গেছে। মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন বিভূতিবাবু। কে করল এমন সর্বনেশে কাণ্ড?

শংকর পুরো ব্যাপারটা শুনে গম্ভীর হয়ে বলল ‘হুম বুঝেছি। এটা তেনাদেরই কারো কম্ম হবে। আপনি এক কাজ করুন বাবু, আজকে আবার গল্পটা লিখুন। তারপর বাক্সতে ভরে তালাচাবি দিয়ে দেবেন। ব্যাস আর চিন্তা নেই। শংকরের কথা শুনে বিভূতিবাবু আবার লিখতে বসলেন গল্পটা। সকাল থেকে সন্ধে, সন্ধে থেকে রাত্তির গড়িয়ে ন-টার সময় শেষ হল লেখাটা। আগের থেকে আরো ভালো হয়েছে গল্পটা। শংকরকে ডেকে নিজের মোটা চামড়ার সুটকেসটার জামাকাপড়ের ভাঁজে গল্পটা রাখলেন। তারপর বাক্সে তালা দিয়ে চাবি নিজের বালিশের নীচে রেখে নিশ্চিন্তে ঘুম।

পরদিন সকালে উঠে দুরুদুরু বুকে চাবি দিয়ে বাক্সের তালা খুললেন। তারপর জামার ভাঁজ থেকে গল্পটা বার করে চোখের সামনে মেলে ধরতেই আবার মাথায় বজ্রপাত। সবেবানাশ, ফের পালটে গেছে! প্রায় কেঁদে ফেললেন বিভূতিবাবু। এত পরিশ্রম আবার জলে গেল। পুরো গল্পটা আবার উলটে-পালটে চটকানো।

শংকরবাবুর এমন কাহিল অবস্থা দেখে বিভূতিবাবুর টাকে হাত বুলিয়ে বলল, ‘ব্যবস্থা আরো কঠিন করতে হবে।’

তারপর পুরো তিন-তিনটে দিন একই ঘটনা। বিভূতিবাবু রোজ প্রচণ্ড পরিশ্রম করে গল্পটা লিখলেন আর রাত্তিরে সেটা পালটে যেতে থাকল। একদিন বাক্সতে গল্পটা ভরে তালাচাবি দিয়ে তার ওপর মোটাদড়ি দিয়ে বাক্সটা কষে বাঁধা হল। কোনো লাভ হল না। পরদিন বাক্সটা দড়ি দিয়ে বাঁধার পর বিভূতিবাবু নিজে সারারাত বাক্সর ওপর জেগে বসে রইলেন। তারপরেও একই কাণ্ড। শেষদিন শংকর আর উনি সারারাত দুজনে গল্পটাকে চেপে ধরে রইলেন। সারারাত কিছু হল না। ভোরের দিকে দুজনেরই কখন একটু চোখ লেগে গেছিল, চোখ খুলতেই …. যাহ আবার গেছে!

সকালে মোড়লমশাই এসেছিলেন বিভূতিবাবুর গল্পের কদ্দূর কী হল জানার জন্য। শংকর আর বিভূতির এমন কালো চেহারা দেখে উনি বেজায় ঘাবড়ে গেলেন। তারপর বিভূতিবাবুর কাছে পুরো ঘটনা শুনে সাংঘাতিক রেগে গিয়ে বললেন, ‘আমাকে আগে জানাননি কেন?… আহরে এত খাটুনির কাজ সব পণ্ড…. এ নিশ্চয়ই ব্যাটা পাঁচুগোপালের কম্ম।’ ‘কে পাঁচুগোপাল’ উদাসভাবে জিজ্ঞেস করলেন বিভূতিবাবু।

‘আর বলবেননি। পাঁচু ছিল এই গায়ের নাম করা সিঁদেল চোর। মহাচালাক। কিছুতেই ধরা যেত না। ব্যাটা যেখানে-সেখানে লুকিয়ে পড়তে পারত। একবার পাশের গ্রামে চুরি করতে গিয়ে লোকের তাড়া খেয়ে একটা পুকুরে পাকা দেড়দিন ডুবে লুকিয়েছিল। গ্রামের লোকেরাও ছাড়েনি। সারাদিন ধরে পুকুরের পাশে বসেই পাহারা দিয়েছিল সকলে। শেষপর্যন্ত আর থাকতে না-পেরে পাঁচু ভেসে উঠেছিল তবে জ্যান্ত আর ধরা দেয়নি, মরা। তো ব্যাটার মরার পরেও স্বভাব যায়নি। এখনতো ভূত হয়ে আরো সুবিধে হইছে। চোখেও দেখা যায় না। এর-ওর পুকুরের মাছ ও চুরি করে। যার-তার ঘরে ঢুকে জিনিসপত্তর লোপাট করে। ঘেঁটেঘুঁটে দেয়। এইতো দিন চারেক আগেই আমার পুকুরটার সব মাছ সাবাড় করে পুকুরেই লুকিয়ে ছিল। রাবণ ওঝা এসে মন্ত্রপুত জাল ফেলে ব্যাটাকে ধরে এইসান পিটুনি দিয়েছে যে তারপর থেকে ওর টিকিটি নেই ওই বজ্জাতটাই এখানে এসে আপনার কাজ পণ্ড করছে। চিন্তা নেই আমি রাবণ ওঝাকে ডেকে আনছি।

ঠিক কাঁটায় কাঁটায় দুপুর দুটোর সময় ভূতনাথবাবু রাবণ ওঝাকে সঙ্গে নিয়ে উপস্থিত হলেন। বিভূতিবাবু মনে মনে কল্পনা করেছিলেন রাবণ ওঝার চেহারা রাবণের মতোই হবে। কিন্তু পুরো উলটো। ফুঁ দিলে উড়ে যাবে এমন লিকপিকে চেহারা। কদমছাঁট চুল। কপালে কমলা রঙের লম্বা টিপ। পরনে লাল রঙের ফতুয়া আর লুঙ্গি। গলায় নাভি পর্যন্ত ঝোলানো ইয়া মোটা রুদ্রাক্ষের মালা। রাবণ ওঝা এসেই তার মোটা ভুরু দুটো কুঁচকে সটান শুয়ে পড়ল মাটিতে তারপর লম্বা নাকটা মেঝেতে ঠেকিয়ে বারকয়েক মাটির গন্ধ নিয়ে তড়াক করে উঠে পড়ে বলল ‘পেয়ে গেছি। সেই আঁশটে গন্ধ। ব্যাটা এখানেই কোথাও লুকিয়ে আছে।’ বলেই আকাশ ফাটানো চিৎকার করে উঠল রাবণ। ‘এ্যাই বজ্জাত, ভালো চাসতো এক্ষুনি এঘর ছেড়ে পালা। ছি-ছি গাঁয়ের অতিথির সঙ্গে কিনা বদমাসি, আজ তোর কান কেটে যদি কিমা না-বানিয়েছি তো আমার নাম রাবণ ওঝা নয়।’ এই বলে ফতুয়ার পকেট থেকে এক খাবলা কীসের গুঁড়ো বার করল রাবণ। জিনিসটা কী বোঝার আগেই হাওয়ায় চোখ-নাক জ্বলে উঠল বিভূতিবাবুর। ওরে বাপরে, রাবণ শুকনো লংকার গুঁড়ো বার করেছে।

রাবণ ওঝার চোখ-মুখ পালটে গেছে ততক্ষণে। বড়ো বড়ো চোখ দুটো লাল টকটকে। চোখের গুলিদুটো সাঁইসাঁই করে এদিক-ওদিক পাক খাচ্ছে।

‘আপনার সমস্যার জায়গাটা দেখানতো’ প্রচণ্ড ভারি গলায় বলল রাবণ। ‘এ্যাঁ … হ্যাঁ হ্যাঁ’ বলে বিভূতিবাবু দৌড়ে গিয়ে প্রায় পাঁচ-ছয় বার লেখা গল্পটার কাগজগুলো রাবণের সামনে এনে সবে করুণ সুরে নিজের দুঃখের কাহিনিটা বলতে যাবেন, রাবণ হাত তুলে বিভূতিবাবুকে থামিয়ে দিল। ‘কিছু বলতে হবে না। আমি সব শুনে নিয়েছি। মজা দেখাচ্ছি ওর। কাগজগুলো ওই টেবিলটার ওপর রাখুনতো। আর আমাকে একটা লাঠি দেন বেশ মোটা দেখে।’

বিভূতিবাবু দুরুদুরু বুকে কাগজগুলোকে টেবিলের ওপর রাখলেন। শংকর কী ভেবে ঘরের দরজার বিশাল মোটা খিলটা এনে দিল রাবণকে। খিলটা হাতে নিল রাবণ। তারপর পকেট থেকে লাইটার বার করে হাতের গুঁড়ো লংকাটুকু একটা কাগজে ঢালল, ঢেলেই ফস করে জ্বালিয়ে দিল কাগজটা।

ওরে বাপরে, কাকে বলে চোখ-মুখে জ্বালা। চোখে অন্ধকার দেখলেন বিভূতিবাবু। রাবণ কিন্তু নির্বিকার। পোড়া লংকা বিভূতিবাবুর গল্পের কাগজে ঢেলে দিয়ে খিল তুলে দমাদম পিটোতে শুরু করল। পেটাই পর্ব শুরু হবার একটু পরেই বিভূতিবাবু দেখলেন তার লেখা কাগজগুলোর অক্ষরগুলো সব ঠ্যাঙানির চোটে পাঁই পাঁই করে এদিক-ওদিক পালাচ্ছে। তিড়িংবিড়িং লাফাচ্ছে। ঘুরপাক খাচ্ছে। রাবণ মনোযোগ দিয়ে অনেকক্ষণ ধরে প্রত্যেকটা কাগজকে আলাদা আলাদা করে পেটাল। তারপর একসময় বিভূতিবাবু নিজের চোখে স্পষ্ট দেখতে পেলেন তার গল্পের কাগজ থেকে ধোঁয়ার মতো কীসের একটা ডেলা থপ করে মেঝেতে পড়ল। রাবণ ওঝার আরেকটা খিলের বাড়ি ওটঠার ঘাড়ে পড়তেই সাঁ করে জানলা দিয়ে গলে উড়ে গেল ডেলা পাকানো ধোঁয়াটা।

আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না পঁচিশ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ভূতের গল্পলেখক বিভূতি গুঁই, সব ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে ‘আঁ-আঁ-আঁ হ্যাঁক… ধুর ছাই’ বলে জীবনে প্রথম খুব অনিচ্ছা সত্ত্বেও অজ্ঞান হয়ে গেলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *