বিবেক আছে বিবেক নেই
বিবেক নিয়ে এক শ্রেণীর মানুষের বড়ই মাথা ব্যথা। বিবেক যদি লকারে ঢুকিয়ে চাবির পাশ ওয়ার্ড ভুলে যান বা চাবিটি গঙ্গা গোদাবরী নর্মদার জলে ফেলে দেন তবেই না আপনি আপনার জীবনে সব পাবেন। ধন ও মান। ক্ষমতা। বহুজনের সম্ভ্রম। আপনি দুধে ভেজাল দেন, ভেজাল ওষুধের ফ্যাক্টরি খুলে বসেছেন, ভাগাড়ের মাংসর কারবারে ফুলে ফেঁপে উঠেছেন, ব্যাঙ্কের কাছ থেকে কোটি টাকা লোন নিয়ে পগার পার হয়ে বিবেকের বাণী দিচ্ছেন, সবের মূল সেই চাবিটি যা কি না গঙ্গা গোদাবরীর জলে আপনি ফেলেছেন কি ফেলেননি। জীবনে সবই হবে বিবেক বর্জিত হয়ে থাকলে। আর যদি অপরটি হয়, বিবেক নিয়ে দিন রাত ভাবেন, দুধের লাইন থেকে, সমস্তদিন যা যা যেভাবে করা উচিত, তা না করে পারেন না। ভিতর থেকে সায় পান না লাইন ভেঙে আগে নিজের কাজটি করে ফেলার, কেরানি হয়ে টেবিলের নিচ থেকে হাত বাড়িয়ে টাকা নিয়ে অকাজের কাজটি আগে করে দেওয়া কিংবা বড় সায়েব হয়ে ফাইল জমিয়ে রেখে চাপ রাখা, কিছু বেনিফিট আসুক, তারপরে তো ফাইল নড়বে। আমি এক বিবেকবাবুর কথা বলি, একেবারে জীবনের অভিজ্ঞতা। ভেজাল নেই। অবাঙালি বড় সায়েব তরুণ, বছর চল্লিশ। প্রাণময়। তাঁর অধীনে যিনি ছোট সায়েব তিনি পুরাতন। ছোট সায়েব লেখেন। বই আছে কিছু। নাম আছে যে অবাঙালি বড় সায়েব জানেন। বড় সায়েবের পরিবার এই কলকাতা শহরের একশো বছরের পুরনো পরিবার। তাঁদের পরিবারের ব্যবসা আছে। তিনি ব্যবসায় না জুতে সিভিল সার্ভিস দিয়ে সরকারি চাকরিতে ঢুকেছেন। বলেন পাবলিক সার্ভিসে বহুত আনন্দ আছে, ব্যবসায় তা নেই। আনন্দ কেমন, না পাবলিকের মুখের হাসি দেখতে তাঁর ভালো লাগে। ভয় আর আশঙ্কা নিয়ে যে পাবলিক আসে, তার কথাটি মন দিয়ে শুনা গেলে অর্ধেক ভয় কেটে যায়। আর কাজটি যদি হয়ে যায়, সে যে কেমন আলো ফুটে ওঠে মুখের উপর তা তিনি এক্সপ্লেন করতে পারবেন না। তিনি বলেন ‘দত্ত সায়েব আপনি লিখেন, আপনি তা লিখতে পারেন’।
হ্যাঁ, বড় সায়েবের কাছে অনেক রকম অনুরোধ আসে, এই কাজটি করে দিন, ওই কাজটি করে দিন। আইন বড় বালাই। আইনকে আবার তিনি যত ভয় করেন, তাঁর অধীনস্ত ছোট সায়েব তার চেয়ে বেশি ভয় করেন। চাকরি আছে বছর দেড়। সারাজীবন উদ্বিগ্ন হয়ে কাটিয়ে গেলেন, ভুল হলো নাকি। আইনের বাইরে কাজ হলো নাকি? অল্প বয়সে ঝুঁকি নিয়ে যা করেছেন, করেছেন, কিন্তু তা করেছেন বিবেকের তাড়নায়। বিবেকের তাড়নায় তিনি আইন ভেঙেছিলেন। বেশি বয়সে বিবেক বিসর্জন দিয়ে আইন ভাঙতে তিনি পারবেন না। তা করতে মন সায় দেয় না। ভয়ও করে। অথচ উপর থেকে চাপ আছে। খুব চাপ। খোদ মহাকরণের চাপ। যা হয় না, তা যেভাবে হোক করে দিতে হবে। অল্প বয়সে বিবেকের তাড়নায় যে আইন ভেঙেছিলেন তার কথা মনে পড়ে। নিঃসন্তান বিধবা এক বৃদ্ধা যাবেন কাশীতে তীর্থ করতে, এক বিঘে জমি তার জন্য বেঁচে দেবেন। দেওরকে বলেছিলেন, এক বিঘে ধানীজমি নিয়ে তীর্থ যাত্রার পাথেয় দিতে। দেওর দিয়েছিল। বিনিময়ে তাঁর অজান্তে যাবতীয় সম্পত্তি বিক্রয় দলিলে ঢুকিয়ে নিয়েছিল। ভিটেটুকু পর্যন্ত। এক মাস বাদে তিনি কাশী থেকে ফিরে দ্যাখেন তাঁর ভিটেই আর নেই। মাটির বাস্তুভিটে ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছে দেওর। সব দখল করে নিয়েছে রেজিস্ট্রি করা দলিলের জোরে। তিনি তরুণ বিবেকবান কর্মী। সেই বিধবা তাঁর কাছে অভিযোগ করলে, তিনি সেই দলিলের নথিবন্ধন বন্ধ করে দিয়েছিলেন। যা করা যায় না তাই করেছিলেন। এর ফলে ভুগতে হয়েছিল তাঁকে, কিন্তু শেষ অবধি তাঁর জয় হয়েছিল। বিবেকবান উপরওয়ালাকে সব লিখিত ভাবে জানালে তিনি সমস্ত কথা শুনে, আইনের পথ বাতলে দিয়েছিলেন। কী ভাবে রায় লিখতে হবে বলে দিয়েছিলেন। আইন তো আইন। লিখনে তার নানা ব্যাখ্যা করা যায়। এখনো লিখনে মহাকরণের অনুরোধ মান্য করা যায় যদিও তা এক প্রতিষ্ঠানের বেআইনি কাজকে মান্যতা দেবে। জমি হাঙরের পক্ষে দাঁড়ানো হবে। কাজ আর হয় না। উপর থেকে চাপ আসে, তবু ছোট সায়েব ফেলে রাখেন। কী ভাবে করবেন? বড় সায়েবের অনেক গুণ। একবার এক ধনী ব্যক্তির কাজ আটকে ছিল। আগে করার জন্য তিনি এসেছিলেন দুটি সিঙ্গল মল্ট হুইস্কির বোতল নিয়ে। দুই সায়েবকে দেবেন। বড়দিন আসছে তো। বড় সায়েব ছোট সায়েবকে ডেকেছিলেন তাঁর চেম্বারে। তখন ধনী ব্যবসায়ী বসে আছেন সেখানে। বড় সায়েব জিজ্ঞেস করলেন ছোটকে, আচ্ছা, দত্ত সাহাব, আপনি ড্রিঙ্ক করেন? ছোট সায়েব চমকে গেছেন, বাইরের লোকের সামনে এই প্রশ্ন? জিজ্ঞেস করলেন, কেন স্যার?
করেন কি না বোলেন।
মাঝে মধ্যে, খুবই কম।
বাড়িতে ড্রিংক কোরেন না?
নো স্যার।
বড় সায়েব বলেন, হামার বাড়িতে ভি চোলে না, ওয়াইফ জানলে তুলকালাম হয়ে যাবে, আপনার?
ছোট সায়েব বলেন, আমার বাড়িতেও সে চল নেই স্যার।
লুকিয়ে রেখে দিবেন।
ছোট সায়েব বলেন, সম্ভব নয় স্যার।
হামার পক্ষেও তো ইম্পসিবল, তাহলে কী হবে?
ছোট অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, বুঝতে পারছি না স্যার।
এই দেখেন না, মিঃ গণপত, দুটা সিঙ্গল মল্ট হুইস্কি এনেছেন, হামি নন ড্রিংকার, আপনি ভি ড্রিংক কোরেন না, তবে কী হবে, বাড়িতে নিয়ে গেলে বিরাট অশান্তি হবে, সংসার ভেঙে যাবে, রিলেশন ব্রেক করে যাবে, দেখুন মিঃ গণপত, ইম্পসিবল, নিয়ে রাখার জায়গা নেই, অফিসে তো মদের বোতল রাখা যায় না, স্যরি, হামি ভাবলাম মিঃ দত্ত লিখেন, মদ-টদ চোলে, শক্তিদাকে দেখেছি একবার, কত খেতে পারতেন, কিন্তু ইনি তো শক্তিদা নন, পোয়েট হলে হতো ঠিক, ইনি দেখি হামার মতো, মদ না খেয়ে যে লিখা যায়, তা আমি এই প্রথম দেখলাম, স্যরি মিঃ গণপত।
মিঃ গণপত এবং তাঁর সঙ্গী বেরিয়ে যেতে বড় সায়েব বিষণ্ণ মুখে বললেন, কী ভাবে বলুন দেখি হামাদের, সব বিসর্জন দিয়ে এসেছি, হুইস্কির বোতল দিয়ে কাজ করাবে! বহুত ইনসাল্টেড ফিল করেছি আজ, চলুন আজ সন্ধ্যেয় হয়ে যাক।
এই বড় সায়েব চাপ খাচ্ছেন মহাকরণ থেকে। খোদ মন্ত্রীর স্ত্রী ওই জুয়েলারির নিয়মিত ভিজিটর। অনুরোধ এসেছে মন্ত্রীর স্ত্রীর, ভায়া মহাকরণ। একদিন বড় সায়েব জিজ্ঞেস করলেন ছোটকে, হবে না, না?
বেআইনি হবে স্যার।
হুঁ, কিন্তু প্রচুর চাপ।
কয়েকদিন বাদে অফিসের শুরুতেই বড় ডাকলেন ছোটকে, দত্ত সায়েব, প্লিজ কাম।
দত্ত সায়েব গিয়ে দ্যাখেন সিংহ সায়েবের সামনে বসে আছেন প্রভাবশালী ব্যক্তি। তাঁর হাত খুব বড়। স্বয়ং মন্ত্রীর স্ত্রী তাঁর ক্লায়েন্ট। তিনি নিজেই এসেছেন কাজটি কবে হবে জেনে নিতে। তাঁর উপস্থিতি আরো চাপের। সিংহ সায়েব বললেন, দত্ত সায়েব বসুন, আপনি তো লিখেন।
দত্ত অবাক, আবার এক হুইস্কি কেস নাকি? বললেন, কেন স্যার?
সিংহ সায়েব বললেন, নভেল লিখেন তো, দেখুন মিঃ চাউদুরি, ইনি একজন রাইটার, অ্যাওয়ার্ড ভি পেয়েছেন।
চৌধুরী হাত বাড়ালেন, আপনার কী কী বই আছে বলবেন, হামি পারচেস করাব।
আপনি বাংলা পড়েন? দত্ত জিজ্ঞেস করলেন।
বলতে পারি, পড়তে পারি না, হামার সব এমপ্লয়ী আছে, তারা পড়বে, পুরা এডিশন কিনে নেব।
বাহ বাহ বাহ, আপনি রয়ালটি পাবেন দত্ত সায়েব, আচ্ছা লিখে কত হয় বছরে?
দত্ত বলতে সিংহ হিশেব করলেন, মানে পার মান্থ দশ বারো হাজার।
কম বেশি।
তাতে কী হবে, এখন আপনি পঁচাশের উপর পান, দুটা ইনক্রিমেন্ট আছে, রিটায়ারমেন্টের সময় ষাট হয়ে যাবে প্রায়, তাই তো।
হবে হয়তো।
বারো হাজারে কি সংসার চলে মিঃ দত্ত?
মাথা নাড়লেন দত্ত, কী করে চলবে, সমরেশ বসু ব্যতীত আর কোনো লেখক লেখাকে পেশা করতে পারেননি, বাংলায় লিখে তা হয় না।
সিংহ চুপ করে থাকলেন, চিন্তিত হয়ে পড়লেন, বললেন, হামি ভেবেছিলাম আপনি লাখ লাখ টাকা লিখে পান, হামি ভেবেছিলাম…।
দত্ত বললেন, ভুল ভেবেছিলেন।
তাহলে কী হোবে মিঃ চাউডুরী?
মিঃ চৌধুরী বললেন, উনি তো চাকরির ইনকাম করেন, লিখাটা এক্সট্রা ইনকাম।
হামার বাড়ির বিজনেস আছে, পিতাজি চেয়েছিল হামি বিজনেসে ঢুকি, হামি না হয় বিজনেসে ঢুকে গেলাম, কাঠের বিজনেস করব, আসাম থেকে কাঠ আনব আর কলকাতায় বিক্রি করব, লেকিন দত্ত সায়েবের তো বিজনেস নেই, লিখাটা বিজনেসের মতো হয়নি, উনি কী করবেন?
মতলব? সূরজপ্রসাদ চাউডুরী বা চৌধুরী জিজ্ঞেস করলেন।
আপনার ফাইল ছেড়ে দিলে, মতলব আপনার ফেবারে কাম করে দিলে হামাদের দুজনের সার্ভিস নট হয়ে যাবে, উনি চাকরি শেষ করে এনেছেন, পেনশন গ্রাচুইটি কুছু মিলবে না, যে সায়েবরা বলছেন করে দিতে, তারাই বলতে পারে কেন করলে, কী আইনে করলে, যে লোকের ফেবারে কাজ হওয়া দরকার, তা না হলে, সে আর এক সায়েবকে ধরবে, চাকরি গেলে হামার কুছু হোবে না, বিজনেস আছে, লেকিন দত্ত সায়েবের কী হোবে বলুন, লিখে উনি অনেক পান হামি তাই ভেবেছিলাম।
সূরজপ্রসাদ চৌধুরী আর থাকেননি। কক্ষ ত্যাগ করেছিলেন অবিলম্বে। তিনি চলে যেতে দত্তকে সিংহ বলেছিলেন, নেভার, নেভার, অন্যায় কাজ করবই না দত্ত সায়েব। অপমান লাগে যখন বলে, আপনি করুন পুষিয়ে দিব। সেই ঘটনার কিছুদিন পর সিংহ বদলি হন। দত্ত তো রিটায়ার করলেন কদিন বাদে। দত্ত আর সিংহর ঘটনার সাক্ষী আমি। আবার এমনো আছে বিবেক, মানবিকতা বিসর্জন দেওয়া আমলা নিরুপায় মানুষকে আরো নিরুপায় করে দিয়েছেন। বিবেকবান মানুষের চেয়ে ক্ষমতাবান মানুষের প্রভাব এই পৃথিবীতে অনেক বিস্তৃত। আর ক্ষমতার প্রধান চিহ্ন হলো বিবেক বিসর্জন দেওয়া। বিবেক বিসর্জন না দিলে আপনি ক্ষমতার মধু আস্বাদনে বঞ্চিত হবেন। তথা কথিত শিক্ষিতজন, সমাজে যাঁরা প্রভাবশালী, তাঁরা কি বিবেকবান হন? গ্রামের চাষীবাসী মানুষকে দেখেছি একটি অন্যায় করতে অধর্ম হবে বলে পিছিয়ে যেতে। আর ধর্মাধর্ম যিনি অন্তরে বিশ্বাস করেন না, তাঁর রোষে পড়ে লোকে ভিটেমাটি ছাড়া হয়, চাকরি হারায়। বিবেকবান হতো যদি এই পৃথিবী তাহলে হিরোসিমায় পরমানু বোমা পড়ত না, সেই লিটল বয় সমস্ত বিবেক তার পেটে পুরে নিয়ে হিরোসিমার উপর তেজস্ক্রিয় মেঘে কালো বৃষ্টি নামিয়ে দিয়েছিল। হ্যাঁ, এক একটা খবর আসে, অটো ড্রাইভার অনেক টাকার ব্যাগ পেয়ে, অলঙ্কারের ব্যাগ পেয়ে থানায় এসে জমা দিয়েছে। বিবেকের আনন্দ এই। বিবেক আছে কোথাও। সকলেই লকারের চাবি গ্যাঙের জলে ফেলে দেয়নি। একটা কথা বলি, অতি সংগোপনে বলি, বিবেকবান অটো-ড্রাইভারের কথা শুনে,আমার কি মনে হয় না, মেয়ের বিয়ের জন্য জুয়েলারি থেকে কেনা কয়েক লাখ টাকার গয়নার পোটলা যদি আমি পেতাম, মেয়ের বিয়ের জন্য ব্যাঙ্ক থেকে তোলা কয়েক লাখ টাকার টাকার ব্যাগ যদি আমি পেতাম, সাময়িক ভাবে কোথায় রেখে দিতাম তা সমস্ত খোঁজাখুঁজির সময় পার করাতে। ব্যাঙ্কের লকারে? লকারের সেই চাবি কোথায় রাখতাম যতদিন না স্বাভাবিক হয় সব। চাবি লুকোতাম কোথায়, বিবেকের কোন ঘরের কোন দেরাজে? বিবেক বড় বালাই।