বিবেকানন্দ বেদান্ত ও ভারতীয় সমাজ
“আমি সমাজতন্ত্রী, তার কারণ এই নয় যে সমাজতন্ত্রকে আমি একটা পরিপূর্ণ বিশুদ্ধ সমাজব্যবস্থা বলে মনে করি, কারণটা এই যে উপবাস করার চেয়ে আধখানা রুটি মেলাও ভাল।
“অন্য সব সমাজব্যবস্থাই পরীক্ষা করে দেখা গেছে সেগুলি ত্রুটিপূর্ণ। এই অবস্থাটাকেও একবার পরীক্ষা করে দেখা যাক; আর কিছুর জন্য না হলেও অন্তত এর নূতনত্বের জন্যই একবার পরীক্ষা করা দরকার। একই মানুষের দল সব সময় সুখ বা দুঃখ ভোগ করে যাবে; তার চেয়ে বরং সুখদুঃখের একটা পুনর্বণ্টন হওয়াই ভাল! ভাল-মন্দের মোট পরিমাণ পৃথিবীতে সব সময় একই থাকে। নূতন নূতন ব্যবস্থার দ্বারা জোয়ালটা কাঁধ বদল করে মাত্র, আর কিছু নয়।
“সমাজের নীচেকার লোকটিও এই দুঃখময় পৃথিবীতে একটু সুদিনের মুখ দেখুক। এর ফলে এই তথাকথিত সুখাস্বাদের অভিজ্ঞতা পার হয়ে এরা সবাই এসে শেষ পৰ্য্যন্ত পরমেশ্বরের শরণ নেবে; এই পৃথিবী, তার গভর্ণমেণ্ট, তার আর যত সমস্যা সম্পর্কে এদের সকল মিথ্যা মায়ামোহ তখন কেটে যাবে।” (Swami Vivekananda–Comeplete Works, Vol, VI–
Sixth Edition, 1956. pp. 381-82)
এই দীর্ঘ উদ্ধৃতিটির ভিতরে বিবেকানন্দের মানসপরিধি, তার ভাবনার স্বরূপ সার্থকভাবে প্ৰতিফলিত হয়েছে। যে চিঠিখান থেকে এই উদ্ধৃতিটি দেওয়া হল তার প্রারম্ভ ও পরিণতির সঙ্গতিটা অবশ্য লক্ষণীয়। বাস্তব সমাজব্যবস্থাটাকে উন্নত করার প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে একদিন আমাদের সকল দুঃখের অবসান ঘটবে এই ধারণাটা যে ভুল সে কথাটা প্ৰমাণ করাই চিঠিখানার মূল উদ্দেশ্য।
“আর একটা মস্তবড় ভুল আমরা করে থাকি এই ভেবে যে পৃথিবীতে মঙ্গলের পরিমাণটা ক্রমবর্ধিষ্ণু এবং অমঙ্গলের পরিমাণটা ক্রমক্ষয়িষ্ণু। এর থেকে এটাই প্ৰমাণ করার চেষ্টা হয়ে থাকে যে, অমঙ্গলটা ক্ৰমশঃ ক্ষয় হয়ে লোপ পেয়ে যাবে, এবং শেষ পৰ্য্যন্ত মঙ্গলটাই শুধু থাকবে।…কিন্তু সমাজের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে মঙ্গল যত বাড়ছে, অমঙ্গলও ততই বেড়ে চলেছে।” ।(ঐ পৃ:৩৭৯-৮০)। এই হল চিঠিখানার গোড়ার কথা। উপসংহারের দিকটা আমরা প্ৰথমেই উদ্ধৃত করেছি। এখন উপক্রম ও উপসংহার মিলিয়ে দেখুন। সমাজ-জীবনের ব্যবহারিক বা বস্তুতান্ত্রিক অগ্রগতির ধারা মানুষের সমস্যার শেষ সমাধান করতে পারে না। চিত্ত ও চেতনাকে ঈশ্বরভাবে ভাবিত করে তবেই মানুষের নিষ্কৃতি।
অথচ, একথা ভাবলে বিস্মিত হতে হয় যে এই চিঠিখানারই মধ্যপথে বিবেকানন্দ ব্ৰাহ্মণ, ক্ষত্ৰিয়,বৈশ্য ও শূদ্র এই চারবর্ণের ক্ৰমান্বয়ী আধিপত্যের ভিত্তিতে সমাজ বিবর্তনের প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন। একথা অকুষ্ঠিতভাবেই স্বীকার করা চলে যে উনবিংশ শতাব্দীর প্রান্তবাসী এই সাধক-সন্ন্যাসীই ভারতীয় মনীষীদের ভিতরে সর্বপ্রথম শ্রেণীস্বার্থের দৃষ্টিকোণ থেকে সমাজ বিবর্তনের ধারা অনুধাবন করার মত বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গীর পরিচয় দিয়েছেন। তার বিশ্লেষণ-পদ্ধতি আধুনিক সমাজবিজ্ঞানের দিক থেকে কতটা অসম্পূর্ণ সে কথা স্বতন্ত্র। কিন্তু সামাজিক পরিবর্তনের মূল সূত্রের ভিতরে তিনি যে শ্রেণীস্বার্থের সন্ধান পেয়েছেন এবং সে-কথা যে তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় প্ৰকাশ করেছেন ভারতীয় সমাজদর্শনের ক্ষেত্রে তাঁর এই মৌলিকত্ব অনস্বীকার্য।
তিনি ব্রাহ্মণ, ক্ষত্ৰিয়,বৈশ্য ও শূদ্র এই চারিটি শব্দের ব্যঞ্জনগত ব্যাপক অর্থ গ্ৰহণ করেছেন এবং এর দ্বারা সমগ্ৰ মানবসমাজের ইতিহাস ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন। শ্রেণীবিভক্ত সমাজের প্রথম স্তরটিকে ব্ৰাহ্মণ্য সভ্যতা বলে সামগ্রিক ভাবে চিহ্নিত করা যুক্তিযুক্ত কিনা সে বিষয়ে ন্যায়সঙ্গত সন্দেহ থাকলেও, এবং ক্ষয়িষ্ণু ব্ৰাহ্মণ্য সভ্যতার সঙ্গে উন্মেষমুখী ক্ষাত্রসভ্যতার সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে ইতিহাসের দ্বিতীয় স্তরে পৌঁছবার ধারণাটিকে একটি অতিসরলীকৃত সূত্র বলে অগ্রাহ করলেও বৈশ্য ও শূদ্র সভ্যতা সম্পর্কে বিবেকানন্দ যা বলেছেন তা আধুনিক সভ্যতার মর্মভেদী এক সুগভীর অন্তদৃষ্টির পরিচায়ক।
বৈশ্য শাসনের মূলগত বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বিবেকানন্দ বলেছেন-“It is awful in its silent crushing and blood-sucking power.”
এখানে “silent” কথাটি বিশেষভাবে লক্ষণীয়। বিবেকানন্দ মোটেই মার্কসবাদী ছিলেন না একথা মনে রাখলে এই শব্দটির ব্যঞ্জনাময় বৈশিষ্ট্য আমাদের আরও বেশী বিস্মিত করে। মার্কসবাদী সমাজবিজ্ঞানী সমাজবাস্তবের আরও সুনিপুণ বিশ্লেষণ করে এই কথাই অন্তভাবে বলতেন–পণ্যপ্রধান পুঁজিবাদী সভ্যতায় শ্রমিকের শ্রমজাত Surplus value বা উদ্বৃত্ত মূল্য মুনাফার আকারে নিঙড়ে নেয়ার এমন একটি কৌশল আছে যে শ্রমিকের মোট শ্রমের কত অংশ তার নিজের জন্য, আর কত অংশ মালিকের মুনাফার জন্য বিনা পারিশ্রমিকে নিয়োজিত হচ্ছে সে হিসাব করা শ্রমিকের পক্ষে অসাধ্য হয়ে ওঠে। ভূমিপ্রধান ক্ষত্রিযুগে শ্রমজীবী মানুষের স্বাৰ্থমুখী শ্রম ও মালিকমুখী শ্রমের পরিমাণিক পার্থক্যটা যত সহজে চোখে পড়ে পণ্যপ্ৰধান বৈশ্য সভ্যতায় তত সহজে চোখে পড়ে না। মার্কস যাকে commodity fetishism বলেছেন সেই পণ্যময়ী জুজুমূর্তির অন্তরালে শ্রমিকের শ্রমসঞ্জাত মূল্য-পরিমাণটা ঢাকা পড়ে যায়। পণ্যের বিনিময় যে মূলতঃ শ্রমশক্তির মূল্যের বিনিময়, আর সেই মূল্যের একটা বিরাট অংশ যে উদ্বত্ত হয়ে মুনাফার আকারে শোষণ করে নেয়া হয়— উৎপাদনের এই সামাজিক ইতিহাসটা চাপা পড়ে যায়। (Thus the determination of the magnitude of value by labour time is a secret hidden away beneath the manifest fluctuations in the relative values of commodities. (Capital l p. 49. Everyman’s Edition)
এইজন্যই পুঁজিবাদী আমলে শোষণটা চলে নিঃশব্দে, কারণ শোষণকে শোষণ বলে চেনা যায় না, এবং এই শোষণের পরিমাণটাও নিঃশব্দে বেড়ে চলে। পণ্যের গায়ে তার মূল্যোৎপত্তির ইতিহাসটা ব্যাখ্যা করে লেখা থাকে না–“value does not wear an explanatory label.” (ঐ পৃ: ৪৭)। এতটা বিশ্লেষণী চিন্তার ভিত্তিতে বিবেকানন্দ ও-কথাটি বলেননি। কিন্তু একটা ব্যাপার তিনি পরিষ্কারভাবেই লক্ষ্য করেছেন, পণ্যবাহিনী বৈশ্যসভ্যতার আড়ালে মানুষের রক্ত শোষণ চলে নিঃশব্দে, এবং এই শোষণ আরো বেশী ভয়ঙ্কর।
বৈশ্য-সভ্যতার মূল্যনিরূপণে বিবেকানন্দ একদেশদর্শী ছিলেন না। পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পৰ্যন্ত বিপুল পরিমাণ পণ্যসঞ্চালনের মারফত মানুষের সঙ্গে মানুষের নির্বিড় যোগসূত্র স্থাপন করেছে এই বৈশ্যসভ্যতা, এবং একই সঙ্গে বিচ্ছিন্ন সীমাবদ্ধ জ্ঞান বিজ্ঞান কৃষি ও সভ্যতার অমূল্য সম্পাদরাশি ছড়িয়ে দিয়েছে সারা পৃথিবীতে।
(The wisdom, civilisation and arts that accumulated in the heart of the social body during the Brahmin and Kshatriya supremacies are being diffused in all directions by the arteries of commerce to the different market places of the Vaisya. But for the rising of this Vaishya power who would have carried to-day the culture, learning, requirements and articles of food and luxury of one end of the world to the other.–“Modern India” প্রবন্ধ দ্রষ্টব্য)
কিন্তু ঠিক এর পরই তিনি প্রশ্ন করছেন—“যাদের শারীরিক শ্রমের ওপর নির্ভর করে ব্ৰাহ্মণের প্রভাব, ক্ষত্ৰিয়ের ক্ষমতা ও বৈশ্যের সম্পদ সম্ভব হয়েছে তারা কোথায়? সব দেশে সব যুগে যাদের নাম দেওয়া হয়েছে “নীচু জাতি,” “অন্ত্যজ,” অথচ যারাই হল আসলে সমাজের শরীর, তাদের ইতিহাসটা কি? উচ্চবর্ণের একচ্ছত্র অধিকার-কবলিত জ্ঞান-বিজ্ঞানের ভাণ্ডারে একটু ভাগ বসাবার অপরাধে ভারতবর্ষে যাদের জন্য জিহ্বা ও মাংস উপড়ে নেওয়ার মত কোমল শাস্তি বিধান করা হয়েছে ভারতের সেই চলন্ত শবগুলি, বিশ্বের সেই ভারবাহী পশুগুলি, সেই শূদ্র জনসাধারণ, তাদের ভাগ্যে কি লেখা আছে?” (Modern India)
বৈশ্য সভ্যতার উন্নামক বৈশিষ্ট্যগুলি লক্ষ করার সঙ্গে সঙ্গে তিনি এর এমন একটি সাধারণ চরিত্র লক্ষ্য করেছেন যা যে কোনও সানন্দ-বিস্ময়ে সমর্থন করবেন। তিনি বললেন—ক্ষত্রিয়ের হাত থেকে ক্ষমতা করায়ত্ত করার সময়ে বৈশ্যদের এমন কোন সদিচ্ছা ছিলনা যে ক্ষমতাটা শূদ্ৰশ্রেণীর হাতে পড়ুক। (That the royal power may not anyhow stand in the way of the inflow of his riches, the merchant is ever careful. But for all that, he has never the least wish that the power shquld pass on from the Kingly to the Shudra Claes-Modern India)। এই একই প্রবন্ধের প্রারম্ভে তিনি দেখিয়েছেন যে শাসনক্ষমতায় জনসাধারণের প্রকৃত অধিকার ভারতবর্ষে কোন দিন ছিল না–না ব্ৰাহ্মণযুগে, না ক্ষত্ৰিয়-বৌদ্ধযুগে। ইতস্ততঃ পরোক্ষভাবে, বিক্ষিপ্ত ও বিশৃঙ্খলভাবে জনসাধারণ আত্মপ্রকাশের জন্য সংগ্ৰাম করেছে। কিন্তু তারা নিজেদের ভিতরে কোন সুদৃঢ় ঐক্য গড়ে তুলতে পারে নি। শিক্ষাদীক্ষা যখন সবই ছিল ঋষিদের হাতে তখন স্বভাবতই জনতার পক্ষে এমন কোন শিক্ষালাভের সম্ভাবনা ছিল না যার দ্বারা তারা কোন উদ্দেশ্য সাধনের জন্য, মানুষের সামগ্রিক ও সাধারণ মঙ্গলের জন্য একতাবদ্ধ হতে পারে। এদিকে কিন্তু পারস্পরিক স্বার্থের খাতিরে ব্ৰাহ্মণ ও ক্ষত্ৰিয় শেষ পৰ্যন্ত ঐক্যবদ্ধ হ’ল। এই ধরণের ঐক্যের সহজাত পাপ হিসেবে এরা সবাই মিলে জনসাধারণের রক্তশোষণ, শক্রের উপর প্রতিহিংসা, অন্যের সম্পদ লুণ্ঠন করার কাজগুলি চালিয়ে যেতে লাগল, এবং শেষ পর্যন্ত পশ্চিমাগত মুসলমান আক্রমণকারীদের হাতে সপ্তা ও সহজ শিকারে পরিণত হল। শোষিত জনসাধারণের দৃষ্টিকোণ থেকে ভারতীয় সমাজেতিহাসের এমন স্পষ্ট বিচার বিবেকানন্দের পূর্বে অন্য কোনও ভারতীয় মনীষী করেছেন বলে আমাদের জানা নেই। অক্টোবরের রুশ বিপ্লবের সঙ্গে পূর্ববর্তী বিপ্লবগুলির মৌলিক পার্থক্য দেখাতে গিয়ে মাক্সবাদী দার্শনিকরা বলেছেন-পূর্ববর্তী বিপ্লবগুলিতে একদল শোষকশ্রেণীর জায়গায় আর একদল শোষকশ্রেণী ক্ষমতায় প্ৰতিষ্ঠিত হয়েছে মাত্ৰ, শোষিত শ্রেণীর হাতে কোন দিনই ক্ষমতা আসেনি। কিন্তু অক্টোবর বিপ্লবই হল পৃথিবীর প্রথম বিপ্লব যা শোষিত শ্রেণীকে ক্ষমতার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছে। বিবেকানন্দ “শূদ্ৰ-বিপ্লব” দেখে যান নি, কিন্তু প্রাক্-শূদ্ৰ-বিপ্লবগুলিতে শেষপৰ্যন্ত যে শোষকশ্রেণীর হাতেই সমাজ ও রাষ্ট্রের ক্ষমতা বহাল রয়েছে এ-ঘটনা তা’র সন্ধানী চোখের দৃষ্টি এড়িয়ে যেতে পারেনি। সমকালীন পশ্চিমী সমাজের গতিপ্রকৃতি লক্ষ্য করে আসন্ন “শূদ্ৰ-বিপ্লবী” সম্পর্কে বিবেকানন্দ নিঃসংশয় ছিলেন- “সোশ্যালিজম, এনাকিজম, নিহিলিজম এবং এই জাতীয় অন্যান্য মতবাদগুলি আসন্ন সমাজবিপ্লবের অগ্রদূত” (Modern India)। – “শূদ্রের আধিপত্য অবশ্যম্ভাবী, কেউ একে ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না– They must have it, none can resist it”–(Works-Vol. VI P. 81.)
বিবেকানন্দ সমাজদৃষ্টির আর একটি চমকপ্রদ দৃষ্টান্ত উল্লেখ না করলে সমালোচকের দৃষ্টি উন্মুক্ত বলে বিবেচিত হবে না। বিপ্লবী শ্রমিক-সংগঠনে অভিজ্ঞ সচেতন রাজনৈতিক কর্মীমাত্রেই জানেন যে শ্রমিকশ্রেণীকে পঙ্গু করে রাখার জন্য পুঁজিপতি শ্রেণীর একটা চিরাচরিত অপকৌশল আছে। নিপীড়িত শ্রেণীর ভিতরে যদি কেউ বিদ্যাবুদ্ধি ও গুণগরিমায় প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হন, চতুর পুঁজিপতিশ্রেণী তাকে ব্যক্তিগত সুযোগ সুবিধা ও ক্ষমতা দিয়ে নিজেদের দলে টেনে নেওয়ার চেষ্টা করে, যার ফলে সে আপন শ্রেণীগত দৃষ্টিভঙ্গী থেকে বিচুত হয়ে শেষ পর্যন্ত পুঁজিবাদের সেবাতেই আত্মনিয়োগ করে, পুঁজিবাদের স্বার্থে নিজশ্রেণীর উপর নিজের বিস্তীর্ণ প্রভাবের অপব্যবহার করে, এবং বিপ্লবের পথ থেকে শ্রমিক শ্রেণীকে প্ৰতিনিবৃত্ত করে। বিলাতের র্যামসে ম্যাকৃডোলাণ্ড থেকে আরম্ভ করে দেশে দেশে এই দৃষ্টান্তের অভাব নেই। বিবেকানন্দ প্রাচীন ভারতীয় সমাজেও নিপীড়িত শ্রেণীর মানুষের এই স্বধৰ্মচুতি ও স্বশ্রেণী-দ্রোহিতা দেখতে পেয়েছেন।
“শূদ্ৰকে ধন সঞ্চয়, জ্ঞানার্জন ও শিক্ষালাভের কোনও সুযোগই দেয়া হয়নি বললেও চলে। এই সামাজিক বঞ্চনার সঙ্গে আরও একটা অসুবিধা এনে যোগ করে দেয়া হল। শূদ্ৰশ্রেণীর ভিতরে অসাধারণ গুণাবলী ও প্ৰতিভা নিয়ে কেউ যদি জন্মগ্রহণ করত তখনই সমাজের উচ্চতর প্রভাবশালী শ্রেণীগুলি তার উপর সম্মান ও উপাধির পুষ্পবৃষ্টি করত, এবং তাকে তার আপনি শ্রেণীর পরিধি থেকে টেনে তুলে নিয়ে উচ্চতর গোষ্ঠীচক্রের মধ্যে স্থান করে দিত। তার সম্পদ ও প্রজ্ঞাশক্তি তখন নিয়োজিত হত একটি বিজাতীয় শ্রেণীর স্বার্থে। তার আপনি শ্রেণীর জনসাধারণ তার বিদ্যাবুদ্ধি ও সম্পদ থেকে কোন সাহায্যই পায় নি।” এই স্বধৰ্মচ্যুতি ও স্বশ্ৰেণীদ্রোহের দৃষ্টান্ত হিসাবে বিবেকানন্দ যে নামগুলি উপস্থিত করলেন তা শুনলে ভারতীয় ঐতিহ্যবিলাসী যে কোন উদার ব্যক্তিও চমকে উঠবেন। এঁরা হলেন বশিষ্ট, নারদ, জাবাল সত্যকাম, ব্যাস, কৃপ, দ্রোণ এবং কর্ণ। শ্রেণী-আভিজাত্যের দিক থেকে এদের প্রত্যেকেরই জন্মকাহিনী, পিতৃপরিচয় বা মাতৃপরিচয় সন্দিগ্ধ রহস্তে আবৃত। “জ্ঞান বা বীরত্বের পুরস্কার স্বরূপ এঁরা কেউবা ব্ৰাহ্মণ সমাজে কেউবা ক্ষত্ৰিয় সমাজে উন্নীত হলেন।” বিবেকানন্দ মন্তব্য করেছেন-“এদের এই সামাজিক উর্ধ্বগতির ফলে গণিকা, দাসী, মৎস্যজীবী বা শটটচালক সম্প্রদায়ের কি যে উপকার হল তা বোঝা দুষ্কর।” (Modern India)। ব্যাস, বিদুর ও জাবাল সত্যকামের উদাহরণ দেখিয়ে যখন আমরা প্ৰাচীন ভারতের উদার আদর্শের জয়গানে আবেগে আত্মহারা হই তখন বিবেকানন্দ দেখালেন, শোষিত শ্ৰেণীকে পঙ্গু করে রাখার অভিপ্ৰায়ে শোষকশ্রেণীর এই স্বার্থগন্ধী উদারতায় বিমুগ্ধ আত্মপ্রসাদ অনুভব করার কোনো অবকাশ নেই। এই চমকপ্রদ ব্যাখ্যার ভিতরে অনেকটা কল্পনা ও অতিশয়োক্তির আশ্রয় গ্রহণ করা হয়েছে এমন সন্দেহের অবকাশ থাকলেও প্রাচীন ভারতীয় সমাজ বাস্তবের বিশ্লেষণে সুপ্রযুক্ত একটি বৈপ্লবিক দৃষ্টিভঙ্গী ও বৈজ্ঞানিক প্রচেষ্টা এবং একটি সংস্কার-নিমুক্তি সতর্ক চেতনা আমাদের আধুনিক মনকেও সচকিত করে তোলে, নূতন করে ভাববার রসদ যোগায়।
শ্রেণীদ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে ভারতীয় সমাজ-ইতিহাসের এই ব্যাখ্যান-প্ৰচেষ্টা নিঃসন্দেহে এ-কথাই প্রমাণ করে যে আত্মপ্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অগ্রসর হওয়ার জন্য শূদ্র জনসাধারণের প্রতি বিবেকানন্দের বহুশ্রুত উদাত্ত আহ্বান-বাণী শুধু একটা উচ্ছল হৃদয়াবেগের ক্ষণিক উচ্ছাস মাত্রই ছিল না, এই আবেগের পিছনে ক্লান্তিহীন গবেষকের সাধনা, মননধর্মী বাস্তব চেতনা ও যুক্তিস্নাত ভাস্কর ভাবনা সমন্বিত সাফল্য নিয়ে অগ্রসর হয়েছে। কিন্তু দার্শনিক যুক্তি যখন কল্যাণধৰ্মী আবেগের আর্দ্রতাকে শতহস্ত দূরে রেখে এড়িয়ে চলতে চায় তখন সেই বিশুদ্ধ বিশুষ্ক পাণ্ডিত্যের চাপে মানুষের হৃদয় অতলে তলিয়ে যায়। আমরা সকলেই জানি দার্শনিক দিক থেকে বিবেকানন্দ ছিলেন শঙ্কর-বেদান্তের অনুগামী। তথাপি বলতে দ্বিধা করলেন না–“রামানুজ শঙ্কর, এরা শুধু পণ্ডিত মাত্রই ছিলেন, এদের হৃদয় ছিল অতি সঙ্কীর্ণ। কোথায় সেই ভালবাসা, পরের দুঃখে কাঁদে কোথায় সেই হৃদয়?” (Works-Vol. Vl, p. 394)
র্যাথবোনের কাছে লেখা রবীন্দ্ৰনাথের সেই অবিস্মরণীর চিঠির কথা আমরা জানি। কিন্তু ভারতে বৃটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বিবেকানন্দের ধিক্কারও কম জ্বালাময় ছিল না। সঙ্গে সঙ্গে অবাক লাগে এই ভেবে যে অমন সুতীব্ৰ আবেগেও তাঁর বুদ্ধির দীপ্তিকে কলুষিত করতে পারেনি। মিস মেরী হেলির কাছে লেখা একখানা চিঠি আরম্ভ করলেন এই বলে—“আধুনিক ভারতে বৃটিশ শাসনের কেবল একটা মাত্ৰই মাঙ্গলিক চরিত্র আছে, যদিও এই চরিত্রটি এসে পড়েছে বৃটিশের অজ্ঞাতসারে (“through unoconscious”)। এই শাসন আর একবার ভারতবর্ষকে বিশ্বের রঙ্গমঞ্চে টেনে বার করেছে, বহির্জগতের সংস্পর্শে আসতে তাকে বাধ্য করেছে” “কিন্তু রক্ত শোষণ করাই যে-শাসনের মূল উদ্দেশ্য সে শাসন দেশের মূলত কোন মঙ্গল করতে পারে না … শিক্ষাবিস্তার আর বরদাস্ত করা হবেনা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা শেষ হয়ে গেছে, (অবশ্য বহু আগেই আমাদের নিরস্ত্র করা হয়েছে।)…কয়েকটি নিরীহ সমালোচনামূলক কথা লেখার জন্য তৎক্ষণাৎ যাবজ্জীবন কারাবাসের ব্যবস্থা হয়েছে, অন্যদের বিনাবিচারে আটক করা হয়েছে, কেউ জানে না এদের মাথা কয়টা কখন কেটে ফেলা হবে…ইংরেজ সৈনিকরা আমাদের পুরুষদের হত্যা করেছে, নারীদের ইজ্জত কেড়ে নিচ্ছে। আর এরই পুরস্কার হিসাবে আমাদের পয়সায় এই সৈনিকদের পথ-খরচা ও পেন্সন দিয়ে বিলাতে পাঠানো হচ্ছে …মনে করো তুমি আমার এই চিঠিখানা প্ৰকাশ করে ফেলেছ–তাহলে ভারতবর্ষে এই মাত্ৰ যে আইন পাশ হয়েছে সেই আইনের বলে ভারতীর ইংরেজ সরকার এখান থেকে আমাকে টেনে হিচড়ে ভারতে নিয়ে যেতে পারবে, এবং বিনা বিচারে আমাকে হত্যা করতে পারবে- দরকার হলে রয়টারের প্রতিনিধি হুকুম মাফিক খবর তৈরী করে ঠিক উল্টা খবর প্রকাশ করবে …যে ঈশ্বর সকলের পিতা, দুৰ্বলের রক্ষার জন্য যিনি সবলকে ভয় করেন না, যাঁকে ঘুস দিয়ে কেনা যায় না এমন একজন ঈশ্বর কি কোথাও আছেন?” (Works-vol. III p 475-477) চিঠিখানার তারিখ ৩০শে অক্টোবর ১৮৯৯ সান। এরই সঙ্গে আবার মিলিয়ে দেখুন-“যীশু আর বাইবেল দিয়ে ইংল্যাণ্ড ভারতবর্ষ জয় করেনি। ভারতবর্ষ জয় করেছে সেই ইংল্যাণ্ড ফ্যাক্টরীর চিমনি যার রণপতাকা, পৃথিবীর বাজার যার রণক্ষেত্র। (Modern India)
বিবেকানন্দের ভাবনার ভিতরে স্বদেশ-চেতনা ও শ্রেণীচেতনা কিরূপ একাত্মতা লাভ করেছিল তার দৃষ্টান্ত হিসাবে আর একটা উদ্ধৃতির লোভ সংবরণ করতে পারলাম না। চিকাগো থেকে তিনি দেওয়ান হরিদাস বিহায়ীদাস দেশাইকে লিখেছেন- “ইতিহাসের কোনকালে কবি কোথায় তোমাদের ধনিক জমিদার পুরোহিত ও রাজরাজরার দল গরীবের জন্য একবার ও ভেবেছে? অথচ এদের মাথাগুলো গুড়ো করেই তা তাদের শক্তির জীবন-শোণিত তৈরী হয়েছে।–ভারতের দরিদ্রশ্রেণীর ভিতরে এত বেশী মুসলমান কেন বলতে পার? তরবারির জোরে তাদের ধর্মান্তরিত করা হয়েছে একথা অর্থহীন। জমিদার ও পুরোহিতের কবল থেকে মুক্তি পাওয়ার আশাতেই তারা মুসলমান হয়েছে। এরই ফলে দেখিতে পাচ্ছ বাংলাদেশের কৃষকশ্রেণীর ভিতরে হিন্দুর চেয়ে মুসলমান অনেক বেশী, কারণ বাংলাদেশে জমিদারের সংখ্যাটা অনেক বেশী।” (Works, vol. VIII P. 330) এ ব্যাখ্যা সম্পূর্ণভাবে গ্রহণ করি বা না করি, সন্ন্যাসীর ইতিহাস-চেতনায় শ্রেণীচেতনার প্রভাব এখানে সুস্পষ্ট। বিবেকানন্দ অন্যত্র একাধিকবার উল্লেখ করেছেন যে শোষিত শ্রমজীবী জনসাধারণ শোষকশ্রেণীর করায়ত্ত রাজশক্তির সমর্থনে দাঁড়াবার মত কোনও উৎসাহ অনুভব করেনি বলেই ভারতবর্ষ বারবার বিদেশীশক্তির পদানত হয়েছে।
।।২।।
নিপীড়িত মানুষের মর্মসন্ধানী ভাবনার দীপ্তিময় দৃষ্টান্ত হিসাবে এ-জাতীয় অজস্র লেখা বিবেকানন্দের গ্রন্থাবলী থেকে তুলে ধরা যেতে পারে। এজন্য সমাজবিপ্লবে বিশ্বাসী ভারতবাসীমাত্রেই এই মহামনীষীর নিকট চিরকৃতজ্ঞ থাকবে। কিন্তু এই স্কৃতজ্ঞ স্মৃতিপূজার সঙ্গে সঙ্গে তার ভাবনা-স্বরূপের যে একটা সুনির্দিষ্ট সীমা ছিল সেদিকেও লক্ষ্য না রাখলে আমাদের আলোচনা পথভ্ৰষ্ট হতে বাধ্য। প্ৰবন্ধের প্রারম্ভেই যে চিঠি থেকে একটা দীর্ঘ উদ্ধতি আমরা দিয়েছি তার ভিতরে বিবেকানন্দের সমাজ-দৃষ্টিয় সীমারেখাটাও স্পষ্ট করে চোখে পড়েছে। ঐ চিঠির ভিতরে তিনি বলছেন, “সবশেষে আসবে শ্রমজীবীর প্রভুত্ব। এর একটা সুফল ফলবে, পার্থিব সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের পুনর্বণ্টন হবে, সঙ্গে সঙ্গে এর একটা কুফলও বোধ হয় দেখা দেবে, সংস্কৃতির মান নীচে নেমে যাবে। সাধারণ শিক্ষা বিপুলভাবে প্রসার লাভ করবে, কিন্তু অসাধারণ প্রতিভাশালীদের সংখ্যা ক্ৰমশঃ কমে যাবে।” যুগ থেকে যুগান্তব্যাপী একটানা বঞ্চনার প্রতিক্রিয়া হিসাবে “শূদ্র-বিপ্লব” অবশ্যম্ভাবী। বিবেকানন্দ তাঁর দিনে এই অনাগত ও আসন্ন বিপ্লবকে ভবিষ্যতের অভিনন্দন জানাতে কুণ্ঠা বোধ করেননি। ন্যায়নীতি ও সমাজনীতি উভয় দিক থেকেই এ বিপ্লব অপরিহার্য্য একথা তিনি বুঝেছিলেন। তধাপি এ বিপ্লবের দ্বারা মানুষের মনুষ্যত্ব যে দুৰ্বার পদক্ষেপে অগ্রগামী হবে এমন বিশ্বাস। তাঁর ছিল না, এ বিপ্লবের দ্বারা মনুষ্যত্ব লাভের সমস্যা সমাধান হবে এমন আশা তিনি পোষণ করতেন না। “শূদ্র-চরিত্র” সম্পর্কে একটা নিদারুণ বেদনাময় হতাশা এই অবিশ্বাসের মুলে কাজ করেছে। দেওয়ান হরিদাস দেশাইয়ের কাছে লেখা চিঠিতে তিনি আমেরিকার নিগ্রোদের ভিতরে অনৈক্য, পারস্পরিক হিংসা, বিদ্বেষ ও চক্রান্ত দেখে জালাময় দুঃখ ও অবসন্ন হতাশা প্ৰকাশ করেছেন। প্ৰতিপত্তিশালী উচ্চশিক্ষিত নিগ্রোও উচ্চবর্ণের মধ্যে ঠাই লাভ করে “জাতে ওঠার” লোভে স্বজাতিকে ভুলে যায় এমন আত্মবিস্মরণের দৃশ্য তাকে ব্যথিত করেছে। তাই “বর্তমান ভারত” প্রবন্ধে তিনি বললেন “শৃদ্ৰ-শ্রেণীর” অত্যুথান অবশ্যম্ভাবী, কিন্তু শূদ্র জগবে তার শূদ্ৰস্তৃত্ব নিয়ে।” (with their Shudrahood’-এই কথাতির উপর তিনি বিশেষ জোর দিয়েছেন) “শূদ্ৰত্ব” বলতে তিনি কি বুঝাতে চেয়েছেন তাও ব্যাখ্যা করেছেন। “স্মরণাতীত কাল থেকে অত্যাচারের চাপে বিচূৰ্ণিত এই শূদ্র শ্রেণী হ্যাক্কারজনক দাসমনোবৃত্তি গ্ৰহণ করে কুকুরের মত উচ্চবর্ণের পদলেহন করে এসেছে, আর না হয়ত অমানুষ নিষ্ঠুর পশুতে পরিণত হয়েছে। তাদের আশা ভরসা বার বার ধূলিসাৎ হয়েছে। লক্ষ্যানুসন্ধানের দৃঢ়তা, ও কর্মক্ষেত্রে অবিচল অধ্যবসায় বলতে তাদের দিছুই নেই।” বিবেকানন্দ যে আদর্শ রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছেন সে-স্বপ্ন যে কোনদিন বাস্তবে রূপায়িত হবে এমন ভরসা তার ছিল না। ব্ৰাহ্মণের প্রজ্ঞা, ক্ষত্ৰিয়ের শক্তি, বৈশ্যের সংগঠনী প্ৰতিভা ও শূদ্রের সাম্যনীতির সমন্বিত স্বরূপই ছিল তার আদর্শ রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি। কিন্তু এই বলিষ্ঠ কল্পনাকে তিনি একটি সন্দেহাকুল জিজ্ঞাসা চিহ্ন দিয়ে সমাপ্ত করলেন–“কিন্তু সে কি সম্ভব?” (Works– Vol, VI, P, 881)। তাঁর জীবনে এ জিজ্ঞাসার উত্তর মেলেনি। দ্বিধা-কণ্টকিত সমাজে জীবনের এই নিরুত্তর জিজ্ঞাসা, ব্যথিত আবেগের এই আশাহীন ব্যাকুলতাই বোধ হয় তাঁকে ব্রহ্ম-জিজ্ঞাসার পথে সকল সমস্তার চরম বিশ্ৰান্তি খুঁজতে বাধ্য করেছে। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভিতর দিয়ে মানুষকে যেতে হবে, শ্রমজীবীর আধিপত্যের ভিতর দিয়ে মানুষের সামাজিক অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ হবে-ইতিহাসের এই অমোঘ অনুশাসন লঙ্ঘন করার উপায় নেই। কিন্তু এই অভিজ্ঞতাই সব শেষে মানুষকে বুঝিয়ে দেবে-এও যথেষ্ট নয়, এহু বাহ। আরও আগে চলতে হবে। সামাজিক ও ব্যবহারিক উন্নতির উত্তঙ্গ শিখরে আরোহণ করেও শেষ রক্ষা হবে না। তখন মানুষ বুঝতে পারবে—আধ্যাত্মিক ঐশ্বর্য্যই সবচেয়ে বড় কথা। যাকে জানলে সব জানা হয়ে যায়, যাকে পেলে আর কিছু পাওয়ার বাকী থাকে না, যার আলোতে চন্দ্ৰ-সূৰ্য্য আলো দেয় সেই পরমেশ্বরের ঐকান্তিক আরাধনাই চরম মুক্তির পরম পন্থা। প্রবন্ধের প্রারম্ভে উদ্ধত চিঠিখানার এই হল মর্মকথা। স্বচ্ছ দৃষ্টি, ক্ষুরধার বুদ্ধি, বিজ্ঞানীসুলভ বিশ্লেষণী শক্তি, নিপীড়িত মানুষের কল্যাণ-কামনায় উদ্বেলিত এক দুরন্ত আবেগ, এ সব কিছুই যেন কোন এক অবসন্ন সন্ধ্যায় চূড়ান্ত অবসান খুঁজছে বৈদান্তিক ব্রহ্মবাদের পরম প্রশান্তির মধ্যে। যে-ঈশ্বর মানুষের মুখে রুটি যোগাতে পারে না সে-ঈশ্বরে বিবেকানন্দ বিশ্বাস করেন নি। কিন্তু রুটি যেদিন জুটবে সেদিন মানুষও বুঝবে রুটির চেয়ে ঈশ্বর অনেক বড়, এই ছিল সমাজবাদী বিবেকানন্দের অধ্যাত্মবাদী বিশ্বাস। “Not by bread alone” কথাটির অর্থ “even without bread” হতে পারে এমন বিশ্বাস তাঁর ছিল না, কিন্তু ফাঁপা রুটির ফাঁকগুলো “ঈশ্বর” দিয়ে ভর্তি করতে হবে এ বিশ্বাস তার ছিল।
“শূদ্ৰ-বিপ্লবে”র আত্মিক প্রকৃতি সম্পর্কে একটা হতাশাক্লিষ্ট সংশয়ই শুধু ভঁাকে ঈশ্বর-প্রত্যাশার স্নিগ্ধ সান্ত্ৰনার বুকে টেনে নিয়েছে-একথা অৰ্দ্ধসত্য-মাত্র। একটা ব্যাপার বিশেষভাবে লক্ষ্য করার মত, রামমোহন থেকে রবীন্দ্রনাথ পৰ্যন্ত বাংলার নবজাগৃতির ঋত্বিককুলের উপর ঔপনিষদিক ব্ৰহ্মবাদের প্রভাব ছিল অসামান্য। এর একমাত্র ব্যতিক্ৰম বোধ বীর-সিংহের সিংহ শিশু ঈশ্বরচন্দ্ৰ, যিনি ঈশ্বরের সিংহাসনের সামনে নতজানু হওয়ার প্রয়োজন বোধ কোনদিন অনুভব করেননি। তিনি যেমন “সোহং”-বাদও প্রচার করেননি, তেমনি মানুষের অনেক রকম দাসত্বের মধ্যে আবার ইশ্বরের দাসত্ব আমদানী করলে কারুর কোনো মঙ্গল হবে এমন কোন ধারণাও পোষণ করেননি। বিবেকানন্দের প্রদীপ্ত সমাজচেতনাও ব্রহ্মবিজ্ঞানের ধারাস্নানে আত্মশুদ্ধি করেছে।
শক্তি ও সভ্যতার উচ্ছ্রিত অহঙ্কারে প্রমত্ত এক বিজাতীয় শাসন ভারতবর্ষকে নাগপাশে বেঁধেছিল। শ্বাসরুদ্ধ পরাধীন জাতি তখন আত্মপ্ৰকাশ ও আত্মপ্রতিষ্ঠার পথ খুঁজেছে। পাশ্চাত্ত্য সভ্যতার আলোকজাত বাংলার মনীষা তখন স্বদেশ ঐতিহ্যের মধ্যে এমন একটা বিরাট আদর্শের সন্ধান করেছে যার উপর নির্ভর করে স্বদেশ আবার আত্মসমীক্ষা ও আত্মপ্রত্যয়ে উদ্বুদ্ধ হবে এবং সভ্যতাগর্বী পশ্চিমী সমাজও যাকে শ্রদ্ধা জানাতে বাধ্য হবে।
উপনিষদের ব্ৰহ্মবাদ স্বভাবতই এমন একটা আদর্শের সন্ধান দিয়েছে। দার্শনিক পরিভাষায় যাকে Monism বলে, মানুষের মনন ধারার উপর তার বিপুল প্রভাব অনস্বীকাৰ্য। এই Monism বস্তুতান্ত্রিক বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গীর দ্বারা পরিশুদ্ধ হলে মার্কসবাদেও পৰ্যবসিত হতে পারে। Monism-এর পরিপ্রেক্ষিতে অন্য কোন বাংলা তর্জমা মনে আসছে না বলে মার্কসবাদের একটা নামকরণ করা যেতে পারে বস্তুতান্ত্রিক অদ্বৈতবাদ। লেনিনের মতে যে গ্ৰন্থ একপুরুষ ধরে রুশিয়ার মার্কসবাদীদের শিক্ষিত করেছে, প্লেখানভ তাঁর সেই প্রখ্যাত গ্রন্থের নাম দিয়েছিলেন “The Development of the Monistic View of History”। আবার বস্তুজগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন করে অন্তরলোকেই যখন সেই একক সত্যের সন্ধান করা হয় তখন Monism পরিণত হয় শঙ্করাচার্য্যের অদ্বৈতবাদে, যে মতে—এক দ্বৈতহীন নিরাকার বিজ্ঞানই একমাত্র সত্য—বাকী সব মিথ্যা, একটা অনাদি ভ্রান্তিবিলাস মাত্র।
সুতরাং অদৈত্ববাদকে আপনি কোন দৃষ্টিভঙ্গীতে গ্রহণ করবেন তাঁর উপর আপনার চিন্তাধারার গতি ও প্রকৃতি অনেকখানি নির্ভর করছে। বিজ্ঞানবাদী বৌদ্ধও তার দর্শনকে অদ্বৈতবাদী বলছেন, কিন্তু সম্পূর্ণ অন্য অর্থে। অনন্ত বিজ্ঞানক্ষণের বিরামহীন স্রোতের মধ্যে বিলীয়মান এক একটি ক্ষণিক বিজ্ঞান, এই একমাত্র সত্য, এক মুহূর্ত্তে সে একক যদিও সাকার, শঙ্কর-সম্মত বিজ্ঞানের মত নিরাকার নয়। বৌদ্ধ বিজ্ঞানবাদের উপর আপনার চিন্তাধারার গতি ও প্রকৃতি অনেকখানি নির্ভর করছে। বহির্জগতের অস্তিত্ব বা অনস্তিতের দিক থেকে এই সাদৃশ্য কতখানি যুক্তিসহ অবশ্যই তা বিচার্য্য বিষয়, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এই দুয়ের মধ্যে যে একটা দুর্লঙ্ঘ্য ব্যবধান রয়েছে সেদিকে দৃষ্টি না দিলে একদেশদর্শিতার দায়ে অভিযুক্ত হতে হয়। বিজ্ঞানবাদী বৌদ্ধ পূর্ণতা বা সমগ্রতাকে স্বীকার করেনি। যা “সমগ্র” তার সত্য নয়, অংশটাই একমাত্র সত্য, যে অংশ নিরংশ অর্থাৎ বিশ্লেষণ করে যার ভিতরে আর কোন অংশের ধারণা করা যাবে না। তাই সত্য। তাই এক্ষণের বিজ্ঞানটুকুই একমাত্র সত্য, বিজ্ঞান-ক্ষণের সন্তান অর্থাৎ স্রোত বা প্ৰবাহটা সত্য নয়, ওটাও বিকল্প মাত্ৰ। আচাৰ্য্য ধৰ্মকীতি তার “প্ৰমাণবাতিকের” পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা ধরে অবয়বীর অস্তিত্ব খণ্ডন করেছেন, অবয়বটাকেই সত্য বলে প্ৰমাণ করার চেষ্টা করেছেন। একটা সামগ্রিক ঐক্যের ধারণা বিজ্ঞানবাদী বৌদ্ধ দর্শনের সম্পূর্ণ বিরোধী। অপরদিকে, অনন্ত বৈচিত্র্যময় জগৎসংসার একটা সুত্রে বাধা, বৈচিত্র্যের পিছনে কোথাও একটা সুনিবিড় ঐক্য বর্তমান, বহু মানুষের বহু অভিজ্ঞতা, বস্তুজগতের বহু খণ্ড খণ্ড অভিব্যক্তি সব কিছুর পিছনে একটা সামগ্রিক ঐকিক সত্তা কাজ করে যাচ্ছে, উপনিষদের প্রথম পাঠকের মনেও এই প্রাথমিক ধারণা অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু বুদ্ধের বাণী শুনলে যে ধারণাই হোক না কেন, দিকৃপাল বৌদ্ধ দার্শনিকদের সঙ্গে পরিচয় হলে এই সামগ্রিক ঐক্যের ধারণাটা অবলুপ্ত হতে বাধ্য। এই পূর্ণতম ঐক্যের ধারণাকে আমরা অনেকভাবেই ব্যাখ্যা করতে পারি। শংকর-সম্মত নিরাকার ব্রহ্মবিজ্ঞানবাদ, রামানুজ-প্ৰদৰ্শিত বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ, এমন কি হেগেলীয় সমগ্রতাবাদ দিয়েও এর ব্যাখ্যা করা চলে। এই দার্শনিক ঐক্যানুভূতির সঙ্গে মাক্সর্বাদেরও কোনো মৌলিক বিরোধ নেই।
সেই প্রাচীন যুগেও বিশ্বপ্রকৃতিকে যতটুকু পৰ্যবেক্ষণ করা সম্ভব হয়েছিল তার ভিতর দিয়েও একটা সুবিম্ভন্ত বিধিবদ্ধতা, একটা পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত নিয়মানুবর্তিতার ধারণা মানুষের মনে বদ্ধমূল হয়েছিল। আর একদিকে প্রাচীন জাৰ্য্যসমাজের জটিলতাবর্জিত ঐর্কিক আন্তঃপ্রকৃতিও একটা সামগ্রিক ঐক্যানুভূতির ভিতরে মানুষের সমাজকে ৰাচিয়ে রেখেছিল, এগিয়ে নিয়েছিল, বিশ্ব প্রকৃতির মহাপ্ত সন্ধানে মানুষকে অনুপ্রেরিত করেছিল। আমাদের বহুমুখী অভিজ্ঞতার যে ঘটনাপুঞ্জ নিক্ষিপ্ত ও খণ্ড খণ্ড আকারে দেখা দেয় তার ভিতরে একটা সাধারণ নিয়মসূত্রের অস্তিত্ব অনুসরণ করা, এক অখণ্ড পূর্ণতার সন্ধান করা বোধহয় মানব-সভ্যতার সৃষ্টি ও অগ্রগতির প্রধান উৎস। “যিনি এক তিনি বহু হলেন” এ শুধু শঙ্কর-বেদান্তের কথা নয়। এ বস্তুবাদী মার্ক্সবাদেরও মূল কথা। কারণ কারণ, এ মননশীল মানবমনে প্ৰতিফলিত বস্তুসত্যের প্রথম প্ৰকাশ। কিন্তু বহুরূপে পরিব্যাপ্ত সেই একের স্বরূপ কি? সে কি এক সর্বনিয়ন্তা ঈশ্বর, সে কি এক নিরাকার বিজ্ঞানস্বরূপ ব্রহ্ম, সে কি এক অব্যৰ্থ অন্ধ নিয়তি, এক সর্বগ্রাসী মহাকাল, অথবা সে এক মূল বস্তুপ্রকৃতি (primordia mater) যা আপনে নিয়মে বহু ধারায় বিভক্ত ও বিবর্তিত হয়ে এই বিচিত্র বস্তুজগতে পরিণতি লাভ করেছে? আধুনিক বিজ্ঞানসমৃদ্ধ বস্তুবাদ এই শেষের সূত্রটিকে সত্য বলে বিশ্বাস করে।
তা হলে সমগ্রতা ও একতাকে কোন দৃষ্টিভঙ্গীতে গ্ৰহণ করা হবে তার উপর দার্শনিক মতের মূলগত ভেদটাও অনেকটা নির্ভর করছে। একটা অপেক্ষাকৃত স্থূল উদাহরণ দেয়া যাক। উপনিষদের একটা বহুজন-শ্রুত বাণী- “মা গৃধঃ কস্যচিন্ধনম”। এর তাৎপৰ্য্যাৰ্থ অনেকরকম কল্পনা করা যেতে পারে। মনে করুন প্ৰাচীন আৰ্য্যদের যৌথ সমাজব্যবস্থার শেষ দশায় যখন ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিন্দু বিন্দু বিকাশ আরম্ভ হয়েছে তখন একথাটি ব্যক্তিগত লোভের বিরুদ্ধে প্ৰযুক্ত হতে পারে। কার ধন? কারুর একার নয়, কিন্তু সকলের। সুতরাং লোভ করবে না। আবার শ্রমজীবি মানুষের বঞ্চনার উপর প্রতিষ্ঠিত শ্রেণীবিভক্ত সমাজে এই একই কথার তাৎপর্য একেবারে উল্টে যাবে। মনুসংহিতার সমাজে এর অর্থ হবে শূদ্রের প্রতি কঠোর হুঁসিশারী। মনু বিধান দিয়েছেন শূদ্রের ধনসঞ্চায়ের অধিকার নেই। কাজেই শূদ্র যদি সমাজে তার শ্রমের ন্যায্য ফল দাবী করে, মনুর মতে সে হবে অন্যের ধানে লোভ করার সামিল। শোষক শ্রেণীর লোভকে গোপন করার জন্য শোষিত শ্রেণীকেই লোভী বলে চিত্রিত করার এ এক বিচিত্র প্ৰয়াস। অনেকদিন আমাদের এমন তর্ক শুনতে হয়েছে কমিউনিষ্টরা ছোটলোকদের স্বাভাবিক লোভ, ঈর্ষ্যা ও পরশ্রীকাতরতায় ইন্ধন যুগিয়ে শ্ৰেণীবিদ্বেষ প্রচার করছে। শ্রেণীবিদ্বেষ যার রক্তে ও অস্থিমজ্জায় মিশে আছে সেই মালিকশ্রেণীর পক্ষে শ্রেণীসাম্য প্রচারের কি অপূর্ব চাতুরী। আবার রবীন্দ্রনাথের মত স্থিতপ্ৰজ্ঞ মনীষী উপনিষদের এই প্ৰখ্যাত কথাটির প্রাচীনতম তাৎপর্ষে ফিরে গেলেন। বর্তমানযুগে ধনিকশ্রেণীর দুরন্ত মুনাফালোভকেই তিনি উপনিষদের মন্ত্র দ্বারা আঘাত করলেন।
উপনিষদ মানুষের ঐক্য ও সমগ্রতাবোধের প্রাচীনতম বাণীমূর্তি। উনবিংশ শতাব্দীর বাংলার মনীষিবৃন্দ উপনিষদের মন্ত্রগুলিকে এই অর্থেই গ্ৰহণ করেছেন। যে দেশে সভ্যতার ঊষালগ্ন উপনিষদের উদাত্ত মন্ত্রে মুখর হয়ে উঠেছিল সে দেশ ছোট নয়, সে জাতি তুচ্ছ নয়, পরাধীন জাতির অবলুপ্ত আত্মচেতনাকে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত করার জন্য এই উদ্দীপনা, এই উদ্বোধনী শক্তির প্রয়োজন ছিল। সভ্যতাগর্বিত বিদেশী শাসকবর্গের সামনে স্ফীতবক্ষে দাঁড়াবার জন্য যে সাহসের প্রয়োজন প্ৰাচীন ভারতের প্রজ্ঞাবাণী সেই আত্মোপলব্ধির সাহস সঞ্চার করেছিল। রবীন্দ্ৰনাথ “ভারত-তীৰ্থকে” বৈদিকমন্ত্রের বাস্তব রূপায়ণ বলে কল্পনা করেছেন। সমগ্ৰতাবাদী ঔপনিষদিক দর্শনকে বিবেকানন্দ যেভাবে তার সমাজ-দর্শনে পরিণত করলেন তার তুলনা বিরল।
“সমগ্রের জীবনেই ব্যক্তির জীবন, সমগ্রের সুখেই ব্যক্তির সুখ। সমগ্রকে বাদ দিয়ে ব্যক্তির অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না—এই হ’ল শাশ্বত সত্য, এই সেই প্ৰস্তার-ভিত্তি যার উপর বিশ্বসংসার গড়ে উঠেছে। … এই প্ৰকৃতির নিয়ম, … … চিরদিন কেউ সমাজকে বঞ্চনা করে চলতে পারেনা … সমাজের উপর তলায় যতই জঞ্জাল পুঞ্জীভূত হোক না কেন, সেই জঞ্জালোয় নীচে সমাজের প্ৰাণশক্তির অক্ষয় ধারা স্পন্দিত হতে থাকে। • সমাজ পৃথিবীর মত সৰ্বংসহ, অনেক ধৈৰ্যের সঙ্গে অনেকদিন অত্যাচার সহ করে চলে। কিন্তু একদিন সে জাগে, ভূমিকম্পের শক্তি নিয়ে জাগে। লক্ষ বছরের নীরব প্ৰতীক্ষার যুগে যে তুচ্ছতা ও স্বার্থপরতার গ্লানিময় আবর্জনা সমাজের বুকে জমে উঠেছিল। এই ভূমিকম্প এক নিমেষে তা দূরে ছুঁড়ে ফেলে দেয়।” [“Modern India”-“বর্তমান ভারত” নামে মূল বাংলা প্ৰবন্ধটি এই প্ৰবন্ধ লেখার সময় লেখকের হাতের কাছে ছিলনা, তাই মূলের ইংরেজী অনুবাদ থেকে পুনরানুবাদ করতে হ’ল-এজন্য পাঠক মার্জনা করবেন।]
ঔপনিষদিক দর্শনের এই সামাজিক পরিণতির সঙ্গে শঙ্কর প্রচারিত বেদান্ত-দর্শনের কোন সঙ্গতি নেই। বিবেকানন্দ নিজেকে অবশ্য শঙ্করণ রোদান্তের ধারক বলে মনে করতেন। কিন্তু মনুসংহিতার যে সমাজবিধানকে বিবেকানন্দ তীব্ৰতম ভাষায় আক্রমণ করেছেন শঙ্কর-বেদান্তু, সেই সমাজের শাসন অবনত মন্তকে মেনে নিয়েছিল। শুধু তাই নয়, আজিও ‘মোহাতমহারাজের মনুসংহিতার সনাতন ধর্মের শাসন ভারতবর্ষে পুনঃ প্ৰতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেন। শংকরের মায়াবাদকে কায়মনোবাক্যে গ্রহণ করলে এই সনাতন পথই গ্রহণ করতে হবে। একমাত্র নিরাকার বিজ্ঞানস্বরূপ ব্রহ্মই যখন সত্য, সমাজ সংসার, সুখ-দুঃখ, পাপ-পুণ্য শেষ পৰ্যন্ত সবই যখন মিথ্যা, তখন নিপীড়িত মানুষের কল্যাণ-কামনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ধনিক শ্রেণীর শোষণব্যবস্থাকে অবলুপ্ত করে বঞ্চিত মানুষকে মানবিক মহিমায় প্রতিষ্ঠিত করার প্ৰয়াসটাও মিথ্যা, মূল্যহীন। রাজশক্তি ও বিত্তবানদের অনুগ্রহে মঠগুলি বেঁচে থাকুক, মোহন্তরা বেঁচে থাকুন, এই মঠ-মিশনগুলিতে অকাতরে অর্থদান করার জন্য ধনিকের মুনাফা-শোষণের পবিত্র অধিকার চিরকাল বেঁচে থাকুক, এই মায়াময় সংসারে এইটুকু মায়া বেঁচে থাকলেই যথেষ্ট।
বলা বাহুল্য, বিবেকানন্দ এ জাতীয় মায়াবাদে বিশ্বাস করতেন না। “গীতা-পাঠের চেয়ে ফুটবল খেলার মধ্য দিয়ে তোমরা স্বর্গের অনেক কাছাকাছি যেতে পারবে। এগুলি দুঃসাহসিক কথা, কিন্তু তোমাদের ভালবাসি বলেই বলছি। বাইসেপ মাস্ল মজবুত করলে গীতা অনেক ভাল বুঝতে পারবে” (“Vedanta and Indian life’)। ঊনবিংশ শতাব্দীর যে বৈদান্তিক সন্ন্যাসী একথা বলতে পেরেছিলেন তিনি নিশ্চয়ই নমস্ত। শংকরাচাৰ্য্য নিজে তার মায়াবাদ যেভাবে বুঝেছিলেন, শংকরানুবর্তী পরবর্তী দুর্ধর্ষ তার্কিক দার্শনিকবৃন্দ এই মায়াবাদকে যেভাবে অনির্বচনীয়তা-সর্বস্ব বলে ব্যাখ্যা করেছেন, বিবেকানন্দ মায়াবাদকে সেই একই অর্থে গ্ৰহণ করেছেন কিনা শেষ বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ আছে। বিবেকানন্দ যেখানে বেদাভেজ ব্যাখ্যা করেছেন সেই “জ্ঞানযোগে”, অথবা “কলম্বো থেকে আলমোড়া পৰ্যন্ত বক্তৃতাবলী”তে কোথাও শ্ৰীহৰ্ষ, চিৎসুখাচাৰ্য বা মধুসূদন সরস্বতীর মত মায়াবাদের ব্যাখ্যা করেন নি। সর্বত্রই তিনি হৃদয়ের দরদ মিশিয়ে এক মানবধর্মী বৈদান্তিক ব্যাখ্যার উপর জোর দিয়েছেন। শংকর থেকে মধুসুদন সরস্বতী পৰ্যন্ত কোন বৈদাক্তিকের ভিতরে এই বৃহত্তম মানবিকতার লেশমাত্র পাওয়া যাবে না। কারণ তারা সমাজদর্শনকে দর্শনের মধ্যে গণনা করেননি, অথবা মনুসংহিতাকেই সমাজদর্শনের শেষ ও সার কথা বলে ধরে নিয়েছিলেন। বিবেকানন্দ বার বার ঘুরে ফিরে দর্শনের মানবিক মর্মকেন্দ্রে এসে উপস্থিত হয়েছেন। সকল মানুষ যখন এক, নিখিল বিশ্ব যখন একই ব্রহ্মের সংহতমূর্তি (Perfect solidarity of the Universe) তখন মানুষের উপর মানুষের বৈষম্যমূলক শোষণ ও নিপীড়ন এই শাশ্বত সত্যের বিরোধী, অদ্বৈত বেদান্তের ব্যভিচার। অথচ বিবেকানন্দ যাঁকে নিজের দার্শনিক গুরু বলে মনে করতেন সেই শংকর ও তার শিষ্যপরস্পরা কিন্তু অনায়াসে সামাজিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের উপর প্রতিষ্ঠিত একটা শোষণমূলক সমাজ-ব্যবস্থার সঙ্গে ব্ৰহ্মবাদকে দিব্যি মিলিয়ে নিতে পেরেছিলেন। মায়াবাদকে এই শোষণব্যবস্থার সহায় হিসাবে প্রয়োগ করাও অসম্ভব নয়। যদিও এরকম কল্পনা করা অন্যায় হবে না যে সকল মায়াবাদী দার্শনিক সজ্ঞানে শোষণব্যবস্থার সহায়ক হিসাবে মায়াবাদকে গড়ে তুলেছিলেন।
এটা আমাদের লক্ষ্য করতে হবে যে বিবেকানন্দ ব্ৰহ্মবাদকে শোষণব্যবস্থার সঙ্গে মিলিয়ে নিতে পারেননি। তাই অন্ততঃ দু’জায়গায় শংকরের হৃদয়হীন সংকীর্ণতার কথা উল্লেখ করেছেন। বুদ্ধের হৃদয় ও শংকরের বুদ্ধির একত্র মিলন হওয়াটাই তার কাম্য ছিল। মূল প্রশ্নটা কিন্তু হৃদয়ের নয়, এ হল সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গীর প্রশ্ন। শুধু হৃদয়ের প্রশ্ন হলে ব্যক্তিগতভাবে পরোপকারের চেষ্টা করে, কতকটা সেবাধর্মের অনুষ্ঠান করে দরদী হৃদয়ের দাবী মেটানো সম্ভব হত। বিবেকানন্দের হৃদয়ের দরদ সমাজটাকে ঢেলে সাজাবার প্রশ্ন নিয়ে আলোড়ির হয়েছিল। প্রশ্নটা তিনি যে কত জোরালো ভাবে তুলেছিলেন তা আমরা আগেই দেখেছি। অবশ্য সমাজের মৌলিক পরিবর্তনের তিনি যে পথ বেছে নিয়েছিলেন সেই মিশন-মার্ক পন্থা কোনদিনই সমাজ-বিপ্লব সৃষ্টি করতে পারবে না। তিনি সমস্যার সমাধান দিতে না পারলেও সমস্যাটির মূল চরিত্র যে হৃদয় ও বুদ্ধি দিয়ে অনুভব করেছিলেন, বিশ্লেষণ করে বোঝার চেষ্টা করেছিলেন সেটাও একটা মস্ত বড় কৃতিত্ব। পরিচ্ছন্ন দৃষ্টি নিয়ে বলিষ্ঠভাবে কোন একটা মূল প্রশ্ন সমাজের সামনে তুলে ধরাটাও মহতী প্ৰজার পরিচায়ক। বিবেকানন্দ সে কাজ সার্থকভাবেই করেছিলেন। কিন্তু তাঁর প্রদর্শিত সমাধান-পদ্ধতিটা ভারতীয় অধ্যাত্মবাদের কুয়াশায় কলুষিত ছিল এ বিষয়ে কোনো বস্তুবাদীর সংশয় থাকা উচিত নয়। এ বিষয়ে শুধু বিবেকানন্দ কেন, ঊনবিংশ শতকের ভারতীয় মনীষার উজ্জ্বলতম পরিণতি যে রবীন্দ্ৰনাথ তার প্রজ্ঞাদৃষ্টিও এই কুয়াশার আবরণকে ভেদ করে বাহির হতে পারেনি, যদিও বিবেকানন্দের তুলনায় রবীন্দ্রনাথের এই আবরণটা অনেক বেশী পাতলা ছিল। পাশ্চাত্ত্য সভ্যতার জ্ঞানবিজ্ঞানের আলোক-ধারায় স্নান করেও ধারা প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির জ্যোতির্ময় রূপটিকে পৃথিবীর সামনে তুলে ধরে আত্মপ্ৰতিষ্ঠার পথ খুঁজেছিলেন এবং সেই পথেই স্বজাতির ভিতরে আত্মোপলব্ধিপ্ৰদীপ্ত স্বাদেশিকতা উদ্বোধিত করার চেষ্টা করেছিলেন, রামমোহন থেকে রবীন্দ্রনাথ পৰ্যন্ত সেই সকল ভারত পথিকই আধুনিক বুদ্ধিদ্বারা পরিমার্জিত ভারতীয় অধ্যাত্মবাদের মধ্যে এক পরম প্ৰশান্তি লাভ করেছিলেন। টোলঘরের সংস্কৃত পড়া বিদ্যাসাগরই এই ধারার বিস্ময়কর ব্যতিক্ৰম। আর এদের ভিতরে রবীন্দ্রনাথই অধ্যাত্মবাদকে লোকোত্তর ব্ৰহ্মলোক থেকে টেনে এনে মানব-সমাজের সামগ্রিক রূপের মধ্যে এক বৃহত্তম মানবিকতাবোধের সঙ্গে একাত্ম করে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
এখানে বিবেকানন্দের দার্শনিক দৃষ্টির সামনে সব চেয়ে বড় বাধা ছিল শংকরের মায়াবাদ। এ বাধা তিনি অতিক্রম করতে পারেন নি। তাঁর সমাজ দর্শনে তিনি যে ঔপনিষদিক ঐক্য ও সমগ্ৰতাবোধকে তুলে ধরেছিলেন তার সঙ্গে মায়াবাদের যে একটা মৌলিক দার্শনিক অসঙ্গতি আছে একথা তিনি স্বীকার করতে রাজী ছিলেন না। কিভাবে তিনি কষ্টকল্পিত সঙ্গতির চেষ্টা করেছিলেন আমাদের প্রবন্ধের প্রারম্ভে উদ্ধৃত চিঠিখানির উপসংহারই তার প্ৰমাণ। শ্রমজীবির বিপ্লবের দ্বারা সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর, সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠার পর মানুষ বুঝতে পারবে সমাজ সংসার সব মিথ্যা, ঈশ্বরই একমাত্র সত্য। তখন ঈশ্বরানুভূতির দরজায় গিয়ে মানুষকে ধর্ণা দিতে হবে। এই সত্যোপলব্ধির জন্যও তাই সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে মানুষকে যেতে হবে। মানুষকে সবরকম অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে বুঝতে দেয়া হোক, শেষ পর্যন্ত ঈশ্বর ছাড়া গতি নেই। তাঁর বিচারবুদ্ধি ছিল বিজ্ঞানধর্মী ও মানবধর্মী, সমাজ-বাস্তবের বিশ্লেষণে তাই তিনি আধুনিক সত্যদৃষ্টির পথে অনেকদূর অগ্রসর হতে পেরেছিলেন, কিন্তু হৃদয়টি ছিল দ্বিখণ্ডিত। নিপীড়িড় মানুষের মর্মবেদনায়, সামাজিক অর্থনৈতিক বৈষম্যের প্রতিবাদে প্রচণ্ড বিক্ষোভে এই হৃদয় উদ্বেলিত হত, আর একদিকে অলৌকিক অনুভূতির উপর গভীর বিশ্বাস, শংকর-বেদান্তের প্রতি প্ৰগাঢ় অনুরাগ ঐ একই হৃদয়কে এক লোকোত্তর প্রশান্তির কোলে টেনে নিয়ে যেত—শেষ পর্য্যন্ত সব মিথ্যা, সবই মায়া। শংকর-প্রদর্শত অধ্যাত্মবাদই ভারতের সব চেয়ে বড় ঐতিহ্য। এই অধ্যাত্মবাদের পুনরুজ্জীবনের দ্বারাই মানুষের চরম মুক্তি সম্ভব হবে এ বিশ্বাস তিনি ছাড়তে পারেন নি। দেশবিদেশে বৈপ্লবিক প্ৰচেষ্টার সাময়িক বিফলতা, ভারতবর্ষের সমাজজীবনের গ্লানিময় পরিবেশ, বৃটিশ শাসনের অত্যাচারের বিরুদ্ধে ফলহীন নিরুপায় প্ৰতিবাদ, নিপীড়িত শ্রেণীর মধ্যে ঐক্য ও সংহতির অভাব, শ্রমজীবি মানুষের আত্মিক ও নৈতিক চরিত্রের সীমাহীন দুর্বলতা এ সব কিছু মিলিয়ে তার হৃদয়ে মাঝে মাঝে হয়ত এমন এক হতাশার সৃষ্টি করত যার ফলে মায়াবাদকে আরও বেশী করে আঁকড়ে ধরার এক বিপরীত প্রেরণা তিনি আরও বেশী করে অনুভব করতেন। রামকৃষ্ণদেবের হৃদয়টিও ছিল মানবিকতা ও অলৌকিকতার এক অদ্ভুত সংমিশ্রণ। রামকৃষ্ণ অলৌকিক ঈশ্বরকে প্রত্যক্ষ করেছেন এবং উপযুক্ত শিষ্যকে প্রত্যক্ষ করাতে পারেন, এই লোকোত্তর বিশ্বাসে তার বিন্দুমাত্র শিথিলতা ছিল না। ঈশ্বর-প্রত্যক্ষটাও কেন্দ্রীভূত সমাহিত চিত্তের উপর প্ৰযুক্ত একধরণের self-hypnotic প্রক্রিয়া কিনা, এ জাতীয় সন্দেহ ও অবিশ্বাসকে তিনি শেষ পৰ্য্যন্ত আমল দেননি। রামকৃষ্ণের চরিত্রের কতগুলি অপূর্ব মানবিক গুণ বিবেকানন্দের উপর যাদুর মত কাজ করেছে এবং এই মানবিক আকর্ষণ অলৌকিকতা পৰ্যন্ত প্রসারিত হয়েছে। এই সবকিছু মিলিয়েই বিবেকানন্দের চরিত্রে স্ববিরোধিতার উৎস আমাদের সন্ধান করতে হবে।
আর একটা কথা উল্লেখ করা বোধ হয় অপ্রাসঙ্গিক হবে না। অবশ্য রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের গোড়া ভক্তের দল এজন্য এই প্ৰবন্ধ-লেখকের ভিতরে “অৰ্বাচীনের আস্পৰ্দ্ধা” র সন্ধান পাবেন বলে আশংকা আছে। তথাপি একথা স্পষ্ট করেই বলা প্রয়োজন যে শংকরের মায়াবাদের প্রকৃত দার্শনিক-চরিত্র সম্পর্কে বিবেকানন্দের স্পষ্ট ধারণা ছিল না। শংকর-বেদান্তের বিবেকানন্দকৃতী ব্যাখ্যার ভিতরে যুক্তির চেয়ে আবেগের প্রাবল্য অনেক বেশী। মায়াবাদের তিনি কোথাও বিশেষ বিস্তৃত অর্থ করেন নি, অথচ বেদান্ত সম্বন্ধে সাধারণভাবে তিনি অনেক বক্তব্যই উপস্থিত করেছেন।
“অদ্বৈত-মতে এক বিজ্ঞান স্বরূপ ব্ৰহ্ম জগতের উপাদান কারণ ও নিমিত্তে কারণ, দুইই বটে। ব্ৰহ্ম জগত রূপে অভিব্যক্তি হয়েছে। কিন্তু পরিণত হয়নি; জগত্ নেই, ব্রহ্মই আছে। মায়া সম্পর্কে ধারণা করতে হলে বেদান্তের এই মূলকথাটি বুঝতে হবে।…যা আছে তা শুধু ব্ৰহ্ম, পার্থক্য ও বহুত্ব সবই মায়াকৃত। … … ভারতবর্ষ হাজার হাজার বছর ধরে পৃথিবীর সকল জাতির কাছে এই challenge জানিয়েছে। ফল হয়েছে, সেই জাতিগুলি সব মুছে গেছে, তোমরা বেঁচে আছ। জগতটা ভ্ৰান্তিমাত্র, সব কিছু মায়া। তুমি নখ দিয়ে মাটি খুঁটেই খাবার খাও বা সোনার থালায় করেই খাও, তুমি প্ৰবল প্ৰতাপশালী রাজচক্রবর্তী হয়ে প্রাসাদেই বাস কর, অথবা তুমি দীনতম ভিক্ষুকই হও, শেষ পরিণতি মৃত্যু, সব সমান, সব মায়া। এই হল বিশ্বের প্রতি ভারতের challenge” (The Vedanta in All its Phases–Lectures from Colombo to Almora, P 323-324) এই উদ্ধৃতির ভিতরে প্রথম অংশটুকু শংকর বেদান্তের একটা মূল কথা বটে, কিন্তু পরে যেভাবে মায়াবাদের ব্যাখ্যার উপসংহার টানলেন—ওগুলো কোনও দার্শনিক কথা নয়। মায়াবাদের স্বরূপ বুঝতে এ কথাগুলি বিন্দুমাত্র সাহায্য করে না। এ জাতীয় মায়াবাদের প্রচার হিন্দুঘরের দর্শনানভিজ্ঞ বৃদ্ধবৃদ্ধার দলও দিনরাত করে থাকেন। “রাজা প্ৰজা ধনী দরিদ্র মৃত্যুতে সব সমান, সংসার মিথ্যা মায়াময়”। এর বেশী আর কিছুই বলা হল না। আর এ কথাটিই যদি বিশ্বের প্রতি ভারতবর্ষের challenge হয়ে থাকে, তবে বিশ্বের পক্ষে এই challenge-এর কোন উত্তর দেবার প্রয়োজন পড়ে না। ভারতবর্ষ অনেকবার নিজের মুমূর্ষু অবস্থার ভিতর দিয়ে নিজেই এর উত্তর দিয়েছে।
শঙ্কর-বেদান্তের অধ্যবসায়ী ছাত্র মাত্রেই জানেন যে মায়াবাদের মূলকথা মায়া বা অবিদ্যার ভাব-রূপতা এবং অনির্বচনীয়তা (Positiveness and Indefinability)। শংকরশিষ্য পদ্মপাদ থেকে আরম্ভ করে ষোড়শ শতাব্দীর মধুসূদন সরস্বতী পৰ্যন্ত কয়েক শ’ বছর ধরে, কয়েক হাজার পৃষ্ঠা ধরে এই অনির্বাচ্যতাবাদের রহস্য উদঘাটন করেছেন। সেই সূক্ষ্ম দার্শনিক বিচারের মধ্যে না গিয়ে ‘সব মায়ার খেলা’ বলে ছেড়ে দিলে কিছুই বোঝা যায় না, challenge তো দূরের কথা। কিন্তু এত পরিশ্রম, এত, কূট তর্কের পরও সার কথাটা এই মাত্র দাঁড়াল—জগতের অস্তিত্ব বা নাস্তিত্ব কোনটাই মুক্তি বা তর্কের দ্বারা, কোন ন্যায়সম্মত ধারণার দ্বারা নিরূপণ করা যায় না; নির্বাচন করা যায় না। সুতরাং জগত অনির্বচনীয়, অথচ একে অভাব বা শুদ্ধ negation বলেও কল্পনা করা যায় না, জগতের প্রতীতিটা ভাবরূপেই হয়ে থাকে। এই অর্থেই জগত মায়াময়। এই ভাবরূপে প্ৰতিভাত, অথচ যুক্তি ও সংজ্ঞার দ্বারা অস্তি বা নাস্তি রূপে অনির্বচনীয় বিশ্বপ্ৰপঞ্চের ভাবনা থেকে যদি একটা abstract principle-এর কল্পনা করা যায়, যা সৎও নয়, অসৎও নয়, সদসৎও নয়, সেই ভাবরূপ অনির্বচনীয়তা সর্বস্ব abostraction-এর নাম দেয়া হয়েছে “মায়া” ভা “অবিদ্যা”—“সদসদ্ভ্যাম্ অনির্বাচ্যা মিথ্যাভূত সনাতনী”। এই অর্থেই জগৎ মিথ্যা। যেহেতু এই অবিদ্যাকে সৎ বা অসৎ অথবা সদসৎ কোনও ভাবেই নির্বাচন করা যায় না, সুতরাং একে ব্রহ্মের অতিরিক্ত একটি দ্বিতীয় সত্তারূপেও দাঁড় করানো যায় না। তাই ভাবরূপ অবিদ্যা স্বীকারের দ্বারা ব্রহ্মের অদ্বৈততত্ত্ব খণ্ডিত হয় না।
অদ্বৈত বৈদান্তিকদের ভিতরে দুর্ধর্ষতম তার্কিক কবি-দার্শনিক শ্ৰীহৰ্ষ “মায়া” সম্পর্কে এই জাতীয় ব্যাখ্যার মধ্যে একধরণের scepticism বা সন্দেহবাদের আশংকা করেই পূৰ্বপক্ষের একটা আপত্তিও সঙ্গে সঙ্গে আশঙ্কা করেছেন—“আপনারা যদি জগতের কোন যুক্তিসিদ্ধ সংজ্ঞা নির্ধারণ করতে না পারেন, তবে উপযুক্ত আচার্যের কাছে সংজ্ঞা-নির্ধারণ-প্ৰণালীটাি শিক্ষা করে নিন, আপনার ন্যায়শাস্ত্র অনুসারে সংজ্ঞা ঠিক করা যাবে না বলে জগতটা মিথ্যা হয়ে যাবে এমন দাবী করবেন কেন? পূর্বপক্ষ এ আপত্তি তুলতে পারেন। তাদের আমরা অদ্বৈতবাদীরা এই কথাই বলব,–আপনার যারা জগতের অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন, আপনারাই আপনাদের বিশ্বাস অনুসারে এই অস্তিত্বের লক্ষণটা কি বলুন। আমরা দেখিয়ে দেব কোন লক্ষণই ধোপে টিকবে না। তবে কি জগতের অস্তিত্ব নেই? তাহলে আপনারাই জগতের নাস্তিত্বে লক্ষণ বলুন। আমরা দেখিয়ে দেব তাও সম্ভব নয়। সুতরাং জগতের অস্তিত্ব নাস্তিত্ব নিয়ে আমরা মাথা ঘামাই না। আপনাদের যুক্তি অনুসরণ করেই জগতটাকে অনির্বাচনীয় বলছি। যদি আমাদের কথা বলেন, আমরা একটি মাত্রই সত্তা নিয়ে সন্তুষ্ট আছি, সেই এক অদ্বিতীয় বিজ্ঞানস্বরূপ ব্ৰহ্মসত্যের উপর নির্ভর করেই আমরা চরিতার্থ।”।
এখন গঙ্গাযাত্রীর বৈরাগ্যবাণীর জগৎটাকে মায়াময় বলি, অথবা সূক্ষ্ণ দার্শনিক অর্থেই মায়াময় বলি, প্রশ্ন থেকে যায় এই মায়াবাদের সার্থকতা কি? বিবেকানন্দ কি এই মায়াবাদ প্রচার করেই ভারতের প্রতি বিশ্বের শ্রদ্ধা আকর্ষণের চেষ্টা করেছিলেন। সমগ্ৰ মানব সমাজের মৌলিক একতা, বিদ্বেষমুক্ত এক মানবিক সংহতি, স্বাৰ্থ-গন্ধহীন স্বাভাবিক মানবীয় শুভ বুদ্ধি, মানুষ মূলত: শুদ্ধ বুদ্ধ মুক্ত অপাপবিদ্ধ,-ব্যক্তিগত লোভ, অন্যের উপর পীড়ন ও শোষণ মূল মানব প্রকৃতির ব্যভিচার-ঔপনিষদিক সমগ্রতাবাদী দর্শনের এই মানবমুখী ব্যাখ্যা জগতের সামনে দৃঢ় আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে তুলে ধরতে না পারলে প্ৰাচীন ভারতীয় আদর্শের প্রতি পশ্চিম দেশের শ্রদ্ধা আকর্ষণ করা সম্ভব হত না।
মায়াবাদের সার্থকতার প্রসঙ্গটি আমরা নিছক ব্যবহারিক দৃষ্টিকোণ থেকেই উত্থাপন করিনি, “বিশুদ্ধ দার্শনিক” দৃষ্টিকোণ থেকেও উত্থাপন করেছি। জগতটা যদি মূলত: মিথ্যাই হয় তবে এই দিব্যজ্ঞান লাভ করা না করায় কার কি আসে যায়, যুক্তিতর্কের দিক থেকেই বা কি হানি হয়? জগতটা মিথ্যা হলে আমার এই দিব্যজ্ঞানে বঞ্চিত হবার ঘটনাটি, আর আপনার এই দিব্যজ্ঞান লাভ করার ঘটনাটি উভয়েই সমান মিথ্যা। আমার ও আপনার সকল বিশ্বাস অবিশ্বাস সবই সমান মিথ্যা। আমি যদি বস্তুজগতটাকে সত্য মনে করে মায়ামোহে ডুবে থাকি, আর আপনি যদি অসত্য মনে করে মায়ামোহ উত্তীর্ণ হয়ে থাকেন, উভয়েরই জ্ঞান-অজ্ঞানের সমান মূল্য। কারণ একমাত্ৰ ব্ৰহ্মই সত্য কি মিথ্যা, জগতটা সত্য কি মিথ্যা তা ত আপনার বা আমার বিশ্বাস বা অবিশ্বাসের উপর নির্ভর করছে না। এজন্য ব্ৰহ্মজ্ঞান লাভ করার কোন প্রয়োজন পড়েন। কারণ বিজ্ঞানস্বরূপ ব্ৰহ্ম আমার ব্ৰহ্মজ্ঞান লাভের উপর নির্ভর করে বসে নেই। তিনি স্বয়ম্ভূ নিজে নিজের মতই আছেন; আপনি কঠোর ব্রহ্মচর্য্য গ্রহণ করে জগতে ব্রহ্মজ্ঞান বিতরণ করুন, আর আমি দিব্যি দুদিন ইন্দ্ৰিয় সুখে মগ্ন থাকি। আপনার বরং বৃথা কষ্ট করাটাই সার। কারণ আপনার কৃচ্ছ্রসাধন আর আমার সুখসম্ভোগ দুই শেষ পর্যন্ত সমানে মিথ্যা। আর যে জগতটাই নেই তাকে উদ্ধার করার জন্য এত প্রচার, আয়োজন, এত গাদায় গাদায় বই লেখা, এত বক্তৃতা, সবই পণ্ডশ্রম। জগৎটা উদ্ধার হল আর নাই হল, জগত যে মিথ্যা, সেই মিথ্যা, ব্ৰহ্ম যে সত্য সেই সত্য। সুতরাং শংকর-বেদান্ত মূলত: non-ethical philosophy, শুধু তাই নয়, এক ধরনের atheistic philosophy-ও বটে। কারণ-শংকর বেদান্তের যুক্তি নৈয়ায়িক নিষ্ঠার সহিত অনুসরণ করলে সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বরও মূলত মিথ্যা, ঈশ্বরোপাসনার কোনো প্রয়োজন পড়ে না। পাপ পুণ্যের ভিতরে, ন্যায় অন্যায়ের ভিতরে তফাৎ করার কোন বাস্তব নিরিখ থাকে না। এর উত্তরে বলা হয়ে থাকে ঈশ্বরোপাসনা ও পুণ্যকর্মের দ্বারা চিত্তশুদ্ধি হয়, সেই বিশুদ্ধচিত্তে ব্ৰহ্মজ্ঞান প্ৰতিফলিত হওয়ার সুযোগ হয়। এরও উত্তর আগেই আমরা দিয়ে রেখেছি। নাই বা হ’ল ব্রহ্মজ্ঞান, নাই বা জানলাম তিনি সত্য, নাই বা মানলাম জগত মিথ্যা, যা মিথ্যা তা মিথ্যাই রইল, যা সত্য তা সত্যই রইল। আমার ব্ৰহ্মজ্ঞানী হবার প্রয়োজন নেই। আমি ব্ৰহ্মজ্ঞানী হলেও মুক্ত না হলেও মুক্ত, কারণ আমি নেই, তিনিই আছেন। অথবা আমি, তুমি, তিনি কেউ নেই, কেবল এক “Impersonal It’ মাত্র আছে।
এই বে-কায়দার অবস্থা থেকে পারা পাবার জন্য জগতের একটা ব্যবহারিক সত্তা বা Pargmatic existence এর Coneept আমদানী করা হয়েছে। কিন্তু তাতেই বা যুক্তির দিক দিয়ে লাভ কি হল। ব্যবহারিক সত্তাটাও মূলত মিথ্যা। মনে করুন জগতটা অনাদিকাল ধরে দীর্ঘায়ত একটা স্বপ্ন, আর রাতের স্বপ্নটা ঐ স্বপ্নের অন্তবর্তী একটা হ্রস্ব স্বপ্ন। এখন রাতের স্বপ্ন থেকে “জাগতিক” স্বপ্নটা সত্তা হিসাবে উচ্চতর আসন পাবে কি জন্য? স্বপ্নটা দীর্ঘতর হলেই কি সত্যতার হয়? বিশেষত পরমাৰ্থ ব্ৰহ্মসত্যের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যবহারিক সত্তাটা যখন মিথ্যা, তখন প্রাতিভাসিক সত্তা ও ব্যবহারিক সত্তার মধ্যে উনিশ-বিশ করার যুক্তি কোথায়? এই পার্থক্যটাও মিথ্যা। এখন তাহলে এই মিথ্যা জগতের মিথ্যা জীবগুলোকে মিথ্যা উদ্ধার করার জন্য এই মিথ্যা হস্ত-প্ৰসারণের প্রয়োজন কি? এই প্রশ্নের মুখে শংকর-বেদান্ত আজ পৰ্যন্ত নিরুত্তর। সব চেয়ে বড় কথা, যে বস্তু-জগতের অস্তিত্বের উপর বাস্তব-বিশ্বাস না রাখলে কোন মায়াবাদী বৈদান্তিকের একটি নিমেষও বেঁচে থাকার উপায় নেই, এক পা চলার শক্তি নেই, একটা কথা মুখ দিয়ে বার করার ক্ষমতা নেই, সেই জগতটাকে একটি ব্যবহারিক সত্তার সুক্ষ্ণ সূতায় ঝুলিয়ে রেখে দায় সারার চেষ্টা করলেও দার্শনিক ভণ্ডামির দায় থেকে অব্যাহতি পাবার উপায় নেই।
তাই বলছিলাম, বিবেকানন্দের শাংকরী মায়া সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা ছিল না। তিনি যেখানে মায়ার ব্যাখ্যা করেছেন সেখানে আরও দশজন সংসার-বিবাগীর মতই—ঈশ্বর সত্য, জগত মায়াময় এইটুকু বলেই ছেড়ে দিয়েছেন। মায়াবাদের প্রতি তার অনুরাগটা mysticism-এরই একটা অঙ্গ। যে সামাজিক দৃষ্টিতে শ্রমজীবির সাম্যবাদী সমাজবিপ্লবের ন্যায্যতা ও অবশ্যম্ভাবিতা ধরা পড়েছিল সেই বৈজ্ঞানিক দৃষ্টির সহিত মায়াবাদের কোন সামঞ্জস্য নেই। বিবেকানন্দ আরও এক জায়গায় বলেছেন—“শংকরের বিরাট বুদ্ধি ছিল, কিন্তু বিশাল হৃদয় ছিল না”—(“The Sages of India”)। একথা যখন তিনি বলেছিলেন তখন মায়াবাদ তাকে বিভ্রান্তি করেনি। তাঁর মতে তিনি যেভাবে মায়ার ধারণা করেছিলেন তা আধ্যাত্মিক রহস্যবাদের প্ৰতি একটা অলৌকিক বিশ্বাসের সহোদর।
প্রাচীন ঔপনিষদিক যুগের মানবিক গৌরবকে ফিরিয়ে এনে বর্তমানকে উদ্ধৃদ্ধ করতে গেলে কিঞ্চিৎ বিপদের সম্ভাবনাও আছে। বিবেকানন্দ Hindu Revivalism-এর মারফত জগতশুদ্ধি ও জাতিশুদ্ধির চেষ্টা করেছিলেন। এই শুদ্ধি-পদ্ধতিতে প্ৰাচীনযুগের মানবধর্মী গৌরবদীপ্তির সঙ্গে সঙ্গে তার রহস্যঘন অধ্যাত্মবাদের কুজ্বাটিকাকেও আমন্ত্রণ করে নিয়ে আসার আশংকা থাকে। বিবেকানন্দের মানবধর্মও তাই অধ্যাত্মবাদের কুয়াসা থেকে মুক্ত হতে পারেনি।
কিন্তু রাজশক্তি, বিত্তশক্তি ও মোহন্ত শক্তি যে চেষ্টাই করুক না কেন, নিপীড়িত লাঞ্ছিত মানুষের বিবেকবাণী যে বীর সন্ন্যাসীর কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছিল তার প্রদীপ্তমূর্তিকে শংকর-বেদান্তের ধূম্রমায়ায় চিরদিন আবৃত রাখা যাবেনা। দেশের মানুষ মানুষ-বিবেকানন্দকে খুঁজে বের করবে—যে মানুষ ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রান্তসন্ধ্যায় দ্বিধাহীন কণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন–‘আসন্ন শূদ্রবিপ্লবের পদধ্বনি আমি শুনতে পাচ্ছি। সে আসবেই, কেউ তাকে ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না।’
পৃথিবীর এক বিরাট অংশ জুড়ে সে বিপ্লব আজ এসে গেছে, নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। সেই দেশের শূদ্র জনসাধায়ণ ব্ৰাহ্মণের জ্ঞান, ক্ষত্রিয়ের ক্ষমতা ও বৈশ্যের সম্পদশক্তিকে আয়ত্ত করে তাকে অতিক্রম করে চলে গেছে। শূদ্র-বিপ্লবের ভিত্তিতে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা-প্রতিষ্ঠিত হবার পরও যদি মানুষ কোনও রহস্যময় ঈশ্বরের কাছে আত্মসম্পর্পণের প্রয়োজন অনুভব করে, তাহলে তাই করবে। কিন্তু সে বিপ্লব, সে সমাজতন্ত্র আগে আসুক। এওত হতে পারে, শোষণহীন পৃথিবীতে সকল মানবিকগুণের অফুরন্ত উন্মেষে চির-ভাস্বর এক ঐক্যবদ্ধ মানবসমাজই তখন ঈশ্বরের স্থান গ্রহণ করবে। সে সমাজ হিরণ্যগৰ্ভ; সেই সহস্রশীর্ষ, সহস্রচক্ষু, সহস্রপাদ বিরাট পুরুষের জ্যোতিতে বিশ্ব জ্যোতির্ময় হবে। উপনিষদের প্রাচীন প্রজ্ঞামন্ত্র যে ঐক্য ও সমগ্রতার কথা ঘোষণা করেছিল। এই পথেই তার চরম সার্থকতা প্ৰমাণিত হবে। আমাদের ভারতবর্ষেও সেদিন যখন আসবে তখন দেশের মানুষ শ্রদ্ধানম কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করবে। সেই বৈদান্তিক সন্ন্যাসীকে যিনি প্রচার করতে চাইলেন শংকরবেদান্ত, কিন্তু ঘোষণা করলেন শোষিত মানুষের মর্মবাণী, আহ্বান জানালেন সাম্যবাদী শূদ্র-বিপ্লবকে।
[বিবেকানন্দের সমাজচিন্তামূলক উদ্ধৃতিগুলি খুঁজে দেখতে ডঃ ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের “Swami Vivekananda–Patriot Prophet’ গ্রন্থখানি থেকে অনেক সাহায্য পেয়েছি। ডঃ দত্তের গ্রন্থে বিবেকানন্দের গ্রন্থাবলীর যে পৃষ্ঠা নির্দেশ করা হয়েছে তার সঙ্গে আমি যে পৃষ্ঠা নির্দেশ করেছি। তার অসঙ্গতি আছে। কারণ, আমি গ্রন্থাবলীর পরবর্তী সংস্করণগুলি ব্যবহার করেছি।–লেখক।]
স্যার আমাদের ভারতের সাধারণ ঘরের ছেলেরা নতুন কিছু আবিষ্কার করলে তাদের কে সাহায্য করে ভারতে বা ভারতের কোন সংস্থা সাহায্য করে ভারতে স্যার আমি একটি নতুন বিমান তৈরি করবো সে বিমান চলবে জলশক্তি আর সৌরশক্তি দ্বারা স্যার আমাকে তৈরি করার জন্য দয়া করে সাহায্য করুন স্যার আমি যে প্রজেক্ট তৈরি করবো তা বর্তমানে এখন কোনো দেশের কাছে নাই স্যার আমি সাধারণ পরিবারের ছেলে স্যার আমাকে তৈরি করা জন্য দয়া করে সাহায্য করুন স্যার