3 of 3

বিবেকের ছাঁকনি

বিবেকের ছাঁকনি

শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবকে, আমাদের ঠাকুরকে, যতটা সহজ সরল ভাবি, তিনি আদৌ তা নন। তাঁর মতো ভয়ঙ্কর শাসনকর্তা ইতিহাসে আর আসবেন কিনা সে-খবর ইতিহাসই রাখুক। রাজা, মহারাজা, ডিক্টেটর, ডেমোক্র্যাট অনেক আসবেন, এসেছেন; মানুষের মনোরাজ্যের এমন নিষ্ঠুর অধিপতি আর হয়তো আসবেন না। এই আগমনে ‘মতো’ বলে কিছু নেই। ‘রামকৃষ্ণের মতো’। এই আবির্ভাব অনন্য এবং একক, যেমন এভারেস্ট একটা, কাঞ্চনজঙ্ঘা একটা।

বড়দের খেলায় অনভিজ্ঞ ছোট কেউ খেলার বায়না ধরলে বড়দের মধ্যে দয়ালু কেউ বলেন : “আহা, নিয়ে নে, নিয়ে নে।” তারপর ফিসফিস করে সকলকে বলে দেন : “ও এলেবেলে, এলেবেলে।” খেলা চলাকালীন সে সারাটা মাঠ অকারণে ছুটে মরে, পায়ে ফুটবল আর পায় না।

উপমাটা এই কারণে এল, ঠাকুর আধ্যাত্মিক মরণপণ খেলায় সংসারীদের গ্রহণ করেছিলেন ঠিক এইভাবেই—এলেবেলে। ধরা থাক, সাক্ষী থাক, আটকে থাক। বাইরে পড়ে থেকে বদমাইসি করার চেয়ে তো ভাল! তিনি কঠোর কৃপালু! তাঁর নিজস্ব টিম তিনি তাঁর নিজস্ব নিবিড় শিক্ষায় তৈরি করে নিয়েছিলেন। তিনি ক্যাপ্টেন। বিপক্ষে ঘোর তামসিকতা। এ-খেলা পৃথিবীর ক্রীড়াঙ্গনে মানুষে মানুষে খেলা নয়। দুটো ক্লাব দুদিকে—বিদ্যা মায়া ও অবিদ্যা মায়ার খেলা, মহামায়া তার রেফারি।

জীব এক-একটি স্বতন্ত্র ঘুড়ি। সুতোয় বাঁধা। দৃশ্যটা কল্পনা করা যাক এইভাবে—গড়ের মাঠে মায়ের মায়া- অনুচরেরা শত শত মনুষ্যরূপী ঘুড়ি ওড়াচ্ছে। আর বহু ঊর্ধ্বে বাতাসে টান টান হয়ে আছে একটি বিশালাকার চাঁদিয়াল ঘুড়ি—ময়ূরকণ্ঠী রঙ। সেই ঘুড়িটি ওড়াচ্ছেন স্বয়ং মা কালী। ওটি মায়ের ঘুড়ি। শ্যামাপদ আকাশে বায়ুভরে হেলছে দুলছে। কখনো কখনো সেই ঘুড়িটি গোঁত্তা মেরে নিচে নেমে আসছে আর তার সূক্ষ্ম সুতোর টানে অন্য এক- একটি ঘুড়ি খুচ করে কেটে গিয়ে লাটাইয়ের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে উদার আকাশে ভাসতে ভাসতে চলে যাচ্ছে মুক্তির আনন্দে। মায়ের তখন কী আনন্দ! হাততালি দিচ্ছেন। “গেছে, একটা গেছে!” খুব উড়ছিল, লাট খাচ্ছিল, ফড়ফড় করছিল।

“ভবসংসার বাজার মাঝে।
ঐ যে আশাবায়ু ভরে উড়ে, বাঁধা তাহে মায়াদড়ি।”

কিন্তু

“ঘুড়ি লক্ষের দুটা একটা কাটে,
হেসে দাও মা হাত চাপড়ি।
প্রসাদ বলে দক্ষিণা বাতাসে ঘুড়ি যাবে উড়ি।
ভবসংসার সমুদ্রপারে পড়বে গিয়ে তাড়াতাড়ি।”

যারা মুক্ত হবে ঠাকুর তাদের মুক্তির মন্ত্র দিয়েছেন। তিনি জানতেন, যত্রতত্র বৈরাগ্যের বীজ ছড়ালে পণ্ডশ্রম হবে। আবার নিরাশও করেননি; কারণ তিনি যে আশার লণ্ঠনটি হাতে ধরে এসেছিলেন। তিনি ছিলেন স্বয়ং সূর্যনারায়ণ। ঠাকুরের মাঝে মাঝেই শিরঃপীড়া হতো। এক সাধক বলেছিলেন, এ তোমার সাধারণ পীড়া নয়, তোমার সঙ্গে সূর্যনারায়ণের যোগ আছে। আমাদের মতো জবজবে গৃহীদের তিনি বিমুখ করতে চাননি। মুচকি হেসে বলতেন, বেশ তো, বেশ তো, সংসারেই থাক না। দিনান্তে তাঁকে একটু স্মরণ করো। বুড়ি ছুঁয়ে থাক, তাহলে কেউ তোমাকে চোরের দান খাটাতে পারবে না। আস্তে আস্তে টুকটুক করে এগোও। চোখ-কান খোলা রাখ। একেবারে বিশ্রী রকমের মোহগ্রস্ত না হলে নিজেই চিনতে পারবে সংসার কি জায়গা। বুঝতে পারবে, দারাসুত কেমন কলের দড়ি! কিভাবে সংসারী মানুষের জ্ঞান-মুণ্ড ছিঁড়ে যায়!

“রমণী-বচনে সুধা, সুধা নয় সে বিষের বাটি।
আগে ইচ্ছাসুখে পান করে, বিষের জ্বালায় ছটফটি।”

সংসারে থাকতে বলায় আমাদের আহ্লাদের কোন কারণ নেই! না থেকে পারা যাবে না তাই। বদ্ধজীব কেমন করে সংসার ছাড়বে! মনের সে জোর কোথায়! সবাই তো ম্যাদামারা। তীব্র শ্লেষে তাঁর উক্তি—”মেগের দাস! “ উঠতে বললে ওঠে, বসতে বললে বসে। কাপ্তেনের অত প্রশংসা, কিন্তু ঐ এক দোষ। ভক্তসমক্ষে তাঁর সমালোচনা করতে ছাড়লেন কই! সকলের সামনে ক্যাটক্যাট করে বললেন : “সকলকেই দেখি মেয়েমানুষের বশ। কাপ্তেনের বাড়ি গিছলাম—তার বাড়ি হয়ে রামের বাড়ি যাব। তাই কাপ্তেনকে বললাম, ‘গাড়িভাড়া দাও।’ কাপ্তেন তার মাগকে বললে, সে-মাগও তেমনি—’ক্যা হুয়া’ ‘ক্যা হুয়া’ করতে লাগল। শেষে কাপ্তেন বললে যে, ওরাই (রামেরা) দেবে। গীতা, ভাগবত, বেদান্ত—সব ওর ভিতরে! টাকাকড়ি সর্বস্ব সব মাগের হাতে! আবার বলা হয়—’আমি দুটো টাকাও আমার কাছে রাখতে পারি না, কেমন আমার স্বভাব।’

“বড়বাবুর হাতে অনেক কর্ম, কিন্তু করে দিচ্ছে না। একজন বললে, ‘গোলাপীকে ধর, তবে কর্ম হবে।’ গোলাপী বড়বাবুর রাঁড়। পুরুষগুলো বুঝতে পারে না, কত নেমে গেছে। কেল্লায় যখন গাড়ি করে গিয়ে পৌঁছলাম তখন বোধ হলো যেন সাধারণ রাস্তা দিয়ে এলাম। তারপরে দেখি যে, চারতলা নিচে এসেছি! কলমবাড়া (sloping) রাস্তা! যাকে ভূতে পায়, সে জানতে পারে না যে আমায় ভূতে পেয়েছে। সে ভাবে আমি বেশ আছি।”

ঠাকুরের এই সমালোচনা কি বোঝায়? উপলক্ষ্য কে? আমাদের সাধারণের চেয়ে অসাধারণ এক রামকৃষ্ণ-অনুরাগী। কাপ্তেন বিশ্বনাথ উপাধ্যায়। ঠাকুরের গৃহিশিষ্য। নেপালী। নৈষ্ঠিক শাস্ত্রজ্ঞ, সুপণ্ডিত, কর্মযোগী ব্রাহ্মণ। সদ্বংশজাত। শৈব। স্ত্রী গোপালের উপাসক, ভক্তিমতী। ঠাকুরের সঙ্গে মিলিত হওয়ার আগে স্বপ্নে ঠাকুরকে দর্শন করেছিলেন। সেই কারণে তাঁকে দর্শন করামাত্রই চিনতে পারেন—ইনিই তো সেই তিনি। কর্মজীবনে নেপাল রাজসরকারের উচ্চপদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। নেপাল সরকার তাঁকে ‘ক্যাপ্টেন’ উপাধি দিয়েছিলেন। সেই কারণেই ঠাকুর সস্নেহে বলতেন ‘কাপ্তেন’। খুব ভালবাসতেন। দুজনের মধ্যে বেদ-বেদান্ত, ভাগবত-গীতা, নানা ভক্তিশাস্ত্রের আলোচনা হতো। ঠাকুর তাঁর একনিষ্ঠ ভক্তিমত্তার প্রশংসা করতেন। কাপ্তেন ঠাকুরকে প্রায়ই স্বগৃহে নিমন্ত্রণ করে পরিপাটি সেবায় ধন্য হতেন। ঠাকুর তাঁর প্রশংসা করে বলতেন : “কাপ্তেনের অনেক গুণ। রোজ নিত্যকর্ম—নিজে ঠাকুরপুজো—স্নানের মন্ত্রই কত! যখন পুজো করে, কর্পূরের আরতি করে—কাপ্তেনের কী স্বভাব! কী ভক্তি! ছোট কাপড়খানি পরে আরতি করে। একবার তিন বাতিওয়ালা প্রদীপে আরতি করে, তারপর আবার এক বাতিওয়ালা প্রদীপে। তারপর কপূরের আরতি। সেসময়ে কথা হয় না। আমায় ইশারা করে আসনে বসতে বললে। পূজা করবার সময় চোখের ভাব—ঠিক যেন বোলতা কামড়েছে। এদিকে গান গাইতে পারে না। কিন্তু সুন্দর স্তবপাঠ করে। আগে হঠযোগ করেছিল—তাই আমার সমাধি কি ভাবাবস্থা হলে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। ওদের কী ভক্তি! আমি যেখানে খাব সেইখানেই আঁচাব। খড়কে কাঠিটি পর্যন্ত। খুব ভক্তি! আমি বরানগরের রাস্তা ধরে যাচ্ছি, তা আমায় ছাতা ধরে! ওর বাড়িতে লয়ে গিয়ে কত যত্ন। বাতাস করে, পা টিপে দেয় আর নানা তরকারি করে খাওয়ায়। আমি একদিন ওর বাড়িতে পায়খানায় বেহুঁশ হয়ে গেছি। ও তো অত আচারী, পায়খানার ভিতর আমার কাছে গিয়ে পা ফাঁক করে বসিয়ে দেয়। অত আচারী, ঘৃণা করলে না!”

আমরা বলি, কাপ্তেনের কী ভাগ্য! ঠাকুর তাঁর আবাস পুণ্য পাদস্পর্শে প্রায়ই ধন্য করেছেন। যখন তখন গেছেন। খেয়েছেন, বিশ্রাম করেছেন, প্রসঙ্গাদি করেছেন, পুজো দেখেছেন। অবতার-সান্নিধ্যে উপাধ্যায়মশাই মহা ভাগ্যবান।

তবু সংসারী! আচার-বিচারে সদা সতর্ক। সমালোচক, সর্বোপরি স্ত্রী বশীভূত। শ্রীরামকৃষ্ণের বিশ্লেষণী ছুরির মতো দৃষ্টিতে একটা কিছু অভাব থেকে গেছে। একশতে একশ দিতে পারেননি। কারণ, যতই হোক সংসার মানুষকে সঙ্কীর্ণতা দেবেই, আসক্তির ছিটেফোঁটা থাকবেই। সবই হবে, পুরো নয়, একটু একটু।

তাই এই বজ্রপাত—”কামিনী-কাঞ্চনই সংসার—ঈশ্বরকে ভুলিয়ে দেয়।”

উপায়! সব সংসারীই জীবনের প্রান্তে এসে উপলব্ধি করে, কী জ্বালা! এত বাতি গলিয়ে কতটুকু সুখ, কতটা আনন্দই বা পেলুম! সংসার অনলে দহি। সেই কতকাল আগে তুলসীদাস যেকথা বলেছিলেন, সে যে কত বড় সত্য—

“বেহা বেহা সবকোই কহে, মেরা মনমে এহি ভায়।
চড় খাটোলি ধো ধো লগড়া জেহেল পর লে যায়।।”

আহা, ঠাকুরেরও তো ঐ একই ভয়। আরো কড়া ভাষা তাঁর—”যখনই দেখি স্ত্রী-পুরুষ একসঙ্গে বসে আছে, তখন বলি, আহা! এরা গেছে। হারু এমন সুন্দর ছেলে, তাকে পেতনীতে পেয়েছে। ‘ওরে হারু কোথা গেল’, ‘ওরে হারু কোথা গেল’! আর হারু কোথা গেল! সব্বাই দেখে, হারু বটতলায় চুপ করে বসে আছে। সে-রূপ নাই, সে-তেজ নাই, সে-আনন্দ নাই! বটগাছের পেতনীতে হারুকে পেয়েছে!

এই পেতনীর স্বরূপ কি? এ কি ঠাকুরের নারী-বিদ্বেষ? অবশ্যই না। “অবিদ্যারূপিণী মেয়েদের মোহিনীশক্তির গ্রাসে গ্রস্ত মোহাচ্ছন্ন পুরুষদের” প্রতি ঠাকুরের সমূহ করুণা। দুজনে মিলে কেন তোমরা ‘বিদ্যার সংসার’ গড়বে না? এই ক্ষোভ! শ্রীরামকৃষ্ণ বলবেন, দেখ বাপু! ধর্ম কাকে বলে, কোন্‌টা ধর্ম, কোটা অধর্ম আমি জানি না। আমার একটাই যা আমি আমার জীবন দিয়ে, সাধনা দিয়ে বুঝেছি—ঈশ্বরই সত্য আর সব অনিত্য-এরই নাম বিবেক। উপায়, উপায় করছ, অতি সহজ উপায় তোমার সামনে রয়েছে, জল-ছাঁকা দিয়ে জল ছেঁকে নিতে হয়। ময়লাটা একদিকে পড়ে, ভাল জল একদিকে পড়ে। বিবেকরূপ জল-ছাঁকা আরোপ কর। তোমরা তাঁকে জেনে সংসার কর। এরই নাম বিদ্যার সংসার।

ঠাকুর জানতেন, কালে এ-প্রশ্ন উঠবে—ঠাকুর কেন বিয়ে করলেন? এর উত্তর নিজেই দিলেন—”সংস্কারের জন্যে বিয়ে করতে হয়।”

সরাসরি এই প্রশ্ন করেছিলেন গিরিশ : “আপনার তো বিয়ে আছে!”

“আছেই তো, নজিরের জন্য। একডেলে গাছও আছে, আবার পাঁচডেলে গাছও আছে। সংস্কারের জন্য বিয়ে, কিন্তু সংসার আর কেমন করে হবে! গলায় পৈতে পরিয়ে দেয়, আবার খুলে খুলে পড়ে যায়—সামলাতে পারি নাই। একমতে আছে শুকদেবের বিয়ে হয়েছিল—সংস্কারের জন্য। একটি কন্যাও নাকি হয়েছিল!”

ঠাকুর বোঝাতে চাইছেন—”এই কামিনী-কাঞ্চন নিয়ে সকলে ভুলে আছে। আমার কিন্তু ওসব কিছু ভাল লাগে না—মাইরি বলছি, ঈশ্বর বই আর কিছুই জানি না।”

আমি একডেলে। এত দূর তোমাদের দরকার নেই। তোমরা নাহয় পাঁচরকম নিয়েই রইলে! শোন, আমি গৃহীর বন্ধু। তাদের হাত ধরে কাঁটার ওপর দিয়ে যুগ-যুগান্তর হেঁটে যাব। কথা একটাই—পাদুকা পর। সেটা কিসে তৈরি? অনাসক্তি! আমার ব্যবস্থাপত্র—

“তোমরা সংসার কর, অনাসক্ত হয়ে। গায়ে কাদা লাগবে, কিন্তু ঝেড়ে ফেলবে পাঁকাল মাছের মতো। কলঙ্কসাগরে সাঁতার দেবে—তবু গায়ে কলঙ্ক লাগাবে না।”

ঘৃণা নয় প্রেম। মোহ নয় জ্ঞান। বিবেকের ছাঁকনি।

বিবেক আমার শ্রীরামকৃষ্ণ। বসে আছেন অন্তরে। বারে বারে প্রশ্ন তাঁকে— ঠাকুর, ঠিক হচ্ছে তো? পারছি তো? পৃথিবী চুলোয় যাক, আপনি কি সন্তুষ্ট? আপনার হাত ধরে যে-পথে হাঁটলে ঈশ্বর-সকাশে নিজেকে হাজির করা যায়, সেই পথের নাম ধর্মপথ। ‘জয়তু শ্রীরামকৃষ্ণ’ বলে সেই পথটি চেনা, সেই পথে চলার নাম ধর্মাচরণ। বাকি সব ধুর!

“ভজো রে ভৈয়া রাম গোবিন্দ হরি।
রামকৃষ্ণ হরি,
জপতপ সাধন কুছ নহি লাগত, খরচত নহি গঠরি।।
সতত সম্পত সুখকে কারণ, জাসোঁ ভুল পরি।
কহত ‘কবীরা’ রামকৃষ্ণ ন জা মুখ, তা মুখ ধূল ভরি।।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *