বিভীষিকার দ্বীপ (ছোট গল্প)
ক্যালিফোর্নিয়ার উপকূল থেকে কয়েক মাইল দূরে অবস্থিত একটি ছোটো নাম-না-জানা দ্বীপের কাছেই সমুদ্রের উপর দেখা দিল একটি মাছ-ধরা জাহাজ। দ্বীপের মধ্যে একটা বড়ো পাথরের উপর হঠাৎ লাফিয়ে উঠল একটি মানুষ, হাতে তার রাইফেল। শূন্যে গুলি ছুঁড়ে লোকটি জাহাজের আরোহীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করল। মনে হল জাহাজের গতি একটু মন্থর হয়েছে। উৎসাহিত হয়ে লোকটি এইবার হাত তুলে চিৎকার করতে লাগল। হঠাৎ লোকটি শুনতে পেল তার পিছনে একটা অস্পষ্ট গর্জনধ্বনির সঙ্গে সঙ্গে শক্ত পাথুরে মাটির উপর জেগে উঠেছে ধাবমান খুরের খট খট শব্দ!
পিছন ফিরে তাকানোর আগেই লোকটি অনুভব করল তার বাঁ হাতের উপর এসে পড়েছে এক দারুণ যাতনাদায়ক আঘাত। পরক্ষণেই প্রচণ্ড ধাক্কায় তার দেহটা পাথরের উপর থেকে নীচের জমিতে ছিটকে পড়ল!
আহত মানুষটি এই অপ্রত্যাশিত আক্রমণের ফলে হতভম্ব হয়ে পড়েনি, বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো মাটি থেকে লাফিয়ে উঠে সে ভূমিপৃষ্ঠে লম্বমান রাইফেলটার দিকে যেভাবে হাত বাড়িয়ে দিল তাতে বোঝা গেল তার পিছনে দৃষ্টির অগোচরে যে ঘটনা ঘটেছে সে বিষয়ে সে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল। রাইফেল হাতে তুলে নিতে না নিতেই আবার জাগল খট খট খুরধ্বনি, পরক্ষণেই পাথরটার যেদিক থেকে সে উল্টে পড়েছিল তার বিপরীত দিক থেকে সংহারমুর্তিতে আত্মপ্রকাশ করল এক ধাবমান বরাহ!
চকিতে পকেট থেকে টোটা নিয়ে লোকটি ক্ষিপ্রহস্তে রাইফেলে টোটা ভরে ফেলল। আক্রমণোদ্যত শূকর তখন খুব কাছে এসে পড়েছে, এক মুহূর্তের জন্য লোকটির চোখে পড়ল রক্তলাল মুখগহ্বরের ভিতর থেকে দুই চোয়ালের বহির্ভাগে উঁকি দিচ্ছে একজোড়া সুদীর্ঘ দন্ত।
পরক্ষণেই রাইফেল সশব্দে অগ্নি-উদগার করল। শূকর আহত হল, তার ডান দিকের কাধ ভেঙে গিয়ে ডান পা বেঁকে গেল কিন্তু তবু তার গতিরুদ্ধ হল না। একেবারে শত্রুর সামনে এসে বরাহ চরম আঘাত হানতে উদ্যত হল।
গুলি ছোঁড়ার সময় ছিল না। মানুষটি এইবার রাইফেলকে লাঠির মতো ব্যবহার করল; প্রচণ্ড সংঘাতে রাইফেলের বাঁট এবং শূকরের একটি দাঁত ভেঙ্গে গেল সশব্দে।
শূকর ভূমিশয্যা গ্রহণ করল। কিন্তু মুহূর্ত পরেই সে আঘাত সামলে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতে লাগল। হাতের ভাঙা রাইফেল ফেলে লোকটি দৌড়ে পালাতে গেল কিন্তু পাথরে হোঁচট খেয়ে আছড়ে পড়ল ভূমিপৃষ্ঠে।
মাটির উপর শুয়ে শুয়েই লোকটি সভয়ে দেখল, শূকরটা টলতে টলতে তার দিকে এগিয়ে আসার চেষ্টা করছে। শূকরের দক্ষিণ স্কন্ধের অস্থি প্রথমেই গুলির আঘাতে ভেঙে গিয়েছিল। লোকটি দেখল রাইফেলের বাঁটের আঘাতে তার বাঁ দিকের পা এবং চোয়ালের নীচের অংশও জখম হয়েছে। তবু প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য এগিয়ে আসার চেষ্টা করছে আহত বরাহ।
লোকটি তাড়াতাড়ি উঠে আবার পলায়নের চেষ্টা করল এবং সভয়ে আবিষ্কার করল তার তিন দিকে অবস্থান করছে বৃহৎ পাথরের প্রাচীর আর সামনের সংকীর্ণ পথের উপর দিয়ে তার দিকে এগিয়ে আসছে জান্তব হিংসার এক শরীরী প্রতিচ্ছবি।
নিরস্ত্র মানুষটি এক পা পিছিয়ে গেল, তার পৃষ্ঠদেশ স্পর্শ করল কঠিন পাথরের দেওয়াল…
আচ্ছা, এইবার আমরা জানতে চাইব এই জনমানবহীন দ্বীপের উপর মানুষটা এল কোথা থেকে এবং কেন এল? আর বিস্তীর্ণ জলরাশির মধ্যে অবস্থিত এই ছোটো ভূ-খণ্ডের উপর স্থলচর বরাহই বা আবির্ভূত হল কেমন করে? এ সব কথা জানতে হলে কয়েকটি বিষয় আলোচনা করা দরকার।
স্পেনের মানুষ যখন প্রথম আমেরিকাতে উপনিবেশ স্থাপন করার চেষ্টা করে তখন তারা দেখতে পায় আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে আছে র্যাটল স্নেক নামক অসংখ্য বিষধর সর্প। সাপের উপদ্রব থেকে বাঁচার জন্য স্প্যানিয়ার্ডরা তাদের মাতৃভূমি স্পেন থেকে একদল শূকর আমদানি করল। শুকরগুলি সর্পভুক। সাপের দাঁত এই পশুগুলোর কঠিন রোমশ চর্ম ভেদ করে বিষ ঢালতে পারে না। এইভাবে স্পেনের শূকর আমেরিকার বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ল। কালক্রমে স্প্যানিয়ার্ডরা বিদায় নিয়েছে, আমেরিকার ইতিহাসেও বহু পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু শুকরের বংশ আমেরিকার সমগ্র অঞ্চল থেকে লুপ্ত হয়ে যায়নি। প্রশান্ত মহাসাগরের কয়েকটি দ্বীপের উপর স্প্যানিয়ার্ডরা ওই জন্তুগুলিকে ছেড়ে দিয়েছিল কারণ ওইসব জায়গা ছিল র্যাটল-স্নেক নামক বিষাক্ত সাপের প্রিয় বাসভূমি।
ওই দ্বীপগুলি থেকে ক্রমশ মানুষের বাস উঠে গেছে; কিন্তু শূকরবংশ লোপ পায়নি। বন্য প্রকৃতির সংস্পর্শে তাদের আকৃতি ও প্রকৃতি হয়ে উঠেছে অত্যন্ত ভয়াবহ, মাংসাশী শ্বাপদের মতোই তারা হয়ে পড়েছে হিংস্র ও রক্তলোলুপ জীব।
এই কাহিনিতে বর্ণিত দ্বীপেও ওইরকম এক দল শূকর অবস্থান করছিল। স্থানীয় মানুষ ছাড়া বাইরের লোক এই ভয়াবহ দ্বীপের বিষয় কিছুই জানত না। হঠাৎ একদিন ক্যালিফর্নিয়াতে উপস্থিত হল বিল ব্রায়ান্ট নামক একজন শিকারি এবং দুর্ভাগ্যক্রমে ওই দ্বীপের জনশ্রুতি তাকে আকৃষ্ট করল। বিল ভাবল একবার ওই দ্বীপে ঘুরে আসতে পারলে একটা অ্যাডভেঞ্চার করা যায়। মাংসাশী শূকরের ভয়াবহ কাহিনি তার কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি।
একটা জাহাজের অধ্যক্ষের সঙ্গে বন্দোবস্ত করে ওই দ্বীপের অভিমুখে যাত্রা করল বিল। দ্বীপ থেকে একটু দূরে জাহাজ থামিয়ে একটা ছোটো জাহাজি বোট বা নৌকো চালিয়ে বিল পূর্বোক্ত দ্বীপে পদার্পণ করল। জাহাজের অধ্যক্ষের সঙ্গে বিলের কথা ছিল দিন চারেক বাদে জাহাজ আবার এইখানে আসবে এবং বিলকে নিয়ে যাবে।
যে নৌকোটায় চেপে বিল দ্বীপে এসে উঠেছিল সেটাকে সে বেলাভূমির উপর রাখল। নৌকোর ভিতর ছিল বন্দুক ছুরি, খাদ্য, তাবু খাটানোর সরঞ্জাম প্রভৃতি বিভিন্ন ধরনের দরকারি জিনিস।
দ্বীপে এসে পৌঁছোনোর আগে পর্যন্ত বিল খুবই উৎসাহ বোধ করছিল কিন্তু জাহাজটা যখন তার দৃষ্টির সীমা ছাড়িয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল তখন সে হঠাৎ খুব নিঃসঙ্গ বোধ করল। মনের নিরুৎসাহ ভাব দমন করে দ্বীপটাকে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করার জন্য সে পা চালিয়ে দিল…
দ্বীপের সামনে বেলাভুমির কাছে হালকা ঘাসজমি ভিতর দিকে ক্রমশ নিবিড় অরণ্যে পরিণত হয়েছে এবং চতুর্দিকে ছড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য ছোটোবড়ো পাথর ও পাহাড়। এক জায়গায় নরম মাটির উপর শূকরের খুরের চিহ্ন বিলের দৃষ্টিগোচর হল। এই দ্বীপে যে শূকরের অস্তিত্ব আছে সে বিষয়ে সন্দেহ করার কোনো কারণ রইল না। একটা পাহাড়ের উপর উঠে বিল চারদিকে দৃষ্টিপাত করতে লাগল এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই নির্জন দ্বীপের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তাকে সব কিছুই ভুলিয়ে দিল।
বেলাভূমির উপর আছড়ে পড়ছিল সাগরের ঢেউ আর মুক্তপ্রকৃতির বুকে দাঁড়িয়ে তন্ময় হয়ে সেই অপুর্ব সৌন্দর্য উপভোগ করছিল বিল- হঠাৎ একটা পাখির দিকে তার দৃষ্টি আকৃষ্ট হল।
পাখিটা হচ্ছে সী-গল নামক এক ধরনের সামুদ্রিক চিল। বালির উপর ধীরে ধীরে পা চালিয়ে ঘুরছিল পাখিটা, তার একটু দূরেই পড়েছিল কয়েকটা বৃহৎ প্রস্তরখণ্ড। পাখিটা নীচু হয়ে মাটি থেকে কিছু একটা ঠোঁট দিয়ে তুলে নেওয়ার চেষ্টা করল আর ঠিক সেই মুহূর্তে পাথরের নীচে ছায়ায়-আচ্ছন্ন অন্ধকার যেন অকস্মাৎ জীবন্ত হয়ে ছুটে এল!
বিল সচমকে দেখল একটা ধূসর বাদামি চতুম্পদ দেহ পাথরগুলোর তলা থেকে ছুটে এসে ঝাঁপিয়ে পড়েছে পাখিটার উপর। একটা আর্ত চিৎকার করেই পাখিটা স্তব্ধ হয়ে গেল, এক জোড়া নিষ্ঠুর চোয়াল তাকে সজোরে চেপে ধরেছে।
বিল প্রথমে ভেবেছিল ওটা একটা নেকড়ে কিন্তু একটু পরেই তার ভুল ভেঙে গেল। নেকড়ের মতোই হালকা ছিপছিপে পেশীবহুল দেহ এবং নেকড়ের মতোই বাদামি-ধূসর দেহবর্ণের অধিকারী হলেও জন্তুটা নেকড়ে নয়- শূকর।
শূকরের এমন হিংস্র ভয়ংকর চেহারা বিল কখনো কল্পনা করতে পারেনি। দারুণ বিস্ময়ে সে স্তম্ভিত হয়ে গেল জনশ্রুতি তা হলে মিথ্যা নয়।
আচম্বিতে বিলের পিছন থেকে ভেসে এল এক অদ্ভুত শব্দের তরঙ্গ! খট-খট-খট-খট শব্দে পাথুরে মাটিতে খুর বাজাতে বাজাতে যেন ছুটে আসছে কয়েকটা ঘোড়া তারই দিকে!
বিল পিছন ফিরে চাইল না- শব্দের উৎপত্তির কারণ যে ধাবমান অশ্বখুর নয় এটুকু বুঝতে তার একটুও দেরি হয় নি সামনে যে গাছটা ছিল চটপট হাত-পা চালিয়ে বিল সেটাতেই উঠে পড়ল।
ভালোই করেছিল, কারণ বিল গাছে উঠতে না উঠতেই সেখানে এসে উপস্থিত হল ছয়-ছয়টা শূকর!
একটা গাছের ডালে বসে পা দুটোকে বিল ঝুলিয়ে দিয়েছিল। কয়েকটা মাংস-লোলুপ বরাহ সেই দোদুল্যমান পা দুটিকে লক্ষ্য করে লাফ দিল। তাদের চেষ্টা অবশ্য ব্যর্থ হল, কারণ গাছটা খুব বড়ো না হলেও বিল শুকর বাহিনীর নাগালের বাইরে অবস্থান করছিল। কয়েকটা জন্তু ব্যর্থ আক্রোশে গাছটাকে আক্রমণ করল, দীর্ঘ দন্তের আঘাতে কয়েক জায়গায় গাছের ছাল উঠে গেল।
দারুণ আতঙ্কে বিলের বুকের ভিতর দপ দপ করছিল, নিজেকে সামলে নিয়ে সে রাইফেল বাগিয়ে ধরল।
গর্জে উঠল রাইফেল, আহত ও রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে পড়ে ছটফট করতে লাগল দুটি শূকর। অন্যান্য শুকরগুলি তৎক্ষণাৎ আহত সঙ্গীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, ধারালো দাঁতের আঘাতে আহত জন্তু দুটিকে টুকরো টুকরো করে শূকরগুলি স্বজাতির মাংসে বীভৎস ভোজসভা বসিয়ে দেওয়ার আয়োজন করল।
কিন্তু জন্তুগুলি তাদের ভয়াবহ ক্ষুধা পরিতৃপ্ত করার সুযোগ পেল না, ঘন ঘন গর্জনে বারংবার অগ্নিবৃষ্টি করল শিকারির রাইফেল, একে একে সব কয়টি শুকরই গুলি বিদ্ধ হয়ে প্রাণবিসর্জন দিল।
বিল এইবার গাছের আশ্রয় ছেড়ে মাটিতে অবতীর্ণ হল। তার অ্যাডভেঞ্চার করার শখ মিটে গিয়েছিল, অত্যন্ত সাবধানে ভয়ে ভয়ে সে নৌকোটার দিকে এগিয়ে চলল। ঘন ঘাসঝোঁপ ও জঙ্গলের রাস্তায় সে পা দিল না, যত দূর সম্ভব ফাঁকা জায়গার উপর দিয়েই সে পদচালনা করছিল।
নৌকোটা তার দৃষ্টিপথে আসতেই বিল চমকে উঠল। সাত-সাতটা শূকর হানা দিয়েছে তার নৌকোটার উপর! জন্তুগুলো চিৎকার করছে, গর্জন করছে এবং ধারালো ছোরার মতো দাঁত দিয়ে টুকরো টুকরো করে ফেলছে নৌকোর উপর অবস্থিত যাবতীয় সামগ্রী!
দারুণ ক্রোধে বিল হাতের রাইফেল তুলে ধরল। কিন্তু ক্রোধ তার চৈতন্যকে আচ্ছন্ন করে দিতে পারে নি, ঠান্ডা মাথায় লক্ষ্যস্থির করে সে গুলি চালাতে লাগল শূকরগুলির উপর।
এক-একটা শূকর গুলি খেয়ে পড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই অন্য জন্তুগুলি আহত সঙ্গীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে ছিন্ন ভিন্ন করতে থাকে।
আবার গর্জে ওঠে রাইফেল, আর একটি শূকরও গুলিবিদ্ধ অবস্থায় লুটিয়ে পড়ে সঙ্গীদের দ্বারা আক্রান্ত হয় এবং গর্জিত রাইফেলের অগ্নিবৃষ্টির কল্যাণে একই ঘটনার হয় পুনরাবৃত্তি।
এই ভাবে একে একে সাতটি জানোয়ারই গুলি খেয়ে মারা পড়ল। বিল তখন ছুটে এল নৌকোটার দিকে। নৌকোর দশা দেখে বিলের কান্না পেল। খাবার-দাবার, জিনিসপত্র সব কিছুই হয়ে গেছে ছিন্নভিন্ন, নৌকোটাও অব্যাহতি পায়নি– ধারালো দাঁতের আঘাতে আঘাতে নৌকোটা টুকরো টুকরো কাঠের স্তূপে পরিণত হয়েছে, সেটাকে আর নৌকো বলে চেনা যায় না!
বিল ব্রায়ানট বুঝল, সে ফাঁদে পড়ে গেছে, নৌকো ছাড়া সমুদ্রের বুকে পাড়ি দেওয়ার উপায় নেই। দ্বীপের ভিতর রয়েছে সাক্ষাৎ মৃত্যর মতো শুকরের দল এবং তার কাছে রাইফেলের টোটা আছে মাত্র চারটি। একটি টোটা রাইফেলে ভরা ছিল, বাকি তিনটি অবস্থান করছিল তার পকেটের মধ্যে। বিল দাঁড়িয়ে ভাবছে, হঠাৎ তার কানে এল একটা যান্ত্রিক শব্দ মোটর!
শব্দটা বিলের খুবই পরিচিত, নিকটবর্তী সমুদ্রের বুকে ধাবমান মোটর-চালিত ক্রুজারের ইঞ্জিন থেকেই যে ওই শব্দটা ভেসে আসছে এ বিষয়ে বিলের কিছুমাত্র সন্দেহ ছিল না। সে তাড়াতাড়ি ছুটে একটা বড় পাথরের উপর উঠে দাঁড়াল, তারপর রাইফেলের গুলি ছুঁড়ে আর চিৎকার করে ক্যাপ্টেনের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করতে লাগল।
এই সময় হঠাৎ পিছন থেকে অতর্কিতে আক্রান্ত হয়ে বিল যে পাথরের উপর থেকে নীচের জমিতে পড়ে যায় সে কথা বর্তমান কাহিনির গোড়ার দিকেই বলা হয়েছে। পরবর্তী অবস্থায় আক্রমণকারী বরাহ বিলের রাইফেলের গুলিতে আহত হয়েও যখন তার দিকে তেড়ে আসে, তখন দ্বিতীয়বার গুলি চালানোর সুযোগ না পেয়ে বিল যে রাইফেলটাকে লাঠির মতো ব্যবহার করেছিল এবং অস্ত্রটার যে বাঁট ভেঙে গিয়েছিল একথাও কাহিনির প্রথম দিকেই বলা হয়েছে।
এইবার দেখা যাক নিরস্ত্র শিকারি ও আহত বরাহের দ্বযুদ্ধের পরিণাম কি হয়।
শূকরটা এগিয়ে আসার চেষ্টা করল, কিন্তু সামনের দুটি পা জখম হওয়ায় ভারসাম্য রাখতে না পেরে মাটিতে পড়ে গেল। অবশ্য তৎক্ষণাৎ সে আবার উঠে দাঁড়াল। ইতিমধ্যে বিলের মনে পড়ে গেছে কোমরের খাপে আটকানো ছোরার কথা, চট করে খাপ থেকে হান্টিং নাইফ খুলে সে প্রস্তুত হল।
শুকর আবার আক্রমণ করল। তার প্রকাণ্ড মুখটা সবেগে এগিয়ে এল শত্রুর দিকে কিন্তু ভয়ংকর চোয়াল দুটো নরদেহের পরিবর্তে শূন্যতাকেই আবিষ্কার করল।
বিল তখন বরাহের পিঠের উপর দিয়ে এক প্রকাণ্ড লাফ দিয়েছে এবং শূন্যের উপরেই শরীরটা ঘুরিয়ে অবতীর্ণ হয়েছে শুকরের পৃষ্ঠদেশে!
বিল যেন হঠাৎ পাগল হয়ে গেল। এক হাতে জন্তুটাকে আঁকড়ে ধরে অন্যহাতে সে উন্মাদের মতো ছুরি চালাতে লাগল শূকরের গলায়, পাঁজরে, বুকে…
প্রাণহীন রক্তাক্ত মৃতদেহটা ফেলে দিয়ে বিল উধশ্বাসে ছুটল সমুদ্রের দিকে। দারুণ উত্তেজনায় তার সমগ্র চৈতন্য তখন আচ্ছন্ন হয়ে গেছে, প্রায় কোমর-জল পর্যন্ত পৌঁছে সে অনুভব করল, এক জোড়া বলিষ্ঠ বাহু তাকে জড়িয়ে ধরেছে।
ক্রুজারের আরোহীরা বিলের রাইফেলের শব্দ শুনতে পেয়েছিল এবং তাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য জাহাজ থামিয়ে একটা ডিঙি ভাসিয়ে আসছিল দ্বীপের দিকে। ওইডিঙি থেকে নেমে এক জন ধীবর প্রায়-অচেতন বিল ব্রায়ান্টকে জড়িয়ে ধরেছিল। পূর্বোক্ত ক্রুজার মাছ ধরার কার্যে নিযুক্ত ছিল, বিলকে তুলে নিয়ে মাছধরা ক্রুজারটি আবার তার নির্দিষ্ট পথে যাত্রা করল।