বিবাহ-সমস্যা

বিবাহ-সমস্যা 

প্রথম পরিচ্ছেদ 

দৈনিক কার্য্য শেষ করিয়া কিছুক্ষণ বিশ্রাম করিতেছি, এমন সময়ে একজন কনেষ্টবল আসিয়া আমার হাতে একখানি কার্ড দিল। রাত্রি আটটা বাজিয়া গিয়াছে, একস্থানে একটা বিবাহের নিমন্ত্রণ ছিল বলিয়া, অফিসের কাজকৰ্ম্ম শীঘ্রই সমাপন করিয়াছিলাম। সহসা সেই কার্ডখানি পাইয়া মনে মনে বিরক্ত হইলাম। কার্ডখানির দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া যুগপৎ আশ্চৰ্য্যান্বিত ও ভীত হইলাম। 

কার্ডখানিতে সর্ব্বরঞ্জন রায়ের নাম লেখা ছিল। রায় মহাশয়ের সহিত আমার বিশেষ সদ্ভাব, বহুকাল হইতে তিনি আমার পরিচিত। তাঁহারই কন্যার বিবাহ উপলক্ষে আমি সেদিন নিমন্ত্রিত হইয়াছিলাম। কোথায় আমি তাঁহার বাড়ীতে যাইব, না তিনিই সেই অসময়ে আমার নিকট কার্ড পাঠাইয়া দিয়াছেন। ব্যাপার কি, বুঝিতে পারিলাম না। 

আমার কোন উত্তর না পাইয়া কনেষ্টবল বলিল “বাবু স্বয়ং কার্ড পাঠাইয়া দিয়া বাহিরে গাড়িতে অপেক্ষা করিতেছেন।” আমি আরও আশ্চর্যান্বিত হইলাম। ভাবিলাম, নিশ্চয়ই কোন বিপদ হইয়াছে। কন্যার বিবাহের সময় প্রায় নিকটবৰ্ত্তী, এমন সময়ে স্বয়ং কন্যাকর্তার কোন ভয়ানক বিপদ না হইলে পুলিসে আসিবে কেন? কিন্তু এ সকল চিন্তা করিবার সময় ছিল না। কার্ডখানির পশ্চাৎ দিকে যাহা দেখিলাম, তাহাতে আমার ধারণাই সত্য হইল। “শীঘ্র আসিবেন, আমার সর্ব্বনাশ হইয়াছে” এই কয়টি কথা যেন কম্পিত হস্তে অতি ধীরে ধীরে লিখিত হইয়াছে বলিয়া বোধ হইল। 

আমি আর বিলম্ব করিলাম না; তখনই সেই কনেষ্টবলের সহিত বাহিরে আসিলাম। আমাকে দেখিবামাত্র সর্ব্বরঞ্জন গড়ি হতে অবতরণ করিলেন এবং আমার হাত ধরিয়া পুনরায় গড়ির উপর আরোহণ করিলেন। আমরা গড়িতে উঠিবার পর তিনি কোচম্যানকে শকট চালনা করিতে আদেশ দিলেন। অশ্বে কশাঘাত করিয়া কোচম্যান গড়ি চালাইয়া দিল। 

আমার অফিস হইতে তাঁহার বাড়ী প্রায় দুই ক্রোশ। সেখানে পৌঁছিতে অর্দ্ধ ঘণ্টার অধিক লাগিবে সন্দেহ নাই। কিন্তু তখনও পর্যন্ত সর্ব্বরঞ্জন বাবু কোন কথা বলেন নাই, মস্তক অবনত করিয়া নীরবে অশ্রুপাত করিতেছিলেন। 

কিছুক্ষণ পরে তিনি আত্মসংবরণ করিলেন। পরে বলিলেন “ভায়া! আমার সর্ব্বনাশ হইয়াছে। আমার ধন গেল, মান গেল, সৰ্ব্বস্ব গেল। আমার অদৃষ্টে এতও ছিল?” 

আমি জিজ্ঞাসা করিলাম “কে আপনার সৰ্ব্বস্ব লইয়াছে? বিবাহ-বাড়ীতে কি চুরি হইয়াছে?” 

সর্ব্বরঞ্জন বাবু সহসা উত্তেজিত হইলেন; বলিলেন “সে নাই, সে নাই, এই ছিল; কোথায় গেল, কেমন করিয়া গেল? কিছুই বলিতে পারি না। আপনি আগে সেখানে চলুন, তবে সব জানিতে পারিবেন।” 

প্রকৃত কথা জানিতে না পারিয়া, আমি আন্তরিক বিরক্ত হইলাম। কিন্তু মুখে তাহা প্রকাশ করিলাম না। কোন কোন লোকে বিপদে পড়িলে একেবারে জ্ঞান হারাইয়া থাকেন। তাঁহারা মনের উদ্বেগে প্রকৃত কথা, দুঃখের প্রকৃত কারণ ভুলিয়া যান এবং আপন ইচ্ছামত কেবল নিজের শোক-প্রকাশক হা হুতাশ করিয়া সময়ক্ষেপ করেন। 

সর্ব্বরঞ্জন বাবুকে উন্মাদপ্রায় দেখিয়া আমি অতি বিনীত ভাবে, জিজ্ঞাসা করিলাম “কে নাই সর্ব্বরঞ্জন বাবু? কি হইয়াছে? সকল কথা পরিষ্কার করিয়া না বলিলে আমার দ্বারা আপনার কোন উপকার হইবে না।” 

সর্ব্বরঞ্জন কি চিন্তা করিলেন। পরে বলিলেন “কি আশ্চর্য্য, সে কথা কি আপনি এখনও বুঝিতে পারেন নাই? কল্যাণী নাই।—আজ তাহার বিবাহ, বিবাহ উপলক্ষে আমার বাড়ী লোকে লোকারণ্য। কল্যাণী-বিবাহের পাত্রী নাই। আমার মান গেল, ধন গেল, সকলই গেল।” 

এইরূপে তিনি আরও কত কি বলিয়া বিলাপ করিতে লাগিলেন বলিতে পারি না, কিন্তু আমি বাধা দিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম “কখন হইতে কল্যাণীকে দেখিতে পাইতেছেন না? আজ তাহার বিবাহ, প্রায় সমস্ত দিনই তাহার সহিত কেহ না কেহ আছে, আজ সে কোথায় যাইবে? আপনি সকল কথা পরিষ্কার করিয়া বলুন?” 

সর্ব্বরঞ্জনবাবু, ত্তর করিলেন “সমস্ত দিনই কল্যাণীর নিকট অন্যান্য রমণীগণ ছিলেন। রাত্রি নয়টার পর হইতে লগ্ন আছে। কিন্তু বর লগ্নের অনেক পূর্ব্বেই মহা সমারোহে আমার বাড়ীতে উপস্থিত হইলেন। তাহাকে দেখিবার জন্য সকলেই বাহিরে আসিলেন। বাড়ীর ভিতর এক কল্যাণীই ছিল। রাত্রি প্রায় আটটার সময় অন্দরে আমার ডাক পড়িল। সেখানে গিয়া যাহা শুনিলাম, তাহাতেই আমার অন্তরাত্মা শুকাইয়া গেল। শুনিলাম, কল্যাণী কিছুক্ষণ একা অন্দরে ছিল, তাহার পর যখন বর দেখিয়া রমণীগণ অন্দরে ফিরিয়া যান, তখন কল্যাণীকে দেখিতে পান নাই। তখনই চারিদিকে লোক পাঠাইয়া দিলাম, তাহারা প্রাণপণে অন্বেষণ করিল : কল্যাণীকে কোথাও দেখিতে পাওয়া গেল না। বাড়ীর খিড়কী দরজা খোলা রহিয়াছে। যে সকল অলঙ্কার তাহার গাত্রে ছিল, সেগুলি সমস্তই খুলিয়া, বাছা আমার রাখিয়া গিয়াছে। আর সকলই রহিয়াছে, কেবল সে নাই — কল্যাণী নাই। আমি আর অপেক্ষা করিতে পারিলাম না, আমার স্ত্রী ও আর যে কয়েকজন মহিলা এ বিষয় জানেন, তাহাদিগকে এই কথা রাষ্ট্র করিতে নিষেধ করিয়া আমি আপনার নিকট ছুটিয়া আসিয়াছি।” 

সর্ব্বরঞ্জন বাবুর কথা শুনিয়া আমি আশ্চৰ্য্যান্বিত হইলাম। ভাবিলাম, এরূপ অদ্ভুত ঘটনা ত পূৰ্ব্বে কখনও শুনি নাই। বিবাহ রাত্রে কখনও কখনও পাত্র পলায়ন করিয়াছে বটে, কিন্তু পাত্রীর অন্তর্ধানের কথা এ পর্যন্ত আমার কর্ণ গোচর হয় নাই। কল্যাণীকে আমি অনেকবার দেখিয়াছি। তাহার বয়স প্রায় তের বৎসর। এই বয়সে তাহার এ কি বুদ্ধি হইল বুঝিতে পারিলাম না। এইরূপ ভাবিয়া বলিলাম “কল্যাণী নিশ্চয়ই কোথাও লুকাইয়া আছে। নতুবা সে কোথায় যাইবে? আর আপনি তাহার অন্তর্ধানের কথা কাহারও নিকট প্রকাশ করিতে নিষেধ করিয়া বড় ভাল কাজই করিয়াছেন। কিন্তু আমার বিশ্বাস, কল্যাণী কোথাও যায় নাই, আপনাদেরই বাড়ীর কোন স্থানে লুকাইয়া আছে।” 

স। না মহাশয়! বাড়ী তোলপাড় করিয়া কল্যাণীর সন্ধান করা হইয়াছে। তাহাকে নিশ্চয়ই কোন লোক চুরি করিয়া লইয়া গিয়াছে। হায়! যখন বরের পিতা এ কথা শুনিবেন, তখন কি বলিবেন? আপনি স্বয়ং ব্রাহ্মণ, আজ যদি কল্যাণীর বিবাহ না হয়, তাহা হইলে আমাকে যে জাতিচ্যুত হইতে হইবে, তাহা আপনি বিশেষরূপে অবগত আছেন। 

আ। কাহার সহিত কল্যাণীর বিবাহ হইতেছে? 

স। হালদারদের একটি পুত্রের সহিত কল্যাণীর সম্বন্ধ স্থির করিয়াছিলাম, কল্যাণীর অদৃষ্ট ভাল, তাই অমন ঘরে তাহার বিবাহ হইতেছে। 

আ। পাত্রের নাম কি? 

স। মোহিনীকান্ত হালদার, নীলরতন হালদারের একমাত্র পুত্র। ছেলেটি এই বৎসরে এফ-এ পাশ করিয়া বি-এ পড়িতেছে। যেমন ঘর, তেমনই বরও মিলিয়াছিল, কিন্তু কি করিব, কল্যাণীর অদৃষ্টে অত সুখ নাই বোধ হয়। 

আমি মোহিনীকান্তকে চিনিতাম। তাহার বাড়ীর নিকট আমার একজন বন্ধ বাস করেন। মধ্যে মধ্যে আমাকে সেখানে যাইতে হয়। ছেলেটি বাস্তবিকই অতি উত্তম। পাড়ার কোন বালকের সহিত তাহার সৌহার্দ্দ নাই। তাহার একমাত্র বন্ধুর নাম নলিনীকান্ত। নলিনীকান্তের স্বর্গীয় পিতা রমানাথ মুখোপাধ্যায়ের সহিত সর্ব্বরঞ্জন বাবুর চির বিবাদ ছিল। সামান্য কারণে এই বিবাদ উপস্থিত হয়। একটা প্রকাণ্ড মাঠ লইয়াই এই উভয় পরিবারের মধ্যে মনোমালিন্য ঘটে। বহুকাল ধরিয়া মোকদ্দমায় উভয় পক্ষেরই যথেষ্ট অর্থব্যয় হইয়া যায়। কিন্তু তাহাতেও কেহ শাস্ত হন নাই। দুই তিন পুরুষ ধরিয়া এই বিবাদ চলিয়া আসিতেছে। 

যতক্ষণ আমি এইরূপ চিন্তা করিতেছিলাম, ততক্ষণ সর্ব্বরঞ্জন বাবু রোদন করিতেছিলেন। ক্রমে গড়ি তাঁহার বাড়ীর নিকট উপস্থিত হইল দেখিয়া, আমি বলিলাম “শুনুন সর্ব্বরঞ্জন বাবু! আপনি এত বিচলিত হইলে কোন কাৰ্য্যই সিদ্ধ হইবে না। এক কার্য্য করুন, আর একবার কল্যাণীর অন্বেষণের জন্য দুই তিনজন বিশ্বাসী লোককে নিযুক্ত করুন। বিবাহ স্থগিত রাখিবার প্রয়োজন নাই। কল্যাণীর সমবয়স্ক কোন বালিকা কি আপনার বাড়ীতে নাই? কিছুদিন পূর্ব্বে আপনি কথায় কথায় বলিয়াছিলেন যে, আপনার এক ভ্রাতুষ্কন্যা কল্যাণীর সমবয়স্কা এবং কল্যাণীর অবয়বের সহিত তাহার আকৃতির যথেষ্ট সামঞ্জস্য আছে। যখন আপনার বাড়ীতে বিবাহ, তখন নিশ্চয়ই অনেক স্ত্রীলোক নিমন্ত্রিত হইয়া আসিয়াছেন। সম্ভবতঃ আপনার ভ্রাতুস্কন্যাও এখন আপনার বাড়ীতে আছে।” 

সর্ব্বরঞ্জন বাবু আমার মুখে দিকে চাহিলেন। বলিলেন, “আজ্ঞে হাঁ, গঙ্গা আমার বাড়ীতে আছে। সে তাহার পিতামাতার সহিত বিবাহের তিন দিন পূর্বেই আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে। কিন্তু আপনি কি প্রস্তাব করিতেছেন বুঝিতে পারিতেছি না; গঙ্গার সহিত মোহিনীকান্তের বিবাহ হইতে পারে না। মোহিনীর কুষ্ঠির সহিত কল্যাণীর কুষ্ঠি মিলিয়া গিয়াছে। গঙ্গার পিতামাতাই বা সম্মত হইবেন কেন?” 

আমি ঈষৎ হাসিয়া উত্তর করিলাম “না না, আমি সে কথা বলিতেছি না। যতক্ষণ না কল্যাণীকে পাওয়া যায়, ততক্ষণ গঙ্গাকে কল্যাণী সাজিতে হইবে। কল্যাণীর সন্ধান পাইলে তাহার সহিতই মোহিনীকান্তের বিবাহ হইবে। আপনার বাড়ীর যে সকল মহিলা কল্যাণীর অন্তর্দ্ধানের কথা জানিতে পারিয়াছেন, তাঁহারা যদি কোন কথা প্রকাশ না করেন, তাহা হইলে আর কেহই এই বিষয় জানিতে পারিবেন না। কল্যাণী বিবাহের কাপড় ও গহনা রাখিয়া গিয়াছে। আপনি সেই বস্ত্রালঙ্কার দ্বারা গঙ্গাকে সজ্জিতা করুন এবং তাহাকে কল্যাণীর আসনে বসাইয়া দিন। কুশণ্ডিকা না হইলে ব্রাহ্মণের বিবাহ সম্পূর্ণ হয় না। কুশণ্ডিকা কাল হইবে বলিবেন। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এই সময়ের মধ্যেই আমি কল্যাণীর সন্ধান পাইব।” 

আমার কথা শেষ হইতে না হইতে আমরা সর্ব্বরঞ্জন বাবুর বাড়ীতে আসিয়া উপস্থিত হইলাম। বাড়ীর অনেকেই আমার পরিচিত, বিশেষ বিবাহে আমিও নিমন্ত্রিত হইয়াছিলাম, সুতরাং আমাকে দেখিয়া কাহারও মনে কোন প্রকার সন্দেহের উদয় হয় নাই। 

আমি গোপনে সর্ব্বরঞ্জন বাবুকে বলিলাম “এখন আমার পরামর্শ মত কার্য্য করুন। বিবাহ স্থগিত রাখিবার প্রয়োজন নাই। যদি এখনও কল্যাণীকে না পাওয়া গিয়া থাকে, তাহা হইলে আপনার ভ্রাতুষ্কন্যা গঙ্গাকেই কন্যারূপে সাজাইয়া আনুন। বিবাহের সময় উপস্থিত–আর বিলম্ব করিবার প্রয়োজন নাই। ইতিমধ্যে যে সামান্য বিলম্ব হইয়াছে, তাহাতে অনেকে অনেক কথা বলিতেছেন দেখিতেছি। কিন্তু আপনি তাহাতে কর্ণপাত করিবেন না। নাচ যেমন হইতেছে, তেমনই হউক। বরং নর্তকীগণকে কিছু পারিতোষিক দিয়া উত্তেজিত করুন। উপস্থিত ব্রাহ্মণদিগকে পাঁচ টাকা করিয়া বিদায় দিন। যে সকল ভিক্ষুক আপনার বাড়ীর চারিদিকে বিবাহের অপেক্ষা করিতেছে, তাহাদিগকে প্রচুর খাদ্যসামগ্রী দিয়া সন্তুষ্ট করুন। এই সমস্ত করিতে আপনার কিছু অধিক ব্যয় হইবে বটে কিন্তু ইহাতে নিমন্ত্রিত লোকদিগের মনে কোনরূপ সন্দেহ হইবে না। কেবল আমাকে গোপনে সংবাদ দিবেন কল্যাণী ফিরিয়া আসিয়াছে কি না? আর এক কথা, যে ঘরে কল্যাণী একা বসিয়াছিল, সেই ঘরটি আমি একবার পরীক্ষা করিতে চাই। সুবিধামত আমাকে সে ঘরে লইয়া যাইবার উপায় করিবেন। 

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ 

আমার কথায় সর্ব্বরঞ্জন বাবু যেন অনেকটা শান্ত হইলেন। তিনি তখনই আমার আদেশ পালন করিবার জন্য অন্দরে প্রবেশ করিলেন। আমি সেই স্থানে বসিয়া রহিলাম। 

রায় পরিবার বহুদিন হইতে বিখ্যাত। বাড়ীখানি প্রকাণ্ড। আমি কখনও ভিতরে প্রবেশ করি নাই বটে কিন্তু শুনিয়াছি, বাড়ীখানি তিন মহল। তিন মহলেই তিনটি প্রাঙ্গণ আছে; তবে প্রথম মহলের উঠানই সকলের অপেক্ষা বড়। সেই উঠানে প্রকাণ্ড আটচালা বাঁধা হইয়ছে। তাহার ভিতরদিক নানা বর্ণের কাপড় দিয়া অতি সুন্দররূপে সজ্জিত। চারিদিকে বেলোয়ারি ঝাড় ও দেয়ালগিরি। মেঝের সুকোমল গালিচার উপর দুগ্ধফেননিভ শুভ্র চাদর পাতা রহিয়াছে। নিমন্ত্রিত ব্যক্তিগণ যথাযোগ্য স্থানে উপবেশন করিয়া বাইনাচ দেখিতেছেন। সর্ব্বরঞ্জন বাবু বরযাত্রী ও কন্যাযাত্রীদিগের মনস্তুষ্টির জন্য বাইনাচ দিয়াছিলেন। নিকটেই কিছু উচ্চ ও স্বর্ণখচিত মখমলের বিছানার উপর পাত্র স্বয়ং উপবিষ্ট। 

আমি সে অঞ্চলে অনেকেরই পরিচিত ছিলাম। অনেকেই আমাকে সর্ব্বরঞ্জন বাবুর অকপট বন্ধুও দূরসম্পর্কীয় ভ্রাতা বলিয়া সন্দেহ করেন। 

অনেকেই আমার সহিত সাদর সম্ভাষণ করিলেন। তাঁহাদের কথায় স্পষ্টই বুঝিতে পারিলাম যে, বিবাহে বিলম্ব হইতেছে বলিয়া তাঁহারা বিরক্ত হইয়াছেন। মনে করিলাম, একবার সর্ব্বরঞ্জন বাবুকে ডাকাইয়া পাঠাই, কিন্তু সাহস হইল না। পাছে নিমন্ত্রিত ব্যক্তিগত কিছু সন্দেহ করেন, এই ভয়ে সে সম্বন্ধে কোন কথা না বলিয়া একমনে বাইনাচ দেখিতে লাগিলাম। 

কিছুক্ষণ পরেই সর্ব্বরঞ্জন তিন চারিজন আত্মীয় লোকের সহিত বাহিরে আসিলেন এবং প্রথমতঃ নাচওয়ালীদিগকে যথেষ্ট পুরস্কার দিয়া সন্তুষ্ট করিলেন। তাহার পর তাঁহারা উপস্থিত ব্রাহ্মণমণ্ডলীকে যথোচিত অর্থদান করিলেন। বাহিরে যে সকল ভিক্ষুক জমা হইয়াছিল, তাহারাও আশাতিরিক্ত বিদায় পাইল। 

এই সকল কার্য্যে প্রায় একঘণ্টা অতীত হইল। কিন্তু লোকে বিরক্ত হওয়া দূরে থাকুক সকলেই একবাক্যে সর্ব্বরঞ্জনের যথেষ্ট প্রশংসা করিতে লাগিল। ওই সময়ের মধ্যে আমার পরামর্শমত কল্যাণীকে আর একবার অন্বেষণ করা হইল, কিন্তু তাহাকে কোথাও পাওয়া গেল না। 

রাত্রি প্রায় দশটার সময় সর্ব্বরঞ্জন বাবু আমাকে “গঙ্গার সহিত বিবাহ দিতে চলিলাম” এই কথা বলিয়া শুভকাৰ্য্য সম্পাদনের জন্য ব্রাহ্মণ ও নিমন্ত্রিত ব্যক্তিবর্গের অনুমতি প্রার্থনা করিলেন। সকলেই সানন্দে সে প্রার্থনায় সম্মত হইলেন। তখন সর্ব্বরঞ্জন বিবাহ স্থানে পাত্র লইয়া গমন করিলেন। 

সেই প্রাঙ্গণেরই একপার্শ্বে বিবাহের স্থান নিৰ্ব্বাচিত হইয়াছিল। আমি যেখানে বসিয়াছিলাম, সেখান হইতে পাত্রকে বেশ দেখিতে পাওয়া গেল। 

এদিকে নিমন্ত্রিত লোক সকলের আহারাদির বন্দোবস্ত হইতে লাগিল। প্রকাণ্ড ছাদে প্রায় সকলেই আহারে বসিলেন। অনেকেই ভাবিল, আমি সর্ব্বরঞ্জন বাবুর পরম বন্ধু; বাড়ী ফিরিবার জন্য ব্যস্ত নহি, এই কারণে এখন আহার করিতে যাইলাম না। 

আমি যেখানে বসিয়াছিলাম, সেইখানেই রহিলাম, কেবল মধ্যে মধ্যে পাত্রের দিকে দেখিতে লাগিলাম। প্ৰাথমিক ক্রিয়া শেষ করিয়া স্ত্রী-আচারের জন্য পাত্রকে অন্দরে লইয়া গেল। প্ৰায় অৰ্দ্ধঘণ্টা সেখানে থাকিয়া বর কন্যার সহিত পুনরায় বিবাহস্থানে ফিরিয়া আসিল। 

বর যখন পুনরায় আপনার নির্দিষ্ট আসনে উপবেশন করিল, আমি তখনই তাহার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিলাম। যাহা দেখিলাম, তাহাতে আমার সন্দেহ হইল। পূর্ব্বে তাহাকে যেন বিমর্ষ দেখিয়াছিলাম, কিন্তু এখন তাহার মুখ বেশ প্রফুল্ল। এখন আর সে পূর্ব্বের মত নিশ্চল নিস্পন্দ জড় নহে, হস্ত-পদবিশিষ্ট সৃষ্টির প্রধান জীব মানব বলিয়াই বোধ হইল। কেন এ পরিবর্ত্তন? স্ত্রী আচারের সময় রমণীগণ নানাপ্রকার কৌতুক ও উপহাস করিয়া থাকেন, এমন কি, বরকে প্রহার পর্যন্ত নীরবে সহ্য করিতে হয়। সেই জন্যই কি সে এখন এত প্রফুল্ল –এত চঞ্চল। তাহাও সম্ভব নহে। মোহিনীকান্তের চরিত্রের বিষয় যতদূর জানি, তাহাতে তাহাকে অতি সৎস্বভাবাপন্ন বলিয়াই বোধ হয়। সে মূর্খ নয়। এফ-এ পাশ করিয়া যখন বি-এ পড়িতেছে, তখন তাহার অনেকটা হিতাহিত জ্ঞান জন্মিয়াছে। সে যে সামান্য আমোদে এত পরিবর্তিত হইবে তাহা বোধ হয় না। ইহার মধ্যে কোন গূঢ় রহস্য আছে। 

এই চিন্তা করিয়া আমি সাবধান হইয়া কেবল মোহিনীর দিকে চাহিয়া রহিলাম। সর্ব্বরঞ্জন নিজ কন্যার পরিবর্তে ভ্রাতৃষ্কন্যা গঙ্গাকে মন্ত্রপাঠ করিয়া দান করিলেন। মোহিনীও মন্ত্রপাঠ করিয়া সেই দান গ্রহণ করিলেন। বলা বাহুল্য, আমার আদেশ মত কল্যাণীর কাপড় ও গহনা সমস্তই গঙ্গার অঙ্গে ছিল। 

ক্রমে শুভদৃষ্টির সময় আসিল। পাত্র ও পাত্রীর মস্তকের উপর একখানা মূল্যবান চাঁদোয়া ধরা হইল। আমি যেখানে বসিয়াছিলাম, সেখান হইতে আর বরের মুখ দেখা গেল না। কাজেই কনের মুখ দেখিবার ভাণ করিয়া চাঁদোয়ার কিছু নিকটে গমন করিলাম। 

যখন চারিচক্ষু সম্মিলিত হইল, যখন মোহিনীকান্ত গঙ্গার দিকে চাহিয়া দেখিল, তখনই আমি মোহিনীর প্রফুল্লতার কারণ বুঝিতে পারিলাম। জানিলাম, কল্যাণীকে বিবাহ করিতে তাহার আন্তরিক ইচ্ছা ছিল না। কেবল পিতামাতার কথায় এ কাৰ্য্যে সম্মত হইয়াছিল। এখন গঙ্গা তাহার মনোমত হওয়ায় তাহার এত আনন্দ। গঙ্গাকে আমি ইতিপূর্ব্বে দেখি নাই। গঙ্গার পিতা সর্ব্বরঞ্জনের সহোদর ভ্রাতা নহেন। সুতরাং তিনি অন্যত্র বাস করিতেন; কাজে-কর্ম্মে কখনও কখনও আসিয়া থাকেন। আমার সহিত তাঁহার আলাপ নাই, সুতরাং গঙ্গা যে কে তাহা আমি জানিতাম না, কিন্তু এখন দেখিলাম, গঙ্গা পরমাসুন্দরী, কল্যাণীর মত লাবণ্য না থাকিলেও গঙ্গার সৌন্দর্য্য সামান্য নহে। কিন্তু মোহিনী কেন যে কল্যাণীকে বিবাহ করিতে নারাজ ছিল, তখন বুঝিতে পারিলাম না। 

মোহিনীকান্ত কল্যাণীকে চিনিত। সে জানিত, কল্যাণীর সঙ্গেই তাহার বিবাহ হইবে, কিন্তু বিবাহের সময় দেখিল, সে যাহা শুনিয়াছিল, তাহা ভ্রম। তাহার স্ত্রী যখন মনোমত হইয়াছে, তখন যাহাই হউক না কেন, মোহিনী কোন কথা বলিল না। 

তৃতীয় পরিচ্ছেদ 

যে ঘর হইতে কল্যাণী চুরি গিয়াছে, সেটি বাড়ীর তৃতীয় মহল। বিবাহের পর বরের বসিবার স্থান হইয়াছে দ্বিতীয় মহলে। বরকে সেই ঘরে লইয়া যাইবার পরই সর্ব্বরঞ্জন বাবু আমার নিকট আসিয়া বলিলেন “ভায়া! যদি সেই ঘরটা দেখা বিশেষ আবশ্যক বোধ করেন, তাহা হইলে এই উপযুক্ত সময়। পূৰ্ব্বেই আপনাকে বলিয়াছি, এইবার দ্বিতীয় মহলের দোতলার বড় ঘরে বরের বসিবার বন্দোরস্ত করিয়াছি। তৃতীয় মহলের কেন, বাড়ীর যে যেখানে রমণী আছেন, সকল স্থান হইতেই আসিয়া তাঁহারা ওই ঘরে আশ্রয় লইবেন। তাই বলিতেছিলাম, এই উপযুক্ত সুযোগ। আমি কিন্তু আপনাকে এদিক দিয়া সেখানে লইয়া যাইতে পারিব না। আপনাকে খিড়কী দিয়া যাইতে হইবে। সেই পথ দিয়াই কল্যাণীকে লইয়া গিয়াছে। 

আমি সম্মত হইলাম। সর্ব্বরঞ্জন বাবু তাঁহার বিশ্বাসী চাকরকে আমার সঙ্গে দিলেন। সে আমার পশ্চাৎ পশ্চাৎ আসিতে লাগিল। চাকরের কথামত আমি সহজেই খিড়কী দিয়া বাড়ীর তৃতীয় মহলে প্রবেশ করিলাম। কি প্রকাণ্ড বাড়ী! এক একটা ঘর যেন এক একটা দালান। 

ভিতরে প্রবেশ করিয়া ভৃত্য একবার চারিদিক দেখিয়া আসিল। কেহ নাই দেখিয়া, সে আমাকে সেই ঘরে লইয়া গেল। যদিও সে সময়ে কোন লোক সে মহলে ছিল না, কিন্তু শীঘ্রই আসিবার সম্ভাবনা জানিয়া, আমি ভৃত্যকে সেই মহলে প্রবেশ করিবার দ্বার বন্ধ করিয়া দিতে বলিলাম। ভৃত্য অতি বিনীত ভাবে উত্তর করিল, সে পূর্ব্বেই সে কাজ সম্পন্ন করিয়াছে। 

ঘরের ভিতর প্রবেশ করিয়া আমি একবার চারিদিকে বিশেষ করিয়া পরীক্ষা করিলাম। কিন্তু কোন ফল হইল না, ঘরের ভিতর হইতে কোন সূত্র পাইলাম না। 

আমি তখন খিড়কী দরজার নিকট আসিলাম। ভৃত্যকে একটা আলোক আনিতে বলিয়া আমি সেইখানে অপেক্ষা করিতে লাগিলাম। ভৃত্য তখনই একটা আলোক আনিল। আমি সেই আলোকের সাহায্যে দেখিলাম, দরজাটি ভিতর হইতেই খোলা হইয়াছিল। বাহিরে যে শিকল ছিল, তাহা খোলাই থাকে, কেবল ভিতর দিকের হুড়কো বন্ধ হয়। ভিতর দিক হইতে কে সেই দরজা খুলিল? কল্যাণী তখন একা ছিল, তাহার নিকটে আর কোন লোক ছিল না। সম্ভবতঃ সে স্বয়ং দরজা খুলিয়াছে। যদি তাহাই হয়, তাহা হইলে কল্যাণী স্বয়ং ইচ্ছা করিয়াই বাড়ী হইতে পলায়ন করিয়াছে। অপর কোন লোক যে বলপূর্ব্বক তাহাকে চুরি করিয়া লইয়া গিয়াছে, এ কথা মনে স্থান পাইল না। কিন্তু এ সকল কথা সর্ব্বরঞ্জন বাবুর নিকট প্রকাশ করিলাম না। 

খিড়কী দরজাটি পরীক্ষা করিয়া আমি সেই স্থান পরীক্ষা করিতে লাগিলাম। যাহা দেখিলাম, তাতে আশ্চৰ্য্যান্বিত হইলাম। দেখিলাম, দরজা হইতে অতি সামান্য দূরে দুইখানি ক্ষুদ্র পায়ের চিহ্ন, শেষ চিহ্নের নিকট একজনের জুতার চিহ্ন রহিয়াছে। কিন্তু তাহার পর আর কোন চিহ্ন দেখিতে পাইলাম না। কেবল যেখানে সেই জুতার চিহ্ন দেখা গিয়াছিল, সেইখান হইতে একখানি গড়ির চাকার দাগ দেখা গেল। 

এই সকল চিহ্ন দেখিয়া আমি স্পষ্টই বুঝিতে পারিলাম, কল্যাণী স্ব-ইচ্ছায় কোন যুবকের সহিত পলায়ন করিয়াছে। কিন্তু সে যুবক কে, তাহা বুঝিতে পারিলাম না। ভাবিলাম, কল্যাণীর বয়স তের বৎসর। এ বয়সে আজকাল কলিকাতার অনেকেই অবিবাহিতা থাকে। কল্যাণীকে দেখিয়া বড় শান্ত বালিকা বলিয়া বোধ হইত, কিন্তু এখন তাহার কার্য্য দেখিয়া চমৎকৃত হইলাম। 

প্রায় এক কোয়ার্টার নানা প্রকার চিন্তার পরও আমি কল্যাণীর প্রণয়ী কে জানিতে পারিলাম না। পুনরায় পরীক্ষা আরম্ভ করিলাম। দরজা অতিক্রম করিয়া দশ পনর হাত দূরে যেখানে সেই পুরুষের পদচিহ্ন দেখিয়াছিলাম, সেইখানে একখানা কাচ কুড়াইয়া পাইলাম। কাচখানি তখন পকেটে রাখিয়া আমি আরও কিছুক্ষণ চেষ্টা করিলাম, কিন্তু বিশেষ কিছু করিতে পারিলাম না। এক প্রকার হতাশ হইয়া আমি সেখান হইতে বাহির হইলাম। ভৃত্যকে সেই মহলে আসিবার দরজা খুলিতে আদেশ করিয়া আমি পুনরায় সর্ব্বরঞ্জন বাবুর বহিৰ্ব্বাটীতে উপস্থিত হইলাম। 

আমাকে দেখিয়া সর্ব্বরঞ্জন নিকটে আসিলেন, কিন্তু সাহস করিয়া কোন কথা জিজ্ঞাসা করিতে পারিলেন না। আমি সঙ্কেত করিয়া বুঝাইয়া দিলাম যে, তখনও কৃতকার্য হইতে পারি নাই। 

সর্ব্বরঞ্জন বিমর্ষ হইলেন। আমি তাঁহার মনোগত ভাব বুঝিতে পারিয়া, তাঁহাকে সান্ত্বনা করিলাম এবং কিছুক্ষণ এক নিভৃত স্থানে বসিয়া গভীর চিন্তায় নিমগ্ন হইলাম। 

কিছুক্ষণ পরেই হঠাৎ আমার মনে এক অদ্ভুত ভাবের উদয় হইল। আমি পকেট হইতে সেই কাচখানি বাহির করিয়া বারম্বার দেখিতে লাগিলাম। ভাবিলাম, কাচখানি কাহারও চশমা হইতে খুলিয়া পড়িয়াছে। কাচখানির রং ফিকে নীল, দৃষ্টিশক্তি বৃদ্ধির জন্য লোকে এ প্রকার কাচের চশমা ব্যবহার করে না। চক্ষুকে শীতল রাখিবার উদ্দেশ্যেই এই প্রকার চশমা ব্যবহৃত হইয়া থাকে। আমার বোধ হইল, সেইদিন প্রাতে কোন লোককে ওই প্রকার চশমা চক্ষে দিতে দেখিয়াছি। কিন্তু কাহার চক্ষে যে সেই চশমা ছিল, তাহা সহজে মনে আসিল না। 

আরও কিছুক্ষণ অতীত হইল। নিমন্ত্রিত লোক সকল আহারাদি সমাপন করতঃ স্ব স্ব গৃহে প্রত্যাগমন করিলেন। নর্তকী সকল পুরস্কার পাইয়া বিশেষ আনন্দের সহিত নৃত্য করিতেছিল, দর্শকবৃন্দ প্রস্থান করিল দেখিয়া তাহারাও নৃত্য স্থগিত রাখিল। বাহির-বাড়ীটা কিয়ৎ পরিমাণে নিস্তব্ধ হইল বটে, কিন্তু অন্দর হইতে মধ্যে মধ্যে এমন হাসির রোল উঠিতে লাগিল যে, সেই শব্দে আমি চমকিত হইলাম। 

কিছুক্ষণ চিন্তার পর আমার মনে হইল, সেইদিন প্রাতে যখন সর্ব্বরঞ্জনের বাড়ীর নিকট দিয়া যাইতেছিলাম, সেই সময়ে একজন মুসলমানকে এই প্রকার কাচযুক্ত চশমা পরিতে দেখিয়াছি। এখন একে একে সকল কথা মনে পড়িল। আমি যখন ওই বিবাহ-বাড়ীর নিকট দিয়া যাইতেছিলাম, তখন বেলা প্রায় দশটা বাজিয়া গিয়াছে। যে কাৰ্যে আসিয়াছিলাম, তাহাতে অধিক সময় অতীত হওয়ায়, আমার গড়ি অতি দ্রুতবেগেই যাইতেছিল। হঠাৎ সর্ব্বরঞ্জনের বাড়ী হইতে প্রায় পঞ্চাশ গজ দূরে একটা প্রকাণ্ড জনতা দেখিয়া কোচমান অশ্বের গতি সংযত করিলে আমি কারণ জিজ্ঞাসা করিলাম। সে বলিল, একজন গণৎকার সকলের হাত দেখিয়া ভূত ভবিষ্যৎ ও বর্ত্তমান বলিয়া দিতেছে। সেইজন্য পথে এত ভিড় যে, গড়ি চালাইতে পারিতেছি না। 

গণৎকারের নাম শুনিয়া আমারও কৌতুহল জন্মিল এবং তাহার সহিত সাক্ষাৎ করিবার ইচ্ছা হইল। কিন্তু তজ্জন্য আমায় গড়ি হইতে নামিতে হইল না। কণ্ঠস্বর শুনিয়া গণৎকার স্বয়ং আমার গড়ির নিকট আসিল। বলিল “দারোগাবাবু! এদিকে আসিয়াছিলেন? দেখুন, এখানকার লোকে আমায় যেন পাগল পাইয়াছে। আমি যেখানে যাইতেছি, উহারাও আমার অনুসরণ করিতেছে। সেই জন্যই পথে এত ভিড়।” 

গণৎকারের কথা শুনিয়া, আমার স্পষ্টই বোধ হইল, সে আমাকে চেনে; কিন্তু আমার ত কিছুই মনে পড়িল না। আমি যে তাহাকে কোথা দেখিয়াছি, অনেক চেষ্টা করিলেও তাহা মনে পড়িল না। কিন্তু গণৎকারকে সে কথা জিজ্ঞাসা করিলাম না। তাঁহার কথায় হাসিয়া বলিলাম, – “তুমি যখন লোকের ভূত, ভবিষ্যৎ বলিতে পার, তখন উহারা তোমায় ছাড়িবে কেন?” 

গণৎকারও হাস্য করিল “বলিল; আপনার আশীর্ব্বাদে আমি জ্যোতিষশাস্ত্র শিক্ষা করিয়াছি। আমার নাম ইব্রাহিম খাঁ, আপনাকে আমি বেশ জানি। সেদিন যে ভয়ানক চুরি হইয়া গিয়াছে, যাহার সন্ধানের ভার আপনার হস্তে পড়িয়াছে, তাহার আসামীদিগকে শীঘ্রই ধরিতে পারিবেন। যদি দয়া করিয়া আপনার হস্তপ্রসারণ করেন, তাহা হইলে ঠিক সময় নির্দ্দেশ করিয়া বলিতে পারি।” 

আমি ঈষৎ হাসিয়া বলিলাম “আমি বড় ব্যস্ত। তুমি যখন আমায় চেন, তখন নিশ্চয়ই আমার বাসা জান। কাল প্রাতে আমার সহিত সাক্ষাৎ করিও। সেই সময়ে আমার হাত দেখিয়া যাহা গণনা করিতে হয় করিও।” 

ইব্রাহিম খাঁ আমার কথায় সন্তুষ্ট হইল। বলিল “আপনি বেশ বলিয়াছেন। কালই আপনার হাত দেখিব। আপনি কোথায় থাকেন তাহা বেশ জানি।” 

আমি জিজ্ঞাসা করিলাম “তুমি হাত দেখিবার জন্য কত পারিশ্রমিক লইয়া থাক?” 

ইব্রাহিম খাঁ হাত নাড়িয়া বলিল “এমন কথা বলিবেন না। পয়সা লইয়া হাত দেখিবার হুকুম নাই। আমার গুরুর আদেশ যে, বিনা পয়সায় সকলের অদৃষ্ট ফলাফল বলিয়া দিব। তবে যদি কেহ সন্তুষ্ট হইয়া পুরস্কার স্বরূপ কিছু দিতে ইচ্ছা করেন, তাহা হইলে সে টাকা গ্রহণে বাধা নাই। আমি এইমাত্র এই বিবাহ-বাড়ী হইতে আসিতেছি। কন্যাকৰ্ত্তা আমার প্রতি সন্তুষ্ট হইয়া পাঁচ টাকা পুরস্কার দিয়াছেন।” এই বলিয়া ইব্রাহিম খাঁ আমাকে পাঁচটা টাকা দেখাইল। 

আমি জিজ্ঞাসা করিলাম “কি জন্য তোমায় পুরস্কার দিলেন? তুমি কি করিয়াছিলে?” 

ইব্রাহিম খাঁ হাসিতে হাসিতে বলিল “তাঁহার কন্যার হাত দেখিয়া তাঁহার ভাবী সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের কথা গণনা করিয়া বলিয়াছিলাম, এই বিবাহ এত সমারোহে সম্পন্ন হইবে যে, গ্রামের সমস্ত লোকের অনেকদিন যাবৎ এ কথা স্মরণ থাকিবে। এই বিবাহ দ্বারা এক ভয়ানক পরিবর্তন সাধিত হইবে। অবশ্য সে পরিবর্তনে উভয় পক্ষেরই সাতিশয় মঙ্গলের সম্ভাবনা।” 

আমি আর কোন কথা কহিলাম না দেখিয়া, ইব্রাহিম সেলাম করিয়া প্রস্থান করিল। আমিও কোচম্যানকে গড়ি চালাইতে আদেশ করিলাম। দেখিলাম, সেই লোকসকল আবার ইব্রাহিম খাঁকে বেষ্টন করিয়া ফেলিয়াছে। 

চতুর্থ পরিচ্ছেদ 

ইব্রাহিম খাঁর বয়স প্রায় কুড়ি বৎসর। কিন্তু তাহাকে দেখিতে এখন পঞ্চাশ বৎসরের বৃদ্ধ বলিয়া ভ্রম হয়। যদিও সে নিতান্ত কৃশ বা দুৰ্ব্বল নহে, তথাপি তাহার মুখ দেখিয়া বোধ হয়, তাহার যৌবন অতীত হইয়াছে। মুখে একপুরু ময়লা জমিয়া গিয়াছে। কতকাল যে ইব্রাহিম স্নান করে নাই তাহা বলা যায় না। তাহার পরিধানে একটা সাদা পায়জামা, একটা ফতুয়া, তাহার উপর একটি টুপী, তাহার চারিদিকে একটা চাদর জড়ান। পায়ে লাহোরের চটী, চক্ষে চশমা। এই চশমার কাচের মত একখানি কাচ আমার নিকট ছিল। কাচখানি ভাল করিয়া দেখিয়া বোধ হইল, সেখানি, ইব্রাহিমের চশমা খুলিয়া পড়িয়াছে। ইব্রাহিম নিশ্চয়ই এখানে অনেকবার আসিয়াছিল। প্রথমবারে যখন সে কল্যাণীর হাত দেখিয়া গণনা করিয়াছিল, তখন তাহার চশমার দুইখানি কাচই ছিল। নিশ্চয়ই সে তাহার পর আবার এখানে আসিয়াছিল। 

ইব্রাহিম কে? লোকটাকে দেখিয়াই বোধ হইয়াছিল, যেন সে আমার পরিচিত। কিন্তু আর কোথায় যে তাহাকে দেখিয়াছি, তাহা তখন স্থির করিতে পারি নাই। ইব্রাহিম নিশ্চয়ই একজন ছদ্মবেশী। তাহার সর্ব্বাঙ্গে রং-মাখান বলিয়া বোধ হয়। নতুবা মানুষের গাত্রে ময়লা সম্ভবে না। সে আমাদিগকে ভুলাইবার জন্য গাত্রে রং মাখিয়াছিল। কে সে? এইরূপ নানাপ্রকার চিন্তা করিতেছি, এমন সময়ে হঠাৎ একজনের উপর সন্দেহের উদয় হইল। সন্দেহ উত্তরোত্তর বাড়ীতে লাগিল। ক্রমে এমন বোধ হইল যে, সেই কল্যাণীকে লইয়া পলায়ন করিয়াছে। 

যাহার উপর সন্দেহ হইল, তাহার নাম নলিনীকান্ত। তাহার বাড়ী সর্ব্বরঞ্জন বাবুর বাড়ী হইতে অর্দ্ধ মাইল দূরে। নলিনীকান্তের পিতামাতা উভয়েই স্বর্গারোহণ করিয়াছেন। সেই এখন সমস্ত সম্পত্তির মালিক। প্রবেশিকা পর্যন্ত পড়িয়াছিল। কিন্তু পরীক্ষা দেয় নাই; তবে সে ইংরাজীতে বেশ কথাবার্তা কহিতে পারিত। ইঁহারা মুখুয্যে নামে খ্যাত। 

বহুদিন হইতে এই মুখুয্যে পরিবারের সহিত রায় পরিবারের বিবাদ চলিয়া আসিতেছে। একটা প্রকাণ্ড মাঠ লইয়াই এই বিবাদ আরম্ভ হয়। নলিনীকান্তের পিতামহ এই বিবাদের সূত্রপাত করেন, এখনও সম্পূর্ণ মিটিয়া যায় নাই। এই দীর্ঘকাল ব্যাপী মোকদ্দমায় উভয় পক্ষের কত অর্থব্যয় হইয়াছে, তাহা বলা যায় না। 

সর্ব্বরঞ্জন বাবুই ন্যায়সঙ্গত সেই মাঠের অধিকারী। বিচারকও সেই প্রকার মন্তব্য প্রকাশ করিয়াছেন। এই সমস্ত সংবাদ আমি সর্ব্বরঞ্জন বাবুর মুখে শুনিয়াছিলাম। নলিনীকান্তকেও আমি বেশ চিনিতাম। যদিও তাহার পিতা ও পিতামহের সহিত সর্ব্বরঞ্জন বাবুর বিবাদ চলিতেছিল, তদাপি নলিনীকান্ত মধ্যে মধ্যে সর্ব্বরঞ্জন বাবুর বাড়ীতে আসিত এবং সামান্য দুই একটা কথা কহিয়া চলিয়া যাইত। তাহার আন্তরিক ইচ্ছা ছিল, যাহাতে তাহার পৈতৃক বিবাদ মিটিয়া যায়। 

যে যুবকের সহিত কল্যাণীর বিবাহের কথা ছিল, তাহার সহিত নলিনীকান্তের বড়ই সদ্ভাব। মোহিনী বিদ্বান, নলিনী মূর্খ, মোহিনী দুর্বল ও কৃশ, নলিনী সবল ও হৃষ্টপুষ্ট, মোহিনী কেবল পুস্তক লইয়াই থাকিত, নলিনী কেবল বনে বনে পক্ষী শিকার করিয়া বেড়াইত; উভয়ের চরিত্রতে এই প্রকার বৈষম্য থাকিলেও উভয়ের মধ্যে কেন যে এত সদ্ভাব হইল, তাহা বলিতে পারিলাম না। দিনের মধ্যে এক নির্দিষ্ট সময়ে উভয়ের সাক্ষাৎ হইত। সেই সময়ে তাহারা পরস্পর পরস্পরের নিকট মনোভাব প্রকাশ করিত। 

একদিন আমি নলিনীকে ওই প্রকার কথা কহিতে দেখিয়া তাহাকে নিকটে ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম “নলিনীকান্ত! তোমার সহিত মোহিনীর এত সদ্ভাব কিরূপে হইল? তোমাদের উভয়ের চরিত্র একপ্রকার না হইলেও তোমাদের মধ্যে যত সদ্ভাব দেখিতে পাওয়া যায়, এমন আর কোথাও দেখা যায় না।” 

নলিনী ঈষৎ হাসিয়া আমার দিকে চাহিল। বলিল “মোহিনী আমা অপেক্ষা অনেক বিষয় ভালরূপ জানে। আমি তাহাকে যখন যাহা জিজ্ঞাসা করি, সে কিছুমাত্র বিরক্ত না হইয়া অতিসরল কথায় আমাকে তাহা বুঝাইয়া দেয়। অথচ তাহার জন্য সে কখনও অহঙ্কার করে না। তাহার মত সচ্চরিত্র বালক এ অঞ্চলে নাই। সেই জন্যই আমাদের উভয়ের এত সদ্ভাব দেখিতে পান। বিশেষতঃ, মোহিনী দুর্ব্বল, আমি সবল, সে যেমন একবিষয়ে আমার সাহায্য করে, আমিও তেমনই অপরাপর অনেক বিষয়ে তাহার সাহায্য করিয়া থাকি।” 

আমি আর কোন উত্তর করি নাই। এখন সেই চশমার কাচখানি পাইয়া আমার একে একে সমস্ত কথা মনে পড়িল। আমার দৃঢ়বিশ্বাস হইল যে, এই নলিনীকান্তই কল্যাণীকে লইয়া পলায়ন করিয়াছে। 

পঞ্চম পরিচ্ছেদ 

এইরূপ চিন্তায় রাত্রি প্রায় এগারটা বাজিল। আর সময় নষ্ট করা উচিৎ নহে বিবেচনা করিয়া, আমি তখনই নলিনীকান্তের বাড়ী গেলাম এবং বাহির হইতে চীৎকার করিয়া ডাকিতে লাগিলাম। কিছুক্ষণ পরে একজন ভৃত্য আসিয়া দ্বার খুলিয়া দিল। বলিল “নলিনী বাবু বাড়ীতে নাই।” যদিও নলিনীর সহিত সাক্ষাৎ হইল না, তথাপি সে বাড়ী নাই শুনিয়া আন্তরিক আনন্দিত হইলাম। ভাবিলাম, আমার সন্দেহ বুঝি সত্যে পরিণত হইল। কিন্তু আমি গম্ভীর ভাবে জিজ্ঞাসা করিলাম “তিনি গেলেন কোথায়? রাত্রি এগারটা বাজিয়া গিয়াছে, এখনও বাড়ীতে ফিরেন নাই?” 

ভৃত্য আমার কর্কশ গম্ভীরস্বর শুনিয়া কাঁপিতে লাগিল। কিছুক্ষণ সে কোন উত্তর করিতে পারিল না। পরে সে কাঁদ কাঁদ স্বরে উত্তর করিল “বাবু বলিয়া গিয়াছেন যে, তিনি তিন চারি দিন এখানে আসিবেন না।”

আ। কোথায় গিয়াছেন? 

ভৃ। আজ্ঞে আমি চাকর, সে কথা কেমন করিয়া বলিব? 

আ। কেমন করিয়া বলিবে জানি না। কোথায় গিয়াছেন, জান। 

ভৃত্য সহসা কোন উত্তর করিল না। কিছুক্ষণ পরে বলিল “ঠিক জানি না।”

আমি আরও কর্কশস্বরে জিজ্ঞাসা করিলাম “যাহা জান বল? ঠিক হউক আর নাই হউক, সে বিষয়ে তোমার কোন মন্তব্য প্রকাশ করিতে হইবে না।” 

ভৃত্য ভয়ে কাঁপিতে কাঁপিতে ভাঙ্গা ভাঙ্গা স্বরে বলিল “তিনি তাঁহার এক বন্ধুর বাড়ীতে গিয়াছেন শুনিয়াছি। সত্য মিথ্যা কিছুই জানি না।” 

আ। সেই বন্ধুর বাড়ী কোথায়? 

ভৃ। শুনিয়াছি শিবপুরে। 

আ। শিবপুরেও ত তাঁহার নিজের একটি বাগান আছে। তিনি ত সেই বাগানে যান নাই? 

ভৃ। আজ্ঞে সে কথা ত আমাদের বলেন নাই। যাহা বলিয়া গিয়াছেন, তাহাই আপনাকে জানাইয়াছি। 

আমি আর কোন কথা জিজ্ঞাসা না করিয়া একখানি গাড়ি ভাড়া করিলাম এবং তখনই কোচম্যানকে শিবপুরের দিকে যাইতে বলিলাম। সর্ব্বরঞ্জন বাবু আমার যে বিশেষ বন্ধু সে কথা পাঠক মহাশয় অবগত আছেন। তিনিই আমাকে নলিনী বাবুর শিবপুরের বাগানের কথা বলিয়াছিলেন। যখন শিবপুরে পঁহুছিলাম, তখন রাত্রি প্রায় দ্বিপ্রহর। সমস্ত প্রকৃতি নিস্তব্ধ আকাশে অৰ্দ্ধচন্দ্র ক্ষীণজ্যোতি প্রকাশ করিতেছে। মৃদুমন্দ বাতাস থাকিয়া থাকিয়া প্রবাহিত হইতেছে। এমন সময় আমি বাগানের ফটকের নিকট অগ্রসর হইলাম। দেখিলাম, দ্বার খোলা। যদি বাগানে কোন লোক না থাকিত, তাহা হইলে ফটক বন্ধ হইত। বাগানের ভিতরে প্রবেশ করিলাম। 

সম্মুখেই এক প্রকাণ্ড অট্টালিকা আমার দৃষ্টি গোচর হইল। বাড়ীখানি দ্বিতল। উপরতলার একটি ঘরে আলোক জ্বলিতেছিল, তদ্ভিন্ন সেই প্রকাণ্ড বাটী অন্ধকারময়। আমি উপরে উঠিতে যাইতেছি, এমন সময় একজন মালি আলোক হস্তে আমায় বাধা দিল। মালিকে দেখিতে হৃষ্টপুষ্ট ও বলিষ্ঠ। লোকটা অসভ্য, ভদ্রলোকের সহিত কথা কহিতে জানে না। এরূপ কর্কশ ভাবে আমার পরিচয় জিজ্ঞাসা করিল যে, আমার ভয়ানক রাগ হইল। আমি কোন উত্তর না করিয়া বাগানের মালিক নলিনীকান্ত সেখানে আছেন কি না, জিজ্ঞাসা করিলাম। সে প্রথমে কোন কথা বলিতে স্বীকার করিল না; অবশেষে অনেক তর্ক-বিতর্কের পর পথ ছাড়িয়া দিল। 

উপরে উঠিয়া দেখিলাম, সকল ঘরেরই দরজা বাহির দিকে চাবি বন্ধ। কেবল একটির ভিতর দিক হইতে বন্ধ। ভিতর দিক হইতে আবদ্ধ গৃহের দরজার সম্মুখে গিয়া সজোরে এক ধাক্কা মারিলাম। একটা ভয়ানক শব্দ হইল। ভিতর দিক হইতে শব্দ আসিল, “কে তুমি?” 

বজ্রগম্ভীর স্বরে আমি বলিলাম “শীঘ্র দরজা খোল নলিনীবাবু! তোমার চুরিবিদ্যা ধরা পড়িয়াছে। যদি ভাল চাও, শীঘ্র দরজা খোল! নতুবা এখনই দরজা ভাঙ্গিয়া ফেলিব।” আমার কণ্ঠস্বরে বোধ হয় আমার পরিচয় পাইয়াছে। ভিতর হইতে অতি ক্ষীণস্বরে উত্তর আসিল, “কিছুক্ষণ অপেক্ষা করুন, আমি দরজা খুলিয়া দিতেছি।” শীঘ্রই দরজা খুলিয়া নলিনীকান্ত বাহির হইল। আমি তখন বলিলাম “নলিনী বাবু! দেখ, তোমার জন্য আমার এই রাত্রে কত ছুটাছুটি করিতে হইয়াছে। এক নিমন্ত্রণ রক্ষা করিতে আসিয়া এত লাঞ্ছনা, কেবল তোমারই জন্য। যাহা হউক, এখন কল্যাণীকে লইয়া আইস, আমি তাহাকে সঙ্গে করিয়া লইয়া যাইব। আমাকে তুমি বেশ চেন, বেশী কথার লোক আমি নয়।” 

নলিনীকান্ত সহসা আমার পদতলে পড়িয়া দুই হস্তে আমার দুটি পা জড়াইয়া ধরিল। পরে মস্তক অবনত করিয়া আমার পদদ্বয় স্পর্শ করিল এবং তখনই এমন ভাবে আমার সম্মুখে দণ্ডায়মান হইল যে,তাহাকে তখন অপরাধী বলিয়া বোধ হইল না। 

এইরূপে দণ্ডায়মান হইয়া নলিনীকান্ত বলিল “আমার আর যতই দোষ বা পাপ থাকুক না কেন, আজ আমি কোন দোষে দোষী নহি। আমি কল্যাণীকে ভালবাসি, কল্যাণী আমাকে ভালবাসে। সেই আমার সহিত পলায়ন করিয়া আসিবার প্রস্তাব করিয়াছিল। আমি তাহাকে এই পরামর্শ দিতে সাহস করি নাই। সে স্ত্রীলোক হইয়া যখন আমার সহিত পলায়ন করিবার ইচ্ছা প্রকাশ করিল, তখন আমি তাহার প্রণয়াকাঙ্ক্ষী হইয়া, কোন্ লজ্জায় না তাহার প্রস্তাবে স্বীকৃত হইব?” 

আ। তোমাদের উভয় বংশের মধ্যে অনেকদিন হইতে বিবাদ চলিয়া আসিতেছে। তুমি কল্যাণীকে লইয়া কি করিবে? বিবাহ করিবে কি প্রকারে? 

ন। আপাতত বিবাহ করিতে পারিব না বটে কিন্তু যতদিন বিবাহ না হয়, ততদিন কল্যাণী এই বাগানে থাকিবে।

আ। মোহিনীকান্ত তোমার পরম বন্ধু, বন্ধুর উপযুক্ত কার্য্যই করিয়াছ? 

ন। সত্য সত্যই বন্ধুর কার্য্য করিয়াছি। মোহিনী কল্যাণীর প্রণয়াকাঙ্ক্ষী নহে। কল্যাণীকে বিবাহ করিতে হইবে বলিয়া সে আমার কাছে কত দুঃখ করিয়াছে। 

“বিবাহের সময় মোহিনীর মুখ দেখিয়া সে কথা বেশ বুঝিতে পারিয়াছিলাম।” আমি পুনঃ দৃঢ় ভাবে বলিলাম “যে গড়িতে আসিয়াছি, সেই গাড়িতে কল্যাণীকে লইয়া যাইব, ইহাই আমার প্রতিজ্ঞা। তবে এই পর্য্যন্ত করিতে পারি, তুমিও সেই গড়িতে সর্ব্বরঞ্জন বাবুর বাড়ীতে যাইতে পার। আমার দৃঢ়বিশ্বাস যে, সেখানে গিয়া সর্ব্বরঞ্জন বাবুর অনুমতিক্রমে তোমাদের বিবাহ দিতে পারিব।” 

নলিনীকান্ত আমার মুখের দিকে চাহিল। কিন্তু মুখে কোন কথা কহিল না। আমি বলিলাম “বোধ হয় তুমি জান যে, আমি কথায় যাহা বলি, কাজেও তাহা করি।” 

নলিনীকান্ত আর কোন কথা কহিল না; ঘরের ভিতর গিয়া তখনই কল্যাণীকে লইয়া আসিল। কল্যাণী আমাকে দেখিয়া চিনিতে পারিল এবং একবার হাসিয়া মুখ নত করিল। পরে সকলে গড়িতে উঠিল। গড়ি সর্ব্বরঞ্জনবাবুর বাটীর দিকে ছুটিল। 

কিছুদূর গমন করিলে পর, নলিনীকান্ত কহিল “মহাশয়, একটা কথা জানিবার জন্য আমার বড় ইচ্ছা হইয়াছে। আপনি কেমন করিয়া জানিতে পারিলেন যে, আমিই কল্যাণীকে এই বাগানে আনিয়াছি। অনেকক্ষণ ধরিয়া আমি এই বিষয় চিন্তা করিতেছি, কিন্তু কেমন করিয়া আপনি আমাকে চোর বলিয়া সাব্যস্ত করিলেন, তাহা বুঝিতে পারিলাম না।” 

আমি ঈষৎ হাসিয়া উত্তর করিলাম, “আমার সহিত কোনপ্রকার চাতুরী করিতে চেষ্টা করা বৃথা। তুমি মনে করিয়াছিলে, তোমার মত চতুর আর কেহ নাই। কিন্তু এখন দেখিলে তোমার ধারণা সম্পূর্ণ মিথ্যা!” 

নলিনীকান্ত নাছোড়বান্দা। সে কিছুতেই আমার কথায় শান্ত হইল না। বলিল “কি কৌশলে আপনি আমায় গ্রেপ্তার করিলেন, তাহা আমার জানিবার বড়ই ইচ্ছা হইয়াছে। আমি এই বয়সে অনেক চাতুরী করিয়াছি, কিন্তু একবারও ধরা পড়ি নাই।” 

আ। কেন না, সে সকল ব্যাপারের সন্ধানের ভার আমার হাতে পড়ে নাই। যদি আমার উপর তাহাদের সন্ধানের ভার পড়িত, তাহা হইলে তুমি তখনও নিশ্চয়ই ধরা পড়িতে। তুমি মনে করিয়াছিলে, আমি ইব্রাহিম খাঁকে চিনিতে পারি নাই, কেমন? 

ন। ইব্রাহিম খাঁ! সে আবার কে? 

আ। জান না? একজন গণৎকার বেশে নলিনীকান্ত – তুমি। 

নলিনী হাসিয়া উঠিল। বলিল “যদি তাহাই হইবে, তাহা হইলে আপনি তখন কেন আমাকে ধরিতে পারিলেন না?” 

আ। তখন ধরিলে আমার উদ্দেশ্য সফল হইত না। গণৎকার সাজিবার উদ্দেশ্য কি জানিতে পারিতাম না। যখন আমি শুনিলাম যে, তুমি সর্ব্বরঞ্জন বাবুর চক্ষে ধূলি দিয়া তাঁহার বাড়ীতে প্রবেশ করতঃ পাঁচ টাকা পুরস্কার লইয়া আসিয়াছ, তখনই তোমার উপর আমার সন্দেহ হয়। তোমার সহিত সর্ব্বরঞ্জনবাবুর বহুদিন হইতে শত্রুতা। তুমি সহজে তাঁহার বাড়ীর নিকট যাইতে পারিবে না জানিয়া, ওই প্রকার ছদ্মবেশ ধারণ করিয়াছিলে। তাহার পর যখন শুনিলাম, কল্যাণী চুরি গিয়াছে, তখনই তোমার উপর আমার সন্দেহ হয়। যখন বর মহা সমারোহে সর্ব্বরঞ্জন বাবুর বাটীতে উপস্থিত হয়, সেই সময় সমস্ত মহিলা কল্যাণীকে ত্যাগ করিয়া বর দেখিবার জন্য বহির্ব্বাটীতে আসিয়াছিল। তুমিও সেই সুযোগে কল্যাণীকে লইয়া পলায়ন করিয়াছিলে। কেমন, আমার কথা সত্য কি না? 

ন। সম্পূর্ণ সত্য। যখন কল্যাণীর হাত দেখিয়াছিলাম, সেই সময় কৌশলে তাহার হাতে একখানি পত্র দিয়াছিলাম। পত্রে ওই কথাই লেখা ছিল। মোহিনী আমার পরম বন্ধু। সে যে মহা সমারোহে কন্যার বাটিতে আসিবে, তাহা আমি বেশ জানিতাম। স্ত্রীলোকেরা বর দেখিবার জন্য বড় ব্যস্ত হইয়া থাকে, তাহা ত আমার অজ্ঞাত নহে। পত্রে ওই সময়ে খিড়কী দরজা খুলিয়া রাখিতে কল্যাণীকে অনুরোধ করিয়াছিলাম। সে আমায় আন্তরিক ভালবাসে। আমার কথা অবহেলা করে নাই। কল্যাণী যেমন খিড়কী দরজা খুলিয়া দরজা দিয়া উঁকি মারিল, অমনি আমি তাহাকে কোলে করিয়া গড়ির উপর তুলিয়া লইলাম। গড়ি বেগে ছুটিতে লাগিল এবং অল্পক্ষণের মধ্যেই বাগানে আসিয়া উপস্থিত হইল। বাগানের সর্দ্দার মালীকে আমি ইতিপূর্ব্বে সমস্ত বন্দোবস্ত ঠিক করিয়া রাখিতে বলিয়াছিলাম। আমরা বাগানে আসিয়া উপস্থিত হইলে, সে আমাদিগকে দ্বিতলের একটি ঘরে লইয়া গেল। তাহার পর আপনি সমস্তই জানেন। 

আ। তোমারও কল্যাণীর পায়ের দাগ দেখিয়া, গড়ির চাকার চিহ্ন দেখিয়া এবং অবশেষে তোমার চশমার একখানি কাচ পাইয়া তোমারই উপর আমার সন্দেহ দৃঢ়ীভূত হয়। আমি আর কোথাও চেষ্টা না করিয়া একেবারে তোমার বাড়ী গিয়া তোমার সন্ধান লই। কিন্তু সেখানে তুমি না থাকায় আমার সন্দেহ সত্যে পরিণত হইল। বাড়ীর চাকরের মুখে শুনিলাম, তুমি কিছুদিন বাড়ী ফিরিবে না। তোমার যে শিবপুরে একখানি বাগান আছে তাহা আমি জানিতাম। তখনই গড়ি ভাড়া করিয়া তোমার বাগানে আসিয়া উপস্থিত হইলাম। 

নলিনীকান্ত আশ্চৰ্য্যান্বিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল “আমার চশমার কাচ পাইয়াছেন? সত্য না কি? আমি তাহা আদৌ জানিতাম না।” 

এই বলিয়া নলিনীকান্ত তাহার চশমা বাহির করিল। দেখিল, সত্যসত্যই তাহার একখানি কাচ নাই; কোথায় খুলিয়া পড়িয়াছে। তখন সে বিরক্ত হইয়া বলিল “এই চশমাই যত অনিষ্টের মূল। ইহাকে আর নিজের কাছে রাখা উচিত হয় না।” এই বলিয়া সে চশমাখানিকে দূরে নিক্ষেপ করিল। 

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ 

যখন আমরা সর্ব্বরঞ্জন বাবুর বাড়ীতে আসিলাম, তখন সর্ব্বরঞ্জন বাবু অতি বিমর্ষভাবে বাহিরে বসিয়া ছিলেন। আমি গাড়ি হইতে একা নামিয়া তাঁহার নিকটে গমন করিলাম দেখিয়া, তিনি হতাশ হইলেন। জিজ্ঞাসা করিলেন “কি ভায়া, কল্যাণীর কোন সন্ধান পাইলে?” 

আমি তাঁহার মুখ দেখিয়া অত্যন্ত দুঃখিত হইলাম, কোন কথা গোপন করিবার ইচ্ছা হইল না, সর্ব্বরঞ্জন বাবুকে সমস্ত কথা খুলিয়া বলিলাম। 

কল্যাণীকে সঙ্গে করিয়া আনিয়াছি শুনিয়া তিনি তখনই গড়ির নিকট যাইতে উদ্যত হইলেন। কিন্তু আমি তাঁহাকে বাধা দিলাম। বলিলাম “সর্ব্বরঞ্জন বাবু! আমি যাহা বলি শুনুন। যেরূপ ব্যাপার ঘটিয়াছে, তাহাতে আপনারা সকলেই বিষম সমস্যায় পড়িয়াছেন। আমি কল্যাণীকে আনিয়াছি সত্য, কিন্তু সে মোহিনীকে বিবাহ করিতে অনিচ্ছুক। আপনার পুত্র নাই, কল্যাণীই আপনার একমাত্র সন্তান। তাহার সুখ-দুঃখের প্রতি আপনার বিশেষ দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন। সে যখন মোহিনীকে বিবাহ করিতে নারাজ, তখন জোর করিয়া তাহার সহিত কল্যাণীর বিবাহ দিলে ভবিষ্যতে উভয়েরই কষ্ট হইবে, আপনাকেও যাবজ্জীবন অনুতাপানলে দগ্ধ হইতে হইবে।” 

এই বলিয়া আমি চুপ করিলাম। সর্ব্বরঞ্জন বাবু কিছুক্ষণ কি চিন্তা করিলেন। পরে বলিলেন “আপনার অনুমান সম্পূর্ণ সত্য। কিন্তু কল্যাণীর যদি মোহিনীকে বিবাহ করিবার এতই অনিচ্ছা ছিল, তবে সে কেন পূর্ব্বে আমাকে এ সকল কথা জানায় নাই; তাহা হইলে ত কোন গোলযোগ হইত না। এখন অধিক দূর অগ্রসর হইয়াছি, কি করিয়া পশ্চাৎপদ হইব বুঝিতে পারিতেছি না। কল্যাণীর গাত্র-হরিদ্রাদি বিবাহের আনুষঙ্গিক ক্রিয়াকলাপ শেষ হইয়াছে। যদি এই লগ্নে কল্যাণীর বিবাহ না হয়, তাহা হইলে আমায় জাতিচ্যুত হইতে হইবে। বিশেষতঃ কল্যাণীর মনোমত পাত্রই বা এই রাত্রে কোথা হইতে সংগ্রহ করিব?” 

আ। সকল কথা না শুনিয়া আপনি ব্যস্ত হইতেছেন কেন? যাহাতে আপনাকে জাতিচ্যুত হইতে না হয়, তাহার উপায় আমি করিব। কল্যাণী নিজেই তাহার মনোমত পতি সংগ্রহ করিয়াছে। 

ম। কে সে পাত্ৰ? 

আ। ক্রমে বলিতেছি, ব্যস্ত হইবেন না। 

ম। তাহার বাড়ী এখান হইতে কতদূর? 

আ। অধিক দূর নহে, আপনার বাটীর নিকটেই। 

ম। নাম বলুন এখনই সেখানে সংবাদ পাঠাইতে হইবে। আর এক কথা, পাত্র বা তাহার পিতামাতা এরূপ হঠাৎ 

বিবাহে সম্মত হইবেন কেন? 

আ। পাত্রের পিতা মাতা নাই—সে নিজেই নিজের অভিভাবক। 

ম। পাত্র স্বয়ং সম্মত আছে? 

আ। উভয়ের মত না থাকিলে কি কল্যাণী এই স্থান হইতে পলায়ন করে? 

ম। তবে কি কল্যাণীকে কেহ চুরি করে নাই? সে কি স্ব-ইচ্ছায় আমার গৃহত্যাগ করিয়াছিল? 

আ। না, কল্যাণীকে কেহ চুরি করে নাই- সে নিজের ইচ্ছায় তাহার প্রণয়ীর সহিত পলায়ন করিয়াছিল। 

ম। মোহিনীর কি দশা হইবে? সে যে কল্যাণীকে না পাইলে মহা গোলযোগ করিবে। 

আ। আপনি সে বিষয়ে নিশ্চিন্ত থাকুন। মোহিনী কল্যাণীকে চেনে। যদি সে কোন গোলযোগ করিতে ইচ্ছা করিত, তাহা হইলে শুভদৃষ্টির সময়ই করিত। তখনই সে জানিতে পারিয়াছিল যে, তাহার সহিত কল্যাণীর বিবাহ হয় নাই। প্রকৃত কথা এই যে, মোহিনী যেমন আপনার কন্যাকে বিবাহ করিতে অনিচ্ছুক, কল্যাণীও তেমনি তাহাকে বিবাহ করিতে নারাজ। 

ম। কেমন করিয়া আপনি এ কথা জানিতে পারিলেন? 

আ। শুভদৃষ্টির সময় যদি বরের মুখের দিকে একবার নজর করিতেন, তাহা হইলে স্পষ্টই দেখিতে পাইতেন। পাত্র যখন বিবাহ সভায় বসিয়াছিল, তখন তাহাকে যত বিষণ্ন ও দুঃখিত দেখিয়াছিলাম, শুভদৃষ্টির পর তাহাকে তত প্রফুল্ল ও সন্তুষ্ট দেখিয়াছি। আর এক কথা, যদি তাহার কল্যাণীকে বিবাহ করিবার ইচ্ছা থাকিত, তাহা হইলে সে তখনই একটা গোলযোগ করিয়া বসিত। সে সম্বন্ধে আপনার কোন চিন্তা নাই। মোহিনী যে এই বিবাহে বিশেষ সন্তুষ্ট হইয়াছে, তাহাতে সন্দেহ করিবার কোন কারণ নাই। 

সর্ব্বরঞ্জন অনেকটা শান্ত হইলেন। বলিলেন “ভাল, একদিকের গোল মিটিল, এখন পাত্র কে বলুন?” আমি হাসিয়া বলিলাম-” সেজন্যও আপনাকে ভাবিতে হইবে না। পাত্র আমার সঙ্গেই আছে।” সর্ব্বরঞ্জন ব্যগ্র ভাবে আমার দুটি হাত ধরিলেন। বলিলেন “যদি আমার জন্য এতই করিয়াছেন, তবে দয়া করিয়া পাত্রের পরিচয় দিয়া আমার চিন্তা দূর করুন।” 

যেভাবে সর্ব্বরঞ্জন ওই কথাগুলি বলিলেন, তাহাতে আমার বড় দয়া হইল। আমি তখনই পাত্রের পরিচয় দিতে ব্যগ্র হইলাম। কিন্তু আমার সাহসে কুলাইল না। যাহাদের সহিত তিনপুরুষ ধরিয়া বিবাদ চলিতেছে, সেই বংশের বংশধরের সহিত কেমন করিয়া নিজের একমাত্র কন্যার বিবাহ দিবেন, তাহাই চিন্তা করিতে লাগিলাম। কিন্তু যখন সেই একমাত্র উপায় ভিন্ন অন্য কোন গতি নাই, তখন আমায় বাধ্য হইয়া বলিতে হইল। বিশেষতঃ নলিনীকান্তের নিকট যে প্রতিজ্ঞা করিয়াছি, তাহা পূরণের জন্য আমায় সে কথা বলিতে হইবে। এই মনে করিয়া বলিলাম “সর্ব্বরঞ্জন বাবু! পাত্রের জন্য আপনার কোন চিন্তা নেই। পাত্র আপনার সম্পূর্ণ পরিচিত—নলিনীকান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়।” 

বিনা মেঘে বজ্রাঘাত হইলে লোকে যেমন চমকিত হয়, জ্যোৎস্নাময়ী রজনীতে গমন করিতে করিতে পথিমধ্যে অজগর সর্প দেখিলে পথিক যেমন সশঙ্কিত হইয়া স্তম্ভিত হয়, নিদ্রাভঙ্গে ক্রোড়স্থ শিশুকে মৃত অবলোকন করিলে তাহার গর্ভধারিণী যেমন হতবুদ্ধি হইয়া কিংকৰ্ত্তব্য বিমূঢ় হইয়া পড়ে, আমার মুখে নলিনীর নাম শুনিয়া সর্ব্বরঞ্জন ততোধিক স্তম্ভিত ভীত ও চমকিত হইলেন। বলিলেন “কল্যাণী যদি মরিয়া যায়, তাহাতেও আমার দুঃখ নাই, কল্যাণীর জন্য যদি আমার জাতিচ্যুত হইতে হয়, সেও ভাল, কল্যাণীকে না পাইলে যদি আমাকে যাবজ্জীবন অনুতাপ করিতে হয়, তাহাও স্বীকার, তথাপি আমার শত্রুর হস্তে আমার জীবনসৰ্ব্বস্ব কল্যাণীকে উৎসর্গ করিতে পারিব না।”

আমি সর্ব্বরঞ্জনের কথায় স্তম্ভিত হইলাম। বলিলাম “সর্ব্বরঞ্জন বাবু! আপনি জ্ঞানবান হইয়া এমন মূর্খের মত কথা বলিতেছেন কেন? যাহাদের সহিত তিনপুরুষ ধরিয়া আপনাদের বিবাদ চলিতেছে, যাহাদের সহিত মোকদ্দমায় আপনারা প্রায় সর্ব্বস্বান্ত হইতে বসিয়াছেন, তাহাদের বংশধর যদি ইচ্ছা করিয়া এই বিবাহ করিতে সম্মত হয়, তবে আপনি তাহাতে বাধা দেন কেন? আপনি কিছু উপযাচক হইয়া তাহাকে কন্যা সম্প্রদান করিতে চাহিতেছেন না। পাত্র স্বয়ং ইচ্ছা করিয়া আপনার কন্যাকে বিবাহ করিতে স্বীকৃত হইয়াছে। ইহাতে আপনার ক্ষতিবৃদ্ধি কি?” 

সর্ব্বরঞ্জন বলিলেন “লোকে কি বলিবে?” 

আমি উত্তর করিলাম, – “প্রথমে অবশ্যই তাহারা নানা কথা কহিবে বটে কিন্তু ভবিষ্যতে সমস্তই মিটিয়া যাইবে। প্রায় আশি বৎসর ধরিয়া যে বিবাদ চলিতেছিল, এই বিবাহদ্বারা সেই বিবাদের নিষ্পত্তি হইবে। যে মাঠ লইয়া এতকাল লাঠালাঠি চলিতেছিল, এখন সেই মাঠে উভয় পরিবারের লোকই খেলা করিতে পাইবে। আপনার বয়স হইয়াছে, আর কতদিন এ সংসারে থাকিবেন? এখন যাহাতে আপনার কন্যা কল্যাণী সুখে থাকে তাহাই করুন।” 

আমার কথায় সর্ব্বরঞ্জন বাবু আর দ্বিরুক্তি করিলেন না। বলিলেন “তবে তাহাই হউক। ঈশ্বরের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কার্য্য করি এমন ক্ষমতা আমার নাই।” 

এই বলিয়া সর্ব্বরঞ্জন বাবু তখনই সেই গাড়ির নিকটে গেলেন এবং দরজা খুলিয়া ফেলিলেন। দেখিলেন, কল্যাণী লজ্জায় মুখ অবনত করিয়া হৃষ্টচিত্তে বসিয়া রহিয়াছে। তাহারই ঠিক সম্মুখে নলিনীকান্ত গম্ভীর ভাবে কল্যাণীর মুখের দিকে চাহিয়া রহিয়াছে। 

সর্ব্বরঞ্জন বাবুকে গড়ির দরজা খুলিতে দেখিয়া নলিনীকান্ত গড়ি হইতে অবতরণ করিল এবং ভাবী শ্বশুরের পদদ্বয় দুই হস্তে ধারণ করিয়া বলিল “আমার অপরাধ ক্ষমা করিবেন। আমি না বুঝিয়া অন্যায় কার্য্য করিয়াছি। কল্যাণী যখন আমাকে বিবাহ করিতে সম্মত হইয়াছিল, সেই সময়ে সেকথা আপনার গোচর করা আমার উচিত ছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, তখন আমার চিত্ত এত চঞ্চল ছিল যে, আমার হিতাহিতজ্ঞান পর্য্যন্ত লুপ্ত হইয়াছিল।” 

সর্ব্বরঞ্জন দুই হস্তে ভাবী জামাতাকে তুলিয়া লইলেন। বলিলেন “বাবা, আর ও সকল কথার প্রয়োজন নাই। ও সকল কথা ভুলিয়া যাও। আজ হইতে দুই পরিবারের মিলন হইল। জগদীশ্বরের নিকট প্রার্থনা করি, যেন তোমরা সুখে-স্বচ্ছন্দে জীবনযাত্রা নির্ব্বাহ করিতে পার।” 

রাত্রি নয়টার পর হইতে সমস্ত রাত্রিই লগ্ন ছিল। সুতরাং নলিনীর সহিত কল্যাণীর বিবাহ সেই রাত্রেই সম্পন্ন হইল। পুরোহিত মহাশয়গণ ইতিপূর্ব্বেই প্রস্থান করিয়াছিলেন। কিন্তু তাঁহাদিগের বাড়ী নিকটেই ছিল। সুতরাং সত্বর সেখানে সংবাদ গেল। তাঁহারাও যথাসময়ে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। 

এদিকে যখন এই বিবাহের আয়োজন হইতে লাগিল, আমি তখন মোহিনীকে বাহিরে ডাকিয়া পাঠাইলাম। মোহিনী নিকটে আসিলে জিজ্ঞাসা করিলাম “মোহিনীকান্ত! আমায় সত্য করিয়া বল দেখি, এ বিবাহে তুমি সন্তুষ্ট কি অসন্তুষ্ট হইয়াছ?” 

মোহিনী ঈষৎ হাসিল। বলিল “আপনি যদি সেকথা না জানিতেন, তাহা হইলে এ প্রশ্ন করিতেন না। কল্যাণীকে বিবাহ করিবার আমার আন্তরিক ইচ্ছা ছিল না, কেবল পিতামাতার কথায় আমি সম্মত হইয়াছিলাম। কিন্তু কে জানিত যে, ভগবান আমার আন্তরিক ইচ্ছা পূর্ণ করিবেন?” 

আমি বলিলাম “তোমার অভিভাবকগণ এখনও এ কথা অবগত নহেন। যখন তাঁহারা জানিতে পারিবেন, তখন তুমি কি বলিয়া তাঁহাদিগকে শান্ত করিবে? তাঁহারা হয়ত সর্ব্বরঞ্জন বাবুর উপর ভয়ানক রাগান্বিত হইবেন এবং তাঁহার চাতুরীর জন্য কতই নিন্দা করিবেন।” 

মো। আমি তাহার উপায় করিব। আমিও পিতামাতার একমাত্র সন্তান। আমার কথা তাঁহারা অগ্রাহ্য করিতে পারিবেন না। বিশেষতঃ যখন তাঁহারা জানিবেন যে, আমি এই বিবাহে বিশেষ সন্তুষ্ট হইয়াছি, তখন তাঁহারাও আর দ্বিরুক্তি করিবেন না। 

আ। তোমার যৌতুকের কি হইবে? গঙ্গার পিতা ধনবান নহেন। তিনি যে তোমায় যথেষ্ট যৌতুক দিতে পারিবেন, এমন বোধ হয় না। 

মোহিনী আমার কথায় চিন্তিত হইল। সে সহসা কোন উত্তর করিতে পারিল না। সৌভাগ্যক্রমে সেই সময় সর্ব্বরঞ্জন বাবু তথায় আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তিনি দূরে থাকিয়া আমাদের কথাবার্তা শুনিতেছিলেন। মোহিনীকে নীরব দেখিয়া উত্তর করিলেন “যৌতুকের জন্য কোন চিন্তা নাই। যদি তুমি তোমার পিতামাতাকে শান্ত করিতে পার, তাহা হইলে কল্যাণীর সহিত তোমার বিবাহে যে যৌতুক পাইতে, গঙ্গার সহিত বিবাহ হইলেও আমি তোমায় সেই পরিমাণেই যৌতুক দিব। গঙ্গার পিতা দরিদ্র বটে, ওই পরিমাণ যৌতুক দিবার ক্ষমতা তাহার নাই বটে, কিন্তু তোমার সে চিন্তা করিবার আবশ্যকতা নাই; আমিই সমস্ত ব্যয়ভার বহন করিব।” 

মোহিনী আন্তরিক আনন্দিত হইল। সেই রাত্রেই কল্যাণীর সহিত নলিনীকান্তের বিবাহ হইয়া গেল। 

সম্পূর্ণ 

[ অগ্রহায়ণ, ১৩১৫ ] 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *